মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_২৬

0
561

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৬
#পুষ্পিতা_প্রিমা

আজিজ চৌধুরীর ফোনে কল এল। তখন বেলা বারোটা হবে। আজিজ ফোন কানে দিতেই ওপাশ থেকে পুলিশ অফিসার শাহেদের কন্ঠস্বর ভেসে এল।

‘ আপনাদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হবে মিঃ চৌধুরী। একটি বাচ্চা মেয়ের কিডন্যাপিংয়ের অভিযোগ এসেছে আপনার উপর। ধারণা করা হচ্ছে ওই বাচ্চাটা এখন আপনাদের বাড়িতেই আছে।

আজিজ চৌধুরী গর্জে উঠলেন। আমি কেন একটি বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপ করব? আপনাদের কাছে কোনো আইউইটনেস আছে? কোনো প্রুফ ছাড়া একটা নির্দোষ মানুষকে ফলস অ্যালিগেশন দেওয়াটা ও এক ধরণের অপরাধ।

পুলিশ অফিসার বেশি কিছু বলল না। শুধু বলল,
‘ এডভোকেট মিঃ রিপ এই অভিযোগ এনেছেন। আমরা উনার কথা ফেলতে পারিনা স্যার। তাই আমরা যাচ্ছি। জানানোর প্রয়োজন ছিল তাই জানিয়ে দিচ্ছি।

আজিজ চোধুরী ফোনটা রাখলেন জোরে আওয়াজ করে। চেঁচিয়ে ডাকল আলিয়াকে। আলিয়ার ধীর পায়ে হেঁটে এল। কারণ তার কোলে পরী। পরীর গায়ে ফ্রক নেই। সাদা কালো চেকের একটি ঢিলা শার্ট। মাথার ছোট ছোট চুল গুলো ছোট ছোট করে দুটো ঝুটি বেঁধে দিয়েছে আলিয়া। ঠোঁটে লিপিস্টিক দিয়ে দিয়েছে। কপালের একপাশে বড় করে একটি নজরটিকা লাগানো। একটা বেবি ডলের মতো দেখাচ্ছে। পরীর হাতে একটা প্লাস্টিকের পাতলা আয়না। সেই আয়না দু হাতে ধরে মুখের সামনে একবার আনছে আরেকবার খিলখিল করে হাসছে। আলিয়াকে আয়নাটা দিয়ে দুম করে মেরে জিজ্ঞেস করছে,

‘ দাদদদদা ওয়াহ না???

আলিয়া হেসে বলছে, ইয়েস আদিশা ইজ সো সুইট, ওয়াও……

পরী আয়নাটা নাড়াতে নাড়াতে হাসে। আজিজ চৌধুরীর দিকে চোখ যাওয়ায় চুপ হয়ে যায়। আলিয়ার কাঁধের কাছে চেপে যায়। আবার আজিজ চৌধুরীর দিকে মাথা তুলে তাকায় ,দেখল আজিজ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পরী আবার চেপে গেল। মুখ তুলে আবার দেখল আজিজ চৌধুরীকে। ঠোঁটদুটো ফুলিয়ে মোচড়ে দিল। আজিজ চৌধুরী রেগে বলল,
‘ লিয়া দেখেছ মেয়েটা আমাকে মুখ ভাঙিয়ে দিয়েছে। দেখেছ তুমি?

