মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৮

0
658

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা

বিক্ষিপ্ত মেজাজের ছেলেটি আজ শান্ত চুপচাপ। রাগ উঠলে সে আর রাগ দেখানোর সাহস করে উঠতে পারেনা। চাপা গর্জন করে। চাপা রাগ দেখায় সে। তা ও মিষ্টির উপর। সে বোধহয় মিষ্টির মন পড়তে জানে। কোথায় মিষ্টির দুর্বলতা তা টের পায়। তাই মিষ্টি যখন তাকে দিয়ে রাখল উদ্ভট শর্ত। সে ও মিষ্টির দুর্বল জায়গায় আঘাত করল। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বকুল ফুল কুড়ালো। মিষ্টির বারণ শুনল না। সেই বকুল আইমির ওড়নার আচঁলে ভরে দিল। তারপর মিষ্টির দিকে তাকাল। সে যা মনে করে দিয়েছে তার কিছুটিই হলোনা। মিষ্টি রাগ দেখাল না। কাঁদল ও না। কি আশ্চর্য!
সে আর ও কষ্ট দেওয়ার ফন্দি আটল। তার বোকা মাথায় বুদ্ধি এল। আইমির সাথে বসে সে বকুল ফুলের মালা গাঁথল। মিষ্টি যখন কাজের ফাঁকে তাদের দিকে তাকাল আদি আইমিকে দিয়ে দিল সেই মালা। আইমি সবকিছু স্বাভাবিক ভেবে নিল। আদি তো তারই। মিষ্টি যখন চোখ ফিরিয়ে নিল আদি প্রচন্ড আহত হলো। মিষ্টির এবার ও রাগ উঠল না। এবার ও কাঁদল না?
মিষ্টির চোখের অগোচরে আইমির হাত থেকে আবার মালাটি কেড়ে নিল আদি। মিষ্টির জন্য গাঁথা মালা অন্য মেয়ে কেন ছুঁবে? আদি সবার সাথে একসাথে বসে খেল। তা ও মিষ্টি বলার আগে। বেছে বেছে ঝাল খাবার খেল। মাথার রগ তার দপদপ করে উঠল। চোয়ালের রগ ফুলে উঠল। চোখদুটো অসম্ভব রকম লাল হলো। তারপর ও সে ঝাল খেয়েই চলল। আইমি তো জানে আদির ঝাল খুব পছন্দ, বাকিরা ও তাই জানে। তাই সবাই কিছু বলল না। কিন্তু যখন সবাই আদির হাঁসফাস দেখল, সবার চোখ যেন কপালে উঠল। আদি তারপর ও খেয়ে চলল। আদি খাবার টেবিল কাঁপিয়ে চিৎকার করে ডাকল,মিষ্টি!
ইশা কোথা থেকে যেন ছুটে এল পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে। চামচে করে সামনে তুলে বলল,খেয়ে নিন নয়ত ফেলে দিন।
আদি চুপচাপ খেল। পুরোটা সময় মিষ্টির দিকে তাকিয়ে খেল। মিষ্টি একবার ও তার দিকে তাকাল না। আদির আবার ও কষ্ট লাগল। তার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে উঠল। সে মাথা নামিয়ে ফেলল। আর খেল না। তার চোখজোড়া ও মিষ্টিকে দেখাল না। মিষ্টি যখন চলে গেল,তখন সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। মিষ্টি ছাড়া বাকি সবাই তার ছলছল চোখ স্পষ্ট দেখতে পেল।
না দেখলে ও মিষ্টি বেশ ভালোভাবে অনুভব করতে পারে ডক্টরের কষ্ট। কিন্তু তার কিচ্ছু করার নেই। নীরবে দেখানো রাগ,অভিমানগুলো ও বেশ ভালোভাবে টের পায় সে। ডক্টরের প্রত্যেকটা কাজে সে টের পায় মিষ্টির প্রতি তার প্রবল অভিমান। প্রবল রাগ। বালিশে মাথা রেখে যখন ডক্টর ঘুমোয় তখন মিষ্টি মাথা তুলে তাকায় ডক্টরের মুখপানে। কে বলবে এই ছেলেটা একটি বাইরের মেয়ের জন্য এত ডিস্পারেট থাকে? কে বলবে এই ছেলেটি মেয়েটি মুখ থেকে একটুখানি মিষ্টি কথা শোনার অপেক্ষায় থাকে? কে বলবে এই ছেলেটা প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের একজন ডক্টর ছিল? কার কাছে আছে এসব প্রশ্নের উত্তর?
