#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৮ (সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা
পরী পা টিপে টিপে চলে যায় ইশার ঘরে। আদি এখনো হসপিটাল থেকে ফেরেনি। ইশাকে রুমে না দেখে পরী পিহুর রুমে চলে যায়। দেখে, পিহু ঘুমোচ্ছে মায়ের বুকে।
পরী পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় ইশার কাছে। পিহুকে সরিয়ে গুটিসুটি মেরে সে শুয়ে পড়ে ইশার পাশে। ইশার বুকে গুজে মিনমিন করে ডাকে, আমমমমা??
পিহু পাশ ফিরে আরামে ঘুমোয়। পরী ইশাকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে আবার ডাকে, আমমমা আমায় ক্ষমা করো। আমি তোমাকে আববাকে আর বোনকে সত্যি খুব খুব ভালোবাসি। তোমরা কেন বুঝোনা আমমা?
ইশা ঘুমের মাঝে বুকে টেনে নেয় পরীকে।মায়ের গায়ের মিষ্টি সুগন্ধ ঘুম এনে দেয় পরীর চোখে। পরী ঘুমে তলিয়ে যায়। আদি হসপিটাল থেকে ফিরে ইশাকে না দেখে পিহুর রুমে যায়। নিত্যকার ঘটনার চাইতে ব্যতিক্রম কিছু দেখে তার দুচোখ চকচক করে উঠল। আদি ধীর পায়ে হেঁটে বসে পড়ে ইশার পাশে। ইশাকে ডিঙিয়ে ছুঁয়ে দেয় পরীর কপাল। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে চুমো দেয়। পরী বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। কতদিন ভালো করে ঘুমোয় না।
আদি আস্তে আস্তে ডাকে ইশাকে। এতসুন্দর একটি দৃশ্য ইশা দেখলেই কি করবে তা ভাবতে না ভাবতেই ইশা নড়েচড়ে উঠল। আদি ডাকল,মিষ্টি এই দেখো। তোমার পাশে কে ঘুমোচ্ছে???
ইশা পিটপিট করে চোখ খুলতেই তার চক্ষুচড়ক। ইশার গাল বেয়ে টপটপ টপটপ জল গড়াল নিঃশব্দে। উত্তেজনায় ইশার গলা শুকিয়ে যায়। এলোপাথাড়ি চুমু দেয় মেয়ের কপালে,গালে। পিহু ও জেগে উঠে। রেহান পরীকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে পিহুর দরজার সামনে। ভেতরে ডুকে দেখতে পায় হাসিখুশি তিনটি মুখ। আর একটি ঘুমন্ত মুখ । ঘুমন্ত মেয়েটিকে এভাবে এখানে ঘুমাতে দেখে যেন রাজ্যের খুশির ঢল নামল মা বাবা আর বোনের মুখে। ঘুমন্ত মেয়েটিকে হঠাৎ করে খুব সুখী মনে হলো রেহানের। পরীর সব আছে। শুধু তার নেই। সে ফকিরের বাচ্চা। লোভী।
পিহু, আদি, ইশা তিনজনই নীরবে হাসল। আর যাকে দেখে তারা এত খুশি সে বেঘোর ঘুম। ঠোঁটটা ফুলিয়ে রেখে ঘুমোচ্ছে। ইশা সেই ফুলিয়ে রাখা ঠোঁটটার উপর আদর করে ডাকে,
‘ পরী মা। এই আমমা,,,
পরী ঘুম। ঘুম।
আদি পিহু দেখার সাথে সাথে রেহান তাড়াহুড়ো করে সরে পড়ে সেই জায়গা থেকে। হাঁটতে হাঁটতে হাতের কব্জি দিয়ে মুছে নেয় ভেজা চোখ। ঘেমে উঠা কপাল। সে এটাই চেয়েছে সবমসময়। পরী ভালো থাকুক।
_______________
পরীর ঘুম ভাঙল প্রায় ভোর পাঁচটার দিকে। ঘুম থেকে নড়েচড়ে উঠতেই পাশে থাকা ইশা প্রায় লাফ দিয়ে উঠল। পরী বিছানা থেকে নেমে যেতেই ইশা ঝাপটে ধরল। বলল,
‘ কোথায় যাচ্ছ? আমাদের রাতের ঘুম হারাম করে এখন পালানো হচ্ছে?
