#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১৯
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
কোকিলের কুহু কুহু ডাকে কল্লোলিত আর নব্য গাছের পাতায় সবুজাভ গ্রামের এপ্রান্তর থেকে ওপ্রান্তর। শীতের প্রকোপ কমেছে অনেক আগেই। বসন্ত এসেছে সে কবে। কোকিলের কুহু কুহু ডাকে মাতাল বাড়ির আঙিনা।
সবুজ কচি গাছের পাতায় আর মাঠ ভরা ফসলে সেজে উঠেছে গ্রামবাংলা। কালো পিচঢালা রাস্তা কৃষ্ণচূড়ার লাল গালিচায় রাঙানো। স্কুল মাঠের মোড়ে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটি বেশ নজরকাঁড়া। স্কুল পড়ুয়া ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েগুলো ফুলের পাপড়ি কুড়ায়। লাল গালিচায় হাঁটে আনন্দ করে। প্রকৃতির এমন অপরূপ সাজে মুগ্ধ হয় রাহা। ভাবতে থাকে কয়েক মাস আগের কুয়াশা মাখানো কনকনে শীতে গভীর পাহাড়ি জঙ্গলে সেই আর্মি ক্যাম্পিংয়ে কাটানো মুহূর্তগুলো । অমন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা স্বপ্ন স্বপ্ন মুহূর্তগুলো অবচেতন মন আবারও ফিরে পেতে চায় । মাঝেমধ্যে ভীষণ অবাক হয় সে, ভয়ে আতঙ্কে দমবন্ধ হয়ে আসে এই ভেবে তার পরিবার যেটা ভাবতেও পারেনা এমন একটা কাজ সে করে বসেছে। যেদিন সত্যিটা জানাজানি হবে সেদিন কি হবে?
যদিও ওইদিন নোরাদের সাথে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পর আনতারা বেগম আর রোহিনীর কড়া প্রশ্নের কবলে পড়েছিল রাহা। নোরা আর অধীর কত ভুল চুং করে পরিস্থিতিটা সব সামলে নিল সেটা শুধু তারা জানে। বাবার কথা ছাড়া এক পাও না বাড়ানো মেয়েটা এত বড় কাজ করে বসলো তা ভাবতে রাহার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। বুক ভার হয়। এই পরিবার আর ওই পরিবারের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সংঘাতের কথা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। কোথায় এর শেষ সে জানেনা? সে কেবল দিন গুনছে।
তিনটা মাস পেরিয়ে গেছে। ঢাকায় সে আর যায়নি এরমধ্যে। কিছুদিন আগে নোরার শরীর খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাই আমজাদ কবির আর আশরাফ গিয়েছিল দেখতে। এবং নিয়ে এসেছিল সুসংবাদ। আরও একজন নতুন মেহমান আসতে চলেছে রায়হানি ভিলায়। নোরা রাহাকে যেতে বললে আমজাদ কবির কি ভেবে মেয়েকে যেতে দিলেন না। বরং আশ্বাস দিয়ে আসলেন নোরাকে তিনি গ্রামে নিয়ে আসবেন কয়দিনের জন্য। কিন্তু আসবে আসবে করে নোরার আসা হলো না। ওই বাড়ির কেউ নোরাকে এ মুহূর্তে জার্নি করতে দিতে রাজী নয়। তাই আর কারো দেখা হয়নি।
মিনার সাথে ফোনে কয়েক বার ফোনালাপ হয়েছিল রাহার। তার মাধ্যমে রাহা জানতে পেরেছে তানজীবের ট্রেনিংয়ের সময়কাল সাড়ে চার মাসের মতো। খুবই কড়া এই প্রশিক্ষণ রাত দিন একাকার করে প্রশিক্ষণে মজে থাকতে হয়। এতে করে সকল যোগাযোগ আপাততপক্ষে বন্ধ রাখা হয়। যদিও বেশ কয়েকবার মিনার ফোনে ফোন এসেছিল তানজীবের গভীর রাতে । সেই দুই কি তিন মিনিটের মতো কথাবার্তা। মিনার নিজের খেয়াল রাখার, বাড়ির সকলের অবস্থা জানা আর ওই জয়পুর গ্রামে বিয়ে করা বউয়ের খোঁজখবর নেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এতটুকু সময়ে রাহা এবার ঠিকই বুঝতে পেরেছে মেজর সত্যিই বলেছে আর দশজনের মতো স্বাভাবিক একটা সংসার তার হবেনা। এজন্যই কি নিজেকে অসামাজিক বলেছিলেন তিনি? কিন্তু রাহা তারপরও স্বপ্ন দেখে। ছোট্ট সাজানো গোছানো একটা সংসার তারও হবে। স্বপ্ন দেখতে বারণ কোথায়?
