#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১২,১৩
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
১২
পথিমধ্যে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। রাহাদের গাড়িতে ওরা চার জন জিনিসপত্র সহ। মিলি মেঘনা আর মামাতো বোন।
আরও তিনটে গাড়ি ইতোমধ্যে যাত্রা করেছে। প্রায় কয়েকঘন্টা জার্নির পর অধীরের বাড়ির রাস্তা ধরেছে মাত্র তাদের গাড়িটা।
হঠাৎ গাড়ির চাকায় সমস্যা। গাড়ি থেমে গেল। রাহা বলল
আঙ্কেল কি হলো?
সমস্যা হয়েছে মা । বৃষ্টি থামলে দেখতে হবে। রাহা জানালার কাঁচ সরালো একটুখানি। মিলি বলল
আমাদের গাড়িতে এই সমস্যা হতে হলো? এখন?
ড্রাইভার আঙুল দিয়ে বলল
আম্মু ওই লোকটাকে ডাকব? মনে হয় ঠিক করতে পারবে।
তারা দেখলো ঝুম বৃষ্টির মধ্যে একজন রেনকোট পড়া লোক একটা জিপগাড়ির চাকা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না।
ডেকে দেখুন না। সাহায্য করতেই পারে।
ড্রাইভার খানিকটা গলা বের করে ডাকলো
এই ভাই! শোনেন। ও ভাই শুনতে পাচ্ছেন?
লোকটা একপ্রকার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আকস্মিক বজ্রপাত আর একঝটকায় মেরুদণ্ড টানটান করে বসলো রাহা। হায়হায় এটা ওই সুকুমার লোকটা! মেজর!
বুকের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ আনন্দ ঢেউ বয়ে গেল। এই একটা মানুষকে ভাবতেই নিজেকে এত সুখী সুখী লাগে কেন তার? অথচ কোথায় সে, আর কোথায় ওই যোদ্ধা। এত যোজন যোজন দূরত্ব তারপরও মনে হয়ে যেন রাহার খুব খুব আপন এই একটা মানুষ।
সুকুমার অফিসার লোকটা এগিয়ে এল। ভুরু কুঁচকে রেনকোটের টুপি ফেলে ড্রাইভারের জানালার কাচ বরাবর মুখ নিয়ে গিয়ে বলল
ভাই কেন ডাকলেন? চাচা ডাকতে পারতেন। মাইন্ড করতাম না।
তৈয়ব মিয়া ফোকলা হাসলো। পেছন থেকে দুটো নারী কন্ঠের হাসি ভেসে এল। ঠিক অপরজনের স্তব্ধ চোখের চাহনি। চোখ সরু করে দেখার চেষ্টা করলো ঠিক কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চাকা গুলো ভালো করে দেখে বলল
নর্মাল ইস্যু। ঠিক করে দিচ্ছি। বসুন।
চাকার সমস্যা নিয়ে আধঘন্টার মতো গবেষণা করে ঠিক করে হাত ঝাড়লো জবর আর্মি অফিসার। বৃষ্টিতে ভেজা জবজবে চুল ঝাঁড়তে ড্রাইভারের কাছে এসে বলল
ঠিক করে দিলাম ভাই।
তৈয়ব মিয়া হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন
ভীষণ রসিক মানুষ।
হ্যা হ্যা কড়া,কঠিন ওসব শুনতে কার ভালো লাগে বলেন? একটু রসিক হওয়ার চেষ্টায় আছি।
গাড়ির কাজ পারেন নাকি?
হ্যা। পারি বলেই তো ঠিক করতে পারলাম। দেখি গাড়ি ছাড়েন।
তৈয়ব মিয়া জানতেও পারলো না এই হাস্যরসাত্মক মানুষটি একজন সেনা অফিসার। জানলে বোধহয় শকড খেত।
কিন্তু গাড়ির ভেতরের একজন সত্যিই শকড। না পারছে হাসতে, না পারছে কিছু বলতে। নিঃশ্বাসটা নিতেও বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
ধন্যবাদ বাবা । আমার ছেলেও কয়দিন আগে বিয়ে করেছে। আপনার বয়সী হবে।
ধন্যবাদ আমি নেইনা। আসি।
ড্রাইভার জানালার কাঁচ তুলে দিল মাথা দুলিয়ে। পেছনের আধখোলা জানালার কাঁচ বরাবর সুকুমার মুখটা ওপাশের মানবীর সামনে একদম স্পষ্ট। দম এবার সত্যি সত্যি আটকে গেছে।
ওয়েলকাম ব্যাক মিস কবির…….
