#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২০(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা
এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় নীরা অবাক। রিপকে বলল,
‘ আপনি ফোন কেন কেটে দিয়েছেন? মেয়েটি কে?
রিপ বলল, কানাডা থেকে এসেছে ফোনটা।
নীরা মুখের উপর হাত দিয়ে রাখল। বলল,
‘ হায় হায় কে মেয়েটি? আমার ভয় লাগছে ব্যারিস্টার।
রিপ নাম্বার ভালো করে দেখতে দেখতে বলল
‘ তোমার ওভার থিংকিং বন্ধ করো নীরা। সবসময় বেশি বেশি ভাবো,বেশি বেশি কথা বলো।
নীরা হেসে ফেলল। বলল,
‘ আপনি কম বলেন তাই আমি বেশি বলি৷ আপনি আমাকে কম দেখতে পারেন। আমি আপনাকে বেশি দেখতে পারি৷ তাই না?
রিপ চোখ তুলে তাকাল।
‘ ফালতু কথা বলবে না নীরা। কম দেখতে পারি মানে কি?
নীরা ভয় পেল৷ মাথা হাত একত্রে নেড়ে বলল,
‘ না না না আপনি আমায় বেশি বেশি ভালোবাসেন। বেশি বেশি দেখতে পারেন।
রিপ ফোন দিল আবার ওই নাম্বারে। ফোন কানে দিয়ে এদিকওদিক হাঁটতে হাঁটতে বলল
‘ এখন ফোন তুলছে না নীরা।
নীরার বিরক্ত লাগল। রিপের হাত থেকে ফোনটা চটপট কেড়ে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল৷ বলল,
‘ধুরর বাদ দেন তো।
রিপ নীরার এমন কান্ডে অবাক হলো। মৃদুস্বরে বলল,
‘ কি হচ্ছে নীরা?
নীরা হাসল। রিপের বুকের কাছে নাক ঘষে বলল,
‘ আজ আমার খুব খুশির দিন ব্যারিস্টার বাবু। ঈদ ঈদ লাগছে। আপনার লাগছে না?
রিপ নীরার এমন পাগলামিতে হাসল। দুহাত দিয়ে নীরাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল। বলল,
‘ ঈদের দিন এখনো আসেনি নীরা। যদি আসে সবার চাইতে খুশি আমি হবো। সেইদিনটা আদৌ আসবে কিনা আমি জানিনা।
নীরা বলল,
‘ কেন আসবে না। আসতেই হবে। আমি আপনার জন্য সেই দিনটা নিয়ে আসব। আপনাকে মন কেমন করা একটা দিন উপহার দেব।
রিপ মৃদু হাসল। বলল,
‘ নীরা দিনদিন তুমি মোটা হয়ে যাচ্ছ কেন?
নীরা রেগে গেল। রিপকে ছেড়ে নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ আপনি আমাকে এভাবে বলতে পারলেন? আমি না আপনার বাচ্চার মা?
রিপ হেসে তড়িঘড়ি করে দরজার কাছে গিয়ে বলল,
‘ এটা না বললে তুমি আমাকে কখনোই ছাড়তে না নীরা। ধরলে আর ছাড়তে চাওনা। তাই নিন্জা টেকনিক ইউজ করলাম। তুমি মুটু না। তোমার ছেলের মতে, তুমি গুলুমুলু৷ খুশি?
নীরা জোরে করে বলল, নাআআ । রিপ বলল,
‘ এই যাহহ, তো কি বললে খুশি হবে?
নীরা বলল, সুন্দর বলবেন৷ সুন্দর। সুন্দর।
রিপ হেসে দিল। বলল
‘ সুন্দর। সুন্দর। সুন্দর। তুমি খুব সুন্দর নীরা। সুন্দরী বউ আমার।
নীরা হেসে দিল। বলল,
‘ যাহহ আমার লজ্জা পায়। এভাবে বলতে বলেছি নাকি?
