#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_১৯
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
ছিকু কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। কপালের মাঝখানে তার ভাঁজ। গালে কেক লেগে তো এমনিতেই ভূত সেজে আছে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল
‘ মিহি পিহুকে আদর কচচে কেন? ছিকুকে মারে কেন?
পিহু বন্ধ চোখ ঝট করে খুলে ফেলল। দূরে গিয়ে চমকে তাকালো ছিকুর দিকে। মাহিদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যেন সবই স্বাভাবিক। ছিকু আবার চিল্লিয়ে বলে উঠলো
‘ মিহি পিহুকে কেক লাগায় দিচে কেন?
পিহু চোখ বড় বড় করে তাকালো। মাহিদ হো হো করে হেসে উঠে ছিকুর কাছে গিয়ে পাঁজাখোলা করে কোলে তুলে নিল। পিহু সেই সুযোগে দৌড়ে পালালো। কি হলো এসব? তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে। ঘেমে উঠেছে পিহু।
ছিকুর গালে ঠাসঠুস করে মারলো মাহিদ। বলল
‘ তুই শালা সবসময় আমার পেছনে পইড়া থাকোস ক্যান? তোর লাগি কি পেরেম টেরেম করতে পারুম না বাপ? তুই শালারে এত কথায় হয় না ক্যান?
ছিকু নাক ফুলিয়ে বলল
‘ পিহুকে আদর কচচো কেন? ছিকুকে আদর করোনা কেন? মারো কেন? ছিকু দুক্কু পায় কেন?
মাহিদ তার গালে চুমু খেল। ছোটখাটো কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল
‘ যাহ বাপ আদর করলাম। তুই তোর খালার লগে জিতাজিতি করতে আসোস কিল্লাই? তোরে এত আদর করি তারপরও তোরে কুলাইনা বাপ।
‘ কেন পিহু বাবু কেন? পিহু আদর খায় কেন?
মাহিদ কপাল চাপড়ালো। বলল
‘ শালারে শালা আর কইস না বাপ। আমার শরম লাগতাছে। হেব্বি শরম লাগতাছে।
‘ কেন ছরম লাগে কেন?
ছিকু বোকা বোকা চাহনি নিক্ষেপ করে প্রশ্নটা করলো।
মাহিদ হেসে ফেলল। তাকে ভালো জড়িয়ে ধরে তার গালের কেক ছিকুর গালে লাগিয়ে দিতে দিতে ওয়াশরুমে পা রাখলো। তারপর ছোট্ট মুখটা ভালো করে ধুয়ে দিল ঢলেঢলে। ছিকু মুখ ধুঁয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে বলল
‘ ছিকু বিটিফুল কেন? মিহি ভূত কেন?
মাহিদ তার মুখ ধুলো। ফেইসওয়াশ দিতে দেখে ছিকুর রাগ হলো। বলল
‘ ছিকু ইটা দেয়নি কেন? মিহি দেয় কেন?
মাহিদ মুখ ধুয়ে হাত ঝাড়া মারলো ছিকুর মুখে। বলল
‘ চুপ থাক শালা। তোরে ফেসওয়াশ দিমুনা। তুই এগুলা দেওয়ার যোগ্য না। তুই এখনো পুটিমাছ।
‘ কেন? জুগ্য না কেন? ছিকু পুতিমাছ কেন?
মাহিদ আবার হাসলো আওয়াজ করে। ছিকুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল
‘ শালা তোর কেন কেন প্রশ্নের উত্তর এখনো আবিষ্কার হয়নি বাপ। তোর কেন কেন শুইনা মাঝেমাঝে আমার মইরা যাতে ইচ্ছা করে বাপ।
ছিকু কষ্ট পেল। মিহি তার জন্য মরি যাবে কেন? এতটা দুঃখ পেল যে তার কান্না কান্না পেল। চোখ পিটপিট করে একবার খুললো একবার বন্ধ করলো সে। মাহিদ বড় করে নিঃশ্বাস নিল। বলল
‘ ওরেবাপ তুই শালা এত নাটক পারোস। তোরে নিয়া আমি কই যামু কহ । তুই শালা এত রঙভঙ শিখছোস কোথা থেইকা?