আনমনে ভাবতে ভাবতে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে রাহা। আজ হেঁটে যাওয়ার মুরোদ নেই। সকাল থেকেই গায়ে জ্বর জ্বর ভাব। ইতোমধ্যে কয়েকবার ফোন এসেছে বাড়ি থেকে যাতে দ্রুত সে বাড়ি ফেরে। মিনিট খানেকের ভেতর রিকশা এসে থামলো রাহার সামনে।
আপা যাইবেন?
রাহা মাথা দুলালো। রোদ ছাতা বন্ধ করতে করতে বলল
হ্যা।
রিকশা একটানে বাড়ির গেইটের কাছে নিয়ে আসলো। রাহা ভাড়া দিতে গেলে চালক নিল না। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু পিছু আসা একটা গাড়িকে দেখিয়ে বলল
স্যারের বারণ আছে আপা। টাকা নিতে পারতাম না।
রাহা গাড়িটার দিকে তাকালো।
কে উনি?
পুলিশ আপা। বলছে টাকা না নিতে। আমারে টাকা দিয়া দিছে।
দশ টাকা ভাড়া দিয়ে উনি নিজেকে কি মনে করছে? ঢং করার জায়গা পায় না? অসহ্য!
আপনি তার হবু বউ…
রাহা কিছু বলতে না দিয়ে বলল
আপনি যান। উনার সাথে আমার কথা আছে।
রিকশাচালক চলে গেল। রাহা রাস্তায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর ইশারা করতেই গাড়িটি শব্দ তুলে থামলো। রাহা তেড়ে গেল জানালার কাছাটাই। রোস্তম চোখে পড়া চশমা খুলে হাতে নিল। হেসে বলল
পথ আটকালেন দেখে ভালোই লাগলো সারাহ।
রাহার চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে যেন।
বিয়ে করবেন সেটা ঢোল পিটছেন? লোকদেখানো কদর করতে কে বলেছে আপনাকে? কেই বা বলেছে আমি আপনাকে বিয়ে করব? রাস্তাঘাটে ঢং না করলে চলে না? পুরুষমানুষ অন্তত এসব করলে মানায় না।
একদমে কথাগুলো বলে থামলো রাহা।
রোস্তম জানালার কাচে হাত বসিয়ে মুখ ঠেকালো। হেসে উড়িয়ে বলল
আহা এত রাগ করছেন কেন? হবু বউকে দেখে রাখার একটা দায়িত্ব আছে নাকি? আর দুটো মাস তো আমার তর সইছেনা। এত সময় কেন নিচ্ছেন বলুন তো।
দুটো মাস কেন? দুইশ বছরেও আপনার এই অপেক্ষা ফুরোবেনা। ছ’টা মাস আমি আব্বাকে সময় দিয়েছি। আপনাকে না। আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে, হতে পারে এটা ভুলেও ভাববেনা। যদি ভেবে থাকেন তাহলে বলব আপনি স্বপ্ন দেখছেন। যে স্বপ্ন কখনো সত্যি হবে না। আপনার মতো বিশ্বাসঘাতক কারোও স্বামী না হোক।
রাহা আর দাঁড়াতে চাইলো না। যাওয়ার আগে রোস্তম ডাক দিল।
দাঁড়ান। কেন বিশ্বাসঘাতল বললেন? বলে যান সারাহ।
রাহা ঘাড় ঘুরালো। একবার গেইটের দিকে তাকালো। আরেকবার রোস্তমের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল
বুঝতে পারছেন না কেন বলছি? আমার সামনে একদম ঢং করবেন না।
রাহার চোখমুখ দেখে ভড়কে গেল রোস্তম। মিহি স্বরে বলল
আমি কি করেছি?
