মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_১৯(সিজন ২)

0
651

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১৯(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা

কানাডার ভোরের দৃশ্য মনমাতানো,নজরকাঁড়া। প্রচন্ডরকম শীতে ঠকঠক করছে মানুষ। তুলো তুলো বরফ ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারদিকে মোহনীয় রূপ দান করেছে৷ যতদূর তাকায় ততদূর সাদা৷ বরফে বরফে সাদা। গায়ের উপর লাল জ্যাকেট,পায়ে সাদা কেডস। মাথায় সাদা টুপি ছেলেটির পড়নে৷ একদল মৌমাছির মতো বন্ধু-বান্ধবের দল ছুটে এল তারদিকে৷ সবাই মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে৷ দেখা হয়ে যাওয়ায় হাতের সাথে হাত মিলিয়ে আবার দৌড়৷ দৌড়াতে দৌড়াতে ছেলেটির খানিকটা গরম লেগে উঠল৷ মাথার টুপিটা খুলে হাতের সাথে মুড়িয়ে ছেলেটি আবার সেই একইভাবে দৌড়াতে লাগল।
একসময় মনে হলো ফোন এসেছে। সাদা সাদা ছোট ছোট বরফের টুকরো সরিয়ে সে আবিষ্কার করল রাস্তার পাশে রাখা লোহার বিরাট একটি টুল৷ নীরবে সেখানে বসে কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিল সে৷ একঝাঁক মাথার চুল ঝাঁকিয়ে ছোট্ট ছোট্ট বরফকুচি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে বলল,

‘ মাহিদ হিয়া ‘ র। হু’জ স্পিকিং?

ওপাশ থেকে আওয়াজ এল,

‘ স্যার আ’ম ডিরুশো। ফ্রম ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি, ডিপার্টমেন্ট অফ ইংলিশ।
ডু ইউ নৌ মি স্যার ?

‘ ওহহ ইয়াহ। আই নৌউ। এভিরিথিং ইজ ওকে?

‘ ইয়াপ স্যার। এভরিথিং ইজ ওকে ৷ বাট সামওয়ান ফ্রম বেংলাডেশ হ্যাজ সেন্ট মেসেইজ টু ইউ। আই কলড ইউ টু টেল ইট। দে কান্ট কনটাক্ট ইউ। হুয়াই স্যার? এনি প্রবলেম?

ছেলেটি কিঞ্চিৎ হেসে মৃদুস্বরে বলল,

‘ আই ডোন্ট ওয়ান্ট। আই ডোন্ট নৌউ মাচ মোর। ইফ আই উইশ টু কনটাক্ট। আই উড ডু মাইসেল্ফ। ডোন্ট ওয়ারি। আই উইল ম্যানেজ৷

ডিরুশো স্বস্তি পেল৷ বলল,
‘ ওকে স্যার৷ আই থট দেয়া’ ওয়জ এ প্রবলেম। হাউএভার টেক কেয়ার। বাই।

ছেলেটি হাসল। পকেটে ফোন ডুকিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই নীল রঙের হুডি পড়া একটি মেয়ে মাথার উপর সাদা লম্বা মোরগঝুঁটির মতো টুপিটা খুলে তার পাশে এসে বসল। ছেলেটির সাথে মৃদু হাসল। ছেলেটির অভিব্যাক্তি বুঝা গেলনা৷ মেয়েটি বলল,

‘ মাহি আই উইল গো টু বাংলাদেশ উইথ ইউ৷ মাম্মা এন্ড পাপা হ্যাভ গিভেন পারমিশন। ইউ নৌ মাম্মাস বার্থপ্লেস ইন বাংলাদেশ।

ছেলেটি দুহাতের তালু একসাথে মিলিয়ে মুখের কাছে রাখল। কিছুক্ষণ পর বলল,

‘ আ’ম ইয়োর টিচার। কল মি স্যার। নট মাহি।

মেয়েটি চুপসে গেল৷ বলল,

‘ সরি মাহি। ওহ নো সরি স্যার।

ছেলেটি বলল,

‘ আ’ম নট রিটার্নিং টু বাংলাদেশ। দি কুয়েশ্চন অফ টেকিং ইউ ইজ নট কামিং জালিশা।

মেয়েটির মুখের ভঙ্গি পাল্টে গেল। হাসি-হাসি মুখ করে লাফ দিয়ে ছেলেটির পাশ ঘেষে বসে বলল

‘ সত্যি তুমি যাবে না বাংলাদেশে ? সিরিয়াসলি বলছ?

ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল৷

‘ বাংলায় শিফট করেছ? গুড।

মেয়েটি হাসল। বলল,

‘ আমি বাংলা পারি। মায়ের মাতৃভাষা মানে আমার ও মাতৃভাষা। এমনকি তোমার মুখে বাংলা ভাষা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।

ছেলেটির ভ্রু কুঞ্চন হলো। সামান্য হেসে উঠে দাঁড়িয়ে এক পা এক পা হাঁটতে হাঁটতে বলল

‘ তুমি না,,, আপনি হবে জালিশা। তুমি বারবার একই ভুল করো৷ ক্লাসে ও বারবার এই তুমি তুমি বলে আমাকে ইরিটেটিংয়ে ফেলে দাও। স্টুডেন্টরা হা করে তাকিয়ে থাকে। তোমার সবকিছু আমার পছন্দের হলে ও এই অভ্যাসটা খুব বাজে লাগে৷

মেয়েটি জিভে কামর দিল। বলল

‘ সরি। আর হবে না। আপনি৷ আপনি। আপনি। এবার ঠিক আছে???

ছেলেটি বরফের টুকরো পা দিয়ে দূরে ছুড়ে মেরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
‘ ইয়াহ। কিপ ইন মাইন্ড অলওয়েজ।

__________________

তিনদিন পর পিহুর বেস্টফ্রেন্ডের বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে সে বিজি থাকবে তাই মেডিক্যালের সব রিপোর্ট থেকে ইনফরমেশন কালেক্ট করে নোট করল পিহু। অনেকক্ষণ রিচার্স করার পর মাথায় ঝিমঝিম করতে লাগল। কফির উদ্দেশ্যে কিচেনের দিকে পা বাড়াতেই কানে এল পরীর সাথে একটি ছোট্ট বাচ্চার কন্ঠস্বর।
‘ এ ফর অ্যাপেল
বাচ্চাটি মায়ের মতো না বলে বলল,
‘ এ(A)ফর আমমা। বি(B) ফর বাবা। ছি ( c) ফর ছিকু। ডি( D) ফর ডক্টর। ই (E) ফর ইশআআ। এফ(F) ফর পিহু৷
পরী চোখ রাঙিয়ে তাকাল।

বাচ্চাটি ছেলেটি আবার বলল,
‘ এ(A) ফর আফি। বি (B) ফর বড়নানু। চি ( C) ফর চিকুভাই। ডি (D) ডক্টরভাই । ই (E) ফর ইশুবুনু। এফ ফর পিহুচুন্নি।

পরী বেত নিল হাতে। বলল,

‘ আরেকবার এসব বললে মাইর চলবে রাহি। বলো এ ফর অ্যাপেল। বি ফর বল। বলো।

রাহি চিৎকার দিল।

‘ ইশুবুনু,,, মাম্মা ছিকুকে মারে কেন? বকে কেন? মাম্মা পুঁচা কেন? ডক্টরভাই???? পাপা নাই কেন? কেউ আসেনা কেন? পিহুচুন্নি নাই কেন? আসেনা কেন? ছিকু ডাকছে কেউ আসেনা কেন?

পিহু রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে হেসে উঠল। রুমে উঁকি দিয়ে ডাক দিল

‘ ছিকুসোনা চু্ন্নি ডেকেছ কেন? তাই তো আসছিনা।

ছিকু এক লাফ দিল। পরীকে ডিঙিয়ে পিহুর কাছে ছুটে এল। হাত নেড়ে বলল,

‘ মাম্মা রেগেছে কেন?

পিহু বলল, তুমি দুষ্টুমি করছ তাই। মাম্মা খুব রেগে আছে ছিকু৷

ছিকু গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবল। বলল,

‘ রেহান কুথাইই? আসেনা কেন? মাম্মার রাগ ভাঙায় না কেন? মাম্মাকে মারেনা কেন? বকেনা কেন?

