মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_২১(সিজন ২)

0
659

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২১(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা

বৃষ্টিজলে ভিজে ভিজে পিহু খান বাড়ি পৌঁছাল। তখন পুরোটা ভিজে গিয়েছে। কাপড় আর ওড়নায় মোঁচড় দিয়ে পানি ঝেড়ে নিল। চুলগুলো থেকে ও পানি ঝেড়ে নিল৷ মাম্মা এভাবে জবজবে ভেজা অবস্থায় দেখলে বকবে। দরজা ঠেলে ভেতরে ডুকতেই নীরা হায় হায় করে উঠল।
‘ ভিজে এ কি অবস্থা হয়েছে তোমার? ছাতা ছিল না? রিকশা নাওনি? সাথে আর কেউ আসেনি?
নীরা প্রশ্ন করেই গেল পিহুকে। পিহু চুপিসারে জিজ্ঞেস করল
‘ মাম্মা কোথায়?
নীরা বলল, আছে ছিকুকে নিয়ে। পিহু ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে বলল,
‘ আমাকে হেল্প করো ছোট মাম্মি। মাম্মা এ অবস্থায় দেখলে খুব বকবে।
নীরা বলল, কেন বকবে? ইশা তোমাকে বকলে আমি ওকে বকে দেব৷ এসো এসো। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।
পিহু চুপিসারে ডুকে পড়ল। পা টিপে টিপে নীরার রুমে চলে গেল। একদম ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরোতেই খেয়াল হলো বিপরীত পাশে বন্ধ দরজাটি আজকে খানিকটা খোলা। গত ছয়টি বছর সে যতবার এই বাড়িতে এসেছে ততবারই বন্ধ দেখেছে রুমটি৷ হয়ত মাঝেমাঝে খোলা হতো। কিন্তু পিহু সবসময় বন্ধই দেখেছে৷ আজ খোলা কেন?
তা নিয়ে বেশি ভাবার সময় পেলনা পিহু৷ ডাক এল ইশার৷ চুল থেকে ভেজা তোয়ালেটা খুলে পিহু গেল ইশার কাছে৷ চুল থেকে এখনো টপটপ পানি ঝড়ছে৷ ইশা বলল,
‘ আসার সাথে সাথে গোসল কেন? ভিজে এসেছ?
পিহু কাঁচুমাচু করে বলল ‘ না ওই আসলে…..
ইশা বলল, তোমার পাপার দোষ সব৷ তাই তোমার সাথে কোনো কথা নেই।
পিহু বলল, পাপার দোষ নেই। পাপা রিকশা নিতে বলেছিল। পাপার ইমার্জেন্সি কাজ পড়েছে,পাপার দেরি হয়ে যাচ্ছিল তাই আমাকে নামিয়ে দিয়েছিল। তুমি পাপাকে বকবে?
ইশা আড়চোখে তাকালো পিহুর দিকে। পিহু মাথা নামিয়ে ফেলল৷ বলল, সরি মাম্মা৷ আমি ইচ্ছে করে ভিজেছি,পাপার দোষ নেই। পাপা জানলে আমাকে বকবে৷ পাপাকে কিছু বলোনা প্লিজ।
ইশা কিছু বলল না।
পিহু তারমধ্যেই খেয়াল করল,তার পা দুটো পেছন থেকে আঁকড়ে ধরেছে কেউ। পরী হাতে বাটি নিয়ে দৌড়ে এসে বলল,
‘ পিহু এসেছ? ছিকুকে এদিকে আসতে দেখেছ? খাবে না বলে পালিয়েছে।
পিহু বলল,
‘ আমার পেছনে এটা কে?
ছিকু মিনমিন করে বলল,
‘ পিহু বলে দেয় কেন? মাম্মা খেতে জোর করে কেন? মিহি এখনো আসেনা কেন?
পরী দৌড়ে আসল। বলল, মিহি আসবে না। তুমি না খেলে পাপা ও আসবে না। কেউ আসবে না।
পিহু দাঁড়িয়ে থাকল। পরী বলল,
‘ পিহু ওকে এদিকে এনে দাও। আমাকে ধরিয়ে দাও। মাইর না দিলে খায়না ও।
ইশা বলল, মারতে হচ্ছে কেন? এবয়সে সব বাচ্চারা এমন করে৷ তাই বলে মারতে হবে? মাইর ছাড়া কিছু চেনোনা? এ বয়সে থাকতে তুমি ও এমন করতে। মারের কথা দূরে থাক,কেউ একটা ধমক দিলে ও মাথা ঠোকাতে ঠোকাতে শেষ।
