মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৩৭

0
650

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৭
#পুষ্পিতা_প্রিমা

কয়েকদিন ধরে খাঁচার ভেতর বন্দী পাখিটার খোঁজ কেউ নেয় না। পাখিটা খিদে লাগলে যন্ত্রণায় ছটপট করে। ডাকে, আদি,মিষ্টি। আদি মিষ্টি।
আদি মিষ্টি আসেনা। ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি হাত বাড়িয়ে ডাকে, মিননননি…আমমাল আমমা নাই। নাই নাই। ইশআআ নাই। কুথাইই আমমা? আমমমা তো নাইই। মিততি নাই। ইশআ নাই। আমমা নাই।
খাঁচার ভেতর মিনি ডানা ঝাপটায়। আদি এসে খুলে দেয় সেই খাঁচা। খাবার দেয় মিনির। বলে, সরি মিনি, আমি তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি। কিন্তু কথা দিচ্ছি এবার থেকে আর অযত্ন হবে না।
মিনি খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পরী হেসে দিল খিক করে। আদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আববা আমমম।
আদি তাকে কোলে নিয়ে নেয়। ছোট্ট গালটার একপাশে আদি গাঢ় চুম্বন দেয়। পরী খিলখিল করে হেসে বলে, আববা পাপ্পি না, আমম। আমম নাই? আম কুথাইই?
আলিয়া চলে আসে। আদির মলিন হওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বলে, আর কতদিন আদি? এবার ফিরে চলো। মেয়েটাকে ঘরে তুলি?
আদি কিছু বলল না। পরী হাত ঘুরিয়ে বলল, আম নাই। আমমা ও নাইই। আমমাল আমমা নাই দাদ্দা। আমমা নাই??
আলিয়ার খারাপ লাগল। বলল, পরী এসব কি বকছে আদি? তুমি সবসময় ওর সামনে ওসব কথা বলো কেন? সব ভুলে সবকিছু নতুন করে শুরু করা উচিত। আর ওই মেয়েটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছ? ওর কি দোষ? দোষ তো ওর না। কিন্তু তারপরও ওঁ কষ্ট পাচ্ছে। তুমি না বুঝলে কে বুঝবে? তুমি তো ওর স্বামী।
আদি দাঁড়িয়ে থাকে সোজা হয়ে। আলিয়া তার কোনো জবাব না পেয়ে বলে,
‘ আমি ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। তুমি না করো না।
আদি এবার ত্যাড়া জবাব দেয়।
‘ এসব অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এটেন্ড করতে পারব না।

‘ ঠিক আছে। তুমি যেওনা। পরী আর পরীর মা যাবে। তাদের জন্যই করা।

‘ পরীর মা মারা গেছে। ও পরীর মা নয়।

পরী আদির মুখের দিকে তাকায় আবার আলিয়ার মুখের দিকে। হাত ঘুরিয়ে বলে,

‘ পরীইইই নাই। নাই,নাই। পরীরর আমমা নাই। আমমাল আমমা নাই।

আদি তাকে জড়িয়ে ধরে হেঁটে হেঁটে চলে যায়। তারা সরতেই আলিয়ার সামনে দৃশ্যমান হয় শাড়ি গায়ে একটি মেয়ে। আলিয়া হাসার চেষ্টা করল । মেয়েটি হাসল না। বিষণ্ণ মুখে চেয়ে রইল আদির যাওয়ার পানে। মিনি খেয়ে ডানা ঝাপটা দিল। সুর তুলে গাইল,
‘ দুক্কু, দুক্কু, আদি ব্যাড বয়। ব্যাড বয়।
মেয়েটির চোখে কান্নারা ভাসে। আলিয়া তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আলতো করে মুখটা ছুয়ে দিয়ে বলে,
‘ ও না যাক। তুমি গেলেই হবে। ও একটু একা থাকুক ওর মেয়েকে নিয়ে।
মেয়েটি চুপচাপ শোনে আলিয়ার কথা। কোনো কথা না বলে চলে যায়।
আদি বেরিয়ে যায় তার মেয়েকে নিয়ে। বাবা মেয়ে ঘুরে সারাদিন। বাইরে খায়। ছোট্ট পরীকে নিয়ে বাসায় ফিরে প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ। পরীর হাতে বেলুন, নানারকম চকলেট বক্স। হাতের চুড়ি, গাড়ি,পুতুল। ছোট্ট পরী আজ খুব খুশি। আদির কোল থেকে নামা মাত্রই দৌড়ে যায় আলিয়ার কাছে। বলে, আমমাল। দাদ্দা,,,, এততততো আমমমাল। পরীইরর।
বারান্দায় উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির পিছু গিয়ে দাঁড়ায় পুতুল হাতে। শাড়ির আচঁল ধরে টান দিয়ে পুতুল দেখিয়ে বলে,