হাসির চোটে রিপ ঢলে পড়ার অবস্থা হলো। হাসতে হাসতে সে চলে গেল ৷ পাগল বউ তার।
__________________
সবার সাথে পিহু ও হলুদ শাড়ি পড়ল। আজ সবার সাথে তাল মিলিয়ে ইচ্ছেমত সাজল। মিলি বলল,
‘ ডাক্তারণীকে আজ চেনা যাচ্ছেনা৷
পিহু বলল, তোদের জন্য কিছু করা ও যায়না। নিশুর বিয়ে কি বারবার হবে নাকি? একবার হচ্ছে। সাজব না?
আজকের জন্য আমি শুধু নিশুর বেস্টু। ডাক্তার বাদ ৷ আর ডাক্তারদের কি সাজতে নেই?
মিলি হাসল৷ বলল,
‘ না সাজতে নেই। ডাক্তাররা সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকবে৷ রিচার্স নিয়ে, রোগীর সেবা করায় ব্যস্ত থাকবে। আচ্ছা, কাউকে পাগলটাগল বানানোর ধান্ধায় আছিস নাকি রে?
পিহু বলল,
‘ বাজে বকবি না একদম । এসব সাজ শাড়ি খুলে তোদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ডিরেক্ট বাড়ি ফিরব৷
মিলি হেসে উঠল। বলল
‘ আহা রাগিস কেন? আমি তো ইয়ার্কি করি।
পিহু মুখ গোমড়া করে রাখল৷ বলল
‘ যখন তখন ইয়ার্কি ভালো লাগেনা মিলি । এমন ইয়ার্কি আর করবি না।
নূপুর হারিয়ে যাওয়ায় পিহুর বিরক্ত লাগছে। রাগ লাগছে৷ কান্না পাচ্ছে। যখন থেকে দেখল নূপুরটা মিসিং সবকিছু উলটপালট লাগছে। এই নূপুরদুটো তার খুব খুব প্রিয়। তারমধ্যে একটি নেই। পিহু সবার অগোচরে হেঁটে হেঁটে নূপুরটি সারা বাড়ি খুঁজল। কোথাও পেলনা৷
যখন স্টেজের কাছে সবাই নিশিতাকে নিয়ে ব্যস্ত তখন পিহু নিশিতার ঘরে চলে আসল। এদিকওদিক হেঁটে সে এলোমেলো সুরে কাঁদল। নূপুরগুলো ও কি ওই মানুষটার মতো হারিয়ে গেছে? পিহুকে এই নূপুরগুলো তার মাহিদ ভাই দিয়েছিল। স্কুলের পাশে বসা মেলা থেকে৷ তা ও পিহুর জোরাজুরিতে। কিনে দিয়েছিল,আবার কথা ও শুনিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল,
‘ যাহ বাপ কিইনা দিলাম৷ তুই বাপ আমার পকেট খালি করার ধান্ধায় থাকস সারাক্ষণ। আমি তোর জামাইর পকেট খালি করুম৷ দেখিস।
পিহু সেদিন হাসতে হাসতে ঢলে পড়েছিল মাহিদের গায়ের উপর ৷ মাহিদ ধুর ধুর ছাই ছাই করে সরে গিয়ে বলেছিল,
‘ ওরেব্বাপ তুই গায়ে পড়স ক্যান ডাক্তারের বাচ্চি?
পিহুর কান্না পাচ্ছে। এখন কি হবে? এই নূপুরটা কেউ না কেউ তো পেয়েছেই৷ পিহুর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল৷ নূপুরটি খুঁজতে গিয়ে তার ধাক্কা লেগে গেল একটি ছেলের সাথে। ছেলেটি পিহুকে দেখে ভ্রুকুঞ্চন করে বলল,
‘ আরিশা তুমি এসেছ? স্যার আসবেন না?
পিহু বলল, আপনার স্যার কাল আসবেন স্যার। আপনি আজকে ও হসপিটালে গিয়েছেন?
ছেলেটি মাথা নাড়ল। পিহু বলল,
‘ আজকে আপনার বোনের গায়ে হলুদ। আর আপনি? স্যার আপনাকে এজন্যই সবাই রোবট ডাকে। এমনি এমনি ডাকেনা।
ছেলেটি বলল, ডাকুক৷ যাইহোক আজকে তোমার ক্লাস ছিল। সেটা মিস করে গিয়েছ। তোমারই ক্ষতি।
পিহু মাথায় হাত দিল। আজকে ও ক্লাসের কথা? পিহুর বিরক্তিকর মুখখানা দেখে ছেলেটি বলল,
‘ এভাবে সেজেছ কেন? এই সাজগুলোয় তোমার বিরক্তির কারণ। যা পারোনা তা করতে যাও কেন? আশ্চর্য! সবাই করবে তাই বলে তোমাকে ও করতে হবে?
