মন_গোপনের_কথা #পর্ব_৩৮

0
324

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৩৮
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা

হসপিটালের করিডোরে মাহিদকে দেখে লুকিয়ে পড়লো নিনিত। অন্যপথে হাঁটতেই নার্স এসে বলল, স্যার আপনাকে থ্রি থার্টি কেবিনে দরকার।

ইমার্জেন্সি?

জি স্যার।

একটু পরে গেলে হবেনা?

হ্যা আসতে পারেন কোনো সমস্যা নেই স্যার। তবে একটু কুইকলি আসলে ভালো হয়।

ওকে কিছুক্ষণ পরেই আসছি।

নার্স চলে গেল। যাওয়ার পথে মাহিদকে দেখলো। মাহিদ এদিকওদিক তাকাচ্ছে বারবার। আশেপাশে অনেক মানুষ। মাহিদের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো

আপনি স্যারের বন্ধু না? আইমিন ডক্টর নিনিত। স্যারকে খুঁজছেন?

মাহিদ কপালের ঘাম মুছে বলল

জি । ও কোথায়? অনেক্ক্ষণ ধরে খুঁজছি।

এইমাত্র ওদিকে গেল। একটু অপেক্ষা করুন। আমি ডেকে আনছি।

মাহিদ অপেক্ষা করলো। নিনিতের কাছে নার্স ধমক খেল।

আমার কথা বলতে কে বলেছে আপনাকে। বলে আসুন আমি এখন কারো সাথে দেখা করতে পারব না। ব্যস্ত আছি।

কিন্তু স্যার?

যেটা বলেছি সেটা করুন।

ওকে স্যার।

নার্স মাথা নামিয়ে চলে গেল। মাহিদকে গিয়ে বলল

স্যার বিজি আছেন। কারো সাথে দেখা করতে পারবেন না।

ওর চেম্বারে আছে এখন ?

আছে, না মানে নেই। স্যার পেশেন্ট…

মাহিদ আর কথা শুনলো না। নিজেই এগিয়ে গেল। নিনিত দরজার কাছাকাছিই দাঁড়ানো ছিল। মাহিদকে দেখে ঘড়ি দেখে ব্যস্ত পায়ে হাঁটতেই মাহিদ সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল

তোর সমস্যা কি? লুকায় আছিস কেন?

নিনিত তাকালোও না। জবাব ও দিল না। মাহিদ তার কাঁধ ধরে ঠেলা দিল। নিনিত এক পা পিছিয়ে গেল। মাহিদ বলল

তোকে কতবার ফোন দিছি! হিসাব আছে?

তোকে ফোন দিতে বলছে কে? কেন ফোন দিচ্ছিস? বিয়ের দাওয়াত দিতে? সে তো এমনিই যাব। আমার স্টুডেন্টের প্লাস বোনের বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে। যেতে তো হবে। তোর দাওয়াত দরকার নেই। জুতো মেরে গরু দান করতে এসেছিস? ফোন ও দিবিনা, সামনে ও আসবি না।

একশ বার আসবো। তুই ফোন ধরছিস না কেন সেটা আগে বল। আমি দোষ করছি ভালো কথা। তুই আমারে শাস্তি দিবি, মারবি, কাটবি। কিন্তু ফোন ধরছিস না কেন? আমারে কি ডিউটি দিছোস? ‌যে তোরে সারাক্ষণ ফোন দিতে থাকুম? দেখা করতে আসছি দেখা দিতেছোস না, কি হয়ছে তোর?

কিচ্ছু হয়নি। পথ ছাড়।

আমার প্রশ্নের উত্তর দে।

নিনিত মাহিদকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল

তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই আমি। সর।

মাহিদ পথ ছাড়লো না। উল্টো পরপর দুটো ঘুষি বসিয়ে দিল নিনিতের মুখে। নিনিত ছিটকে পড়লো। রাগে ক্রোধে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে মাহিদ। পেছন থেকে আদেশ বাণী আসলে ও শুনলো না কেউ। নিনিত ও থেমে নেই। মাহিদকে ঘুষি বসিয়ে বলল

গায়ে হাত তুলোস কেন? নিজে দোষ করবি আবার আমার গায়ে হাত তুলবি।

দুজনেই কথা বলতে বলতে মারামারিতে লেগে যাচ্ছে।

আদি আর পিহু দুজনেই এসে দুজনের কান্ড দেখে হতভম্ব। পিহু দৌড়ে এসে চেঁচিয়ে বলল

কি হচ্ছে এসব? এসব কি স্যার? মাহিদ ভাই তুমি এখানে কেন?

