মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_২৯(সিজন ২)

0
671

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৯(সিজন ২)
পুষ্পিতা_প্রিমা

জালিশাকে রুমে ভেতর রেখে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিল ইমি৷ রাতটা সেভাবেই কেটে গেল। জালিশার আকুতিমিনতি না শুনে আইমি সিদ্ধান্ত নিল কালই ব্যাক করবে কানাডা। জাবির তার কথামতো সকালেই ফ্লাইটের টিকিট কাটল।

নিয়াজ সাহেব জালিশার রুমের দরজা খুলে প্লেটে করে খাবার নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিল। জালিশার চোখমুখ মুছে দিয়ে বলল,
‘ কি চাইছিস এখন?
জালিশা চোখমুখ মুছে বলল,
‘ চলে যাব।
নিয়াজ সাহেব হাসল তার কথায়৷ বলল,
‘ বর রেখে চলে যাবি?
জালিশা বলল,
‘ বিয়ে তো হয়নি। কাজী আরিশার নাম উচ্চারণ করেছিল। আমার নয়৷ আর নিনিত ভাইয়া রাজী নেই৷ তার অজান্তে বিয়েটা হয়েছে। নিকিতা আন্টি এমনটাই বলেছে, বর কনের অমতে বিয়ে হলে সে বিয়ে জায়েয নয়। এটাকে বিয়ে বলা যায়না।

নিয়াজ সাহেব বললেন,
‘ তো তুই কেন এমনটা করেছিলি? নিনিত তো ফায়ার হয়ে আছে।

জালিশা বলল,
পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমি বউ সেজে বসেছিলাম। শুধু বিয়েটা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ সেখানে তখন অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। আমি শুধু চেয়েছি আরিশার সাথে যাতে বিয়েটা নাহয়। কারণ রিপ আন্কেল বলেছে যে, আরিশা নিনিত ভাইয়াকে নয় মাহিদ স্যারকে পছন্দ করেন। স্যার ও। নিনিত ভাইয়া আরিশার সাথে ভালো থাকত না, তাই আমি শুধু বিয়েটা হওয়া থেকে আটকিয়েছি। এছাড়া যা উপায় ছিল তাতে করে, দুই পরিবারের সম্মানে আঘাত লাগত। হসপিটালের বড় বড় ডক্টররা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আরিশা স্লিপিং খেয়ে নিয়েছিল,তাই সে বিয়ের পিড়িতে এমনি ও বসতে পারতোনা।
আরিশার মা বাবা বোন ও কিছুই জানতো না। রিপ আন্কেল আমার সাথে সাথে তাদেরকে ও প্রথম জানিয়েছে। তাই আরিশার শাড়িটা আমি পড়েছি। পরী আপু আর ইশা আন্টি হেল্প করেছিল।
নিয়াজ সাহেব বললেন,
‘ আমাকে এসে তুই বলতে পারতিস । আমি কিছু করার চেষ্টা করতাম। তোর নিকিতা আন্টি বেশ রেগে আছে তোর উপর৷ যাইহোক,যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস ভেবেচিন্তে নিয়েছিস ?
জালিশা ডুকরে কেঁদে উঠে মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ মাম্মাম আর পাপা কষ্ট পেয়েছে। আমি তাদের বিশ্বাস নষ্ট করেছি। এবার তারা যা বলবে তাই হবে।
নিয়াজ সাহেব মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ ঠিকআছে যাহ। তো যাবি যখন একেবারে নিনিতের বিয়েটা খেয়ে যাহ৷
তোর আন্টি এই মাসের ভেতর ছেলেকে বিয়ে করিয়ে ছাড়বে। বিয়েটা দেখে যাহ।
জালিশা ফোলা ফোলা চোখদুটো তুলে তাকালো। সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলল
‘ না,,,, আমি যাব। আগেই চলে যাব। কখনোই এই দেশে আসব না। কখনোই না।
নিয়াজ সাহেব হেসে ফেললেন আওয়াজ করে। বলল,
‘ আমি শুনেছি কেউ একজন নাকি আমার ছেলেকে ভালো টালো ও বাসে। সে কে জানিস কিছু?
জালিশা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে ফেলে বলে,
‘ না। আমি কিছু জানিনা।
নিয়াজ সাহেব হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
‘ আমি জানি। যাই,, তোদের যাওয়ার ব্যবস্থা করি। জালিশা ফুঁপিয়ে উঠল। নিয়াজ সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরোনোর সাথে সাথে নিনিত সরে গেল দরজার কাছ থেকে। নিয়াজ সাহেব বলল,
‘ কখন এসেছিলি?
নিনিত মাথা চুলকে বলল,
‘ এখন মনে হয়।
নিয়াজ সাহেব তার মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘ গাধা। মায়ের উপর আর কত দিন নির্ভর করে থাকবি? এবার নিজে থেকে কিছু কর। জালিশাকে যেতে দিসনা।
নিনিত নাকের মাথা চুলকিয়ে বলল,
‘ চলে যাওয়া ভালো বাবা।
জালিশা আর ও ভালো কিছু ডিজার্ভ করে। এসব ওর বয়সের পাগলামি।
নিয়াজ সাহেব মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।