পিহু চোখ বড় বড় করে তাকালো। বলল,
‘ আপনি আমায় এভাবে বললেন স্যার? আমি পারিনা কে বলেছে?, আমি সব পারি। আমি কি পারি সেটা আপনি ভাবতে ও পারছেন না।
ছেলেটি হাসল ঠোঁট এলিয়ে। বলল, গুড স্টুডেন্ট আমার। প্রাউড অফ ইউ। স্যার আমাকে বেস্ট টিচার এমনি এমনি বলেনা৷ আমি ও বেস্ট স্টুডেন্ট ক্রিয়েট করতে পারি।
পিহু বলল, আহারে। এখন সব আপনার নাম? আমার কিচ্ছু না।
ছেলেটি এবার আওয়াজ করে হেসে দিল৷ বলল, কিচ্ছু না৷
পিহু মুখ ফুলালো। ছেলেটির ডাক পড়ল মায়ের।
‘ নিনিত! তাড়াতাড়ি আয়। কোনোকাজে তাড়া নেই কেন তোর?
নিনিত বলল, আচ্ছা তুমি থাকো আমি যাই। কাজ আছে।
পিহু কিছু বলতে চাইল। সে বলার আগে নিনিত নিজেই বলে দিল পিহুর কথা,
‘ আবার ও কাজ?
পিহু হেসে উঠল৷ মাথা নাড়িয়ে বলল, যান৷ যান৷ কথা নেই আপনার সাথে। কাজ করুন৷
__________
সবার সাথে হাসিখুশিতে আনন্দে পার হলো গায়ে হলুদ৷ কিন্তু নূপুর হারানোর কথা মনে পড়তেই সব বিষাদ লাগছে পিহুর। তারপর ও মুখের উপর কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হচ্ছে পিহুর। নিনিতের একঝাঁক বন্ধু-বান্ধবের মাঝখানে খুব অগোচরে দাঁড়িয়ে কেউ একজন পিহুর সে মলিনমুখ দেখার চেষ্টা করার আগেই পিহু সরে গেল৷ পিহু যদি জানত??
বিয়ের দিন আদি আর রেহান আসল। পিহু তাদের কাছে ছুটে গেল৷ আদিকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ পাপা মাম্মারা আসবে না?
আদি হেসে বলল, না৷ তারা সবাই তোমার মামার বাসায় যাবে। রাতেই চলে আসবে৷
পিহু নাক ফুলিয়ে বলল, মামার বাসায় কেন হঠাৎ। রেহান বলল
‘ বলতে হবে কেন?
পিহু বলল,
‘ বলবে না কেন?
তিনজনই একসাথে হেসে উঠল। পিহু বলল,
‘ আমার ‘ কেন ‘ বাপকে আনতে পারোনি দাভাই ? আমার সাথে থাকত ও ।
রেহান বলল, কেন কেন বলে বলে মাথা খেয়ে নিত তোমার।
আদি বলল, সব মিষ্টির দোষ। ও দিচ্ছে না ছিকুকে।
ছিকুতো আমরা আসার আগে কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলেছে৷ প্রশ্ন করেছে
‘ কেউ ছিকুকে নিয়ে যায় না কেন? ছিকু বড় গাড়ি চালাতে জানে না কেন? ছিকু বড় হয়না কেন?
পিহু, রেহান একসাথে হেসে উঠল৷
আদিকে দেখে নিনিত ছুটে আসল। কুশলাদি বিনিময় করে বলল ‘ স্যার, ম্যাডাম, পরী আপু,রাহি ওরা কোথায়?
আদি হেসে বলল, তাদের কি দরকার? আমরা কি যথেষ্ট নই?
নিনিত বলল, না স্যার। তারপর ও?
