#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনজঙ্গল। রাত্রিগভীর হওয়ায় থেকে বন্যপশুদের ডাক এবং হিংস্র কিছু অদ্ভুত আওয়াজের উৎপত্তিতে পাহাড়ি ভেজা সোঁদা গন্ধযুক্ত মাটিতে কয়েক মিনিটের জন্য লুটিয়ে পড়া মুখে নীল বাদামী রঙ মাখা, নাইট ভিশন গগলস, ব্যালিস্টিক হেলমেট, চোখ সুরক্ষা সরঞ্জাম, বুলেটপ্রুফ ভেস্ট সহিত জলপাই রঙা, সবুজ , খাকি,কালো আর মেরুন রঙের মিশেল ভারী পোশাক গায়ে শায়িত সেনাদের চোখে গভীর তন্দ্রা। ফুঁস ফুঁস করে শ্বাস ছাড়ছে শাকপাতা, শক্ত পোড়া রুটি খেয়ে সার্ভাইভাল মিশনে টিকিয়ে থাকা চার সেনা।
অন্য একজনের চোখে ঘুম নেই বিষপোকার কামড়ে আঘাতের যন্ত্রণায়। যতক্ষণ কাজে মগ্ন থাকে তখন খোঁজ নেই, কিন্তু বিশ্রামের বেলায় ব্যাথা যেন ছুটে আসে একপ্রকার। বিশ্রামের বিপরীতমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বিষপোকার কামড়ের ক্ষতগুলো।
যদি ও তন্দ্রা লেগেই আসছিল।
হঠাৎ বিকট শব্দে বাজপাখির মতো চোখ ছুটে গেল চোখের পলকেই। কানখাড়া করে যে অবস্থায় রয়েছে সেই অবস্থায় শুয়ে থাকলো সেনা কমান্ডো। নাকে এসে ঠেকলো বিশ্রী, বিষাক্ত, বাজে গন্ধ। কমান্ডো প্রস্তুত আসন্ন যুদ্ধের অপেক্ষায়।
পাহাড়ি ভেজা মাটি ও যেন কাঁপতে লাগলো সেই আগত আগন্তুকের পদধ্বনিতে।
দপ দপ দপ!
এক, দুই, তিন,
পরপর তিনটা সেকেন্ড।
গোঁৎ গোঁৎ ভয়ানক শব্দ তুলে হিংস্র মেটে রঙের সেই পশুটি ঝাঁপিয়ে পড়লো সেনা কমান্ডোর উপর।
ততক্ষণে বাকি সেনাদের চোখ ছুটে গিয়েছে। আকস্মিক আক্রমণে সবাই চমকালে ও তা দেখানোর জোঁ নেই। পাল্টা আক্রমণ চালানোর জন্য তৈরি হতেই লড়াইকারী কমান্ডো বজ্রগম্ভীর গলায় চিৎকার দিয়ে বলল,
এভরিওয়ান টু গো এওয়ে!
অন্য সেনা একজন বলে উঠলো
তানজীব সাবধান!
হিংস্র নেকড়ে ততক্ষণে নিজের চার ধারালো পা দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে কমান্ডোকে।
তার প্রকান্ড সুরৎের ভেতর কমান্ডোর হাতের বাহু।
গলার রগ টানটান হয়ে এল কমান্ডোর। যেন এক্ষুণি ছিঁড়ে যাবে। সবটা হালকা হয়ে যাবে।
আর ও প্রকান্ড আকারে হা করলো নেকড়েটি। এবার তার শিকারী দৃষ্টি কমান্ডোর গলার পাশটা। শিকারী জানে কোথায় তীর ছুঁড়তে হয়।
কিন্তু সে জানেই না তার চাইতে শক্তিশালী যোদ্ধার উপর হামলা চালিয়েছে সে । বোকা পশুটি প্রতিপক্ষকে খুবই দুর্বল ভেবে নিয়েছে। গলার পাশটাতে হিংস্র ধারালো দাঁত বসিয়ে দেওয়ার সময় কোমড়ের গাঁথা কমান্ডো নাইফ নিয়ে ঘ্যাঁচ করে গেঁথে গেল নেঁকড়ের গলার মাঝ বরাবর। চার পা দিয়ে আঁকড়ে ধরা, এবং আঁচড় কাঁটা কমান্ডোর শরীর থেকে আলগা হয়ে দূরে ছিটকে পড়লো সেই নেঁকড়ে গোৎ গোৎ শব্দ তুলে।
বাকি চার সেনা কমান্ডোর হর্ষধ্বনিতে ভয়ানক পরিবেশ আর ও ভয়ানক হয়ে এল। পশুটির নির্গত গরম ধোঁয়া উঠা রক্তের গন্ধ আর গায়ে লেপ্টে থাকা নেঁকড়ের বিভৎস পুঁতিগন্ধ নিঃসরণে পরপর দুইবার ঢোক উঠলো ভয়ানকভাবে আহত কমান্ডোর।
গল গল করে মুখ থেকে বেরিয়ে পড়লো রক্তবমি।
চার সেনা কমান্ডো তাকে দ্রুত তুলে নিয়ে জায়গাটি প্রস্থান করলো।
টাইম মেশিনে দেখলো আর আধঘণ্টার মতো। তাদের ট্রেনিংয়ের শেষ সময়।
এর আগে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
মৃত্যুকোলে ঢলে পড়া কমান্ডো ছটপট করতে করতে চোখ বুঁজে নেওয়ার ঠিক আগেই কানে এল নিজের নামটি
তানজীব!!!!
