মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৩ (সিজন ২)

0
917

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩ (সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা

পড়নে সাদা কলেজের ড্রেস। পায়েস কেডস। ফোন হাতে মাহিদ গেমস খেলছে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটি বাইকে হেলান দিয়ে। একাদশ শ্রেণীর ছাত্র সে। গেমসে এমনভাবে মজে আছে সে কার বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো তার খেয়াল নেই। চারটা বাজতে না বাজতেই পাশের গার্লস স্কুল ছুটি হলো। হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ল ঝাঁকে ঝাঁকে হাই স্কুলের মেয়ে। কেউ কেউ দলে দলে হাঁটছে। কেউ কেউ একা। মাহিদ চোখ তুলে দেখল না কাউকে। বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পর,
গেমস খেলতে খেলতে আচমকা সে পা বাড়িয়ে দিল সামনে। তার পায়ের সাথে লেগে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে একটি মেয়ে। দুহাতের তালুতে ব্যাথা পেল। কয়েকটা মেয়ে হৈচৈ করে উঠল। মাহিদকে বকতে লাগল নম্র ভাষায়। মাহিদ হাসল। কিন্তু চোখ তুলে দেখল না মেয়েগুলোকে।
পিহু বন্ধুদের সাহায্যে উঠে দাঁড়ায়। অগ্নিচোখে তাকায় মাহিদের দিকে। আশেপাশের কয়েকজন মাহিদকে গালি ও দিল বোধহয়। এই ছেলেটা কি পরিমাণ বেয়াদব?
পিহুর হাতের তালু ঘষা খেয়ে ছিড়ে গেল। জ্বলছে সেই জায়গায়। সে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,

‘ আমি ব্যাথা পেয়েছি মাহিদ ভাই। তুমি এভাবে ফেলে দিলে কেন? সারাক্ষণ এসব করে কি পাও তুমি?

মাহিদ এতক্ষণ পর চোখ তুলে তাকাল পিহুর দিকে। পিহুর হাতের ছিলে যাওয়া অংশের দিকে তাকাল। বেশ সময় নিয়ে বলল, তোর ডাক্তার বাপ আছে কিজন্য? চিন্তা করিস না, তোর ডাক্তার বাপ ব্যান্ডেজ করিয়ে দেবে। আর এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছিস কেন? ভালো করে হাঁটতে পারিস না?
পিহু হাত ঝাড়তে ঝাড়তে তার ফ্রেন্ডদের দিকে তাকাল। তারপর মাহিদের দিকে ঘৃণা ছুড়ে দিয়ে পা বাড়াল। মাহিদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পিহুর মাথায় চড় মারল জোরে। গর্জন করে বলল,

‘ ওই আমি দাঁড়িয়ে আছি তুই দেখছিস না? যাচ্ছিস কোথায়?

পিহু মাথায় হাত দিয়ে টলমলে চোখে তাকাল। মাহিদ পিহুর বন্ধুদের বলল, তোমরা যাও।
তারা তাকাল পিহুর দিকে। পিহু মাথা হাত দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার বন্ধুরা চলে গেল। মাহিদ আবার ওই বাইকে গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ওই নাম্বার এনেছিস? দিয়েছে?

পিহু রেগে তাকাল মাহিদের দিকে।

‘ তুমি প্রেম করবে আর আমি নাম্বার এনে দেব? তুমি ভাবলে কি করে? আমি মামাকে বলে দেব। তুমি দিনদিন আর ও অসভ্য হয়ে যাচ্ছ। আনিসাকে তোমার পছন্দ হয়েছে,তুমি নিজে গিয়ে বলোনা। আমাকে কেন বলছ?