আলিয়া হো হো করে হেসে উঠল। পরীকে তার সাথে চেপে ধরে বলল। আমি শিখিয়েছি মুখ ভাঙানো।
আজিজ চৌধুরী বেজায় রেগে যান। পরীর দিকে তাকাতেই পরী আবার ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ মোচড় দেয়। আজিজ চৌধুরী চেঁচিয়ে বলে উঠে,
‘ তোমার নাতনীকে বারণ করো লিয়া। আমার এসব সহ্য হচ্ছেনা।
পরী আজিজ চৌধুরীর মতো চেঁচিয়ে বলল, ইননননননননা……
আলিয়া হাসল। এবার তাহলে স্বীকার করছ তো যে আদিশাই তোমার নাতনী?
আজিজ চৌধুরী কিছু বলতে যায় তার আগেই রাইনা দৌড়ে এল। বলল, মা আদিশাকে আমার কাছে দিন।
আলিয়া প্রথমেই দিতে চাইল না। কিন্তু আজিজ চৌধুরী যখন বলল, তখন বহু সংকোচ করে দিয়ে দিল। রাইনা তো বেজায় খুশি। পরী রাইনার কোলে যাওয়া মাত্র রাইনাকে আয়না দেখাল। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দেখাল। বলল, ওয়াহ না????
রাইনা খিক করে হেসে দিল। বলল, হ্যা হ্যা ওয়াও। মামনিকে খুব সুন্দর লাগছে।
পরী রাইনার মতো বলার চেষ্টা করল। পারল না। শুধু বলল, মামোনননি?
রাইনা হাসতে হাসতে পরীকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। পরীকে ছেড়ে দিল রুমের ভেতর। আফি তখন বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমোচ্ছে। রাত বারোটাই ঘরে ফিরে দিনের বারোটাই ও ঘুম থেকে উঠেনা সে। রাইনা পরীকে দেখিয়ে দিল আফিকে। হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল,
‘ খুব খুব মেরে এসো। যাও। ডাকবে, আফিইই,,
পরী রাইনার দিকে ভ্রুকুঞ্চন করে তাকাল। ডাকল,আফফিইই……
রাইনা হাসল। বলল, যাও, যাও। দুমদুম মেরে এসো।
পরী এগিয়ে গেল। পড়নের শার্টটা হাঁটুঅব্দি। মাঝেমাঝে আদি ও এমন ঢিলা শার্ট পড়ে বাগানের কাজ করে। রাইনা হেসে আওড়াল। বাবা মেয়ের একই দশা।
পরী হাতে থাকা প্লাসটিকের গোল আয়নাটা দিয়ে আফির বিছানার শেষে এসে পড়া মুখে দুম করে মারল। বলল, আফফি…
আফফি নড়েচড়ে ঘুমোলো। কিন্তু চোখ মেলে তাকাল না। পরী আয়নাটা দিয়ে দুমদুম দুমদুম মারল আফির মাথায়। আফি এবার ব্যাথা পেল। মাথায় হাত দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসল। পরী খিলখিল করে হেসে উঠল। আফি চোখ কচলে দেখল, ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে। আফি চেঁচাল না। মেয়েটির খিলখিল করা হাসি দেখল। বলল, এখানে কি চাই?
পরী তার মুখ বাড়িয়ে কন্ঠস্বর টেনে বলল, আফফফফি এতততো ……
আফি রাইনাকে দেখল। বলল, এই মেয়েটা এখানে কি করে?
রাইনা ভয়ে ভয়ে বলল, ও আপনার ভাইয়ের মেয়ে। এত কিউট একটা মেয়েকে একটু আদর করতে ইচ্ছে করেনা আপনার?
আফি রাইনার কথায় অবাক হয়ে বলল, আদির মেয়ে? আদর?
নিজের হাতের দিকে তাকায় আফি। চেঁচিয়ে উঠে পরমুহূর্তেই। এই মেয়েটাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আমাকে যাতে না ছুঁই। তোমার সাহস কি করে হয় আমার পারমিশন ছাড়া আমার রুমে যাকে তাকে নিয়ে আসো। দূরে সরাও এই মেয়েকে।
পরী ভড়কে গেল। ডাগর ডাগর চোখগুলো বড় বড় করে তাকাল আফির দিকে। আওয়াজ করে ডাকল, আফফফফফি….
আফি ও বড় বড় চোখ করে তাকাল। বলল, ওমা এই মেয়ে তো দেখছি আমাকেই ধমক দিচ্ছে।
পরী খাটে ভর দেয় বুকের। একটা পা কোনোমতে তুলে দেয়। বুকে ভর দিয়ে দিয়ে কোনোমতে কষ্ট করে উঠে বসে খাটের উপর। আফির কাছে গিয়ে পিঠে দুহাত দিয়ে ঘিরে ধরে। চুল টেনে ধরে। দুমদাম মারে পিঠে। নখ দিয়ে আঁচড় দেয়। আয়নাটা দিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন ভাবে মারে। তারপর ঠোঁটের কাছে আঙুল দিয়ে বলে, ভোববব।
রাইনা নিজের অজান্তেই হেসে দেয়। আফি সেভাবেই থাকা অবস্থায় বলে, মেয়েটার কত সাহস? ভোবব মানে কি?
রাইনা ফট করে বলে ফেলল, মনে হয় চুপ করতে বলছে।
আফি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পরীর দিকে। পরী তার এভাবে তাকানো দেখে আবার বলল,ভোবববব।
খিটখিটে মেজাজের আফি পরীর কথায় হেসে ফেলল। পরক্ষণে চোখ লাল করে বলল, চোপ……..

