#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_১৭
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
রিকশা এসে থামলো খান বাড়ির গেইটের কাছেই। রিকশা থেকে নেমে পিহু বাড়ির দিকে হেঁটে গেল। মাহিদ ভাড়া চুকিয়ে পিহুর পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলল
‘ আমি কি তোর জামাই লাগি? তুই ভাড়া দেস নাই ক্যান?
পিহু থামলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। বলল
‘ জামাই হওয়ার প্র্যাক্টিস করো। তোমার বউ আসতে বেশি দেরী নেই।
মাহিদ চোখ গরম করে চাইলো। পিহু এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লো। তখনি ছিকুর মুখোমুখি। সে সোফার উপর বসে আছে। মটু পাতলু দেখছে। হাতে ফুটবল। পিহুকে দৌড়ে আসতে দেখে সে চমকে উঠলো। বলল
‘ ছিকু ভয় পাচি কেন? পিহু দুড়ে আসিছে কেন?
পিহু হেসে তার পাশে গিয়ে বসলো ধপাস করে। মাহিদ ও এল পরপর। ছিকু তাকে দেখে খুশি হলো। দাঁত দেখিয়ে হাসলো। বলল
‘ মিহি ছিকুর জুন্য চকলেট আনিনি কেন?
মাহিদ পকেটে হাত দিয়ে যা পেল তা ছুঁড়ে মারলো ছিকুর দিকে। বলল
‘ ল শালা। তোরে চকলেট চকলেট খাওয়াইতে খাওয়াইতে আমি ফতুর হইয়্যা যামু বাপ।
ছিকু চকলেট পেয়ে মহাখুশি। সেগুলো কুড়িয়ে নিল। পিহু একটা তুলে নিয়ে প্যাকেট ছাড়িয়ে গালে পাচার করে দিয়ে বলল
‘ উম খুব মজা।
ছিকু মন খারাপ করে ফেলল। বলল
‘ পিহু ছিকুর চকলেট খায় ফিলছে কেন? মুজা মুজা বলে কেন?
মাহিদ গিয়ে ছিকুর পাশে বসলো। ছিকুকে তার কোলের উপর নিয়ে বলল
‘ রাক্ষসী ডাক বাপ।
‘ কেন ডাকবু কেন? পিহু রাক্ষুচী কেন?
পিহু নাক ফুলিয়ে মাহিদের দিকে চাইলো। কুশন নিয়ে মাহিদের মুখে ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ একদম পঁচাবেনা আমায় মাহিদ ভাই। তুমি আমাকে কি পেয়েছ?
‘ পাইলাম কই বাপ?
‘ ওকে ওসব শেখাবেনা মাহিদ ভাই। ও আমাকে রাক্ষসী ডাকা শুরু করবে আবার। তোমার মুখে তো ভালো কথা নাই।
‘ যে ভালা কথা কয় তার কাছে যাহ। তোরে ধরে রাখছ কে?
পিহু কুশন তুলে আবার ছুঁড়ে মারলো মাহিদের মুখে। ছিকুকে বলল,
‘ আপনাকে কেক দেব না। আপনি আমাকে রাক্ষসী ডেকেছেন কেন?
বলেই হনহনিয়ে চলে গেল সে। ছিকু মন খারাপ করে বসে থাকলো।
মাহিদ হা হু করে হাসলো। ছিকু ও তার সাথে খিকখিক করে হাসলো। রিপ আসলো। বসলো সোফায়। টিভির চ্যানেল পাল্টানোর সময় ছিকু তাকে বলল
‘ বেরিচতার, মিহি পিহুকে রাগায় দিচে কেন? রাক্ষুচী ডাকতে বলেছে কেন?
মাহিদ ছিকুর গাল চেপে ধরলো তার গালের সাথে। বিড়বিড় করে বলল
‘ শালা আর কথা পাস নাই?
ছিকু মাহিদের দিকে চাইলে মুখ তুলে। বলল
‘ মিহি এখুন আদর কচচে কেন?
