#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_২৬
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
প্যাথলজির বইটা খুলে একটা একটা পৃষ্ঠাতে লম্বা লম্বা করে কলমের দাগ টানছে ছিকু। মেঝেতে বসা সে। আফি খবরের কাগজ পড়ছে। পিহু কোমড়ে হাত দিয়ে ছিকুর কাজ দেখছে। কয়েকটা পৃষ্ঠাতে বেশি ভার দিয়ে কলম টানতেই ছিঁড়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। হায়হায় করে উঠলো পিহু৷ বলল
‘ এসব কি হচ্ছে বাজে ছেলে ?
ছিকু পিহুর দিকে তাকালো। কলম দেখিয়ে বলল
‘ কেন ছিকু বাজি ছিলে কেন? ছিকু লিখিলিখি করি কেন? পুড়াচোনা করি কেন?
আফি বলল
‘ কি হয়ছে আম্মা?
‘ আমার বইটা শেষ করে দিল। আম্মা! বড়মা, দিদিয়া? দেখো ছিকু কি করেছে? আল্লাহ সব শেষ।
ছিকু কপাল কুঁচকে তাকালো পিহুর দিকে। পিহু চেঁচামেচি করছে কেন? পিহুকে চিল্লাতে দেখে ছিকু কলমটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলল
‘ পিহুকে ইটা দিয়ে মারবো কেন?
পিহু তার গালটা জোরে টেনে দিয়ে আলতো করে চড় মারলো। বলল
‘ দাঁড়াও আমার পাপা আসুক। আজকে তোমাকে ওই ভূতের কাছে দিয়ে আসতে বলব পঁচা ছেলে। আম্মা কি করেছে দেখো?
সবাই ছুটে এল। ইশা বলল
‘ কি হলো?
পিহু ছিকুকে দেখিয়ে দিল। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকালো। আফি বলল
‘ এইডা তোমার বই? আমিই তো ওরে আইনা দিছি ওর কান্না থামানোর লাগি।
পিহু বলল
‘ কি আশ্চর্য!
রাইনা বলল
‘ যেমনভাবে বলতেছে মনে হচ্ছে খুশির কথা বলতেছে। আশ্চর্য ব্যাপার।
আফি কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। এই রেহাইন্নের মা তারে কথায় কথায় এরকম ধমকায় ক্যা?
আফি উঠে চলে গেল। ছিকু কলম দেখিয়ে ইশাকে বলল
‘ ইশুবুনু পুড়ালিখা করেনা কেন? পুঁচা কেন?
পিহু কপাল চাপড়ে বইটা কেড়ে বলল
‘ এইটা নতুন বই আমার। কাল দাভাইকে আনতে বলেছি।
পরী বলল
‘ হ্যা ওটা তো আমার ড্রয়ারের উপর ছিল। ওখান থেকেই বোধহয় বড়পাপা রাহিকে দিছে।
ছিকু দাঁড়িয়ে পড়লো। পিহুর কাপড় টেনে দিয়ে বলল
‘ পিহু ইটা নিয়ে ফিলচে কেন?
পিহু ধমকে বলল
‘ একদম চুপ। বই নষ্ট করে আবার কথা বলে। ঠাস করে মেরে গাল লাল করে ফেলব বেয়াদব ছেলে।
ছিকু নিচের ঠোঁট উল্টে ফেলল। সবার দিকে একে একে তাকালো। পরী বলল
‘ আমি নেই। পিহুর বই ছিঁড়েছেন কেন? ভালো হয়েছে।
ইশা তাকে কোলে নিয়ে ফেলল। বলল
‘ আর বকো না। না বুঝে করছে।
ছিকু পিহুর দিকে রেগে তাকিয়ে বলল
‘ পিহু ডগ কেন? ক্যাট কেন? মাংকি কেন? মিহিকে বুলে দিব কেন? পিহু বুকা দিচে কেন? মিহি পিহুকে বুকা দিবে কেন?
রাইনা হেসে ফেলল৷ পিহু ফুঁপিয়ে চেয়ে রইলো ছিকুর দিকে৷ রাইনা তাই ছিকুকে ইশার কোল থেকে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ ওরেবাবারে আমরা চলি যাই। পিহু আমাদের মারবে।
তারা চলে যেতেই ইশা পিহুকে বলল
‘ কয় পৃষ্ঠা ছিঁড়েছে?