ছিকু ঠোঁট উল্টে বলল
‘ মিহি মরি যাবে কেন?
মাহিদ হেসে ছিকুকে কোলে তুলে নিল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে, মাথায়, গালে চুমু দিয়ে বলল
‘ ওরেব্বাপ তুই তো আমারে দেখতে পারোস ভালা। যাহ তোরে ছাইড়া কোথাও যাইতাম না বাপ। মরি যাইতাম না।
ছিকু খুশি হলো। বলল
‘ মিহি গুডবয় কেন?
মাহিদ হেসে উঠলো হো হো করে। পরীর বাচ্চা ছিকু এত চালাক! শালারে কোনো কথা শিখায় দিতে হয় না।
___________________
নিশিতাকে মেহেদী পড়ানোর জন্য সবাই পিহুকে খুঁজছে। মাইশা একহাতে পড়াবে আর পিহু অন্যহাতে। কেউ যখন পিহুকে খুঁজে পেল না মাইশা বলল, আমি ওকে খুঁজে আনি।
নীরা বলল
‘ হ্যা হ্যা আম্মা একটু খুঁজে আনো। নিয়ে আসো ওকে।
ইশা বলল
‘ পিহুর কি হলো আজ?
মুনা বলল
‘ ওর কি শরীর খারাপ লাগছে নাকি। আমি ও খেয়াল করলাম কেমন মনমরা মনমরা আজ সারাদিন।
ইশা বলল
‘ সকালে তো ঠিকঠাক ছিল। ও এমনিতেই শরীর খারাপ করলে ও কাউকে বলেনা। আমাকেই দেখতে হয়।
পিহু তার দু গালে লেগে থাকা কেক মুছে বেরোতেই যাচ্ছিলো। গালের পাশে পানি লেগে থাকায় মাইশা তাকে দেখে ভুরু কুঁচকালো। বলল
‘ ওখানে পানি কেন?
পিহু তোতলাতে তোতলাতে বলল
‘ ছিকু কেক লাগিয়ে দিয়েছে ওর হাত থেকে তাই মুছে নিলাম।
মাইশা পিহুকে ধরে নিয়ে এল। সবাই তাকালো তার দিকে। পিহুর অস্বস্তি হচ্ছে। সে অনবরত ঘামছে। এই শাড়ি, প্রসাধনী তার অসহ্য লাগছে। খুলে ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
ইশা এসে বলল,
‘ পিহু তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে মা?
পিহু আমতাআমতা করতে করতে বলল
‘ না আম্মা। আমি তো ঠিক আছি। কেন?
ইশা তার মুখে হাত বুলালো। বলল
‘ শরীর খারাপ লাগলে বলো। হ্যা।
পিহু মাথা নাড়ালো। মাইশা তাকে ডাকলো। পিহু গিয়ে নিশিতার পাশে বসলো। মেহেদী পড়িয়ে দিতে দিতে বলল
‘ আমাকে এখানে থাকার জন্য জোর করিস নারে। আমাকে বাড়ি যেতে হবে।
‘ কেন কেন? আমি তোকে আর মাইশাকে ছাড়ব না। কিছুতেই না। কালকে আমার সাথে ক্লাবে যাবি। ব্যস।
পিহু বলল
‘ না মাইশা থাকুক না। আমাকে যেতে হবে রে। আমাকে কিছু মেডিসিন নিতে হবে।
‘ কি মেডিসিন? ভাইয়া আছে না? ভাইয়াকে বলব এনে দিতে। ডোন্ট ওয়ারি।
‘ আমি যাব। জোর করিস না দোস্ত।
নিশিতা মন খারাপ করে বসে থাকলো। মাইশা বলল
‘ আমাকে ও তো বাবার সাথে ফিরতে হবে। আমি তো থাকতে পারব না।
‘ যাও যাও। কাউকে লাগবেনা আমার।
মুখ গোঁমড়া করে বসে রইলো নিশিতা। পিহু মেহেদী পড়াতে পড়াতে আনমনা হয়ে গেল। মাইশার চোখ গেল সেদিকে। পিহুর হাতের দিকে একপলক তাকালো সে। তার কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে দিয়ে বলল
‘ এনি প্রবলেম পিহু?