‘ মাহিদ তাকে ধপাস করে সোফায় ফেলে দিল। তারপর পিঠে চাপড় দিয়ে চলে গেল। রিপ তার যাওয়ার দিকে একটুখানি চোখ তুলে তাকালো।
ছিকু সোফায় ব্যাঙের মতো পড়ে রইলো। রিপ হেসে ফেলল। হেঁটে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে আবার সোফায় বসে বলল
‘ ভাইকে সবাই একা একা এখানে বসিয়ে রেখেছে কেন?
‘ চবাই ইকা ইকা ছিকুকে ফেলি রাখচে কেন?
রিপ তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিল। বলল
‘ ছিকু তো একা নয়। বেরিচতার ও আছে।
ছিকু রিপের মুখের দিকে তাকালো। বলল,
‘ বেরিচতার ও আচে কেন?
রিপ হেসে উঠলো।
___________
পিহুর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মুখ মোছার তোয়ালে নিল। দেখলো ফোনে নিনিতের কল। পিহু কল ব্যাক করলো। নিনিত কিছুপরেই ফোন তুললো।
‘ আসসালামু আলাইহকুম স্যার।
‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম। পৌঁছে গিয়েছ?
‘ হ্যা। আমি আপনাকে জানাতেই যাচ্ছিলাম।
‘ মা জিজ্ঞেস করছিল। ওকে রাখি। টেক কেয়ার। কাল দেখা হচ্ছে।
‘ জ্বি।
ফোন কেটে গেল টুইটটুইট শব্দ করে। পিহু তোয়ালে রেখে দিল। মাহিদ তার ঘরে এসে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ফোনে মনোযোগ দিয়ে বলল
‘ চল।
‘ কোথায়?
‘ আইসক্রিম খামু।
‘ এখন?
‘ হু।
‘ কোথায়? কেন?
মাহিদ লাফ দিয়ে উঠে বসলো। বলল
‘ ওই লেকের পাড়ে যামু। চল, চল। তোর জন সারপ্রাইজ। ছিকু শালারে ও লইয়্যা যামু। চল। আয়।
বলেই মাহিদ রুম থেকে বের হয়ে গেল। পিহু একটি কূর্তি পড়া ছিল কালো রঙের। এটি তাকে রেহান দিয়েছিল। মাহিদ কিছুক্ষণ পর এল ছিকুকে কোলে নিয়ে। ছিকু ও কালো শার্ট পড়েছে। পায়ে সুন্দর একজোড়া জুতো পড়েছে। পিহুকে দেখে বলল
‘ ছিকু ও যাবে কেন? আইসকিম খিতে যাবে কেন?
পিহু হাসলো। মাহিদ যেতে যেতে বলল
‘ তাড়াতাড়ি আয়।
পিহু হেঁটে গেল। নীরা বলল
” এখনই তো এলি? আবার কই যাস?
মাহিদ বলল
‘ যাব আর আসবো। চিন্তা নাই বাপ।
‘ সাবধানে যাস।
তারা বেরিয়ে গেল। মুনা বলল
‘ এরা তিনজন ঝগড়া করতে ও দেরী হয় না। আবার ভাব পড়তে ও দেরী হয় না। তিনজনই এক ক্যাটাগরির।
পরী বলল
‘ একদম। পিচ্চিটাকে দেখোনা। কি খুশি বাইরে যাচ্ছে তাই। এত পন্ডিত!
মুনা হাসলো। বলল
‘ মাহিকে পেলে ও ভীষণ খুশি। আর কাউকে লাগেনা ওর।
___________
লেকের পাড়টা সবসময় আলোকিত থাকে। নানান রকম দোকান বসে, ছোট বাচ্চাদের খেলার জিনিস, ছোট্ট ছোট্ট নিত্যদিনের ব্যবহার করার জিনিস, খাবারের দোকান ইত্যাদি ইত্যাদি। বাতির আলো পড়ছে লেকের স্বচ্ছ জলে। পিহু বলল
‘ তুমি কি কাউকে খুঁজছ মাহিদ ভাই?