‘ চার পাঁচ পৃষ্ঠা হবে।
‘ আচ্ছা চিন্তা করলে কি সেগুলো আর ফিরে আসবে? ছেলেটা ভীষণ দুষ্ট হচ্ছে আজকাল। যা ইচ্ছে হচ্ছে তাই করছে।
পরী বলল
‘ মাহিকে নাকি বলে দেবে পিহুকে মারার জন্য। একদম পাকা পাকা কথা৷
ইশা পিহুর দিকে তাকালো। বলল
‘ আচ্ছা আমি এখন আসি।
পিহু পরীকে বলল
‘ মাহিদ ভাই আমাকে মারবে? অত সাহস আছে নাকি।
ইশা যেতে যেতে থামলো। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল
‘ আছে তো। আছে বলেই তো মারে।
পিহু ইশার দিকে হা করে চেয়ে রইলো। তারপর ঘরে চলে গেল।
মাহিদের ফোনে কল দিল পিহু। মাহিদ তখন রিকের সাথে বসার ঘরে টিভিতে খেলা দেখছে। মাহিদ ফোন তুলে কানে দিয়ে বলল
‘ কিতা হইছে বাপ?
‘ মাহিদ ভাই তুমি আম্মাকে কি কি বলে ফেলেছ? আম্মা আমার দিকে কেমন করে কেমন করে তাকাচ্ছে। তোমার সমস্যা কি বুঝিনা আমি৷ হুটহাট যা ইচ্ছা তাই বলো বসছো। কি বলেছ?
‘ কিহ? তোর মা ফোন ধরছিল?
‘ হ্যা।
মাহিদ ফোন কেটে দিয়ে রিকের পাশে শক্ত হয়ে বসে রইলো। রিক বলল
‘ কি হয়ছে?
মাহিদ বলল
‘ বিরাট কারবার হয়ছে বাপ।
রিক হেসে বলল
‘ পিহু ছিল নাকি?
‘ হ।
‘ মেয়েটার সাথে ঝগড়া করা ছাড়লি না তুই।
মাহিদ দাঁড়িয়ে পড়লো। এদিকওদিক পায়চারি করতে করতে বলল
‘ শালা বাপের বইন।
_________
পিহু রিকশা থেকে নেমে মাত্রই মেডিক্যালের গেইটের ভেতর পা রাখবে। মাহিদ এল সাইকেল চালিয়ে। পিহু দ্রুত সরে পড়ে বলল
‘ আশ্চর্য!
মাহিদ সাইকেল থামালো। সাইকেল থেকে নেমে বলল
‘ থাম বাপ।
পিহু ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। মাহিদ বলল
‘ তোর লগে কথা আছে। চল।
‘ কোথায়?
মাহিদ তার হাত টেনে নিয়ে গেল। বলল
‘ পেছনে বস বাপ। কথা কইবি না বেশি।
পিহু বলল
‘ আমার ক্লাস।
মাহিদ গর্জে বলল
‘ চুপ বেডি। যা বলতাছি তাই কর৷
পিহু চুপচাপ সাইকেলের পেছনে বসলো। মাহিদ সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ তোর এত শরম কিল্লাই করে বাপ? ভালা কইরা ধর।
পিহু লজ্জায় ভালো করে ধরলো না৷ মাহিদ সাইকেল চালিয়ে পিহুকে খান বাড়ি নামিয়ে দিয়ে নিজে সোজা কোথায় যেন চলে গেল। নীরা ছুটে আসলো। বলল
‘ ওরেবাবা পিহু আসছে। আসো আসো আম্মজান। তোমারে খুঁজতাছি আমি।
পিহু সালাম করলো। তারপর চেহারার রঙ বদলে বলল
‘ মামি মাহিদ ভাই এটা কি করলো? আমার তো আজ ক্লাস আছে।
‘ ধুরর আজ কেলাস টেলাস বাদ। আমার সাথে হবে আজ যত কেলাস টেলাস । আসো আসো।
পিহু বাড়িতে পা রাখলো। মুনার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। মুনা গালভরে হেসে বলল
‘ তোর ছেলে যেটা বলো সেটা করে দেখায়। এই না হলে মাহিদ খান।
পিহু কারো মতলব কিছু বুঝলো না। রিপ,রিক বাড়িতেই ছিল। পিহুকে পেয়ে তারা ও খুশি। পিহু বলল
‘ কেন এখানে আমাকে আনা হলো?
কেউ কিছু বললো না। খাইয়ে দাইয়ে পরে নীরা বলল
‘ মাহির তো বউ আসবে কিছুদিন পর৷ তো কিছু আসবাবপত্র বানাতে দিবো। তো তুমি তো মেয়ে। মেয়েরাই তো জানে মেয়েদের কি কি দরকার পড়ে। তাই তোমারে নিয়ে আসতে বলছি মাহিরে।
পিহু হতবাক। রিপ তাকে নিয়ে বসে গেল খাতা কলম নিয়ে। ফুলদানি পর্যন্ত বাদ রাখেনি। কি একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। নীরা বলল
‘ উফফ মাইশু তো খুশি হয়ে যাবে ব্যারিস্টার। তাই নাহ?