মাহিদ ও রেগে তাকাল পিহুর দিকে।
” তোর সাহায্য চেয়েছি বলে তোর দাম বেড়ে গেছে তাইনা? লাগবে না তোর সাহায্য। যাহ মর গিয়ে। যাহ আমার সামনে থেকে। খবরদার কাঁদবি না।

পিহু ঝরঝর করে কেঁদে দিল। ইউনিফর্মের পকেট থেকে বের করল একটি কাগজ। ছুড়ে মারল মাহিদের দিকে। বলল,

‘ আমি পারব না ওসব। তুমি দাও গিয়ে। নিজে প্রেম করবে,লাইন ঠিক করে দিতে হবে আমাকে। আমি বলে দেব সব মামাকে।

জোরে কষে চড় বসাল মাহিদ পিহুর গালে। বলল, যাহ, বলে দিয়ে আয়। আজকেই যাবি। না গেলে তোর খবর আছে। যাহ।

পিহু কাঁদতে কাঁদতে হাঁটা ধরল। পুরো রাস্তা খালি। একটা স্টুডেন্ট ও নেই। পিহুর রাগ লাগল মাহিদ ভাইয়ের উপর। মাহিদ বাইকে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। আবার দৌড়ে আসল। আচমকা পিহুকে জড়িয়ে ধরল। পিহুর হাতে কাগজটা গুজে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে,
‘ তুই আমার বোন না। প্লিজ দিয়ে দিস আনিসাকে। তুই খুব ভালো না আরি। নে।

মাহিদ তার হাতে কাগজটি গুজে দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল। বলল, কালকেই নাম্বারটা নিয়ে আসবি। আমি এখানেই থাকব। পিহু কাঁদতে কাঁদতে বাসায় গেল।

বাসায় যেতে যেতে পিহু হাতের কাগজটি দেখে দেখে কাঁদল। বাসায় গিয়ে আদিকে দেখে আর ও জোরে কেঁদে দিল। জাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। নাকের পানি চোখের পানি এক করে কাঁদল।
আদি তার গালে এমন লাল ছাপ দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ গালে কি হয়েছে আম্মি? এত লাল হয়ে গেছে কেন?

লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে আলিয়া সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসল। বলল, হয়ত কেউ জোরে চড় মেরেছে। মাহি নয়ত? পিহু মাহি মেরেছে তোমায়? চড় মেরেছে।

পিহু জবাব দিল না। জোরে জোরে কাঁদল। তারপর কিছুক্ষণ পর কান্না থামল। আদি জিজ্ঞেস করল,

‘ পাপাকে বলো মাহি মেরেছে আজ ও?

পিহু নাক টেনে টেনে বলল,

‘ না। মাহিদ ভাই মারে না আমাকে। মারলে ও আমি ব্যাথা পাইনা।

আদির ভ্রু কুঞ্চন হলো। বলল,

‘ মারলে ও ব্যাথা পাওনা। তাহলে কাঁদছ কেন?

পিহু নাক টেনে টেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আবার ও কাঁদল। হাতের মুঠোয় মাহিদের দেওয়া কাগজটা দিয়ে চোখের পানি নাকের পানি মুছে ডাস্টবিনে ফেলে দিল। কাউকে আর কিচ্ছু বলল না।

রাতে ইশার ফোনে মাহিদ মেসেজ পাঠাল।
‘ ওই কাঁদুনি মনে করে দিয়ে দিবি চিঠিটা। তোর জন্য চকলেট বক্স কিনে রেখেছি।

পিহু তার উত্তর সরূপ পাঠাল,

‘ চকলেট বক্স আমার দরকার নেই। চিঠিটা ডাস্টবিনে সাঁতার কাটছে। সাবধান কাল স্কুলের সামনে দাঁড়াবে না। পাপা যাবে আমাকে আনতে, আমাকে রোজ রোজ কে এভাবে মারে তা দেখার জন্য।

মাহিদ একমিনিট না পেরোতেই পাঠাল।

‘ তোর ডাক্তার বাপকে মারব এবার। তুই শালীরে আমি একবার হাতের কাছে পাই।

পিহু পাঠাল।
‘ শালীকে কি দরকার? বউ কি মারা গেছে?

