মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_২৪(সিজন ২)

1
659

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৪(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ভেজা শার্ট আর কপালে মোড়ানো ব্যান্ডেজ, নিস্তেজ চোখদুটো দেখে নীরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল৷ কিন্তু যার জন্য কাঁদল সে নির্লিপ্ত কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ কাঁদছ কেন মা? মাথা খারাপ করিও না তো। সিরিয়াস কিছু হয়নি।
নীরার কান্নাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে
মাহিদ ঘরে ডুকে গায়ের শার্টটি খুলে ছুড়ে মারল দূরে। নীরা পিছু পিছু দৌড়ে গেল৷ দেখল মাহিদের হাতের বাহুতে ছিলে গিয়ে খয়েরী রঙ ধারণ করেছে। নীরা শার্টটি কুড়িয়ে নিয়ে চোখের সামনে ধরল৷ রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখে আবার ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,
‘ এত রক্ত ঝড়েছে কি করে? এগুলো তোর রক্ত? মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছিস? কোথায় আঘাত পেয়েছিস? কিছুতো বল। এই মাহি? কথা বলছিস না কেন? মাহি? তুই অ্যাক্সিডেন্ট করেছিস? বাইক কোথায়? তোর এই অবস্থা কখন হলো?

মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।

নীরা বলল,
‘ মেরে ফেল আমায়। তারপর তুই যা ইচ্ছে তাই কর৷ এভাবে কি দেখছিস?

মাহিদ সেন্টার টেবিলে জোরে লাতি বসালো। বলল,
‘ চুপ করতে বলেছি মা৷

নীরা চেঁচিয়ে উঠল।
‘ কেন চুপ করব? তুই বড় গলায় কার সাথে কথা বলছিস? তোর বাপকে ডাকব?
মাহিদ বেশ বিরক্ত হলো। শাওয়ার নিতে চলে গেল নীরাকে উপেক্ষা করে৷ মুখে পানির ঝাপটা দিল ঘনঘন। অবিরত পানির ঝাপটা দেওয়ার পরে যখন তাকালো আয়নায় নিজের জ্বলজ্বল করা চোখের লাল কোণা দেখে নিজেই ভড়কে গেল সে।
নীরার অবিরত চেঁচামেচি কানে এল তার। মাথার যন্ত্রণা বাড়তে লাগল ক্রমশ।

________________

হসপিটালের করিডোরে লোহার লম্বা বেঞ্চে বসা মেয়েটির ঘনঘন নাক টানার আওয়াজে কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁপিয়ে উঠল নিনিত। নিজে নিজে বসে কপালের পাশে ব্যান্ডেজ করল মেয়েটি৷ নিনিতের হেল্প নিল না। নিনিত আবার বলল,
‘ কেন কাঁদছ আরিশা? আমি স্যারকে ডাকব?
পিহু উচ্চস্বরে বলল,
‘ নাহহহ।
নিনিত বলল,
‘ তো কি করব? মাহিদের জন্য কাঁদছ?
পিহু উত্তর দিল না। নিনিত বলল,
‘ ওকে আমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। প্রেসক্রিপশন ও দিয়েছি। চিন্তা করো না।
পিহুর গুনগুনিয়ে কান্না বন্ধ হলোনা। নিনিত বলল,
‘ গালের পাশে লাল হয়ে গিয়েছে কেন?
পিহু উত্তর না দিয়ে গালে হাত দিয়ে আবার কেঁদে উঠল। নিনিত বলল,
‘ আবার কাঁদছ আরিশা? আচ্ছা কি হয়েছে বলবে? মাহিদের অ্যাক্সিডেন্ট কি করে হলো? এত রক্ত ঝড়েছে ওর, আর তুমি ওকে ব্যান্ডেজ না করিয়ে,রক্তক্ষরণ বন্ধ না করে কাঁদছিলে। একজন সাধারণ মানুষকে এসব শোভা পায়। তোমার মতো মেডিক্যালের স্টুডেন্টকে না৷
পিহু আর ও জোরে ফুঁপিয়ে উঠল। নিনিত বলল,
‘ সময়মতো আমি না পৌঁছালে কি হতো? তুমি কাঁদতে পেরেছ কিন্তু ব্যান্ডেজ করাতে পারছিলে না। তাই না?
পিহু নাক চোখ মুছে বলল,
‘ আমার কোনোকথাই শুনছিল না। আমার হাতে ব্যান্ডেজ করাবেনা বলেছে।
নিনিত কপালের ঘাম মুছল। বলল,
‘ ও তোমার কথা শুনেনি, তুমি ও ওর কথা শুনবে না। ব্যস। ও একটা গাধা, ও তো বলবেই ব্যান্ডেজ করাবেনা ৷ আমাকে ও তো করাতে দিচ্ছিল না। জোর করে করিয়েছি।
পিহু হাতের কব্জি দিয়ে চোখ মুছল। নিনিত বলল,
‘ চলো বাসায় পৌঁছে দেই। ভেজা কাপড়ে বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
পিহু নড়ল না। নিনিত গলার আওয়াজ খানিকটা বড় করে বলল,
‘ যাবে?
পিহু নড়েচড়ে বসল। বলল,
‘ হুমম। একা যেতে পারব।
নিনিত মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ হ্যা যাও। নইলে স্যারকে ডেকে আনছি৷
পিহু উঠে দাঁড়ালো। বলল,
‘ আমি আপনার স্যারের কাছে যাচ্ছি।
নিনিত হেসে উঠল। বলল,
‘ আচ্ছা যাও৷
পিহু ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো ঠিক। কিন্তু পা বাড়াল হসপিটালের বাইরে। নিনিত পিছু ডাকল
‘ স্যারের কাছে যাচ্ছ না?
পিহু রেগে তাকালো। নিনিত হাসল। বলল,
‘ আচ্ছা আচ্ছা চুপ হয়ে গেলাম৷ যাও৷