নিনিত শান্ত হয়ে গেল আদিকে দেখে। মাহিদ ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে আছে। নিনিত বলল

আমি ওকে বলেছি পথ ছাড়তে। ও পথ ছাড়লো না। আমি তো ওইদিনই বলে দিয়েছি কোনো বন্ধুটন্ধু নেই আমার। তারপর সামনে আসে কেন? দোষ তো করেছেই আবার গায়ে হাত তুলে।

পিহু মাহিদকে বলল

মারামারি করতে এসেছ এখানে?

মাহিদ গর্জে বলল

চুপ। তুই কি জানোস? ওরে আমি কতবার ফোন দিছি। একবার ও ফোন তুলেনাই। কাল শেষমেষ ব্লকে রাখলো । আমাকে কিছু বলার সুযোগ তো দিতে হবে। আমি এখানে আসছি দেখা করার জন্য, শালা আমাকে তারপর ও এড়িয়ে যায়। আমারে কি ডিউটি দিছে?

পিহু মাথায় হাত দিল। আদি কিছু না বলে চলে গেল। বন্ধু বন্ধুর মাঝে তার না যাওয়াটাই ভালো। আদি চলে যেতেই নিনিত ও চলে যাচ্ছিল। মাইশা,জালিশা আর নিশিতাকে দেখে থেমে গেল। নিশিতাকে বলল

তোরা এখানে কেন?

আমরা আজ একটু ঘুরতে যাব তাই ভাইয়া। নার্স বলল এদিকে নাকি তোমার আর মাহিদ ভাইয়ের ঝগড়া লেগেছে?

তন্মধ্যে পেছন থেকে পিহুকে বলতে থাকা মাহিদের গলার আওয়াজ ভেসে এল।

তুই এখানে কেন এলি? আমার ওর ঝামেলা হতেই পারে। তোরে এখানে আসতে কে বলছে?

তুমি আমার সাথে কেন এভাবে কথা বলছো? এখন সব দোষ আমার হয়ে গেল?

মাহিদ রাগে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছে চেহারায় তা স্পষ্ট। গর্জে বলল,

তুই তো তোর জামাইর পক্ষেই কথা বলবি অলওয়েজ। তোর যাহ তার কাছে।

সবাই হতভম্ব মাহিদের কথায়। পিহু ঢোক গিললো। বহুকষ্টে গলার আওয়াজ ছোট রেখে বলল

কি বললে?

মাহিদ কেমন করে তাকালো। তারপর নিজের বলা কথায় ভুল ধরতে চুপসে গেল। পিহু বলল

কি বলেছ?

বেশ বলছি। যা কি করার তুই কর।

পিহু নিজেকে বহুকষ্টে সামলালো। বলল

তোমার মতো বন্ধু কারো না হোক। প্রিয় মানুষ কারো না হোক। তুমি মানুষই না। বন্ধু অনেক দূরের কথা।

রাগে মাহিদের মেজাজ যেন তুঙ্গে। পিহুর গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল। পিহু আহ করে শব্দ করে উঠতেই জালিশা, মাইশা আর নিশিতা চমকে উঠলো। পিহু দেয়াল আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়েছে কোনোমতে। নিনিত গিয়ে উরুধুরা ঘুষি বসিয়ে দিয়ে বলল

আজকে মদ গাঁজা গিলছস তুই? পাগল হয়ে গেছস? ওকে কেন মারছি বেয়াদব। তোর রাগারাগি আমার সাথে।

নিশিতা বলল

কি করছ তোমরা? ভাইয়া আর না।

মাহিদ আর উল্টোফিরে নিনিতকে মারলো না। নিনিত মারলো আর সে চুপচাপ মাইর খেল৷ মাইশা পিহুকে গিয়ে ধরলো। বলল

পানি খাবে? চলো।

পিহু ফুঁপিয়ে উঠলো। কাঁদতে লাগলো।
জালিশা বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে। নিশিতা নিনিতকে সরিয়ে ফেলল। মাহিদকে বলল

মাহিদ ভাই কেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছ? কি শুরু করেছ তোমরা? এগুলো শিক্ষিত মানুষের কাজ না। ছিঃ।

নার্স ও আর ও কয়েকজনকে চলে যেতে বলল নিশিতা। শেষমেশ নিনিতকে বলল

তুমি ও তো কম না কিছুতে। এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন?

