মন_নিয়ে_কাছাকাছি #পর্ব_১৮,১৯

0
120

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১৮,১৯
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
১৮

রাতের আকাশ ফুঁড়ে চন্দ্রসুধার বর্ষণে উদ্দীপিত, শ্বৈলপ্রান্ত। কুজ্ঝটিকায় আচ্ছন্ন আশপাশ। নির্জনতায় গা ছমছমে আভাস। ঘরটা দোতলায়।
দেয়ালগুলোতে টাঙানো কতগুলো পুরোনো পেইন্টিং। মাথার উপর যান্ত্রিক ফ্যানটাও পুরোনো জং ধরা । জানালাটা বিশাল। ফিনফিন করে শীত ঢুকে পড়ছে ভেতরে।

বেলী, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা, জারবেরা ফুলে আচ্ছাদিত বিছানা। টিকটিক টিকটিক করে চলতে থাকা যান্ত্রিক ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রাহা আবারও দীর্ঘ কেশযুক্ত মস্তক ফেলে রাখলো ফুলেল পরিশোধিত বিছানার চাদরে। শাড়ির আঁচল গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। মাথার ঘন কেশপাশের সাথে লেপ্টে রয়েছে পুষ্পপত্র।

দুচোখের তারা নিবদ্ধ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে টিকটক করে চলতে থাকা যান্ত্রিক দেয়াল ঘড়িটার দিকে। তৃতীয় বারের মতো আরও একবার গড়াগড়ি খেতেই ঠকঠক করে দরজায় ঠোকা পড়লো সাথে গুরুভার গলার সুনাদ আওয়াজে ফাঁকা ঘর কেঁপে উঠলো।
মন ব্যাঙাচি তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠলো রাহার। মস্তিস্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। বুকের ভেতর কে যেন বিরতিহীন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। পাশ থেকে ওড়না টেনে ঘোমটা টানতেই আলতার শিশির পড়ে গেল মেঝেতে। ত্রস্ত পায়ে সে হেঁটে গেল দরজার কাছে। নাক অব্দি ঘোমটা টানা মুখে নিস্পন্দ নিস্প্রভ হয়ে থম ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সে বহুক্ষণ। দরজার ওপাশ থেকে হাস্কি গলার আওয়াজটি কিছুক্ষণ পর পর ভেসে আসছে। আর বুকের ভেতর নিদারুণ বয়ে চলা দুন্দুভি বেজে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। খট করে দরজা খুলে দিল সে।

ফুঁস করে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল তানজীব।

পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেল। এত অপেক্ষা কেন করান ম্যাডাম?

আমাকেও করিয়েছেন।

প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে?

রাহা দু পা পিছু গেল।

একদম। ছাড় দেব কেন?

যথাস্তু । এখন ভেতরে আসতে পারি ম্যাডাম?

রাহা ঘোমটার আড়ালে মাথা দুলালো।

আসাই যায়।

আচ্ছা।

এক পা বাড়ালো তানজীব। রাহা বরঞ্চ তিন পা পিছিয়ে গেল। তা দেখে তানজীব হাসলো নিঃশব্দে। দৃষ্টি রাহার দিকে নিবদ্ধ রেখে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল

দেরী করার জন্য সরি।

আমি জানি আমার অপেক্ষা কখনো ফুরোবে না। আমি তাই সরিটা নিচ্ছিনা।

তানজীব ঘড়ি খুলতে গিয়ে থেমে গেল। এক পা এক পা করে হেঁটে রাহার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথাটা নিচু করে ফিসফিস করে বলল

গত চৌদ্দ বছরে আমি আপনাকে একবারও তো ভুলিনি ম্যাডাম। এই যে এত বছর পর সাক্ষাৎ। অপেক্ষা আমি করিনি?

রাহা দু পা পিছিয়ে গেল আরও।

তার কারণও আপনি। কেন দূরত্ব রেখেছেন? যোগাযোগ রাখা যেত।

তানজীব তার সাথে সাথে সমান তালে এগিয়ে গেল।

হুহ, আমার দোষ।

উহু, আপনার দোষ নেই। দোষটা ভাগ্যের।

তাহলে এত দূরে সরা কেন? কি সমস্যা?