মাহিদকে কিছু বলতে হলো না। কোথা থেকে হন্যি হয়ে মাইশা দৌড়ে এল। পাশে একটা ছোট্ট মেয়ে। ছিকু মাহিদের কোলে লাফ দিয়ে উঠলো। বলল
‘ মাইচা আসিছে কেন? মাইচা বিটিফুল কেন?
মাইশা হাসলো। মাহিদের কোল থেকে ছিকুকে নিয়ে আদর করলো। বলল
‘ কেমন আছেন আপনি?
‘ পাইন।
‘ ওরেবাবারে।
পরে মাহিদের দিকে তাকালো মাইশা। বলল
‘ কেমন আছেন?
‘ ভালো। আপনি?
‘ ভালো না থাকলে এখানে আসতাম? হেই পিহু কেমন আছ?
পিহু মাথা নাড়লো। ও এজন্যই এখানে আসা? মাহিদের উপর ভীষণ রাগ লাগলো তার। বউয়ের সাথে দেখা করতে আসবে আসুক গে, পিহুকে সাথে নিয়ে আসার কি দরকার?
ছোট্ট মেয়েটির সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিল মাইশা। ওর নাম আহানা। ক্লাস ফাইভে পড়ে। মাইশার মামাতো বোন। আহানার সাথে ছিকুর ভাব পড়ে গেল। আহানার আঙুল ধরে ধরে হাঁটতে লাগলো সে এদিকওদিক। পিহু বলল
‘ আব্বা আসেন আমার সাথে।
ছিকু গেল না। বলল
‘ আনানার সাথে যাব।
পিহু রেগে বলল
‘ যাও। আর পিহুর কাছে আসলে খবর আছে।
মাহিদ আইসক্রিম কিনে নিয়ে আসলো। সবার হাতে দিল। পিহু নিল না। বলল
‘ আমি বাড়ি যাব।
মাইশা বলল
‘ কেন? আমিই বলেছি তোমাকে নিয়ে আসতে। থাকো না।
মাহিদের হাত থেকে আইসক্রিমটা নিল পিহু। মাহিদ বলল
‘ চিল মুডে থাক। তোর সবকিছুতে এলার্জি কেন?
পিহু রেগে ফোঁসফোঁস করলো। মাইশা হেসে ফেলল। বলল
‘ মিঃ মাহিদ আপনি ওকে রাগিয়ে দিচ্ছেন কেন?
মাহিদ বলল
‘ অলওয়েজ রাগ। এসবের জন্য চাপ নেওয়ার দরকার নেই। এই আয়।
‘ যাব না।
পিহুর কাঠকাঠ গলা উত্তর তৎক্ষনাৎ ফিরে এল।
‘ তো কি করবি?
‘ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো। কোথাও যাব না।
মাইশা বলল
‘ কিন্তু কেন?
মাহিদ বলল
‘ থাকুক।
মাইশা বলল
‘ তো ও এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে?
ছিকু ফিরে তাকালো। তার এক হাতে চিপসের প্যাকেট। অন্য হাতে আইসক্রিম। দৌড়ে পিহুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। পিহু বলল,
‘ চলে যান৷
‘ পিহু ইমুন করে বলে কেন?
মাইশা বলল
‘ আহারে বাবুটা ও কষ্ট পাচ্ছে। পিহু রিল্যাক্স। রাগ কমিয়ে ফেলো এবং চলো।
পিহু ছিকুর হাতের কব্জি ধরলো। ছিকু বলল
‘ ছিকু আইসকিম খিতে পারেনা।
পিহু তার হাত ছেড়ে দিল। ছিকু আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটলো পিহুর আগে আগে। আহানার সাথে কথা বলতে বলতে পিহু এদিকওদিক হাঁটলো। মাহিদ আর মাইশা তখন অন্যদিকে। দোলনা দেখে ছিকু বলল
‘ ওখানে ওখানে।
পিহু বলল
‘ চড়বেন?
