মন_গোপনের_কথা #পর্ব_২৭,২৮

0
277

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_২৭,২৮
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
২৭

পিহু রাতে খাবে না বলে জেদ ধরেছে। দরজা বন্ধ করে বসে আছে। নীরা এল, মুনা এল, রিক এল। সে গেল না। সে ভাত খাবে না। বাঁশ দিয়ে আবার ভাত খাওয়াচ্ছে। সে খাবে না মানে খাবে না। মাহিদ এসে দরজার বাইরে চিল্লাচিল্লি করে গালাগাল দিতে লাগলো।

‘ ওই বেডি তুই দরজা বন্ধ করছোস কিল্লাই বাপ? দরজা খোল। মাইর না খাইতে চাইলে দরজা খোল শালী।

পিহু বলল

‘ খুলব না। তোমাকে আমি ভয় পাই না। আমি ভাত ও খাব না, দরজা ও খুলবো না।

সে যাইহোক। মাহিদ ও পারলো না। শেষমেশ রিপ গেল চুপিসারে হেঁটে হেঁটে। দরজায় টোকা মেরে বলল

‘ মামা বাইরে এসো। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। এসো এসো।

পিহু দরজা খুলে দিল। গালফুলিয়ে বলল

‘ কি সারপ্রাইজ?

রিপ হেসে ফেলল। পিহুর মাথা নাড়া দিয়ে বলল

‘ ভাত খাওয়ার পর দেব। আগে খেতে হবে। আমার কথার কিন্তু নড়চড় হয় না।

পিহু তারপর টেবিলে গেল। মাহিদ তাকে দেখার কপাল কুঁচকে চাইলো। পিহু মুখ মোঁচড়ে দিল। মাহিদ সেইরকম রেগে গেল। শুধু রিপ থাকায় কিছু বলল না। পিহু ও সুযোগ নিল। খেতে খেতে মাহিদকে পরপর কয়েকবার মুখ মোচড়ে দিল। মাহির কোনোরকম গোগ্রাসে খেতে তাড়াতাড়ি সরে পড়লো। শালীরে আইজ কয়েকটা না দিলে রাতে ঘুম ভালা হইবো না।

পিহু খেয়ে উঠলো৷ ঘরের দিকে যেতেই মাহিদ তার লম্বা বেণুনী জোরে টেনে দিয়ে দৌড়ে তার ঘরে চলে গেল। পিহু মাথার পেছনটা চেপে ধরে টলটলে চোখে চেয়ে থাকলো মাহিদের ঘরের দিকে। ঘরের দরজায় থু থু ছিটিয়ে বলল

‘ মাহিদ ভাই দেখে যাও তোমার ঘরের দরজায় কি দিছি। একদম ভালো কাজ করছি। হুহ।

মাহিদ সাথে সাথে দরজা খুলে বের হয়ে এল। দরজা দেখে বলল

‘ কি দিছস?

উড়ো থুতু ছিটায় সেগুলো চক্ষুগোচর হচ্ছে না তাই পিহু আবার ও থুতু ছিটিয়ে বলল

‘ থুতু মারলাম। আমাকে মারছো কেন?

মাহিদ কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। এই শালীরে কি করন যায়?
পিহু ঘরের দিকে দৌড় মারলো। চিল্লিয়ে বলল

‘ মামা, মামি দেখো মাহিদ ভাই আমাকে মারছে।

মাহিদ এগোতে ও পারলো না। নীরা মুনা ছুটে এল।

‘ মাহি ও না বেড়াতে আসছে। তুই মারোস এজন্যই তো আসতে চায় না।

মাহিদকে কিছু বলতে না দিয়ে তারা দুজনেই পিহুর কথা শুনে বকবক করতে লাগলো। মাহিদ শুধু পিহুর দিকে চেয়ে আছে। যেন সে শিকারি। শালীরে এমন মারা মারতে হইবো যাতে শালী দুই সেকেন্ড বেহুশ থাকে। কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে চলে গেল মাহিদ৷
পিহু ঘরে ঢুকে মুখ চেপে ধরে খিকখিক করে হাসতে লাগলো। মাহিদ খানকে জব্দ করতে পেরে ভালো লাগছে৷ কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো মামা তাকে সারপ্রাইজ দেবে বলেছে। কোথায় সারপ্রাইজ?