_________________

সোফার পেছনে গুটিসুটি মেরে বসে থাকল রাহি। সোফার পেছনে পিঠ লাগিয়ে বসে বিড়বিড় করে বলল,
‘ ছিকুর খিদে পাইনা কেন? পরী শুধু খেতে বলে কেন? ছিকুর বমি পায় কেন?
পরী পা টিপে টিপে হাঁটল। ছিকুর বিড়বিড় করে বলা কথা শুনল। একেবারে ছিকুর সামনে গিয়ে বলল,
‘ ধরে ফেলেছি। এবার পালাবে কোথায়?
ছিকু সোফার সাথে লেগে গেল। বলল,
‘ উফপপপ। ছিকুকে জ্বালাচ্ছ কেন? ছিকুর রাগ লাগে কেন? ছিকুর খেতে ইচ্ছে করেনা কেন?
পরী হেসে দিল। ছিকুর দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ না খেলে পরী ছিকুর সাথে আর কথা বলবেনা।
ছিকু ঠোঁট ফুলালো৷ বলল,
‘ পরী এমন কেন? বাচ্চার সাথে ফাইট করে কেন? ছিকুর দুক্কু লাগে কেন?
পরী বলল,
‘ পরীর বাচ্চাটা দুষ্টু কেন? পরীর দুক্কু লাগে কেন?
রাহি উঠে দাঁড়াল। দৌড়ে আফির পা দুটো আঁকড়ে ধরে বলল,
‘ আফিভাই ছিকুভাইকে কোলে নাওনা কেন?
আফি তাকে কোলে নিয়ে নিল। পরী দৌড়ে এসে বলল,
‘ বড়পাপা ওকে ধরে রাখো।
ছিকু আফির গলায় মুখ গুজল। বলল,
‘ না না খাবেনা। ছিকু খাবেনা। ছিকুর খেতে মন চায় না কেন? পরী বুঝেনা কেন? পরী ছিকুর সাথে ফাইট করে কেন?
পরী জোর করে তাকে কোলে নিয়ে নিল। তারপর সোফায় বসিয়ে দিয়ে জোর করে করে ভাত খাওয়ালো। চেপেছিপে খাওয়ালো। ছিকু কেঁদে কেঁটে সাগর বানালো। আফি বলল,
‘ জোর করে কি খাওয়ানো যায়।
পরী ধমক দিল,
‘ খাওয়ানো যায়। তোমরা একদম চুপ থাকবে। আমি আর আমার ছেলের মাঝখানে একদম আসবেনা৷
রাহি গালে ভাত থাকা অবস্থায় ভ্যা ভ্যা করে বলল,
‘ ছিকু পরীর বাচ্চা নয়। ছিকু পরীর বাচ্চা কেন? ছিকু রেহানের বাচ্চা নয় কেন?
পরী আর ও জোরে ধমক দিল।
‘ তুমি পরীর বাচ্চা। রেহানের নয়।
রাহি কাঁদল৷ পরী আবার ও খাইয়ে দিল। রাহি কেঁদে কেঁদে খেল।
পরী বলল, মাইর পড়লে তোমার বাপ ও খাবে৷
ছিকু কেঁদে কেঁদে বলল,
‘ ছিকুর বাপ খাবে কেন? ছিকু খাবেনা কেন?
পরী হাসল। বলল, না না ছিকুর বাপ খাবেনা। ছিকু খাবে। বেশি বেশি খাবে।
পরী রাহিকে পানি খাইয়ে দিল। রাহি সোফা থেকে নেমে দূরে চলে গেল। আফির পেছনে গিয়ে গালের ভেতর আঙুল ডুকিয়ে দিল। যা খেল তা গড়গড় গড়গড় করে বমি করে দিল। পরী চোখ লাল করে তাকিয়ে থাকল। রাহি পরীকে দেখামাত্রই কেঁদে দিয়ে বলে,
‘ পরী ছিকুকে মারবে কেন? এভাবে তাকায় কেন? ছিকুর বমি পায় কেন?
পরী কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ইশা আসল। তাকে চিন্তিত দেখে পরী জানতে চাইল,
‘ কি হয়েছে আম্মা?
ইশা বলল,
‘ মাহি নাকি এক্সিডেন্ট করেছে?
পরী জানতে চাইল।