জীবন্ত একটি পুতুল যখন মৃদুমধুর শ্বাস টেনে ঘুমোয় আদির পাশে, আদির ঘুম ভেঙ্গে যায় সেই নিঃশ্বাসের আওয়াজে। নিশ্চুপ অনুভূতিরা তখন পাল্লা দিয়ে যেন বেড়ে যায়। সেই অনুভূতি নিয়ে অপলক তখন ডক্টর তাকিয়ে থাকে মিষ্টির মুখপানে। তা কি মিষ্টি জানে?
যখনই পড়ে যায় মিষ্টির দেওয়া শর্তের কথা আদির রাগ হয়,অভিমান হয়,তার ও কান্না পায়। কিন্তু সে জানেনা কিভাবে কাঁদতে হয়। কিভাবে কাঁদলে মিষ্টি জেগে উঠবে। কিভাবে কাঁদলে মিষ্টি তার শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে এসে তার বুকে মাথা রাখবে। কিভাবে আর্তনাদ করলে মিষ্টি ও আর্তনাদ করবে। আর কেমন কষ্ট পেলে মিষ্টি তারকাছে ছুটে আসবে? আর কেমন আঘাত পেলে মিষ্টি ধরা দেবে তার কাছে। কিভাবে ক্ষতবিক্ষত হলে মিষ্টি তার জন্য কেঁদেকেটে সাগর বানাবে। মিষ্টির মুখের দিকে আনমনে সেসব ভাবতে ভাবতে আবার ও আদির দুচোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। সে আচমকা চোখদুটো চেপে ধরে মিষ্টির ঘাড়ে। যখন বুঝতে পারে মিষ্টি জেগে থেকে ও সাড়া দিচ্ছে না, তার আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেনা। তখন সে দূরে চলে আসে। বালিশে দুচোখ চেপে ধরে। মিষ্টি পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। ঘাড়ের কাছে হাত দিতেই তার হাতে লেগে যায় খুবই মূল্যবান চোখের নোনাজল। সে তার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। দেখতে দেখতে কখন তার চোখের কোণা বেয়ে কানের কাছে জল গড়াল সে বুঝতে পারলনা।
দুইদিকে দুপাশে দুজনই নীরবে কাঁদল। কিন্তু কারো কান্না কেউ শুনল না। যতই হচ্ছে রাত গভীর, বাড়তে লাগল অনুভূতিদের নিশ্চুপ কান্না। দুইজনের দুই মাথার নিচে বালিশ জানে সে কান্নার বেগ কতটুকু। সে কান্নার গভীরতা কতটুকু।

__________________________

আদি বিরক্ত হলো মিনির কাজে। মিনি কেন ওই আইমির সাথে কথা বলে? মিনি শুধু মিষ্টির সাথে কথা বলবে। মিনি ও কি বুঝে গিয়েছে মিষ্টি তাদেরকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে? হয়ত বুঝে গিয়েছে সেজন্য দূরে দূরে থাকছে। কিন্তু সেসব নিয়ে কোনো ভাবাবেগ নেই মিষ্টির। সে এত নির্বিকার কেন?? কি চাইছে সে? আদি তার কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না। আইমি তার ফোনে থাকা এক একটি ছবি দেখায় আদিকে। বলে,আদি তোমার মনে পড়ছে এই ছবিটি আমরা কোথায় তুলেছি? এই ছবিটি দুজনই যখন নদীর পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম তখন তুলেছি। আর এটা যখন আমরা দুজন লং ড্রাইভে ঘুরতে গিয়েছিলাম। দেখো তুমি বাইক চালাচ্ছ। আমি পেছনের মেয়েটি আমি। আমরা দুজন। তোমার মনে পড়ছে আদি!