জালিশা রুম থেকে বের হলো। নিনিতের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ সরি ভাইয়া।
নিনিত ভ্রু উঁচাল। যেতে যেতে বলল,
‘ যাই বলো তুমি কিন্তু অনেক ভালো অ্যাক্টর হতে পারবে৷
জালিশা কিছু বলল না। নিনিত বলল,
‘ কিছু বলছ না কেন?
জালিশা বলল,
‘ এমনি। বাংলাদেশের মানুষগুলো আসলেই বিচিত্ররকম। আমি ও তার কম না।
নিনিত হাসল। বলল,
‘ সুবুদ্ধি হয়েছে তাহলে৷
জালিশা হাসল। নিনিত বলল,
‘ ভালো লাগছে তোমার উন্নতি দেখে। এবার আরিশা আর মাহিদকে ঠাটিয়ে দুটো চড় দিতে পারলেই শান্তি। আমার সাথে যাবে?
জালিশা থমকাল। বলল,
‘ কোথায়?
নিনিত বলল,
‘ মাহিদের বাসায়৷ রিপ আন্কেল রাতে দাওয়াত করেছে৷ ওদের কনগ্রেস জানাতে যাব। জালিশা মাথা নাড়ল।
‘ যাব। নিয়ে যাবে?
নিনিত কপাল কুঞ্চন করল।
‘ নিয়ে যাব, তাই বলেছি।

____________________________

রিপ তাড়া দিল। ইশাকে ডেকে বলল,
‘ ইশু তাড়াতাড়ি কর৷ পিহু রেডি হয়েছে?. ইশা তাড়াহুড়ো করে ছুটতে ছুটতে জবাব দিল।
‘ এক্ষুনি হয়ে যাবে রিপদা। গাড়ি চলে এসেছে?
রিপ বলল,
‘ কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা, আর ভাবিকে নিচে নেমে আসতে বল। সাথে পরীকে। পরীর সেখানে অনেক কাজ।
সিড়ি ধরে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে ছোট্ট খয়েরী রঙের পাঞ্জাবী পড়া ছেলেটা নেমে এল৷ রিপকে ডাকল
‘ ব্যারিচতার ছিকুভাই রেডি। রিপ হাসল। গিয়ে কোলে তুলে নিল। বলল,
‘ মিহির মতো পাঞ্জাবী পড়েছ?
রাহি মাথা নাড়ল। বলল,
‘ মিহির মতো কেন? ছিকু মিহির মতো বর নয় কেন?
রিপ হাসল। বলল,
‘ বউ আসুক তারপর বর সাজবে।
রাহি মাথা নাড়াল। বলল,
‘ বউ আসবে কখন?
রিপ বলল,
‘ বড় হলে। মিহির মতো হলে তখন।
রাহি বলল,
‘ মিহির মতো কখন হববো।
রিপ ঘড়ির দিকে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ এত প্রশ্ন কেন?
রাহি বলল,
‘ ব্যারিচতার রাগো কেন?
রিপ তাকে নিয়ে গিয়ে গাড়ির উপর বসিয়ে দেয়। রাহি হেসে ফেলল খিক করে। কদুর বিচির মতো দাঁত দেখিয়ে হেসে গাড়ি চালানোর মতো করে বলল,
‘ ছিকুভাই গাড়ি চড়বে। ওহ ওহ কি মুজা কি মুজা! ফিপফিপ যাবো। ভুউউউউ যাবো। ফিপফিপ। ভুউউউউ।