রাহা গাড়ির সিটের সাথে একদম পিঠ মিশিয়ে নিল। মিলি আর মেঘনা অবাক চোখে তাকে দেখছে। গাড়িটা তখনি আওয়াজ করে স্টার্ট নিল।
কপালের চুল ঝাড়া দিতে দিতে আর্মি অফিসারের ক্ষুরধার চোখদুটো দেখলো, গাড়ির জানালার কাচ ভেদ করে কয়েকটা উড়ো চুল, আর মুখের একটা পাশ, একটা চোখ তার দিকে ঘুরানো। ঝুম বৃষ্টি তেড়ছা তেড়ছা রেখার মাঝে নারী মুখটি দেখা গেল যতদূর গাড়িটি দেখা গেল।
বক্র হাসির রেখা খেলা করে গেল মেজরের ঠোঁট। নারী মানেই বুঝি ছলনা।
____________
সামান্য বিলম্ব হতেই সবাই কৈফিয়ত দিতে হলো রাহাকে। তবে সবটা বুঝিয়ে বলতে সবাই শান্তি। ওরা পৌঁছুতেই দেখলো পুরো বাড়িভর্তি মানুষ।আজকের দিনে এমন ঝড়তুফান হতে হলো? নোরা এসে সবাইকে ভেতরে নিয়ে গেল। মিনা আর সানজু তাদের সবাইকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। আনতারা বেগমের অনুরোধে শেখাওয়াত বাড়ির সব মেয়েদের আসতেই হলো। খানসা বেগম আর মনোয়ারা বেগম থাকায় মিনা আর সানজু কোথাও নড়তেও পারছেনা। মনোয়ারা এমনিতেই মিনাকে সহ্য করতে পারেননা। তারউপর কথা অমান্য করলে দু চারটা কথা শোনাতে ভুলবেন না উনি। মিনা কোনো ঝামেলা চায় না।
আমজাদ কবির মেয়ের শ্বশুরবাড়ি এসে দেখলেন জামাই বাদে, আর কোনো পুরুষমানুষ নেই। উনি অপমানবোধ করলেন যেটা অধীর বুঝতে পেরেছে। বাবা মামাদের সে কত করে বুঝিয়েছে কিন্তু তারা কেউ এখানে থাকবেন না তা আগে থেকেই বলে রেখেছেন। আমজাদ কবির সিদ্ধান্ত নিলেন এটাই উনার শেষ আসা এই বাড়িতে। আর ক’টা দিন পর মেয়েকে নিয়ে যাবেন আশরাফকে পাঠিয়ে। চা নাশতা খেয়ে চলে যাওয়ার কথা উঠলে একপ্রকার হৈচৈ লেগে গেল সেখানে। অধীর রেগেমেগে আনতারা বেগমকে বললেন
সবাই এরকম করতে থাকলে নোরাকে আমি পাঠিয়ে দেব ওর বাড়িতে। এত অপমান সয়ে ওর এখানে থাকার কোনো দরকার নেই।
আনতারা বেগম বিপাকে পড়ে বললেন
আমি কি করব? আমি তো বুঝালাম তোর আব্বাকে।
বাড়িতে একপ্রকার তান্ডবলীলা শুরু হতেই বাড়ির প্রান্তরে গাড়ির হর্নের আওয়াজে সবাই সতর্ক হলো। দেখলো রাহান চলে এসেছে। অধীর বলল
তানজীব কোথায়?
সবাইকে ঘাড় ধরে নিয়ে এসেছে।
আব্বাদেরকে?
হ্যা।
কেমনে? কোথায় গিয়েছে ওরা?
আরেহ আমাদের বাড়িতে গিয়ে আড্ডা মারছে। আমিও হসপিটাল থেকে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন দেখলাম তানজীব ভিজেভিজে এল কোথাথেকে। চেঞ্জ করে আঙ্কেলদের সহ সাথে করে নিয়ে এসেছে। চাচ্চু আর আব্বা আসেনি। ওরা আসবেও না। থাক গে।
অধীর তার কাঁধ চাপড়ে বলল
থ্যাংকস দোস্ত।
মেজরকে দিস।
শালা থ্যাংকস নেইনা।
দুবন্ধু হেসে উঠলো উচ্চরবে।
আজমীর রায়হান লজ্জায় পড়ে গেলেন সবার সামনে। তবে একথা ওকথা বলে কথা ঘুরিয়ে নিলেন ঠিকই। এমন ভাবভঙ্গি করলেন যেন বিয়েটাতে উনারা বেশ খুশি। সব ঠিকঠাক। আনতারা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন অতঃপর।
________
মিনাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে তানজীব তার পাশে এসে সোফায় বসলো। এক হাত দিয়ে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল
মিনি কি করে?
মিনা মুখ কালো করে বলল
তুমি জানো আমি একবারও অধীর ভাইয়ের ঘরে যেতে পারিনি। ওখানে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে।
তানজীব ভুরু কুঁচকে বলল
কারা আমার বোনকে রেখে আড্ডা দিচ্ছে?
মিনা বলল
অনেকে আছে।
রাহান এসে মিনার অন্যপাশে বসে বলল
ভাই তুই কি আমার বউটারে বড় হতে দিবিনা? তোর আদরে আদরে তো বাদড় হচ্ছে।
মিনা নাকফুলিয়ে তাকালো। তানজীব আর রাহান দুজন হেসে উঠলো।
___________
বউয়ের বাড়ির লোকজনদের আলাদা খাওয়ানো হলো। শেখাওয়াত বাড়ি থেকে যারা এসেছে তারা আলাদা খেল। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। খানসা বেগম তানজীবকে ডেকে বললেন উনারা চলে যাবেন। সানজু মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাবে না। তানজীব তার মাথায় টোকা দিয়ে
ওই যাবি?