আলিয়া ভড়কে গেল আজিজ চৌধুরীর মুখে অমন কথা শোনায়। তার চোখজোড়া টলমল করে উঠল। বলল, না আমি আদিশাকে কাউকে দেব না। আদিশা আমার নাতনী। আমার আদির মেয়ে। আমি ওকে দেব না। আজিজ চৌধুরী একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ কি করে আদির মেয়ে হয় লিয়া? আদির সন্তান বলতে কিচ্ছু নেই। তুমি শুধু শুধু পাগলামি করছ। মেয়েটাকে নিয়ে এসো। আমি ওকে সরিয়ে ফেলব। অন্য কোথাও রাখব। নিয়ে এসো।

আলিয়া না না করে উঠে। বলে, আমি ওকে দেবনা। তুমি ওকে কোথাও নিয়ে যাবেনা। আদিশা আমার কাছে থাকবে। তুমি নিয়ে যেওনা প্লিজ।

আজিজ চৌধুরী বোঝাতে পারেনা আলিয়াকে। আলিয়া জেদ ধরে আদিশাকে ও দেবেনা। কিছুতেই না।
কিন্তু আজিজ শোনেনা। পুলিশ আসার আগেই পরীকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আজিজ চৌধুরীর রেপুটেশনে কিছুতেই কিডন্যাপিং নামক স্পটটি ফেলা যাবেনা। আলিয়ার সাথে মনোমালিন্য হয় আজিজের। আলিয়া শেষপর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে পরীকে তুলে দেয় আজিজ চৌধুরীর হাতে। পরী আজিজ চৌধুরীর কোলে যেতে না যেতে শক্ত করে টেনে ধরে দাড়ি। চুল। মুখ দিয়ে রাগে ইইইইই শব্দ বের হয় তার। আলিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকে দাদদদদা?
কিন্তু আজিজ চৌধুরী আর দাঁড়ায় না। নিমেষেই নিরুদ্দেশ হয়। ঘন্টাখানেক পরে ফিরে আসে বাসায়। তার প্রায় আধঘন্টা পর পুলিশ আসে বাড়িতে। কোনো প্রুফ পায়না। রিপ শুধু অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় চৌধুরী বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যের দিকে। বেরিয়ে আসার আগে সে আবার থমকে দাঁড়ায়। তা ও মিনির ডাকে। মিনি ডানা ঝাপটে ঝাপটে ডাকে, রিইইই নাইস বয়। মিস ইউ। মিস ইউ।
রিপের হঠাৎ খারাপ লাগে। মিনি ও যে চৌধুরী বাড়ির সদস্য এটা ও লুকিয়েছে মেয়েটি। দিনের পর দিন তাকে মিথ্যে বলেছে। তার বিশ্বাস নিয়ে খেলেছে। কি বোকা সে? কতটা বোকা হলে মানুষ এভাবে অন্ধবিশ্বাস রাখে অপরের প্রতি। যেখানে সব মিথ্যে, পুরো পৃথিবীটা মিথ্যে।
কিন্তু কোথায় পরী? কি জবাব দেবে সে তার ভাই ভাবিকে। মাকে কি জবাব দেবে? কোনো উপযুক্ত প্রমাণ নেই তার হাতে। কি করবে এখন সে? কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? ডক্টর আদি চৌধুরীই বা কোথায়? কোথায় সে সৌভাগ্যবান পুরুষ?