_____________________________

সাদা পাথরের ওড়নাটির উপর বিয়ের শাড়িটা পিহুর গায়ে জড়িয়ে দিল নীরা। বলল,
‘ বিয়ের শাড়ি না পড়ুক। শুধু গায়ে জড়ালে হবে। অনুষ্ঠানের সময় পড়বে সেখানে গিয়ে।
পরী বলল,
‘ ছোটমা শাড়িটা ভারী, বিয়ের ওড়নাটা এমনি গায়ে জড়িয়ে দাও। ভালো দেখাবে।
নীরা তাই করল। পিহুর থুতনি ধরে বলল,’ আহা কি মিষ্টি লাগছে। আমি তোমার চাচুমা, ঠিকআছে? আমাকে চাচুমা ডাকবে। ব্যারিস্টার কি ডাকবে সেটা তার আর তোমার ব্যাপার। আমাকে চাচুমা ডাকবে।
পিহু এত মন খারাপের ভেতর হেসে ফেলল। ইশা তাড়া দিল,
‘ নীরা রিপদা নিচে নামতে বলছে। তাড়াতাড়ি আয়।
পিহু এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে কাউকে খুব করে খুঁজল। আফি এসে বলল,
‘ ছোট মা কোথায়? আমারে কি ভুইলা গেছে নি?
পিহু হেসে ফেলল। দৌড়ে গিয়ে আফির বুকে পড়ে বলল,
‘ ভুলব কেন? পঁচা কথা বলো কেন বড়পাপা?
আফি মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করল। বলল,
‘ সুখে থাকো মা। ভালা থাকো। তোমার বাউন্ডুলে জামাইটারে আঁচলে বাধিয়া রাখো। সুখে সংসার করো। আমাদের ভাই বোন লাগবো,সেদিকে ও খেয়াল রাইখো। বুঝছ?
পিহু লজ্জা, আড়ষ্টতায় মুখ তুলল না। যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তারসাথে এখনো চোখ মেলা হলোনা। আবার ভাইবোন? এরা দুলাইন বেশি বুঝে৷
আফি বলল,
‘ হইছে হইছে উঠো। আর লজ্জা পায়ওনা। ভালা থাইকো সবসময়। আর এই বুইড়ারে মনে রাইখো। এখন তো কাউরে সুন্দর চেহারা দেখায় পটাইতে পারিনা। তাই তোমাদের লাগবো। হাসার জন্য, কথা বলার জন্য, সময় কাটানোর জন্য। ঘরের মানুষ ও দাম দেইনা, বাইরের মানুষ কি দাম দিবো।
রাইনা চেঁচিয়ে উঠল।
‘ সরুন। ফালতু কথা বলবেন না। এ বয়সে এসে ঢংয়ে ধরেছে। কথা আর পাননি?
মুনা শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে হেসে ফেলল। বলল,
‘ রাগ করছেন কেন আপা? বড়ভাই ঠিকই বলেছে।
নীরা বলে ফেলল ফটাফট।
‘ বড়ভাই আপনি যখন ইচ্ছে তখন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবেন। দরজা অলওয়েজ খোলা। টেবিলে অলওয়েজ খাবার সাজানো থাকবে। মেয়ের শ্বাশুড়িটা একটু ও বজ্জাত না। খুব বেশি ভালো। হুমম।

আফি বলল,
‘ ঠিক কইছো ছোটবোন। আমি ও দেখতে পারতাছি আমার ছোটমার শ্বাশুড়ি মেলা ভালা হইবো। আমি যখন ইচ্ছা তখন চইলা যামু।

রেহান ডাক দিল। সবাই তাড়াহুড়ো লাগাল। পিহু বারবার এদিক তাকালো। না কোথাও দেখা গেলনা আদিকে। পিহু ইশাকে ডাকল,
‘ মাম্মা পাপা কোথায়? আমার সাথে এখনো রেগে আছে? কথা বলবে না?
ইশা হাত বুলালো মেয়ের মুখে৷ বলল,
‘ বলবে না কেন? আজ আর কেঁদোনা। তোমার পিছু পিছু আমরা ও সেখানে যাব। কাঁদবে না, ঠি’ কাছে?
পিহু ইশাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ মাম্মা আমি রোজ চলে আসব এখানে। তোমাদের না দেখে থাকতে পারব না আমি।
ইশা হাসল। বলল,
‘ এরকমটা সবাই বলে। আমাদের থাকতে হয়। আমাদের পারতে হয়। আমরা নারী,আমরাই সব পারি।