পরী শক্ত হয়ে বসে রইল। ইশার হাত ঠেলে দিয়ে বলল,
‘ আমাকে এখানে কে এনেছে?
ইশা হাসল। বলল, ভূতে এনেছে।
পরী তাকাল ইশার হাসিখুশি মুখের দিকে। মায়ের মুখের উজ্জ্বল প্রাণবন্ত হাসিটা কি সে এই প্রথম দেখল? হাসিটা এত সুন্দর কেন? তার নিজের মা বলে? নাকি এমনি ও সুন্দর। তাহলে পরী দেখেনি কেন?
পরী চোখ সরিয়ে ফেলে। বলে, আমার আজ অডিশন। ছাড়ুন। যেতে হবে।
ইশা পরীর কাছাকাছি ঘেষে বসে। পরীকে তার দিকে ফিরিয়ে মুখ আগলে ধরে বলে,
‘ আজ আমি যদি যাই তাহলে কি রাগ উঠবে??
পরী চোখ নামিয়ে বলে, জানিনা।
ইশা খিক করে হেসে দেয়। বলে,
‘ আমি যাবই যাব। আমার পরীর গান শুনব।
পরী চোখ তুলে তাকায় আবার। এবার চোখ নামায় না। তাকিয়ে থাকে অপলক।
ইশা ভ্রু কুঞ্চন করে বলে, কি দেখছে মা??
পরীর নাক মৃদুমন্দ কেঁপে কেঁপে উঠে। ইশা স্নেহের স্পর্শ দেয় পরীর কপালে। পরীর চোখ থেকে সাথে সাথে গড়ায় জল। ইশা দেখার সাথে সাথে বলে,
‘ মা কি কাঁদছে? কেন কাঁদছে? আমমা কি আবার দুক্কু দিয়েছে?
পরী গলা জড়িয়ে ধরে ইশার। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ইশা কান্নাহাসিতে ভাসে। পরী মুখ তুলে ইশার গালে গাল লাগিয়ে ডাকে, আমমমা।
ইশা এবার একদম আওয়াজ করে কেঁদে দেয়। পরী ইশার গালের পাশ ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে। চোখের জলে, ঠোঁটের ভেজা স্পর্শে ভিজে যায় ইশার গাল। পরী ফুঁপিয়ে উঠে উঠে বলে,
‘ আমমা আমায় ক্ষমা করেছ??
ইশা পরীর ভেজা দুগাল মুছে দিয়ে বলে,
‘ তোমার উপরে কোনোকালেই রাগ ছিলনা আমাদের। ক্ষমার প্রশ্ন কেন আসছে? পরীকে তার আমমা আববা খুব ভালোবাসে। কিন্তু পরী কি বাসে???
পরী উপরনিচ মাথা নাড়ে কয়েকবার। ইশা হেসে পরীর মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল আদি চোখ কচলে কচলে চলে আসল। চোখে হাত দিয়ে কচলে কচলে বলল,
‘ মিষ্টি আমার ঘুম হয়নি ধুরর। তুমি আসোনি কেন? ধ্যাত।
ইশা জিভে কামর দিয়ে রাখে।
‘ এই লোকটা কখন কি বলে ফেলে। নির্লজ্জ লোক একটা!
