#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১০
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
নোরাহ আর অধীরের বিয়েটা খুবই সাদামাটা ভাবে মিটলো। অধীরের বাবা মামা ফুপারা বিয়ে পড়ানোর সময় উপস্থিত ছিলেন না। নোরাদের আত্নীস্বজনে ভর্তি ছিল বিয়ের আসর।
এ নিয়ে আমজাদ কবিরের নটখটের শেষ নেই। উনি ক্রোধের আগুনে হনহন করে জ্বলতে জ্বলতে বারবার পায়চারি করছিল এদিকওদিক। পরিস্থিতি সামাল দেবেন নাকি নিজেকে সামলাবেন তা নিয়ে দোটানায় পড়ে গিয়েছিলেন। পরে আশরাফের কথা অনুযায়ী চুপ করে যা হচ্ছে তা হতে দিলেন।
এমন অপমান উনাকে কেউ করার সাহস পায়নি আজ অব্দি। বরাবরের মতো ক্ষমতা আর অর্থের দিক দিয়ে উনি উনার শত্রুপক্ষকে টেক্কা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজকের এই ঘটনায় নিজের মেয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকায় উনি কিছুই করার সাহস করে উঠতে পারলেন না। নইলে ওই দুই পরিবারের মানুষকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে দু’মিনিটও নিতেন উনি।
বিয়ে পড়ানোর সময় তানজীব আর রাহান পেছনে দাঁড়িয়েছিল সাক্ষী হিসেবে। বাদবাকি সময় তানজীব ওইখানে উপস্থিত ছিল না। ও-ই চেয়ারম্যান আর তার বড়ভাইয়ের আড়দৃষ্টি যে তার উপরেই ছিল সেটা প্রখর মস্তিষ্ক বুঝে গিয়েছিল। সেও সমান প্রতাপে তাকাতেই চটজলদি চোখ সরিয়ে নিয়েছিল তারা। ছেলেটা একদম বাপের মতো হয়েছে। সেই ডহর অন্তর্ভেদী চোখ দুটো। চোখে পড়লেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। যেন ভেতরটা পড়ে ফেলে। গোঁয়ার্তুমি স্বভাবও কি আছে নাকি বাপের মতো? তাহলে তো ম*র*তে হবে। ওসব অতি ডাঁটিয়াল মানুষের জন্য দুনিয়া বেশিদিনের নয়।
বিয়ে পড়ানো শেষে নোরাকে অধীরের হাতে তুলে দেওয়ার সময় আমজাদ কবির বেশ পাকাপোক্ত শর্ত উত্থাপন করলেন।
বাবা আমার মেয়েদের গায়ে আমি ফুলের আঁচড়ও লাগতে দেয়নি। খুব আদরে যত্নে বড় করেছি। যত শত্রু বিবাদ সব আমাদের সাথে। আমার মেয়েকে যাতে না জড়ায় তোমার পরিবার। এতে আমি শান্ত হয়ে বসে থাকব না। চুপচাপ থাকার লোক আমি নই।
যেন শীতল গলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে দিলেন তিনি। রাহা আর আশরাফ একে অপরের দিকে চাইলো।
আব্বার শেষের কথাটা বলার কি দরকার ছিল? মানুষটা আজও শোধরালো না। আশরাফ পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল
আব্বা থাক।
উনি থামলেন না। অধীরের মাকে বললেন
বেয়াইন একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না। ঘরে ছেলের বউ আমারও আছে। ওকে কখনো আমার দু মেয়ের থেকে আদর মহব্বত কম করিনা। গালভরে আব্বা আমাকে এমনি ডাকেনা। আশা করি আমার মেয়েকে খোঁচাখুঁচি করবেন না। আমার মেয়ে যথেষ্ট ভদ্র অমায়িক। আপনার ঠোঁট ঠোঁটে তর্ক করবেনা ঠিকই। কিন্তু একবার খারাপ ভাবনা চলে এলে আপনাকে উপরে মা ডাকবে ঠিকই কিন্তু সম্মান করবেনা। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। সোজাসাপটা কথা বলে ফেলি বিধায় অনেকের শত্রু হয়ে যায়। কিন্তু আমি কোনোটাই ভুল বলিনা। আমার মেয়েটাকে দেখে রাখবেন। যত গালাগালি করার আমাদের করেন সমস্যা নাই। কিন্তু আমার মেয়েকে ওসব কথা বলে কষ্ট দেবেন না। বেয়াই সাহেব তো এদিকে এল না। থাক উনি উনার বন্ধুদের কুপরামর্শ নিয়ে। সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে নরক বাস কথাটা আমি আপনি সবাই জানি। আপনি একটু উনাকে সঠিক পরামর্শ দেবেন।
