#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৭ (সিজন ২)
®পুষ্পিতা_প্রিমা
বিমর্ষ, চিন্তিত, উদ্বিগ্ন ক্লান্ত চেহারায় রিপ হাতের কব্জিতে থাকা ফোনের দিকে তাকালো। আগত শিশুটির অবিরত কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে রিপ আদিকে জিজ্ঞেস করল,
‘ আর কতক্ষণ লাগবে আদি? সহ্যের একটা সীমা থাকে।
আদি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কেবিনে একবার উঁকি দিল। বলল,
‘ আর বেশিক্ষণ লাগবেনা।
আমার লাইফে এমন কেস আমি দেখিনিই মন হয় । নিজের হাতে কত অপারেশন করিয়েছি। অথচ পিহু?
রিপ টিস্যু বের করে মুখ মুছল। বলল,
‘ সব ওই হারামির বাচ্চার দোষ। পিহু যখন ওকে দেখতে চাইছিল তখন কোথায় ছিল ও?
আদি বলল,
‘ আহা ৷ চড় একটা মেরেছিস তো। এবার শান্ত হ। আমরা এসব নিয়ে পরে কথা বলব। মাহিদের এমনিতে ও বুঝা উচিত ছিল, অমন সময় গায়ে হাত তোলা যায়না৷
রিপ বলল,
‘ এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে এখন ও বুঝেনা, কোথায় কার ভালো। নিজের ভালোটা ও কি সে বুঝে? সব আমাকেই দেখতে হয়। আমি একটু অসতর্ক থাকলেই শেষ। সে নাকি আর ও সবার দায়িত্ব নেবে।
রিক এসে থামিয়ে দিল রিপকে। বলল,
‘ এখন কি এসব কথা বলার সময়? ও পিহুর কাছে যেতে চাচ্ছিল তুই ওকে যেতে দিলিনা কেন?
রিপ বলল,
‘ ওর কারণেই পিহুর এই অবস্থা। যেতে দেব না৷
রিক বলল,
‘ যা ইচ্ছে তাই কর।
পরী ইশাকে ধরল। দুহাতে ইশাকে আগলে ধরে ডাকল,
‘ আম্মা উঠো। আম্মা? ডক্টর কি বলেছে শুনেছ? আম্মা?
ইশা মুখ তুলল না৷ স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল,
‘ আমি থাকি এখানে। তুমি যাও।
পরী বলল,
‘ আম্মা তুমি এমন করলে আমার ভালো লাগেনা। তুমি উঠো না?
ইশা বলল,
‘ আমি আছি পরী। তুমি যাও।
পরী গেলনা। দাঁড়িয়ে থাকল। রেহান বলল,
‘ রাহি কোথায়?
পরী বলল,
‘ মাহির কাছে হয়ত।
লম্বা প্যান্ট গুটিয়ে থ্রিকোয়াটার করল রাহি। মাহিদের পাশে বেঞ্চের উপর পেটে ভর দিয়ে উঠে বসল কোনোমতে। ভয়ে ভয়ে মাহিদের হাতে পড়ে থাকা ঘড়ি ছুঁয়ে বলল,
‘ ঘড়ি আমাকে দাওনা কেন?
মাহিদ তার হাতের দিকে তাকালো। রাহি চেহারা ভীতু ভীতু করে বলল,
‘ ইভাবে দিখো কেন? ছিকু ভয় পাই কেন?
মাহিদ চাটি মারল রাহির মাথায়। বলল,
‘ ধুর হ শালা। মাথা খারাপ। মাইর খাস না ফালতু কথা বলে।
রাহি বেঞ্চটার উপর উঠে দাঁড়াল। মাহিদের মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘ ধুরর ছালা,, বুলো কেন?
মাহিদ বলল,
‘ আরিশ্শের বাচ্চা আরিশ্শে চোখ খুলেনা বাপ। আমার ব্যারিস্টার আমারে চড় মারছে হেতির লাইগা।
রাহি বলল,
‘ লাইগা,মাইগা,নাইগা এমুন বুলো কেন? ছিকু কিচ্ছু বুঝেনা কেন?
মাহিদ ধমক দিল।
‘ চুপপ শালা অশিক্ষিত।
রাহি ভড়কে গেল। বলল,
‘ চুপপ বুলো কেন?
মাহিদ কপালের একপাশ চেপে ধরে বলল,
‘ ওরেব্বাপ তুই ধুর হ শালা। যাহ।
রাহি বেঞ্চ থেকে নেমে গেল। নামার সময় পেটে ব্যাথা পেল৷ পেট ধরে ধরে যেতে বলল,
‘ মিহি ব্যাথা দিয়েছে কেন? মেরেছে কেন? দুক্কু দিয়েছে কেন?