মাহিদ ফোন বন্ধ করে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকল। ইচ্ছে করল তার, চৌধুরী বাড়ি গিয়ে পিহুর মাথা ফাটিয়ে দিতে। সাথে তার ডাক্তার বাপ আর বুড়ি দাদির। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই কি সবসময় উপায় হয়?

__________________

ভরাট অডিশনে গান ধরল পরী। রিনরিনে কন্ঠস্বর তার। ঝিরঝির বৃষ্টির তালে তালে সে ও গান ধরল বৃষ্টির গান। উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে তার গান। আর কিছুটা দূরে দাঁড়ানো একটি ছেলে ও। এই প্রথম সামনাসামনি সে গান গাইতে দেখল পরীকে। সবার অুনরোধে সে ও পরীর সাথে তাল মিলিয়ে গান গাইল। মৃদুমধুর ঝংকারে সেই গান মুখোরিত করল পুরো অডিশন। দুইজনই বেস্ট। কাকে রেখে কাকে ফার্স্ট করবে?
সবাই গানের তালে তালে মৃদুমৃদু মাথা দোলাচ্ছে, হাত নাড়ছে, পা নাড়ছে। গানের কথায় ঠোঁট মিলাচ্ছে।

” তোমার এমনি আসা, এমনি যাওয়া
এমনি হাজার ছল, সাজিয়েছ যেন
তোমার এমনি খেলা খেয়ালখুশি
করছে কোলাহল, থামেনি এখনও
চুপিচুপি দেয়াল জুড়ে আঁকছি কত
মন কেমনের খাতা
চুপিচুপি জানতে পেলাম নিরুদ্দেশে
মায়ার চাদর পাতা

কিছুকিছু কথা বসে আছে ভিজে
মিছি মিছি ব্যথা হয়নি যে নিজে
ঝরে যাওয়া পাতা জুড়ে বসে ডালে
মেঘে মেঘে কথা শোনে সে আড়ালে

আকাশ যখন গাইবে বলে বাদলেরই গান
বাতাস তখন বইতে গিয়েও দেখায় অভিমান
অভিমান
আকাশ যখন ফিরতি পথে মন খারাপের সুর
বাতাস তখন নীরব চিঠি পাঠায় বহুদূর
বহুদূর।

অডিশন শেষ হলো। পরপর অনেকেই গান গাইল। পরী পুরোটা সময় ধরে রেহানের সামনে পড়তে চাইল না। তার এসব ফালতু চ্যালেঞ্জের প্ল্যান পাপা শুনে খুব বকা দিয়েছে । পরীর মনে হলো পাপা তার সাথে খুব কমই ওভাবে কথা বলে। তার বিশ্বাস, ভরসা,ভালোবাসার জায়গা ওই মাম্মা আর পাপা। তাদের কথার একটু ও নড়চড় সে হবেনা। পাপা স্পষ্ট বলে দিয়েছে, রেহান ছেলেটা খুব ভালো। তার সাথে কোনোরূপ মজা করবে না পরী। তোমার নিজের স্কিল থাকলে তুমি অবশ্যই অ্যাওয়ার্ড পাবে। কিন্তু কেড়ে নেওয়া নয়। কেড়ে তারা নেই যারা সত্যিকার অর্থে লুজার।
পরী তো কখনোই লুজার নই। কিন্তু তার এই ছোট্ট জীবনে সবচাইতে বড় পাওয়াটি হলো তার গান। এই গানটা দিয়ে সে তার সবটা তুলে ধরতে চায়। তারপর ও সে তার পাপাকে কথা দিয়েছে,
‘ আদিশা খানম এমন কোনো কাজ করবেনা যাতে তার পাপার মাথা নিচু হয়। তার শিক্ষা নিয়ে আঙুল উঠে। পরী তার পাপার কথার বাইরে এক পা ও রাখেনা। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল। নেক্সট অডিশনে সে গান গাইবে না। গান গাইলে সে ফার্স্ট না হলে সবাই তাকে লুজার ডাকবে বাকিদের মতো। না গাইলে তো সেই অপশনটি থাকছেনা। রেহান তাকে অডিশন শেষে অনেক খুঁজল। পেল না। অনেকক্ষণ খোঁজাখুজির পর সে যখন বাইকে চেপে বাইক ছাড়তে গেল কোথা থেকে তার সামনে এসে পড়ল পরী। রেহান থেমে গেল। পরী রেহানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রেহান বাইক থেকে নেমে ডাক দিল পরীকে। পরী থমকাল কিন্তু পিছু ফিরে তাকাল না। এই ছেলেটা তার স্বপ্ন পূরণে একমাত্র বাধা। কোনোকথা বলতে ইচ্ছা করল না পরীর। রেহান আবার ডাক দিল,