পিহু ধ্যান ভাঙলো। চমকে উঠে সে বলল
‘ কি?
মাইশা বলল
‘ তোমার ফুল নষ্ট হচ্ছে। মনোযোগ নেই বোধহয়।
পিহু তাড়াতাড়ি মেহেদী মুছে নিল। বলল
‘ হ্যা আর ভুল হবে না।
নিশিতা নিনিতকে ডাক দিল।
‘ ভাইয়া এদিকে আসো তাড়াতাড়ি।
নিনিত হাতের কাজ রেখে এগিয়ে এল। স্টেজের নিচে দাঁড়িয়ে বলল
‘ কি হয়েছে?
‘ পিহু,মাইশা নাকি চলে যাবে।
নিনিত কপাল কুঁচকালো। পিহু আমতাআমতা করতে করতে বলল
‘ আসলে স্যার আমার,,
নিনিত বলল
‘ বাসা থেকে কোনোকিছু আনতে হবে?
‘ হ্যা।
‘ তোমাকে যেতে হবে?
‘ হু।
‘ ঠিক আছে। এখন সবার সাথে বেরিয়ে পড়বে। আর কাল ঘুম থেকে উঠেই চলে আসবে যা লাগে তা নিয়ে। এবার খুশি নিশু?
নিশিতা মাইশার দিকে তাকালো। নিনিত বলল
‘ মাইশা ঠিক আছে আমার কথা? আপনাকে ও আসতে হবে।
মাইশা মাথা দুলালো। নিশিতা গাল ফুলানো কমালো। পিহু তার হাতে চিমটি কেটে বলল
‘ তোর সবসময় বাড়াবাড়ি।
নিশিতা হাসলো। মেহেদী পড়ানো শেষ হতে না হতেই মাহিদের সাথে ছিকু এল অনেকক্ষণ পর। ছিকুর দু হাতে দুটো বেলুন। খেলছে সে। পরী বলল
‘ এগুলো কে দিছে আব্বা?
‘ মিহি।
মাহিদ ফিসফিস করে বলল
‘ তোরে কিল্লাই এগুলা দিছি সেগুলো একমাত্র আমিই জানি।
ছিকু দাঁত দেখিয়ে হেসে পিহুকে ডাক দিল। বলল
‘ পিহু মিহিকে মিহিদি দেয় না কেন?
পিহু শুনে ও চোখ তুলে তাকালো না। হাত তরতর করে কাঁপতে কাঁপতে লাগলো তার। কোনোমতো আঁকা শেষ করে তাড়াতাড়ি স্টেজ থেকে নামলো সে। বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো দ্রুত। আদি আর রিপের সামনাসামনি পড়ে গেল তখনি। আদি বলল
‘ এভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন?
‘ আমরা কখন বেরোবো পাপা?
‘ এখন। তোমার মেহেদী পড়ানো শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।
‘ আমার কাজ শেষ।
‘ ওকে। সবাইকে বলো। গাড়ি এক্ষুণি চলে আসবে।
রিপ বলল
‘ তুমি এভাবে ঘামছো কেন মামা?
পিহু তোতলাতে তোতলাতে বলল
‘ জানিনা এমনি বোধহয়।
‘ এমনি?
______________
গাড়ি এসে দাঁড়ালো দুই বাড়ির মানুষের জন্য। রিপ নীরা মুনা আর রিককে গাড়িতে বসিয়ে মাহিদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলো। আদি বলল
‘ উঠে পড়।
‘ মাহি আসেনি তো।
আদি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। বলল
‘ মাহি কোথায়?
‘ আসবে। ছিকুর সাথে বোধহয়।
তখনি পিহু আর পরী এল। আদি বলল
‘ ওই গাড়িতে বসো তোমরা।
পিহু এদিকওদিক তাকিয়ে বলল
‘ মাইশারা কি চলে গিয়েছে পাপা?
রিপ বলল
‘ আমি ওকে আর ওর বাবাকে গাড়িতে তুলে দিয়েছি। তোমরা উঠে বসো। তোমাকে তো আবার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
পিহু গাড়িতে উঠে বসলো। মাহিদ ছিকুকে নিয়ে এল। ছিকু চেঁচিয়ে বলল,
‘ ছিকু মিহির সাথে যাবে কেন? মিহির সাথে ঘুম দেবে কেন?
