মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৩৬ (সিজন ২)

0
601

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৬ (সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ফজরের আজানের সাথে সাথে করিডোরে বসে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা মানুষগুলোর চোখ খুলে গেল হঠাৎ ৷ ছোট্ট ছোট্ট হাত পা নেড়ে কেবিন ফাটিয়ে কেঁদে পৃথিবীতে আগমনের জানাল দিল নতুন মেহমান। দুরুদুরু বুক কেঁপে উঠল সবার। ঘুমঘুম চোখ নিয়ে সবাই এদিকওদিক তাকাল।
নীরা দৌড়ে গেল পায়চারি করা লোকটার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ ব্যারিস্টার কিছু শুনতে পেয়েছেন?
রিপ অনবরত এদিকওদিক হেঁটে কপালের ঘাম মুছল। বলল,
‘ বেশি কথা বলোনা নীরা। চিন্তা হচ্ছে।
নীরা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হওয়া ডক্টরের কাছে ছুটে গেল আদি, ইশা। নার্সের কোলে ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা। আলো পড়ায় চোখ খিঁচে বন্ধ করে রয়েছে। হাতের তালু শক্ত করে মুঠি করা। মাথায় লেপ্টে রয়েছে চুল। দন্তহীন গালের ভেতর লাল টকটকে জিহ্বা দেখিয়ে জানান দিচ্ছে মায়ের স্পর্শ পাওয়ার আকুতি মিনতি। মায়ের বুকের স্তন পান করার আবদার৷ টপ টপ টপ চোখের নোনাজল গড়াল ইশা আর নীরার। নার্সের কোল থেকে কাঁপাকাঁপা হাতে ছোট্ট বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে নিল ইশা। নরম তুলতুলে তুলোর মতো হৃষ্টপুষ্ট শরীর। ডাগর ডাগর চোখদুটো খিঁচিয়ে বন্ধ করা। কাঁটা থুতনির উপর আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল ইশা। নীরা বলল,
‘ ইশু আমাকে দে না?
ইশা দিয়ে দিল নীরাকে। আদি ডক্টরকে জিজ্ঞেস করতে চাইল কিছু একটা। তারমধ্যে হুড়মুড় করে চলে এল একটি ছেলে। এলোমেলো চাহনি দিয়ে সবাইকে দেখল। নীরার কোলে কিছু একটার টের পেয়ে ও সেদিকে তাকাল না। সবাই হা করে তাকিয়ে থাকল। মাহিদ ডক্টরের দিকে তাকাল। হাতের কব্জি দিয়ে মুখ মুছে বলল,
‘ সাইড দিন। আমি ভেতরে যাব।
রিপ এসে আটকাতে চাইল। মাহিদ হাত ছাড়িয়ে নিল তাড়াতাড়ি। গর্জে বলল,
‘ কি হয়েছে?
রিপ ভড়কে গেল। নীরা বলল,
‘ আব্বা এই দেখ, এই,,,
মাহিদ ডক্টরকে বলল,
‘ আমি ভেতরে যাব।
ডক্টর বলল,
‘ এখন দেখা করতে দেওয়া যাবেনা। পেশেন্টের সাথে এখন দেখা করে লাভ ও নেই।
মাহিদ শুনতে চাইল না। বলল,
‘ আমি ওর সাথে কথা বলব।
রিপ মাহিদকে টেনে নিয়ে এল। বলল,
‘ এটা হসপিটাল মাহি । যেখানে সেখানে তোর জোর খাটবে না।
মাহিদ অসহায় চোখে চেয়ে রইল। বলল,
‘ আমি শুধু একবার কথা বলে চলে আসব।
রিপ কথা বলতে চাইল না মাহিদের সাথে। মাহিদ বলল,
‘ আমি যাব।
রিপ বলল,
‘ যেতে পারবি না।
চেঁচিয়ে কেঁদে উঠা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ কানে এল মাহিদের। কানচাপা দিয়ে সে বলে উঠল,
‘ আহা থামাও না।
রিপ গর্জে উঠে, মাহি?
মাহিদ বেঞ্চে বসে পড়ে। আদি জিজ্ঞেস করল ডক্টরকে।
‘অপারেশন সাকসেসফুল?
ডক্টর বললেন,
‘ সাকসেস বাট প্রথম সন্তান হওয়ায় আপনার মেয়ে প্রচন্ড,,
আদি কম্পিত গলায় জানতে চাইল,
‘ কি হয়েছে ??
ইশা বলল,
‘ পিহু? না? ডক্টর আমার পিহু?
আদি বলল,
‘ এসব কি বলছ মিষ্টি?
ইশা সবাইকে ঠেলেঠুলে ডুকে পড়ল অপারেশন থিয়েটারে। নিথর হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে ইশা। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে মুখ ছুঁয়ে ডাকতেই শান্ত হয়ে গেল ইশা। বাকহারা হয়ে পড়ল মুহূর্তে। চোখের নোনাজল গড়াল গাল বেয়ে। পড়ল বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটির মুখে। তরতর করে কাঁপতে কাঁপতে ইশা ডাকল,
‘ ডক্টর? রিপদা?