তারা এসেছিল সেনাবাহিনীর কমান্ডো ট্রেনিং এর শেষ সমাপ্তি টানার জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বন জঙ্গলে,, ট্রেনিং পিরিয়ড এর শেষের দিকে তাদের জঙ্গল সার্ভাইভাল মিশনে পাঠান হয় সুধুমাত্র একটা কমান্ডো নাইফ দিয়ে যেখানে এই কমান্ডোদের কে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম বিপদের সাথে লড়াই করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকতে হয়। যে সময় বন থেকে নিজের খাবার নিজেই যোগাড় করে নিতে হয়। অনেকটা নেভি সোয়াডস এর “হেল উইক” এর মতন এদের ও একটি নরকীয় যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা সম্বলিত সার্ভাইভাল মিশন টাইম কাটাতে হয় পাহাড়-পর্বতের গহীন অরণ্যে। যেটার প্রমাণ তারা করেছে ট্রেনিং পিরিয়ডের শেষ দিনটাতে এসে। ঝড়ে পড়ার গল্পে তাদের পাঁচ জনের নাম না লেখার জন্যই এত কষ্ট আর এত ত্যাগ তাদের।
যদি ও এরপর এয়ারবর্ন কোর্স, ড্রিল,কমান্ডো ড্রিল কমপ্লিট করা ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এক্সেরসাইজে বিভিন্ন দেশ এর স্পেশাল ফোর্স গুলোর সাথে অংশ নিতে হবে। এরই নাম প্যারা ব্যাটালিয়ন স্পেশাল ফোর্স কমান্ডো কোর্স।
প্যারা কমান্ডো কোর্স বা আর্মি কমান্ডো কোর্স বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কষ্টকর একটি প্রশিক্ষণ। সেনাবাহিনীর সকল আর্মস এবং সার্ভিস থেকে কেবলমাত্র স্বেচ্ছাসেবী অফিসার এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। এই প্রশিক্ষণ যেমন কঠোর তেমন ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রশিক্ষণের ব্যাপ্তিকালের ছয় মাসে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী কমান্ডোকে যেতে হয় শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রমের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি দিন যেন নরকের আগুনের মতো হয়ে ওঠে প্রশিক্ষণার্থী কমান্ডোর জন্য।
কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, অমানুষিক পরিশ্রম আর অবর্ণনীয় শারিরীক নির্যাতন সহ্যের পর তৈরি হন একজন কমান্ডো। কখনো নামতে হয় উত্তাল সাগরের অতল গহ্বরে, কখনো অসীম নীলাকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় নিচে, কখনো বা হাড় কাঁপানো শীতের রাতে লড়তে হয় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। ক্ষুধার তাড়নায় খেতে হয় অনেক অখাদ্য, সার্ভাইভাল ট্রেনিংয়ে গিয়ে লড়তে হয় নিজের ক্ষুধার্থ শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণুর সাথে।
ছয় মাসের নির্ঘুম রাত-দিনের হিসেব কমান্ডোদের থাকে না।
********
ভয়ানক সব সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে আরও এক মাস প্যারাট্রুপিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণের পর প্রশিক্ষণার্থী সেই দুর্লভ কমান্ডো সোনালী রঙের ব্যাজ পরিধান করার সময় প্রত্যেকটা বীভৎস মুহূর্তগুলো একের পর এক মনে করতে লাগলো কপাল, হাত কাঁধের একপাশ সাদা ব্যান্ডেজে মুড়িয়ে থাকা প্যারা স্পেশাল ফোর্স অফিসার মেজর তানজীব তাহমিদ। ঠোঁটের কোণায় তার বিজয়ের গর্বিত হাসি।
___________________
ঝাপসা সবুজ জলপাই রঙা আকাশ ছোঁয়া উঁচু বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা পাহাড়ের বুকে বাঁধহীন গড়িয়ে পড়া ঝর্ণার কলকল পানির শব্দ, পাখপাখালির কলকাকলি, পাহাড়ের নিজস্ব শব্দসুর, জনমানবের কোলাহল, বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ সবটা মিলিয়ে অভূতপূর্ব বিস্ময়কর একটা সুন্দর রাজ্য যেন।
দমকা হাওয়ায় সাদাটে শাড়ি পরিহিত কন্যার এলোকেশী চুল উড়ছে সাথে পটপট শব্দে দূরের তেরপাল জাতীয় কিছু একটা দোল খাচ্ছে । হইহই হাসি, সুরেলা বাঁশির আওয়াজ, কলকল পানির শব্দ, নয়ত শুকনো পাতার মড়মড় আওয়াজ, হিসহিস জাতীয় অদ্ভুত কিছু শব্দ, কোলাহল, কলতান সবকিছুকে চাপিয়ে গা ঘেঁষে কন্যার পেছনে কেউ এসে দাঁড়ালো। উড়ুক্কু শাড়ির আঁচল বলিষ্ঠ আঙুলের চাপের শিকার। ফুঁস করে কানের কাছে তপ্ত আগুনের লাভা ফেলে ভারী গমগমে গলায় ফিসফিস করে ডেকে উঠলো
প্রাণো…..