___________________

একহাত দেয়ালে লাগিয়ে দেয়ালে টানানো পিচ্চিটার ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রিক। হাসিখুশি গুলুমুলু মেয়েটা তার মেয়ে। আজ মেয়ো নেই তার কতগুলো দিন। কতগুলো রাত। পরীর কান্নায় তার ঘুম ভাঙত মাঝরাতে। কিন্তু আজকাল মাঝরাত পার হলে ও তার চোখে ঘুম ভর করেনা। মাঝরাতে নরম তুলতুলে শরীরের মেয়েটি তার ছোট ছোট হাত দিয়ে বাবাকে ডাকেনা। গায়ের উপর উঠে গালে গাল লাগিয়ে আদর করেনা। নরম নরম হাতগুলোর মাইর ও খাওয়া হয়না কতগুলো দিন। খাওয়ার সময় আচমকা দৌড়ে এসে হা করে বলেনা, পাপপপপা আমম।
রিকের ও আর হাসা হয়ে উঠেনা। একসাথে বসে কতদিন খাওয়া হয়না। মা টা কোথায়? কি খাচ্ছে? কার হাতে খাচ্ছে? আদৌ খাচ্ছে তো? পাপার কথা কি তার একবার মনে পড়েনা? পাপার যে তার কথা খুব মনে পড়ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তাকে ছাড়া। অফিসে বেরোনোর সময় কান্না করে মা টা আর পুরো বাড়ি মাথায় তোলেনা। কি শান্ত পরিবেশ? রিকের ভালো লাগেনা। বুকে কষ্ট হয়। বুকটা একদম খালি হয়ে গেছে। পরীকে দরকার। খুব করে দরকার। পাপা খুব খুব মিস করছে পরীকে। কখন দৌড়ে এসে পাপার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে ডাকবে, পাপপপপা। কখন। সেই সুদিন কবে আসবে? আদৌ আসবে তো?
মুনা এসে তাড়া দেয় রিককে। রিক সন্তর্পণে চোখদুটো চেপে ধরে দুই আঙুল দিয়ে। বহুক্ষণ পর হেঁটে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে দেখা রিপের সাথে।

‘ আর কতদিন রিপ? আজিজ চৌধুরীর কাছে আমি এবার নিজেই যাব। আর বসে থাকব না।

রিপ অন্যদিকে মুখ করে রাখে। বলে, ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো। কারণ ডক্টর আদি চৌধুরী যেদিন জানবে পরী তার মেয়ে যেকোনো মূল্যে সে পরীকে তার কাছে নিয়ে যাবে।
রিক আচমকা রেগে যায়। রিপের শার্টের কলার টেনে ধরে। মুনা আর তালহা বেগম আঁতকে উঠে। তালহা বলে, ছেড়ে দে রিক। কি করছিস? ও তোর ভাই।
রিক ছেড়ে দেয়। স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিপের উপর। রিপ শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। রিক মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যা, ও আমার ভাই। তাই আমি ছেড়ে দিয়েছি। নাহলে ওর অবস্থা করুণ হতো। ওর উপর নির্ভরশীল হয়েছি তাই ও আমাকে এত বড় কথা বলতে পারল। ওর ভাবা উচিত ছিল পরী শুধু আমার মেয়ে। তার ভাইঝি। পরীকে আমার খুব করে দরকার মা। পরীকে আমার চাই। তোমরা বুঝতে পারো না মা। তোমরা বুঝোনা। পরীকে ছাড়া আমার প্রত্যেকটা কতটা দুর্বিষহ কাটছে। কতটা কষ্ট হয় আমার। কতটা একা লাগে আমার।
রিপ তারপর ও শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। রিক বলে, তুই বুঝবি না আমার কষ্ট আজ। কিন্তু সেদিন ঠিক বুঝবি যেদিন তোর সন্তান ও পরীর মতো কোথাও নিখোঁজ হয়ে যাবে। পরী তো তোর কেউ না।

রিপের শক্ত খোলসে আঘাত পড়ে। সে তারপর ও সামান্য নড়েনা। শুধু রিকের দিকে তাকায় চোয়াল শক্ত করে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে।

‘ পরী আমার কেউ নয়?