আদি বলল
‘ ডোন্ট ওয়ারি। তোমার বিয়েতে সবাইকে আসতেই হবে। তখন আসার জন্য বলতে ও হবেনা ৷
নিনিত আর রেহান উচ্চস্বরে হাসল৷
পিহু বলল,
‘ পাপা আমি যাই?
আদি সায় দিল।
পিহু চলে গেল। নিনিত তার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে গেল আদিকে৷ নিয়াজ শেখওয়াত আর নিকিতা শেখওয়াত আদিকে দেখে বেশ খুশি হলেন। বললেন,
‘ মিঃ চৌধুরী আপনার মিসেসকে না এনে বড় ভুল করলেন। আজ বাকি কথা সেড়ে নেওয়া যেত।
আদি বলল, তাড়া নেই। সব ধীরে সুস্থে। আর মিসেস কোনো কাজের না। সে শুধু শ্রোতা হয়ে বসে থাকত। বেশ লজ্জাবতী।
সবাই একসাথে হেসে দিল আদির কথায়৷ রেহান চুপিসারে বলল
‘ চাচ্চু আমি বলে দেব কাকিয়াকে।
আদি বেশ সাহেবের মতো করে বলল,
‘ গুড জব ৷ তোমার কাকিয়ার রাগী চেহারাটা আমার বেশ পছন্দের।
রেহান হেসে বলল,
‘ তুমি সত্যি পারো চাচ্চু ৷
_________________
বরের জুতো লুকিয়ে রাখল নিশিতার বান্ধবীরা। পিহু ও বাদ যায়নি। বর অসহায় হয়ে তাকালো তার বন্ধু-বান্ধব আর নিনিতের দিকে৷ নিনিত বলল
‘ এটা কি ধরণের ইয়ার্কি? জুতো দিয়ে দাও।
সবার আড়ালে পিহু থেকে গেল৷ সবার মাঝখান থেকে পিহু বলে উঠল।
‘ আগে টাকা তারপর জুতো। নইলে নাই।
নিনিত পিহুর গলার আওয়াজ চিনল। বলল,
‘ এটা কি ধরণের ইয়ার্কি আরিশা? টাকা যা দেওয়ার দিয়েছে। আবার কেন?
পিহু এবার সামনাসামনি আসল। কোমরে হাত দিয়ে বলল
‘ যা দিয়েছে সব আপনার বন্ধুরা হাতিয়ে নিয়েছে। আমরা কিচ্ছু পাইনি৷
নিনিত চোখ বড় বড় করে বলল, আমার বন্ধুরা৷ মাথা খারাপ?
পিহু বলল, আপনার বন্ধুদের মাথা খারাপ৷ টাকা দিয়েছে আমাদের, নিয়ে নিয়েছে তারা।
অসভ্য।
নিনিত তার বন্ধুদের দিকে ফিরল। বলল,
‘ এই তোরা নিয়েছিস? দিয়ে দে। তোরা কি ওদের মতো বেকার নাকি? টাকা নিয়ে টানাটানি করছিস কেন?
নিনিতের বন্ধুরা কি বলল কে জানে পিহু রেগে বলল,
‘ আমরা বেকার? লাগবে না ওইটাকা ? আপনার শিক্ষিত বেকার বন্ধুদের নিতে বলেন।
নিনিত হাসল। বলল, বাইরে আছে সে। নিয়ে এসো।
পিহু মুখ মোচড়ালো৷ বলল,
‘ দরকার নেই।
পিহু গেল না। নিনিত বলল,
‘ তুমি কি আমার চাইতে বেশি সুন্দর? মুখ ভাঙাচ্ছ কেন?
পিহু হুট করে লজ্জায় পড়ে গেল৷ টিচারকে মুখ ভাঙিয়েছে? আল্লাহ!
লজ্জা কাটাতে পিহু বলে উঠল।
‘ অবশ্যই সুন্দর।
তারপর পরই চলে গেল দৌড়ে৷ নিনিত তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল৷ মাথা গেছে এই মেয়ের?