ছিকু মাথা দুলালো। পিহু তাকে সেখানে নিয়ে গেল। কিন্তু সে টাকা আনেনি। তাই ওখানকার লোকগুলোকে আঙুল দিয়ে মাহিদকে দেখিয়ে বলল ওনি টাকা দেবেন। ছিকু দোলনায় বসে পড়লো। আহানা পাশাপাশি অন্য দোলনায় বসলো। পিহু ছিকুর পাশটায় বসে পড়লো। ছিকুকে এক হাতে ধরে চোখ বন্ধ করে দুলতে দুলতে মনে পড়লো এক এক কথা। এই এত এত মানুষ আর কোলাহলের মধ্যে ও পিহুর মনে হলো তার মন খারাপের কথাগুলো শোনার একটা মানুষ ও নেই। যে শোনার সে অন্য কারো সাথে ব্যস্ত। তার কাছে নিজেকে লুকোতে ব্যস্ত৷
অন্যদিকে দূরে দাঁড়িয়ে ও তার বন্ধ চোখের পাতা আর বিষন্ন চেহারায় যে চোখ বুলিয়ে গেল একজন তার খবর ও পিহুর নেই। ভীষণ অদ্ভুত!
দোলনা চড়া শেষ হলো। ছিকু আর আহানাকে নিয়ে এদিকওদিক ঘুরাঘুরি করলো পিহু। মাইশা আর মাহিদ ও কিছুক্ষণ পর এল। আহানা চুড়ির দোকান দেখছে। মাইশা বলল
‘ চুড়ি নেবে?
আহানা লাল রঙের চুড়ি হাতে নিল। মাইশা সেগুলো কিনে নিল। মাহিদ ছিকুর জন্য ঘড়ি নিল। চশমা নিল। ছিকু তো মহাখুশি। মিহি এত ভালু কেন? এত গুডবয় কেন তার মাথায় ঢুকেনা। মাহিদ টাকা দিয়ে দিল। মাইশা দিতে দিল না৷ পিহু দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা দূরে। মাইশা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল
‘ হেই পিহু তুমি কিছু নেবে?
আসো না এখানে। ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আবার ও ছিকুর জন্য একটি কাঠের গরুর গাড়ি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মাইশা চুড়ি দেখছে। মাহিদ খয়েরী রঙের চুড়ি দেখিয়ে দিয়ে বলল
‘ ওগুলো সুন্দর। দেখতে পারেন।
মাইশা সেগুলো হাতে নিল। বলল
‘ তাইতো। আপনার তো পছন্দ আছে।
পিহুকে ধরে নিয়ে এল মাইশা । সব চুড়ি পিহুর হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে বলল
‘ তুমি এসব নাও।
পিহু না না করে উঠলো। সব খুলে ফেলল। বলল
‘ আমি চুড়ি পড়িনা। ওগুলা মাহিদ ভাই আপনার জন্য চুজ করেছে। আপনি পড়ুন।
বলেই মাইশার হাতেে সব চুড়ি পড়িয়ে দিল পিহু। মাইশা শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। পরক্ষণে মাহিদের দিকে তাকালো। আবার পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল
‘ তো কি পড়ো তুমি? ঘড়ি? ঘড়ি দেখবো।
‘ নাহ।
পেছনে ফিরে ছিকুকে চাইলো পিহু। ছিকু নেই। পিহু বলল
‘ ছিকু? এই আব্বা? ছিকু কোথায় মাহিদ ভাই?
মাহিদ ঘাড় ঘুরালো। ছিকু কোথাও নেই। হাতের সবকিছু রেখে ছিকুকে খুঁজতে চলে গেল মাহিদ। হন্যি হয়ে সবাই খুঁজতে লাগলো ছিকুকে। কোথাও নেই সে। মাহিদ পিহুর কাছে এল। পিহু তখন পাগলের নতো ছিকুকে খুঁজছে। মাহিদ এসে তার হাত টান দিয়ে মোচড়ে ধরে বলল
‘ তোর সাথে না ছিল। কোথায় গেল? তুই কি করছিলি? একটা বাচ্চাকে ও দেখে রাখতে পারিস না?
পিহু ফুঁপিয়ে উঠে বলল
‘ এখানেই তো ছিল।
‘ এখানেই ছিল। তো কি হাওয়া হয়ে গেল?
মাইশা দৌড়ে এসে বলল
‘ ওকে বকছেন কেন? কোথায় গেল বাবুটা?