পরী মাথা তুলে আদিকে একবার দেখে। আবার ইশাকে জড়িয়ে ধরে। আদির কথা বুঝতে পেরে মিটিমিটি হেসে দেয় নিঃশব্দে। আদি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। পরীকে দেখে কি বলবে তা যেন ভুলে গেল। পিহু ও ঘুম থেকে উঠে পড়ল। আদি ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ আমার কপালে একটু ও আদর মহব্বত নাই। আমি কারো বাবা টাবা নই। আমার মেয়ে টেয়ে নেই। বউ ও নেই।
পরী মুখ তুলে তাকাল। পরী কথা না বলায় আদির রাগ লাগল। বলল,
‘ মিষ্টি আমি যাচ্ছি। তুমি থাকো তোমার মেয়ের সাথে।
পরী ইশাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। বলল, ইনননা।
আদি বলল, পিহু তুমি আসো। আমরা মর্নিং ওয়াকে যাব একসাথে। এই মহিলা আর তার মেয়ের সাথে তুমি কথা বলবে না। পিহু খাট থেকে নেমে আদির কাছে যেতে না যেতেই পরী দৌড়ে যায়। এতদিনের দূরত্ব,মান অভিমান কাটিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে ডাকে,
‘ আববা তুমি আমাকে কেন ভালোবাসো না। সবসময় পিহু পিহু করো। আমি তোমার মেয়ে নই??
আদি চোখ চোখ বড় বড় করে তাকায় পিহুর দিকে। পিহু মিটিমিটি হাসে। আদি চোখ মেরে দেয় পিহু আর ইশাকে। ইশা চোখ রাঙায়। আদি পরীর চুলের উপর হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
‘ না তুমি শুধু মিষ্টির মেয়ে। আমার মেয়ে শুধু পিহু।
পরী আওয়াজ করে কেঁদে দেয়। ইশা চিৎকার করে বলে, কি করছেন ডক্টর?
পরী আদিকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। আদি একেবারে টেনে ধরে শক্ত করে বুকের সাথে পিষ্ট করে বলে,
‘ মাববববো। পরী পাজি হয়ে গেছে বেশি।
পরী আর ও জোরে কেঁদে দেয় আদির আহ্লাদ শুনে। আদি তার কপালের একপাশে গাঢ় চুমু দিয়ে বলে,
‘ আমার দুইটা কলিজা। জানো????
একটি পরী আরেকটি পিহু। এদের ছাড়া আমি নিঃস্ব। আর এদের ভালোবাসি কিনা প্রশ্নটা কি আদৌ উঠার কথা???
পরী মুখ তুলে তাকায় আদির দিকে। কপাল দেখিয়ে বলে, আদর করো।
আদি একগাল হাসল। কপালে গাঢ় আদর দিয়ে বলে, আমালটা দাও।
পরী খিলখিল করে হেসে উঠে আদির কথা শুনে।
বাবার গালে সেই ছোটবেলার পরীর মতো লালা লাগিয়ে দিয়ে ডাকল , আমার আববা।
আদি হেসে বলল, উহুম তোমার না। পিহুর।
পরী মাথা দিয়ে আদির বুকে মেরে বলে, নাআআ আমার। পিহু অনেক আদর পেয়েছে। আমি পাইনা।
আদি একহাতে ডাকল পিহুকে। মলিন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল পিহু। আদি ডাকার সাথে সাথে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আদিকে। দুহাতের বন্ধনে দুইমেয়েকে আবদ্ধ করল আদি। আজ ঠোঁটের সাথে সাথে চোখদুটো ও হাসল। ইশা দুচোখ ভরে দেখল বাবা আর মেয়েদের খুনসুটি।
আদি চোখ তুলে দেখল মিষ্টির মিষ্টি হাসি। বলল, মিষ্টি ভালোবাসি।
পরী আর পিহু একসাথে খিলখিল সুরে হেসে উঠল। ইশা চোখের উপর কাপড় দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল রুম থেকে। এই নির্লজ্জ লোকটাকে নিয়ে সে মহাজ্বালায় আছে।
বাপ মেয়ে তিনজনের হাসিতে মুখোরিত হলো পুরো ঘর। তা সদ্য ঘুম থেকে উঠা রাইনার কানে গিয়ে বিঁধল। টলমলে চোখের জল মুছতে মুছতেই তার সামনে এসে পড়ে ইশা। কিছু বলে উঠার আগেই রাইনা হনহন পায়ে হেঁটে চলে যায়।
____________________
পরী ভেবেই নিল যে সে সেকেন্ড হবে। রেহান ফার্স্ট। ইশা অনেক করে বুঝাল। রেহানের জয় মানে তারই জয়। সবাই জানে যে সেই রেহানের স্ত্রী। বরঞ্চ রেহান ফার্স্ট না হলে কিংবা সেকেন্ড হলে পরীরই লজ্জা। পরী মাথা নাড়ল চুপচাপ। এভাবে কেউ তো কখনো বুঝায় নি। হয়ত বুঝিয়েছে পরী বুঝেনি। মা বাবার উপর থাকা রাগ অভিমানের চোটে সে কি কোনোমতে কষ্ট দিয়ে ফেলল কাউকে?