‘ কখন? কোথায়?
ইশা বলল,
‘ পিহু নাকি এসেছে। দাঁড়াও ওকে জিজ্ঞেস করি।
ইশা আর পরী বাইরে গেল৷ পিহু তাদের দুজনকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে। এভাবে কি দেখছ?
পরী বলল,
‘ মাহির কি হয়েছে? ও কোথায় এখন? তোমার এই অবস্থা কেন? কপালে কি হয়েছে?
পিহু কপালে হাতটা ছুঁয়ে বলল,
‘ কিছু হয়নি তো।
ইশা চাপা কন্ঠে বলল,
‘ সোজাসাপটা বলো কি হয়েছে। ভনিতা পছন্দ না পিহু৷ তুমি আজকাল অবাধ্য চলছ।
পিহুর দুচোখ টলমলে করে উঠল। ইশার দিকে তাকিয়ে থাকল চুপ করে৷ টপ করে দুফোটা জল ও গড়াল৷
ইশা হা করে তাকিয়ে থাকল৷ বলল,
‘ কি এমন বলেছি? কাঁদছ কেন? পিহু??
পিহু চলে গেল৷ পরী বলল
‘ আব্বাকে ফোন দাও। আব্বা বলতে পারবে। নয়ত ছোটমাকে ফোন দাও। মাহি কোথায় আছে এখন বলতে পারবে।
ইশা ফোন দিল আদিকে। আদি কিছু বলতে পারল না। সে এসব কিছু জানেই না। ইশা নীরাকে ফোন দিল। ওপাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠ ভেসে এল।
ইশা বলল,
‘ মাহি বলছিস? মাহি?
ওপাশ থেকে ছেলেটি রাশভারি কন্ঠে বলল,
‘ হ্যা৷ কি হয়েছে? মাকে খুঁজছ?
ইশা বলল,
‘ কি হয়েছে তোর? এক্সিডেন্ট করেছিস নাকি? নিনিত জানাল আমায়।
মাহিদ উত্তর দিল,
‘ কিছুই হয়নি। মাহিদের কিছু হয়না।
ইশা বলল,
‘ কম কথা বল। কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস সেটা বল আগে। বেশি আঘাত লেগেছে? ঔষধ নিয়েছিস?
মাহিদ বলল,
‘ কিছু হয়নি বাপের বইন। বুঝোনা ক্যান? আমি বাইক এক্সিডেন্ট করুম? মাথা খারাপ? বাইক আমার কথামতো চলে৷
ইশা হাসল। বলল,
‘ বাবারে বাবা, তুই তো সবকিছুতে মাস্টার। তোর সাথে আর কি কথা বলব?
মাহিদ বলল, রাখো, রাখো। ঘুমাচ্ছি। ব্যারিস্টারের বউ ফোন রাইখা গেল কই? আমার কানের উপর ফোন রাইখা চইলা গেছে। এটা ভংভং করে আমার কান খাইয়া ফেলতাছে। আমার ঘুমডা নষ্ট করলো।
ইশা ফোন রেখে দিল। বলল,
‘ পিহুর কপালে কি করে আঘাত লাগল?
ইশা আবার ফোন দিল মাহিদকে। মাহিদ ফোন তুলল,
‘ কিতা হইছে বাপ? আবার দিলা ক্যান?
ইশা হেসে বলল,
‘ ওই মানে, ওই পিহুর কথা বলছিলাম। ও কোথায় ব্যাথা পেয়েছি জানিস? কি করে কপালে ব্যাথা পেল?
মাহিদ নির্লিপ্ত কন্ঠে হাই হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘ কে পিহু? আমি চিনিনা এমন কাউকে। কার কথা বলছ? রাখছি এখন। পরে কথা বলব।
ইশা ফোন রেখে দিল। পরীকে বলল,
‘ মাহির সাথে পিহুর এখনো ঝগড়া হয়?
পরী বলল,
‘ আমি তো দেখিনি। ঝগড়া করতে ও দেখিনি।
ইশা যেতে যেতে বলল,
‘ এখন বড় হয়েছে। এখন এসব এমনিতে ও শোভা পায়না।