নিনিত গেল বাইরে। তিনচারটা বাচ্চার সাথে বল নিয়ে খেলা করা ছেলেটার কাছে গিয়ে বলল,
‘ এখানে কেন বসে আছিস? ডক্টর আদি চৌধুরী,আর রেহান চৌধুরী এসেছেন। দেখা করে আয়৷
ছেলেটি দুই হাঁটু দিয়ে বল খেলতে খেলতে জবাব দিল,
‘ দেখা করতে হচ্ছে কেন?
নিনিত ছেলেটির কথায় অবাক হলো। বলল
‘ আশ্চর্য কথা বলিস তুই। ওরা জানে তুই এখানে এসেছিস?
ছেলেটি মাথা নাড়ল। হ্যা বলল। নিনিত বলল,
‘ তাহলে তো ভালোই।
চলে যাওয়ার আগে নিনিতের আর ও একটি কথা মনে পড়ল৷ সে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
‘আচ্ছা আরিশার সাথে দেখা করিস নি? ও এখানেই আছে। টাকার জন্য ঝগড়া করছিল।
নিনিত উত্তর পেলনা৷ ছেলেটি ততক্ষণে ব্যস্ত হয়ে গেল ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর সাথে খেলায়। বাচ্চাগুলোর চেঁচামেচিতে কানেই গেলনা সেকথা।
ছেলেটি বাচ্চাগুলোর সাথে সাথে খেলতে খেলতে বলল,
‘ ওরেব্বাপ ডেঞ্জারাস বাচ্চা।
নিনিত হেসে দিল ছেলেটির কথায়। আওয়াজ করে ডেকে বলল,
‘ ভেতরে যাবি না?
ছেলেটি হাত নাড়িয়ে জবাব দিল,
‘ না। একঝাঁক মেয়ের ভেতরে আমার কি কাজ?
নিনিত আবার ও হাসল। বলল,
‘ না না তোর কোনো কাজ নেই। থাক এখানে।
ছেলেটি আবার খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷
_______________
গাড়িতে বসা অবস্থায় রাহি তার হাত আর মাথা দিয়ে পরীকে ইচ্ছেমতো মারল। ইশাকে ঠোঁট টেনে টেনে বলল
‘ রেহা’নন,, ডক্টর বিয়ে গেছে। ছিকুকে নিয়ে যায়নি কেন? পিহুচুন্নি আমাকে নিয়ে যেতে বলেনি কেন? রেহান পুঁচা কেন? ডক্টর পুঁচা কেন?
পরী হাত দিয়ে তার কপাল ঢলতে ঢলতে বলল
‘ সবাই চলে আসবে এক্ষুনি। আমমা দেখো এই ছেলেটা আমাকে কিভাবে মারছে?
ইশা কোলে নিয়ে নিল রাহিকে। বলল
‘ ছিকুসোনা আমমাকে এভাবে কেউ মারে? ব্যাথা পেয়েছে না? দেখো কাঁদছে হয়ত?
রাহি পরীকে মাথা নিচু করে দেখার চেষ্টা করল। বলল,
‘ পরী কাঁদে কেন? রেহান আসেনা কেন? পরীকে আদল করেনা কেন?
পরী চোখ লাল করে তাকাল। ইশা হেসে দিল খিক করে। ড্রাইভার ও হেসে দিল। রাহি ইশাকে দুমদাম মেরে বলল
‘ ইশুবুনু হাসে কেন? পরী রাগে কেন?
ইশা বলল,
‘ আচ্ছা ঠিকআছে হাসব না। পরী তুমি রেগোনা।
রাহি কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসল। আবার কেঁদে দিয়ে বলল,
‘ আদি পুঁচা। রেহান পুঁচা। পরী পুঁচা। ইশআআ পুঁচা। সব্বাই পুঁচা। ছিকু গুড বয়।
ইশা বলল,
‘ সব্বাই পু্ঁচা ৷ শুধু তুমি ভালো। আর কেঁদোনা।
ছিকু মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ না আমি কাঁদব।
ইশা বলল, আচ্ছা কাঁদো।
ছিকু বলল,
‘ কথা বুলবো।
ইশা বলল, কার সাথে বুলবে?
ছিকু বলল, রেহান। ডকতর।
পরী বলল, দরকার নেই। আমমা ওর কথায় কান দিওনা।
ছিকু বলল, ইশা ফোন দেয়না কেন? পরী এমন করে কেন?