পরী বলল
‘ না। আপনি সবাইকে জ্বালাবেন। দরকার নেই। চলে আসেন।
ছিকু মুখ কালো করে ফেলল। মাহিদ ইশারায় পরীকে বলল গাড়িতে উঠে বসো। পরী গাড়িতে উঠে বসলো। রাইনা পেছন থেকে বলল
‘ ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ি ছেড়ে দিতে বল রেহান। তোর ছেলেটা দারুণ পাজি হয়েছে।
রেহান মাথা নাড়লো। ছিকুর কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল
‘ চলে আসেন। মিহি ঘুমাবে।
‘ নাহ।
ছিকু মাহিদের গলা আঁকড়ে ধরে রাখলো। মুখ গুঁজে রাখলো। সে যাবে না। মাহিদ বলল
‘ শালা আমার সুড়সুড়ি লাগতেছে বাপ। ছাড় আমারে। আমি তোর হাগুমুতু পরিষ্কার করতে পারুম না বাপ । যাহ তুই।
ছিকু তাকে ছাড়লো না । ওভাবেই বলল
‘ কেন যাব কেন? ছিকুর ঘুম পায় কেন?
রেহান ও ড্রাইভারের পাশে বসে পড়লো। আদি পরী পিহুর পাশে বসে বলল
‘ মাহি এদিকে নিয়ে এসো ওকে।
মাহিদ এগিয়ে গেল। ছিকুকে আদির কোলে দিতে বহু কষ্ট পোহাতে হলো। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগেই দেখলো পিহু চুপচাপ পাথরের ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। কোনোদিকে তার হেলদোল নেই।
ছিকু চিৎকার করে হাত পা দুরুমদারুম নাচাতে নাচাতে কাঁদলো । পরী হাত ধরলো, আদি ধরলো মাথা। তারপর গাড়ি ছেড়ে দিতেই আদি বলল
‘ ওই দেখেন বাইরে ভূত। কান্না করলে নিয়ে যাবে।
ছিকু কান্না থামালো। বাইরে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো
‘ কেন? নিয়ে যাবে কেন?
আদি বলল
‘ আপনি কাঁদছেন তাই।
ছিকু কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার ও চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। বলল
‘ মিহির কাছি যাবু কেন?
আদি সান্ত্বনার বদলে হেসে ফেলল আওয়াজ করে। ইশা পেছন থেকে বলল
‘ সোনা বাসায় গিয়ে চকলেট দেব আপনাকে। মিহিকে আবার কাল দেখতে পাবেন তো।
ছিকু কেঁদে কেঁদেই বলল,
‘ ইশু ছোনা ডাকে কেন?
আদি হেসে ফেলল হঠাৎ। রেহান আর ড্রাইভার ও। পরী আর রাইনা মিটমিট করে হাসলো। ইশা রেগে বলল
‘ এখানে হাসার কি হলো ডক্টর?
আদি বলল
‘ ঠিক আছে হাসলাম না আর মিষ্টি।
বলেই আবার হাসলো আদি। ইশা রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠলো। পরী আদিকে বলল
‘ তুমি আম্মাকে সারাক্ষণ পঁচাও কেন আব্বা ?
‘ আমি পঁচালেই পঁচতে হবে কেন?
_____________
ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেছে পিহুর। নিশিতার ফোনে কল দিতেই নিশিতা রেগে বলল
‘ ফোন দেওয়ার দরকার নাই আর। আর আসিস না।
‘ রাগ করছিস কেন নিশু? মাইশা এসেছে?
‘ আসেনি। তুই ও আসিস না। দরকার নাই তোদের। যাহ।
ফোন কেটে দিল নিশিতা। পিহু তাদের বাসায় গেল না। সোজা পার্লারে চলে গেল। রাস্তায় মাইশার সাথে দেখা হলো। মাইশা বলল
‘ তুমি ও এখন? আমি ভাবলাম শুধু আমার দেরী হয়েছে।
পিহু বলল
‘ ও রাগ করে বসে আছে। আমার তো ঘুম ভাঙতে দেরী হলো।
‘ কি করব আর? রাগ ভাঙাতে হবে।
পিহু চুপ করে থাকলো। মাইশা বলল
‘ তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
‘ হুম।
‘ মিঃ মাহিদ আর তোমার সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?