লক্ষ্মীটি!….
এলোকেশী কন্যা ঘাড় ঘুরালো চমকে উঠে । আঁচল টান পড়ায় বেশি ফিরতে পারলো না। যতটুকু পারলো ততটুকুতেই আবছা আবছা দেখতে পেল একটা সুকুমার শ্যামবরণ চেহারার বলিষ্ঠ এক পুরুষালী মুখাবয়ব। মুখের একটা পাশ ভয়ানকভাবে রক্তাক্ত। তার গভীর অন্তর্ভেদি দুটো চোখ। ঈষৎ খাঁড়া নাক। কালচে দুটো ঠোঁট । তপ্ত নিঃশ্বাসের আঁচড়ে ঝাঁজড়া হয়ে যাচ্ছে সব। তাপে বাষ্পীভূত হলো কন্যার কন্ঠনালীর জলকণা। শুকনো ঢোক আটকে থাকলো কন্ঠনালীতে।
★★★★★★★★
পরপর কয়েকবার শুকনো কয়েকটা ঢোক গিলে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে হাতড়াতে হাতড়াতে এক লাফ মেরে উঠে গেল মেয়েটি । ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল সে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে তার। বুকটা হাপড়ের ন্যায় উঠানামা করছে। ডান হাতটা বুকে চেপে ধরে জোরালো শ্বাস নিল সে। বিছানায় গোছগাছ করে তন্দ্রাচ্ছন্ন ঠিকই তারই মতো অনুরূপ একটি মেয়ে ঘুমোচ্ছে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
নরম পায়ে হেঁটে সে ঘরের জানালা খুলে দিল। সাথে সাথে শাঁ করে দমকা বাতাস এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল তার অল্পস্বল্প কাঁপতে থাকা স্থির, অচঞ্চল দেহের নধর। স্থির-কুহকী চাহনিযুক্ত সুরম্য, শঙ্কিত, আর নিকষ কালো উদ্বেগহীন দুটি চোখের তারা নিবদ্ধ বাড়ির পেছনকার পুকুরের টুইডুবুর দেওয়া মাছের পোনাদের উপর।
ঘনকৃষ্ণ সর্পিল ঢেউখেলানো এলোমেলো অবাধ্য চুলগুলো স্থানচ্যুত লতারাশির ন্যায় ঝুলে আছে, লেপ্টে আছে গলায়, বুকে, পিঠে। পড়নের সাদা ওড়না অবিন্যস্ত। বড় অংশটি লেপ্টে রইলো লাল মেঝেতে।
অন্ধকার ঘরে হঠাৎ আলো, বজ্রপাতের বিকট শব্দ, অন্যদিকে পাশে থাকা তপ্ত শরীরের উষ্ণতা না পেতেই একপ্রকার ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলো নোরা । জানালার কাছে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীকে দেখে কপালে ভাঁজ পড়লো তার।
বিছানা থেকে নেমে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির পেছনে গিয়ে কাঁধ ছুঁলো আলতো করে। একরকম ভড়কে গিয়ে ঘাড় ঘুরালো যুবতী। নোরা কপালে হাত দিয়ে বলল
জ্বর তো বেশি। তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বৃষ্টির ছাঁট লাগছে। চলে আয়।
বড় বোনের ধমকাধমকি যুবতীর চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
আব্বা আম্মাকে ডাকব? শরীর বেশি খারাপ লাগছে? মিথ্যে বলিস না ছোট।
সরু চিক্কণ একে অপরের সাথে এঁটে থাকা ঠোঁটজোড়া এবার আলগা হলো।
আ–আমি ঠিক আছি আপা।
নোরা খেয়াল করলো বোনের চোখ অসম্ভব লাল, জ্বলজ্বলে। হালকা হালকা কাঁপছে। বোনের থেমে যাওয়া সরা-উৎস থেকে শব্দহীন দরদর পানি গড়িয়ে পড়তেই দুহাত বোনের কপোলে রাখলো সে। চেপে মুছে দিতে দিতে কুটিল হাসি হেসে বলল
ওহ বাজে স্বপ্ন দেখেছিস!
চলবে,,,