‘ আমমাল দল।

রিনরিনে গলার স্বর কানে ভাসতেই মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বাচ্চাটির মুখের দিকে। হাটুমুড়ে বসে মেয়েটির মুখের কাছে। গালের দুপাশে আদর দিয়ে বলে,

‘ আমাকে আমমা ডাকো মা।

পরী মাথা দুলিয়ে ডাকে, আমমা।

সাথে সাথে আচমকা পরীর হাত ধরে হেঁচকা টান মারে আদি। তার সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে বলে,

‘ ডাকবে না কখনো। তোমাকে বলেছি না।

পরী কাঁদোকাঁদো হয়ে যায়। মেয়েটি টলমলে চোখে বিধ্বস্ত চেহারায় তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে। এ ছেলেটাকে সে চিনতে পারছে না মোটে ও।
পরীকে ধমকে আদি বলে উঠে বলে,

‘ আর ডাকবে? বলো আর ডাকবে?

পরী তার মুখে মুখে কেঁদে কেঁদে বলে,

‘ আদ দাব্বে। আদ দাব্বে?

আদি ভয়ানক রেগে যায়। বলে, বলো আর ডাকব না। ডাকব না। বলো।

পরী মুখে মুখে বলে,

‘ দাববো না। দাববো না।

বলা শেষ করতে না করতেই পরী চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,

‘ আমমা কুথাইইই? আমমা নাই?

আদি জড়িয়ে ধরে শক্ত করে । বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,

‘ নেই। আমমা নেই। আমি আছি। আমি থাকব।

বাবা মেয়ের কথা শোনার অপেক্ষা করল না মেয়েটি। ডুকরে কেঁদে উঠে চলে গেল। আদি পরীকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় বলল,

‘ ঠোঁটে ব্যাথা আছে আম্মি?

পরী কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘ দুক্কু। আববা দুক্কু। পাপপা মামমা রিইই পাপ্পি। আমমা নাই। নাই নাই। আমমা কুথাইই? আমমা ওততো না?

আদি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায় জবাব দেয়,

‘ চলে গেছে তোমার আমমা। মরে গেছে। নেই।

পরী এবার গুনগুন করে কাঁদে। আমমা নাই। আমমা নাই।

________________

বাবার গায়ে সাদা ধবধবে পান্জাবী। ছোট্ট মেয়েটির পড়নে সাদা ফ্রক। বাবার হাতের আঙুল ধরে হেঁটে হেঁটে এল একটি কবরের সামনে। দিনটি জুমাবার।
পরী কবরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল, আমমা কুথাইই?
আদি তাকাল মেয়ের নিষ্পাপ চোহারাটার দিকে। মেয়ের সামনে বসে আঙুল দিয়ে কবর দেখিয়ে দিয়ে বলে,
‘ আমমা ঘুমম।
পরী পিটপিট চোখে চেয়ে রইল কবরের দিকে। আমমা ঘুমালে ও কিভাবে ঘুম ভাঙাত যেন?
পরী ভাবতে লাগল। মনে পড়েছে অনেকক্ষণ পর। আমমার পেটে সুড়সুড়ি দিত,নয়ত গালে লালা লাগিয়ে দিত। নয়ত গলায় কাছে গিয়ে নাক ঘষত। এখন ও এমন করলে আমমা উঠে যাবে না?
পরী গেল কবরের কাছে। বসল। কবরের মাটিতে হাত বুলিয়ে ডাকল, আমমমমা ঘুমমম???