বুঝে নিতে হয়।

তানজীব মাথা দুলালো। ওড়নার উপরেই ছুঁয়ে দিল রাহার কপোল। প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,

হুম, বুঝে নিলাম।

রাহা আরও দুপা সরে গেল। পিছু করে দাঁড়িয়ে বলল

নাহ বুঝেননি। আপনি রাগের মাথায় ওইদিন আমার ঘোড়াটা ভেঙে ফেলেছেন। আমি দেখেছি ব্যাগে। আপনি জানেন আমি ওটাকে কত যত্নে রেখেছিলাম। আর আপনি ভেঙে ফেলেছেন।

তানজীব জিভে কামড় দিল।

কি করে ওটা দেখে ফেলেছ তুমি? আমি তো..

ব্যাগে দেখেছি। আপনার সবকিছু আজ থেকে আমার।

তানজীব নিঃশব্দে বিড়াল পায়ে গিয়ে রাহার পেছনে দাঁড়ালো। শাড়ির ভাঁজে উদরে হাত গলিয়ে, একটানে তার দিকে ফিরিয়ে নিল সে রাহাকে । রাহার দুহাত গিয়ে ঠেকলো তার বুকের উপর। শ্বাস ভারী হয়ে এল তার। বুকের ভেতর কিছু একটা লাফাচ্ছে। তানজীব অন্য হাত দিয়ে তার ঘোমটা তুলে অর্ধেক অংশ তার মাথার উপর নিল। নাকের উপর করপুট ছুঁয়ে নিজের ধারালো গালের একপাশ দিয়ে চেপে ধরলো রাহার নরম গালের একপাশ। ধারালো দাঁড়ি গুলো গালে ঢেবে যেতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল রাহা। শিরশিরিয়ে উঠলো সারা দেহ। দম প্রায় বন্ধ হয়ে এল।
শক্ত করে ধরলো সে তানজীবের পাঞ্জাবি। তানজীব কানে ওষ্ঠ করপুট গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল

সেন্সলেস হয়ে গেলে আমি ফেঁসে যাব ম্যাডাম।

অতি অনুরক্তির প্রভাবে রাহা নেতিয়ে পড়তে পড়তে তানজীব নিজেই আগলে ধরলো তাকে দুহাত দিয়ে। রাহা দুহাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে নিতেই হেসে উঠলো তানজীব। ছোট ছোট করে ছাঁটা অসিতবরণ চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে রাখলো রাহা। কতক্ষণ ওভাবে একে অপরের সাথে মিশে থাকলো তার হিসেব নেই।
স্ব শরীরে এই প্রথম এত কাছে আসা। মন কবে কাছাকাছি চলে এসে বাঁধা পড়েছে তার হিসেব করতে বহু পুরোনো খাতার হিসেব মিলাতে বসতে হবে।

দীর্ঘসময় পার হতেই তানজীব দুহাতের বাঁধনে ধরে শক্ত করে ধরে তুলে নিল কোমল নারীদেহ। সারা মুখে, ওষ্ঠ অধরে, গলদেশের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে দিল উষ্ণ আর্দ্র বলিষ্ঠ ঠোঁটের প্রলম্বিত চুম্বন। ওড়নাটা খসে মেঝেতে পড়ে গেল।

পাঁজাখোলা করে কোমল নারীশরীর তুলে নিয়ে ফুলেল সুরভিত শয়নস্থানে রেখে দিল তানজীব। মুঠোয় মুঠোয় ফুলের পাপড়ি তুলে নিল চাদরের উপর থেকে। রাহার মুখের উপর ছিটিয়ে দিতেই রাহা টেনে নিল তার পাঞ্জাবির কলার। কোমল পেলব ঠোঁট গেঁথে দিল ধারালো গালের একপাশে। নাকের সাথে নাক ঠেকিয়ে জোরে শ্বাস নিল সে । তানজীব চেয়ে রইলো তার কেঁপে উঠা নাকের ডগা, আর ঠোঁটের কোণায়। রাহা কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠলো…