মায়ের দিকে একবার চেয়ে আবারও তানজীবের দিকে তাকালো সানজু। রাহা আপুকে বলেছে না যেতে। তাই সে আজ যাবে না।
সানজু মাথা নাড়ালো দুপাশে।
ওকে। পরে যাস। মণি তোমরা চলে যেতে পারো। ও থাকুক। মজা করুক। বাচ্চা মেয়ে। কোনো সমস্যা হবে না।
সানজু খুশি হয়ে বলল
থ্যাংকিউ ভাইয়া।
মোস্ট ওয়েলকাম।
তানজীব চলে গেল। সানজু দৌড় দেওয়ার আগেই খানসা বেগম ওর হাতটা ধরলো জোরে। বলল
এই শোন, ও কি তোকে কিছু বলে?
সানজু আগ্রহ নিয়ে বলল
কে?
তোর তানজীব ভাই।
কেন? কি বলবে?
মেয়ের বোকা কথায় বিরক্ত হলেন মা। মনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন
হ্যা রে কিছু বলেনা? মনে করে দেখ।
না। কি বলবে? সানজুনি ডাকে, বুড়িমা ডাকে, দাদীমা ডাকে। এইতো বড়ভাই থেকে শিখেছে।
বলেই হাসলো সে। খানসা বেগম হাতটা ঝাঁকিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে বললেন
মেয়ে বড় হচ্ছিস না। এত লাফালাফি কিসের বুঝিনা আমি।
সানজু ছাড়া পেয়ে একদৌড়ে চলে গেল। খানসা বেগম আর মনোয়ারা বেগম একে অপরের দিকে তাকালেন তখন। বললেন
কিছুই বলেনি নাকি।
মনোয়ারা বেগম বললেন
ওর এমনিতে মুখ ভার। কি বলবে? তোর মেয়েটা যা গাধা ইনিয়েবিনিয়ে বললেও তো বুঝবেনা।
____________
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। রাহা ভেবেছিল মেজরকে আবার দেখবে। কিন্তু একবারও দেখেনি। সেটা কি ইচ্ছে করে নাকি?
সানজুর মুখে শুনেছে উনি নিচে ছিলেন। মিনাও সেখানে। দু’ভাইবোন সমানতালে এড়িয়ে যাচ্ছে তাদের। আমজাদ কবির মেয়ের ঘরে এসেছেন। মেয়ের ঘর দেখবেন তাই। নোরা সব ঘুরেফিরে দেখিয়ে বলল
আব্বা আজকে রাহা থেকে যাক। কাল পরশু তো আমি যাব। তখন ও আমার সাথে যাবে।
আমজাদ কবির প্রথমে হ্যা বলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আবার কি মনে করে বললেন
না না এ বাড়িতে ওর থাকা হবেনা। না দরকার নেই। রাহা তুই থাকবি? এখানে কি করবি থেকে?
রাহা কিছু না বলে চুপ করে থাকলো। নোরা বাবার হাত জড়িয়ে ধরে বলল
আব্বা আব্বা প্লিজ এমন করোনা। ও থাকলে আমার ভালো লাগবে। নইলে তো কষ্ট হবে।
ও কতদিন থাকতে পারবে তোর সাথে? না না।
এই মাত্র দু’দিন। আর থাকতে হবেনা তোমার মেয়েকে।
মেয়ের অভিমানী গলা শুনে বাবা রাজী হলেন বটে কিন্তু রাহাকে শর্ত দিলেন
ওই বাড়ির লোকজন, কোনো মেয়েছেলের সাথে কথা বলতে যেন না যায়।
রাহা বিনা দ্বিধায় সবটা মেনে নিল।
রাহা থাকবে সেটা শুনে সানজু খুশিতে গদগদকণ্ঠে সেটা মিনাকে বলে এল। তারমানে সবাই সন্ধ্যা নাগাদ চলে যাবে। আর তারা থেকে যাবে। তখন সবাই কথা বলার সুযোগ পাবে।
নোরার বাড়ির সবাইও চলে গেল। মিলি আর মেঘনাকে থেকে যেতে বললে বাবা ভাইয়ের কথা ভেবে তারা রাজী হলো না। এতদূর আসতে দিয়েছে এই ঢের। নোরা তাই বেশি জোরাজুরি করলো না।
বাড়ির সবাইকে বিদায় দিয়ে নোরার আর রাহা সবার পিছুপিছু আসছিল। রোহিনীও খুশি হয়েছে রাহা থেকেছে বলে। সবাই যার যার কাজে মগ্ন। তখন তানজীবকে দেখা গেল অধীরের সাথে বেরিয়ে আসতে। নোরা আর রাহা থমকে গেল। অধীর হেসে বলল
থেকেছ এই কারণে আমি ভীষণ খুশি রাহা। গুড গার্ল।
রাহা হাসলো। নোরাহ বলল
আপনি একটু আসুন তো। কিছু কথা আছে। আসুন।
নোরার এমন হঠাৎ দরকারের কারণ বোধহয় ওই দুজনকে একটু কথা বলার সুযোগ করে দেয়া। অধীর তার পেছন পেছন চলে গেল।
তানজীব দুপাশে ঘাড় নেড়ে আঁড়চোখে রাহার দিকে চাইলো। রাহাও আঁড়চোখে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিল। বলল
থ্যাংকস।
কেন?