আদি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল।
বাচ্চা মেয়েটি আবার ডাকল, আমমা কুথাইইই?
কোনো আওয়াজ আসল না। আমমা বলে উঠল না,

‘ আমি এখানে মা। মা কি আমায় খুঁজছে?

পরী কবরের মাটিতে কান লাগিয়ে দিল। বলল,
‘ আমমমা পরীইইই এক্কাননে। আমমি এক্কাননে। আমমা কুথাই? আমমা আম? আমমা পরী দুক্কু। আমমা?

আমমাকে এত দুঃখের কথা শোনাচ্ছে আম্মার কোনো সাড়াশব্দ নেই। পরী এবার কেঁদে দিল। নাক কেঁপে কেঁপে উঠল তার কন্ঠস্বরের সাথে। তার খিদে পেয়েছে তাই কবরের মাটি হাতে নিয়ে গালে দেওয়ার মতো করে বলল,
‘ আমমা আম? আমমা?
আদি দৌড়ে এল। হাত থেকে মাটি ফেলে দিয়ে বলল,
‘ এসব খাইনা মা? আমি খাবার এনেছি। খাবে??
পরী দুপাশে মাথা নাড়িয়ে কেঁদে কেঁদে না বলল।
বলল,
‘ আমমা আমম। আমমমা খাববে? পরীইই খাববে।
আদি পান্জাবীর হাতায় চোখ মুছল। কিছুক্ষণ পর চোখদুটো তুলে বলল,

‘ আমমা ও খাবে। আমরা ও খাব। আববার ও তো খিদে পেয়েছে?

পরী আদির চোখের পানি মুছে দিয়ে গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলল,

‘ আববা দুক্কু। পরীইইই দুক্কু। আমমা কুথাই? আমমা আয়। খাববো।

আদি পরীকে বসিয়ে দিল মাটিতে। সাদা ফ্রকটাতে লেগে গেল কবরের আশেপাশের কাদা। আদি খাবারের প্যাকেট খুলে পরীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘ তুমি খেলে তোমার আমমা ও খাবে। এখন ও কি খাবে না?

পরী আদির হাত থেকে খাবারের প্যাকেটটি কেড়ে নিল। কবরের পাশে রেখে হাতে কিছু তুলে নিয়ে অদৃশ্য কিছুর সাথে বকবক করতে করতে বলল, আমমমা উমম উমম। খাহ। খাহ। মদা মদা। উমম উমম। আমমা খাবববে না? আমমা? পরররী আমম? আমমা কুথাইই, খাববে না? খাহ। আমমা খাহ।
আদি অপলক চেয়ে রইল কবরটার দিকে। মেয়ের কান্ড দেখতে লাগল। পরী সব খাবার ঢেলে দিল কবরের পাশে। মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগল,আমমা মদা মদা। উম উম খাহ। আমমা পররী আম নাই। আম নাই।
আদি ডুকরে কেঁদে উঠল। মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, আছে আম আছে। বাসায় চলো। খাবে চলো।
পরী তার বুক থেকে সরে দাঁড়াল কিন্তু গেল না। কবরের উপর মাথা দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে বলল, ইননা আমমা। আমমাল আমমা খাবেনা । পররীর আমমা।
পরী তার পাশ থেকে তার পুতুলটি দিয়ে দিল আমমাকে। বলল, দল আমমাল। এততো আমমাল। আমমা কুথাইই। পরীইই দুক্কু। আমমা আতো। আমমা আতো।
দূরে দাঁড়ানো রিক এগিয়ে আসে। পরীকে কোলে নিয়ে আদিকে বলে,
‘ আমি বাসায় যেতে পারতাম ওঁকে নিয়ে আসার জন্য। ওঁকে এখানে কেন আনলে?

আদি চোখ মুছে বলল, ও আসতে চাইছিল। খাচ্ছিল না। বাসায় নিয়ে গিয়ে খাওয়াবেন। সারাক্ষণ প্রশ্ন করছে আমমা কোথায়?