‘ না কেউ নয়। তুই পরীর কেউ নস। তুই তো নিজেই বলেছিস পরী আমার কেউ নয়। তাহলে তোর ও তো কেউ নয়। তোর তো একটু ও কষ্ট লাগার কথা নয়। একটু ও না।

রিপ একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তাকায় ভাইয়ের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘ পরী আমার সবটা। আর এই পরীকে আমি দ্বিতীয় বার চোখের আড়াল হতে কিছুতেই দেবনা। শুধু একবার আমি পরীকে পাই। শুধু একবার।

রিকের ঠোঁটে খানিকটা হলে ও হাসির ছটা দেখা যায়। সে বলে,
‘ পরীর রিইইই কে একদম পড়ে ফেলা যায়। কিন্তু মাঝেমাঝে একদম চেনা যায় না। পড়া যায় না। মনের কথাটা এবার অন্তত বলা শেখ রিপ।
রিপ হাসে। অবজ্ঞার হাসি। ব্যঙ্গার্থ হাসি। বলে,

‘ কি লাভ তাতে? যারা পড়তে জানে এবার না হয় তাদের কথা ভাবি। তাদের কথা রাখি। মরিচীকার পেছনে আর কতদিন ঘুরব? আর কতকাল? এবার থেকে নিজেকে নিয়ে ভাবি। অন্যের কথা ভেবে এভাবে নির্ঘুম রাত কাটার কোনো মানে হয়? নিজে ভালো থাকার লড়াইয়ে না হয় নামি এবার। নিজেকে ভালো রাখার।

আচমকা দুতলার রেলিং ধরে দাঁড়ানো মেয়েটি রিপ তাকানোর সাথে সাথে সরে যায়। কান্নাহাসিতে সে একাকার হয়। দেয়ালে পিঠ চেপে দাঁড়ায়। কান্নাহাসির সংমিশ্রণে সে বলে,
‘ আমি আজ খুব খুশি রিপদা। কারণ তুমি আজ থেকে নিজের কথা ভাববে বলেছ। নিজের দিকে তাকাও এবার। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো। আর কতদিন আমার মতো এক অভাগীর জন্য নিজে নিজেই আত্মঘাতী হবে? আর কতকাল আমার কষ্টগুলো দূরীভূত করার চেষ্টা করবে? আর কতদিন এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে কাটাবে? এবার তুমি গুছিয়ে নাও তোমার জীবন। আমার সুখ সেখানেই। আমার আপনদের ভালো থাকতে দেখা। তুমি ভালো থেকো রিপদা। হাসিখুশিতে থেকো। তোমার সেই আগের মুগ্ধ করা হাসিটা আমি আবার দেখতে চাই। আমি আবার ও বিরক্ত হতে চাই। তোমার পাশে আমি তোমার জীবনসঙ্গীকে দেখতে চাই। তোমার ছোট্ট একটি সাজানো সংসার দেখতে চাই। আমার চিন্তা আর করোনা তুমি। আমি এভাবেই ভালো আছি। এভাবেই ভালো থাকব।

যদি কখনো মন কেমন করা সুখ ধরা দেয় জীবনে সেদিন তোমায় আমি ঠিক বলতে আসব, রিপদা দেখো আমি খুব সুখী। খুব খুব সুখী। তুমি ও সুখী হও।
তুমি কিন্তু সেদিন আর রাগ পুষিয়ে রেখোনা। আমি জানি তোমার রাগের কারণ, বুঝি আমি। কেন আমি সুখী হলাম না? যদি আমি সুখী হতাম তাহলে আজ তুমি এমনটা করতে না। আমাকে আবার ইশু বলে ডাকতে। মিসেস চৌধুরী বলে ডাকতে না । জানিনা তোমাকে আমি সুখী হয়ে দেখাতে পারব কিনা?