পরীর রাগ লাগল। ছিকুকে কিছু বললেই আমমা তাকে বকে। পরী রাহিকে টেনে আনল। রাহি বলল,
‘ এভাবে টানে কেন? ব্যাথা পাইনা? মাম্মা এমন কেন? রেহান বকেন কেন? মারেনা কেন?
পরী ধমক দিল,
‘ একদম চুপপ। আরেকবার কথা বলবে মাইর পড়বে। চুপচাপ খাবে তারপর ঘুমোবে।
রাহি মাথা নাড়ল।
‘ খাবো না। মাম্মাটা পুঁচা কেন? ছিকুর খেতে ইচ্ছে করেনা কেন? ছিকুকে জোর করে খাওয়ায় কেন?
পরী ভাতের লোকমা দিয়ে দিল রাহির গালে। ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে বলল
‘ ফেললে দেখিও কি অবস্থা করি। খাও। খাও।
ছিকু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল পরীর দিকে। পরী অন্যদিকে ফিরে পানির গ্লাস হাতে নিতেই রাহি সব ফেলে দিল গাল থেকে। বলল,
‘ ইয়াকক। ছিকুর বমি পায় কেন?
পরী ঠাসস করে চড় মেরে দিল সাথে সাথে। রাহি ঢলে পড়ে গেল। ইশা আর পিহু আঁতকে উঠল। পিহু দৌড়ে গিয়ে রাহিকে কোলে তুলে বুকের সাথে চেপে ধরল৷ রাহি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। মাথাটা দিয়ে দুমাদুম মারল পিহুকে। ইশা কোলে নিয়ে নিল রাহিকে। এদিকওদিক হেঁটে শান্ত করাতে গেলে পরী এসে বলল,
‘ আমমা আমাকে দাও। একদম প্রশয় দিওনা। আজকাল চালাকি শিখেছে৷ ছুঁলে ও কেঁদে দিবে।
পরী নিয়ে নিতে চাইল রাহিকে। ইশা চড় বসাল পরীর গালে৷ দূরে দাঁড়ানো নীরা আর মুনা আঁতকে উঠল।
ইশা বলল,
‘ ও খাবেনা। তুমি গিয়ে খাও৷ ওকে খাওয়ানোর আমরা আছি৷
রাহির কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে যায়। পরী ও সাথে সাথে কেঁদে দেয়৷ আমমা তাকে মারল??
পরী বলল,
‘ ঠিক আছে তোমরা রাখো। তোমরা খাওয়াও। আমি নেই ওর কোনো কাজে৷ আমাকে যাতে আমমা না ডাকে। ও আমার ছেলে না৷ আমার ছেলেটেলে নেই৷
ইশার চোখের কোণা ঈষৎ লাল হয়ে এল৷ নীরা তাড়াতাড়ি দৌড়ে এল। পরীকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল
‘ কি করছিস ইশু? তুই ও বাচ্চা হয়ে গেলি ? মেয়েটার গায়ে হাত তুললি কেন? ওর বাচ্চা খাচ্ছেনা তাই এরকম করছে আর কি।
ইশা বলল,’ বাচ্চা শুধু সে মানুষ করছে৷ আর কেউ করেনি।
পরী কেঁদে উপরে চলে গেল। কিছুদিন আগে বড়মা ও এভাবেই তাকে চড় মেরেছে। বলেছে,
‘ তুই আমার নাতির গায়ে হাত তুলিস কোন সাহসে? তুই না থাকলে ও আমাদের কাছে ভালো থাকবে। তোকে খাওয়াতে হবেনা। পড়াতে হবেনা। তুই থাক তোর মতো৷ মাত্র এক বাচ্চার মা হয়ে এত বিরক্ত তোর?
পরী দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভীষণ রকম কাঁদল। সে কেন এমন করে কেউ বুঝতে চায়না।
‘ এ কয়দিন ধরে রাহি একদম খাবার মুখে দিতে চাইছেনা। একটুখানি দিলে গালে আঙুল ডুকিয়ে দিয়ে আবার বমি করে ফেলে দেয়। না খেয়ে না খেয়ে তুষ্টুপুষ্ট শরীরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। তারপর যখন শুকিয়ে যাবে একদম,তারপর সবাই আর ও বেশি বেশি করে বলবে,ছেলেটা ও মায়ের মতো হয়েছে। একদম শুটকি। মা খাওয়ায় না বোধহয়। তখন সব মায়ের দোষ। এদিকে খেতে জোর করলে ও মায়ের দোষ, না খাওয়ালে ও মায়ের দোষ।