নিনিত মাহিদকে বলল

হুটহাট গায়ে হাত তোলার আগে ভেবে নিস কার গায়ে হাত তুলছিস। ও তোর,,

আরেহ ঢং করিস না। ও আমার কেউটেউ না। যা সব সব তোর। তোর মাথা নড়ে যাওয়ার কারণ ও এইবার স্পষ্ট আমার কাছে। আমি কি বাচ্চাছেলে যে কিছুই বুঝিনা।

নিনিতের চক্ষু শীতল। অতিরিক্ত বিস্ময়ে যা হয়। এই মাহিদকে সে চেনেনা। নিশিতা বলল

এসব কি বলছ মাহিদ ভাই?

পিহু কান্না থামিয়ে চেয়ে আছে। মাহিদ বলল

ঠিকই বলছি।

তারপর পিহুর হাত ধরে টেনে তুললো। নিনিতের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল

দুজনের সমস্যা আমি। বুঝতে পারছি এইবার। সমস্যা এখানেই সমাধান।

নিনিত হা করে চেয়ে থাকলো। মাহিদ বলল

যাহ তোর জিনিস তোরে দিয়া দিছি। এইবার তো আমার উপর রেগে থাকবিনা। ভাইরে ভাই মুখে বলে দিলেই তো হয়। আমার উপর রাগ দেখালেই কি আমি বুঝুম নাকি?

নিশিতা বলল

মাহিদ ভাই তুমি,,

মাহিদ আর এক মুহূর্ত ও না দাঁড়িয়ে চলে গেল। নিনিত কপালে হাত দিয়ে ঘাম মুছলো। তারপর চললো। নিনিত চলে যেতেই মাইশা পিহর কাছে ছুটে এল। বলল

পিহু শোনো আমরা ঘুরতে যাই চলো। মন ভালো হয়ে যাবে। তুমি এসব কানে তুলো না। মিঃ মাহিদ রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কথা বলছে।

_____________

মাহিদকে এলোমেলো আর মুখ, ঠোঁট ফোলা অবস্থায় বাড়ি ফিরতে দেখে নীরা অবাক। শুকিয়ে আসা অংশটা আবার ও ছিঁড়ে গিয়েছে। রক্ত জমে আছে। চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা। তাকানো যাচ্ছেনা। নীরা ছুটে এল।

‘ কি হয়ছে রে আব্বা? তোর এই অবস্থা কেন?

মাহিদ উত্তর দিল না। চলে গেল ঘরে। নাজিয়া বানু বলল, ওর কি হলো রে নীরু ?

জানিনা মা৷

মাহিদের ঘরে বিকট শব্দ হতেই মুনা আর নীরা ছুটলো একসাথে। দেখলো মাহিদের রুমের ছন্নছাড়া অবস্থা। ক্রিকেট ব্যাডটা দরজার কাছে পড়ে রয়েছে।
নীরা মুনার চোখ কপালে। পিহুর জন্য কেনা বিয়ের লাল বেনারসিটি পড়ে আছে মেঝেতে। সব বিয়ের বাজার ও।
নীরা বলল

এই মাহি এগুলো কি করলি? এগুলো পিহুর।

এগুলোর জায়গা আমার ঘরে না। যার ঘরে থাকার কথা তার বাড়িতে পাঠাও। খবরদার বিয়ে টিয়ের নাম ধরবেনা কেউ। এসব নিয়ে যাও নইলে আগুন লাগিয়ে দেব এক্ষুনি।

নীরা ছুটে গেল।

তোর এই অবস্থা কেন রে? কি হয়ছে? পিহুর সাথে ঝামেলা হয়ছে? তোর আব্বা শুনলে শেষ। এমন করিস না। আমাকে খুলে বল। মাথা ঠান্ডা কর। মাহি। কাল তোদের মেহেদী।

মেহেদির গুষ্ঠিরে কিলাই। বললাম না বিয়ার কথা আর তুলবানা। এসব সরাও চোখের সামনে থেকে। বিরক্ত লাগতেছে।

মুনা সবগুলো তুলে নিয়ে বলল

কি আশ্চর্য দেখছিস? এগুলো কোনো কথা?