এত মায়া কেন বাড়ালেন মেজর? আপনাকে ছাড়া থাকতে আমার কষ্ট হবে ভীষণ।

আমি সবসময় আছি ম্যাডাম। আপনার সাথে।
রোদ্দুর হয়ে, বৃষ্টি হয়ে,বদনাম হয়ে, ডাকনাম হয়ে।
সবসময়।

কাল থেকে তো আর দেখব না আপনাকে। আর কবে দেখব? বাকি দিনগুলো কিভাবে যাবে আমি জানিনা। আপনি থাকলে আমার ভয় হতো না।

আপনাকে ভীতু মানায় না ম্যাডাম। একটুও না। আমি ফিরে আসি। তারপর আপনাকে ঘরে তুলব। আমাদের ছোট্ট একটি সংসার হবে প্রাণো।

রাহার চোখের কোণায় জ্বলজ্বল করছে টলমলে পানি।

যদি কেউ মেনে না নেয়? আপনার বাড়ির কেউ। আপনার চাচা জেঠুরা। ওরা….

তানজীব বিরক্ত হলো বেশ। দু’হাত দিয়ে রাহার মুখ একদম চেপে ধরে বলল

আমার এই অনিশ্চিত আথান্তর জীবনের সাথে আপনাকে জড়িয়ে ফেলার জন্য সরি ম্যাডাম। না হওয়া বউটার দুঃখ কমিয়ে দিলাম আর কি। ওসব কথা বলতে চাচ্ছিনা প্লিজ…….

রাহা বাঁকা হয়ে গিয়ে মুখ লুকোতে চাইলো। বলল

জানালা দিয়ে শীত ঢুকছে। বন্ধ করে দিয়ে আসি।

তানজীব বাঁধা দিল। হাতের মুঠো করে ফুলের পাপড়ি এনে ছিটিয়ে দিল রাহার মুখে। রাহা চোখ খিঁচে বন্ধ করলো বন্ধ চোখের পাতায় পাপড়ি পড়ায়। নড়েচড়ে বলল…..

চোখ খুলতে পারব না তো।

তানজীব ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল

চোখ খুলতে হবে কেন?

ঠোঁটের উপর এসে পড়া পাপড়ি সরিয়ে দিতে রাহা হাত বাড়ানোর প্রস্তুতি নিতেই কড়াপড়া আঙুল আলিঙ্গনে জড়ালো তার আঙুলের সাথে।

মুখের উপর তপ্ত শ্বাসের আঁচড়ে, জঠরে বলিষ্ঠ হাতের বিচরণে গায়ে কাঁপুনি ধরলো তার।
অধরোষ্ঠে আটঁকে যাওয়া ফুলের পাপড়ি সরিয়ে নিল মেজর নিজের ওষ্ঠ দ্বারা। শুঁষে নিল সমস্ত কুন্ঠা আর জড়ত্ব। দূরত্ব কমিয়ে নিল, ঘুচিয়ে নিল পুরোপুরি।
প্রাণপুরুষের উষ্ণ ছোঁয়ায় থেকে থেকে কেঁপে নারী কোমলাঙ্গ। এক রহস্যময় রজনী কাটলো বিবশ গভীর নিস্পন্দ রাত্রিরে পুরোনে জংলী বাড়ির একটা ছোট্টঘরে।

এই স্বপ্ন স্বপ্ন ঘোর লাগা মুহূর্তগুলোর সমাপ্তি ঘটলো এয়ারপোর্টে। সন্ধ্যায় হাড়কাঁপানো শীতের মাঝে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে রাহা অধীর, রাহান, নোরাহ,মিনাদের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখলো অনেকগুলো সেনা অফিসারদের মাঝে অফিসিয়াল আর্মি পোশাকে আবৃত মেজর যাওয়ার সময় মায়াভরা চাহনিতে তার দিকে কয়েকপল তাকিয়ে আবারও পুরোদমে হেঁটে চলে গেলেন। আর একবারও তাকালেন না। কোনো কথা বলে গেলেন না।

একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতেই রাহার মনে পড়লো মেজর তাকে বলেনি কবে ফিরবে। অন্য চিন্তা, অভিমান, অনুরাগকে ঠাঁই না দিয়ে রাহার মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো গত দুদিনের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়া মানুষটার জন্য। তিনি যেপ্রান্তেই থাকুক না কেন যেন সুস্থ থাকেন। দ্রুত ফিরে আসেন প্রাণোর কাছে। অপেক্ষা যেন খুব দীর্ঘ না হয়। এখন তিনি প্রাণোর না হওয়া বর নন। প্রাণোর স্বামী।

চলবে

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১৯
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা

কোকিলের কুহু কুহু ডাকে কল্লোলিত আর নব্য গাছের পাতায় সবুজাভ গ্রামের এপ্রান্তর থেকে ওপ্রান্তর। শীতের প্রকোপ কমেছে অনেক আগেই। বসন্ত এসেছে সে কবে। কোকিলের কুহু কুহু ডাকে মাতাল বাড়ির আঙিনা।
সবুজ কচি গাছের পাতায় আর মাঠ ভরা ফসলে সেজে উঠেছে গ্রামবাংলা। কালো পিচঢালা রাস্তা কৃষ্ণচূড়ার লাল গালিচায় রাঙানো। স্কুল মাঠের মোড়ে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটি বেশ নজরকাঁড়া। স্কুল পড়ুয়া ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েগুলো ফুলের পাপড়ি কুড়ায়। লাল গালিচায় হাঁটে আনন্দ করে। প্রকৃতির এমন অপরূপ সাজে মুগ্ধ হয় রাহা। ভাবতে থাকে কয়েক মাস আগের কুয়াশা মাখানো কনকনে শীতে গভীর পাহাড়ি জঙ্গলে সেই আর্মি ক্যাম্পিংয়ে কাটানো মুহূর্তগুলো । অমন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা স্বপ্ন স্বপ্ন মুহূর্তগুলো অবচেতন মন আবারও ফিরে পেতে চায় । মাঝেমধ্যে ভীষণ অবাক হয় সে, ভয়ে আতঙ্কে দমবন্ধ হয়ে আসে এই ভেবে তার পরিবার যেটা ভাবতেও পারেনা এমন একটা কাজ সে করে বসেছে। যেদিন সত্যিটা জানাজানি হবে সেদিন কি হবে?

যদিও ওইদিন নোরাদের সাথে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পর আনতারা বেগম আর রোহিনীর কড়া প্রশ্নের কবলে পড়েছিল রাহা। নোরা আর অধীর কত ভুল চুং করে পরিস্থিতিটা সব সামলে নিল সেটা শুধু তারা জানে। বাবার কথা ছাড়া এক পাও না বাড়ানো মেয়েটা এত বড় কাজ করে বসলো তা ভাবতে রাহার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। বুক ভার হয়। এই পরিবার আর ওই পরিবারের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সংঘাতের কথা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। কোথায় এর শেষ সে জানেনা? সে কেবল দিন গুনছে।

তিনটা মাস পেরিয়ে গেছে। ঢাকায় সে আর যায়নি এরমধ্যে। কিছুদিন আগে নোরার শরীর খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাই আমজাদ কবির আর আশরাফ গিয়েছিল দেখতে। এবং নিয়ে এসেছিল সুসংবাদ। আরও একজন নতুন মেহমান আসতে চলেছে রায়হানি ভিলায়। নোরা রাহাকে যেতে বললে আমজাদ কবির কি ভেবে মেয়েকে যেতে দিলেন না। বরং আশ্বাস দিয়ে আসলেন নোরাকে তিনি গ্রামে নিয়ে আসবেন কয়দিনের জন্য। কিন্তু আসবে আসবে করে নোরার আসা হলো না। ওই বাড়ির কেউ নোরাকে এ মুহূর্তে জার্নি করতে দিতে রাজী নয়। তাই আর কারো দেখা হয়নি।