পরী চোখ কচলে কচলে চেঁচিয়ে কাঁদল। আমমা আমম? আমমা দুক্কু? পরীইই দুক্কু।
রিক তাকে যতই নিয়ে যেতে লাগল পরী তার কোল থেকে নিচে নামার চেষ্টা করল। রিকের কোল থেকে নেমে বৃষ্টি ভেজা কবরের মাটি আঁকড়ে ধরল শক্ত করে হাতের মুঠো দিয়ে। একদলা কাদা চলো আসল হাতের মুঠোয়। পরী কাদা ছুয়ে ছুয়ে কেঁদে কেঁদে বলল, আমমা আমম খাববো। আমমা কুথাইই? ইশআআ কুথাইই? ফিপি কুথাই? নাই? পাপপা আমমা নাই? আববা আমমাল আমমা নাই??
রিক চোখের জল আড়াল করে কাঁদল। মাথা নিচু করে বসে থাকা ছেলেটি মাথা নিচু করে কাঁদল। মেয়ের আহাজারি সে সইতে পারছে না। কবরে কি করে শুয়ে আছে মেয়েটি? মেয়েটি তো তার মা! মা কি এতটা পাষাণ হয়?
ছেলেটির চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল
‘ এই পুরো জাহানে তুমিই একমাত্র মা মিষ্টি, যে সন্তানের ডাক শুনতে পায়না। সন্তানের চোখের জল তোমার হৃদয় স্পর্শ করতে পারে না। তোমার তো হৃদয় ও নেই মিষ্টি। এমন একটা হৃদয়হীন মেয়েকে কি করে আমি ভালোবাসলাম? কি করে আমি এতবড় ভুল করলাম। আমি যে ভালো নেই মিষ্টি। তুমি ভালো থাকতে দাওনি আমায়। তুমি আমার ভালো দেখতে পারো না মিষ্টি। আমি ঘৃণা করি তোমায়।

রিক পরীকে কোলে নিয়ে হাঁটা ধরল। পরী হাত বাড়িয়ে কেঁদে কেঁদে চলে যেতে লাগল। আদির দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকল, আববা আমমা কুথাই? আমমাল আমমা কুথাই? আমমা পরররী আম। আম। আমমা? আববা?
আদি তাকিয়ে দেখল মেয়ের যাওয়া। আদি কেঁদে উঠল। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পরীর যাওয়া। বলল, মিষ্টি তুমি তো একেবারে ছেড়ে চলে গেলে। ওই দেখো আমার মেয়েটা ও আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তুমি আমার সন্তানকে ও আমার কাছে দিয়ে গেলে না। আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেলে। আমায় একা রেখে চলে গেলে। তুমি আজ নেই আমার কাছে, আজ পরী ও নেই। সে অন্যের সন্তান। আমার দোষটা বলো মিষ্টি। কোন দোষের শাস্তি দিলে আমায়? তোমায় রেখে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলাম বলে?

আমি তো নিজের ইচ্ছেই যায়নি মিষ্টি। তুমিই পাঠিয়েছ আমায়। তুমি আমায় এতটাই ভালোবাস যে আমার রেখে যাওয়া পান্জাবী কেটে টুকরোটুকরো করেছ। আমার সন্তানকে অন্যের কাছে দিয়ে দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেছ। ভালোবাসা কি এমন হয় মিষ্টি?

ভালোবাসলে তুমি চিন্তা করতে কি করে আমি থাকব এখানে এই একলা একা। এইভাবে নিঃস্ব হয়ে। আমি যে ভালো নেই মিষ্টি। আমার কষ্ট হয়। তুমি জানো মিষ্টি আজ রাতে তো ঘুম যেটুকু হয় সেটুকু ও হবে না। আজ ঘুম আসবে না আমার চোখে। কারণ আজ পরী থাকবে না। আজ পরী নেই। আমার বুকে পরী থাকবে না আজ। বুকটা খালি হয়ে গেছে। পুরো রুমটা আজ খা খা করবে পরীর শূন্যতায়। তুমি তো ভালো আছ মিষ্টি, শুধু আমি ভালো নেই। তুমি আরামে ঘুমোচ্ছ, কিন্তু আমার রাত কাটে নির্ঘুম। চোখের পাতায় ঘুম ভর করেনা মিষ্টি। মনে হয় এই যেন মিষ্টি এল আমার বুকে মাথা রাখতে। মনে হয় এই যেন পরী চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। তুমি তো নেই, আজ থেকে পরী ও নেই। আমি যাচ্ছি মিষ্টি। তোমাকে সঙ্গ দিতে আমি আর আসব না। আমাকে সঙ্গ দিতে যে কেউ আসে না। আইমি আছে। আমি ওর কাছে যাচ্ছি। তোমার কাছে আর আসব না আমি। আর আসব না।
আদি পিছু হেঁটে হেঁটে চোখ মুছে অনেকদূর চলে আসে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যায় তার গন্তব্যে। পিছু ফিরে তাকায় না। কেউ যে ডেকে উঠছে না ডক্টর বলে। কেউ ডাকছে না তাকে। তাকে কারো প্রয়োজন নেই।