____________________

রিপ বাড়িতে এসে মাহিদের অবস্থা দেখে ভড়কে গেল। গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে তার। জ্বরের ঘোরে চুপটি মেরে শুয়ে আছে বিছানায়। চোখদুটো লাল হয়েছে অসম্ভব। চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে রয়েছে। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব ও তাকে দেখতে এল। রিপ এসে তার পাশে বসার সাথে সাথে মাহিদ উঠে বসল। রিপ বলল,
‘ উঠার দরকার নেই। পরী ফোন করেছে,তোকে একটু যেতে বলেছে। সেটা বলতে এসেছি।
মাহিদ বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করল। রিপ বারণ করল৷ বলল,
‘ এত জ্বর নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। তোর দিদিয়াকে ফোন দিয়ে বলে দে কাল যাবি। নয়ত পরশু।
মাহিদ বলল,
‘ আজ গেলে কি হবে?
রিপ বলল,
‘ যত কম যাবি ততই মঙ্গল। পিহুর বিয়ের আগে কম যাওয়ার চেষ্টা কর৷ বিয়েটা হয়ে যাক তারপর ইচ্ছেমত যাস।
মাহিদ অবাক হলো।
‘ বিয়ের আগে গেলে কি সমস্যা? বিয়ের সাথে আমার কি?
রিপ চাপা মেজাজ দেখিয়ে বলল,
‘ তোর সমস্যা না হলে ও অন্য কারো সমস্যা হতে পারে। বুঝিস না যখন বুঝার চেষ্টা ও করিস না। এই তোরা কখনো কিছু বুঝবি ও না৷
রিপ চলে গেল। মাহিদ আবার ধপ করে শুয়ে পড়ল।
ঠিকআছে যাবে না। যাবিনা, বললেই তো হয়। এতকথা শুনালো কেন বাপ ? খ্যাঁকখ্যাঁক মার্কা বাপ তার ?
মাহিদ শুয়ে পড়ল আবার। জ্বর বাড়ল ক্রমশ। নীরা জলপট্টি দিতে দিতে চোখ মুছল। রিপ এসে পাশে বসে থাকল অনেক্ক্ষণ। মাথায় হাত বুলালো।

রাত দশটা না সাড়ে নয়টা দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে রিপ সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। ধীরপায়ে হেঁটে দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে সাথে অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হলো। এমন ঝড়বাদলের রাতে এই মেয়েটি এখানে কেন? রিপের ভ্রু কুঞ্চন হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ পিহু তুমি এসময় এখানে?
মেয়েটি হুড়মুড় করে ঘরে ডুকে বলল,
‘ মামা এক্ষুনি চলে যাব। বাসার কাউকে জানিয়ে অনেক কষ্ট করে এসেছি। এক্ষুনি চলে যাব।
রিপ জানতে চাইল।
‘ কেন এসেছ?
পিহু এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,
‘ মাহিদ ভাই। মাহিদ ভাইকে দেখতে এসেছি। দেখেই চলে যাব। মাহিদ ভাই নাকি বেশি অসুস্থ?
নীরা এল সাথে মুনা ও। রিপ বলল,
‘ উপরে ওর রুমে আছে। তাড়াতাড়ি এসো।
পিহু মাথা নাড়িয়ে সাথে সাথে উপরে যাওয়ার জন্য পা বাঁড়াল। নীরা বলল,
‘ ও মা পিহু তার মাহিদ ভাইকে কত দেখতে পারে? ওরেবাবা।
রিপ ধমক দিল৷
‘ চুপ। একদম চুপ নীরা৷ বেশি কথা বলো তুমি৷
নীরা চুপ হয়ে গেল। মুনা হেসে দিল। বলল,
‘ তোরা ও পারিস।