পিহু রিপের ঘরের দিকে গেল৷ রিপ টেবিলের কাছে। নীরা কিছু কাপড়চোপড় ব্যাগে থেকে বের করছে। পাশেই কিছু চকচকে র্যাপিং পেপারে মোড়ানো গিফট বক্স জাতীয় কিছু। পিহু বাইরে দাঁড়িয়ে বলল

‘ আসব?

রিপ বলল

‘ হ্যা হ্যা। আমি এক্ষুনি যাচ্ছিলাম।

পিহু বিছানার শাড়ি আর আর ও বাকি জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল

‘ আমার সারপ্রাইজ।

নীরা রিপ দুজনেই একত্রে হাসলো। নীরা বলল

‘ এদিকে আসো আম্মাজান। তোমারে দেখাই মাইশুর জন্য কি কি কিনছি। বসো। তোমার মামা সারপ্রাইজ দিবো তোমারে। তুমি আগে এইদিকে আসো।

পিহু অনিচ্ছা স্বত্বেও বসলো। মুখটা তার থমথমে। নীরা একটি সুন্দর গয়না দেখালো। বলল

‘ এইটা তোমার বড়মামা আর বড়মামি মানে বড়দা আর আপা মাহির বউয়ের জন্য আগে বানাইয়া রাখছিল। এইটা মাইশুকে ভালো লাগবে না?

পিহু মাথা নাড়লো। নীরা আরেকটি ছোটখাটো বক্স বের করলো। সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটি ছোট আন্টি। নীরা সেটি বের করে পিহুর আঙুলে পড়িয়ে দিল। রিপকে দেখিয়ে বলল

‘ ব্যারিস্টার এটা মাইশুকে আর ও বেশি সুন্দর লাগবে না?

রিপ বলল

‘ একদম।

নীরা সেটি খুলে নিল। বলল

‘ এটা যেমন তেমন না। আমি আমার জমানো টাকা দিয়া ডায়মন্ড কিনছি আমার ঘরের রাণীর জন্য। হুহ এইখানে ব্যারিস্টারের কোনো ভাগ নাই।

রিপ বলল

‘ মেনে নিলাম।

নীরা আর ও একটি গয়নার বাক্স বের করলো। সেটি খুলে দেখলো পুরোনো ডিজাইনের একটি গয়না। নীরা বলল

‘ এটি আমার শাশুমার। মাহির বউয়ের জন্য দিয়া গেছে। তোমারে আর পরীর জন্য যেমন দিছে মাহির বউয়ের জন্য ও দিয়া গেছে। সুন্দর নাহ?

পিহু মাথা নাড়ালো। নীরা একজোড়া মোটা ভারী বালা বের করলো। পিহুর হাতে পড়িয়ে দিয়ে বলল

‘ এগুলা মাহির নানু দিছে ওর বউয়ের জন্য। একদম খাঁটি সোনা।

পিহুর হাত থেকে আবার ও সেগুলো খুলে নিল নীরা। শেষমেশ একজোড়া ঝুমকো কানের দুল বের করলো। দারুণ পছন্দ হলো পিহুর। কিন্তু সে হাত বাড়ালো না। এগুলো তার নয়। কান্না গলায় আটকে রয়েছে পিহুর। কথা বলতে ও পারছেনা সে। নীরা সেগুলো পিহুর কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল

‘ ওমা ব্যারিস্টারের পছন্দ তো হেব্বি। সেইরকম সুন্দর এগুলা।

গর্বে রিপ হাসলো একটুখানি। নীরা বলল

‘ ইশু ও একটা রাখছে। আমাকে ফোনে বলছিল একবার। মাহির বউরে বিয়ার পর দাওয়াত দিয়া ওইটা দিবো বলছে। শুনো আম্মাজান আমার খুব শখ ছেলের বউকে নিজ হাতে সাজামু আমি। আমার তো মাইয়্যূ নাই, ওইদিন আমার শখ পূরণ হইয়্যা যাইবো। আমার তো ভাবতেই খুশি লাগতেছে।

পিহু কথা বললো না। নীরা বলল

‘ দাঁড়াও আর ও কিছু দেখায়।

বলতে না বলতেই নীরা শাড়ির ভাঁজ খুলে ফেলল। কতগুলো পুরোনো শাড়ি। ওগুলো রেখে নতুন কেনা লাল, খয়েরী আর নীল শাড়িটা মেলে ধরলো পিহুর সামনে। বলল

‘ এগুলা সুন্দর নাহ আম্মা?

পিহু ক্ষীণ গলায় বলল

‘ হুহ।

নীরা বলল

‘ এগুলা বিয়ের পর পড়বো আর কি। দাঁড়াও আর ও কিছু দেখাই৷
নীরা তিনটা থ্রি পিছ বের করলো। সেলাই করা নেই। সেগুলোর ভাঁজ খুলে বলল

‘ এগুলা ও বিয়ের পর পড়বো । কয়দিন শাড়ি পড়ে থাকবে ? আজকালকার মেয়েরা তো শাড়ি পড়তেই চায় না। পড়ে মাহি কিনে দিবোনে।

আমার বাচ্চা তো এখন টাকা পয়সা কামাই না। তাই সব খরচ তার বাপের উপর।
পিহু বলল
‘ আমি চলে যাই?
নীরা রিপের দিকে তাকালো। বলল
‘ সারপ্রাইজ নিবা না।
‘ এগুলোই তো সারপ্রাইজ আমার জন্য। আর চাই না।
পিহু রুম ত্যাগ করলো।
তার রুমের দিকে যেতে যেতে মাহিদের সাথে দেখা হলো আবার। মাহিদ পড়নের সাদা টি শার্টের গলা পেছনে ঠেলে দিয়ে পিহুর দিকে তাকাতেই বলল

‘ ওমা তুই কান্দোস কিল্লাই। তোরে তো আমি মারিনাই।

পিহু তাকে এড়িয়ে চলে যেতেই মাহিদ খপ করে তার হাত ধরলো। টেনে এনে আবারও তার সামনে দাঁড় করালো। বলল

‘ সমস্যা কি?

‘ অনেক সমস্যা। সারাদিন মাইশা মাইশা করো আবার আমার সাথে কি? তোমার পুরো পরিবার মাইশা মাইশা করবে, আর তুমি ও তাদের সাথে তাল মিলবে। মাঝখানে আমাকে টনার কি দরকার? একদম ছুঁবেনা আমাকে। কথা বলতে ও আসবে না।

বলেই হনহনিয়ে চলে গেল পিহু।
রিপ এসে মাহিদকে পিহুর ঘরের দিকে অবাক চোখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল

‘ ঘরে যাহ।

মাহিদ চলে গেল চুপচাপ। পিহুর ব্যাপারটা তাকে ভাবাচ্ছে। শালীর কি হলো আবার?