সকাল থেকে রেহানকে কোথাও দেখা গেল না। পরী বালিশের উপর একটি কাগজ দেখতে পেল। পরী খুলে দেখে, রেহান তাতে বলেছে।
‘ আমি ক্লাব থেকে সোজা অডিশনে যাব। তুমি সবাইকে নিয়ে চলে এসো। অল দ্য বেস্ট। আই উইশ আজকে তুমিই অ্যাওয়ার্ডটা পাবে।
পরীর বিরক্ত লাগল। এই ব্যাটা এত ডং দেখায় কেন??
অডিশন শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে রিক, রিপ মুনাকে আসতে দেখা গেল। পরী তাদের দেখে ছুটে গেল। রিক ভেবেছিল পরী কথায় বলবে না। কিন্তু পরী এসে রিককে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
‘ পাপা মিস ইউ। মিস ইউ এ লট। আ’ম সরি পাপা।
রিক হেসে দেয়। বলে, সরি কেন? সরি তো আমার বলা উচিত। কিন্তু আমি সরি বলব না। যে ভুল করেছি সেই ভুলের মাশুল দেব।
পরী অতটা ভাবল না রিকের কথাগুলোকে। রিপের কাছে গিয়ে বলল,
‘ পাপা তুমি ক্ষমা করেছ আমায়?
রিপ হাসল। পরীর মাথাটাকে হাত দিয়ে নাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘ পরী দোষ করেনি তো। ক্ষমা কেন করব?
পরী হেসে জড়িয়ে ধরে। বলে, আমার গান শুনতে এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। ভাই কোথায়?
রিপ বলল, ও কিছুক্ষণ পরে আসবে। ও এডমিশন টেস্টের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেনা? কোচিং থেকে ফিরে চলে আসবে।
পরী মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ আজকে ও কোচিংয়ে যেতে হলো?
পিহু মুখ মোচড়াল নিজে নিজে।
‘ বাহ মাহিদ সাহেব পড়তে পড়তে তো একেবারে মগজ শুকিয়ে ফেলছে। ফোন দিলে খ্যাঁকখ্যাঁক ছাড়া কিছুই পারেনা। সারাক্ষণ বাপ বাপ করতে থাকে।
____________
অডিশন শুরু হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এল। পরী এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে আর কারো কথায় তার মাথায় থাকল না। একজন একজন করে গান গেয়ে চলে গেল গায়ক গায়িকা। পরীর পালা আসল। পরী ভয়ে ভয়ে স্টেজে উঠল। চারদিক করতালিতে মুখোরিত হলো। পরী স্টেজে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, আদি,ইশা,রিক, রিপপ আর মুনাকে। এরাই তার অভিভাবক। আপন। ভালোবাসা। পরীর নিজেকে সবচাইতে সুখী সুখী মনে হলো। সবাই কত ভালোবাসে তাকে। সে এতদিন আম্মা আব্বাকে ভুল বুঝে নিজের ক্ষতিই করেছে। পিহু হাত নাড়িয়ে ডাকছে, দিদিয়া। পরী হেসে দিল পিহুর কান্ড দেখে।
রিনরিনে কন্ঠস্বরে মনের মাধুরী মিশিয়ে গাইল।
ওরা মনের গোপন চেনে না
ওরা হৃদয়ের রং জানে না
প্রজাপতি ডানা ছুঁলো বিবাহ বাসরে
কেন সারারাত জেগে বাড়ি ফিরি ভোরে?