___________________________

গাড়ির কাছাকাছি যেতে না পিহু দেখল আদিকে। রিকের সাথে কথা বলছে। পিহু গুটিগুটি পায়ে ধীরপায়ে হাঁটল৷ রিক দেখল পিহুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে চলে গেল। আদি পিহুর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। পিহু আদির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আদি মাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সবাই তাকিয়ে রইল বাবা মেয়ের দিকে। পিহুর নেত্রপল্লব নড়ে উঠতেই গলে পড়ল চোখের নোনাজল। চোখের কোণা ঘন লাল। নোনাজল গড়াতে গড়াতে দুচোখ আবার ভর্তি হয় জলে। পিহু কাঁপাকাঁপা কন্ঠে ডাকে,
‘ পাপা??
আদি চোখ এদিকওদিক ঘুরিয়ে তাকায় পিহুর দিকে। পিহুর গন্ডদেশ বেয়ে গড়ানো জলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ কেন কাঁদছ? আমি তো কেউ নয়!
পিহু আওয়াজ করে কেঁদে দেয়। ইশা আঁতকে উঠে ডাকে, ডক্টর?
আদি বলল,
‘ কোথাও একটা কিন্তু থেকে গেছে তাই হয়ত, মেয়ে আমাকে তার মনের কথা শেয়ার করেনি। আমি কি ভালো বাবা নই?
পিহু ঝাপটে জড়িয়ে ধরল আদিকে। আদি বলল,
‘ কেন ধরছ এভাবে? যাচ্ছ যাও। কাঁদার দরকার নেই। আমার জন্য কেন কাঁদবে? আমি তখন থেকেই পরীর বাবা ও নই, পিহুর ও না। আজ বুঝতে পেরেছি, আজ তুমি ও আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছ আমার জায়গা। গুডড। ভেরি গুড। বলে দেখতে পারতে, অতটা ও খারাপ না আমি।
পিহু হিঁচকি তুলে কাঁদে। কেঁদে কেঁদে বলে,
‘ সরি পাপা। আ’ম ভেরি সরি। কথা দিচ্ছি কখনো এমনটা হবেনা। সব বলব তোমায়। সবটা।
আদি পিহুকে বুক থেকে তুলে নেয়। ইশা দৌড়ে আসে। বলে,
‘ ডক্টর এমন সময় কেন কাঁদাচ্ছেন ওকে? কেন ডক্টর? দেখছেন, ও চলে যাচ্ছে।
আদি পিহুর চোখ মুছে দেয়। ইশাকে বলে,
‘ তুমি বলেছিলে কোনো একসময়, আমাকে বিয়ে করাটা তোমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল সিদ্ধান্ত। আমি ভুল মিষ্টি, তোমার জীবনে। ঠিক তেমন আমার সন্তানদের ও। একজন তো ছোট থেকেই দূরে দূরে ছিল। আরেকজন এতকাছে থেকে ও কত দূরে দূরে ছিল মিষ্টি। আমি বারবার কেন ব্যর্থ হই মিষ্টি? সবকিছু থেকে ও নেই আমার। তুমি ও এমন। মেয়েগুলো ও।

আমাকে আপন ভেবে বলতে পারতে পিহু, যে, তুমি বিয়েটাতে রাজী ছিলেনা। বারবার জিজ্ঞেস করেছি আমি তোমায়। তোমার বোঝা উচিত ছিল,
‘ মনের ভেতর চেপে রাখা কথা যদি সবাই বুঝতে পারতো তাহলে আর কোনোকিছুর প্রয়োজন হতোনা। না বলা কথাগুলো, না বলা অপ্রকাশিত ভালোবাসাগুলো এতসহজে হারাতো না। হারিয়ে যেত না। বলতে হয়, প্রকাশ করতে হয় পিহু। ভালোবাসা,প্রেম, মুগ্ধতা,মায়া, মমতা, পছন্দ লুকিয়ে রাখার বিষয় না পিহু। চেপে রাখার বিষয় না। চেপে রাখার বিষয়,লুকিয়ে রাখার বিষয় অপছন্দ, ঘৃণা, অসম্মান।

অপ্রকাশিত ভালোবাসাগুলো চেপে রাখার মতো তুচ্ছ বিষয়টার কারণেই অপ্রকাশিত থেকে যায়। চাপা পড়ে যায়।

পিহু কাঁদল হিঁচকি তুলে তুলে। সে বুঝতে পারেনা,,

‘ ভালোবাসার সংজ্ঞা কেন সবার কাছে এক নয়? অপ্রকাশ্যে ভালোবাসায় কেন এত যন্ত্রণা হয়?