ছোট্ট পরী কাঁদতে থাকে, মুনা আর রিক খাবার হাতে বসে থাকে। পরী খাবার মুখে নেয় না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ডাকে, আমমা কুথাইই?
রিক তার মুখের সামনে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলে, যদি খাও তাহলে আমমার কাছে নিয়ে যাব।
পরী শোনে না রিকের কথা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। বিড়বিড় করে বলে,
‘ আমমা ঘুমমম, পরররীই ও ঘুম। ঘুমম।
পরী বিড়বিড় করে বলে, আমমা কুথাইই। আমমাল আমমা কুথাই?
বিড়বিড় করা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে পরী। রিক ডাকে, মুনা ডাকে। পরী উঠে না মেঝে থেকে। চোখ দুটো বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছে না খেয়ে। হঠাৎ রিকের মনে হলো পরী বলছে, আমমা ঘুম। পরররী ও ঘুম। আমমা ঘুমম,পরী ও ঘুমমমমম।
রিক কেঁদে উঠে ডাকল,
” মা উঠো। মা। পরী মা। উঠো।
পরী উঠল না। তার নিঃশ্বাসের আওয়াজ শোনা গেল না। মুনা ফুঁপিয়ে উঠে আওয়াজ করে কেঁদে দিল। পুরো হাতের মুঠোয় আছে কবরের মাটি। পুরো মুখে দাগ চোখের জলের। রিপ দৌড়ে এসে পরীকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কেঁদে উঠল। পরীর কাছে বসে কোলে নিয়ে নিল সেই নিথর তুলতুলে শরীর। মুখে হাত দিয়ে ডাকল,
‘ মা এভাবে কেউ ঘুমোয়? উঠো মা। পরী মা? পরী? এই মা? উঠো না? এই পরী? এই মা? রিইই ডাকছে তো?
পরী উঠে না। রিইই বলে ডেকে উঠেনা। পাপপা বলে ডেকে উঠেনা। মামমা বলে ডেকে উঠেনা। আববা বলে ডাকে না। বিড়বিড় করে ও আর বলে না,

‘ আমমা কুথাই? আমমাল আমমা কুথাই?

__________________________

দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙায় ছেলেটি তার পাশে হাঁতড়ে খুঁজে পায়না তার বাচ্চা পুতুলটিকে।
ডুকরে কেঁদে উঠে বলে, তোমার মা চলে গেছে, তুমি যেতে পারো না। আমার মা। পরী মা উঠো। আসো আমার কাছে। কোথায় তুমি। এই মাহ? কোথায় মা? কোথায় পরী? পরীহ?????