মিনার সাথে ফোনে কয়েক বার ফোনালাপ হয়েছিল রাহার। তার মাধ্যমে রাহা জানতে পেরেছে তানজীবের ট্রেনিংয়ের সময়কাল সাড়ে চার মাসের মতো। খুবই কড়া এই প্রশিক্ষণ রাত দিন একাকার করে প্রশিক্ষণে মজে থাকতে হয়। এতে করে সকল যোগাযোগ আপাততপক্ষে বন্ধ রাখা হয়। যদিও বেশ কয়েকবার মিনার ফোনে ফোন এসেছিল তানজীবের গভীর রাতে । সেই দুই কি তিন মিনিটের মতো কথাবার্তা। মিনার নিজের খেয়াল রাখার, বাড়ির সকলের অবস্থা জানা আর ওই জয়পুর গ্রামে বিয়ে করা বউয়ের খোঁজখবর নেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এতটুকু সময়ে রাহা এবার ঠিকই বুঝতে পেরেছে মেজর সত্যিই বলেছে আর দশজনের মতো স্বাভাবিক একটা সংসার তার হবেনা। এজন্যই কি নিজেকে অসামাজিক বলেছিলেন তিনি? কিন্তু রাহা তারপরও স্বপ্ন দেখে। ছোট্ট সাজানো গোছানো একটা সংসার তারও হবে। স্বপ্ন দেখতে বারণ কোথায়?

আনমনে ভাবতে ভাবতে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে রাহা। আজ হেঁটে যাওয়ার মুরোদ নেই। সকাল থেকেই গায়ে জ্বর জ্বর ভাব। ইতোমধ্যে কয়েকবার ফোন এসেছে বাড়ি থেকে যাতে দ্রুত সে বাড়ি ফেরে। মিনিট খানেকের ভেতর রিকশা এসে থামলো রাহার সামনে।

আপা যাইবেন?

রাহা মাথা দুলালো। রোদ ছাতা বন্ধ করতে করতে বলল

হ্যা।

রিকশা একটানে বাড়ির গেইটের কাছে নিয়ে আসলো। রাহা ভাড়া দিতে গেলে চালক নিল না। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু পিছু আসা একটা গাড়িকে দেখিয়ে বলল

স্যারের বারণ আছে আপা। টাকা নিতে পারতাম না।

রাহা গাড়িটার দিকে তাকালো।

কে উনি?

পুলিশ আপা। বলছে টাকা না নিতে। আমারে টাকা দিয়া দিছে।

দশ টাকা ভাড়া দিয়ে উনি নিজেকে কি মনে করছে? ঢং করার জায়গা পায় না? অসহ্য!

আপনি তার হবু বউ…

রাহা কিছু বলতে না দিয়ে বলল

আপনি যান। উনার সাথে আমার কথা আছে।

রিকশাচালক চলে গেল। রাহা রাস্তায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর ইশারা করতেই গাড়িটি শব্দ তুলে থামলো। রাহা তেড়ে গেল জানালার কাছাটাই। রোস্তম চোখে পড়া চশমা খুলে হাতে নিল। হেসে বলল

পথ আটকালেন দেখে ভালোই লাগলো সারাহ।

রাহার চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে যেন।

বিয়ে করবেন সেটা ঢোল পিটছেন? লোকদেখানো কদর করতে কে বলেছে আপনাকে? কেই বা বলেছে আমি আপনাকে বিয়ে করব? রাস্তাঘাটে ঢং না করলে চলে না? পুরুষমানুষ অন্তত এসব করলে মানায় না।

একদমে কথাগুলো বলে থামলো রাহা।

রোস্তম জানালার কাচে হাত বসিয়ে মুখ ঠেকালো। হেসে উড়িয়ে বলল

আহা এত রাগ করছেন কেন? হবু বউকে দেখে রাখার একটা দায়িত্ব আছে নাকি? আর দুটো মাস তো আমার তর সইছেনা। এত সময় কেন নিচ্ছেন বলুন তো।