অধীর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শ্বশুর মশাইকে দেখে যাচ্ছিল। আর কথাগুলো শুনছিল। ভেতরকার কথা বলতে উনি ভয় পাননা এটা যেমন তাকে মুগ্ধ করেছিল ঠিক তেমনি বাজে লেগেছিল শেখাওয়াত আঙ্কেলদের অসৎ বলায়। মানুষটাকে নিয়ে ভারী দোটানায় পড়ে গেল সে। তবে এটুকু বুঝেছে মানুষটা যতই দাম্ভিক হোক, মেয়েগুলো উনার দুর্বলতা।
রাজিয়া বেগমও এসে মেয়ে জামাইর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে মেয়েকে হাতে তুলে দিলেন অশ্রু বিসর্জন দিয়ে। ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢাকা পড়া বধূটিও কান্নার চোটে কেঁপে কেঁপে উঠলো। যখন শক্ত একটা হাত তার হাতটা চেপে ধরলো ভরসা দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে তখন কমতে লাগলো কান্নার গতি।
________________
নোরাকে কোলে করে এনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছে আশরাফ। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে গাল মুছে দিতে দিতে বলল
তোর বর তো তোর সাথে আছে। আর কি লাগে? কারো কথা কানে নিস না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে বনু।
নোরাহ ফুঁপিয়ে উঠে নিজেকে সামলে বলল
মিনা আর তানজীব ভাইকে দেখেছ?
হ্যা দেখেছি।
তোমার মধ্যে কোনো বিকার নেই কেন তাহলে?
তো কি করব? ওদের সাথে কি আমাদের সেই আগের মতো সম্পর্ক আছে? ওরা আমাদের কোন চোখে দেখে সেটা জানিস না।
কিন্তু মিনা আমায় জড়িয়ে ধরেছিল?
আর এসেছে?
না একবারও তো আর সামনে আসেনি।
তোকে জড়িয়ে ধরেছে ওটা ওদের পরিবার দেখলে খবর হয়ে যাবে। ওসব কথা বাদ দে। কান্না বন্ধ কর।
রাহাকে ডেকে দাও।
রাহা পাশেই ছিল। আশরাফ ডাকতেই সে চলে ছুটে এল। বোনের ভেজা কপোল মুছে দিয়ে সে বলল
তুই কাঁদলে আমার তো খারাপ লাগে আপা।
সবাইকে দেখে রাখিস হ্যা। নাইরাকে দেখে রাখিস। আর আব্বা আম্মাকেও দেখিস।
সবাইকে দেখব। তোকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। ওই বাড়িতে খুব বেশি চুপ থাকিস না । জিজুর ফুপীগুলো খুবই বজ্জাত। আমার মোটেও ভালো লাগেনি। তুই যদি বোকা হয়ে থাকিস তাহলে তোকে সারাক্ষণ কথা শোনাবে।
আচ্ছা আচ্ছা আমার দাদীমা।
রাহা এবার কান্নাচোখে হাসলো। নোরাহ বলল
ওহ হ্যা দাদীকেও দেখে রাখিস। সাজঘরে এখনো ঘুমোচ্ছে। শরীর বোধহয় বেশি খারাপ লাগছে না?
বয়স হয়েছে। এখন সবসময় শরীর খারাপ থাকবে। আমি আছি। তুই চিন্তা করিস না তো। পৌঁছামাত্রই ফোন দিবি।
আচ্ছা। নোরা চোখ দূরে গিয়ে আটকে গেল । তানজীবকে দেখতেই বুকটা ভার হয়ে এল। এত বেদনা সয়েও মানুষটা আড়ালে আড়ালে একটা টুঁশব্দও না করে কেমন যেন আজ বন্ধুত্বের দায়িত্ব কর্তব্যগুলো পালন করে গেল । অধীর সাহেবের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে এই বন্ধুটির বিরাট অবদান।
ওই দেখ, তোর আর্মি অফিসার।
রাহা সাথে সাথে ঘাড় ঘুরালো। হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো প্রায় লোকটাকে এদিকেই তাকিয়ে থাকতে দেখে। ঠোঁটের সাথে ঠোঁট এঁটে মুখের ভেতর কি যেন চিবোচ্ছেন উনি। রাহা সাথে সাথে নোরার দিকে ফিরে গেল আবার। নোরাহ বলল
তোর সাথে কি কথা হয়েছে?