ইশা হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করল রাহিকে। কিন্তু সে ঘুমোয় না। কান্না থামেনা। একবার বলে,
‘ ছিকুকে মাম্মা মারে কেন?
আবার কাঁদে।
‘ ছিকু ব্যাথা পায় বুঝেনা কেন?
আবার কাঁদে। ইশা অনেকভাবে শান্ত করার চেষ্টা করে কিন্তু তার কান্না থামেনা। বলেই যায়,
‘ ছিকু ব্যাথা পায় কেন? মাম্মা ও ব্যাথা পায় কেন? ইশু মাম্মাকে মারে কেন? ছিকু আর মাম্মা ব্যাথা পায় কেন? কাঁদে কেন?
আবোলতাবোল বকতে বকতে রাহি ঘুমিয়ে পড়ল সন্ধ্যার দিকে। পাশে পিহু ও। ইশা দুজনের গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে রুমে দরজা লাগিয়ে দিল। পরীর রুমে যেতে পারল না। দরজা বন্ধ। মুনা বলল,
‘ গায়ে হাত তুললি কেন? রাহি খাচ্ছেনা তাই একটু রাগ হয়েছে। ওর বাচ্চা।
ইশা বলল, তুমি যাও। নয়ত বড়দাকে বলিও একটু কথা বলে আসতে। নাহলে রাতে কিচ্ছু মুখে তুলবে না। যা তেজ তার।
মুনা বলল,
‘ আমি দেখছি। তারপর ও এভাবে না মারলে ও পারতি। আদরে আদরে বড় করেছি,কেউ মারলে সহ্য করতে কষ্ট হয় ৷ তোর বড়দা আর ও তোর উপর রেগে যাবে।
ইশা বলল, মারব না? ছিকুর গাল দেখেছ? লাল হয়ে গেছে গালটা। রেহান দেখলে কি বলবে? তার ছেলেকে এভাবে মেরেছে, আমরা কোথায় ছিলাম প্রশ্নটা উঠবে না? ও কেন খেতে চাইছেনা সেটা আগে জানতে হবে। জোর করলে কি ও খাবে?
মুনা বলল, আর রেগে থাকিস না। তুই মেরেছিস, তুই গিয়ে রাগ ভাঙিয়ে আয়। তোরই তো মেয়ে। যাহ।
ইশা বলে দিল, পারব না আমি। ডক্টর বলব ফোন করে ওকে কিছু বলার জন্য। আমি পারব না৷
মুনা বলল, তোরা কেউ কারো থেকে কম না। সবাই রাগ জাহির করায় ব্যস্ত থাকিস সারাক্ষণ। বুঝিনা কিছু।

____________________

বৃষ্টিতে ভিজায় পিহুর গা কাঁপিয়ে সাথে সাথেই জ্বর আসল। ঘুমের ঘোরে বিছানা হাঁতড়ে ইশাকে খুঁজতেই স্পর্শ লাগল নরম তুলতুলে একটি ছোটখাটো শরীরের সাথে। ঘুমের মাঝে ও পিহু টের পেল,
‘ ছিকুসোনা ঘুমিয়ে তারপাশে।
পিহু ছিকুকে তার বুকের উপর টেনে নিল। কোঁকড়ানো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ডাকল,
‘ আব্বা?
রাহি ঘুম ছুটে নড়তে চড়তে আওয়াজ করল,
‘ উমম। মেরেছে কেন? বুকেছে কেন? ছিকু ব্যাথা।

