মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৫

0
564

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ফিসফিস করে কথা বলছে আদি। তা ও মিনির সাথে। হাতের পাউরুটিটা ছোট ছোট টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে আদি। কিন্তু মিনি টুকরো করতে দিচ্ছে না। আদির হাত থেকে কেড়ে নিচ্ছে। রাতে না খাওয়ায় সকাল না হতেই তার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল আদির। ইশা দেরীতে ঘুমিয়েছে তাই বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। আদি মেঝেতে ইশার পাশে বসে মিনিকে খাওয়াচ্ছে। মিনি তার আঙুলে ঠোকর দিচ্ছে। আদি হো হো করে হাসছে। হাসতে হাসতে মিনি পেট ভর্তি করে উড়াল দিল। আদির মিনির দিক থেকে চোখ সরাতেই নির্বোধ চোখদুটো হঠাৎ আটকে গেল একটি ঘুমন্ত সুন্দর মুখশ্রীতে। হাত ভাঁজ করে মাথার নিচে দিয়ে ঘুমোচ্ছে তার মিষ্টি। আদি একটুখানি হাসল। বোকা বোকা আদি যেখানে সুন্দরের সংজ্ঞাটাই জানেনা, বুঝেনা, সেই আদির কাছে আজ ঘুমন্ত মেয়েটির চেহারাটি অপূর্ব সুন্দর মনে হলো। আদির চোখে হঠাৎতই লেগে গেল এক নামহীন নেশা। যে নেশায় বুঁদ বু্ঁদ হতে আদি হেলে পড়ল ইশার মুখের কাছে। ঘুমন্ত মেয়েটি যদি একবার তার আখিঁ মেলে দেখত, তাহলে বুঝতে পারত,তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন নয়। বরঞ্চ স্ত্রীতে মোহিত একজন স্বামী। এ চাহনি দেখে মেয়েটির লজ্জা পেয়ে ছেলেটির বুকে মুখ গুজার কথা। কিন্তু সে ঘুমে আচ্ছন্ন। আদি ইশার বালিশে মাথা রেখে মিষ্টিকে দেখার চেষ্টা করল। মিষ্টির মৃদুমধুর শ্বাসপ্রশ্বাসের ঢেউ এসে ঠেকল তার মুখে। আদি অনুভব করল,তার খুব ভালো লাগছে। ভালো লাগা কাকে সেটাই আদি জানেনা। কিন্তু তবু ও আদির ভালো লাগছে। আদি আর ও ভালোভাবে দেখার জন্য অন্য একটা বালিশ এনে দিল ওই বালিশের শেষের দিকে। উঁচু বালিশের মাথা রেখে আদি এবার বেশ স্পষ্ট দেখতে পেল মিষ্টির কাজলনয়না, চিকন ঠোঁট,মায়াবী মুখ। আদির হাসি পেলনা এবার। সে শুধু চেয়ে রইল। তার অবচেতন মন বলে দিল,চেয়ে থাকলেই কাটবে না নেশা। আদি তাই তার কাঁপাকাঁপা হাতের আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিল মিষ্টির নাক,ঠোঁট,চোখের পাতা। অবচেতন মন আবার ও বলল,এ নেশা কাটার নয়। আদি এবার অন্যকিছু ভেবে পেলনা। খানিকক্ষণ শুধু চেয়ে রইল মিষ্টি মুখটার পানে। যখন অনুভূতিদের দফারফা অবস্থা। যখন কোনো এক নির্বোধ নেশাক্ত প্রেমিক হয় স্বামী তখন শুধু মুখপানে চেয়ে থেকে কাটেনা নেশা। আদি মিষ্টির গালের একপাশে চেপে ধরে তার পুরো মুখ। চেপে ধরে আড়চোখে তাকায় মিষ্টির মুখের দিকে। আঙুল দিয়ে সরিয়ে দেয় মিষ্টির চুল। এভাবেই চুল নিয়ে খেলা করতে থাকে। মিনিট না পেরোতেই মিষ্টি নড়েচড়ে উঠল। মুখের উপর তার ভার ভার অনুভব হলো। মিষ্টি নড়তেই আদি আর ও চেপে ধরল। তার খুব খুশি লাগছে মিষ্টির সাথে দুষ্টুমি করতে। মিষ্টি চট করে উঠে বসে। আদি নিজেকে সামলায়। অন্যদিকে মুখ করে বসে ভয়ে। যদি মিষ্টি রাগ করে?