নীরা তাকে শান্ত করাতে পারলো না। তাই কাছে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বলল

‘ মাহি আমাকে বল। আমাকে বল না কি হয়ছে। আমি সব সমাধান করে দেব। বল।

মাহিদ নীরার দিকে তাকালো এবার। বলল

‘ পরশু মেহেদি টেহেদী এসব হবেনা। আমি এই বিয়ে করব না। কাল পরশু আমার ম্যাচ আছে।

সবার চোখেমুখে দ্বিগুণ বিস্ময়। নীরা বলল

এই জিনিসগুলো নিজেই পছন্দ করে কিনেছিস মাহি। এগুলো ফেলতে পারলি কি করে? তোর বুক কাঁপলো না? এগুলো একটা মেয়ের কাছে কি তুই জানিস? তুই এমন কেন রে?

আহ! বেশি কথা শুনতে ইচ্ছে করছেনা। আমাকে একা থাকতে দাও। তোমরা যাও।

কেউ আর কিচ্ছু বলল না। মুনা বলল, নীরুকে ফোন দে।

____

নীরার ফোন পেয়ে পিহু খানিকক্ষণ থম মেরে বসে থাকলো। সামনেই বসা ছিকু। মাথা নিচু করে খাতায় কলম চালাচ্ছে এলোমেলো। ফোন তুলে কানে দিতেই নীরা ও চুপ করে থাকলো। পিহু ও কথা বলল না। নীরা অনেক্ক্ষণ পরে বলল

তোমাদের কি হয়েছে আম্মা? সব কি ঠিক আছে?

কিচ্ছু ঠিক নেই। মাহিদ ভাইকে জিজ্ঞেস কর।

কি বলছে বলো না?

আমাকে যা নয় তা বলেছে স্যারের সাথে জড়িয়ে। ওরকম মানুষের সাথে আমি থাকতে পারব না। এসব বিয়ে বিয়ে থামিয়ে দাও মামি।

এসব অলক্ষুণে কথা কেন বলো? ও মাথা গরম থাকলে কি বলে ফেলে নিজেও জানেনা। ওর কথায় কেঁদো না। এমন করো না। এরকম করলে কি করে চলবে? তোমার মামা শুনলে মেরেই ফেলবে ওকে।

পিহু ফোঁপাতে থাকলো। ছিকু কলম চলা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো

পিহু কাঁদে কেন? পিহুকে চবাই মারে কেন?

পিহু কান্না থামিয়ে ফোনটা রেখে দিল।

________________

মুখ গোমড়া করে বারান্দায় বসেছিল নিনিত। হসপিটালের ব্যাপারটা মাথা থেকে সরছেনা। কি বিশ্রী একটা ব্যাপার ঘটে গেল। মাহিদটা কি আসলে মানুষ? পুরো সাইকোর মতো হয়ে গেছে। মাথা ব্যাথা তরতর করে বাড়ছে তার। সামনে একটা মেয়েমানুষের ছায়া পড়তে দেখে চোখ তুলে তাকালো নিনিত। জালিশাকে দেখে বলল

তুমি? মা কিছু বলেছে?

আপনি ব্যাথার ঔষধ নিয়েছেন কিনা জিজ্ঞেস করছে। নিয়েছেন?

নিনিত উত্তর দিল না। এই সামান্য ব্যাথার জন্য ঔষধ লাগেনা। তার মাথায় যন্ত্রণা করছে বেশি।

মাথা চেপে ধরে বলল

মাহিদ আজকে পাগলের মতো বিহেভ করেছে। আমি ওর এমন রূপ কখনো দেখিনি।

আপনি ওনাকে বেশি মেরেছেন। ওদিন ও মেরেছেন।

নিনিত জালিশার দিকে ফিরলো। বলল

তো আমি কি করতাম জালিশা? ও কি করলো দেখোনি? আর শেষে কি বললো।

ঠিকই বলেছে।

নিনিত জালিশার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালো।

তুমি ও ওর পক্ষ নিচ্ছ? আমি আরিশাকে,,

অস্বীকার করছেন কেন? আপনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে আপনি আরিশাকে চাননি? মাহিদ ভাইয়ের বদলে যদি অন্য কেউ হতো তখন ছাড় দিতেন? বন্ধু তাই সেক্রিফাইজ করছেন না তো? আপনার চাইতে আপনার বন্ধু অনেক চালাক ডক্টর।

মিথ্যে।

এটাই সত্যি। কেন অস্বীকার করছেন?