রিপ দরজা ধাক্কালো বারবার। পিহু বালিশ থেকে মুখ তুলে বলল

‘ খুলবো না। আমি ঘুমাচ্ছি।

রিপ বলল

‘ আমি দাঁড়িয়ে আছি। তুমি না বেরোনো পর্যন্ত যাচ্ছি না।

পিহু অনেক্ক্ষণ পর উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুললো। রিপকে খালি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। কোথায় সারপ্রাইজ?
রিপ তার হাতের মুঠো বাড়িয়ে দিল পিহুর দিকে। পিহু তাকালো হাতের দিকে৷ রিপ হাতের মুঠো খুললো৷ তারপর পিহুর সামনে ঝুলিয়ে রাখলো একটি চাবি। বলল
‘ এটি কার?
পিহু ফুঁপিয়ে উঠে বলল
‘ সব মাইশার। এটা ও তারই হবে। আমাকে দেখানোর কি দরকার?
‘ একদম নয়। এটাই তোমার সেই সারপ্রাইজ।

চলবে,,,,,

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_২৮
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা

চা নাশতা সেড়ে রিকের সাথে টিভিতে নিউজ দেখতে বসেছে পিহু। কিছুক্ষণ পর সে মেডিক্যালের উদ্দেশ্যে বের হবে। নীরা গরম গরম পেঁয়াজু ভেজে আনলো। বলল

‘ নাও এগুলা খাও। ঝাল ঝাল করে বানাইছি।

পিহু প্লেটটা হাতে নিল। বলল

‘ কালারটা সুন্দর হয়েছে।

নীরা হাসলো৷ পিহু রিককে বলল

‘ মামা খাও।

‘ তুমি খাও। আমি তেলের জিনিস তেমন খাই না।

‘ একটা নাও শুধু । ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না।

রিক তার জোরাজোরিতে নিল। পিহু সোফায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে পেঁয়াজু খেতেই কোথাথেকে মাহিদ উড়ে আসলো। প্লেট থেকে দু তিনটা একসাথে হাতের মুঠোয় নিয়ে চিবোতে চিবোতে পিহুর কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসলো। শার্টের কলার পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল

‘ তারপর?

পিহু নাক ফুলিয়ে চেয়ে রইলো তার দিকে। মাহিদ পেঁয়াজু বাকিগুলো হাতে রেখে অন্য হাতে আর ও কয়েকটা নিয়ে ফেলল। প্লেটে আর দুটো বাকি রইলো। পিহু চিল্লিয়ে নীরাকে ডাকলো

‘ মামি?

রিক চমকে উঠলো।

‘ কি হয়েছে?

মাহিদকে দেখে আর কিছু বুঝার বাকি রইলো না কারো। নীরা মুনা ছুটে আসলো। নীরা হায়হায় করে বলল

‘ তোরে ডাকছি না? তুই ওরগুলা খাচ্ছিস কেন? আশ্চর্য।

‘ মেরিমা কবি বইলা দিছে, যাহা পাও, তাহা খাও।

পিহু বলল

‘ গু খাও। এগুলো কেন খাচ্ছ?

সবাই আচমকা হেসে উঠলো পিহুর কথায়। মাহিদ হো হো করো হেসে লুটিয়ে পড়লো পিহুর পাশে। পিহু সরে বসলো। মাহিদ হাসতে হাসতে সোফা কাঁপিয়ে ফেলল। পিহু ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল

‘ আমি হাসার কি বলেছি?

সবাই হাসি চাপা দিল। শুধু মাহিদের হাসি এখনো থামেনি। পিহু বাকি পেঁয়াজুগুলো মাহিদের মুখের উপর ফেলে প্লেট দিয়ে দুম করে পিঠে মেরে চলে গেল।

নীরা মাহিদকে বলল

‘ একদম ভালো হয়ছে।

মাহিদ হাসতে হাসতে ধপাস করে সোফা থেকে পড়ে গেল। সবাই চোখ পাকিয়ে চেয়ে থাকলো। মাহিদ তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে প্যান্ট ঝেড়ে বলল

‘ শালী তোর কারণে হয়ছে ডাক্তারের বাচ্চি।

নীরা বলল

‘ ও কিছু করেনাই। সবসময় ওর দোষ দিবিনা।

মাহিদ বিড়বিড় করল

‘ শালার বাপের বউ।

_______________

পিহু গায়ে এপ্রোন আর ব্যাগ নিয়ে বসার ঘরে চলে এল। মুনা ভাতের প্লেট নিয়ে দৌড়ে আসলো। বলল

‘ আসো। ইশু বলবে আমার মেয়েকে খালি পেটে বের করে দিয়েছে।

পিহু বলল

‘ নাআআ। আমি সকালে ভাত খাই না মামি। খাব না।

নাকমুখ তুলে রাখলো পিহু। মুনা লোকমা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

‘ শুধু দুটো। মাহিকে ডাকি দাঁড়াও। মাহি! এই মাহি?