ওরা মনের গোপন চেনে না
ওরা হৃদয়ের রং জানে না
তুমি চিরদিন, ভীষণ কঠিন
তোমার ঘর ভেসে যায় ওরা
মুখ দেখে বুঝতে পারে না
তুমি চিরদিন, ভীষণ কঠিন
তোমার ঘর ভেসে যায় ওরা
মুখ দেখে বুঝতে পারে না
ওরা এ মন কেমন বোঝে না
ওরা আসল কারণ খোঁজে না
তুমি চিরকাল, স্বপ্নে মাতাল
হেঁটে সারাজীবন ধরে, ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে
তুমি চিরকাল, স্বপ্নে মাতাল
হেঁটে সারাজীবন ধরে, ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে
ওরা মনের গোপন চেনে না
ওরা হৃদয়ের রং জানে না
প্রজাপতি ডানা ছুঁলো বিবাহ বাসরে
কেন সারারাত জেগে বাড়ি ফিরি ভোরে
ওরা মনের গোপন চেনে না
ওরা হৃদয়ের রং জানে না।
পরী স্টেজ থেকে নেমে। তার কন্ঠস্বরের গুনগান গাইল বিচারকেরা। তারা ধরেই রাখল যে পরীই ফার্স্ট হবে। কিন্তু মঞ্চ কাঁপিয়ে নীরবে পা টিপে টিপে সবার সামনে দৃশ্যমান হলো একটি ছেলে। ভীড়ের মানুষ যেন উত্তেজনায়য় একপ্রকার হৈ হুল্লোড় করে উঠল। রেহান নিজেই অবাক। এতগুলো মানুষ তাকে ভালোবাসে? আর সে কিনা শুধু দুইজন মানুষের জন্য নিজেকে এতটা তুচ্ছ ভাবছিল? রেহান তাকাল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মলিন মুখের মহিলাটির দিকে। রাইনা চোখ ফিরিয়ে নিল। রেহানের কষ্ট লাগল। বেহায়া দুচোখ এতশত অপমানের পর ও খুঁজে বেড়াল তার সো কল্ড ড্যাডকে। কিন্তু তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই এখানে। পরীর গান শোনার সাথে সাথে সে কেটে পড়ল। রেহানের হাসিখুশি মুখটা নিভু নিভু হতে না হতেই মঞ্চ রঙিন হয়ে উঠল। দুচোখের পলক নিমেষেই নিবদ্ধ হলো ওই দর্শকশ্রোতার ভীড়ে কোনো ভালোলাগার একটি মুখে। অযাচিত হাসিটা ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণায়। কিন্তু হাসিটা ফুটে উঠার আগেই কেন যেন সেই ভীড়ের মাঝে দাঁড়ানো রমণী অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে কথাবার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যেন সে মুখোমুখি হতেই চাইনা ছেলেটির। চোখে
রেহানের হাসিটা সেখানেই দমে গেল। কি আশ্চর্য! সে কেন নির্লজ্জ হতে যাই বারবার? সে কেন ভুলে যাই , সেরা সিংগারের উপাধি পেলে ও ফকিরের বাচ্চার উপাধি মুছে যাইনা। আর ফকিরের বাচ্চাদের দেখে দয়া, সহানুভূতি উতলে উঠে।
ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা নয়।
পুরো দর্শকমহলে টান টান উত্তেজনায় ও রেহানের মন খারাপের বিষয়গুলো গেঁথে থাকে। আজ এই মন কেমনের সন্ধ্যায় আচমকা তার চোখে চোখ রেখে দূরে দাঁড়িয়ে যদি একটু মুচকি হাসি দিত তাহলে খুব বেশি একটা ক্ষতি হয়ে যেতনা। বরঞ্চ ভালো হতো। শুধু ভালো হতো না,খুব বেশি ভালো হতো।
কিন্তু তার অতো সময় কোথায়?