নিনিত দাঁতে দাঁত চেপে বলল

শাটআপ জালিশা। মুখ বন্ধ করো।

করব না মুখ বন্ধ। আমি বলব। বলে যাব। আপনি পিহুকে চেয়েছিলেন। ওর জন্য আপনার মনে একটা সফট কর্ণার অবশ্যই ছিল, আছে। হয়ত থাকবে। আর বেশ কিছুদিন গেলে আপনি ওকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলতেন৷ হয়ত এখনো বাসেন৷ কিন্তু স্বীকার করছেন না৷

ও শুধু আমার স্টুডেন্ট। জাস্ট স্টুডেন্ট। অন্য কিছু না৷ স্টপ জালিশা।

আমি স্টপ হলেও সত্যিটা সত্যিই। আপনার মনে অবশ্যই পিহু আছে নইলে রাগ আসতো না। আপনি অস্বীকার করবেন না।

নিনিত জালিশাকে চুপ করানোর জন্য হাত চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল

‘ ওরা একে অপরকে চাই। আমি সেখানে আগাছা হতে চাই না। তুমি এসব ফালতু কথা বলবে না জালিশা। যা বললে সব মিথ্যে।

না চাইলে আপনি নিশ্চয়ই চাইতেন।

নিনিত বিরক্ত হয়ে জালিশার হাত ঝেড়ে ফেলে বলল

সেই এক কথা। তুমি আমাকে স্বস্তি দাও প্লিজ৷ ফালতু কথা না বলে, বলো আমি কি করব এখন? আমি আমার জন্য ওদের মধ্যে ঝামেলা চাইনা। ভাবতেই নিজের উপর রাগ লাগছে। আমার ওর কথা শোনা উচিত ছিল।
হয়ত আরিশার জন্য কিছু একটা ছিল আমার মনে, কিন্তু সেটা মাহিদের থেকে বেশি নয়। মাহিদ যেটা ভাবছে সেটা তার মনের ভুল। ও আরিশাকে নিয়ে দ্বিধায় থাকে। তাই ওর রাগ হচ্ছে। ও সম্পূর্ণ ভুল বুঝলো আমাকে।
ও আমার কারণেই মনের কথা শেয়ার করতে পারেনি। সব দোষ আমার।
আজকের ঘটনায় আরিশা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। আমি জানিনা ও কি সিদ্ধান্ত নেবে। আমার মাহিদের কথা শোনা উচিত ছিল। আজকে যা হয়েছে সব আমার কারণে। কেন যে রাগারাগি করতে গেলাম৷

____________

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল পিহুর । ছিকুর কান্নায়। পিহুর সাথে থাকবে বলেছে। তাই পিহু তাকে রেখেছে। এখন মায়ের জন্য কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ জোরে হওয়ায় পিহু উঠে কোলে তুলে নিল। পরীর ঘরের সামনে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে পরীকে ডাকলো। পরী দরজা খুলে ছিকুকে কোলে নিয়ে বলল

বলেছিলাম না রাখতে। এখনো ঘুম ভেঙে দিল তো?

থাক। সমস্যা না। ওকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আসছি।

হ্যা যাও। ঘুমিয়ে পড়ো। তোমার চোখ ফুলেছে কেন?