মাহিদ খান এল হেলেদুলে হেঁটে। চুলগুলো হাত দিয়ে ফ্যাশন করে আসতে আসতে বলল

‘ কিতা হয়ছে বাপের বড় বইন?

‘ ভাত খাবি আয়।

পিহুকে আগাগোড়া পরখ করে কপাল কুঁচকালো মাহিদ। পিহু মুখ মোচড়ে দিল। মাহিদ মুনার হাতে প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল

‘ এগুলা সব আমি খামু। আর কোনো হারামিরে ভাগ দিমুনা বাপ।

মুনা হেসে পিহু না শোনেমত বলল

‘ সবসময় ওর পেছন লাগিস কেন? এমনিতে তো জীবনে ও সকালে ভাত গিলিস না।

‘ এহন গিলুম৷ শালীরে দিমু না৷ শালী আমার বাড়ির ভাত খাইবো কিল্লাই?

মুনা এক লোকমা দিল। মাহিদ অন্যরকম ভঙ্গিতে চিবোতে লাগলো পিহুর দিকে চেয়ে চেয়ে। পিহু মুখ ফিরিয়ে নিল। মাহিদ তার সামনে গিয়ে খেতে লাগলো। মুনা কপাল চাপড়ে বলল

‘ আল্লাহ কি দিয়ে বানাইছে এই ছেলেকে?

পিহু তন্মধ্যে চেঁচিয়ে উঠলো। ব্যাগ সোফা ছুঁড়ে মেরে পা নাচিয়ে বলল

‘ ছোট মামা দেখো মাহিদ ভাই কেমন করে?

মাহিদ হেসে ফেলল। ঢকঢক করে পানি খেয়ে কয়েক ফোঁটা পিহুর মুখে ছুঁড়ে মেরে বলল

‘ বল্টুর বিবিজান তুই চিড়িৎচিড়িৎ গরম হইয়্যা যাস ক্যান বাপ?

পিহু রাগে কিড়মিড় করে উঠলো। মুনা বলল

‘ ধুরর বাবা আমি এসবে নাই। আমি রিপকে ডাকি। দাঁড়া।

মাহিদ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। পিহু সোফায় গালফুলিয়ে বসে রইলো। চেহারায় রাগের আভা। রিপ এসে বলল

‘ কি হয়েছে? কোথায় মাহি?

পিহু বলল

‘ চলে গেছে।

রিপ বলল

‘ আচ্ছা। ও আসুক। আমি দেখব। তুমি খেয়ে নাও। আমি গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।

মুনা তাকে কয়েক লোকমা জোরপূর্বক খাইয়ে দিল। তারপর বের হয়ে গেল পিহু। মেডিক্যালে পৌঁছুতেই নিশিতা ছুটে এল। হেসে বলল

‘ আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম রে।

‘ কেন?

‘ তুই আমার সাথে ওভাবে কথা বলছিস কেন আজকাল?

মন খারাপ হলো নিশিতার। পিহু তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

__________

বাড়ি ফিরতেই ছিকুর মুখোমুখি হলো পিহু। ছিকু তাকে দেখে ছুটে এসে বলল

‘ পিহুর জুন্য মন পুড়িচে কেন?

পিহু তাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে টাপুসটুপুস চুমু খেয়ে বলল

‘ আব্বার জুন্য মন পুড়িচে কেন?