পিহু মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ঘুমাও। ছিকু ঘুমিয়ে পড়ল আবার। সাথে পিহু ও।
পরী ঘুমঘুম চোখ নিয়ে চলে এল পিহু আর ছিকু থাকা রুমের দরজার সামনে৷ চোখদুটো ফোলা৷ দরজায় টোকা দেওয়ার আগে ইশা চলে এলো৷ দরজা ঠেলে সে রুমে ডুকে ঘুমন্ত রাহিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল
‘ কি চাই?
পরী মুখ কালো করে ঘুমন্ত রাহির মুখের দিকে চেয়ে রইল। কানে বেজে উঠল
‘ ছিকু ব্যাথা পায় কেন?
পরী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ আমমা আমার রাহি। ওকে দাও। ঘুম আসেনা।
ইশা বলল, নেই। ও যাবেনা বলেছে তোমার কাছে। তোমাকে দেখলে কাঁদবে। রেহান আসুক। ওকে দেব। তুমি যাও৷
পরী হাতের কব্জি দিয়ে চোখ মুছল। বলল,
‘ তুমি আমাকে মেরেছ, কিন্তু আমি তোমার উপর রেগে নেই আমমা। রাহি ও আমার উপর রেগে থাকবেনা। আমি ওকে সরি বলব। দাও।
ইশা রাহিকে নিজের সাথে চেপে ধরে রাখল। বলল, দেব না। মারার আগে ভাবো নি কেন? তুমি না বলেছিলে তোমার কোনো ছেলে নেই। আবার নিতে এসেছ কেন?
পরী হাতের কব্জি দিয়ে চোখ আবার ও ঘষে নিল। বলল,
‘ আমমা রাহি আমার ছেলে। এমন কেন করছ আমমা? দাও না। ওকে ছাড়া ঘুম আসেনা।
ইশা বলল, নাআ দেব না যাও।
পরী কেঁদে দিল৷ কেঁদে দৌড়ে চলে গেল৷ ইশা হেসে রাহির কপাল থেকে চুল সরিয়ে গাঢ় চুম্বন দিয়ে বলল,
‘ ছিকুভাই দেখে এসো মাম্মা কাঁদে। ছিকুর জন্য কাঁদে। ইশু বকা দিয়েছে মাম্মাকে। ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে৷
ছিকু নড়েচড়ে উঠল। আড়মোড়া বলল,
‘ কেন কাঁদে? কেন বাপ কেন?
ইশা হেসে দিল। বাইরে কান পেতে বলল,
‘ রেহান এসেছে। যাবে না?
ছিকু চোখ বন্ধ অবস্থায় হাত নেড়ে বলল, ‘রেহানকে মাররবো।
ইশা হেসে দিল। বলল, আগে চোখ খুলো।

রেহান রুমে ডুকে হাতের ব্যাগ,আর গিটার ব্যাগটা খুলে রাখল। দেখল বউটা টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে।
রেহান জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেল। হাতের পানি নিয়ে ছুড়ে মারল পরীর দিকে৷ পরী সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠল। রেহান তার চোখ দেখে ভড়কে গেল। বলল,
‘ কি হয়েছে? মা ছেলে আবার ও মারামারি করেছেন? কে জিতেছে আপনি নাকি মাই ব্যাটা? নিশ্চয় চড় টড় মেরে আজ গাল ফাটিয়ে দিয়েছেন?
পরী কিছু বলল না। পা টিপে টিপে এসে রেহানকে জড়িয়ে ধরে তার শার্টে মুখ মুছে দিয়ে বলল,
‘ যান আপনার ব্যাটাকে নিয়ে আসুন। আমার সাথে রাগ করেছে। আমি সরি বলেছি বলুন। যান।
রেহান বলল,
‘ আরেহ বাইরে থেকে এসেছি,চেন্জ করতে হবে আমাকে। তোমার ছেলে আমাকে পেলে পেটুকের মতো সারাগালে কামড় দেওয়ার সুযোগ খুঁজে। সরো। আমাকে ফ্রেশ হতে দাও।
পরী রেগে গেল৷
‘ আমার ছেলেকে পেটুক বলবেন না। ও খাচ্ছেনা তাই আজ কত জোরে মেরেছি জানেন?
রেহান রেগে তাকালো।
‘ কিভাবে মেরেছ? ভাত খেতে চাইছেনা খাবেনা। অন্যকিছু খাওয়াবে। মারবে কেন? আশ্চর্য! তুমি যেমন তোমার ছেলে ও এমন হয়েছে আর কি? তুমি বেশি বেশি খেলে রাহি ও খেত৷ যেমন মা তেমন ছেলে। তারপরও ওকে মেরেছ। বাহঃ।
রেহান ফ্রেশ হতে চলে গেল। পরী বলল,
‘ আপনি রাগ করছেন কেন? বাবা ছেলে এত রাগ করে কেন? পরীকে কেউ বুঝেনা কেন? ছেলে ও বুঝেনা। ছেলের বাপ ও বুঝেনা। ধ্যাত।