পিহু চমকে উঠলো। আমতাআমতা করলো সে। মাইশা হেসে ফেলল। বলল
‘ আমার ও এমন একটা কাজিন আছে। পরিচয় করে দেব পরে। ওর সাথে সারাক্ষণ আমার ঝগড়া লেগে থাকে। তোমার আর মিঃ মাহিদের যেমন ঝগড়া লাগে।
পিহু হাসলো একটুখানি। পার্লারে পৌঁছে অনেক কষ্টে নিশিতার রাগ ভাঙাতে হলো। তারপর সাজগোছ কমপ্লিট হলো একটু দেরীতেই। নিনিত ফোনের উপর ফোন করে যাচ্ছে। গাড়ি আসলো তাদের ক্লাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পিহু খয়েরী রঙের গাউন পড়েছে। মাইশা ব্লু রঙের। ক্লাবে পৌঁছাতে আর ও আধঘন্টার মতো সময় লাগলো। মাইশার সাথে তার দুইটা আন্টি পার্লারে এসেছিল। তারাসহ পৌঁছে গেল ক্লাবে। পৌঁছুতেই সবাই বউ দেখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো। পিহু সেই ভীড়ের মাঝখানে গেল না। অন্যদিকে ছুটতে না ছুটতেই দেখলো ছিকু বরের জন্য সাজানো স্টেজে উঠে দাঁড়িয়ে নানারকম এঙ্গেল থেকে ছবি তুলছে। সাদা শার্টের উপর নানারকম কালো শেপের ডিজাইনের শার্ট পড়া ক্যামেরাম্যান মাহিদ। মামা ভাগিনার খুনসুটি দেখার মতো। মাহিদ যেরকম বলছে সেরকম করছে ছিকু। একসময় পিহুকে চোখে পড়লো ছিকুর। সে চিৎকার করে বলে উঠলো, পিহু দেখে আছে কেন? পিহু হাসে কেন?
মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে পিহুর দিকে তাকালো। পিহু দ্রুত অন্যদিকে হাঁটা ধরলো। তবে বেশিদূর পালাতে পারলো না। মাহিদের মুখোমুখি হলোই। ভয় পেয়ে গেল সে। মাহিদ ভুরু উঁচালো। বলল
‘ সমস্যা কি?
‘ কিছু না।
বলেই আশেপাশে তাকিয়ে পিহু চলে যাচ্ছিল। মাহিদ ঘুরে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। পিহু মুখ তুলে রেগে তাকালো। বলল
‘ পথ ছাড়ো।
মাহিদ পথ ছাড়লো না। পিহু এদিকওদিক তাকিয়ে উশখুশ করতে লাগলো। তারপর আবারও চোখ তুলে তাকালো। তারপর একেবারেই চোখ সরিয়ে বলল
‘ আমাক যেতে হবে।
‘ তোকে ধরে রাখছে কে?
পিহু চোখ তুলে তাকালো। বলল
‘ তাহলে সামনে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
‘ দেখছি।
পিহি উশখুশ করে উঠলো। হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল
‘ কি দেখছ?
‘ কিছু না।
পিহু সরে যেতেই মাহিদ আবারও তার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলল
‘ পালাচ্ছিস কেন?
পিহু মুখ তুললো। বলল
‘ তো কি করব?
‘ দাঁড়িয়ে থাক।
পিহু এবার চলে যাচ্ছে। মাহিদ তার পথ আটকে গর্জে বলল
‘ কোথায় যাচ্ছিস?
‘ জাহান্নামে। সমস্যা কি তোমার?
‘ এখানে থাক।
‘ ওখানে সবাই আছে।
‘ ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।
‘ কেন?
মাহিদ উত্তর দিল না। মাইশা পিহুকে ডাকছে। পিহু সরে পড়ার সময় মাহিদ বলল
‘ খবরদার নড়বি না এক পা ও।
মাইশা এল। বলল
‘ পিহু চলো নিশিতা ডাকছে।
পরক্ষণে মাহিদের দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল
‘ আপনি ও আসুন না।
মাহিদ মাথা নাড়ালো।
‘ যাব।
মাইশা পিহুর হাত ধরলো। বলল
‘ চলো না।
পিহু মাহিদের দিকে তাকালো। তারপর মাইশার সাথে যেতে যেতে বলল
‘ স্যারকে দেখেছেন?