ঘুম থেকে উঠেছি তাই হয়ত।

পিহু ঘরে চলে এল। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ার সময় ফোনের স্ক্রিনে একটি ছবি দেখা গেল। ছিকু বোধহয় দেখছিল। পিহু ছবিটির দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না। তবে ফোনের স্ক্রিন কেঁপে উঠতেই বুক ভার হয়ে আসলো। ঘড়িতে কাঁটা তখন দেড়টার ঘরে। ফোন রিসিভ করলো না সে। শুয়ে পড়তেই আবারও বেজে উঠলো ফোন। পিহু কান চাপা দিল বালিশ দিয়ে। ফোন বাজতেই আছে। শেষমেষ ফোন তুলে কানে দিল। জেদের বশে একটা কথা ও বলল না। একটা শব্দ ও না৷ আশ্চর্যজনক হলেও ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ এল না৷ পিহু শেষমেশ বলল

‘ অন্যের বউকে এতরাতে ফোন দিয়েছ কেন? কি চায় তোমার? আমাকে মানসিকভাবে আর কত অত্যাচার করবে৷ কোনো সম্পর্কের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা নেই, সম্মান নেই মাহিদ ভাই। তুমি একটা আজব প্রাণী। আর আমি ও আর ও বেশি আজব কারণ দুনিয়াতে এতগুলো মানুষ থাকতে আমি তোমার মতো একটা মানুষকে ভালোবাসতে গিয়েছি। যার প্রতিদান তুমি আমাকে রোজ রোজ দিচ্ছ। তোমার বাড়িতে যেতে এখন আমার ভয় লাগছে। বিয়ে শব্দটা ভয় লাগছে। আমাকে একটু দয়া করো মাহিদ ভাই। এই বিয়েবিয়ে শব্দগুলো যাতে আর শুনতে না হয় এমন একটা ব্যবস্থা করো। আমি তোমাকে ভালোবেসে ভীষণ রকম পস্তাচ্ছি। তোমাকে ভালোবাসা একদম উচিত হয়নি। তুমি আমাকে ভালোবাসতে জানোনা। তুমি ভালোবাসতে শিখোনি এখনো। তোমাকে আমার চাই না চাই না মাহিদ ভাই ৷

মাহিদ যা বলার ছিল তা না বলে বলল,

ভালো কথা৷ সব মানলাম। সব দোষ আমার আমি জানি। আমি মহাঅপরাধী সেটা ও জানি৷ তোকে বলতে হবেনা। তুই একটা কাজ কর, আমার বাড়ি আয়। বাড়ির সবাইরে সেটা বুঝিয়ে বল। তোরে ও আমার পক্ষে বিয়া করা সম্ভব না৷ তোরে আমি ভালোবাসিনা। তোর লগে থাকা সম্ভব না। আয় আমারে মুক্তি দে।

পিহু কান্নার বাঁধ ছেড়ে দিল৷ কান্নার আওয়াজ ক্রমশ বড় হচ্ছে। কাঁদার জন্য কথা আটকে আসছে।

তাহলে এতদিন অভিনয় কেন করলে? সব অভিনয় ছিল তোমার?

হ অভিনয় ছিল। তোরে শুধুশুধু ভালাবাসতে যামু ক্যান? আমার কি খায়দায় আর কাজ কাম নাই? তোর চাইসে ও সরস বেডি আমার পেছনে পইড়া আছে। যাহ।

পিহু দম বন্ধ রেখে বলল

‘ ঠিক আছে। আসছি কাল।

সকাল সকাল মেডিক্যালে যাওয়ার নাম করে খান বাড়িতে গিয়েছে পিহু। বাড়িতে ঢুকতেই মাহিদকে দেখতে পেল সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায়। পিহু রান্নাঘরে চলে গেল। মুনা রান্না করছে। মুনার সাথে কথা বলে নীরার কাছে চলে গেল সে। নীরা মাহিদের ঘরে জিনিস গোছাচ্ছে।
নাজিয়া বানু বললেন, ওমা বউ চলে আসছে আজকে।
নীরা তাকে দেখে চমকালো। বলল

‘ আম্মা তুমি মা জানাইয়া আসলা হঠাৎ?
আসো একটু জড়ায় ধরি।

পিহু ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। নীরা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল

‘ কি হয়ছে? আমারে বলবা তো। ওমা কাঁদো কেন? পিহু?