ইশা নিজের মুখ স্পর্শ করে ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,কি করেছেন ডক্টর?
পরক্ষণে নিজের প্রশ্নে সে নিজেই হতবাক হলো। লজ্জা পেল। আদির সহজ সরলভাবে মিষ্টির মুখ ছুয়ে বলে আমি এখানে আমার মুখ রেখেছি মিষ্টি।
ইশা কি এখন লজ্জায় লাল,নীল হবে নাকি ধমক দেবে বুঝে উঠতে পারল না। তবে শেষমেশ লজ্জাটাই স্থির হলো। লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ফিরে চাদর কুটতে লাগল। আদি ভেবে পেল না মিষ্টিকে কি বলা যায়। কি বললে মিষ্টি কথা বলবে? তার পাগলা মাথায় বোকা বুদ্ধি আসল। বলল, মিষ্টি তুমি খুব সুন্দর। ইশা ফিরতে চেয়ে ও ফিরতে পারল না। লজ্জায় আবার বুঁদ হলো। মিনমিন করে আদির মত করে বলল, আপনি ভালো না ডক্টর।
আদির মুখ কালো হয়ে গেল। মন খারাপ করে বলল,মিষ্টি আমি খারাপ?
দূর থেকে মিনি যেন খুশি হলো। ডেকে উঠল,আদি ব্যাড বয়। ব্যাড বয়।
আদির মন খারাপ যেন দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেল। মাথা নিচু করে চাদর খামচে ধরে রইল। কোনো কথা বলল না। ইশা মাথা নিচু করে আদির চেহারা দেখার চেষ্টা করে ডাকল, ডক্টর?
আদি জবাব দিল না। ইশা আবার ও ডাকল,ডক্টর?
আদি চোখতুলে তাকাল শুধু। কিছুই বলল না। আদির তাকানো দেখে ইশা খানিকটা লজ্জা পেল। আজকাল তার হুটহাট লজ্জা লাগছে। তার বয়সটা বোধহয় এমনই তাই। আদি রাগ করে উঠে যেতে নিল। ইশা হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। আদির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, রাগ?
আদি বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়াল। আবার মাথা নিচু করে রইল। ইশা হাসল। হেসে বলল, এখনো আছে?
আদি চোখ তুলে তাকাল ইশার দিকে। এক অন্যরকম ভাবে। ইশা ভড়কে গেল। বলল, কি ডক্টর?
আদি জবাব দিল না। মনে হলো কিছুক্ষণ আগের সেই নেশাক্ত চাহনি ফিরে আসল আদির চোখে। ইশা পরিচিত নয় এ দৃষ্টির সাথে। এ দৃষ্টি সম্পূর্ণ অপরিচিত। সে বুঝার চেষ্টা করে সেই দৃষ্টির অব্যক্ত কথা। কিন্তু বুঝতে পেরে ও না বুঝার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায়।
আমি আসছি বলে উঠার আগেই আদি তার তার শাড়ির আচঁল টেনে ধরল। কিছুই বলল না। ইশা অবাক হওয়ার শীর্ষ পর্যায়ে না পৌছানোর আগে আদি তার মুখ আগলে ধরল দুহাতে। গালের একপাশে আদির গাল লাগিয়ে বসে রইল চুপচাপ, শব্দহীন। শুধু নম্র কন্ঠে ফিসফিস করে আবদার নিয়ে উচ্চারণ করল,মিষ্টি এভাবেই থাকি?