রিপ বলল
‘ একদম। খুশির জন্যই তো এতকিছু।
শুধু আসবাবপত্র নয়। এমনকি শাড়ি টারি দেখালো অনলাইনে। পিহু রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে কোনোমতে দুটো শাড়ি চুজ করে দিয়ে হনহনিয়ে তার ঘরে চলে এল। একদম আর বের হলো না। মাহিদ এল সন্ধ্যার দিকে। হাতে নানানরকম ফাস্টফুড। মুনা বলল
‘ তুই এগুলা খাস মাহি ? সারাদিন আজ এগুলো খেয়েছিস?
মাহিদ বলল
‘ ধুর বিগ মাদার। এগুলা খামু কোন দুঃখে? এগুলা ডাক্তারের বাচ্চির লগে আনছি। শালী আমারে পাইলেই হামলা করবো, তাই ঠান্ডা করার জন্য এগুলা আনছি। খবরদার এই কথা কাউরে আর কইবানা। শালা বাপ জেঠা শুনলে কথার আর শেষ থাকবো না বাপ।
মুনা তার কান মলে দিয়ে বলল
‘ সারাক্ষণ বাপ বাপ। শালা শালা ? দাঁড়া আমি বলব তোর বাপকে।
মাহিদ হেসে চলে গেল। ঘরে গিয়ে ফ্রেশট্রেশ হলো। তারপর মনে পড়লো পিহুকে এগুলা দেওয়ার ছিল। শালীর খোঁজ খবর নাই ক্যান? মাহিদ নিজেই গেল পিহুর খোঁজে। দরজায় কয়েকবার টোকা দিতেই পিহু এসে দরজা খুললো৷ কোনো কথা না বলে আবার বিছানায় গিয়ে বসলো। বলল
‘ আমাকে এক্ষুণি দিয়ে আসো। আমি থাকবো না এখানে।
মাহিদের কপালে ভাঁজ দেখা দিল।
‘ ধর তোর লাগি এগুলা আনছি। খাহ।
‘ খাব না।
‘ তোরে কামড়াইছে কেডা বাপ?
‘ মুখ সামলে কথা বলো। তোমার বউয়ের জন্য কি কি কিনতেছ কিনো। আমাকে টানার কি দরকার?
মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখলো পিহু। মাহিদ হো হো করে হেসে উঠলো। চুল জোরে ঝাঁড়া মেরে বলল
‘ তোরে টানমু না তো কি আমার বউরে টানুম। আমার বউ ব্যাথা পাইবো বাপ।
পিহু বলল
‘ চুল ঝাড়তেছ কেন? আশ্চর্য?
মাহিদ আবার ও হাসলো। পিহুর সামনে গিয়েই বসলো। বলল
‘ ধর খা। ফুচকা আনছি। ধর।
‘ নাহ। খাব না।
‘ ধুর শালী মাথা গরম করোস কিল্লাই? ধর খাহ।
‘ না খাব না। তোমার বউকে খাওয়াও।
মাহিদ বক্সটা খুলে একটা নিল। পিহুর মুখ বরাবর নিয়ে গিয়ে বলল
‘ তোর বাপ বিষ খা। আর মইরা যাহ।
‘ খাব না।
মাহিদ নিজেই অনিচ্ছা স্বত্বেও খেতে খেতে বলল
‘ তুই না খাহ। আমি খাই।
পিহু আড়ঁচোখে চেয়ে থাকলো। বিড়বিড়িয়ে বলল
‘ ওমা সব খেয়ে ফেলতেছে।
তারপর মুখ ফুটে বলল
‘ আমি খাব। সব খেয়ে ফেলতেছ কেন?
মাহিদ হো হো করে হেসে উঠলো আবার। বাকিসব পিহুর সামনে দিয়ে বলল
‘ খাহ।
পিহু খেতেখেতে বলল
‘ আমি থাকবো না এখানে।
‘ তোরে এখানেই থাকতে হইবো বাপ৷
‘ কখনো না কোনোদিন না৷
মাহিদ তার দিকে তেড়ে গেল। পিহু ভয়ে চেপে গেল। মাহিদ তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল
‘ তোরে এখানেই থাকতে হইবো বাপ৷ এক বছর, দশ বছর, ১০০ বছর৷
চলবে