ছিকু খিকখিক করে হেসে ফেলল। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পিহুর কোলে নেচেনেচে বলল

‘ ওহ ওহ পিহুচুন্নি আসিচে কেন? ওহ ওহ মুজা মুজা।

নাচতে নাচতে পিহুর নাকে মাথা লেগে গেল। পিহু বলল

‘ উফফ।

ছিকু কাঁদোকাঁদো চেহারায় বলল

‘ পিহু দু্ক্কু পাচে কেন? কান্না করে না কেন?

পিহু বলল

‘ চুপ বাজে ছেলে৷ ব্যাথা দিয়ে আবার বলে দুক্কু পাচে কেন?

সবাই আসলো। পিহু বলল

‘ দেখেছ আসার সাথে সাথে কোলে চড়ে বসেছে।

রাইনা বলল

‘ এভাবে বলছিস কেন? আমার ভাই কাল তোর কথা কতবার বলেছে জানিস? তোর জন্য পেট ও পুড়ছে, মন ও পুড়ছে। সব পুড়ছে।

পিহু ছিকুর দিকে তাকিয়ে বলল

‘ ওমা তাই? পিহুর জন্য মন পুড়ছে কলিজার? কলিজা পুড়েনি?

‘ কুলিজা পুড়িচে কেন?

পিহু খিক করে হেসে তাকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে কপালে টুক্কুস করে চুমু দিল।

______________

খাবার টেবিলে সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নিনিত গম্ভীরমুখে এসে বসলো নিশিতার পাশে। জালিশা এতক্ষণ বকবক করছিল নিনিত আসায় চুপ হয়ে গেল। পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেতে লাগলো। তার মা আইমি ডাক দিল।

‘ খাওয়ার আগে পানি খাচ্ছ কেন জালিশা? কতবার বলতে হয়?

জালিশা গ্লাস রেখে দিল। নিকিতা বেগম খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলল

‘ তোকে কখন থেকে ডাকছিলাম নিনিত। একটু সাড়া দিলেই তো হয়।

নিনিত জবাব দিল না। চুপচাপ বসে রইলো। জালিশার কপালে ভাঁজ পড়লো। এই ডাক্তারের সমস্যা কি?

চুপচাপ খেতে লাগলো সবাই। নিকিতা বেগম বললেন

‘ জিয়াদ তো জার্মানি তে চলে যাবে। আইমি ও বললো ওরা তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে। আমার মনে হয় চৌধুরী সাহেবের সাথে কথা বলা দরকার। কি বলিস নিনিত?

নিনিত এবার ও জবাব দিল না। নিশিতা বলল

‘ মা পিহুর সাথে তো তোমার ফোনে কথা হয়। ওকে বলো না আমার সাথে কথা বলতে। আমার সাথে আজকাল কেমন করে যেন কথা বলো।

নিনিত চোখ তুলে তাকালো নিশিতার দিকে।

‘ কেন?

নিশিতা ভড়কে গেল।

‘ সত্যি বলছি ভাইয়া। আমি কিছুই জানিনা।

জালিশা ভাত নাড়তে লাগলো শুধু। এত সুন্দর একটা মেয়ে তাদের সামনেই ঘুরঘুর করে তাদের কি চোখে পড়ে না? শুধু ওই মেয়েটার কথা। মেয়েটাকে কি না করবে জালিশা নিজে ও জানেনা।

নিনিত খেয়ে চলে যাওয়ার সময় নিকিতা বেগম বলল

‘ আমি তাহলে কথা বলি। হ্যা?

নিনিত জালিশার দিকে তাকালো একবার। তারপর চলে গেল। আইমি বলল

‘ নিনিত তো লজ্জা পেতে ও শিখে গেছে। বাহবা।

জালিশা খাবারে পানি ঢেলে দিল। আইমি বলল

‘ এটা কি করলে?