ওই গাড়ি ঠিক করে দেয়ার জন্য। আচ্ছা সরি সরি। আপনি তো আবার থ্যাংকস নেন না।
হ্যা, এটা মনে রাখার দরকার।
রাহা হেসে মাথা দুলিয়ে বলল
ঠিক আছে। রাখবো। কিন্তু.
আবার কি?
আপনি চশমা পড়ে নিলেন কেন?
ভাল করে দেখার জন্য।
মানে?
নাথিং।
রাহা থেমে থেমে বলল,
আমি শুনেছি আর্মিরা খুবই কঠোর হয়। ওদের হৃদয় বলতে কিছুই থাকেনা।
তো?
ওরা মজা করেনা।
তো?
কিন্তু আপনি খুব মজা করেন।
এখন?
আপনি খুব খারাপ।
তারপর।
ধ্যাত।
তানজীব হেসে উঠলো।
আচ্ছা।
আজকে চলে যাবেন আপনি?
হ্যা।
এখানে আর কবে আসবেন?
কেন?
এমনি।
জানিনা। না আসতে পারলেই ভালো। আচ্ছা, বড় বোনের বিয়ে হলো। আপনার বিয়ে কবে? দাওয়াত পাবো?
দাওয়াত তারা পায় যারা খোঁজ রাখে।
আচ্ছা। তাহলে হচ্ছে।
হবে না কেন?
কোথায় থাকে?
বহুদূরে।
কতদূরে?
যত দূর হলে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শোনা যায় না। কিন্তু অনুভব করা যায়।
আচ্ছা।
তানজীব সদর দরজা পেরুতেই রাহা ছুটে গিয়ে ডাকলো
চলে যাচ্ছেন?
তানজীব থেমে গিয়ে বলল
থাকব কেন?
দুটো মিনিট অপেক্ষা করবেন?
উত্তর এল না। সম্মতি ধরে নিয়ে রাহা নোরার ঘরে ছুটলো। ব্যাগের ভেতর থেকে ওড়নার নিচে করে কিছু একটা নিয়ে দ্রুত চলে এল। দেখলো মেজর এখনো দাঁড়িয়ে আছে। রাহা পেছনে গিয়ে বলল
আপনার জিনিস।
তানজীব ঘাড় ঘুরালো। বাঁকুড়ার সেই পোড়ামাটির ঘোড়া। বাবা এনেছিল তানজীবের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে। মেঘের মতো অবিচল মেজরের চোয়াল খানিকটা শক্ত হলো অযোগ্য মানুষীর হাতে এত দামী ঘোড়ার উপস্থিতি দেখে। চট করে কেড়ে নিল সে।
রাহার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
এটা এখন কাকে দেবেন?
যোগ্য কাউকে।
এতদিন অযোগ্য মানুষের হাতে ছিল?
তানজীব একদম চোখ তুলে তাকালো। কেমন অগ্নিদাহ দৃষ্টি। রাহার সকল প্রতিরোধ কেমন গুঁড়িয়ে গেল।
দৃষ্টি নত করে নিল সে। ঘন আঁখিপল্লব বিন্দু বিন্দু জলকণায় ভারী হয়ে এল।
মেজরের পাথর কঠিন দৃষ্টিতে এবার টলমল হলো। তিনি দৃষ্টি শীতল করলেন। কন্ঠস্বর নরম করে বললেন
একজন যতসামান্য নগন্য সেনা অফিসারের দেয়া দু পয়সার ঘোড়াকে যত্নে রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ মিস কবির। এটা আমার আব্বার দেয়া ঘোড়া। আপনার এই উপকার ভুলব না।
রাহা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো
আপনাকে খুঁজলে কোথায় পাওয়া যাবে?
আকাশের নীচে। নীচে না পেলে ভেবে নেবেন উপরে। কে খোঁজ রাখে ক্ষুদে সেনাদের? বিপদ ছাড়া তাদের খোঁজ কেউ নেয় না মিস কবির। আপনি জানেন আপনি স্বার্থপর একটা দুনিয়ায় আছেন। এখানে কেউ কারো নয়।
রাহার অক্ষিকোটর জ্বলজ্বলে তারার মতো জ্বলতে লাগলো।
বিদায় মিস কবির। তাকদীরে থাকলে আবার দেখা হবে। মিনিকে রেখে গেলাম। বেশি মায়ায় জড়াবেন না। আমি আমরা আপনাদের জন্য ভুল মানুষ। ভুল মানুষের মায়ায় পড়া মানে নিজহস্তে বিষপান। আলবিদা। ভালো থাকবেন।
বলামাত্র তানজীব আর দাঁড়ায়নি। রাহা পিছু করে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ডুকরে উঠলো।
নোরার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে একলা একা বসে রইলো চুপচাপ। সরা উৎস থেকে দরদর করে জল গড়ালো কপোল বেয়ে আত্মাভিমানে।
তারপরও তার প্রবল বিশ্বাস একই আকাশের নীচে তাদের আবার দেখা হবে। হবেই।
চলবে……
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১৩
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
সেদিনের পর প্রায় মাস দু তিনেক পার হলো। দুটো দিন নোরার সাথে থেকে গ্রামে ফিরেছে রাহা। মিনার সাথে তাদের দুবোনের কয়েকটা ঘন্টা সময় কেটেছে একসাথে। কে কোথায় কি পড়ছে, কি করছে, নানান গল্পগুজবে মত্ত ছিল তিনজন। যদিও রাহার ব্যাথিত মন সবার আড়ালে বারবার ভিজে উঠছিল বোবা কান্নায়। কেমন একটা মানুষের সাথে অদৃশ্য এক মিতালি সুঁতোর বাঁধনে জড়িয়ে পড়েছিল সে ষোল বছর আগে। সেই প্রকান্ড পুরোনো জমিদার বাড়িটার একটা আঙিনায় বাঁধা পড়েছিল তাদের মধ্যকার বন্ধন। তাকে না ছোঁয়া যায়, না ধরা যায়, না ভাবা যায়। সবখানেই দুঃখ দুঃখ ব্যাথা। রাহার দুঃখী মন তারপরও এই দুঃখটা পেতে চায়। বারবার, শতবার। সে যদি একটু দুঃখ ঘুঁচে দিতে পারতো ওই মানুষটার। উনার কথায় রাগ না অভিমান পড়ে ঝড়ে? চৌদ্দটা বছর দেখা না হওয়া একটা মানবীর প্রতি কিসের অভিমান হবে? নিশ্চয়ই সেই ঘৃণার আস্ফালিত রাগ। নয়ত কি?