আহানা বলল
‘ আমি তো চুড়ি দেখছিলাম। ও ঘড়ি আর চশমা নিয়ে খেলছিল। হুট করে কোথায় চলে গেল?
মাহিদ কপাল চেপে ধরলো। পিহু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মাইশা বলল
‘ কেঁদোনা। নিশ্চয়ই কেউ নিয়ে গেছে। মিঃ মাহিদ আপনি ওদিকে যান। আমি ওদিকটাই দেখছি।
মাহিদ চলে গেল। মাইশা ও। পিহু চোখ মুছলো ঘনঘন। কোথায় চলে গেল ছিকু?
________
ছিকুর হাতে চকোচকোর প্যাকেট। হাতে দুটো ঘড়ি পড়ে রয়েছে সে। বুকের সাথে চশমাটা লাগিয়ে রেখেছে। চকোচকো খেতে খেতে সে লোকটিকে বলল
‘ ইখানে মিহি নাই কেন?
লোকটা হাসলো। বলল
‘ কি নাম তোমার? বাড়ি কোথায়? কার সাথে এসেছ?
‘ ইখানে পিহু নাই কেন? মাইচা নাই কেন?
লোকটা হেসে বলল
‘ তুমি এত কেন কেন করো কেন?
ছিকুর এখন কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট বেঁকে আসছে তার। চোখ কচলে ঠোঁঠ বাঁকাতে লাগলো সে। লোকটা তাকে কোলে তুলে নিল। বলল
‘ চলো ওই দোকানগুলোর দিকে। তোমার মা বাবা নিশ্চয়ই ওখানে। চলো।
ছিকু লোকটার কোলে উঠতে চাইলো না। দৌড়ে পালালো কেঁদে উঠে। পিহু লেকের পাড় ছেড়ে এসেছে। ছিকু বোধহয় হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে এসেছে। তার ধারণায় ঠিক হলো। ছিকু দৌড়ে দৌড়ে আসতে লাগলো। পিহু তাকে দেখে দৌড়ে গেল। ছিকু তাকে দেখে ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল। ছিকু হাঁটুগেড়ে হাত টানতেই ছিকু তার বুকে এসে ঝাপটে পড়লো। গলা ধরে মুখ গুঁজে কেঁদে দিল উচ্চস্বরে। পিহু ও তার সাথে সাথে কেঁদে দিল। গালে, কপালে চুমু দিতে দিতে বলল
‘ কোথায় গিয়েছ আব্বা? এভাবে না বলে কেউ যায়?
ছিকু কাঁদতে কাঁদতে নাকমুখ লাল করে ফেলেছে। পিহু তার গাল মুছে দিতে দিতে বলল
‘ আর না আর না। ভয় পেতে হবে না। আমি আছি তো।
ছিকুর কান্না থামলো থেমেথেমে। পিহু তাকে কোলে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখলো বুকের সাথে। ছিকু ইদুর ছানার মতো গুঁজে থাকলো। মাহিদ আর মাইশা দু’জনই পিহুকে খুঁজতে এসে এমন দৃশ্য দেখে থামলো। পিহু তাদেরকে দেখে ছিকুকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। বলল
‘ ওই তো ওদের কাছে যাও। এই কলিজা!
ছিকু মুখ তুললো। মাহিদ এসে তাকে কোলে নিয়ে ফেলল। জড়িয়ে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল
‘ তোকে নিয়ে তো কোথাও যাওয়া যাবেনা। ভ পাইয়ে দিলি।
মাইশা বলল
‘ উফ বাঁচা গেল। কি পরিমাণ ভয় পেয়েছি বলে বুঝাতে পারব না। আপনি শুধু শুধু পিহুকে বকছিলেন।
ছিকুর গাল মুছে দিল মাহিদ। গালে আদর করে বলল
‘ আর না।
ছিকু তার কাঁধে মাথা ফেলে রাখলো। লোকটা এসে বলল
‘ আপনারা কেমন মা বাবা? বাচ্চাটাকে দেখলাম একা একা হাঁটছে। পাশেই রাস্তা। গাড়ি চলছে অনবরত। যদি রাস্তায় উঠে যেত?