‘ পরী..

পরী পিছু ফিরল। বলল,

‘ আমরা কি পূর্ব পরিচিত?

রেহান বেশ সময় নিয়ে জবাব দিল,

‘ ঠিক জানিনা। তবে ছোট্ট পরীর পুরোটা জুড়ে আমি না থাকলে খানিকটা জুড়ে ছিলাম। কিন্তু আজকের এই পরীর কোথাও আমি নেই। ভাবতেই অবাক লাগছে।

পরী কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল রেহানের দিকে। বলল, থাকার কথা ছিল?

রেহান মৃদু হাসল। বলল,

‘ ছিল। তার আমার অপেক্ষায় থাকার কথা ছিল। আমি তার অপেক্ষারত দুটো চোখ দেখতে চেয়েছিলাম।

পরী চোখ সরাল না। চোখ ছোট ছোট করে তাকাল রেহানের দিকে। প্রশ্ন ছুড়ল খুবই সহজ করে,

‘ কে আপনি আমার?

রেহান উত্তর দিল না। পরীর হাতে গুজে দিল একটি কাগজ। বলল, সব উত্তর এখানে। সময় হলে পড়ে নিও।

পরী হাতের সেই কাগজটির দিকে চেয়ে রইল। রেহান তাকে অবাক করে দিয়ে চলে গেল। পরী রাগে সাথে সাথে ছিড়ল কাগজটি। তার স্বপ্নগুলো এক নিমেষেই চুরমার করে আবার ভালো সাজা হচ্ছে?

_________

ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে পরী হসপিটালে গিয়েছিল জরুরী কাজে। সেখানে দেখা হয়ে গেল আদি আর রেহানের সাথে। দুজনই হেসে হেসে কথা বলে হসপিটাল থেকে বের হতে যাচ্ছিল। তখনই সামনাসামনি পড়ে যাই পরী। হাতে কাগজের মতো কিছু একটা। রেহান কথা বলতে চাইল, পরী সাইড দিল তাদের। অন্যদিকে মুখ করে তাকাল। আড়চোখে দেখল আদির মলিন হওয়া মুখ। আদি তার জায়গা থেকে নড়ল না। মেয়ের সাথে আজ খুব করে কথা বলতে মন চাইল। কিন্তু বলতে গেলেই যদি চেঁচামেচি করে?

রেহান বলল,

‘ চাচ্চু পরী কি অসুস্থ? পরী হসপিটালে কেন এসেছে?

আদি ফিরে তাকাল পেছনে। পরীর মুখটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হলো এই মেয়েটাই তার সন্তান। তার পরী। তার বড় মেয়ে। কিন্তু আজ কতটা দূরে সে। মা বাবার ছায়া ও সে দেখতে পারেনা। আদির বুক ভার হয়ে এল। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল পরীর দিকে। পরী তাকে এগিয়ে আসতে দেখে রিপোর্টটি তার কাছে চেপে রাখল। আদি এসেই পরীর হাত ধরল। ধীরেসুস্থে নিয়ে নিল সেই রিপোর্ট। বলল,

‘ তোমার জন্মদাতা ছাড়া আমার আর ও একটি পরিচয় আছে পরী। আমি একজন ডক্টর। সো রিপোর্টটা আমি দেখতেই পারি?