পরী বলল,
‘ কাল তোমার টিচার আসুক৷ টিচারকে দিয়ে মাইর খাওয়াবো।

রাহি হাত উপরে তুলল । বলল,
‘ টিচারকে আমি ডিসুম ডিসুম মারবো। টিচার পুঁচা কেন? টিচার আমাকে মারে কেন? বকে কেন? মাম্মা মারতে বলে কেন? পাপাকে কেউ কিছু বলেনা কেন? কেউ ছিকুকে ভালোবাসেনা কেন?

ইশা জুস নিয়ে আসল। ডাকল,
‘ ছিকুভাই কোথায়?
ছিকু খুশি হলো। ইশার কাছে ছুটে গিয়ে জুসের গ্লাস কেড়ে নিল। খেয়ে বাম হাত দিয়ে মুখে ঢলা মেরে বলল
‘ ইশুবুনু ডক্টর কুথাই? আসেনা কেন? পরীকে বকেনা কেন? রেহান কুথাই। আসেনা কেন? ছিকুকে একা ফেলে চলে গিয়েছে কেন? ছিকুকে মিস করছেনা কেন?
ইশা হেসে দিল। বলল,
‘ এত প্রশ্নের উত্তর কি করে দেব ভাই?
ছিকু বলল,
‘ কেন? দিতে পারোনা কেন?
পরী আসল। ছিকুকে কোলে তুলে নিল। ছোট টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দিল। বলল,
‘ চুপচাপ পড়ে নাও। কাল টিচার পড়া না পারলে বকবে৷
রাহি মন খারাপ করে ফেলল৷ মাথা নিচু করে বসে রইল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ রাহির পড়তে ইচ্ছে করেনা কেন? কার্টুন দেখতে ইচ্ছে করে কেন? মাম্মা বুঝেনা কেন?

পিহু,পরী আর ইশা তিনজনই মিটিমিটি হাসল রাহির কথাশুনে। পরী বলল,
‘ পড়ার সময় আদর করতে আসবেনা আমমা। একটু ও পড়তে চাইছেনা।
ইশা বলল,
‘ আদর করে করে পড়াতে হবে পরী৷ বকলে তো হবেনা।
পরী বলল, আমি কি ওকে আদর করিনা? সারাক্ষণ বকি?
ইশা বলল, রাগ করছ কেন? তুমি ওর মা,তুমি আদর করবে না এটা কখনো হয়? বরং তুমি সবার চাইতে ওকে বেশি আদর করো৷
পরী হাসল। বলল,
‘ নাহহ। ওই বাদড়টাকে আমি আদরটাদর করিনা। একদম বাপের মতো হয়েছে।
রাহি বলল,
‘ বাপ নাই কেন? আসেনা কেন? ছিকু মিস করছে বুঝেনা কেন?

____________________

সবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পিহু বেরিয়ে পড়ল তার বেস্টফ্রেন্ড নিশিতার মেহেদী সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে। একজায়গায় এসে জড়ো হলো বাকি সব বান্ধবীরা। প্রিয় বান্ধবীর বিয়ে নিয়ে কত কল্পনাজল্পনা সবার৷
নিশিতার বাড়ি পৌঁছে সবাই লেগে গেল যে যার কাজে৷ পিহু দায়িত্ব নিল,গোলাপ ফুল দিয়ে নিশিতা আর তার বরের নামটি সে নিজহাতে সাজাবে। নিচে একজন দাঁড়িয়ে পিহুকে ফুল দিচ্ছে, পিন দিচ্ছে। পিহু উঁচু চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে তার কাজ করছে। পড়নের কুর্তির ওড়নাটি ঝুলে আছে গলায়। দু তিনটা উটকো চুল চোখের সামনে এসে বারবার তাকে বিরক্ত করে চলেছে৷
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পিহু সাজাতে লাগল বান্ধবী আর বরের নাম। যেন মনে হলো নাম দুটির একটির জায়গায় মাহিদ অন্যটিতে পিহু৷
নিশিতার বাবা এসে বলল
‘ কি দরকার ছিল মা এসবের। আমি ওদেরকে বলে দিতাম। ওরা করে দিত। তোমার কত কষ্ট হচ্ছে।
পিহু হাসল। বলল, আন্কেল নিশিতা আমার খুব খুব প্রিয় বান্ধবী । তারজন্য এটুকু কোনো ব্যাপার না। আমি ভালোবেসে করছি।
নিশিতার বাবা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে চলে গেল৷ পিহু পেছনে হাত দিয়ে বলল,
‘ মিলি ফুল দে। আর একটা লাগবে শুধু।