আপনি মেজর তাহমিদের কাছ থেকে আসা সমস্ত চিরকুট পুড়িয়ে ফেলেছেন। যেগুলো আমার কাছে আসার কথা ছিল। মনে পড়ছেনা? আপনি কি ভেবেছেন? আমি জানতে পারব না কিছু? আপনাকে উনি বিশ্বাস করেছেন।
রোস্তম এবার চমকে উঠলো। কথা ঘুরিয়ে বলল
তাতে কি যায় আসে? ও আপনাকে কেন চিঠি লিখবে? কি সম্পর্ক ওর সাথে আপনার? ভালো করেছি পুড়িয়ে ফেলে।
যেন ভাঙবে তবুও মচকাবে না সে।
রাহা রাগে কিছু বলতে পারলো না। বলল
আপনি সবকিছু জানেন। তারপরও বিয়ে বিয়ে করছেন। লজ্জা করেনা? দয়া করে আমার পিছু ছাড়েন। আব্বাকে বুঝান। আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব না। তার কারণটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? স্পষ্ট করে বলে দেওয়ার পরেও যদি আপনি আমার পেছনে পড়ে থাকেন তাহলে আমার কিছু করার নেই।
রোস্তম যেন আকাশ থেকে পড়লো।
গাড়ি থেকে নেমে এল সে।
মানে কি? তাহলে আপনি কেন ছ’মাস সময় নিলেন? কেন মিথ্যে বললেন? সারাহ দেখুন ওই মেজরের সাথে আপনার কিছু থাকতে পারেনা। কারণ ওরা আপনাদের শত্রু। কেসটাও আমি জানি। তাহলে কেন এসব বলছেন?
কে আমার শত্রু আর কে আমার মিত্র সেটা আপনাকে দেখতে হবেনা। আমি আপনাকে বিয়ে করব না । ব্যস।
আপনার আব্বাকে বলেছেন?
সেটা আমার ব্যাপার। সময় হলে ঠিকই বলব।
রোস্তম রক্তাক্ত চোখে চাইলো। বলল
আমি পৌঁছুতে দেব না আপনাকে ওই মেজরের কাছে। আমি অনেকদিন অপেক্ষা করেছি আপনার জন্য। আমার সাথে এটা অন্যায় হচ্ছে।
আমি এর চাইতেও বেশি অপেক্ষা করেছি মিস্টার রোস্তম। আর অন্যায়ের কথা বলছেন? সেটা আপনি করেছেন আমার সাথে। বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আপনি শাস্তি পাবেন। এতটা পাবেন যা কল্পনাও করতে পারছেন না। আজকের পর থেকে আর পিছু নেবেন না দয়া করে।
গটগট পায়ে হেঁটে গেইটে ঠেলে ঢুকতেই রাহা পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটাকে দেখে থমকে গেল। ঠোঁটের ফাঁক থেকে সিগারেট ফেলে খুকখুক করে কাশলেন আমজাদ সাহেব। রাহা মাথার কাপড় টেনে নিয়ে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। আমজাদ সাহেব গেইট ঠেলে বের হলেন। রোস্তম উনাকে দেখে হাঁফ ছাড়লেন। বললেন
আপনার মেয়ে দেখলেন…
আমি সব শুনেছি রোস্তম। ওই ছেলে আর কিছু লেখা টেখা পাঠালো নাকি?