আদি রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে তাকাল পরীর দিকে। পরী কোনোকথা না বলে রিপোর্টটি কেড়ে নিল আদির কাছ থেকে। চলে গেল। আদি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। রেহান বলল, চাচ্চু আমি যাই।
আদি ভ্রু কুঞ্চন করে তাকাল রেহানের দিকে। রেহান হেসে চলে গেল।
আদি ফোন দিল ইশাকে। ইশা এই অবেলায় ফোন পেয়ে অবাক হলো। বলল,
‘ কি হয়েছে ডক্টর? আপনি ঠিক আছেন?
আদি বলল, আমি ঠিক আছি, কিন্তু পরী?

ইশা এবার ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইল,

‘ কি হয়েছে পরীর?

‘ পরী নকল রিপোর্ট কেন বানিয়েছে? ওইখানে লিখা আছে, ওর গলায় সমস্যা। গান না গাওয়ার কথা বলা হয়েছে। পরী কেন গান গাইবে না।

ইশা উত্তর দিতে পারল না। বলল,

‘ আমি তো কিছুই জানিনা।

আদি আর কিছু বলল না। ফোন রেখে দেওয়ার আগে বলল,

‘ মিষ্টি তোমার মেয়েটা খুব নিষ্ঠুর। আমার সাথে একটু কথা ও বলেনি। আমাকে আববা ডাকেনি। রাখছি…

ইশা চুপ হয়ে শোনে আদির অভিযোগ। উত্তর দেওয়ার আগেই আদি ফোন কেটে দেয়। তার নিজের উপর রাগ হয়। নিজের মৃত বাবার উপর রাগ হয়। মায়ের উপর রাগ হয়। তাদের জন্যই তার মেয়েটা তার কাছ থেকে আজ এতটা দূরে।

_________

আদি আর ইশার কথার মাঝখানে পিহু আসল। বলল, পাপা দিদিয়া নেক্সট অডিশনে গান গাইবে না। আমি আজকে নিউজ শুনেছি। দিদিয়া নাকি অসুস্থ? তাই ব্রেক নিয়েছে।
আদি রেগে গেল। ইশাকে বলল,
‘ কি পরিমাণ হিংসুটে তোমার মেয়ে মিষ্টি। রেহান গাইবে তাই তোমার মেয়ে গাইছে না। ও রেহানকে ওর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছে।
আদি কথা বলা শেষ না করতেই রেহান আসল। সোজাসুজি বলল, আমি গান গাইব না চাচ্চু। গান আমার প্রফেশন নয়, এটা আমি আমার ভালো লাগা থেকে করি। পরীর অসুবিধা হলে আমি গান গাইব না।
ইশা বলল, না এটা কি করে হয়? ওর জেদকে প্রশয় দেওয়া যাবেনা। ওর যা মনে হয় তাই করে। তুমি গাইবে রেহান।
আফি এসে সোফায় হেলান দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বলল,

‘ তুই গাইবি না রেহান। আসতে না আসতেই পরীর সাথে পাঙ্গা নেওয়া শুরু করেছিস তাইনা?
দুই টাকার সিংগার হয়ে পরীর সাথে কম্পিটিশন করছিস? তুই গাইবি না। পরী গাইবে। পরী না গাইলে তখন তুই গাইবি। পরী যেই অডিশনে গাইবে সেই অডিশনে তুই যাবিনা।

রেহান মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বলল,
‘ ঠিক আছে ড্যাড।

রাইনা বলল,
‘ পরী কি ছোট বাচ্চা? ওকে সবকিছু পেতেই হবে কেন? ও যথেষ্ট বড় হয়েছে। সবকিছু বুঝে ও। তারপর ও কেন? ওরজন্য রেহান কেন গান গাইবে না।

ইশা চুপ থাকল পুরোটা সময়। রেহান বিরক্ত হয়ে বলল, মা প্লিজ। আমার এসব কথা আর বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। আমি গান না গাইলে কিচ্ছু হবেনা। কিন্তু পরী না গাইলে তার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। রেহানের মনে পড়ল, কালকের পরীর বলা কথাগুলো। পরী রেহানের মুখের উপর বলেছিল,