__________________

নিঃশব্দে মৃদুমৃদু আলোকিত রুমটাতে ডুকে পড়ল পিহু। হাতের কাগজটি নিয়ে পা টিপে টিপে ঘরে ডুকল সে৷ কাঁথা জড়িয়ে আলুথালু হয়ে ঘুমানো ছেলেটির কাছে যেতেই শুকনো ঢোক গিলল পিহু। কপালের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে ছেলেটি। ক্ষতস্থানের আশেপাশে শুকনো রক্ত লেগে আছে। পিহু কপালটা ছুঁতে গিয়ে ছুঁল না৷ দাঁড়িয়ে থাকল বেশকিছুক্ষণ। জানালার কাচ ভেদ করে বাতাসের ঝাপটা আসছে। পিহু দৌড়ে গেল জানালার কাছে। কাচ বন্ধ করতে গিয়ে আটকা পড়ল ছেলেটির কথায়। ছেলেটি গায়ে কাঁথা টানতে টানতে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
‘ মা জানালা বন্ধ করিওনা।
পিহু থমকে গেল৷ জানালা বন্ধ করল না। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে ছেলেটির মাথার কাছে গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসল। প্রায় অনেক্ক্ষণ সময় কেটে যাওয়ার পর পিহু টের পেল ছেলেটির নিঃশ্বাসের আওয়াজ৷ ঘুমের দেশে তলিয়ে যাওয়ার সংকেত৷ পিহুর রাগ লাগল। এই ছেলেটার এখন ঘুমিয়ে যেতে হলো? সে কেন এল?
পিহু ব্যাগ থেকে ফার্স্ট এইডবক্স বের করে কপালে হাত দিতেই টের পেল ছেলেটির শরীর অত্যধিক গরম৷ তার কপালে ভাঁজ পড়ল। কপালে ভালো করে হসত দিয়ে দেখল কপালটা উত্তপ্ত। পিহু নীরাকে ডাকল। নীরা বলল,
‘ তুমি তো ডাক্তার। নাও সেবা করো৷ ডাক্তার কি ডাকব? আমার ছেলেটার এত জ্বর কেমনে আসল?
পিহু বলল,
‘ আমি আছি। আর ডক্টর ডাকতে হবেনা। লাগলে পাপাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে নেব।
নীরা মাথা দুলালো। ছেলের কপালে গালে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ আমার মাহি অসুস্থ, আমার কিছু ভালোলাগেনা। আমার বাচ্চাটা হুট করে অসুস্থ হয়ে গেল। ও বকবক না করলে আমার ভালোলাগেনা।
পিহু বলল,
‘ চিন্তা করোনা মামি৷ তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি আছি। চিন্তার কিছু নেই। আমি মেডিসিন নিয়ে এসেছি৷ মাহিদ ভাইয়ের ঘুম ভাঙলে খাইয়ে দেব যদি জ্বর না কমে।
নীরা মাথা নাড়িয়ে পিহুর গালে হাত বুলিয়ে চলে গেল।
পিহু ঘুমন্ত ছেলেটির মুখের সামনে গিয়ে বসল। ধীরেসুস্থে ব্যান্ডেজ করাতে করাতে ডাকে,
‘ মাহিদ ভাই এত ঘুমাও ক্যান বাপ? আমি আইছি না?
ছেলেটি নড়েচড়ে আর আয়েশ করে ঘুমিয়ে পড়ল৷ পিহু ডাকল,
‘ মাহিদ ভাই?
ছেলেটি শুনল না। উঠল না। পিহু ডেকে গেল,
‘ মাহিদ ভাই? মাহিদ ভাই? মাহিদ ভাই এই মাহিদ ভাই? জাতির ভাই উঠোনা ক্যান বাপ? আমার কান্না পাচ্ছে। উঠো। মারো। তা ও উঠো। ভাল্লাগেনা।