ছোট্টছোট্ট ভালোলাগা গ্রাস করে নিল মিষ্টির মুখের ভাষা। সে না আওয়াজ করতে পারল? না নড়তে পারল? আজ যেন তার শুধু থেমে থাকার সময়। মুহূর্তটা যেন চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত গতিতে চলতে লাগল। সাথে প্রবল থেকে প্রবলতর হলো মিষ্টির ভালোবাসার প্রগাঢ়তা। মিষ্টি ডুবে যেতে লাগল ডক্টরের স্পর্শে। ভেসে যেতে লাগল এক নতুন জগতে। লজ্জায় এবার মিষ্টি মুখ লুকোলো আদির বুকে। চেপে গিয়ে বলল,ডক্টর খুব খারাপ। আদির কেন জানি এবার রাগ উঠল না। সে মিষ্টিকে আষ্টেপৃষ্ঠে হাতের বাঁধনে ধরে বলল,তাহলে আর ছাড়ব না মিষ্টি। এটা তোমার পানিশ। ভালো না?
মিনি ডানা ঝাপটাল কয়েকবার, ডেকে উঠল, আদি নাটি বয়। নাটি বয়।

_____________

সময় চলতে লাগল তার নিজস্ব গতিতে। মেয়েটি আপন করে নিল চৌধুরী বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে। কিন্তু তাকে দুইজন কাজের লোক ছাড়া বোধহয় আর কেউ আপন করে নিতে পারেনি। এমনকি তার ডক্টর ও না। ডক্টর অসুস্থ তাই মিষ্টির উপর তার এত নির্ভরশীলতা, এত ভরসা। যখন সুস্থ হয়ে যাবে ডক্টরের কল্পনায় ও হানা দেবে না মিষ্টি নামক মেয়েটি। মেয়েটি ফোন কানে কথা বলছে তার রিপদার সাথে। চৌধুরী বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে। বাগানের অন্যান্য সব ফুলগাছগুলোর চাইতে বকুল ফুল গুলোর সুগন্ধ বেশিই ছড়াচ্ছে। মেয়েটি ফোনের ওপাশের ছেলেটির কথায় বিরক্ত হয়ে রাগ দেখিয়ে বলে, রিপদা শুধু পড়ালেখার কথা কেন বলো? পড়ালেখা তো অনেক করেছি। মামা মামি অনেক করেছে আমার জন্য । তুমি অত চিন্তা করোনা তো।
ওপাশ থেকে জবাব আসল। ‘ এতকিছু বুঝিনা। আমি টাকা পাঠিয়ে দেব তোর ভর্তির। ন্যাশনালে ভর্তি হয়ে নিবি। তোর মামা মামির টাকা তোর নেওয়া লাগবে না।
ইশা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। বলে, ভাগ্যিস তুমি নেই দেশে। নাহলে সারাক্ষণ বইয়ের ভেতর ডুকিয়ে রাখতে আমায়।
ওপাশের ছেলেটির হাসির আওয়াজ শোনা যায়। বলে, শিক্ষাই আসল শক্তি। তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আর এজন্যই তোকে পড়াশোনা কন্টিনিউ রাখতে হবে।
বেশ খানিকক্ষণ কথা বলার পর মেয়েটি ফোন রাখল।
বকুল ফুলের গাছটির কাছে গিয়ে একটি বকুল ফুল ছিড়তে চাইল। আবার কি মনে করে ছিড়ল না। কেউ একজনের উপস্থিতি টের পেয়ে সে পিছু ফেরার আগেই তার শাড়ির আচঁল টান দিল কেউ। আবার ছেড়ে ও দিল। সে ভয়ে চিৎকার দেওয়ার লোকটির হাসির আওয়াজ শোনা গেল। ইশা হকচকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে,দুই পা পিছু হাটল। বলল, আপনি?
আফি অন্যরকমভাবে হাসল। মাথার চুলগুলো উল্টেপাল্টে ফেলল। আবার উদ্ভট হাসল। ইশা ঘৃণা নিয়ে হাঁটা ধরল। আফি আবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তখন নেমে এসেছে সন্ধ্যা। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আফির মতলব বুঝা গেল না। সে ইশার দিকে এগোতে এগোতে বলল,নাম কি?