‘ সবাই আমার কাছ আমার জিনিসগুলো কেড়ে নেয়। পিহু সব কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে। আবার এখন এসেছেন আপনি। আমার স্বপ্ন পূরণে একমাত্র বাঁধা আপনি।

রেহান চলে গেল। আদি আফিকে বলল,

‘ ও তোমার ছেলে দাভাই। কি বলেছ ওকে? রেহান যেতে না যেতেই শুনল, ও আমার নিজের ছেলে নই। পরী তো তোর নিজের সন্তান, তার প্রতি তোর মায়া হয়না। রাইনা স্পষ্ট ছেলের দুচোখ দেখল। তার এই মুহূর্তে আফিকে খুন করতে ইচ্ছে হলো। সে চেঁচিয়ে বলল,

‘ ও আমার ছেলে। আমার ছেলেকে উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। ও এই বাড়ির সন্তান। নিজের ছেলে নই কথাটি বলতে বুক কাঁপেনা। রেহানের কোনো বাবা নেই। ওর মা বাবা সব আমি। আপনাকে দরকার নেই। বাবা হিসেবে কি করেছেন আপনি ?

আদি গিয়ে থামাতে চাইল রাইনাকে। রাইনা আদির হাত ছুড়ে ফেলল,
‘ তোর ভাই আর মেয়ের কি ক্ষতি করেছে আমার ছেলে? তারা দুইজনই আমার ছেলের ভালো দেখতে পাইনা।
ইশা কিছু বলতে চেয়ে ও বলল না। পিহু এককোণায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল।

___________

পরী ফোনে কল এল অচেনা নাম্বার থেকে । রিসিভ করে ফোন কানে দিতেই ভেসে এল পুরুষালী কন্ঠস্বর।
‘ নিচে আসা যাবে?
পরী চিনতে পেরে বলল,
‘ সোজা বাসায় আসুন। নিচে যেতে পারব না।

রেহান উসখুস করল। পরী গর্জে বলল,

‘ আপনি আপনার প্রেমিকার বাসায় আসছেন না, যে এভাবে উসখুস করতে হবে। আসলে আসুন না আসলে নাই।
রেহান বলল, না,না আমি আসছি।
রেহান এসেই সোফায় বসল। বৃষ্টিজলে খানিকটা ভিজে গিয়েছে। চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে তার উপর ছুটে এল একটি তোয়ালে। পরী তারদিকে না তাকিয়ে জবাব দিল,
‘ চা না কফি?
রেহান কিচ্ছু বলল না। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে লাগল। বলল, বসো।
পরী চেঁচিয়ে উঠল।
‘ বসো আপনার বাড়িতে গেলে বলবেন। এখানে নয়। এটা আমার বাড়ি।
রেহান মাথা মুছতে মুছতে বলল,
‘ এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। সো আমার ও বাড়ি।
পরী না শোনার মত করে বলল, এক্সকিউজ মি!!!
রেহান পরীর মতো করে টেনে বলল, কফি খাওয়া যায়।
পরী চলে গেল। উপর থেকে মুনা আর নীরা তাকাল রেহানের দিকে। নীরা ফটাফট বলে ফেলল,
‘ আমাদের পরীর সাথে ভালোই মানাবে। আমার তো বেচারাকে দেখেই কষ্ট হচ্ছে। রাগী বউ তার।
মুনা হেসে দিল। বলল, তুই বেশি বেশি ভাবিস নীরু। রিপ তোকে এমনি বকেনা।
নীরার চেহারা কালো হয়ে এল। বলল, তার মেইন কাজ তো আমাদের মা ছেলেকে হাটতে বসতে বকা দেওয়া। ব্যারিস্টারি ঘরে ও দেখায়।
মুনা হাসল। বলল, আমার পরীর জন্য এরকমই একজন চায়। যে পরীকে সামলাতে পারবে। তাকে বুঝতে পারবে। আমি তোর বড়দাকে বলে দেখব।
মুনা নাশতা সাজিয়ে দিল রেহানের সামনে। রেহান কিছুক্ষণের মধ্যেই গল্পে মজে গেল সবার সাথে। পরী যখন এল, বলল
‘ কি বলতে এসেছিলেন বলে চলে যান। আপনাদের এই বাড়িডে শোভা পাইনা।
মুনা চোখ দিয়ে ইশারা করল পরীকে। পরী পাত্তা দিল না। মুনাকে উপরে পাঠিয়ে দিল। রেহান বলল, নেক্সট অডিশনে তুমি গান গাইছ পরী। আমি সেটা বলতেই এসেছি।
পরী আচমকা চেঁচিয়ে উঠল। দয়া দেখাতে এসেছেন?
পরী কারো দয়া নেইনা। পরীর কারো দয়ার প্রয়োজন হয়না।
রেহান অবাক হয়ে দেখল পরীকে।
‘ তুমি আমাকে কম্পিটিটর না ভাবলে ও পারতে পরী। আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারতাম। তুমি কেন এমন হয়ে গেলে? চাচ্চু কাকিয়া তোমায় কত মিস করে। তোমার কি একটিবার সেই বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করেনা? এত পাষাণ হয়ে গেলে কখন?
পরী রক্তবর্ণ চোখে তাকাল রেহানের দিকে। রেহান উঠে দাঁড়াল। বলল, এটা বলার জন্যই এসেছি। গান না গাইলে তোমার ক্ষতি। আমাকে আর দোষারোপ করতে পারবে না কিন্তু।
পরী রেগে তাকিয়ে থাকল রেহানের দিকে। রেহানের পিছু পিছু কিছুদূর গেল। রেহান পিছ ফিরে তাকিয়ে হাসল। বলল,