না পাঠাইনি। ফোনও আসেনি । শুনলাম ভিআইপি কোর্সের জন্য এখন ইউএসএ আছে। আপনি একটা কথা বলুন তো সারাহ-র সাথে ওই মেজর তাহমিদের যোগাযোগ আছে?
আমজাদ সাহেব আরও একটি সিগারেট ধরালো। বলল
না। এটা সম্ভব না রোস্তম।
আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই ওই ছেলেকে…
বয়সের দোষ রোস্তম। বিয়েশাদি হলে ঠিক হয়ে যাবে। আমার মেয়েটার আর বয়স কত? তুমি ওসব ভেবোনা। আর দুটো মাস পর সব ঠিক হয়ে যাবে। বয়সের দোষে মানুষ ভুলচুক করে। সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।
কিন্তু দু মাস আগে যদি….
কিছু হবেনা রোস্তম। তুমি ওই ছেলের খোঁজখবর রাখো। এই গ্রামে যাতে ভুলেও ওই ছেলের পা না পড়ে। রাহাকে আমি আর ঢাকায় যেতে দিচ্ছিনা।
রোস্তম নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরলো। আর এদিকে বাড়িতে ঝামেলা লেগে গেল রাহাকে নিয়ে। তানজীবের চিঠি নিয়ে কেন এত উতলা হতে হবে তাকে এটা ভেবে পেলেন না আমজাদ কবির। উনার পরামর্শে যে রোস্তম সমস্ত চিঠি পুড়িয়েছে বাবার মুখে এমন স্বীকারোক্তির পরে সেটা রাহার জানতে সময় লাগলো না। তবে সেদিনের পর থেকে বন্ধ খাঁচায় পড়ে রইলো সে ঠিক ডানাকাটা বন্দী পাখিটার মতো। রাজিয়া বেগম আর মাহফুজা বেগম মেয়ের অমন রাগারাগি হম্বিতম্বি দেখে ছিঃ ছিঃ করে উঠলেন। এসবের কোনো মানে হয়? মেয়ে কি জানেনা ওই ছেলের সাথে কখনো তার যাবেনা? দুই পরিবার যে পরস্পরের কতখানি শত্রু সেটা কি ভুলে বসে আছে?
তারপর জানুয়ারির ঠিক মাঝামাঝি সময়ে এক অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এল রাহার কাছে। রাহা মেসেজটি দেখলো প্রায় দুদিন পর। এত দেরীতে মেসেজটি দেখে দম প্রায় বন্ধ হয়ে এল তার। কার মেসেজ ছিল সেটা বুঝতে সময় লাগলো না তার। তবে দেরীতে দেখায় নিজের উপর রাগ হলো। সুদীর্ঘকাল পর মরুভূমির বুকে বৃষ্টি যেমন প্রাণ নিয়ে আসে। চাতক যেমন প্রাণ ফিরে পায়। তার অপেক্ষা ফুরোয়। ঠিক তেমন ছোট কয়েকটা শব্দের মেসেজে রাহার মন খারাপের মেঘ দূর হয়ে গেল এক নিমেষে। সে বারবার পড়লো মেসেজটা। হাজার বার পড়লো। কানে বারবার বেজে উঠলো চেনাপরিচিত সেই গলার স্বর।
কেমন আছেন ম্যাডাম? আপনার ফোনটা ট্রেস করা হচ্ছে তাই খুব সাবধানে এই নাম্বার থেকে মেসেজ করা হচ্ছে। শ্বশুরআব্বা দেখি ভারী চালাক। সে যাইহোক, সরাসরি দেখা হবে আমাদের। খুব শীঘ্রই। কোনো মন খারাপ না। ওকে?
ইয়োর মেজর…
চলবে……..