আদি বিছানা থেকে ধড়ফরিয়ে নামে। পা কাঁপতে থাকে অনবরত। পুরো শরীর টলতে থাকে। খালি পায়ে সে কাঁপাকাঁপা শরীর নিয়ে এগোতেই চোখ যায়, ঘরের এককোণায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকা মেয়েটির কোলে একটি ছোট্ট বাচ্চা। মেয়েটি নীরবে সমান তালে চুমু কেটে যাচ্ছে ছোট্ট মেয়েটির পুরো গালে। বাচ্চা মেয়েটি ঘুমন্ত। ঘুমন্ত বাচ্চা মেয়েটির গালে ইচ্ছেমত আদর দিতেই দিতেই হঠাৎ মেয়েটি ভয়ে চুপসে যায় আদিকে দেখে। দুপাশে মাথা নাড়ায় অবিরত। কাঁদে এলোমেলো। আদি এগোয় মেয়েটির দিকে। ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি ততক্ষণে ও ঘুম। মেয়েটি বুকে চেপে ধরে পরীকে। দুপাশে ঘনঘন মাথা নেড়ে কি যেন বুঝাতে চাই।
আদি তার সামনাসামনি যেতে না যেতেই ধপ করে বসে পড়ে মেয়েটির সামনাসামনি। মেঝেতে বসে হাতের ভর দিয়ে রাখে মেঝের উপর। তারপর তাকায় ঘুমন্ত বাচ্চা মেয়েটির মুখের দিকে। চুমু দেয় লাল টকটকে গালটায়। চোখ তুলে তাকায় তারপর পরীকে কোলে নেওয়া মেয়েটির দিকে।
চেয়ে থাকে নির্নিমেষ। যেন কতবছর না দেখার তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। যেন কতকাল খুব দূরে ছিল। ছোঁয়ার বাইরে ছিল। আদি কাঁপাকাঁপা হাতে মেয়েটিকে ছুঁতে না ছুঁতেই পরী কেঁদে উঠে। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে বলে, আমমা কুথাই। নাই?
মেয়েটি কেঁদে উঠে পরীর এমন কথা শুনে। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে আদুরে গলাশ বলে,
‘ এইতো আমমা। এইতো পরীর আমমা। আমার মা কি চিনতে পারছেনা তার আমমাকে? তার বাবার মতো?
পরী চোখ কচলে কচলে উঠে পড়ে। টুপ করে চুমু খায় মেয়েটির গালে। দৌড়ে চলে যায় বিছানায়। পুতুল জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। বিড়বিড় করে বলে, ইশআআ নাই। ফিপি নাই। আমমা নাই। নাই,নাই। আববা মাববে।

মেয়েটি জোরে আওয়াজ করে কেঁদে দেয় পরী চলে যাওয়ায়। ছেলেটি তাকিয়ে থাকে তার কান্নামাখা মুখটার দিকে। চেয়ে থাকে অপলক। পলক পড়ে না। সে ও আর নড়ে না চড়ে না। যখন বোধগম্য হয় ব্যাপারটি সে উঠে যেতে নেয়। তার চোয়াল শক্ত হয়। উঠে যেতে না যেতেই মেয়েটি ও দাঁড়িয়ে পড়ে। ছেলেটিকে তার দিকে ফিরিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছেলেটির গলা। পা দুটো আলগা হয়ে হাওয়ায় ভাসে। শাড়ির আঁচল লুটোপুটি খায় মাটিতে। আদি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটি তার ভার দিয়ে ঝুলিয়ে থাকে ছেলেটির গলা ধরে। চোখের নোনাজলে ভেসে যায় ছেলেটির পান্জাবীর কলার। কাঁধ। মেয়েটি তার ঠোঁটদুটো চেপে ধরে ছেলেটির গলার একপাশে।
ডাকে, ডক্টর,,,
ছেলেটি যেন বহুবছর পর ডাকটি শুনল। মেয়েটির পিঠের দিকে দুহাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল, যাহ এ কি করে মিষ্টি হয়? মিষ্টিকে সে ছুঁতে পারছে? মিষ্টি কি আছে? মিষ্টি কথা বলছে? কি করে?
মেয়েটির হিঁচকি উঠে যায়। গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে সে এবার ছেলেটির বুকে গিয়ে পড়ে। বুক আঁকড়ে ধরে। মাথা রেখে আজ শেষ কান্নায় ভাসতে ভাসতে বলে,
‘ আমি বুঝে গিয়েছি সন্তান মা না ডাকলে কতটা কষ্ট। কতটা যন্ত্রণা হয়। আপনি আর শাস্তি দেবেন না আমায়। পরীকে মা ডাকতে বলুন। আপনি মিষ্টি বলে ডাকুন। ডক্টর আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে,পরীকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবব না। আপনাকে বিয়ে করে নিতে বলব না। দূরে যেতে বলব না। এবার আমার কাছে আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন ডক্টর। আমি আর নিতে পারছিনা। আমার কষ্ট হচ্ছে। আপনি ফিরে আসুন আমার কাছে, পরীকে ফিরিয়ে দিন। আমার দুজনকেই চাই। পরীকে চাই। পরীর আববাকে চাই। আসবেন তো ডক্টর। এই ডক্টর?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here