মাহিদ তাকে আর ও শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলো।
_________
পিহু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মাইশা ডাকলে ও এল না। শেষমেশ মাহিদকে বলল
‘ ছিকুর বোধহয় ঘুম পাচ্ছে। পিহু ও চলে যেতে চাচ্ছে। আমরা আসি। সাবধানে যাবেন।
মাহিদ রিকশা ডেকে তাদের রিকশায় তুলে দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। মাইশা ছিকুকে আদর করে বলল
‘ টা টা আমাদের বাসায় আসিয়েন কেমন?
ছিকু ড্যাবড্যাব করে তাকালো। ঘুমঘুম গলায় বলল
‘ টা টা। চি ইউ।
মাইশা হাসলো। রিকশা চলতে শুরু করলো। মাহিদ হাঁটা ধরলো। পিহুকে বলল এদিকে আয়। পিহু এল না। সোজা হাঁটা ধরলো। মাহিদ ছিকুকে শক্ত করে ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে গেল। পিহুকে থামিয়ে দিয়ে বলল
‘ সমস্যা কি? কথা কানে যায় না?
পিহু তাকে ডিঙিয়ে আবার হাঁটা ধরলো। ছিকু তখন ঘুমে ঢলে পড়েছে। মাহিদের কাঁধে ঘুমোচ্ছে। মাহিদ কথা বাড়ালো না বেশি।
বাড়ি যেহেতু বেশি দূরে নয়। তাই রিকশা লাগলো না। আসার সময় ও হেঁটেই এসেছে তারা। পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেল বাড়িতে। পরী এসে কোলে নিল ছিকুকে। বলল
‘ ওমা ওর নাকমুখ লাল কেন? কেঁদেছে মনে হচ্ছে। কে মেরেছে?
মাহিদ বলল
‘ কেউ মারেনি। অনেক কাহিনি। পরে বলব।
পিহু ততক্ষণে তার ঘরে চলে গিয়েছে। মাহিদ তার চলে গিয়ে মুখ হাত ধুলো। নীরা খেতে ডাকছে সবাইকে। মাহিদ এল। পিহু এল অনেক্ক্ষণ পর। তার ও মুখটা ফুলে রয়েছে। মুনা বলল
‘ সমস্যা কি এদের খালা বোনপোর? দুজনেরই চোখমুখ ফোলা।
রিপ খেয়াল করে দেখলো তাই তো। রিক বলল
‘ ওখানে কোনো সমস্যা হয়েছে মামা?
পিহু খেতে খেতে বলল
‘ তেমন কিছু হয়নি বড় মামা।
মাহিদ চুপচাপ খাচ্ছে। পরী বলল, রাহিকে অতগুলো জিনিস কেন কিনে দিলি ভাই? শুধু শুধু টাকা নষ্ট।
মাহিদ বলল
‘ পড়ুক। এগুলো ও পছন্দ করেছে।
নীরা বলল
‘ পিহুকে কিছু কিনে দিসনি?
মাহিদ খাওয়া বন্ধ করলো। অতঃপর বলল
‘ নাহ।
সবাই কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। মাহিদ খাওয়া শেষ করে চলে গেল। পিহু ও নিজের ঘরের দিকে যেতেই মাহিদ তাকে হাত ধরে টেনে তার ঘরে ঢুকিয়ে ফেলল। পিহু অবাক হয়ে বলল
‘ কি সমস্যা?
মাহিদ টেবিলের উপর চুড়ি গুলো নিল। পিহুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
‘ আমার পছন্দের জিনিস। ফালাই দিলে খনর আছে। যাহ৷
পিহু চুড়িগুলো দেখলো৷ বলল
‘ তোমার বউকে দাওনি কেন? ও তোমার পছন্দের মানুষ না।
‘ দিছি। সব তোরে দেখাইতে হবে নাকি?