মাহিদ রাহির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ শালা চিটিংবাজ। তোরে আমি জীবনে ও মাইয়া দিতাম না বাপ।
মেয়ের মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে আধশোয়া হয়ে পড়ে থাকা ইশাকে আদি ডাকল। ইশা কোনো উত্তর দিল না। আদি তার হাত ছুঁয়ে ডাকল,
‘ মিষ্টি?
ইশা নড়ল। উঠে বসে মুখ মুছে বলল,
‘ কি হয়েছে?
আদি বলল,
‘ ভয়ে আতঙ্কে পিহু সিনকোপ হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহে ব্যাঘাত ঘটায় ওর জ্ঞান ফিরতে দেরী হবে মিষ্টি। তুমি চিন্তা করো না। ও ফিরে আসবে আমাদের কাছে।
ইশা বলল,
‘ ও যতক্ষণ না আমাকে মা বলে ডেকে উঠবে ততক্ষণ আমি অন্যকিছু ভাবতে পারছিনা ডক্টর। সময়গুলো আটকে আছে কেন? আমার আর তর সইছেনা। পিহু এখনো দেখলই না তার ফুটফুটে একটা বাচ্চা হয়েছে।
আদি বলল,
‘ আমার তো চিন্তা হচ্ছে। আমার বাচ্চা তার বাচ্চা দেখে আবার বেহুশ না হয়ে যায়।
ইশা হাসার চেষ্টা করলে ও হাসতে পারল না। আদিকে জিজ্ঞেস করল,
‘ ছিকু কোথায়? সারাটা রাত ঘুমোয়নি। কিছু খায় ও নি। পরীকে বলুন ওকে আগে কিছু খাওয়াতে।
আদি বলল,
‘ তুমি?
ইশার গলার স্বর খানিকটা উঁচু হলো।
‘ এখন খেতে বলছেন আমায়? পিহু উঠুক না? পিহু ও তো অনেকক্ষণ খায়নি।
আদি আর কিছু বলল না। ছোট্ট শিশুটির কান্নার আওয়াজ ভেসে আসল। আদি বলল,
‘ ওনার ও খিদে লেগেছে। ওনার মা তো উঠছেই না।
ইশা বলল,
‘ আমার চিন্তা হচ্ছে ডক্টর। বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকলে ক্ষতি হবে৷
আদি বলল,
‘ চিন্তা করোনা। আমি দেখছি কি করা যায়।
ইশা মাথা নাড়াল। আদি গিয়ে আবার ফিরে এল৷ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ নার্স কি বলেছে মিষ্টি? ছেলে নাকি মেয়ে?
ইশা বলল,
‘ আমি তো খেয়াল করিনি ডক্টর।
আদি মাথা চুলকালো। বলল,
‘ কি কান্ড দেখো মিষ্টি ? ভাই আসল নাকি বোন আসল সেটা ও জানিনা এখনো।
ইশা মৃদু করে হেসে বলল,
‘ যেই আসুক, তার মা সুস্থ হয়ে আমার কোলে ফিরলেই হলো।
_____________________
নীরা দোলাতে দোলাতে শান্ত করানোর চেষ্টা করল শিশুটিকে৷ মাহিদ তার ব্যারিস্টার বাপকে না দেখে সাহস করে নীরার কাছে আসল। নীরা চোখ তুলে দেখল মাহিদকে। বলল,
‘ আব্বা তোর বাপ কি তোকে জোরে মেরেছে? ব্যাথা পেয়েছিস?
মাহিদ মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ বহুত৷
নীরা বলল,
‘ পিহু তো তার চাইতে ও বেশি ব্যাথা পাইছে। ও অবস্থায় কেউ গায়ে হাত তুলে আব্বা?
মাহিদ বলল,
‘ আর মারুম না কইছি না?
নীরা হাসার চেষ্টা করল। মাহিদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ সে তোর বাচ্চার মা না আব্বা? সে ভালো না থাকলে না তুই ভালো থাকবি, না তোর বাচ্চা। না এ বাড়ি ও বাড়ি কেউ৷ তারে ভালো রাখার দায়িত্ব তো তোর। তারে ভালা রাখবি কথা দিছস না তোর ফুপীরে।
মাহিদ চুপটি মেরে থাকল। নীরা বলল,
‘ হইছে আর মাথা নামায় রাখিস না৷
মাহিদ চোখ তুলল। নীরার কোলে থাকা শিশুটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,
‘ মা এই ডাক্তারণীর বাচ্চি কখন কথা বলবে আমার সাথে?