রাহা চোখ পাকিয়ে চাইলো। মায়া মায়া গলায় বলল
এই লোকটাই তো গাড়ি নিয়ে দৌড় দিয়েছিল।
এ্যাহ? কি বলিস?
হ্যা।
তারমানে কথা বলেছে?
ধুরর জানিনা। কথা বললেই কি না বললেও কি?
এমা কি বলিস? বল না। কথা বলেছে? এই দেখ দেখ মিনাও এসেছে। পাশেরজন ডাক্তার। মিনার বর। আমাকে সানজু মেয়েটা বলেছে।
রাহা ঘাড় ফিরিয়ে জানতে চাইলো
বিয়েও হয়ে গেছে?
হ্যা।
ওদের খুব মানিয়েছে না আপা। তুই আর জিজু যেমন। একদম রাজযোটক।
নোরাহ লজ্জিত হয়ে বলল
এ্যাহ কচু।
_______________
আনতারা বেগম নোরার পাশে বসলেন। অধীর নোরার অপরপাশে বসলো। মা ছেলের মধ্যে কোনো কথা হলো না। শ্বশুরের কথায় মা যে কষ্ট পেয়েছে সেটা বুঝে গিয়েছে অধীর। কিন্তু এখন আপাতত কিছুই করার নেই। নোরাকে ঘরে তুলতেই হবে। এটাই মূল কাজ।
রাহার পাশ কেটে তানজীব অধীরের গাড়ির কাছাকাছি গেল । মাথা নিচু করে কাচ বরাবর মুখ নিয়ে গিয়ে বলল
আঙ্কেলকে ডাকিসনি কেন? তোর কি বোধবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে?
আরেহ উনি আসবেন না। ভাইয়াকে ডেকে দে। রিজুকেও নিয়ে আসুক। ড্রাইভার আঙ্কেলের পাশে বসতে পারবে। আব্বাকে তোর চাচ্চুদের সাথে গাড়িতে তুলে দে।
তানজীব কটমট করে তাকালো। তারপর যাওয়ার সময় শাড়ি পরিহিত মেয়েটিকে বাম পাশের কাঁধ গলে পড়া ওড়নার কোণা মুচলেকা করতে দেখে থেমে গেল।
আম্ভরিক কন্ঠে ঝড় তুলে ডাকলেন….
মিস কবির!
রাহা অসিতবরণ চোখ তুলে তাকালো।
আপনাকে কিছু কথা বলা দরকার। আপনার চেয়ারম্যান আব্বাকে দয়া করে বলে দেবেন এ কথা। করিমউল্লাহ তথা আহম্মেদ কুদ্দুসের দ্বিতীয় ছেলেকে বাজারের মাথায় হাত পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখার আদেশ দিয়েছে আপনার আব্বা। উনাকে সতর্ক করবেন। আহম্মেদ কুদ্দুস অফিসার তৌহিদ তাহমিদের বিশ্বস্ত খাদিম ছিলেন।
সো, ওরকম জঘন্য খবর আমার কানে আসলে ওখানকার প্রশাসন আপনার আব্বার চেয়ার টেনে নেবেন। তখন উনি জাস্ট ম্যান থাকবেন। নট এ চেয়ার ম্যান।
সেকথা বলামাত্রই থম ধরা মুখে তিনি চাইলেন রাহার দিকে। রাহা হতবাক হয়ে তাকালো। একদম চোখাচোখি চাইতে পারলো না।
কবির চেয়ারম্যান এর চাইতেও জঘন্য কাজ করে মিঃ তাহমিদ। তখন কোথায় থাকেন আপনি?