আদি তো এতক্ষণ কিছুই শুনল না। সে তো ওই টেবিলে মুছতে থাকা মেয়েটির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। আইমি আদির দৃষ্টি লক্ষ করে যখন তাকাল,দেখতে পেল ওই মেয়েটিকে। যে মেয়েটি আদিকে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অন্যতম কারণ। আইমি ভেবে পায়না, এই ছোট্ট একটা মেয়ের মাঝে কি দেখল আদি? যার কারণে সে তার আইমির দিকে ও পর্যন্ত ভালোভাবে তাকায়না।
তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল খুব সুন্দর একটি দিনের কথা। আইমি সেদিন তার অদক্ষ হাতে শাড়ি পড়েছিল। কুচিগুলো এলোমেলো ছিল। মা ঠিক করে দিলে ও শেষপর্যন্ত তা ঠিক থাকেনি। শাড়িটা আদিই দিয়েছিল তাকে। আদি সেদিকে তার মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল। যখন আইমি লজ্জা পেয়ে মাথা নামাল অমনি আদির হাসির আওয়াজ শোনা গেল। আদি তার কানে কানে বলেছিল, আপ বহত খুবসসুরাত লাগরাহে হো।
আইমি হেসে আদির বুকে দুমদাম কিল বসিয়ে বলেছিল,ইয়ে স্রেপ মে। কেবেল তুমহারা।
আইমির ঠোঁটের কোণায় আবার ও এক চিলতে হাসি ফুটে। সে এখনো সেই আশা নিয়ে দিনতিপাত করে। তার আদি একদিন ঠিক তার কাছে ফিরে আসবে। তার আইমিকে সে একদিন ঠিকই চিনবে। চিনবেই।

______________________

এভাবেই পার হলো অনেকগুলো দিন। দুইমাসের কাছাকাছি। আজিজ চৌধুরী ইশার কথা শুনে স্বস্তি পেলেন। ইশা তাদের আশ্বস্ত করল, ডক্টর যাবেই। এবার ডক্টর সুস্থ হবে। হয়ত মিষ্টির চোখের আড়াল হয়ে যাবে। তারপর ও ডক্টর সুস্থ হয়ে যাবে। হয়ত কিছুদিন মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হবে কিন্তু তারপর ও তো ডক্টর সুস্থ হবে। কোনো একসময় যখন ডক্টর দেশে ফিরবে তখন হুট করে না হয় এক মন কেমনের বৃষ্টির সময় আবার দেখা হয়ে যাবে দুজনের। তখন তো সে মিষ্টি থাকবেনা, একটি অপরিচিত মেয়ে ইশা হয়ে দাঁড়াবে ডক্টরের সামনে। আদির পুরো স্যুটকেস গুছিয়ে দিল ইশা। পুরো স্যুটকেস গোছানোর সময় কয়ফোটা জল যে সেই কাপড়ের উপর পড়ল হিসাব নেই ইশার। আদি রুমে এসে যখন দেখল, তারসব কাপড়চোপড় গুছিয়ে দিচ্ছে মিষ্টি। সে অবাক চোখে চেয়ে রইল। বলল, এসব কার? প্যান্ট,শার্ট,কোর্ট?