নীরা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। পরক্ষনেই বলল,
‘ আব্বা এটা বাচ্চি নয়, বাচ্চা। তোর ছেড়া হইছে আব্বা।
মাহিদ হা করে তাকিয়ে থাকে নীরার দিকে। মুখ কালো করে বলে,
‘ তাইলে এরে কোলে নিমুনা। ছেড়ি আসেনাই ক্যান? আমি শ্বশুর হমু কেমনে?
নীরা হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
‘ বাপ যখন হইছস শ্বশুড় ও হবি আব্বা। চিন্তা করিস না।
মাহিদ মাথা নামিয়ে রাখে। রাহি এসে কোমরে হাত দিয়ে বলে,
‘ আমি বাবু দিখিনা কেন? বাবুকে কুলে দেয়না কেন? বাবুকে আদল করিনা কেন?
মাহিদ অসহায় চোখে তাকায় রাহির দিকে।
রাহি বলল,
‘ ইভাবে দেখো কেন?
মাহিদ গলা কাত করে বলে,
‘ বাপ তুই ছ্যাঁকা খাইছস।
রাহি ও মাহিদের মতো গলা কাত করে বলে,
‘ ছিকু ছিকা খিয়েছে কেন?
নীরা হাসতে লাগল। কোলের বাচ্চাটি কেঁদে উঠল। মাহিদ বলল,
‘ ডাক্তারণীর লগে আমি কথা কমুনা। ছেড়ি দিবে কইছে না?
নীরা বলল,
‘ দিছে না? তোরে তো ছেড়িই দিছে আব্বা। তোর ছেড়ি, নাম তার মেরি। মেরির বাপ, এবার সবাইরে মিষ্টি খাওয়া।
মাহিদ শান্ত,নির্জীব গলায় বলল,
‘ তুমি মিছা কথা কইওনা মা। আমি বহুত কষ্টে আছি। তার মারে চড় মারছি, এর লাইগা মেরি আহেনাই নাকি?
নীরা হাসতে হাসতে ঢলে পড়ার অবস্থা হলো। কোনোমতে বলল,
‘ আব্বা তুই কেমন বাপ হইলি? ছেড়ি হইছে নাকি ছেড়া হইছে নিজে জানলি না এখনো।
মাহিদ বলল,
‘ বাপের বউ হাসিওনা৷ হাসো ক্যান? রাগ লাগে বাপ।
নীরা বলল,
‘ নে তোর ছেড়িরে কোলে নে।
মাহিদ বলল,
‘ নিতাম না।
নীরা বলল,
‘ ওমা কেন?
মাহিদ গলা কাত করে বলল,
‘ এরে ছেড়ার মতো ও লাগে, ছেড়ির মতো ও লাগে।
মুনা এসে কোলে নিয়ে নিল বাচ্চাটিকে। বলল,
‘ এসব কি কথা মাহি? মেয়ে হয়েছে তুই দেখতে পাচ্ছিস না?
মাহিদ বিস্ময় ফুটিয়ে বলে,
‘ মেয়ে? আমার? ওররে। তুমি ঠিক কইছো? ওরেব্বাপ!
রাহি চিমটি দিল মাহিদের পায়ে। বলে,
‘ ওররে বুলো কেন?
মাহিদ তাকে মাথার উপর তুলে আবার নিচে রেখে কানে কানে বলল,
‘ শালা তোর বউ আইয়্যা পড়ছে বাপ।
রাহির খুশি কে দেখে?
হাততালি দিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ ছিকুর বউউ আসি গিয়েছে। ওহ ওহ কি মুজা, কি মুজা!
মাহিদ দৌড়ে গেল কেবিনের কাছে। ইশা থাকায় যেতে পারল না। কেবিনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিস্তেজ হয়ে চোখ বন্ধ করে থাকা মেয়েটিকে উদ্দেশ্যে করে মিনমিন করে বলে,
‘ ওরেব্বাপ তুই উঠ না। তোর লাইগা আমি কাঁদছি মেরির মা। তুই আমারে কাঁদাইছস কিল্লাই? উঠ তাড়াতাড়ি। আর মারুম না তোরে, আদর করুম৷ ওঠ। ওঠ। আয় আমার কাছে। আয়। আমার ছেড়ি তোর লাগি কাঁদতেছে বউ। আয়। তাড়াতাড়ি আয়। পরে ঘুমাস। আয়।
চলবে