ইশা পিহুর কান্না থামানোর চেষ্টা করে যায়। বুকের সাথে চেপে ধরে নিজে নিজেই হু হু করে কেঁদে দেয়। মেয়ের গালে,কপালে মমতার স্পর্শ এঁকে দিয়ে বলে,

‘ ভালো থেকো মা। ভালো রেখো সবাইকে। বাবার কথায় কষ্ট পেওনা। বাবা যাবে তোমার কাছে। আমি পাঠাবো। দেখবে, আমাকে ও বলতে হবেনা,নিজ থেকেই চলে যাবে। আর কেঁদোনা।

পিহুকে বারণ করে কিন্তু ইশা নিজেই উঠে আসা হিঁচকি সামলাতে পারল না। পিহু ইশার কান্না দেখে আর ও জোরে কেঁদে দেয়। পরী এসে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘ পিহু কি হচ্ছে? দূরে কোথাও যাচ্ছ না তো। কেন এমন করছ? আমমা তুমি ও কি শুরু করেছ?

ইশা ওই কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পিহুর হাত রিপের হাতের উপর রেখে কম্পিত কন্ঠে সিক্ত হয়ে বলল,
‘ রিপদা সেই ছোটবেলা আমার দুমুঠো ভাতের অভাব তুমি হতে দাওনি। স্নেহ, মমতা,ভালোবাসার অভাব হতে দাওনি। আমাকে সারাজীবন তুমি আগলে রেখেছ। আমার গায়ে তোমার অজান্তে কাঁটা লাগলে ও তোমার জানামতে তা কখনো হয়নি। আমাকে সবসময় অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছ রিপদা। এখনো আছ। ঠিক সেভাবেই আমার মেয়ের মাথার উপর ও অভিভাবক হয়ে থেকো সারাজীবন। আমি জানি,তুমি ও ওকে আগলে রাখবে। তোমার ছেলের বউ নয়,মেয়ের মতো ওকে আগলে রেখো। দেখে রেখো। তোমার ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয় রিপদা। দেখোনা, এখন তো বাড়ছে। আমি ও চাই তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকতে। তুমি আমার মেয়ের মাথার উপর ছাদ হয়ে থেকো, ঢাল হয়ে থেকো। সবাইকে ভালো রাখার ক্ষমতা আল্লাহ তোমায় দিয়েছে রিপদা৷ তোমার কাছে সবাই ভালো থাকবে। আমার বিশ্বাস তুমি সবাইকে ভালো রাখবে। তুমি ও ভালো থেকো রিপদা।

রিপ আঁখিজলে ভাসে। ইশার মাথার উপর হাত রেখে বলে,
‘ ইশু তোকে কতটা ভালো রাখতে পেরেছি জানিনা। কিন্তু তোকে কথা দিচ্ছি, তোর মেয়েকে আমি আমার মা বানিয়ে রাখব। আমার রাজকন্যা বানিয়ে রাখব। আমার অভিভাবক বানিয়ে রাখব। আমি ও যে অভিভাবকহীন। আমার এমন একটা মায়ের খুব দরকার। তোদের তো একটা দিয়ে ফেলেছি, দেখ আরেকজনকে নিয়ে এসেছি। আর দেবনা তোকে। এই মা টা ও অনেক সাধনার ফল। আজ পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষটা এই আমি। আজ আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারব,
‘ সবচাইতে সুখী মানুষটা আমি। হ্যা আমি। আমি যা চেয়েছি তা পেয়েছি। এ যেন পিহু মাহিদের খুশির দিন নয় ইশু। আমার খুশির দিন। ইশু!
‘ মানুষ বেশি কাঁদে কোনদিন জানিস? যেদিন মানুষ জীবনের সবচাইতে খুশির খবরটা শুনে কিংবা দেখে। এই কান্নার কিন্তু শব্দ হয়না, এই কান্নার রঙ নেই, রূপ নেই, আকার নেই। এই কান্না অদৃশ্য। এই কান্না নীরবে হয়, নিঃশব্দে হয়। ইশু বুঝিস?
ইশা হা করে তাকিয়ে থাকল। বলল,
‘ বুঝি। নীরব কান্না কিন্তু খুব বেশি দুঃখের সময় ও হয়। যখন, দহনের জ্বালা কাউকে বলতে পারা যায়না। কারো সাথে খোলাখুলি বলা যায় না। তখন ও হয়। তখন ও কিন্তু নীরবে নিঃশব্দে কান্না করে মানুষ। সেই কান্না ও তখন কেউ বুঝতে পারেনা। উপলব্ধি করতে পারেনা। অনুভব করতে পারেনা। খুব বেশি আনন্দ আর খুব বেশি কষ্ট একে অপরের পরিপূরক রিপদা।