রেহান ইশার কাছে গেল৷ রাহি রেহানকে দেখে কোলে ঝাপ দিল। গাল দেখিয়ে বলল,
‘ উফফফ।
রেহান বলল, বেশি লেগেছে?
রাহি উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, লেগেছে কেন? ব্যাথা লেগেছে কেন?
রেহান বলল, জোরে মেরেছে। তাই লেগেছে।
রাহি জিজ্ঞেস করল, রেহান ছিকুর কাছে থাকেনা কেন?
রেহান রাহির গালে জোরে চুম্বন বসিয়ে জবাব দিল, রেহানের অনেক কাজ তাই৷
রাহি প্রশ্ন করল,
‘ রেহানের এত কাজ কেন?
‘ রেহান বড় তাই।
‘ রেহান এত বড় কেন?
‘ রেহান ছিকুর বাবা তাই।
‘ রেহান ছিকুর বাবা কেন?
‘ পরীর বর তাই৷
‘ রেহান পরীর বর কেন?
‘ পরীকে বিয়ে করেছে তাই।
‘ রেহান পরীকে বিয়ে করেছে কেন?
‘ একটা ছিকু লাগত তাই।
‘ রেহানের ছিকুকে লাগে কেন?
‘ জানিনা।
‘ রেহান জানেনা কেন?
রেহান অতিষ্ঠ ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে। দিনশেষে ছেলের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টা করে সে। বাকিরা তো হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু শেষমেশ রেহান নিজে ও অবাক হয়। এ ছেলেটা এত প্রশ্ন পায় কই? পুরো একটা প্রশ্ন ব্যাংক৷ ছিকু জিজ্ঞেস করল,
‘ রেহান চুপ কেন?
‘ ছিকু পাপা ডাকেনা তাই।
‘ ছিকু পাপা ডাকেনা কেন?
‘ ছিকু দুষ্টু তাই।
‘ ছিকু দুষ্টু কেন?
রেহান রাহির পেটে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলে,
‘ ছিকুর পাপা ও দুষ্টু তাই৷
রাহি হাসতে হাসতে ঢলে পড়ল রেহানের গলায়। তারপর ও তার প্রশ্ন থামল না।
‘ ছিকুর পাপা দুষ্টু কেন???

পরী রেহানের কোলে রাহিকে দেখে দৌড়ে গেল। কেড়ে নিল রাহিকে। রাহি পরীর চুল টেনে ধরে বলল,
‘ পরী কোলে নিল কেন?
পরী বলল, আদর করার জন্য।
‘ আদর করবে কেন?
‘ আমার বাচ্চা তাই।
‘ তোমার বাচ্চা কেন?
‘ আমি জন্ম দিয়েছি তাই।
‘ তুমি জমমমো দিয়েছ কেন?
‘ তো কি পেটের ভেতর রেখে দেব? বাপের মতো ঢিলা ঢিলা কথা বলো কেন?
ছিকু হাসল। পরীর চুল শক্ত করে টেনে ধরে বলল,
‘ ছিকুর বাপ ঢিলা কেন?
পরী তাকে এলোপাতাড়ি চুমু দেয়। রেহান উত্তর দিল,
‘ ছিকুর মা ও ঢিলা তাই।
রাহি বুঝল কি বুঝল না। দাঁত দেখিলে খিলখিল করে হেসে উঠল। রেহানের চুল ধরে কাছে আনল। পরীকে কাছে টানল। দুজনের মুখ তার মুখের দুইপাশে এনে বলল,
‘ ছিকুকে কেউ আদল করেনা কেন? কেন বাপ কেন?
পরী রেহান একসাথে হেসে উঠল। দুজনই চুমু বসাল ছেলের দুইগালে। রাহি হেসে উঠল। বলল,
‘ রাহিকে সব্বাই আদল করে কেন? কোলে নেয় কেন?