ইশা বলল, আচ্ছা আচ্ছা দিচ্ছি।
ইশা ফোন দিল। রেহান ফোন ধরল। ইশা বলল
‘ রেহান ছিকুর সাথে কথা বলো।
ছিকু ইশার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিল। সাথে সাথে বলল
‘ রেহান মেরে ফেলবো। তুমি আসোনা কেন? পরীকে মারো না কেন? আদল করো না কেন? ছিকুর কাছে আসোনা কেন?
রেহান হাসির কারণে কিছু বলতে পারল না। ছিকু পরীকে বলল,
‘ আমমা রেহান হাসি দেয় কেন? কাঁদেনা কেন?
পরী বলল, আমি কি জানি?
ছিকু হাতের মুঠি দিয়ে মারল পরীকে। বলল,
‘ আমি রেহানের কাছে যাব।
রেহান ফোনের ওপাশে বলল,
‘ রেহান ডেকেছ কেন? আসব না।
রাহি জিহ্বায় কামড় দিল। বলল,
‘ পাপা ডেকেছি না? এখনো আসবে না?
রেহান বলল,
‘ না।
ছিকু বলল, কেন আসবে না? কেন? কেন?
ইশা হাসতে হাসতে মাথায় হাত দিল। বলল,
‘ কেন আর কেন? এছাড়া আর কোনো কথাই জানেনা তোমার ছেলে পরী।
পরী ফোন নিয়ে নিল। রেহানের সাথে কথা বলে কেটে দিল। রাহিকে ইশার কোল থেকে নিল৷ রাহির ছোট্ট নাকটাতে তার নাক দিয়ে দুম করে মেরে বলল,
‘ তুমি পাপাকে খুব জ্বালাচ্ছ। মাম্মাকে জ্বালাচ্ছ। সব্বাইকে জ্বালাচ্ছ। তুমি খুব পুঁচা রাহি।
ছিকু পরীর নাকে দুম করে আর ও একটু বাড়ি খেয়ে বলল
‘ রাহি পু্ঁচা কেন? রাহির মাম্মা পুঁচা কেন?
পরী হেসে দিল। রাহির গালের একপাশ তার গালের সাথে লাগিয়ে বলল,
‘ রাহি পুঁচা। রাহির মাম্মা পুঁচা।
রাহি মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ নাআ রাহি গুড বয়। রাহির মাম্মা গুড বয়। নাআ গুড গার্ল। অ্যাম আই রাইট?
পরী তার ঠোঁট রাহির গালে চেপে ধরে বলল, রাইট।
রাহি বলল, কুথাই যাচ্ছে রাহি? কেন যাচ্ছে,?
পরী বলল, নানুর বাড়ি যাচ্ছে। বেড়াতে যাচ্ছে।
রাহি সজাগ হলো৷
‘ মিহি????
ইশা হেসে দিল। রাহির গাল টেনে দিয়ে বলল,
‘ হ্যা হ্যা ওখানেই যাচ্ছি আমরা। মিহির কাছে যাচ্ছি৷
___________________
পরীরা পৌঁছানোর সাথে সাথে নীরা ফোনে কাউকে একগাদা বকাঝকা করল৷ তারপর ফোন কেটে দিয়ে রাহিকে কোলে তুলে নিল। রাহি নীরার দিকে একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল৷ বলল,
‘ ব্যারিসতারা বউ রাগে কেন?
নীরা খিক করে হেসে বলল,
‘ এমনি এমনি।
রাহি বলল, এমনি এমনি রাগে কেন?
মুনা এসে কোলে নিল রাহিকে। রাহি মুনার গাল টেনে দিয়ে বলল,
‘ সব্বাই রাহিকে কোলে নেয় কেন? অফিচম্যান আসেনা কেন? ব্যারিচতার আসেনা কেন?
সবাই হেসে গড়াগড়ি খেল রাহির কথায়। প্রায় অনেকসময় কেটে যাওয়ার পর কোথাথেকে যেন ছুটে আসে একটি ছেলে নীরার কাছে। নীরাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে রাখে প্রায় অনেকক্ষণ। সবাই সেদিকে তাকিয়ে হাসে৷ ছেলেটি নীরার গালে জোরে চুমু বসিয়ে ডাকে,
‘ মেরি মা!