আমি তোমার ছেলেকে মুক্তি দিতে এসেছি মামি। আর কখনো আসবো না এই বাড়িতে। তোমার ছেলে বলেছে আয় আমাকে মুক্তি দিয়ে যাহ। আমার ও মুক্তি চাই। আমি থাকতে পারব না তোমার ছেলের সাথে।

নীরার এমন রাগ উঠলো। তাও যথাসম্ভব চেপে রেখে পিহুর গাল মুছে দিতে দিতে বলল

তুমি ওর মুখের কথা বিশ্বাস করতেছ? ও বেয়াদব তো। মহা বেয়াদব। বেয়াদবরে আমি কাল গালে ঠাস ঠাস দিছি। এমনিতে তো নাকমুখ ফাটায় আসছে, তারউপর আমি ও দিছি। এমন জ্বর উঠছে রাতে আমারে আর ওর আপারে ঘুমাতে দেয় নাই।
তোমার মামা জানলে তো আস্ত রাখতো না। দুদিন পর বাচ্চার বাপ হবে এখনো বাপের হাতে মার খায় লজ্জা শরম নাই তো। একদম নাই। তুমি ওর কথায় চলে আসছো? কাল রাতে তোমারে ফোন দিছিলো? আমি ফোন দিতে বলছিলাম। দিছিলো?

হ্যা। ফোন দিয়ে বলছে আজ এসে সবাইকে বলতে আমাকে বিয়ে করা সম্ভব না। আমার দ্বারা ও সম্ভব না।

নীরা বলল

দাঁড়াও।

বলেই চলে গেল। মাহিদকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল। কেউ কারো দিকে তাকালো না। নীরা মাহিদকে টেনে এনে পিহুর সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। হাতের উপর হাত রেখে মিলিয়ে দিয়ে বলল

দেখ তো কত সুন্দর! আমি এই ঘরটা কার জন্য সাজাইছি এত সুন্দর কইরা? তোমার জন্য আম্মা। তুমিই থাকবা এই ঘরে। এই বাড়ির গিন্নি হবা তুমি। এই সংসার তোমার। ঘরটা তোমার, ঘরের মানুষটা ও তোমার। তোমার লগে মশকরা করলে, তোমারে কষ্ট দিলে তুমি উল্টো কষ্ট দিবা, কাঁদবা কেন? তুমি ও টাইট দিয়ে দিবা। বুঝছো?

মাহিদ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। হাত নিয়ে নিতেই নীরা হাত দুটো চেপে ধরে রাখলো। অসহায় চোখে তাকালো দুজনের দিকে। বলল

‘ শক্ত করে ধরতো দেখি। দুজনই ধর। দেখি কে কতক্ষণ ধরে রাখতে পারে। কে বেশি সেরা? কি দরকার এত ঝগড়াঝাটির? কিছুক্ষণ দুজন কথা বল। মিটিয়ে নে হ্যা? নিজেদের ঝামেলা নিজেদের মেটাতে হয়৷ হাতটা কিন্তু কেউ ছাড়বি না খবরদার। একটু কথা বল৷ আমি যাই৷

নীরা বের হয়ে গেল৷ দরজার কাছে গিয়ে বলল

কথা বলো হ্যা। মিটিয়ে নাও সব৷ আর কোনো ঝামেলা চাই না আমি।

দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল নীরা।

সে চলে যেতেই হাত দুটো নড়তে চড়তে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে আলাদা হলো।
পিহু হাতটা বাড়িয়ে রাখলো৷ মাহিদ আঁড়চোখে তাকালো হাতটার দিকে। অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করছে একটা রিং। পিহু সেটি খুলে নিল। ব্যাগ থেকে সাদা ড্রেসটি বের করে সেটির উপর রিংটি রাখলো। তারপর মাহিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

নাও মুক্তি। মুক্তি চেয়েছ না? এবার খুশি?

মাহিদের কাঠের পুতুলের মতো চেয়ে আছে। পিহু বলল, ও হ্যা আরেকটা জিনিস আছে।

ব্যাগ থেকে একটা মলমের কৌটা বের করলো। মাহিদের হাত তুলে হাতের উপর দিয়ে বলল

আমার জন্য কাল মার খেয়েছ তাই এটা দিলাম। লাগিয়ে নিও। জ্বালা কমবে, ব্যাথা কমবে। আসি।

মাহিদ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো। মীরা পিহুকে আসতে দেখে ছুটে গেল।

কথা বলছ? ঝামেলা মিটমাট করছ?

পিহু উত্তর দিল না।

নীরা মাহিদের কাছে ছুটলো। গিয়ে বলল

কথা বলোস নাই? ওরে কিছু বলোস নাই গর্দভ?

সব দিয়ে দিছে।

কি?

মাহিদ খাটে রাখা ড্রেসটা দেখিয়ে দিল।

ওটা তুই দিছিলি?