রিপ হাসল। বলল,

‘ আজ ও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তুই দুই সন্তানের মা। সেই ছোট্ট ইশুনা তুই? কতবড় বড় কথা বলতে পারিস এখন? কতবড় সংসারের দায়ভার তোর উপর? কতগুলো মানুষকে ভালোরাখার দায়িত্ব তোর উপর। যাইহোক, কি বলছিলি না। খুব বেশি খুশি আর খুব বেশি কষ্ট একে অপরের পরিপূরক। তাহলে বলব,

‘ তুই সত্যি বলেছিস।

দুঃখ গিয়ে যেমন সুখ আসে। আঁধার কেটে যেমন আলো নামে। রাতে শেষে যেমন দিন নামে ঠিক তেমন আমার জীবনে ও আজ খুশির ঢল নেমেছে। আজ মন কেমনের বৃষ্টি পড়ছে দেখ। কি সুন্দর ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। দেখ মন কেমন করা বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টিটা আমার ইশু। আমার জন্য পড়ছে। তুই খুশি হসনি?

ইশা হাসল। কান্নাজলে ভাসতে ভাসতে বলল,
‘ আমি খুব খুব খুশি রিপদা। আচ্ছা, এতদিন কি তোমার জীবনে অন্ধকারাচ্ছন্ন কিছু ছিল রিপদা? হঠাৎ এমন কথা কেন বললে?
রিপ আওয়াজ করে হেসে দেয়। বলে,
‘ যার নীরার মতো জীবনসঙ্গী থাকে তার জীবনে অন্ধকার? তোর ও তো একজন আছে, নীরার মতো। আদি?? তোর জীবনে কি অন্ধকার আছে?
আদি আর নীরার মতো জীবনসঙ্গী থাকলে তাদের জীবনে অন্ধকার থাকেনা ইশু। থাকেনা।
ইশা হাসল। বলল,
‘ তুমি ভালো থেকো রিপদা। খুব ভালো থেকো। তোমার মতো মানুষগুলোকে নিজের জন্য না হলেও অপরের জন্য ভালো থাকতে হয়। আশপাশের সবাইকে ভালো রাখার জন্য ভালো থাকতে হয়। সবাইকে আগলে রাখার জন্য ভালো থাকতে হয়।

রিপ বলল,
‘ তোর জামাই বাবাজির হাতে তোর মেয়েকে তুলে দিয়ে আয় এবার। কিছুক্ষণের মধ্যে ভারী বৃষ্টি নামবে। তাড়াতাড়ি যাহ। গাড়ির ভেতর বসে ফোন টিপছে।
ইশা গেল। গাড়ির ভেতর উঁকি দিয়ে বলল,
‘ জামাই বাবাজি আপনি আছেন?
মাহিদ সাহেবের মতো করে নড়েচড়ে বসে বলল,
‘ কিতা হইছে বাপের বইন। আমার বউরে আসতে বইলো, বর তার লাইগা কখন থেইকা বইসা আছে এখানে। আসতে কও৷ আবার এসব কথা কাউরে কইওনা। তুমি আর দিদিয়া ছাড়া বাকি সবাইরে আমার শরম করে। বউটারে ও।
ইশা উচ্চস্বরে হেসে দেয়। সরে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ এই নে তোর বউ।
মাহিদ চোখ বড় বড় করে তাকায়৷ পিহুকে দেখল, যেন যমরাজকে দেখল। তাড়াতাড়ি মাথা নিচে নামিয়ে ফেলে মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমি কিছু কইনায় বাপের পোলার বউ। কিছু কইনায়৷