‘ স্যার? মিঃ নিনিত। হ্যা তোমাকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করছিল তুমি এসেছ কিনা।
মাইশার সাথে কথা বলতে বলতে পিহু একবার মাহিদের দিকে ফিরে তাকালো। দেখলো ফুলেফেঁপে থাকা এক ভয়ংকর নিউক্লীয় বোমা। এখনি ঠাসস করে ফাটবে আর সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ছিকু ও পিহু আর মাইশার পেছন পেছন দৌড়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল
‘ মিহি ইকা কেন? মিহির সাথি কিউ নাই কেন? মিহিকে ভূতে খিয়ে ফিলবে কেন?
মাহিদ বিড়বিড় করে বলল
‘ শালা তোরা আমারে কি পাইছস বাপ? একেকডারে খুন করুম আমি। সবার আগে ওই ডাক্তারের বাচ্চিরে করুম। শালী কি পাইছেডা কি?
___________
বর এসেছে। ছেলেরা সবাই ফিতা কাটবে। নিনিত এসে মাহিদকে ধরে নিয়ে গেল। বলল, তুই একা একা কি করিস ওখানে। ফিতা কাটবো। চল।
মাহিদ গেল চুপচাপ। ফিতা কাটার সময় বরপক্ষ টাকা ছাড়তে চাইলো না। মাহিদ ্ কাঁচি না দিয়ে বলল
‘ শালার জামাই টাকা ছাড়ো। নইলে কাঁচি ও দিতাম না, বউ ও দিতাম না বাপ। মশকরা করো? আমরা মশকরার মুডে নাই। টাকা বাইর করো।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো তার কথায়। নিনিত তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল
‘ ফাটিয়ে দিয়েছিস মামা।
মাহিদ কলার ঝাঁকিয়ে বলল
‘ মাহিদ খান বলে কথা।
বরপক্ষ নাছোড়বান্দা মাহিদের পাল্লায় পড়েছে। টাকা না দিয়ে উপায় আছে? টাকা দিল। মাহিদ কাঁচি দিল শেষমেশ। ফিতা কেটে জামাই ঢুকলো।
ছিকু নাচতে নাচতে বলল
‘ নিচির জামাই আসিছে। ওহ ওহ জামাই আসিচে। কেন আসিচে কেন?
ইশা তার নাচ দেখে হাসতে হাসতে বলল
‘ আপনার এত খুশি কিসের ভাই? আপনি এভাবে নাচছেন কেন?
‘ নিচির জামাই আসিচে কেন? বুউ আসেনি কেন?
” নিশিই তো বউ।
‘ কেন? নিচি বুউ কেন?
ইশা হেসে উঠলো আবার। ছিকু আবার নাচতে লাগলো। একবার এক পা এক হাত তুললো, আবার আরেক পা আরেক হাত তুললো। কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে গাইলো
‘ ডুম্পাছালে ডুম্পাছালে ডুম, ডুম, ডুম।
ইশা হাসতে হাসতে ঢলে পড়ার অবস্থা হলো।
__________
বরকে মালা পড়ানোর সময় এল। বউয়ের বোন কিংবা বান্ধবীরা মিষ্টি খাওয়াবে আর মালা পড়াবে। পিহুর হাতে মালা, মাইশার হাতে মিষ্টি। বাকিরা তাদের পেছন পেছন এল। পিহু বরকে বলল
‘ জিয়াদ ভাইয়া টাকা বের করো। দশ দশ।
মাহিদ বলল
‘ এদের দশ টাকা দিয়ে দূর দূর করে তাড়াও তো। শালার ফকির। বিয়া বাড়িতে ও শান্তি নাই।
মাইশা আর বাকিরা খিক করে হেসে উঠলো। মাইশাকে দেখে মুখ সংযত করে ফেলল মাহিদ। পিহু নাকফুলিয়ে তাকালো। নিনিত হেসে পিঠ চাপড়ালো মাহিদের। বলল
‘ তুই পারিস বটে।
মাহিদ মাথা দুলালো। পিহু চেঁচিয়ে বলল
‘ আমি দশ হাজার বলেছি। দশ টাকা বলিনি। কানে বেশি শুনে।
মাহিদ কপাল কুঁচকে তাকালো। কিছু বলতে গেল কিন্তু মাইশা থাকায় কিছু বললো না। বরপক্ষ টাকা ছাড়তে চাইলো না। শালা বাবুরা এমনিতেই আট খসিয়েছে। আবার দশ? বরের বন্ধু বলল
‘ পান বানিয়ে খাওয়ান বেয়াইন । তারপর দেখা যাবে।
পিহু ভ্যাবাছ্যাঁকা খেল। মাইশা বলল
‘ আমি বানাতে পারি পান। মিঃ মাহিদ একটা পান এনে দিবেন?