ইশা ভয়ে জবাব দিল, আপনি এভাবে এগোচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছিনা একটু ও।
আফি হো হো করে হাসল। বলল,ভয় না পেলে পিছু হাটছ কেন? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।
ইশা ঘৃণিত চোখে তাকাল। বলল, আমি চিৎকার করব কিন্তু।
আফি মাথা হেলিয়ে বলল, করো।
ইশা চুপ থাকল। কিছুক্ষণ পর চিৎকার দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই তার মুখ শক্তপোক্ত হাত দিয়ে চেপে ধরল আফি। ইশার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। সে তড়পাতে লাগল। চোখে অন্ধকার দেখল। ধস্তাধস্তি করতেই আফি ইশার চুলগুলো থেকে ক্লিপটা খুলে নিল। তারপর ইশার দিকে বাজেভাবে তাকিয়ে বলল, পাগলটা বউ সুন্দর পেয়েছে।
ইশা চেঁচিয়ে উঠে বলল, আপনি ছাড়ুন আমায়। ওনাকে পাগল ডাকবেন না। আপনি নিজেই পাগল।
আফি তার শক্তপোক্ত হাত দিয়ে ইশার হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল, কি করবে না ছাড়লে?
ইশা চেঁচিয়ে ডাকল, ডক্টর। আফি চেপে ধরল আবার ইশার মুখ। ইশা আফির সাথে পেরে উঠল না। আফির হাতে কামড় বসিয়ে দিল সুযোগ পেয়ে। আফি ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠল। শাড়ির আচঁল ফেলে দিল ইশার। ইশা শাড়ির সরতেই আবার টেনে ধরল। কষ্টে তার বুক ফেটে গেল। এলোমেলো চুল আর বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে কোনোমতে চৌধুরী বাড়ি ডুকে পড়তেই সে ঝুঁকে পড়ল সাদা পান্জাবী আর পায়জামা পড়া ছেলেটির পায়ের কাছে। ইশাকে পায়ের কাছে পড়তে দেখে আদি ভয় পেল। দু পা পিছু গেল। পরক্ষণে ইশার এলোমেলো কান্না দেখে এগিয়ে গেল। বলল, মিষ্টি তুমি কোথায় গিয়েছ? মিষ্টি তুমি কেন কাঁদছ?
আলিয়া আর আজিজ চৌধুরী নেমে এলেন ইশার কান্নার আওয়াজ শুনে। ইশা কান্নার জন্য কথা বলতে পারল না। আলিয়া চৌধুরী আর আজিজ চৌধুরীকে কিছু জিজ্ঞেস করতে দেয়না। আদিকে ছুঁতে ও দেয়না। শাড়ি দিয়ে কোনোমতে গা ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে উপরে চলে যায়। আদি মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। রাগের ফুলকি বেরোচ্ছে তার চোখ দিয়ে। যেন মুহূর্তেই সব লন্ডভন্ড করে দেবে। ড্রয়িংরুমে চলতে থাকা বিশাল বড় টিভিটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল এক নিমেষেই। সোফার কভার এক নিমিষে ছুড়ে ফেলল। রাগ দমনের জন্য আলিয়া আর আজিজ চৌধুরী কোনো উপায় পেল না। ইশাকে ও ডাকতে পারছে না। দুজনই দিশেহারা হয়ে পড়ল। আদি এত উত্তেজিত হয়ে গেলে অপরপক্ষে তার শরীর ও খারাপ হবে। আদি রাগে অদ্ভুত আওয়াজ করে সোফাটা উল্টে দিল। তারপর মাথায় হাত দিয়ে আপনাআপনি মেঝেতে বসে পড়ল। ডাক দিল,মিষ্টি!