মিষ্টি তার কাজে ব্যস্ত হয়ে জবাব দিল, আপনার।
আদি ছুড়ে ফেলে দিল। বলল, আমি এসব পরিনা। এসব আমি পরব না। আমি যাব না। কোথাও যাব না।
ইশা হতবাক হলো। এতদিনের চেপে থাকা সব রাগ যেন আদি উগলে দিল। বহুদিন পর আবার জিনিস ভাঙচুর করল। বাড়ির সবাই আদির এই রূপ দেখে ভড়কে গেল। গ্লাস ভাঙার কাচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল পুরো রুমে। আদি আশপাশ দেখে আর ও কিছু খুঁজে নেওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইশা ডাক দিল। আদির পায়ে কাচ বিঁধে যাওয়ার ভয়ে সে খাট থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আদিকে ধরার জন্য এগোতেই তার দুপায়ের তলায় বিঁধে যায়। সে আর্তনাদ করে উঠে। যন্ত্রণায় চোখ ফেটে তার জল বের হয়ে আসে। সে ডাকে,ডক্টর?
আদি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে এল। কি করবে ভেবে পেল না। ক্ষমার চোখে চেয়ে ডাকল,মিষ্টি?
ইশা ততক্ষণে মাথা চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়ল। বাইরে দাঁড়ানো সবাই আদির দিকে তাকিয়ে আর এগোতে পারল না। ঠিকই তাই হলো। আদি তাদের মুখের সামনে ধপ করে দরজা বন্ধ করে দিল। কাচগুলো সরিয়ে মিষ্টির কাছে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। অসহায় হয়ে মিষ্টির মুখ আগলে ধরল। বলল, আর করব না এমন। আর কখনো না।
মিষ্টি দূরে সরে যায়। বলে, চলে যান আপনি। যান।
আদি যেন ক্ষতবিক্ষত হলো। মিষ্টির রক্তাক্ত পা ছুঁতে গেলেই মিষ্টি তার পা গুটিয়ে নেয়। আদি তার কাঁপাকাঁপা হাত দিয়ে মিষ্টির পা শক্ত করে টেনে ধরে। দুইজায়গায় কাচ লেগেছে। মিষ্টি আদির হাত সরিয়ে দেয়। বলে, আমি পারব ব্যান্ডেজ করে নিতে। আপনি যান ডক্টর।
আদি মিষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মিষ্টি তার দিকে ফিরে ও তাকায়না। সে ও এবার বহুকষ্টে এক সিদ্ধান্তে পৌছাল। এবার থেকে মিষ্টির ভালোথাকটা আগে জরুরী। মিষ্টির হাসিমাখা মুখটা সে কতদিন দেখেনা। এবার থেকে মিষ্টি যা চাইবে তাই হবে। মিষ্টির চাওয়া পাওয়ার মূল্য দেবে। অনেক কষ্ট দিয়েছে সে মিষ্টিকে। আর না। আদি আর চোখ তুলে তাকায়না মিষ্টির দিকে। মিষ্টির পায়ের ব্যান্ডেজটা সে মিষ্টির কাছ থেকে কেড়ে নেয়। ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়। মিষ্টি অনেকসময় পর তাকায় আদির দিকে। ব্যান্ডেজ শেষ করার পর আদি চোখতুলে তাকাতেই চোখাচোখি দুইজন বহুদিন পর। সাথে সাথে দুজনই দুদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। দুইজনই কান্না আটকানোর বহু চেষ্টা চালায়। আদি কোলে তুলে নেয় মিষ্টিকে। বিছানায় বসিয়ে দেয়। তারপর নিজের স্যুটকেস নিজেই গুছিয়ে নেয়। বামহাতের কব্জি দিয়ে চোখ ঘষে নেয় কিছুক্ষণ পর পর। মিষ্টি আড়চোখে তাকিয়ে দেখে আদির কান্ড। সে ও চোখ ঘষে নেয়। চোখের জলগুলো যে বড্ড নির্লজ্জ। সময় অসময় দেখেনা শুধু গড়ায়।

রাতে ইশার পায়ে যখন আদি মলম লাগিয়ে দিতে ব্যস্ত। ইশা তখন দুচোখ ভরে দেখে আদিকে। এই মানুষটাকে সে কতদিন দেখবে না। কতমাস দেখবে না। দিনগুলো খুব খারাপ কাটবে ইশার। প্রত্যেকটা দিনই তো শুরু হয় ডক্টরকে দিয়ে। তাহলে সেই ডক্টর যদি না থাকে?