‘ নাহ। আমি কারো পার্সোনাল লাইফে নাক গলায় না।
‘ ভালা।
‘ আর এই চুড়ি আমি নেব না। তোমার পছন্দের জিনিস তোমার পছন্দের মানুষই ডিজার্ভ করে।
মাহিদ কেড়ে নিল সেগুলো। ছুঁড়ে মারলো দূরে। তারপর পিহুকে বের করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল।
_______________
পরের দিন পিহু চলে চৌধুরী বাড়িতে। পরী ছিকু এল না। তারা আর কিছুদিন থাকবে। নিশিতার বিয়ের দাওয়াত পড়লো। আদি ভেবে পাচ্ছেনা কি দেওয়া যায় নিশিতার বিয়েতে। পিহু বলল, তোমাদের গুলো তোমরা দেবে। আমারটা আমি। আমাকে টাকা দিয়ে দেবে পাপা।
আদি বলল
‘ ওকে ফাইন।
বিয়ের কেনাকাটায় পিহুকে নিয়ে গিয়েছিল নিশিতা। এতে নিশিতার মা অনেক খুশি। বিয়ের কয়েকদিন আগে ও পিহুকে যেতে বলেছিল। কিন্তু পিহু যায়নি। সে মেহেদীর দিন সকালে বাকি ফ্রেন্ডসদের সাথে গিয়েছে। নিশিতা তাদের পেয়ে মহাখুশি। মেহেদী সন্ধ্যায় সব বান্ধবীরা এক রঙের শাড়ি পড়লো। পিহু শাড়ি সামলাতে পারেনা। তাই পড়তে চাইনি। কিন্তু পার্লারের মেয়েগুলো ভালোভাবে পড়িয়ে দিয়েছে। সাজিয়ে দিয়েছে। নিশিতাকে সাজানোর কাজ চলছে তখনো। পিহু আদি ইশা আর বাড়ির সবাই এসেছে শুনে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। আদি আফি দেখে হা করে তাকালো। ছিকু লাফ দিয়ে উঠলো। বলল
‘ ও বাপ পিহুকে বিটিফুল লাগে কেন? ছিকু চিনতি পারেনা কেন?
পিহু হেসে তার গাল টেনে আদর করলো। তার সাথে উপরে নিয়ে গেল। পরীও গেল। এশার আযানের আগে আগে নীরা মুনারা এল। পিহুকে দেখে নীরা চোখ কপালে তুলে বলল
‘ ওমা পিহু রাণীরে কি সুন্দর লাগতেছে আপা। দেখো।
মুনা বলল
‘ তাইতো।
পিহু হেসে বলল
‘ মামি তোমরা বসো। মামারা কোথায়?
‘ আছে নিচে।
নিনিত যাচ্ছিল একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। নীরাদের দেখে থেমে গেল। বলল
‘ আন্টি আপনারা খেয়েছেন?
নীরা বলল
‘ হ্যা হ্যা বাবা খেয়েছি। তোমার তো আজ অনেক ব্যস্ততা।
‘ হ্যা। আরিশা তুমি একটু দেখো আন্টিদের কি কি দরকার পড়ে৷
পিহু মাথা দুলালো। নিনিত চলে গেল। নীরা বলল
‘ হু হু দেখো দেখো । এটা তোমারই সংসার আগে পড়ে। তোমারই বাড়ি। তোমরাই দেখে রাখা উচিত।
_______
মাইশাকে দেখে রীতিমতো অবাক হলো পিহু। নিশিতা দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো মাইশাকে। বলল
‘ আমি কতগুলো মেসেজ দিলাম তোমায়। দেখোনি?
মাইশা বলল
‘ চলেই এসেছি। সেজন্য আর রিপ্লাই করিনি। এবার খুশি হয়েছ? এসেছি কিন্তু।
‘ তুমি স্পেশালি মাহিদ ভাইয়ের ফেয়ন্সে। মাহিদ ভাই আমার ভাইয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কাজিন। তুমি না আসলে কেমন যেন বেমানান। খেয়ে নাও চট করে। আর তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়িরা ও এসেছে। যাও যাও। চিল করো।
পিহুকে দেখে হাসলো মাইশা। পিহু হাসলো। বলল
‘ মামিরা আম্মাদের সাথে। চলেন ওখানে।
‘ চলো। তুমি আমাকে তুমি করে বলতে পারো।
‘ আপনি করে বলতে ভালো লাগছে।
‘ ওকে।
নীরা তাদের দুজনকে দেখে অবাক হলো। মাইশা গিয়ে সালাম দিল সবাইকে। ইশা বলল
‘ মাইশা না? আসো আসো। আর কে এসেছে তোমার সাথে?