ক্যালেন্ডারে শরৎ ঋতুর দ্বিতীয় মাস আশ্বিন শুরু হয়েছে আর প্রকৃতিতে দোলা দিচ্ছে অনিন্দ্য পালাবদল। শরৎ এ সময় খুলে দিয়েছে তার অপরূপ বিভা ও সৌন্দর্য। আবহমান বাঙালির ঐতিহ্যে লালিত শরৎ ঋতু বাঙলার প্রকৃতির মনোলোভা সংবেদন নিয়ে কাশফুলের দোলা দিচ্ছে।
কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের পড়ানোর ডিউটি চলছে রাহার পড়ার ফাঁকেফাঁকে। ইতোমধ্যে নোরাহ দুবার এসেছে বেড়াতে। রাহাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে যায়নি।
সেদিন ফুরফুরে ছিল আকাশ। একদম ফকফকা।
স্কুলের বাচ্চাদের পড়ানোর সময় সেই প্রবীণ কনস্টেবল আবারও রাহার সামনে হাজির। বাবার বয়সী বলে রাহার ভার জিভ নড়লো না পারিবারিক শিক্ষার দরুণ। উনি ওই নোরার বিয়ের আগের দিনটার মতো একটা বাদামী রঙা খাম বাড়িয়ে দিলেন। রাহা নিল তবে যথেষ্ট ভদ্র গলায় বলল
শিকদার সাহেব বাড়াবাড়ি করছেন। এর ফল মারাত্মক হবে।
স্যার বলেছেন আপনার যা বলার তা চিঠিতে লিখে দিতে। আর পাঠানোর হলে আমি কাল আসব থানায় যাওয়ার পথে।
রাহা চোখমুখ শক্ত করে বসে রইলো। বাচ্চারা হৈচৈ শুরু করতেই সে ধমক দিল।
স্টপ। কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব সবাইকে। এত হৈ চৈ কিসের?
সবাই শান্তশিষ্ট ম্যামকে রেগে যেতে দেখে ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেল। কনস্টেবল চলে গেল। রাহা খামটা ছিঁড়ে তন্নতন্ন করলো। চিরকুটটাতে চোখ বুলিয়ে দেখলো ডিএসপি রোস্তম শিকদার সেই প্রথম দেখে পাগল হলাম বলে বলে সস্তা প্রেমের আকুতি জানিয়েছেন। একজন পুলিশ অফিসারের এমন ছ্যাঁচড়ামি দেখে গা গুলালো তার। মানুষ এত নির্লজ্জ হয় কি করে?
তারপর কঠোর ভাষায় তিরস্কার করার দরুণ হঠাৎ একদিন ডিএসপি অফিসার আগন্তুকের মতো হাজির হলো রাহার সামনে। ক্লাসে পাঠদান রত ছিল রাহা। আচমকা রোস্তম শিকদারের আগমনে চকিতে চমকালো সে। ভয়ে বুক কেঁপে উঠেছিল দুরুদুরু।
ব্লু রঙের ড্রেস রোস্তম শিকদারের উজ্জ্বল গাত্রদেহে আঁকড়ে ধরেছে। অমন সুদর্শন একজন পুরুষ কি করে এমন লাগামছাড়া হয় বুঝে পেল না রাহা। এজন্য বলা হয় বাহ্যিক সৌন্দর্য নয় ভেতরের সৌন্দর্যই আসল।
ক্লাস শেষ বলে বাচ্চাদের উনি ছুটি বলে বেরিয়ে যেতে আদেশ দিলেন। বাচ্চারা হৈ হৈ করে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল।
তারপর তিনি গলায় রস মিশিয়ে নানান ধরণের হাস্যরসাত্মক কথায় গলানোর চেষ্টা করলেন রাহাকে। রাহা কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য করলো না। মুখটা ঘুরিয়ে রাখলো অন্যদিকে শক্ত করে। রোস্তম শিকদার শেষমেশ রাহার মুখ থেকে কথা বের করতে না পেরে বললেন
হবু শ্বশুর মশাই এটা তো বলেনি যে, উনার মেয়ে কথা বলতে জানেন না?