মাহিদ উত্তর দিল না।

নীরা গর্জে বলল

ভালা হয়ছে। তোর সাথে এরকমই হওয়া উচিত ছিল। এখন কষ্ট লাগতেছে? যাহ এবার যা করার কর।

তুমি আটকাও।

আমি? আমি কেনে আটকাবো? কেন আটকাবো? আমি আইজ ওরে আটকাবো। কাল তুই আবার ওরে কষ্ট দিবি। আমার মুখ থাকবো ওর সামনে? আমি ওরে আটকাবো না বরং আমি ওর পক্ষে। তুই যাহ করার কর। আমি আজ ইশু আর ডাক্তাররে ফোন দিয়ে জানায় দিবো সব। পিহুর মতো মেয়ে তোর চাইতে ভালা কাউরে ডিজার্ভ করে। তোরে না। আমি আর ওরে আটকামু না। যা তুই যা করার কর। তোরে অনেক সুযোগ দিছি।

নীরা চলে গেল। মাহিদ জোরে করে ডাকলো

মা আমি আর কিছু করব না।

তোর বিশ্বাস নাই।

নীরা সোজা চলে গেল। পিহুর কাছে গেল। বলল, থাকো খাওয়া দাওয়া করে যেও।

সরি মামি। আমি বাসায় চলে যাব। মেডিক্যালে যাচ্ছিনা আজ। কিছু খাব না।

নাজিয়া বানু বলল

ও পিচ্চি আমার নাতির লগে রাগ করছোস? বিয়া কি মুখের কথা! তোর বাপ শ্বশুর জেঠারা মিলে কত কি করছে এই বিয়ে নিয়ে। আর তুই বিয়ে করবি না? এটা কোনো কথা? পরশু তোদের মেহেদী রাত।

তাতে কি হয়েছে নানু? আমার ভালো থাকার চাইতে ও এসব আয়োজন বড় হতে পারেনা কখনোই। আমি কার সাথে ভালো থাকবো সলই সিদ্ধান্ত আমি নিতেই পারি। এবং নিয়েছি ও। আমি আসছি।

নীরা কত জোর করলো। এক মুহূর্ত ও আর দাঁড়ালো না পিহু।
বাড়িতে গিয়ে ইশাকে আদিকে পইপই করে বলল সে এই বিয়ে করবে না। আদি ইশা অবাক হলেও তার কথার খুব পাত্তা দিল এমনটা না। নীরা তাদের সব বুঝিয়ে বলেছে।

নিনিত ও এসেছিল খান বাড়িতে। রিপ নীরার সাথে কথা বলে চলে গেল। মাহিদের সাথে বললো না।

রিপ সব শুনে মাহিদের উপর চটে গিয়েছে। নীরা বলল, ও বলছে আর কোনোদিন ঝামেলা করবে না। মাফ করে দিন। আমি অনেক মারছি, বকছি সেদিন। সত্যি।

ওয়াদা করতে বলো আমার সাথে। নইলে বিয়ে হবে না। পিহু যা বলো তাই হবে। দরকার নেই এসবের।

নীরা মাহিদকে বলল

‘ বল আর কখনো করবি না।

রিপ বলল

‘ জীবনে আর কখনো ওর গায়ে হাত তুলবি?

মাহিদ নীরার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
নীরা বলল

না বল। ওমা!

মাহিদ মাথা নাড়লো।

আর কখনো ওর সাথে কঠোর হয়ে কথা বলবি?

না।

আর কখনো ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করবি?

না।

কথাগুলো যেন মনে থাকে। নইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবেনা। আমি ওকে অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি। তারপর ও ওর মুখে হাসি দেখতে পাইনি আমি। সাবধান! ওর সামনে আমার মুখ যেন থাকে।

মাহিদ মাথা নাড়লো।

মাহিদের ফোনে ছিকু ফোন দিল পরীর ফোন থেকে। মাহিদ ফোন তুলতেই ছিকু বলল

পিহু মিহির বিয়ে কেন? পিহু মিহির বুউ কেন?

তো কি হয়ছে? ফোন কেন দিছোস?

ছিকুর বুউ নাই কেন? মিহির বুউ আচে কেন?

চলবে,
একটু জগাখিচুরি লিখলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here