_________________

চোখের আশপাশ ভিজে থাকা ছেলেটি কেবিন থেকে বহুদূরে দাঁড়িয়ে। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নীরা এগিয়ে গেল ছেলেটির দিকে। কোলে ছোট্ট বাচ্চাটি কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হয়েছে। নীরার উপস্থিতি টের পেল ছেলেটি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নীরার দিকে। নীরা বাচ্চাটির দিকে বলল,
‘ আব্বা এই দেখ তোর বাচ্চা, একটিবার কোলে নে?
মাহিদ ছলছলে চোখ লুকোতে চাইল মায়ের থেকে। নীরা ও টলমলে চোখে কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ আব্বা এ তোর ভবিষ্যৎ। একবার তাকিয়ে দেখ, মা বাবা দুজনের চেহারা পেয়েছে। দেখ কি সুন্দর চোখ, কি সুন্দর মুখ। কি আদুরে। কি নরম তুলতুলে। আব্বা কোলে নিবিনা?
মাহিদ তারপর ও বাচ্চাটির দিকে তাকালো না। নীরা বলল,
‘ আব্বা তাকা একবার। একটিবার দেখ। দেখ কার মতো হয়েছে। একটু আদর করে দে।
মাহিদ নীরার থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল নীরার কোলে থাকা বাচ্চাটির দিকে। নীরাকে জিজ্ঞেস করল কাঁপাকাঁপা গলায়,
‘ আমি নেব?
নীরা যেন কান্নাহাসিতে একাকার হলো। চোখ দুটো এক হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল,
‘ আব্বা ওকে ও মারিস না। সহ্য করতে পারবেনা।
মাহিদ তাড়াতাড়ি নীরাকে পিছু করে দাঁড়াল কিছু লুকোতে। নীরা বলল,
‘ মুখ ফিরিয়ে নিলি কেন আব্বা? এই বাচ্চাটাকে ও কি মারবি?
মাহিদ দেয়ালে হাত দিয়ে দাঁড়াল। নীরা ডাকল,
‘ আব্বা কোলে নিবিনা?
মাহিদ হাতের কব্জিতে চোখমুছে সামনে ফিরল আবার। নীরার কোল থেকে বাচ্চাটি কোলে নিয়ে নিল। প্রথম নিজ সন্তানকে কোলে নেওয়ার অনুভূতিতে মাথা চোখ আর উপরে তুলতে পারল না সে। দূরন্ত বাউন্ডুলে ছেলের এইরূপ দেখে নীরা কাঁদল। রিনরিনে গলায় বলল,
‘ আব্বা আদর করে দে। দেখ তোর আদর পাওয়ার আশায় বসে আছে।
মাহিদ কোলে থাকা বাচ্চাটিকে দুহাতে উপরে তুলে ধরে মুখের কাছে এনে আটকে গেল। বাচ্চাটি চিল্লিয়ে কেঁদে উঠল। মাহিদ বাচ্চাটির নরম তুলতুলে গালের পাশে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল শক্ত করে। বাচ্চাটি কাঁদতে কাঁদতে শান্ত হয়ে গেল নিমেষেই। নীরা ওই দূরে কেবিনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,
‘ ওখানে যাবিনা আব্বা?
মাহিদ নীরার দিকে তাকিয়ে থাকল।
নীরা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে বলল,
‘ যাবিনা? যা।
মাহিদ এক পা এগিয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকাল। আবার নীরার দিকে চেয়ে ডাকল,
‘ মা???
নীরা ফিরল না। মাহিদ টালমাটাল পায়ে এগোলো। এগোতে এগোতে পা আটকে গেল কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে। গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ ভেসে এল।
ইশার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রাখার কারণে মেয়েটিকে দেখা গেলনা। পরী রেহান দাঁড়িয়ে রইল ইশার মাথার কাছে।
মাহিদ দেখল না মেয়েটিকে । কোলের বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আবার ওই শোয়া মেয়েটির দিকে তাকালো। ছোট্ট একটি বাচ্চা কোথা থেকে দৌড়ে এসে পা আঁকড়ে ধরল মাহিদের। বলল,
‘ মিহি পিহু কুথাই? পিহু নাই কেন? মিহি চুপ কেন? কিউ কিছু বুলেনা কেন? মিহি মিহি কুথা বুলোনা কেন?
মাহিদ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কোলের বাচ্চাটি কেঁদে কেঁদে উঠল। মাহিদ বাচ্চাটির কান্না দেখল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here