টকটকে লাল রূপ ধারণ করা চোখদুটোতে ভাসল মিষ্টির কান্না মাখা চেহারা। মিষ্টির ভয়ার্ত মুখশ্রী। সে অন্যকিছু ভাবতে পারল না। কাউকে কিছু না বলে, দৌড়ে গেল মিষ্টির কাছে। সিড়ির রেলিংয়ে বসা মিনি উড়ে গেল আদির পিছু পিছু। হালকা ভাজিয়ে দেওয়া দরজার কাছাকাছি দাঁড়াতেই শোনা গেল গুনগুন করে কান্না। আদির কানে যা খুব যন্ত্রণার হয়ে বিঁধল। সে দরজা ধাক্কা দিতেই দেখতে পেল মেঝেতে বসা অবিরত কান্না করা মেয়েটিকে। আপনাআপনি তার চোখ ঝাপসা দেখাল। সে তাড়াহুড়ো করে মিষ্টির কাছে যেতেই মিষ্টি দূরে সরে গেল। চিৎকার করে বলল,না,না,আমায় ছুঁবেন না। ছুঁবেন না।
আদি নিজের হাতের দিকে তাকাল। বলল, মিষ্টি আমি, আমি তোমার ওই, আমি তোমার।
আদির মনে পড়ল না সে মিষ্টির কি হয়? সে অন্যকিছু ভাবল ও না। মিষ্টি আবার ও দূরে সরে যাওয়ার আগেই সে মিষ্টিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল। বলল,মিষ্টি কেঁদোনা। তোমাকে ওরা কি বলেছে?
মিষ্টি মনে হলো, ওই কিছুক্ষণ আগের ছেলেটির স্পর্শের মতো এখনকার ছেলেটির স্পর্শগুলো বাজে লাগছে না। ঘৃনা লাগছে না। বরঞ্চ এই ছেলেটির হাত চোখবন্ধ করে ধরা যায়। ছেলেটির বুকে অনায়াসে মাথা রাখা যায়। চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। মিষ্টি পাগলের মতো করে কাঁদল। ছেলেটির পান্জাবী খামচে ধরল। কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিল ছেলেটির বুক। ছেলেটি নীরব হয়ে রইল যেন।
যখন কেটে গেল ভয়। কেটে গেল অস্বস্তি। মেয়েটি ছেলেটির বুকে খুঁজে নিল নিরাপদ আশ্রয়। ছাড়ল না। ছেলেটি ও যেন চাইল না মেয়েটি ছাড়ুক। মেয়েটি শক্ত করে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে মেয়েটির মাথায় চিবুক রাখল। বহুক্ষণ পর, একরাশ ভালোবাসায় বিভোর হয়ে ডাকল,মিষ্টি?
মিষ্টি যেন সেই ডাক শুনে আর ও ভয় পেল। কান্নার ঢোক তুলে আবার ও চেপে গেল ছেলেটির বুকে। কেঁদে কেঁদে বলল, আপনি কেন এলেন না ডক্টর? এমনটা হলে আমি এখানে কি করে থাকব ডক্টর?
আদি কিছুই বুঝল না। শুধু বলল, আমি মেরে ফেলব সবাইকে। বাজে লোকগুলোকে মেরে ফেলব আমি।
মিষ্টি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,আপনার ভাইটা খুব খারাপ ডক্টর। ওনি বাজেভাবে তাকান আমার দিকে। আমার কষ্ট হয় ডক্টর।
আদি বুঝল না কে তার ভাই। ভাইটা আবার কি? আদি বুঝার চেষ্টা ও করল না। শুধু মিষ্টিকে বলল, মিষ্টি আমি আছি।
মিষ্টি কেঁদেকেটে বহুসময় পর মুখ তুলে তাকাল আদির মুখপানে। আদি অশ্রুসিক্ত হয়ে মিষ্টির মুখ দুহাতে আগলে ধরল। দেখল মিষ্টির ঠোঁটের কোণায় একটুখানি হাসি। আবার দেখল মিষ্টির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল। মিষ্টি কি পাগল। হাসছে ও কাঁদছে ও। আদি বুঝলই না মিষ্টি খুশিতে কাঁদছে। অবশেষে সে বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার একটি জায়গা পেল। রিপদার পরে ভরসা করার মতো একজন মানুষ পেল। একটি নিরাপদ আশ্রয় পেল। একটি ভালোবাসার মানুষ পেল। তার মত অভাগীর এটুকুই বা কম কিসের! আদি চোখ হঠাৎই ঝাপসা হয়ে উঠল। তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো মিষ্টির মুখের দিকে তাকাতেই। আবছা আবছা দেখা গেল একটি মেয়ের মুখশ্রী। আবছা আবছা দেখা গেল একটি মেয়ের অবয়ব। আদি মাথা ছেড়ে দিয়ে বলে উঠল, কে?