ভক্তদের অটোগ্রাফ দিতে দিতে সে বড্ড ব্যস্ত। এতটাই যে আড়চোখে তাকানোর মতো ভুলটা ও সে করতে ইচ্ছুক নয়।
পরী কানের ইয়ারফোন গুজে দেয় ভালো করে। যাতে আশেপাশের কোনো আওয়াজ কানে না আসে। তারপর ও ভেসে আসছে গান। গানের কথা। পরী আর ও ভালোভাবে গুজে দেয় ইয়ারফোন। হাত থেকে খসে পড়া কলম উঠিয়ে সে বলল,
‘ আমি আসছি।
পরী লম্বা লম্বা পা ফেলে মিশে যায় ভীড়ের মাঝে। সে পিছু ফেলে আসে মঞ্চ। মঞ্চে থাকা ছেলেটির দৃষ্টি। কিন্তু তার পিছু ছাড়েনা গানের কথাগুলো।
” অগোছালো দিন-রাত বলে যায়
হাতে রাখা তোর হাত বলে যায়
ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি আমি
অগোছালো দিন-রাত বলে যায়
হাতে রাখা তোর হাত বলে যায়
ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি আমি
শোন আজ বাকি কথা থাক
বেরিয়ে যাই বেড়াতে
এই মন তোর নামেতে জমাক
স্বপ্নে পাওয়া তারাদের
এভাবেই দিন-রাত ঢলে যাক
মন আমার বার বার বলে যাক
ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি আমি
ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি আমি
আকাশ কুসুম ভাবিস না আর
সব দিয়েছি তোকেই আমার
চাউনিতে তোর পাগল হয়ে যাই
মনের ভিতর নদীর জলে
রঙ্গিন রঙ্গিন নৌকো চলে
চল না এবার হঠাৎ বয়ে যাই
শোন আজ বাকি কথা থাক
বেরিয়ে যাই বেড়াতে
এই মন তোর নামেতে জমাক
স্বপ্নে পাওয়া তারাদের
এভাবেই দিন রাত ঢলে যাক
মন আমার বার বার বলে যাক
ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি আমি
ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি আমি
পুরো মঞ্চ আর দর্শকমহল কল্লোলিত হয় রেহানের গানের গুনগানে। সবাই নিজেদের ভেতর বিশ্বাস পোষন করে রাখে এই অডিশনের আওয়্যার্ড রেহানই পাবে। কিন্তু হলো তার বিপরীতটা। পরী খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় নিজের নাম শুনে। আদি ইশা রিপ রিক মুনাকে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে খুশিতে। আশপাশ ভুলে খুশিতে পাগলাপারা হয়। রাইনার কাছে গেলেই রাইনা সরে দাঁড়ায়। হাত দেখিয়ে বলে,
‘ যথেষ্ট হয়েছে। এত আশীর্বাদ দিয়ে কি করবে? আমি না দিলে কিছু হবেনা।
পরীর মুখ কালো হয়ে যাই। বলে,
‘ তুমি কি আমার উপর রেগে আছ বড়মা??