খুবই সোজা প্রশ্ন, তবে দুস্তোষ্য।
তানজীব অন্য দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে হাসলো কেমন তুচ্ছ করে। এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর উনি চট করেই দিয়ে দিলেন।
আমি থাকি মিস কবির। যাদের চোখ আছে তারাই শুধু দেখতে পায়। আনফরচুনেটলি আপনার সেই চোখ নেই। আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন ভণিতা করে যাচ্ছেন তখন থেকে। ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না। এতে আমি বরাবরই এগিয়ে থাকব।
রাহার গলা কেঁপে উঠলো। হাত পা ঠান্ডা অনুভূত। এদিকওদিক তাকালো সে। বলল
কিসের ভণিতা? আমি কোনো ভণিতা করছিনা।
ঘুরে দাঁড়ালো রাহা। তানজীব ও ঘুরে দাঁড়ালো। গেঁটে গলায় দাঁত চেপে বলল
মিস কবির যাওয়ার আগে উত্তর দিয়ে যান।
রাহা আবার তার পিঠের দিকে ফিরলো। ভ্রুকুটি করে বলল
কিসের উত্তর?
গটমট পায়ে হেঁটে চলে গেল তানজীব।
নিকষকালো অন্ধকার অথবা জ্যোৎস্নার আলোয় মিলিটারি টেন্টে, সেই জঙ্গলের গোপন অফিসের কোণে বসে নির্ঘুম রাত জাগা জবর আর্মি অফিসারের হাতের লেখা চিঠি পড়ার সৌভাগ্য আপনার আর কখনো না হোক মিস কবির। চিঠি নয় চিঠির আধুলিও আর পাবেন না আপনি।
অত্যধিক বিস্ময় নিয়ে রাহা তানজীবের যাওয়া দেখলো। কেমন আকস্মিক ক্রোধের বশীভূত সে। কি করেছে সে? তার মাথায়ও এল না কনস্টেবল আলীউল্লাহর দেওয়া সেই সস্তা প্রেম নিবেদন বিদিত চিরকুটের মতো একটি বাদামী খামে ভরা নীল চিরকুট এসেছিল সীমান্তের পাড় হতে। যেগুলো ওর হাতে আসার পূর্বেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে সাব ইন্সপেক্টর রোস্তম শিকদারের হাতে।
চেয়ারম্যানের কনিষ্ঠ কন্যার হাতে প্রথমবার চিরকুট তুলে দিতে যেতেই উঠোনের কোণায় বসে ফুলগাছের চারার আগাছা পরিষ্কার করায় ব্যস্ত কন্যা যখন উনাকে দেখে পালালো তখন থেকেই উনি অত্যাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন চেয়ারম্যান কন্যার উপর। সুদূর ভূখন্ড থেকে আগত চিরকুট খানা তিনি তারপর থেকে ছয় ছয়বার ছিঁড়ে ফেলেছেন। কিন্তু পরে জবর আর্মি অফিসারের হম্বিতম্বি ধমকাধমকির চোটে তিনি এই সপ্তমবারে চিরকুট পাঠালেন ঠিকই কিন্তু তাতে আর্মি অফিসারের কড়াপড়া হাতের লেখা ছিল না। ছিল সহজলভ্য প্রেমের দরখাস্ত। যা পড়ে ভীষণ বিচ্ছুরিত হয়ে হাসিতে ফেটে পড়েছিল রাহা। নামহীন প্রেরকের নাম আন্দাজ করে সে ভীষণ গালাগালিও করেছিল কয়েকটা। কাগজের কোণায় লিখা নাম্বারটা মেঘনাকে দিয়েছিল যাতে ফোন করে আচ্ছা করে বকে দেয় অসভ্য পুলিশ অফিসারকে।
রাহার মেজরের বলা কথার রেশ কাটিয়ে উঠার আগেই মায়ের কান্নার আওয়াজ কানে এল তার সাথে গাড়ির আওয়াজ । চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো বরের গাড়িটা চলে যাচ্ছে। পেছন পেছন আরও দু’তিনটে বড় ছোট গাড়ি ছুটে চলেছে কালো কাঁকুড়ে রাস্তার উপর, ব্যস্তময় শহরের বুকে।
রাহা চমকে উঠলো। বুকের ভেতরটা মোচড়ে উঠলো। আরও কথা যে বলার ছিল। উনি চলে গেলেন? এত রুষ্ট কেন তার উপর? আর কি কখনো দেখা হবে? কারণটা না জেনে যে শান্তি পাবেনা ও?
চলবে,,