‘ আর খেতে ইচ্ছে করছে না

আইমি কিছু বলতে যাচ্ছে। জাবির তার হাত ধরে বসিয়ে দিল। বলল

‘ পরে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলো।

_____________

বাড়িতে গুঞ্জন হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে। পিহু পড়ার টেবিল থেকে উঠে বসার ঘরের দিকে যেতেই সবার কথা শুনলো। ছিকু মেঝেতে বসা। মাথা নিচু করে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে খেলছে। সবাই আলাপ করছে। পিহু কিছু্ক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার ঘরে চলে গেল। মন বসছেনা পড়ায়। সবার সামনে চলে এসে ছিকুকে কোলে তুলে নিল। সবাই তার দিকে তাকালো। আদি বলল

‘ ছিকুসোনাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। পড়াও।

পিহু চলে গেল ছিকুকে নিয়ে। ছিকুকে টেবিলের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল

‘ আব্বা ওখানে কি বলছে সবাই?

ছিকু তার দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকালো। পিহু তার জাতে চুমু দিয়ে বলল

‘ কি দেখেন? বলেন না।

‘ চবাই পিহু পিহু বুলে কেন?

‘ সেটা তো জানি। কি নিয়ে কথা হচ্ছিল?

ছিকু আর কিছু বলতে পারলো না। শুধু খেলতে খেলতে বকবক করলো

‘ চিংগুম কে চাঙ্গু চে বাচনা ইয়াম্পুচিবল, বুলে দো ইয়াম্পুচিবল!

পিহু তাকে বই ধরিয়ে দিয়ে বলল

‘ এখান থেকে পড়ুন। এল ফর লায়ন।

‘ এল ফল লায়ন কেন? ছিকু ভয় পাচে কেন?

‘ চুপ। বলুন এম ফর ম্যাংগো।

‘ ম্যাংগো খেতে মন চায় কেন? ম্যাংগো মুজা মুজা কেন?

পিহু কপাল চাপড়ালো৷ বলল

‘ অশিক্ষিত থাক। যাহ আর পড়ামু না শালা।

ছিকু খিকখিক করে হেসে বলল

‘ পিহু মিহির মুতো বলে কেন? কেন বাপ কেন?

___________

সন্ধ্যা থেকে পিহুকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে মাহিদ। রাত দশটা বাজলে ও পিহুর ফোন তোলার নামগন্ধ নেই। পিহু ইচ্ছে করেই ফোন তুলছে না। বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে। ছিকু ঘুমায় রাত একটা দেড়টার দিকে। পিহুর সাথে বসে থাকে। পিহু টেবিলে পড়ছে৷ ছিকু টেবিলের উপর। বইয়ে সিংহ, বাঘ, সাপ এগুলো পরখ করে করে দেখছে। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ও দেখছে। পিহু বই থেকে মাথা তুলে বলল

‘ ঘুম পাচ্ছে আমার। আপনি কখন ঘুমাবেন?

‘ ছিকুর ঘুম আচেনা কেন?

‘ আসবে কোথাথেকে? সন্ধ্যায় ঢুসে ঢুসে ঘুমিয়েছেন। এখন আমাকে জ্বালাচ্ছে।

ছিকু আবার বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানোতে মনোযোগ দিল। একপর্যায়ে সিংহ, বাঘের ছবি আর দেখতে পেল না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আচমকা। পিহু দৌড়ে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে বুকের সাথে।
কি হয়েছে, কি হয়েছে বলতেই ছিকু কেঁদেকেঁদে বলল

‘ টাইগার নাই কেন? মাংকি নাই কেন?

পিহু হেসে বলল

‘ ওহ এই কথা?ওগুলো অন্য পৃষ্ঠাতে আর কি।

ছিকুকে শান্ত করালো। পিহু নিজেই ঘুমিয়ে পড়লো। ছিকু তার বসে বসে ফোন নিয়ে খেলছে। এক পর্যায়ে দেখলো ফোনে কে যেন কথা বলছে। ছিকু ফোনটার কাছে শুয়ে পড়লো। মুখ লাগিয়ে ডাকল

‘ ইখানে মিহি কেন?