ইশা অবাক হলো। বলল, কি ডক্টর ? যন্ত্রণা হচ্ছে?
আদি চোখ নিবদ্ধ করল মিষ্টির মুখে। মনে করতে চাইল আবছা অবয়বটিকে। কিন্তু মনে পড়ল না। মনে করতে চাইলেই তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। সে অস্ফুটভাবে উচ্চারণ করল,মিষ্টি মেয়েটি আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। চলে যেতে বলো।
ইশা কিছু না বুঝে জিজ্ঞেস করে,কোন মেয়ে ডক্টর? কার কথা বলছেন?
আদি ইশার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। শুধু চেয়ে রইল ইশার মুখের দিকে। আনমনে বলে ফেলল, মেয়েটি তুমি নও মিষ্টি? মেয়েটি কে মিষ্টি?
ইশার শুকনো গাল আবার ও ভিজে গেল। সে চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকাল। নিজে নিজেই বলল, আইমি বোধহয়। আপনি তো তাকে ভালোবাসেন ডক্টর। আমাকে নয়। এই নির্বোধ ডক্টর আমায় ভালোবাসে। কিন্তু সুস্থসবল ডক্টর আমায় চেনেই না। ভালোবাসা তো ছাই।
আচমকা মিষ্টি পান্জাবীর কলার ধরে টেনে আনল আদিকে। একরাশ দুঃখ,যন্ত্রণা,কষ্ট নিয়ে কাতর হতে হতে বহু অনুনয় করে বলল, ডক্টর আমায় কখনো ভুলে যাবেন না। আপনি আর কাউকে ভালোবাসবেন না। শুধু মিষ্টিকে ভালোবেসে যাবেন। ভালোবাসবেন।
আদি যেন এবার সত্যি সত্যি অবাক হলো। তার মুখ দিয়ে বেরোলো না কথা। শুধু নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল মিষ্টির মুখের দিকে। একি কোনো অন্যায় আবদার?

_________________

টিমটিম করে জ্বলছে ঘরের লাইট। ছেলেটি ঘুমোচ্ছে এপাশে কাত হয়ে। তার গায়ের নিচে মেয়েটির শাড়ির আচঁল। হাতে পেঁচানো শাড়ি। মেয়েটি কয়েকবার ছেলেটির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাল। হাসল। বালিশের উপর থাকা কাগজটিতে লিখতে তার অসুবিধা হলো,তারপর ও এবড়োথেবড়ো ভাবে সে লিখে ফেলল,

অবচেতন মনে মিষ্টিকে ভালোবেসে ফেলার জরিমানা কি হতে পারে ডক্টর? আপনি জানেনা না বোধহয় তাই না? আমিই বলে দিচ্ছি। জরিমানা খুবই অল্প পরিমাণ। যখন আপনার সামনে মিষ্টি নামক মেয়েটি থাকবে না, সে আপনার কাছে ধরা দেবেনা, আপনার খুব করে তাকে ছুঁতে মন চাইবে তখন আপনি চুপিচুপি গিয়ে দাঁড়াবেন বাগানের সেই বকুলগাছের পাশে। বকুল ফুলের সুগন্ধ যখন এসে ঠেকবে আপনার নাকের কাছে,তখন আপনি অনুভব করতে পারবেন মিষ্টিকে। মনে হবে মিষ্টি আপনাকে ছুঁয়ে দিয়ে গেল। আপনার কাছে ধরা দিয়ে গেল। আপনাকে দেখা দিয়ে গেল। জরিমানা এতটুকুই ডক্টর। মিষ্টি তার ডক্টরের কাছ থেকে কি এরচাইতে ও বেশি জরিমানা চাইতে পারে? মিষ্টি যে ডক্টরকে ভালোবেসেছিল। হ্যা,খুবই অল্পসময়ে,অল্পমুহূর্তে,অল্পআলাপে। আপনি ও তো ভালোবেসেছিলেন ডক্টর। মনে পড়ছে না?