দুটো মাস কেন? দুইশ বছরেও আপনার এই অপেক্ষা ফুরোবেনা। ছ’টা মাস আমি আব্বাকে সময় দিয়েছি। আপনাকে না। আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে, হতে পারে এটা ভুলেও ভাববেনা। যদি ভেবে থাকেন তাহলে বলব আপনি স্বপ্ন দেখছেন। যে স্বপ্ন কখনো সত্যি হবে না। আপনার মতো বিশ্বাসঘাতক কারোও স্বামী না হোক।

রাহা আর দাঁড়াতে চাইলো না। যাওয়ার আগে রোস্তম ডাক দিল।

দাঁড়ান। কেন বিশ্বাসঘাতল বললেন? বলে যান সারাহ।

রাহা ঘাড় ঘুরালো। একবার গেইটের দিকে তাকালো। আরেকবার রোস্তমের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল

বুঝতে পারছেন না কেন বলছি? আমার সামনে একদম ঢং করবেন না।

রাহার চোখমুখ দেখে ভড়কে গেল রোস্তম। মিহি স্বরে বলল

আমি কি করেছি?

আপনি মেজর তাহমিদের কাছ থেকে আসা সমস্ত চিরকুট পুড়িয়ে ফেলেছেন। যেগুলো আমার কাছে আসার কথা ছিল। মনে পড়ছেনা? আপনি কি ভেবেছেন? আমি জানতে পারব না কিছু? আপনাকে উনি বিশ্বাস করেছেন।

রোস্তম এবার চমকে উঠলো। কথা ঘুরিয়ে বলল

তাতে কি যায় আসে? ও আপনাকে কেন চিঠি লিখবে? কি সম্পর্ক ওর সাথে আপনার? ভালো করেছি পুড়িয়ে ফেলে।

যেন ভাঙবে তবুও মচকাবে না সে।

রাহা রাগে কিছু বলতে পারলো না। বলল

আপনি সবকিছু জানেন। তারপরও বিয়ে বিয়ে করছেন। লজ্জা করেনা? দয়া করে আমার পিছু ছাড়েন। আব্বাকে বুঝান। আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব না। তার কারণটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? স্পষ্ট করে বলে দেওয়ার পরেও যদি আপনি আমার পেছনে পড়ে থাকেন তাহলে আমার কিছু করার নেই।

রোস্তম যেন আকাশ থেকে পড়লো।

গাড়ি থেকে নেমে এল সে।

মানে কি? তাহলে আপনি কেন ছ’মাস সময় নিলেন? কেন মিথ্যে বললেন? সারাহ দেখুন ওই মেজরের সাথে আপনার কিছু থাকতে পারেনা। কারণ ওরা আপনাদের শত্রু। কেসটাও আমি জানি। তাহলে কেন এসব বলছেন?

কে আমার শত্রু আর কে আমার মিত্র সেটা আপনাকে দেখতে হবেনা। আমি আপনাকে বিয়ে করব না । ব্যস।

আপনার আব্বাকে বলেছেন?

সেটা আমার ব্যাপার। সময় হলে ঠিকই বলব।

রোস্তম রক্তাক্ত চোখে চাইলো। বলল

আমি পৌঁছুতে দেব না আপনাকে ওই মেজরের কাছে। আমি অনেকদিন অপেক্ষা করেছি আপনার জন্য। আমার সাথে এটা অন্যায় হচ্ছে।

আমি এর চাইতেও বেশি অপেক্ষা করেছি মিস্টার রোস্তম। আর অন্যায়ের কথা বলছেন? সেটা আপনি করেছেন আমার সাথে। বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আপনি শাস্তি পাবেন। এতটা পাবেন যা কল্পনাও করতে পারছেন না। আজকের পর থেকে আর পিছু নেবেন না দয়া করে।

গটগট পায়ে হেঁটে গেইটে ঠেলে ঢুকতেই রাহা পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটাকে দেখে থমকে গেল। ঠোঁটের ফাঁক থেকে সিগারেট ফেলে খুকখুক করে কাশলেন আমজাদ সাহেব। রাহা মাথার কাপড় টেনে নিয়ে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। আমজাদ সাহেব গেইট ঠেলে বের হলেন। রোস্তম উনাকে দেখে হাঁফ ছাড়লেন। বললেন

আপনার মেয়ে দেখলেন…

আমি সব শুনেছি রোস্তম। ওই ছেলে আর কিছু লেখা টেখা পাঠালো নাকি?