রাইনা গটগট করে হেঁটে চলে যাই। রেহান রাইনার পিছু নেয় মা মা ডেকে ডেকে। রাইনা শোনেনা। রেহান রাইনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আটকায়। বলে, মা কিসের এত রাগ?? এসব কোনো ব্যাপার না। গান আমার সব নয় মা? আমার তো গান না গাওয়ার কথা ছিল,চাচ্চুর কথায় গেয়েছি। মা একবার ভাবো পরীর যা, আমার ও তা। প্লিজ মা রেগে থেকো না। তুমি ছাড়া আমার যে কেউ নেই মা। তুমি রেগে থাকলে আমার কষ্ট হয়।
রাইনা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,
‘ কে তোর মা। আমি তোর মা নই?
রেহানের কাছে দৌড়ে আসে ভক্তরা। প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ স্যার আমরা কিছুই বুঝতে পারছিনা। মাঝখান থেকে আদিশা ম্যাডাম কি করে???
রেহান হেসে শুধু জবাব দিল,
‘ ওর যা আমার ও তা। মনে করুন ওই আওয়্যার্ডটা আমি পেয়েছি।
______
রেহানের আশেপাশে জটলা পাকিয়েছে লোকজন। অটোগ্রাফ দিতে দিতে ক্লান্ত সে। হাসিমুখে সবার প্রশ্নের উত্তর ও দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই চোখতুলে তাকাতেই সামনের ভীড় ঠেলে আসা মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। বলল,
‘ অটোগ্রাফ।
আদি গাড়ি থেকে নেমে এল পরী কোথায় যাচ্ছে তা দেখার জন্য। পরীকে ভিড়ের মাঝে ডুকে যেতে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
রেহান হাসল মৃদু। একদম চোখে চোখে তাকিয়ে দিয়ে দিল অটোগ্রাফ। বলল, কনগ্রেসুলেশন মিস.আদিশা খানম।
সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল রেহানের দিকে। নিজের ওয়াইফের সাথে এভাবে কথা বলছে রেহান চৌধুরী?
পরী এক পা এক পা পিছু পিছু হেঁটে হেঁটে বহুদূরে চলে আসে। অনেকদূরে চলে আসার পর তাকায় নিজের হাতের দিকে। চোখের সামনে ভাসে সেই লেখা।
‘ ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি আমি।
পরী চোখ তুলে তাকায় রেহানের দিকে।
বিড়বিড় করল, ভালোবাসা??????
ভালোবাসা কারে কয়???
___________
পিহুর স্কুল ছুটি হলো সে বহুদিন পর দেখল মাহিদ দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের সামনে। পিহুর হাতে চিঠি গুজে দিয়ে বলল,
‘ ওই তোর বান্ধবী রাইসাকে দিবি এই চিঠি। ওই নেহা মেহার ন্যাকামার্কা কথা শুনলে আমার গা গুলায় বমি পায়। তোরে কি কইছি,হুনছস??
পিহু মাথা চেপে ধরল। বলল,
‘ পুরা স্কুলের সব মেয়েকেই তোমার লাগবে?????
মাহিদ তার মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘ লাগব। শুধু তুই ছাড়া।
পিহুর রাগ লাগল। সে বলল,
‘ মাহিদ ভাই আমার পথ ছাড়ো। রাইসার সাথে আমি কথা বলিনা।
মাহিদ মাথার দুপাশ চেপে ধরে বলল, ও বাপ। আমার মাথা গরম হইতাছে। তোরে আমি কি করি? কথা একবারেই হুনছ না ক্যান বাপ?
পিহু তার লম্বা জিহ্বা বের করে দিয়ে বলল,
‘ ভ্যা ভ্যা ভ্যা। ডং ছাড়ো। পড়াশোনায় মন দাও। যাও।
মাহিদ মাঝরাস্তায় বসে পড়ল। গর্জে বলল,
‘ ওরেব্বাপপ তোরে আমি আজ গাড়ির নিচে চাপা দিয়া মারুম শালী। তুই আমার হুনছ না ক্যান। মুখে মুখে তর্ক করস ক্যান? আমি কি তোর দুলাভাই লাগি?