না! মিলির কোনো সাড়াশব্দ পেলনা পিহু। পিহু বলল,
‘ তাড়াতাড়ি দে। নেমে যাবো।
পিহুর কথা শুনে একঝাঁক ছেলের মাঝখান থেকে কেউ একজন থেমে গেল। পা টিপে টিপে এসে কম্পিত হাতে একটি ফুল তুলে দিল পিহুর দিকে। পিহু আন্দাজে হাতঁড়ে ছেলেটির হাত ধরল৷ হাত বেয়ে বেয়ে ফুলটি ধরল। রাগ করে টেনে নিয়ে বলল,
‘ এত দেরি করিস কেন?
ব্যস! ফুলের কাঁটায় ছেলেটির আঙুল ছিলে গেল। আওয়াজ করে ছেলেটি দ্রুত সরে গেল। মেয়েটিকে সে দেখল না। মেয়েটির ও তাকে দেখা হলোনা৷ পিহু কালো জ্যাকেট পড়া একটি ছেলেকে আঙুল ঝেড়ে ঝেড়ে চলে যেতে দেখল৷ জিভে কামড় দিয়ে বলল,
‘ মিলি ছিলনা? ও আল্লাহ!
তাড়াতাড়ি করে চেয়ার থেকে পিহু দৌড় লাগাল ছেলেটির পিছু। বিয়ে বাড়িতে টানানো রঙবেরঙের পাতলা পর্দা সরিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সে থেমে যায় ছেলেটি যেখানে থেমেছে৷ পিহু ডেকে উঠল

‘ এক্সকিউজ মি! আঙুলটা দেখান, ব্যান্ডেজ করিয়ে দিই। শুনতে পাচ্ছেন?
ছেলেটি পিছু ফিরেনা৷ ফিরল না৷ দাঁড়িয়ে থাকল। পিহু আর একটি পর্দা সরিয়ে আর ও এক পা এগিয়ে গেল
‘ বেশি ব্যাথা পেয়েছেন?
ছেলেটি আঙুল ঝাঁড়া থামিয়ে দিল৷ পকেটে হাত পুড়ে দাঁড়িয়ে থাকল৷ পিহু এগোনোর সাহস পেলনা। দুই পা পিছু হটে দাঁড়াল।
অচেনা,অজানা ছেলেটির জন্য উৎকন্ঠিত হওয়া চেহারাটা দৃশ্যমান হলো দূরে থাকা ছোট ছোট আয়নার মতো পর্দায় থাকা গ্লাসে। ছেলেটির চোখ ও থেমে গেল সেই পর্দায়৷ ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে রইল সেদিকে। আলাদা আলাদা দেখা গেল সবকিছু। অনুতপ্ত দুটো চোখ, ঘর্মাক্ত নাক,তেলতেলে থুতনি, কাঁপাকাঁপা দুটো ঠোঁট। বেশ পরিচিত মনে হলো। একসাথে পুরো চেহারাটা দেখলে হয়ত?
না! ছেলেটি ফিরে তাকানোর আগেই মেয়েটি সেখান থেকে উধাও। ছেলেটি দু পা সামনে এসে পর্দা সরাল। দেখল নিচে পড়ে আছে একটি নূপুর। কুড়িয়ে নিল সেটি। খুব চেনা এই নূপুরটি। নিশ্চয় মানুষটি ও চেনাই হবে।

________________

নীরা রুমে এসে ফোন হাতে নিল তাড়াতাড়ি। ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই, ভেসে আসল একটি মেয়ের ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ৷ কিছু জিজ্ঞেস করলে ও মেয়েটি কিছুই বলল না। শুধু কেঁদেই গেল৷
রিপকে ধরিয়ে দিল নীরা। রিপ মেয়েটির কান্নার আওয়াজ শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল৷ কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর রিপ নিজেই ফোনটি কেটে দিল।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here