নীরা যেন খুশিতে কাঁদে। কেঁদে দিয়ে বলে,
‘ আসার সাথে সাথে বন্ধুর বোনের বিয়েতে চলে যেতে হলো তোর? গেলি যে গেলি আর এলিনা৷ থেকে এলি৷
ছেলেটি মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে হাসে। বলে,
‘ মা আসতে দিচ্ছিল না। কি করব? তুমি রাগ করোনা প্লিজ। আজ তোমার হাতের রান্না খাব। তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোবো। এবার খুশি?
নীরা ছেলের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু কাটে। মুখে হাত বুলিয়ে বলে, আমার মাহি। আমার বাচ্চাটা আগের মতো কথা বলেন কেন?
______________
ভাই! !
ডাকটি শোনার সাথে সাথে পিছু ফিরে ছেলেটি। মুখ ফুটে বের হয়,দিদিয়া!
সে ধীরপায়ে হেঁটে মেয়েটিকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে উপরে তুলে ঘুরিয়ে বলল
‘ এখনো শুকনো কেন? মোটা হওনি তুমি?
পরী হাসার জন্য কথা বলতে পারল না৷ হাসতে হাসতে চোখের জল বেরিয়ে গেল। বলল, ভাই তুই কতবড় হয়ে গেছিস? আমি তোকে চিনে উঠতে পারছিনা। ও আল্লাহ!
ছেলেটি ইশার কাছে গেল৷ সালাম করে জড়িয়ে ধরে ডাকল,
‘ ডাক্তারের বউ, তোমার ডাক্তার কোথায়?
ইশা বলল, আছে। তুই কেমন আছিস?
ছেলেটি বলল,
‘ খুব খুব ভালো আছি৷ তোমরা ভালো থাকলে আমি ও ভালো।
দূর থেকে একটি চিকন কন্ঠস্বর ভেসে আসল। ‘ মিহি????
মাহিদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। লালসাদা টিশার্ট। কালো প্যান্ট। সাদা কেডস পড়া ছোট্ট বাচ্চাটির কালো চুলগুলো সামনের দিকে কয়েকটা কোঁকড়ানো। ডাগরডাগর চোখগুলো দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে মাহিদের দিকে৷
মাহিদ এক পা এক পা হেঁটে গেল। বাচ্চাটির সামনে হাঁটুগেড়ে বসে বলল,
‘ কে তুমি?
রাহি বলল
‘ আমি ছিকুভাই। আমি রাহিয়ান চুধুরী। আমি পরীর বাচ্চা। আমি রেহানের বাচ্চা। আমি,,,,,,,,
মাহিদ বলল,
‘ ধুরর শালা তোর পরিচয় দিতে কইছি বাপ। কার বাচ্চা। তোর বাপ কার বাচ্চা। তোর মা কার বাচ্চা সব জানি আমি।
রাহির রাগ হলো। সে চিল্লিয়ে বলল,
‘ এভাবে বকো কেন? আমার মাম্মাকে কোলে নিয়েছ কেন? বাপ বাপ বলো কেন?
মাহিদ হেসে ফেলল৷ রাহিকে কোলে তুলে নিল। রাহির গালে জোরে চুমু বসিয়ে বলল
‘ কেন’ র মাস্টার৷ এবার থেইকা বাপ কইবি বাপ। বল বাপ।
রাহি খিলখিল করে হাসল। বলল,
‘ বাপ বুলবো কেন? কেন বাপ কেন? মিহি দুষ্টু কেন? মিহি বাপ ডাকে কেন? আমি বাপ নয়, আমি বাচ্চা বুঝেনা কেন?