একসাথে দুটো ইঙ্গিত। রাহার চোখজোড়া জ্বলে উঠলো ধিকধিক করে।
এটলিস্ট আপনার মতো লাফাঙ্গা মানুষের সাথে কথা বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। ঘৃণা বুঝেন?
উনি রাহার কথা একদম গায়ে মাখলেন না। গলার সুর বদলে বললেন
আজকে গলার সুর একদম অন্যরকম। প্রথম দিন আমাকে দেখে পালালেন।
বেরিয়ে যান।
আমার চিঠির উত্তর দেননি আপনি। কিসব আজেবাজে বকেছেন। উত্তরও লিখতে জানেন না নাকি? যাহোক চিঠি দিয়েছেন এটাও বেশি। ধন্যবাদ।
আপনার ওসব লেখা দেখলে আমার ঘৃণা লাগে। বুঝেন না আপনি?
রোস্তম হাসলো। মাথা দুলিয়ে বলল
বুঝি বুঝি। আর্মি অফিসারের চিঠি হলেও কি এমন বলতেন?
রাহা চমকালো এমন উদ্ভট কথায়।
আর্মি অফিসার? চিঠি? কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?
রোস্তম শিকদার সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো।
অবাক হচ্ছেন কেন? আর্মির কেউ আপনার পরিচিত আছে নাকি? খুবই ঘনিষ্ঠ কেউ?
আপনি কি আমার সাথে মজা নিচ্ছেন? নিশ্চয়ই কিছু জানেন। তাহলে মজা নিচ্ছেন কেন?
আজ আসি। অন্য একদিন আসব।
রোস্তম শিকদার উঠে দাঁড়ালো বেঞ্চ থেকে। স্কুল গেইট পার হতেই রাহা ব্যাগ নিয়ে পিছু ছুটলো। ডেকে বলল
আমার নামে সত্যি কি কোনো চিঠি এসেছিল? মিথ্যে বলবেন না।
এসেছিল। আমার হাতে নয়। শুনেছি।
কার কাছে শুনেছেন?
বলতে পারব না। দুঃখিত। পরে দেখা হচ্ছে।
সব যেন রাহার মাথার উপর দিয়ে গেল। রোস্তম শিকদার যে পালিয়েছে সেটা রাহার কাছে স্পষ্ট। নিশ্চয়ই তিনি কোনোকিছু লুকচ্ছেন। মেজর কি তাকে সত্যি সত্যি চিঠি লিখলো? আর উত্তর না পাঠানোতে রাগ?
কার হাত দিয়ে চিঠি পাঠালো? কে হতে পারে মেজরের বিশ্বস্ত? নিজেকে পাগল পাগল লাগল রাহার।
এই বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাহা কয়েকবার গ্রাম্য থানায় গিয়েছে লুকিয়ে। কিন্তু রোস্তম শিকদারের সাথে দেখা হলো না। শেষমেশ উপজেলার থানায় গিয়ে দেখা হলো কনস্টেবল আলীউল্লাহর সাথে। রাহা উনাকে রাস্তায় দেখেছেন। সেখানে কথাবার্তা বলেছে। আলীউল্লাহ জানালো একজন প্যারা স্পেশাল ফোর্সের অফিসারের সাথে তিনি কথা বলেছেন। রোস্তম স্যার যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছিলেন সেভাবে বলেছেন উনি। কি বলেছে তা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, চিঠিগুলো আমি যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছি এবং ম্যাডামের হাতে দিয়েছি এই স্বীকারোক্তি করেছিলাম।
অতঃপর রাহা সবটা বুঝে গেল। রোস্তম শিকদার এতবড় ধূর্ত বাজ একজন মানুষ ভাবতেই তার ঘৃণা হলো। আব্বার সাথে কিসের এত ভাবসাব মেলামেশা এই লোকের? ভাবতেই ঘৃণাত্মক শ্লেষ্মা বের হলো মুখ দিয়ে।
অন্যদিকে চিঠিগুলো পড়তে না পারার দুঃখে কয়েকটা রাত নির্ঘুম কাটলো তার। আকাশের পাখিদের দেখে ইচ্ছে হলো তারও যদি ডানা থাকতো। উড়ে উড়ে সে পৌঁছে যেত মেজরের কাছে। ভুলটা ভাঙিয়ে দিত। কিন্তু সে বন্দী। না কোনো প্রশ্ন করতে পারে তার বাবাকে। না কোনো শাস্তি দিতে পারছে ওই পুলিশ অফিসারকে। কনস্টেবল আলীউল্লাহকেও কথা দিয়েছে রাহা। রোস্তম শেখকে সরাসরি দোষী সাব্যাস্ত করা যাবে না। কারণ উনার সমস্ত অন্যায়ের সাক্ষী একমাত্র আলীউল্লাহ। সুতরাং কোনোকিছু হলেই সব দোষ আলীউল্লাহর উপর গিয়ে পড়বে।
বাদামী খাম আর নীল চিরকুটে কি লিখেছিল মেজর? নিশ্চয়ই প্রেমের ছন্দ লিখেনি। তাহলে কি অপ্রেমের গল্প লিখেছিল? সাতটা চিঠি কি একইরকম ছিল? নাকি সাতটা সাত রঙের, সাত ধরণের ছিল।
সেই দিনটি কখন আসবে যখন মেজরের সাথে আবার তার দেখা হবে।
_______________
তারও কয়েকমাস পরের কথা………..