_____________________

ইশা পিহুর গায়ে হাত দিয়ে দেখল জ্বর অনেক। আদিকে বলায় আদি সাথে সাথে বলল, পরী রেহান থাকুক। তুমি চটজলদি পিহুকে নিয়ে বাসায় চলে এসো। ওর ট্রিটমেন্ট দরকার।। পিহুর ধৈর্যশক্তি অনেক। সে বলল,
‘ আমি ও একজন ডক্টর মাম্মা। আমার ট্রিটমেন্ট আমি নিজেই করতে জানি। পাপাকে চিন্তা করতে বারণ করো।
আদি ফোনের ওপাশে রেগে গেল। ইশাকে কথা শুনিয়ে দিল।
‘ তোমার মেয়ে আমার কথা শুনছে না মিষ্টি। পিহুর মন খারাপ হলো। পাপা মাম্মার উপর রাগ দেখাচ্ছে?
ইশা বলল, আমি দেখছি। ড্রাইভারকে পাঠান। আমি পিহুকে নিয়ে চলে যাব।
আদি ফোন রাখল। পিহু নাক ঢলে ঢলে ঘর থেকে বের হলো। কফির উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে পা বাড়াল। বিশাল আয়োজন চলছে। কতপদ রান্না হচ্ছে তা ভাবতেই পিহুর মাথা খারাপ হলো। দাভাই আসলেই এদের এত পদ রান্নার কি দরকার বুঝে পায়না সে। দাভাই গুনে গুনে খাবার খাই।
ইশা পিহু চলে যাওয়ার বদলে রিক আদিকে চলে আসতে বলল,
‘ একদিকে মেয়েজামাই,অন্যদিকে বোনজামাই, মাহি, সবাই মিলে ভালো একটা সময় কাটবে সবার।
আদি এল। পিহুকে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ছিকু আদির কোলে উঠে বসে পড়ল একদম।
‘ ডকতর মন খারাপ কেন?
আদি বলল,
‘ পিহুর জ্বর তাই।
‘ পিহুর জ্বর কেন?
‘ বৃষ্টিতে ভিজেছে তাই।
‘ বৃষ্টিতে ভিজেছে কেন?
‘ দুষ্টু তাই।
‘ পিহুকে মারোনা কেন?
‘ পিহু বড় হয়েছে তাই।
‘ বড় হয়েছে কেন?

পিহু পুরো বাড়ি একা একা হাঁটল। আদির মুখে সে শুনেছে,
‘ তোমার মাহিদ ভাইকে দেখেছ? দেখা হয়েছে? কথা হয়েছে?
পিহু মাথা চেপে ধরল।
‘ পাপা ও জানে নাকি সে শয়নেস্বপনে মাহিদ ভাইকে দেখে। না জানলে এমন উদ্ভট প্রশ্ন করে কেন? বাসার সবাই আজ এই মাহি নামটি জপছে কেন? ছিকু ও ডাকল, মিহি?
জ্বরের ঘোরে পিহু কি ভুল শুনছে?? এলোমেলো পায়ে হেঁটে পিহু ওই কাঙ্ক্ষিত রুমটিতে চলে গেল। দরজা ঠেলে ডুকে দেখল, সাজানো গোছানো রুমটি। সেই আগের মতো এলোমেলো নেই। দেয়ালে টাঙানো বিশাল একটি ছবি। সেই ছবিটাতে ছেলেটি কে? চিনতে পারছেনা পিহু। ঝাপসা চোখ সে মুছে নিল। না এখনো চিনতে পারছেনা। কালো রঙের শার্ট, কালো জ্যাকেট পড়া হাসিমুখে ছেলেটি কে হতে পারে? পিহুর আপন কেউ? নাকি কেউ না? পিহু যতই ভাবছে মাথায় যন্ত্রণা বাড়ছে।
রিপ মামা আজ বাসায় কেন নেই? মামার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর থাকত৷ মামাকে প্রশ্ন করতে হয়না৷ সব উত্তর রেডি থাকে। আজ মামা কোথায়? এই মাহি মাহি নামটি সে আর শুনতে পারছেনা। মুখ ফুটে কাউকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছেনা?
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হলো৷ রাহি খেল টেবিলের উপর বসে সবার মাঝখানে। বলে গেল,
‘ ছিকুর হাত খেতে পারে না কেন?
রেহান উত্তর দিল
‘ ছিকুর হাত ছোট তাই।
‘ ছিকুর হাত ছোট কেন?
রিক উত্তর দিল
‘ ছিকু ছোট তাই।
‘ ছিকু ছোট কেন?
রিপ উত্তর দিল,
‘ ছিকু বাচ্চা তাই।
‘ ব্যারিচতার বড় কেন? অফিচম্যান বড় কেন? ডকতর বড় কেন? সিংগারম্যান বড় কেন? মিহি বড় কেন?
পিহু চেঁচিয়ে উঠল
‘ ছিকু বেশি কথা বলো কেন?
সবাই চুপ হয়ে গেল। রাহি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ পিহু বকে কেন? পুঁচা কেন? পিহুকে কেউ বকেনা কেন?