____________________
ঝুমঝুম বৃষ্টির ছাঁটে রাস্তাঘাট প্লাবিত। আকাশটা বেশ গম্ভীর। শাঁ শাঁ বাতাস বইছে অবিরত। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ। বাতাসের সাথে বৃষ্টির ফোঁটার ছিটকি এসে পড়ছে মেয়েটির মুখে। গাড়ির কাচ ভেদ করে দিয়ে মেয়েটি মুখ বের রাখল বাইরে৷ নিশিতার বাড়ি থেকে ফিরছে সে। পাশে ড্রাইভিং করা লোকটি তার বাবা।
আদি বলল,
‘ পিহু কি হচ্ছে? বাসায় ফিরছ ভিজে ভিজে। তোমার মা কি বলবে?
পিহু বলল, ‘ কিচ্ছু বলবে না পাপা।
আদি বলল, হসপিটাল থেকে তোমাকে তোমার নানুর বাসায় একা একা ফিরতে হবে। আমার কাজ আছে হসপিটালে। তোমার জন্য ছোট্ট সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে সেখানে।
পিহু বলল,
‘ আমি যেতে পারব পাপা। সারপ্রাইজ পেলে আমি খুশি হইনা পাপা । বিরক্ত হই।
আদি বলল, এটা কি ধরণের কথা? আ’ম সিউর তুমি খুব খুশি হবে সারপ্রাইজটি পেলে।
পিহু বাইরে মুখ বের করে দিল। হসপিটালের কাছাকাছি আসতেই নেমে পড়ল সে। ছাতা মেলে আদিকে বিদায় জানাল। ছাতা ঘুরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়াল রাস্তার পাশে। আদি যেতে যেতে বলল,
‘ রিকশা নাও জলদি। ভিজে গেলে জ্বর লেগে যাবে।
আদি আড়াল হতেই পিহু ছাতা সরিয়ে দিল নিজের উপর থেকে। খানিকটা ভিজে আবার ছাতা ধরল। দেখল রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। বৃষ্টি বাড়ছে। পিহু ছাতা বন্ধ করে দুহাত মেলে ভিজার চেষ্টা করল। আবার ছাতা মেলে ছাতা ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁটল। বজ্রপাতের মতো বিকট শব্দকে সে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করল। যখন ভিজে একেবারে জবজবে হয়ে গেল খুশিতে মন নেচে উঠল তার। নিজের ভেতর থাকা চাপা কষ্টগুলো যেন ধুয়ে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছে। যেতে যেতে আবার যেন পর্যায়ক্রমে নিজ জায়গায় এসে থেমে যাচ্ছে। পিহু বুঝে নিল, কষ্টগুলো তাকে ভীষণরকম ভালোবাসে। তাই তো যেতে চায়না। ঘুরে ফিরে একই জায়গায় এসে থেমে যায়।
মুখের উপর থেকে ছাতা সে তখন সরিয়ে নেয়, যখন ঝুম বৃষ্টির মাঝে বাইক নিয়ে ছুটে চলেছে একটি ছেলে। মাথায় পড়া ডার্ক ব্লু রঙের হেলমেট। বাইকটি যেতে যেতে কেন যেন পিহুর কয়েককদম আগে গিয়ে থেমে গেল। পিছু পিছু হটতে হটতে একদম এসে দাঁড়াল পিহুর সামনে। মাত্র কয়েক যোজন দূরত্ব দুজনের মাঝে৷ পিহু ছাতা নামিয়ে ফেলল। বৃষ্টিজলে ভিজে ভিজে দেখার চেষ্টা করল,চেনার চেষ্টা করল ছেলেটিকে৷ হেলমেট পড়ে থাকায় চিনতে পারল না তার খুব পরিচিত,খুব আপন মানুষটিকে। ছেলেটি পকেট থেকে বের করল একটি নূপুর। তুলে ধরল মেয়েটির সামনে। মেয়েটি কাঁপাকাঁপা হাতে নিয়ে নিল সেই নূপুর। কোনো কথা হলোনা, আলাপ হলোনা। ছেলেটি নিঃশব্দে এল। নিঃশব্দে চলে গেল। পিহু নূপুর হাতে দাঁড়িয়ে থাকল রাস্তায়। অবচেতন মনটা খুব করে চাইল,
‘ এ যদি তার মাহিদ ভাই হতো? মন কেমনের বৃষ্টিরা খুব খুশি হতো। ঠিক পিহুর মতো। হতোনা??
চলবে,,,