ইশা ডুকরে উঠল। আদি ভড়কে গেল। চমকে ইশার দিকে তাকালে, চোখের জল দেখে আদি খুশিতে আটখানা হয়ে গেল। তার চোখজোড়া খুশিতে চকচক করে উঠল। সে মিষ্টির খুব কাছে গিয়ে বসল। কিছু বলার আগেই মিষ্টি ডুকরে উঠল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমার টেডিবিয়ার চাই। যেকোনো ভাবে। যেকোনো,,,,, যেকোনো মূল্যে চাই।
আদি চট করে দূরে সরে আসল। একরাশ ঘৃণা,রাগ,অভিমান ছুড়ে মাথা নাড়িয়ে না,না করে বলল, না এ আমার মিষ্টি নয়। আমার মিষ্টি শুধু শুধু আমায় কেন দূরে ঠেলে দেবে সামান্য একটা টেডিবিয়ারের জন্য। টেডিবিয়ার কি আদির চাইতে ও বেশি মূল্যবান? কখনোই আদির মিষ্টি নয় এই মেয়ে। কখনোই না।

_____________________

মধ্যরাত । বিষণ্ন মুখে বসে রইল মিষ্টি খাটের এক কোণায়। মুখে নেই সামান্যতম হাসির ছিটেফোঁটা। চোখে ঘুম ও নেই। তারপাশে প্রতিদিন ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটি আজ নেই। সে বারান্দায় গিয়েছে সেই কখন আর আসেনি। মিষ্টির ছেলেটার উপর রাগ উঠছে। এই ছেলেটা না ঘুমিয়ে এতরাতে বারান্দায় কি করছে?
সে যখন এসব ভাবনায় মগ্ন হঠাৎ তার সামনে ছুড়ে এল লাল টকটকে একটি বেনারসি শাড়ি । তার বিয়ের শাড়ি। সে শাড়িটা হাতে নিয়ে চকিতে তাকাতেই দেখতে পেল ফোলা ফোলা চোখমুখের ছেলেটিকে। তার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ রূপে উপেক্ষা করে ছেলেটি বসে পড়ে তার মুখপানে। চোখেচোখে ইশারায় বলে,শুধু একটিবার মিষ্টি। তোমাকে বউরূপে দেখতে চায়। আর কখনো এমন অন্যায় আবদার করব না। তুমি রাগ করোনা প্লিজ। শুধু একটিবার।
আদির বোকাবোকা চাহনি আর বোকাবোকা আবদার শুনে মিষ্টি বিষম খেল। কিছু বলে উঠার আগেই আদি আবার হাতের কব্জি দিয়ে চোখমুছে নিল। চলে গেল।
মিষ্টি শাড়িটা হাতে নিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। আকাশপাতাল ভাবল। এ শাড়িটা পড়ে সে ডক্টরের বউ হয়ে এসেছে এ বাড়িতে। শাড়িটা সে নিজের কাছে রেখে দেবে। কাউকে দেবেনা।
শাড়িটা গায়ে দিতেই তার নিজেকে মনে হলো সে এক নতুন বধূ। অথচ পেরিয়ে গেছে বিয়ের সাতমাস।
ঘরের মৃদু মৃদু ডিমলাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করছে মেয়েটির মিষ্টি মুখ। ছেলেটি তো তাকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখতে চেয়েছিল,তাহলে কোথায় সে?
ইশা ঠাঁই দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ডাকল,ডক্টর?