কিন্তু কোনোদিন যদি শতবাধা পেরিয়ে ও সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসে। যদি কখনো গর্জন করে আকাশের বুক ছিড়ে সেই বৃষ্টি আসে, তাহলে সবার আগে আমি আগে তোমার কাছে ছুটে আসব। এক মন কেমনের শুভক্ষণে তোমাকে বলতে আসব,
‘ রিপদা দেখো আমি আজ খুব সুখী একজন। আজ ডক্টর আছে আমার পাশে। আমার কাছে। আমি আজ ডক্টরকে শুনতে পায়। আমি খুব সুখী রিপদা।
সেদিন তুমি খুব করে হেসো রিপদা। আর তোমার সেই আশীর্বাদের হাত আমার মাথার রেখে বলো,
‘ তুই ভালো থাক ইশু। সুখে থাক। আর তোর এই রিপদাকে মনে রাখ।

_____________

রিপ চোখ সরিয়ে নেয়। কেন মেয়েটি লুকিয়ে তার কথা শোনে? কিসের এত অনুতাপ তার? সে তো জানেনা, বুঝেনা তার রিপদা তাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণায় এমন হয়ে আছে। তাহলে সামনে আসতে তার কিসের এত ভয়, কিসের এত লাজ?
সেদিন কেন একটিবার মনে হয়নি যে জীবনের এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রিপদাকে একটু জানানো দরকার। যে তার জীবনের সবচাইতে বড় কন্ট্রিবিউটর। সেদিন কেন একটিবার ভাবেনি অন্য একটি ছেলেকে কবুল বলার আগে রিপদাকে একটিবার জানানো দরকার। রিপদা যে জানার অধিকার রাখে! সেদিন কেন বলেনি?
আচ্ছা রিপদা তাকে বারণ করত বলে? বিয়ে করতে বারণ করত বলে? ডক্টরকে এতটা ভালোবাসে সে? এতটা ?
ডক্টরকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে জানায়নি। নাকি রিপদা নামক সামান্য জীবটিকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি? হয়ত সেটাই হবে। ডক্টরের ভালোবাসার কাছে রিপদা তো তুচ্ছ একটি বালি কণামাত্র। জানালেই কি না জানালেই বা কি? রিপদা একদিন ঠিক ক্ষমা করে দেবে? কিন্তু প্রশ্ন তো একটা থেকেই যায়, আদৌ কি ক্ষমা শব্দটি আসে? যদি সে কখনোই মেয়েটিকে ভালো বা বাসত? তার চাওয়ায় বোধহয় কোনো ত্রুটি ছিল। নাহলে তার ভালোবাসা কেন পূর্ণতা পেল না। তার ভালোবাসাই তো ত্রুটি ছিল না।
আদির চাওয়ায় বোধহয় ত্রুটি ছিলনা। তাই সে পেয়েছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে এক মুহূর্তের জন্য হলে ও পেয়েছে। কিন্তু তারপর পেতে পেতে ও হারিয়েছে। আচ্ছা প্রশ্ন তো আর ও একটা থেকে যায়,

‘ এটা কে কি পাওয়া বলে?

প্রশ্নটা যদি একবার,শুধু একটিবার মেয়েটিকে করা হতো। তাহলে সে বলত,
না পাওয়ার যন্ত্রণা ম্লান হয় অন্যকারো সংস্পর্শে। কোনে না কোনো সময়। কিন্তু পেয়ে ও হারানোর যন্ত্রণার মতো যন্ত্রণা কি আর দুটো আছে?

রিপ মেয়েটির কথার পুরো বিপরীতে অবস্থান করে।

‘ কে বলেছে না পাওয়ার যন্ত্রণা ম্লান হয়? তুই জানিস ম্লান শব্দটার মানে কি? তুই বুঝিস? বুঝিস না। জানিস না। ম্লান শব্দটার মানে হচ্ছে সেই পাষাণকে ভুলে থাকার জন্য অন্য কারো সাথে ভালো থাকার অভিনয় করা। আর দিনশেষে রাত নামলেই সেই নিজের আসলরূপে বেরিয়ে আসা। আর সেই রূপের সাক্ষী ওই খোলা আকাশ,আর চাঁদ। বিছানার বালিশ। নইলে এই ক্ষত বিক্ষত হৃদয়টি। খোঁজ রাখিস? খোঁজ না রেখে কি করে বলিস অমন কথা? কেন বারবার প্রমাণ করিস তুই বড্ড পাষাণ। বড়ই পাষাণ।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here