ইশা তার লেখা কাগজটি মোচড়ে নিল। পাশে থাকা আদির অ্যালবামের ছবির নিচে কাগজটি চাপা দিল। তার মনে প্রশ্নের ঢেউ উঠল,আচ্ছা ডক্টর কি দেখবে মিষ্টির লেখা কাগজটি? ডক্টরের কি তখন সময় হবে? নাকি আইমি নামক শব্দটির কারণে মিষ্টি শব্দটি ঢেকে যাবে! ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে! হয়ত মুছে ও যাবে?
অ্যালবামটি পাশে রেখে ইশা শুয়ে পড়ল। গলা উঁচিয়ে একবার দেখে নিল ঘুমন্ত ছেলেটার মুখ। খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে সে ও ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো।
মাঝরাতে আদির ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে মিনিকে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর হাতের পেঁচিয়ে থাকা শাড়ি ছাড়িয়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে এল। পিছু ফিরে একবার তাকাল ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে। তারপর হেঁটে এসে দাঁড়াল একটি রুমের বন্ধ দরজার সামনে। ঠেলা দিতেই যখন খুলল না। সে আওয়াজ করে ধাক্কাতে লাগল। অনেকক্ষণ এভাবে ধাক্কানোর ফলে সবাই জাগ্রত হয়ে গেল আওয়াজ পেয়ে।

ইশার চোখ লেগে এসেছিল মাত্র। যখন সে আদিকে দেখল না ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেল। দৌড়ে রুম থেকে বের হতেই দেখল বিপরীত পাশে কোনো একরুমের সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আলিয়া,আজিজ চৌধুরী আর রায়না।
ইশা যেতে না যেতেই তারা রেগে তাকাল তার দিকে। পেছন পেছন এসে দাঁড়াল আফি। সে নীরবে হাসল। ইশা যখন তাদেরকে ঠেলে রুমে ডুকে পড়ল, তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠল, ডক্টর!
আদি মদের বোতল হাতে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ইশার দিকে। চোখমুখ কুঁচকে তাকাল। মদের বোতলে আর ও কয়েক চুমুক দিয়ে বলল, মিষ্টি যাও এখান থেকে।
ইশা দৌড়ে গেল। মদের বোতল কেড়ে নিয়ে বলল,কি করছেন ডক্টর? পাগল হয়ে গেছেন? কে বলেছে এসব খেতে? আমি এতকিছু কার জন্য করছি। আদি তাকাল দরজার দিকে। কাকে যেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ও বলেছে । চলে যাও তুমি।
ইশা মদের বোতল দূরে ছুড়ে ফেলল। রুমটিতে লাইট জ্বালিয়ে দেখল,পুরো রুমে ভর্তি মদের বোতল। তারমানে ডক্টরকে কেউ শিখিয়ে দিয়েছে।
আজিজ আলিয়া চৌধুরী সরে দাঁড়ালেন। ইশা আদিকে নিয়ে রুমে চলে গেল। আফি তাকাতেই মুখ ফিরিয়ে নিল ইশা। বলল, পুলিশে দেব আমি।
আদির পাগলামো বাড়তে লাগল ক্রমশ। উল্টাপাল্টা কথা বলতে লাগল। ইশাকে ধরে বলতে লাগল, মিষ্টি তোমার ঠোঁট সুন্দর, চোখ খুব সুন্দর। তুমি খুব সুন্দর। তুমি এভাবেই থাকো। ইশা আদির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ডক্টরের প্রেসক্রাইভ করা ঔষধটা গুলিয়ে খাইয়ে দিতেই আদি হেলে পড়ল মেঝেতে। ইশা টেনে বিছানায় বসতে পারল না। আদি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইল।
ইশা আর কিছু বলল না। কেঁদে বলল, আপনাকে সুস্থ করার জন্য আমি এতকিছু করছি,আর আপনি?