‘ বাবা এসেছে আন্টি।
নীরা বলল
‘ বাহ কি মিষ্টি! কি মিষ্টি মেয়ে৷ তোমার মাহিদের সাথে দেখা হয়ছে?
‘ না আন্টি। কিন্তু আমি ওনাকে দেখেছিলাম বাইরে। পরে কথা বলে নেব।
মাইশার সাথে অনেক আলাপ হলো সবার। পিহু তার হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল পুরোটা সময়। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির বাইরে গেল। মাহিদকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। মাহিদ চোখ তুলে তার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার ফোনে মুখ গুঁজলো। পিহু এগিয়ে গেল। বলল
‘ আমার চুড়ি তুমি মাইশাকে দিয়েছ কেন? চুড়ির কি অভাব পড়েছে?
‘ কে বলেছে ওসব তোর চুড়ি?
‘ আমি বলছি। এটাই সত্যি।
‘ তো কি সমস্যা?
‘ সমস্যা মানে? অবশ্যই সমস্যা। আমার জিনিস অন্য কেউ কেন নেবে?
‘ তুই ওই দুই টাকার চুড়ি কেন পড়বি? আমারই ভুল হয়েছে ওইদিন। তুই দামী মানুষ। ফুটপাতের কম দামের চুড়ি তুই পড়বি কেন? তুই নামকরা ডাক্তার মানুষের মেয়ে, ডাক্তারের বউ। তুই পড়বি স্বর্ণ আর ডায়মন্ড। সস্তা চুড়ি তুই পড়িস না সেটা জানা ছিল না।
‘ আমি কখন বলেছি ওগুলো সস্তা?
‘ বলিসনি। আমি সস্তা সেটা ও কখনো কেউ বলেনি, তবে কাজে বুঝিয়ে দেয়। আর চুড়িও সস্তা সেটা বলিসনি তবে তোর প্রতিক্রিয়া সেটাই বলে দিল।
‘ সবসময় এমন করো তুমি। কথা পেঁচাও শুধু। আমি কখনো দাম নিয়ে কিছু বিবেচনা করিনা। আর তুমি সস্তা সেটা কে বললো? সস্তা তো আমি। আমিই সস্তা, আমিই কালো, আমিই অসুন্দর, আমিই সব।
মাহিদ বিরক্ত হলো। বলল
‘ তোকে কালো বলল কে? ঠাস করে একটা দেব বেয়াদব।
‘ তুমি বলেছ। ছিকুকে বলোনি? আমি শুনেছি। চিন্তা করোনা তোমার কপালে সুন্দরী জুটেছে । আমার মতো কালোটালো কেউ জুটেনি।
মাহিদ তার হাতটা টেনে ধরে চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে কিড়মিড় করে বলল
‘ ওসব আমার মনের কথা নয়। আমি ওসব মজা করে বলেছি।
‘ তাহলে কোনটা তোমার মনের কথা? বলো।
মাহিদের হাত আলগা হয়ে গেল। সে ছেড়ে দিল পিহুকে। বলল
‘ দূরে থাক। তুই আস্ত একটা সমস্যা আর মাথা ব্যাথার কারণ। দূরে যাহ। দূরে যাহ।
‘ যাব না। আগে বলো।
মাহিদ ধাক্কা দিল পিহুকে। পিহু টাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল। মাহিদ আবার ধরে ফেলল। দাঁড় করিয়ে বলল
‘ পড়ে গেলে ভালো হতো।
‘ তো ধরেছ কেন?
‘ কারণ।
‘ কারণ?
‘ কারণ ধরা উচিত।
চলবে,,,
রিচেক করা হয়নি বাপ।
নাইষ নাইষ খমেন্ঠ ছাই ভাপ।