তার পেছনে কারো গাঢ় নিঃশ্বাস পড়ার আওয়াজে তার সম্ভিৎ ফিরল। সে সাথে সাথে পিছু ফিরল। ছেলেটির বুকের কাছে গিয়ে পড়ল। চোখ তুলে তাকাতেই ছেলেটির চোখে চোখ পড়ল। ছেলেটির ভয়ংকর দৃষ্টি সে উপেক্ষা করতে পারল না। যেন ডুবে গেল নিমেষেই। কথা হারিয়ে ফেলল। কি বলবে খুঁজে পেলনা। ছেলেটি তার মাথা শাড়ির আচঁল দিয়ে ঢেকে দিল। ঘোমটা মাথায় ছোট্ট বউটি তার ভেবে স্বস্তি মিললে ও ধীরে ধীরে অস্বস্তি দানা বাধঁতে শুরু করল। পিটপিট করে তাকানো মেয়েটির চোখে চোখ রেখে সে বুঝিয়ে দিল, তুমি আমার সাথে অন্যায় করছ মিষ্টি। এর মাশুল দিতে হবে তোমায়।
মিষ্টি তো কিছুই বুঝল না। আদি কপাল ঠেকাল মিষ্টির কপালে। দুই কানের পেছনে হাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল মিষ্টির মুখ। কপাল থেকে শুরু করে ভেজা স্পর্শে রাঙিয়ে দিল মিষ্টির পুরো মুখ। মিষ্টি গাল বেয়ে পড়া চোখের জল ও যেন মুছে নিল আদি। মন কেমন করা অনুভূতিরা আজ গাঢ় থেকে গাঢ় হলো যেন। মিষ্টি হারিয়ে গেল ডক্টরের চোখের চাহনিতে। কথা বলা ভুলে গেল। দূরে সরিয়ে দিতে গিয়ে ও পারল না। যেন তার শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। পুরো ঘরটাতে যেন বকুলফুলের সুগন্ধ মৌ মৌ করল। আজ ভালোবাসারা হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিল। মিষ্টির মিষ্টি প্রেমে ডুবে গেল ডক্টর। ভালোবাসায় মাখামাখি হলো দুজন। রচিত হলো ভালোবাসার কাব্যমালঞ্চ। দুজন হারিয়ে গেল দুজনাতে।

_______________________

দুইটা গাড়ি এসে দাঁড়াল চৌধুরী বাড়ির গেইটের কাছে। প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র এক গাড়িতে। অন্য গাড়িতে আলিয়া,আইমি আর আদি বসবে। শেষমেশ আজিজ চৌধুরী যাচ্ছে না। পুরো বাড়ি খুঁজে কোথাও পাওয়া গেল না আদিকে। ইশা দৌড়ে ছাদে গেল। আদির পিছু গিয়ে দাঁড়াল। ডাকল,ডক্টর!
আদি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ভ্রু উপরে তুলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, আমি চলেই যাব মিষ্টি, তোমার এত তাড়াহুড়ো কেন?
ইশা হকচকিয়ে গেল। বলল, আচ্ছা আমি নিচে যাচ্ছি।
আদি তার হাত ধরে টান দিল। সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে তার গলার একপাশে কাধেঁর কাছাকাছি দেখিয়ে বলল, আমার এখানে খুব জ্বলছে মিষ্টি।
ইশা অবাক হলো। বড় বড় চোখ নিয়ে বলল, আমি করেছি?
আদি রেগে গেল। গর্জে বলল, তো কে করবে আর?