জিনিসটি হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে মিনা চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। দরজা খুলে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই রাহানকে দেখে চমকালো। রাহান ঘাড় ঘুরিয়ে বলল
চশমাটা কোথায় রেখেছিস?
ও…ওখানে…
রাহান ঘাড় ঘুরিয়ে পূর্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। ভ্রুকুটি করে এগিয়ে গিয়ে বলল
শরীর বেশি খারাপ লাগছে?
মিনা দুপাশে মাথা নাড়ালো। তোয়ালে এনে মুখ চুল মুছিয়ে দিতে দিতে রাহান বলল
মুখ ধুতে গিয়ে চুল ভেজাতে হয়? তুই বড় হবি কখন?
মিনা ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইলো। তার হাত পা কাঁপছে। রাহানের অভিজ্ঞ চোখ মিনার মুখশ্রী দেখে কিছু একটার টের পেল। হাত ছুঁয়ে বলল
কি রে হাত ঠান্ডা কেন?
হাত ছুঁতে গিয়ে দেখলো মিনা হাতের ভেতর কিছু একটা চেপে ধরে রেখেছে। রাহান সেটা দেখার চেষ্টা করতেই মিনা ফুঁপিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। রাহানের বুকের সাথে মিশে গিয়ে আওয়াজ করে কেঁদে উঠতেই হাতের মুঠি নরম হয়ে এল। রাহান তাকে দু বাহুর মধ্যিখানে আগলে রেখে হাতের বস্তুটি দেখে বাকহারা হয়ে পড়লো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করা দায়। মিনাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে হেসে উঠলো সে। মুখ তুলে সারামুখে চুম্বনচিহ্ন এঁকে বলল
এটার জন্য কাঁদতে হয় পাগল? আমি কত খুশি হয়েছি জানিস?
আমার শরীরটা কাঁপছে কেন? আমার ভয় লাগছে খুব।
রাহান তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়ে বলল
এখন থেকে বেশি বেশি খেতে হবে ছকিনার মা। আমাকে ছাড়। আর্মি ম্যানকে জানাই।
মিনা ছাড়লো না। বলল
এখন না। আরেকটু থাকেন। ও আল্লাহ আমি কি মরে যাব? এরকম লাগছে কেন ডাক্তার?
রাহান গালে ঠোঁট চেপে ধরে ধমক দিল
চুপ চুপ। ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি তো মিনি। তুই ঘুমা।
মিনা ঘুমিয়ে পড়লো অনেক কাহিনীর পর। রাহান তার ঘুমন্ত মুখে চুমু এঁকে গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে চলে গেল। বাড়ির সবাই তাকে দেখলো। সানজু বলল
আপার আজকে হলো কি? সারাক্ষণ মন খারাপ করে ছিল।
সেলিম সাহেব বললেন
কি রে রাহান কোথায় যাচ্ছিস? মিনির কি শরীর খারাপ? চশমা ছাড়া কোথায় যাচ্ছিস?
মিষ্টির দোকানে যাচ্ছি।
সবাই একে অপরের দিকে তাকালো।
মিষ্টি কেন?
দাদা হতে যাচ্ছ। মিষ্টি খাবে না? ভালো মিষ্টি নিয়ে আসছি। সানজু চশমাটা খুঁজে রাখিস।
সানজু লাফিয়ে উঠলো।
এমা আমি ফুপী হবো। না খালামণি হবো। না না। ও আম্মা বলো না আমি কি হবো?
খানসা বেগম বুকে হাত চেপে বলল
আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। কত খুশির খবর!
সানজু বলল
আমি আপার কাছে যাই। আপা কি লজ্জা পেয়ে বের হচ্ছেনা নাকি?
খবরদার যাবিনা ওখানে। ও ঘুমোচ্ছে। শরীর খারাপ লাগছে। এখন ঘুমোক।
আচ্ছা চুপিচুপি যায়। আপাকে একটু দেখে আসি।
কোনো আওয়াজ করব না।
সানজু চলে গেল। খানসা বেগম মনোয়ারা বেগমকে ডেকে বলল
বড় আপা শুনেছ খুশির খবর? ও বড় আপা? আমাদের বাড়িতে তো নতুন মেহমান আসতে চলেছে। রোহিকে একটু ফোন দাও না।
পরে জানাস। ওর কত কাজ সেখানে। শুয়ে শুয়ে তো দিন কাটাচ্ছে না।
খানসা বেগমের মুখটা মলিন হয়ে এল।
তুমি কি খুশি হওনি আপা? আল্লাহ বেজার হবে। এমন করো না।
আমার খুশির কথা কে ভেবেছে ছোট? আমার ছেলেকে দেখেছিস? মায়ের কাছে এসেছে সে?
তুমি খুশি হবে না জানে তাই আসেনি।
তুইও ওদের হয়ে কথা বলছিস?