_________________

নীরা একদফা চেঁচামেচি শেষ হলো ফোনে। কারো উপর একনাগাড়ে রাগ ঝেড়ে ফোন রাখল। ইশা মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ এই নীরু পারে ও। দেশে ফিরেছে ছেলেটি একটু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সময় কাটাবে না? সারাক্ষণ তার পিছনে লেগে থাকবে নাকি? ও কি মেয়ে?
পিহু পিটপিট করে চোখ খুলল। ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করল,
‘ মাম্মা ও কে?
ইশা উত্তর দিল, তোমার মাহিদ ভাই। বাসায় ফিরেনি তাই তোমার ছোট মামি বকাঝকা করছে তাকে।
পিহু আবার চোখ বন্ধ করল। চট করে উঠে, সোজা হয়ে বসে পড়ল। ইশাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ মাম্মা পাপা কোথায়? আমি বাসায় যাব। এখানে থাকব না। একমুহূর্ত ও থাকব না। কোথায় পাপা?
পিহুর কান্নার আওয়াজে সবাই ছুটে এল। ইশা বলল,
‘ তোমার মামারা যেতে দেবেনা এতরাতে। আজ রাতটা থাকি,কাল সকালে চলে যাব।
পিহু বিছানা থেকে নেমে পড়ল। রিপের কাছে ছুটে গেল। রিপকে দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ মামা আমি থাকব না এখানে। চলে যাব। কখনো আসব না এখানে। মামা আমাকে দিয়ে এসো। আমি থাকব না।
রিপ তার মাথায় হাত বুলালো। বলল,
‘ আচ্ছা।
ইশা বলল,
‘ রিপদা এত রাতে?
রিপ বলল,
‘ থাকতে যখন চাইছেনা তখন জোর করে রাখবি? বেশিদূর না। আমি দিয়ে আসি। ওখানে ওর বড়মা আর বড়আব্বা আছে।
ইশা আদিকে বলল। আদি ঘুমঘুম চোখে উঠে এসে বলল
‘ তোকে কষ্ট করে আর যেতে হবেনা রিপ। আমি নিয়ে চলে যায়। জ্বরের ঘোরে এমনটা করছে। রিপ পিহুর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পিহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ সুস্থ হয়ে আবার আসবে। মামা তোমাকে দেখতে যাব। সাবধানে থেকো।
পিহু আর ও জোরে কাঁদল। কোনোমতে গাড়িতে তুলল পিহুকে। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে সে বসে রইল। ইশা আদি বাকিদের সাথে কথা বলে উঠে আসল। ঠিক গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগমুহূর্তে উল্কারগতিতে যেন ছুটে এল একটি বাইক। ঠিক পিহুর পাশে। সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল ছেলেটির দিকে। মাথা থেকে হেলমেট খুলে পাশে থাকাতেই ছেলেটি আবিষ্কার করল চোখের কোটর থেকে বেরিয়ে আসা দুটো চোখ। গাল বেয়ে পড়া নোনা জল। সে বুঝতে চাইল চোখদুটোর গভীরতা, বুঝতে চাইল গাল বেয়ে নীরবে পড়া অশ্রুর কারণ, বুঝতে চাইল মেয়েটির চোখের ভাষা। অনুভব করতে চাইল,মেয়েটির নীরব আর্তনাদ। কিন্তু পারল না। অগোচরে,নিঃশব্দে কিছু একটার কাছে সে যেন হেরে গেল।
ভ্রু উচিঁয়ে মেয়েটির কান্নার কারণ বুঝতে চাইল সে। বাইক পিছু টেনে মেয়েটিকে আর ও একবার ভালো করে দেখল। ইশাকে বলল,
‘ চলে যাচ্ছ কেন?
ইশা বলল
‘ পিহু থাকতে চাইছেনা।
ছেলেটি এবার ও মেয়েটির দিকে তাকাল। ইশাকে বলল,
‘ আচ্ছা।
পিহু সিটে পিঠ লাগাল। নিজের দুচোখ স্পষ্ট দেখল, বাউন্ডুলে,উড়নচণ্ডী কিশোরটা আজ টগবগে যুবক। কথাবার্তায় গাম্ভীর্যতায় ভরপুর। চোখের চাহনি গুলো বড্ড অচেনা। গলার স্বরটা ও বড্ড অচেনা। তাহলে কি এ তার মাহিদ ভাই নয়? এই ছেলেটাকে সে ভালোবাসেনা। সে তার মাহিদ ভাইকে ভালোবাসে। কিন্তু তার মাহিদ ভাই তো আর নেই। সেই ছয় বছর আগেই হারিয়ে গেছে। মাহিদ ভাই হারিয়ে গেছে।
গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে পিহুর মনে হলো ছেলেটি বাঁকা হাসল পিহুর দিকে তাকিয়ে৷