মাহিদ ছিকুকে ডাকলো। বলল
‘ যাহ পান লইয়্যা আয় ডক্টরের মায়ের কাছ থেকে?
‘ নিনি ডততর?
‘ হ।
নিনিত হেসে ফেলল ছিকুর কথা শুনে।
ছিকু গেল। নিকিতা বেগমকে বলল,
‘ মিহি পান দিতি বুলেচে কেন?
‘ পান?
ছিকু তাকিয়ে থাকলো। মুনা বলল
‘ মাহি পান দিতে বলছে বোধহয়।
নিকিতা বেগম একটি পান ধরিয়ে দিয়ে গাল টেনে দিল ছিকুর। ছিকু পান নিয়ে গেল। এসে পান বাড়িয়ে দিয়ে রেগে বলল
‘ নিনির আম্মো গাল টানি দিচে কেন?
মাহিদ তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল
‘ আমারে ক্যান জিগাইতাছোস? ডক্টরগেরে জিগা।
নিনিত হেসে ছিকুকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে বলল
‘ ছিকু ব্যাথা পেয়েছে?
‘ বিথা পাইনি কেন?
নিনিত আবার হাসলো।
মাইশা পান বানিয়ে দিল। বরের বন্ধুরা পাঁচ হাজার দিল। বলল
‘ আর নাই।
পিহু বলল
‘ অসম্ভব। এগুলো দিয়ে কি হবে? আমরা অনেক জন এখানে। টাকা ছাড়ুন। বিয়ে একদিনই তো হচ্ছে। রোজ রোজ তো হবে না। কিপ্টামি চলবেনা জিজু।
বর চুপচাপ হাসলো। বলল
‘ আমার হাতে কিছু নাই।
‘ নাই বললে তো শুনবো না।
শেষমেশ আট হাজারে সবাই চুপ মারলো। কারণ ওদিকে নিনিতের বাবা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। পিহু সবাইকে টাকা ভাগ করে দিয়ে ফেলল। নিজেরটা নিজের কাছে রাখলো।
তারপর বর বউয়ের সাথে তাদের সবাইকে খেতে বসতে হলো। পিহুকে নিনিতের পাশে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল সবাই মিলে।
রেহান পরীকে ও নিয়ে আসলো নিয়াজ সাহেব। ছিকু বসলো মা বাবার মাঝখানে চেয়ারে। সে বসে টেবিলের উপরে কিছু দেখতে পারেনা তাই তাকে পরী দাঁড় করিয়ে দিল। বলল,
‘ আমি খাইয়ে দেই আব্বা?
ছিকু রেগে গেল। সে হাত দিয়ে খাবে। কেন পরীর হাতে খাবে? সে সবার মতো হাত দিয়ে খাবে। রেহান বলল, আচ্ছা আচ্ছা আপনি একা একা খান। আপনার জন্য প্লেট আনা হয়েছে।
ছিকু খুশি হলো।
মাইশা বসলো পিহুর অন্যপাশে। মাহিদকে খুঁজতে খুঁজতে নিয়ে এল নিনিতের বাবা। পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ব্যারিস্টারের পোলা তুই যাস কই হুটহাট? হবু বউয়ের লগে বইসা ভাত খা। বোস।
মাহিদ বসলো চুপচাপ। আগ বাড়িয়ে কিছু খেল না। মাইশা বেড়ে দিতে দিতে বলল এগুলা দিই? ওটা দিই?