যেটা সত্যি সেটা বলেছি আপা। ভুল বললে মাফ করো। মেয়েটার সাথে বিনয়ী আচরণ করো একটু।
এ সময় ওকে সাপোর্ট দিতে হবে। তোমারই বংশধর আসছে। পর না।
মনোয়ারা বেগমের চোখ টলটলে পানিতে ভরে উঠলো। ছেলেটা এসে বললে কি হতো?
_____________
সিনিয়র স্যারের সামনে এসে সম্মানসূচক কুর্নিশ জানালো মেজর। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওসমানী বিজ্ঞ চোখে মেজরকে পরখ করছে। আজকে এত উৎফুল্ল দেখাচ্ছে মেজরকে?
এনিথিং রং মেজর?
মেজর আমোদিত কন্ঠে বললেন,
Sir, My sister is going to be a mother. I just got the happy news. That’s why, I’m so happy.
Wow! Good News Major! Best wishes for your sister.
Thank you sir.
Good luck to you too, you are going to be a mama.
Yes Sir. Pray for them.
Sure Major.
পা ঠুকে স্যালুট জানিয়ে মাথার র্যাংক ব্যাজ সমেত ক্যাপটা খুলে হাতে নিয়ে দৌড়ে গেল সে। তরুণ সৈনিকরা সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে মেজর স্যারের দৌড়ে যাওয়া দেখে ফিসফিস করে বলল
সামথিং ইজ ফিশি…
কয়েকটা মিলিটারি ট্রাক বিকট শব্দ করে এসে থামলো সবুজাভ প্রান্তরের এককোণে। ধুপধাপ নেমে এল সেনারা।
আজ রাতেই গুরুত্বপূর্ণ একটা অপারেশনকে উদ্দেশ্য করে গভীর জঙ্গলের ভেতরে মিশন সাকসেসের জন্য সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার তাড়া দিয়ে টেন্টের ভেতর ঢুকে পড়লো মেজর।
একটি নীল চিরকুট আর একটি সাদা ছোট টেডিবিয়ারকে বেঁধে নিল লাল ফিতা দিয়ে। অপারেশন উপলক্ষে সহকর্মী অফিসার, আর সিনিয়র অফিসারের পদচারণায় মুখোরিত প্রান্ত। বাতাসের দাপটে মোটা জলপাই রঙা তেরপাল পৎপৎ শব্দ করে দুলছে। শক্ত বুটের মশমশ আওয়াজ আর তেরপাল উল্টে হৈ হৈ করে মেজরের উপর আক্রমণ করে বসলো সহকর্মী, যদিও পদমর্যাদায় ছোট বড়। সবার গায়ের নিচে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে রইলো তানজীব।
চিরকুটটি তুলে নিয়ে সবাই ছুটলো একজনের পর একজন। সিনিয়র অফিসারদের এমন দলছুট দেখে সৈনিকরাও আনন্দে মেতে উঠলো। সবার ঠোঁটের কোণায় চওড়া হাসি। তানজীব ঘাসের উপর পা কুড়িয়ে বসে থাকলো টেন্ট থেকে বেরিয়ে। গালে হাত দিয়ে হতাশ গলায় বলল
বোনের জন্য লিখেছি চিরকুট। নট ফর এনিওয়ান এলস।
সবাই এসে ঘিরে বসলো তানজীবকে।
শুধু শুধু দৌড়ালেন মেজর। বোনকে লুকিয়ে চিঠি লিখছেন। মনে হচ্ছে প্রেমিকাকে লিখছেন। ঢপ খেলাম।
তানজীব বক্র হাসলো। চিরকুট কেড়ে নিয়ে হেঁটে হেঁটে টেন্টের দিকে এগিয়ে গেল সে। ঠিকই তো গত ছ’মাসে চিঠি লিখা হয়নি তাকে নিয়ে। লেখা চিঠি না হয় জমা থাক বুকপকেটে। পড়া না হোক। তার ছোঁয়া না হোক। তার অবজ্ঞা না পাক। জমা থাকুক।
কলমের কালিতে সেই চেনা চেনা ছন্দগুলো বসে গেল চিরকুটের ভাঁজে ভাঁজে……
এই হারানো খামে,
নামে বেনামে–
মিষ্টি চিঠি হয়ে বেচেঁ থাকার ইচ্ছেটা থাকুক তবে।
দেখা আবার হবে,
বিষন্ন বিকেল কিংবা মৌন সন্ধ্যায়,
নীড়ে ফেরা হালতি পাখির ডানায়,
যে শোকগাথা হয়েছিলো লেখা,
গোপন কথা এক,
না জেনে থাকুক খুশি সবাই,
মানুষ বরাবরই একা,
জেনেও মানুষ বাঁধে ঘর
বরাবর, দিলাম আবেদনপত্র এইভাবে,
দুঃখবিলাসী আমার ফুরিয়ে যাওয়া ফুসফুসের বিশুদ্ধ বাতাস কি হবে?
একদিকে মেজর বিষন্ন মনে বুক পকেটে জমা করলো আরও একটি বেনামি চিঠি, অপরদিকে জানালা পেরিয়ে দূর আকাশের তারা গুনতে ব্যস্ত কন্যা দিনগুণে আর বিড়বিড় করে কবে ফুরোবে অপেক্ষার দিন।
চলবে……