মাহিদ আর ও নড়েচড়ে ঘুমোলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে ততক্ষণে। পিহু কাঁথা সরিয়ে দিল। ডাকল,
‘ মাহিদ ভাই? আমি কি চলে যাব? উফ উঠো না। আমাকে মেরেছ তাই সরি বলো। আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সরি বলার জন্য আর কখনোও আসব না। তোমাকে জ্বালাবো না । তুমি তখন আমার গায়ে হাত তুলতে পারবে না। আমাকে মারলে আমার বর তোমাক মারবে। তখন কি তোমার কষ্ট হবে? এই মাহিদ ভাই উঠো না? উঠবেনা? মাহিদ ভাই। এই মাহিদ ভাই?
মাহিদ বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। পিহু তার চুলে বিলি কাটল। মাহিদের হাতটা তুলে নিজের গালে ছোঁয়ালো। বলল,
‘ মাহিদ ভাই তুমি আমাকে,,,, আমাকে এখানে মেরেছ। তুমি জানো ছয়টা বছর আমি এই মারগুলোকে কতটা মিস করেছি। জানোনা তুমি? এই যে তুমি আমাকে আজ ও মারলে, আমি কিন্তু একটু ও ব্যাথা পায়নি। আমি তো খুশিতে কাঁদি। শোনো মাহিদ ভাই, আমি তোমাকে আর চাইব না। তুমি শুধু একটাই কাজ করবে , তোমার কাছে আমি শুধু একটা জিনিসই চাইব। আমাকে যেখানে বিয়ে দেবে, তুমি সেখানে রোজ যাবে,তারপর আমাকে মেরে আসবে। আর কিচ্ছু চাইব না তোমার কাছ থেকে। তুমি আমাকে এরচাইতে ও বেশি কিছু দিতে পারবেনা মাহিদ ভাই৷ মাহিদ ভাই তুমি কেন জানলে না, আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। খুব ভালোবেসেছিলাম৷ তুমি জানলে না মাহিদ ভাই। তুমি বুঝলে ও না। তুমি আমাকেই ভালোবাসলে না মাহিদ ভাই। নাকি ভালোবাসা কাকে বলে তা ও তুমি জানোনা? কোনটা? আজ থেকে সবকিছু মিথ্যে প্রমাণিত হোক মাহিদ ভাই৷ আমি যে তোমাকে ভালোবাসি তাও মিথ্যে প্রমাণিত হোক৷ তাহলে আমার আর কোনো কষ্ট থাকবেনা। তোমাকে না পেলে ও আমার কোনো কষ্ট থাকবেনা। আমার কোনো কষ্ট নেই মাহিদ ভাই৷ তুমি যদি আমায় ভালোবাসতে তখন তোমাকে না পেলে আমার খুব কষ্ট হতো। কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোইবাসোনা। তাই আমার কোনো কষ্ট নেই। আমার শুধু একটাই আফসোস থেকে যাবে,
‘ তুমি কেন আমায় ভালোবাসলেনা মাহিদ ভাই? তুমি চোখের ভাষা বুঝোনা মাহিদ ভাই, মুখের ভাষা কি করে বুঝবে। তাই আমি ও তোমাকে বললাম না আর৷ আমাকে ভালো না বেসে তুমি যদি ভালো থাকো তাহলে তাই হোক৷ তুমি ভালো থেকো। আমি নাহয় তুমি ভালো আছো দেখে ভালো থাকব। ভালোবাসা তো একেই বলে৷

রিপ বাইরে থেকে ডাক দিল।
‘ পিহু দেরি হয়ে যাচ্ছে।
পিহু তাড়াতাড়ি চোখ মুছল। নিজের দু হাতের মুঠোয় থাকা ছেলেটির হাতটাতে মুছে নিল নিজের দুচোখ। তারপর সোজা বেরিয়ে গেল৷ তারপর রিপকে বলল,
‘ আর কখনোই আসব না এ বাড়িতে। কখনো না।
রিপ কিছু বলল না। চুপচাপ হাঁটল৷