আদি মাথা নামিয়ে বসে রইল। কিচ্ছুটি বলল না। ইশা দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আগেই আফি ডুকে পড়ল রুমে। ইশার দুগাল তার হাত দিয়ে চেপে ধরে হাটতে হাটতে বলে, এই মেয়ে কোন সাহসে বললি আমায় পুলিশে দিবি? এত সাহস কই পেলি? তোর বাপের ক্ষমতা আছে?
আদি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল ছেলেটি মেয়েটির মুখ চেপে বকছে। সে মজা পেল। নড়েচড়ে বসে দেখতে লাগল চোখ ছোট করে করে। ইশা বহুকষ্টে ডাকল, ডক্টর?
আদি শুনল না।
সর্বশক্তি কষে চড় বসাল ইশা আফির গালে। বলল, বেজন্মা কোথাকার। ভাইয়ের বউয়ের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা হয়না?
আফির চোখ যেন হিংস্র জন্তুর মতো ধপধপ করে জ্বলে উঠল। ইশার গলা চেপে ধরে বলল,কিসের বউ তুই? বেশ্যা কোথাকার? বউ হতে আসছিস! স্পর্ধা কত?
ইশা হাত দিয়ে ঠেলে দিতে চাইল। আফি এবার তার শাড়ি টেনে ধরল। ইশা চিৎকার দিয়ে উঠল। ডাকল,ডক্টর।
আদি পিলে চমকে উঠল। আবার ও মজা পেল সে। নির্বাক তাকিয়ে রইল মেয়েটির কান্নারত মুখটির দিকে। ইশা হাত ছুড়াছুঁড়ি করল। আফি হাসতে লাগল হো হো করে। ইশা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। চিৎকার করে ডেকে উঠল,ডক্টর বাচাঁন আমায়।
আদির কানেই গেল না। সে বসেই থাকল। গালে চড় পড়ার আওয়াজে ইশা চমকে উঠল। চোখবন্ধ করে রইল। আজিজ চৌধুরী গর্জন করে বলল, তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছি আমরা আফি? ছিঃ লজ্জা হয় আমার। তুমি এ বাড়িটা ও নোংরা করে ফেলছ!
আফি কিছুই বলেনা। গালে হাত দিয়ে ইশার দিকে রেগে তাকিয়ে তারপর গটগট পায়ে হেঁটে চলে যায়। আজিজ চৌধুরী ইশার দিকে তাকায় না। চলে যায় দরজা বন্ধ করে। ইশা দেয়াল ঘেষে বসে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে দেয়ালে মাথা ঠেকায়। এই দেয়ালে হেলান দেওয়া ইশা,অন্যদেয়ালে হেলান দিয়ে ইশার দিকে তাকিয়ে তাকা আদি। একজন কাঁদে। অপরজন শুধু নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। ইশা অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে দূরে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে, আপনাকে বিয়ে করাটাই আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল ডক্টর। তার চাইতে বড় ভুল আপনাকে ভালোবাসাটাই। আমি কেন আপনাকে ভালোবাসলাম ডক্টর?
আদি চেয়ে রইল মেয়েটির বকবক করা মুখের দিকে নির্নিমেষ। মেয়েটিকে এভাবে দেখতে সত্যি ভারী সুন্দর লাগছে! একবার বলবে কি?

চলবে,
( আপনাদের মতামত জানাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here