ইশা চোখ নামিয়ে নিল। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আপনি দাড়াঁন আমি মলম আনছি। আর জ্বলবে না। আদি তাকে ছাড়ল না। টেনে ধরল। ইশার হাত বুকে রেখে বলল, এখানে জ্বলছে মিষ্টি। এখানের চাইতে ও এখানে বেশি জ্বলছে। কিন্তু তুমি তা দেখতে পাচ্ছ না। নিষ্ঠুর তুমি মিষ্টি।
মিষ্টি তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নেয়। নিচে নেমে আসে। আদি ছাদের রেলিংয়ে হাতে ইচ্ছেমত আঘাত করে।
মিষ্টি চুপচাপ সব জিনিসপত্র গোছগাছ করে দেয়। আইমি এসেই তাড়া দেয়। আদি আড়চোখে মিষ্টির দিকে তাকায়। তার প্রচন্ডরকম রাগ হয় এ মেয়েটার প্রতি। এত নিষ্ঠুর মেয়ে কি করে হয়। রুমে গিয়ে সে আবার ও মিষ্টির চোখে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মিষ্টি ফিরে ও তাকায়না। আলিয়া চৌধুরী ডাকতে আসে। মিষ্টি সব জিনিসপত্র দিয়ে ফেলে দাড়োঁয়ানকে। গাড়িতে নিয়ে যায়। আদি শক্ত ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে মিষ্টির দিকে। যখনই দেখল সে মিষ্টির কাছে আবার ও অবহেলিত, তখন সে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকল। মিষ্টিকে সে চরম শাস্তি দেবে। চরম শাস্তি। তারপর ও তার দুচোখ টলমল করে উঠল। শেষ মুহূর্তে ও কি মিষ্টি একটিবার ভালোভাবে কথা বলবে না তার সাথে?
মিষ্টির বিয়ের শাড়িটা নিজের কাছে রেখে দিল। বলল, এই শাড়িটা আমার কাছে থাকুক মিষ্টি। দেবে?
মিষ্টি সাথে অন্যদিকে মুখ করল। এলোমেলোভাবে কাঁদল।
আদি ও অন্যদিকে মুখ করল। পান্জাবীর হাতায় চোখ মুখ মুছল। আবার ও তার কন্ঠ ধরে আসল। একটি বকুল ফুলের মালা দিয়ে বলল, এটি আমি তোমার জন্য গেঁথেছি মিষ্টি। তুমি আমায় ভুল বুঝেছ। আদি শুধু মিষ্টির জন্যই মালা গাঁথে মিষ্টি। তুমি সেটা ও বুঝলে না।
ইশা নিঃশব্দে কাঁদল, আদির দিকে তাকাল না। আদি আবার ও বলল,
আমি ফিরে আসার পর তুমি এ শুকনো বকুল ফুলের মালা তোমার খোঁপায় দিয়ে সাজবে। আমি ফিরে আসব। সত্যি।
তার নিজের একটি পান্জাবী ইশার হাতে তুলে দিয়ে বলে, এই পান্জাবীটা আমার খুব প্রিয়। এটি তোমার কাছে রাখবে। আমি এসেই যেন পায়। খুব যত্নে রাখবে মিষ্টি।
ইশা পান্জাবীটা হাতে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। আদি বসে পড়ে খাটে। মাথা চেপে ধরে। বলে,তুমি কেন আমায় আটকাচ্ছ না মিষ্টি।

ইশা আলিয়ার পায়ের কাছে বসে পড়ে। আইমি, আজিজ চৌধুরী ভড়কে যায়। ইশা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওঁনাকে আমার কাছে রেখে যান। আমি কথা দিচ্ছি পুরোপুরি সুস্থ করে তুলব আমি তাকে। আপনাদের ছেলেকে আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দেব। কিন্তু আমার চোখের আড়াল করবেন না প্লিজ। আমি কথা রাখব। ওঁনাকে নিয়ে যাবেন না। আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবেন না।
সবাই বিরক্ত হয় ইশার কথায়। বলে, যেখানে আদি রাজী হয়েছে সেখানে এতবড় সুযোগ আমরা কেন মিস করব? তোমাকে তো ভালো মনে করেছিলাম এখন দেখছি তুমি বড়ই সুবিধাবাদী একটা মেয়ে। সত্যি সত্যি তুমি নিজেকে এ বাড়ির বউ মনে করে নিয়েছ নাকি?