মাহিদ চুপচাপ মাথা দুলালো। মাইশা মনে মনে ভাবলো, এই মানুষটা তো ভীষণ অদ্ভুত!
পিহু ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিংড়ি খাচ্ছে। নিনিত বলল
‘ তোমার না চিংড়িতে এলার্জি। অন্য কিছু খাও। এটা রাখো।
পিহু হাত দিয়ে চিংড়ি ঢেকে নিল। না আমি এটাই খাব।
নিনিত হেসে ফেলল তার কান্ড দেখে।
মাহিদ এদিকওদিক তাকালো। দেখলো নিশিতা মাথা নিচু করে একটু একটু খাচ্ছে। মাহিদ বলে উঠলো,
‘ ওই নিশুর বাচ্চা নিশু তুই মাথা নিচু করে খাইতেছোস কিল্লাই? দুনিয়ার সব শরম তোর আইজ চইলা আসছে না? ঢং করোস? এমনিতে তো জামাই জামাই কইরা নাচতে নাচতে বেহুশ।
মাহিদের কথা শুনে জিয়াদ সহ টেবিল কাঁপিয়ে হেসে উঠলো সবাই। নিশিতার কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে মাথা আর ও নামিয়ে ফেলল। মাহিদ ভাইটার মুখে একদম লাগাম নেই।
হাসতে হাসতে নিনিতের কাশি উঠে গেল। পিহু পানি বাড়িয়ে দিল। মাহিদের দিকে তাকিয়ে ভাবলো ছিঃ ছিঃ এত ঠোঁটকাটা মানুষ ও হয়?
ছিকু চেঁচিয়ে বলল
‘ মিহি নিচিকে বুকে কেন? নজ্জা দেয় কেন? মিহি পুঁচা কেন?
মাহিদ চোখ লাল করে তাকালো। ছিকু হাতের ভাতের মুঠো গালে ঢুকিয়ে দিয়ে মাহিদের দিকে চোখ লাল করে তাকালো। সবাই আবার ও হেসে উঠলো।
ছিকু চিকেন হাতে নিয়ে ভাত চিবোতে চিবোতে বলল
‘ মিহিকে ইটা দিয়ে মারতে মন চাই কেন?
সবার আরেকদফা হাসলো।
মজা হাসির মধ্যে দিয়ে খাওয়া শেষ হলো সবার।
তারপর এল বধূ বিদায়ের সময়। যাওয়ার সময় নিনিতকে ঝাপটে ধরে সে কি কান্না নিশিতার! নিনিত আবেগ কনট্রোল করে বোনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে স্নেহের পরশ দিল। বলল
‘ আরেহ বেশিদূর তো না। কাঁদার কি দরকার?
নিশিতা কার কথা শোনে? মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। মাহিদ সেখানে গিয়ে বলল
‘ তোরে তো লন্ডন পাঠাইতাছি না বাপ? কান্দোস কিল্লাই?
নিশিতা ফুঁপিয়ে উঠলো। পিহু থমথমে মুখে এককোণায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইশা বলল, ওর কাছে যাও না। তুমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড না?
পিহু ধীরপায়ে হেঁটে গেল। নিশিতা তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। কেঁদেকেঁদে বলল
‘ তুই আমার আম্মা আব্বার মেয়ে হয়ে উঠিস পিহু। আমার ভাইকে ভালো রাখিস।
তার কথায়, কান্নায় পিহুর চোখের কোণায় জল জমে উঠলো। টুপটাপ কয়েকটা ফোঁটা পড়ে গেল নিশিতার কাঁধে। পিহু তাকে ছাড়লো। চলে যেতেই মুখোমুখি হলো নিনিতের। হাতের কব্জি দিয়ে চোখের কোণা ঘষলো পিহু। চোখ নামিয়ে নিল নিচে। অনুভব করলো তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কারণ জানা নেই।
নিনিতের সামনে থেকে সরে পড়লো সে। সরতে না সরতেই আবারও মাহিদের মুখোমুখি হয়ে গেল পিহু। মাহিদ চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল।
চলবে,
???