বাইক থেমে নেমে রিপের কাছে গেল মাহিদ৷ রিপ কিছু বলে উঠার আগেই তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল মাহিদ। রিপ খুশিতে হাসল । বলল,
‘ সারাটাদিন কোথায় ছিলি?
মাহিদ বলল, বন্ধুদের সাথে। রিপ বলল, এবার সবাইকে ভালো রাখা শিখ।
মাহিদ কিছুই বুঝল না। শুধু শুনল।

_________________

চৌধুরী বাড়ির গেইটের আগে গাড়ি থামাল রেহান। মাহিদের কোলে রাহি। রাহি প্রশ্ন করল,
‘ আমরা কুথায় যাচ্ছি?
মাহিদ বলল,
‘ শ্বশুড়বাড়ি।
‘ শ্বশুড়বাড়ি যায় কেন?
‘ বউয়ের জন্য।
রাহি খুশি হলো। জোরে হাত তালি দিয়ে বলল,
‘ ওহহ ওহহ বউ বউ। রাহির বউ৷ রাহির বউ নাই কেন?
রেহান আর পরী হেসে উঠল। মাহিদ পেট চেপে হাসল। রাহিকে নিচে নামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে ডুকে পড়ল চৌধুরী বাড়িতে। রাহি দৌড়ে গিয়ে রাইনার কোলে উঠে বলল,
‘ দাদু ছিকুর বউ নাই কেন? কেন বাপ কেন?
মাহিদ হো হো করে হেসে উঠে বলল,
‘ তোর বউ আইবো বাপ। আগে আমাগো বউ আসুক। সবুর কর বাপ।
রাহি বলল,
‘ রাহি বউ কুথাই৷ নাই কেন?
মাহিদ আরেকদফা হাসল। হাসতে হাসতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তার হাসির আওয়াজে পালানো মেয়েটি পালাতে পারল না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল৷ মাহিদ হাসতে হাসতে তাকাল তার পাশে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো মেয়েটিকে । হাসি থামল একটু একটু করে। মেয়েটি চোখতুলে তাকালো তার দিকে। সে ও তাকালো৷
কাটল সময় অনেকক্ষণ।
ফুরোলো কয়েক সেকেন্ড, মিনিট,ক্ষন।
তারপর ও আনাগোনা হলোনা হৃদয়মন।

চলবে,
গঠনমূলক মন্তব্য চাই,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here