না পাঠাইনি। ফোনও আসেনি । শুনলাম ভিআইপি কোর্সের জন্য এখন ইউএসএ আছে। আপনি একটা কথা বলুন তো সারাহ-র সাথে ওই মেজর তাহমিদের যোগাযোগ আছে?

আমজাদ সাহেব আরও একটি সিগারেট ধরালো। বলল

না। এটা সম্ভব না রোস্তম।

আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই ওই ছেলেকে…

বয়সের দোষ রোস্তম। বিয়েশাদি হলে ঠিক হয়ে যাবে। আমার মেয়েটার আর বয়স কত? তুমি ওসব ভেবোনা। আর দুটো মাস পর সব ঠিক হয়ে যাবে। বয়সের দোষে মানুষ ভুলচুক করে। সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।

কিন্তু দু মাস আগে যদি….

কিছু হবেনা রোস্তম। তুমি ওই ছেলের খোঁজখবর রাখো। এই গ্রামে যাতে ভুলেও ওই ছেলের পা না পড়ে। রাহাকে আমি আর ঢাকায় যেতে দিচ্ছিনা।

রোস্তম নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরলো। আর এদিকে বাড়িতে ঝামেলা লেগে গেল রাহাকে নিয়ে। তানজীবের চিঠি নিয়ে কেন এত উতলা হতে হবে তাকে এটা ভেবে পেলেন না আমজাদ কবির। উনার পরামর্শে যে রোস্তম সমস্ত চিঠি পুড়িয়েছে বাবার মুখে এমন স্বীকারোক্তির পরে সেটা রাহার জানতে সময় লাগলো না। তবে সেদিনের পর থেকে বন্ধ খাঁচায় পড়ে রইলো সে ঠিক ডানাকাটা বন্দী পাখিটার মতো। রাজিয়া বেগম আর মাহফুজা বেগম মেয়ের অমন রাগারাগি হম্বিতম্বি দেখে ছিঃ ছিঃ করে উঠলেন। এসবের কোনো মানে হয়? মেয়ে কি জানেনা ওই ছেলের সাথে কখনো তার যাবেনা? দুই পরিবার যে পরস্পরের কতখানি শত্রু সেটা কি ভুলে বসে আছে?

তারপর জানুয়ারির ঠিক মাঝামাঝি সময়ে এক অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এল রাহার কাছে। রাহা মেসেজটি দেখলো প্রায় দুদিন পর। এত দেরীতে মেসেজটি দেখে দম প্রায় বন্ধ হয়ে এল তার। কার মেসেজ ছিল সেটা বুঝতে সময় লাগলো না তার। তবে দেরীতে দেখায় নিজের উপর রাগ হলো। সুদীর্ঘকাল পর মরুভূমির বুকে বৃষ্টি যেমন প্রাণ নিয়ে আসে। চাতক যেমন প্রাণ ফিরে পায়। তার অপেক্ষা ফুরোয়। ঠিক তেমন ছোট কয়েকটা শব্দের মেসেজে রাহার মন খারাপের মেঘ দূর হয়ে গেল এক নিমেষে। সে বারবার পড়লো মেসেজটা। হাজার বার পড়লো। কানে বারবার বেজে উঠলো চেনাপরিচিত সেই গলার স্বর।

কেমন আছেন ম্যাডাম? আপনার ফোনটা ট্রেস করা হচ্ছে তাই খুব সাবধানে এই নাম্বার থেকে মেসেজ করা হচ্ছে। শ্বশুরআব্বা দেখি ভারী চালাক। সে যাইহোক, সরাসরি দেখা হবে আমাদের। খুব শীঘ্রই। কোনো মন খারাপ না। ওকে?

ইয়োর মেজর…

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here