________________

বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য শেখওয়াত বাড়ি আর চৌধুরীর বাড়ির সবাই বৈঠক বসল। নিনিতের মামা আসল দুইজন পিহুকে দেখতে। রিক ছিল কিন্তু রিপ সোজাসাপটা জানিয়ে দিল,
‘ এসবে সে নেই।
ইশা রাগ করে বলেছিল,
‘ আমি তোমার নিজের বোন নয় তাই তুমি এভাবে নিজেকে গুটিয়ে আমার বেলায়। নিজের বোন হলে ভাগিনীর সবকিছুতে তুমি থাকতে।
রিপ একদম রেগে গেল।
‘ ঠাঁটিয়ে চড় মারব ইশু। কথায় কথায় এসব প্রসঙ্গ তুলবি না। তুই কিছু বুঝিস না। তুই বুঝবি ও না। তোদের মত মানুষদের সেই ক্ষমতা নেই। তোদের সেই ক্ষমতা থাকার কথা ও নয়।
রিপ রেগে চলে গেল। ইশা মুখ কালো করে নীরাকে বলল,
‘ রিপদা কথায় কথায় ধমকাধমকি করে। তুই তোর বরটাকে ধোলাই করতে পারিস না?
নীরা হেসে দিল খিলখিল করে। বলল,
‘ আহারে। আমার ধোলাই হওয়ার কোনো শখ নাই বাপ। সে উল্টো আমাকে ধোলাই করে বসায় রাখবে।
ইশা হাসল। কিন্তু রিপদার বলা কথাগুলো মাথা থেকে ফেলতে পারল না।