ইশা বলল,
‘ বের হ গাড়ি থেকে। নইলে তোর বাপকে ডাকছি। মাহিদ বের হলো গাড়ি থেকে। ইশাকে বলল,
‘ ওই দেখো সবাই কেমন কইরা দেখে। যেন আমি বউ সাজছি। লজ্জা করেনা?
ইশা হাসল। হাত ধরে টেনে পিহুর হাতের নিচে তার হাত রেখে বলল,
‘ এই ধর। শক্ত করে। আর ছাড়িস না। ছাড়লে মাইর চলবে।
মাহিদ তার হাতটার দিকে তাকালো। মিনমিন করে বলল,

‘ আমার হাত বাপ নিচে থাকব ক্যান? উপরে থাকবো।
পিহুর হাতের উপর সে হাত রাখল। বললল
‘ ছাড়লে মাইর।
সবাই একসাথে হেসে উঠল। পিহু মাথা নামিয়ে হাসল।
‘ ঢিলা জামাই তার।

__________________________

সবাই গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ছাড়ল। পরী রেহান অন্য গাড়িতে করে আসল। রাহি জেদ ধরায় পিহুর সাথে বসিয়ে দিল তাকে। মাহিদ আর পিহুর মাঝখানে বসিয়ে দিল তাকে। রাহি মাহিদকে বলে,
‘ শুশুর বাড়ি যাচ্ছি কেন?
মাহিদ কিছু বলতে চাইল। পিহু থাকায় বলতে পারল না। পিহু বাইরে তাকিয়ে আছে। রাহি বলল,
‘ কিউ কুথা বুলেনা কেন?
পিহু বলল,
‘ কি বুলব?
‘ মিহি কুথা বুলেনা কেন?
পিহু বলল,
‘ নজ্জা।
মাহিদ সব সহ্য করল । রাহি বলল,
‘ নজ্জা পায় কেন? মিহি বউ কেন?
পিহু আওয়াজ করে হেসে দিল। মাহিদ চিমটি দিল রাহিকে।
রাহি বলে,
‘পিঁপড়া কামড়ায় কেন? ছিকু ব্যাথা পায় কেন?
মাহিদ মন মনে হাসল। বলল,
‘ জামাইবাবাজি আর লড়তে আসবা শ্বশুড়ের লগে? আসবা??

_______________________

সন্ধ্যা নামতে নামতেই পুরো খান বাড়ি আত্মীয়স্বজনে ভরে গেল। পিহুকে নতুন করে সাজানো হলো। সাজ সাজ রব নিয়ে পিহু পুরো রুমটাতে এলেমেলো ঘুরল। কি আশ্চর্য! আজ থেকে এটিই তার ঘর। এটিই তার বাড়ি। পাগলা জামাইটা গেল কই? একবার ও দেখা পাওয়া গেল না তার। নিনিত আর জালিশা এল। নিনিতের ভারী লজ্জা। কাল এসেছিল বিয়ে করতে,আজ এসেছে বন্ধুর বউ দেখতে। ইশশশশ!!!
পিহু নিনিতকে বলল,
‘ স্যার সব ঠিকঠাক।
নিনিত বলল,
‘ কষে চড় বসাতে ইচ্ছে করছে। তোমাকে আর তোমার বরকে। জালিশা না থাকলে কি হতো? আশ্চর্য! আমাকে বলবে না?
পিহু লজ্জা পেয়ে গেল। নিনিত বেরিয়ে গেল।মাহিদ নিনিতের হাতে চিমটি কেটে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমার বউ আমি মারুম। তুই ক্যান মারবি শালা?
নিনিত বলল,
‘ এসব চিমটাচিমটি বউয়ের লগে করিস ভাই। বউ খুশি হইবো।
মাহিদ হাত দিয়ে কান চাপা দিল।
‘ ছিঃ ছিঃ কানটা উড়ে গেল বাপ। কি বিশ্রী কথাবার্তা! ছিঃ ছিঃ