মাহিদ মাত্রই বাইরে থেকে বাড়িতে পা রেখেছে। ছিকুর গলা শুনে বলল

‘ পিহু কোথায়?

‘ কেন? মিহি পিহুকে খুঁজি পায় না কেন? পিহু ঘুম কেন?

‘ এক কাজ কর। জগ দেখতেছোস আশেপাশে?

‘ দিখি কেন?

‘ জগের পানি ঢেলে দে শালীর মুখের উপর৷ দে। তোরে চকলেট দিমু৷ চিপস দিমু।

ছিকু খাট থেকে নামলো। জগ তুলতে পারলো না। ফোনের কাছে এসে বলল

‘ ছিকু পানি নিতি পারিনা কেন? দুক্কু পায় কেন?

‘ শালা। তাইলে এক কাজ কর। তোর খালার সব চুল টেনে দে।

ছিকু পিহুর গায়ের উপর উঠে বসলো। চুল দুমুঠোয় ধরে টানতে টানতে বলল

‘ মিহি চুল টানিত বুলছে কেন? পিহু দুক্কু পায় কেন?

পিহু চেঁচিয়ে উঠলে চুলে হাত দিয়ে। ধমকে বলল

‘ কি হচ্ছে এসব? আম্মার কাছে দিয়ে আসব?

ছিকু ঠোঁট ফুলিয়ে বলল

‘ পিহু বুকা দিচে কেন? মিহিকে বুকা দেয় না কেন?

পিহু দেখলো ফোনে মাহিদের কল। পিহু ফোন কেটেই দিচ্ছিলো। মাহিদ বলল

‘ তোর সমস্যা কি? ফোন ধরোস না ক্যা?

‘ আশ্চর্য! তোমার সাথে কেন কথা বলতে হবে? আমি ব্যস্ত আছি।

‘ কি নিয়ে ব্যস্ত আছিস?

‘ জানোনা? বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত আছি৷ কেনাকাটা করতে যাব কাল। লিস্ট করছি। রাখো।

মাহিদ রাখলো না৷

‘ তোর কেনাকাটা আর বিয়ের গুষ্ঠিরে কিলাই। কারে বিয়া করবি তুই?

‘ জানো না? তোমার বন্ধুকে। তুমি একটা কাজ করো। আমার পেছনে অযথা সময় ব্যয় না করে নিজের পেছনে সময় দাও। আমাকে নিয়ে ভাবার অনেক মানুষ আছে। তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি ওই মাইশাকে নিয়ে ভালো থাকো। সামনে আমার বিয়ে, আমাকে ডিস্টার্ব করো না আর। লোকে শুনলে, দেখলে খারাপ কথা রটাবে।আমি আর কলঙ্কিত হতে চাইনা৷ তোমাকে ও কলঙ্কিত করতে চাই না। ভাইবোনের সম্পর্ক অটুট থাক। আমি চাই। তুমি ও নিশ্চয়ই চাও৷

‘ খবরদার ফোন রাখবি না পিহু।

পিহু ফোন রাখলো। শুধু রাখলো না বন্ধ ও করে দিল।
পিহু ফোন কেটে দিতেই মাহিদের হাতের হাতের ফোনটা রাগের শিকার হয়ে তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লো৷

পিহু ছিকুকে বলল

‘ সোজা আম্মার ঘরে যান। পাপা এসেছে। যান।

ছিকু যেতে যেতে নাকমুখ কুঁচকে মুখ মোচড়ে বলল

‘ পিহু টাইগার কেন? লায়ন কেন? মাংকি কেন? মিহি গুড বয় কেন?

চলবে
বিয়ার জন্য প্রস্তুত হও বাপ।

(প্রত্যেক পর্ব পরে সংশোধন করা হয়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here