___________________

নিনিত পিহুকে ডেকে নিল হসপিটালের পাশে ছোটখাটো পার্কটাতে। খুব ইমার্জেন্সি কথা বলার আছে। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়ে গেছে অথচ পিহুর পছন্দ অপছন্দ জানা হয়নি নিনিতের। পিহু আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল।
নিনিত আসামাত্রই একটুখানি হাসল। পিহু ও মৃদু হেসে বলল,
‘ আপনার আর ও আগে আসার কথা ছিল স্যার।
নিনিত ঘড়ি দেখে ফিফটিন মিনিটস লেট। সরি আরিশা।
পিহু হাসল। কিছুদূর যেতে যেতে বলল,
‘ এমনিই বলছিলাম, কোনো সমস্যা নেই।
নিনিত সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করল,
‘ এখানে কেন ডেকেছি জানো নিশ্চয় ?
পিহু মাথা নাড়ল। বলল,
‘ উত্তরটা ও আপনার কাছে আছে স্যার। নইলে আমি রাজি হতাম না। পাপা যেটা চায় সেটাই হবে।
নিনিত মাথা নাড়ল৷ বলল,
‘ বুঝতে পেরেছি।
পিহু বলল,
‘ আপনার?
নিনিত দুর্বোধ্য হাসল। বলল,
‘ আমার পছন্দ অপছন্দ গুলো আমি নিজেই ঠিক বুঝতে পারিনা। এই স্টাডি, ক্যারিয়ার এসবের বাইরে অন্যকিছু ভাবার সময় হয়ে উঠেনি। পরিবার যেটা চায় সেটাই৷
দুজনের মাঝে এটুকুই কথা হলো। কিছুটাদূরে চোখ গেলে দুজনেই দেখতে পেল একটি বাচ্চাকাচ্চার সাথে খেলা করছে৷ কপালে এখনো ব্যান্ডেজ মোড়ানো আছে। পিহু আর এগোলোনা। নিনিত ডাক দিল ছেলেটিকে।
‘ মাহি????
ছেলেটি থেমে গেল। দুজনকে একনজর দেখে আবার খেলায় মত্ত হয়ে গেল। নিনিত পিহুকে ডাকল,
‘ আরিশা এদিকে এসো।
পিহু পা টিপে টিপে গেল। নিনিত মাহিদকে ডাক দিল আবার।
‘ মাহি তুই কি ছোট বাচ্চা?
মাহিদ থামল। শার্টের কলার পেছনে ঠেলে এগিয়ে আসল। কপালের একপাশ থেকে ঘাম মুছে নিয়ে বলল,
‘ তুই বাপ বউ লইয়া ঘুরতে আইছস। এইহানে আমি কি করুম বাপ?
নিনিত হেসে দিল। বলল,
‘ এখন কেমন আছিস সেটা জানতে ফোন দিয়েছি, ফোন তো ধরিস নি। তাই এখন সামনাসামনি জিজ্ঞেস করতে ডেকেছি।
মাহিদ হাসল। কপালের পাশের ব্যান্ডেজটা ছুঁয়ে বলল,
‘ ওরেব্বাপ এইডা এখনো আছে? দাঁড়া খুলতাছি।
একটান দিয়ে মাহিদ ব্যান্ডেজটা খুলল। পিহু আঁতকে উঠল। নিনিত বলল
‘ পাগল হয়ে গিয়েছিস? কি করছিস মাহি?
মাহিদ ব্যান্ডেজটা ছুঁড়ে মারল পিহুর দিকে। তারপর বলল,
‘ এসব ফালতু ব্যান্ডেজের কোনো কাম নাই। শুধু শুধু কপাল বিশ্রী বানাইয়া রাখছে।
নিনিত বলল,
‘ তোর ক্ষত এখনো শুকোয়নি।
মাহিদ হাত নেড়ে বলল,
‘ যাহ তো বাপ। শুকাবে ও না। যাহ।
নিনিত পিহুর দিকে তাকালো। বলল,
‘ এই পাগলটার সাথে কথা বলতে গেলেই সমস্যা। আরিশা তুমি এসো, আমি যাচ্ছি।
পিহু দাঁড়িয়ে থাকল। নিনিত চলে গেল। মাহিদ হাত দিয়ে ঘাড় ম্যাসাজ করতে লাগল। পিহু চোখ তুলে একবার তাকালো। চোখাচোখি হতেই আবার চোখ নামিয়ে নিল। মিনমিন করে বলল,
‘ বাসায় যাব। পৌঁছে দেবে? আর কখনো বলব না। এই শেষবার।
মাহিদ কিছু বলল না। চলে গেল৷ পিহু কেঁদে দিল সাথে সাথে। আবার চোখ মুছে নিল। ততক্ষনে মাহি বাইক নিয়ে এসেছে। দুইতিনবার হর্ন বাজালো। পিহু দেখল। ধীরপায়ে হেঁটে মাহিদের পেছনে গিয়ে বসল। মাহিদ আবারও হর্ন বাজালো। পিহু ভালোকরে বসে কাঁপাকাঁপা হাতে মাহিদের কাঁধ ছুঁল। মাহিদ বাইক স্টার্ট দিতে না দিতেই পিহু আঁতকে উঠে মাহিদের পিঠে জড়িয়ে ধরল। পিঠে তার মুখ ঠেকে গেল।
মাহিদ বাইকে মনোযোগ দিয়ে মাথা নিচু করে তাকালো তার বুক আঁকড়ে ধরা দুটো হাতকে। আবারও বাইকে মনোযোগ দিল। পিহু মাথাটা ফেলে রাখল তার পিঠে। চোখের নোনা জল মুছে দিল শার্টে।

মাহিদ তার পিঠে ঠান্ডা কিছু অনুভব করল। নড়েচড়ে উঠতেই পিহু আর ও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল তাকে। এইবার ডুকরে কেঁদে উঠল। সারারাস্তা পার হলো ওভাবেই।

চৌধুরী বাড়ির সামনে বাইক থামতেই পিহু তড়িঘড়ি করে নামল বাইক থেকে। নিজেকে আড়াল করে ডুকে পড়ল গেইটের ভেতর। গেইটের পাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। উদ্ভটসুরে কেঁদে দিয়ে মাথা নামিয়ে রাখল ঠোঁট চেপে৷ গেইট ঠেলে ডুকে পড়া ছেলেটি তার আসলরূপ দেখে নিল মুহূর্তেই। পিহু মাথা নামিয়ে কেঁদে গেল। মাহিদ বিস্ময় নিয়ে তার কান্না দেখল। পিহু তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে এদিকওদিক তাকাতেই মাহিদকে দেখে ভড়কে গেল৷ কান্না থেমে গেল। পিহু দুই পা এগোতেই মাহিদ দুই পা পিছু হাঁটল। দৌড়ে গিয়ে বাইকে চেপে বসে মুহূর্তেই অদৃশ্য হলো। পিহু গেইটের কাছে দাঁড়িয়েই রইল।

চলবে,

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here