জালিশা পিহুকে বলল,
‘ আমি কাল কানাডা চলে যাব আরিশা।
পিহু চমকায়। বলে,
‘ এত বড় সিদ্ধান্ত কেন? আমার কারণে কি তোমার কোনো ক্ষতি হলো?
জালিশা বলল,
‘ না না তোমার জন্য কিছু হয়নি। সব আমার লাক। যাইহোক, কনগ্রাসুলেশন অন ইয়োর উইডিং। খুব ভালো থেকো।
পিহু বলল,
‘ তোমাকে ও। স্যার খুব ভালো মানুষ। তোমাদের দুজনকে একসাথে দেখে খুব ভালো লাগছে। তুমি স্যারকে পছন্দ করো এটা জানলে আমি নিজে থেকেই বিয়েটাতে মত দিতাম না।
জালিশা হাসল। বলল,
‘ তোমার স্যার আর স্যারের মা বিয়েটা মানেনা। মানার কথা ও নয়। বিয়েতো হয়নি।
পিহু বলল,
‘ কিন্তু!!!
জালিশা থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ কোনোকিন্তু নয় আরিশা। আমি চলে যাব।
পিহুর মন খারাপ হয়ে গেল।
খাওয়া দাওয়া, আচার অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি খালি হলো। সবাই গল্পের আসর বসালো ড্রয়িংরুমে। রেহান মাহিদকে গুঁতো দিয়ে বলল,
‘ বাসর রাত আজ হব্বে না। ফুল টুল আনিনাই। কাল কাল শালাবাবু।
মাহিদ জিভে কামড় দিল। বলল,
‘ ছিঃ। কি শুনলাম। কান উড়ে গেল বাপ।
রেহান হো হো করে হাসল। বড়রা সবাই গল্পকরছে একপাশে বসে। রেহান বোর বোর হতে হতে লুডুবোর্ড নিয়ে আসল। পরীকে ডাকল,
‘ পরী পিহুকে নিয়ে এসো। লুডু খেলব। রাহি দৌড়ে আসল।
‘ আমমি খেলব না কেন?
রেহান বলল,
‘ চুপচাপ পাপার পাশে বসো।
‘ পাপার পাশে ছিকু বসবে কেন?
‘ আমার মাথার জন্য।
মাহিদ হা হু করে হেসে উঠল। পিহু আসল। বলল,
‘ কি হয়েছে দাভাই?
রেহান বলল,
‘ আমি আর তুমি। তোমার দিদিয়া আর মাহিদ। খেলা জমবে। এসো। বসো।
মাহিদ পরীর সাথে ঘেঁষে বসল পিহু তার পাশে বসায়। পরী রেহান মিটিমিটি হাসল। পিহুর রাগ লাগল,
‘ অসভ্য বর।
খেলার মাঝখানে মাহিদ চিল্লিয়ে বলে উঠল,
‘ ওরে ছক্কা বাপ তুই উঠস না ক্যান বাপ? ক্যান উঠোস না।
রাহি আসল। গুটি একবার উল্টে দিয়ে বলল,
‘ আমি খিলবো।
মাহিদ গুটি আবার বসিয়ে বলল,
‘ ধুরর বাপ। তুই যাহ। শালা ডিস্টার্ব করস কিল্লাই?
রাহি গলা একপাশে কাত করে ফেলল। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ আমি খিলবো। না নিলে??????
মাহিদ বলল,
‘ না দিলে কি করবি বাপ? কি করবি? যাহ ফুটট৷
রাহি একপাশে গলা কাত করে ফেলে বলল,
‘ আমি খেলব, না নিলে লুডুতে সুসু করে দেববো।
মাহিদ চোখ পাকিয়ে বলল, কি???
রাহি বলল, সুসু করে দিব।
মাহিদ উল্টে পড়ে গেল পিহুর গায়ের উপর। পরী উল্টে পড়ল রেহানের উপর।
রাহি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, সুসু করে দেব না কেন?
পিহু চোখ খিঁচে বন্ধ করে রাখল। মাহিদ তাড়াতাড়ি পিহুর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে উঠে গেল৷ চলে যেতে যেতে বলল,
‘ তুই পরীর বাচ্চা ছিকুরে আমি মাইয়া দিতাম না। সুসু করার আর জায়গা পাইলো না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here