ইশা নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত হয়। ডক্টর কি তাকে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে?
ইশা ছুটে আসল। ততক্ষণে আদি নিচে নেমে এসেছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আলিয়া আর আইমি নিচে নেমে আদিকে দেখে খুশিতে আটখানা হলো। ইশার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছ আদি চলে যাওয়ার জন্য অলরেডি নেমে এসেছে।
ইশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আদি তাকানোর সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিল। আফিকে দেখা গেল। ইশা দেখে ও যেন দেখল না। বাড়ির কাজের লোকের পিছুপিছু সে দৌড়ে গেল। আদি গাড়িতে উঠে বসার আগেই পিছু ফিরল। দেখা গেল না মিষ্টিকে। মিনি গাড়ির ভেতরে খাঁচার ভেতর অনবরত ডানা ঝাপটাল। আইমি ছেড়ে দিতেই মিনি উড়ে এল মিষ্টির কাছে। মিষ্টির গালে গাল ঘেষে আদর দিল। ডাকল, মিষ্টি গুডবাই । তারপর উড়াল দিল আইমির কাছে।
আইমির ডাকে আদির সম্ভিৎ ফিরল। আইমির হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। দিক্বিদিক না দেখে দৌড়ে আসে মিষ্টির কাছে। জাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। এবার প্রকাশ্য কেঁদে দেয়। পুরোটাই বাচ্চাদের মতো। একবার চোখমুছে আরেকবার কেঁদে কেঁদে বলে, মিষ্টি আই হেইট ইউ। রিয়েলি হেইট ইউ। তুমি খুব কষ্ট পাবে মিষ্টি। খুব। আমার চাইতে বেশি কষ্ট পাবে। তুমি কাউকে বলতে ও পারবে না তোমার কষ্টের কথা মিষ্টি। দেখাতে ও পারবে না তোমার চোখের পানি। দেখাতে ও পারবে না। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছি। দূরে ঠেলে দেওয়ার শাস্তি তুমি পাবে। ঠিকই পাবে।
ইশা যখন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে আদি কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আবার ও ফিরে আসে। মিষ্টির মুখ আঁকড়ে ধরে বলে, এই মিষ্টি, আমি, এই আদি, এই ডক্টর ভালোবেসেছে তোমায়। কিন্তু তুমি ভালোবাসোনি। একটু ও বাসোনি। তুমি এই ডক্টরের জন্য ঠিকই কাঁদবে মিষ্টি। ঠিকই কাঁদবে।
কি আশ্চর্য। সবার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে আদি গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। একটিবার আর ফিরে তাকাল না। কারো কথায় কান দিল না। আইমি শুধু অবাক চোখে দেখল আদির কান্না। আদি কাঁদছে একটা বাইরের মেয়ের জন্য। এটা ও দেখার ছিল। কাজের লোকের ভীড়ে ইশা দাঁড়িয়ে থাকল। শুধু চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকল নির্নিমেষ। চিৎকার করে ডেকে উঠল,ডক্টর যাবেন না। যাবেন না। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমাকে আপনার মতো করে কেউ ভালোবাসে না ডক্টর। আপনি যাবেন না।
কে শোনে কার কথা। পুরো চৌধুরী বাড়িটাই যেন হয়ে গেল নির্জীব।
ইশা ফিরে তাকাল চৌধুরী বাড়ির দিকে। কি অদ্ভুত বাড়িটাতে কেউ নেই। পুরো শব্দহীন। মিষ্টি ডাকটা ভেসে আসেনা। কেউ জোরে চিল্লিয়ে ডাকে না, মিষ্টি।
শুধু অন্ধকারে সিড়ির রেলিং হাতড়ে হাতড়ে মিষ্টির মুখ দিয়ে বের হয় , ডক্টর, আপনি কোথায়?

চলবে,
( আপনাদের অনুভূতি জানাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here