‘ যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না?

বলেই নিজে নিজে হাসল রেহান। পরী কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ছুড়ে মারল ছাতা। বলল, লাগলে নিন,না লাগলে ফেলে দিন। আর কখনো এভাবে আমার বাড়িতে আসবেন না।
রেহান হেসে দিল। বলল, কিন্তু তুমি এসো আমার বাড়িতে। আই মিন তোমার বাড়িতে। সরি তোমার শ্বশুরবাড়িতে।
রেহান ছাতা কুড়িয়ে নিয়ে ছাতা মেলল। পরীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ মন কেমনের বৃষ্টিগুলো আমায় ছুঁতে পছন্দ করে। তোমায় নয়। তাই ছাতা তোমার প্রয়োজন। পরীর নাকের ডগায় টোকা মেরে রেহান চলে গেল। পরী দাঁড়িয়ে রইল তার জায়গায়। নাকটা বারবার ধুয়ে নিল বৃষ্টির পানিতে।

রিপ পরীর কাছে ছুটে এল। বলল, পরী মা এভাবে কেউ ভিজে। ঠান্ডা লেগে যাবে। চলো।
পরী রাগ করে দাঁড়িয়ে থাকল। বলল, যাব না। ওই ছেলেটা আমাকে ছুঁয়েছে।
রিপ আওয়াজ করে হেসে দিল। বলল, ও তোমার ফিউচার বর না? সমস্যা কোথায়?

পরী রেগে তাকাল রিপের দিকে। বলল, কখনোই না পাপা।
রিপ হাসল। বলল,
‘ নেআনকে পরী ভুলে গেল কিভাবে। পরী তো নেআনের জন্য পাগল। নেআন বর,পরী বউ। মিননি থাকলে আজ এমনটাই বলতো। পরী অন্যকিছু ভাবল না। চেঁচিয়ে বলল,

‘ না। না। আমি কখনোই ওই চৌধুরী বাড়িতে যাব না। সব তছনছ করে ফেলব আমি। তবু ও যাব না।
রিপকে শক্ত ধরে বলল,
‘ পাপা আমি যাব না। না। না। যাব না।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here