পিহু যেতে যেতে বলল,
‘ তোমাকে পাগলের মতো লাগছে। রাস্তায় এভাবে বসেছি কেন?
মাহিদ দৌড়ে গিয়ে পিহুর চুলের ঝুটি ধরে। বলে, ওই ডাক্তারের বাচ্চি মাইরা ফেলুম তোরে। আর তারপর আমি জেলে যামু।
পিহু মুখে মুখে বলল,
‘ হুহহ, যাও গিয়ে। তোমার বাপ ব্যারিস্টার তোমার এসব কান্ড দেখলে এমনি এমনি জেলে পুড়বে।
মাহিদ রেগে গেল। বলল, তোর বোতলে পানি থাকলে দে তো। তোর সাথে ফটরফটর করতে গিয়া আমার গলা শুকায় গেছে।
পিহু বোতল বাড়িয়ে। খালি বোতল হাতে পেয়ে মাহিদ রেগে বোতল দিয়ে মারে পিহুকে। বলে,
‘ তোর ডাক্তার বাপের মাথা রাখছস এইখানে? ওরেব্বাপ আমি মইরা যামু এখন পানির তেষ্টায়।
পিহু কাঁদতে কাঁদতে ও খিক করে হেসে বলল, মরে যাও।
মাহিদ তার পিঠে থাকা ব্যাগ দিয়ে ঘুরিয়ে মারে পিহুকে। তারপর মাথার চুল টেনে শক্ত করে টেনে ধরে বলে,
ওরেব্বাপ আমার মাথা গরম হইছে। গরম ধোঁয়া উঠছে কান দিয়া। তুই আমারে মেরে ফেললি ডাক্তারের বাচ্চি।
______________
পরদিন রেহানের সামনে গিয়ে অডিশন থেকে পাওয়া সব টাকা,চেক আর আওয়্যার্ডটি ছুড়ে ফেলে পরী। চেঁচিয়ে উঠে কেঁদে কেঁদে বলে,
‘ আমাকে দয়া দেখিয়েছেন? এমন দয়া আমার চাইনা।
রেহান হতভম্ব হয়ে যায়। পরী চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে বলে,
‘ আমি তো ফার্স্ট হতে চাইনি। আমার কোনো দোষ নেই। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার নামে উল্টাপাল্টা কথা ছড়ানো হচ্ছে। আমি রেহান চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেল করে নাকি এই আওয়্যার্ডটা আদায় করেছি? সুযোগ নিয়েছি।
পরী কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে। রেহান থামাতে আসে। বলে, পরী কে বলেছে এসব কথা? কখন?
আফি এসে কষে চড় বসায় রেহানের গালে। টাকাগুলো রেহানের মুখে ছুড়ে মেরে বলে,
‘ কুত্তারবাচ্চা তুই কাকে নিয়ে খেলা করছিস? তুই ফকিরের বাচ্চা তোর টাকা নিয়ে বেরিয়ে যাহ এই বাড়ি থেকে। তুই চৌধুরী বাড়ির মেয়েকে নিয়ে খেলা করছিস? তুই যাহ। দূর হ। পথে পথে গলা বিক্রি করে রোজাগার করে খা। রাইনা সিড়ির রেলিঙ ধরে বসে পড়ে মাথায় হাত দিয়ে। হয়ত বেহুশ ও হয়ে পড়ে। রেহান ধরতে পারেনা। ছুঁতে পারেনা। দেখতে ও পারেনা। আফি তাকে বের করে দিয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। রাইনা ঢলে পড়ে সিড়ির মাঝবরাবর। রেহানের মা ডাকটি কিছুক্ষণ পর আর ভেসে আসেনা।
চলবে,,,