#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_২
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
গ্রামের সম্মুখপথে তিনতলা সাদা রঙের যে বাড়িটা দেখা যায় সেটা আমজাদ চেয়ারম্যান বাড়ি। পাশেই বয়ে গেছে বড় রাস্তাটি। আকাশী রঙের প্রাচীরের মধ্যিখানে লোহার গেইট বাঁধানো জায়গাটা ঠেলে বাড়ির দিকে এগোনোর সময় চোখে পড়ে বাড়িটির কন্যাহস্তের গড়ে তোলা বাগান। নানা রকমের ফুলে বাড়ির আঙিনাটা ভরে আছে। সকাল বিকেলে সদ্য ফোঁটা ফুলের সুবাসে ম ম করে। ঘুরঘুর করে কয়েকটা পোষা মোরগ মুরগী। সোহ সোহ আওয়াজ করে বাড়ির বয়ঃজ্যোষ্ঠ জাহানারা খাতুন সারাক্ষণ তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। বিষ্ঠায় যে ভরিয়ে ফেলে উনার নাতনিদের পরিষ্কার ঝকঝকে করে রাখা উঠোনটা।
উঠোনের এককোনায় মাথার উপর ছাদ দেওয়া একটি মজলিশ খানা। চেয়্যারম্যান সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গ নিয়ে এই মজলিশখানায় বসে আলোচনা সাড়ে। ছোট কন্যার অপছন্দ বাড়ির ভেতরে বসে কূটনৈতিক আলোচনা করা। মোটকথা বাবা ভাইয়ের পেশাকেই সে আপাতদৃষ্টিতে বিরক্তির চোখে দেখে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। মাথার উপর খাঁ খাঁ করা রণচণ্ডী ধারণ করা সূর্যটির তেজ কমেছে। এবার গা এলিয়ে দিয়ে আহ্বান জানিয়েছে গোধূলিকে। তারপর নিস্তেজ গোধূলি ধীরে ধীরে গ্রাস হলো আঁধারিয়া কবলে। বিহঙ্গদের নীড়ে ফেরার দৃশ্য রোজ দেখে বাড়ির ছোট কন্যাটি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। তার ভালো লাগে এই ঘরে ফেরার দৃশ্যটা। মানুষকে তার কর্মশেষে নিজ নীড়ে ফিরতেই হয়। নিজ ঘর। নিজ বাড়ি। আপনরা থাকে যেথায় ।
ডাক ভেসে এল।
রাহা কোথায় রে তুই? তাড়াতাড়ি আয় ননদিনী। একা পারছিনা তো আমি ।
ভাইকন্যার মায়ের ডাক শুনে সারাহ ছুটে গেল ভাইয়ের ঘরে। ভাইয়ের বউ তারই মতো মেয়েটিকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। যার সাথে তার দুটো বছরের ব্যবধান। কিছুদিন পরেই যার বিয়ে।
এসেই দরজার দুই দিকে দুইহাত রেখে উঁকি দিল সে। ঘনকালো লম্বা সর্পিলাকার বেগুনি ফিতা দিয়ে বাঁধানো বেণুনীটা ঝুলে পড়লো সামনে।
সবাই ঘাড় ঘুরাতেই চমৎকার করে মিষ্টি হাসিটা হেসে সে বলল,
টিংটিং রে কোথায় তুই?
যাবি শ্বশুরবাড়ি?
পড়ে নতুন শাড়ি আর
চড়ে গরুর গাড়ি?
নোরার পাশেই বসা বাচ্চা মেয়েটির হাতে খাঁচার ভেতর ডানা ঝাপটালো বন্দী ছোট্ট কাকাতুয়া পাখিটা । সুর টেনে গাইলো
টিংটিং টিংটিং।
ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি খিলখিল সুরে হেসে উঠলো। বলল
চা..রা…আ ফিপপি
নোরাহ আর অন্তরা হেসে উঠলো।
__________________
মা বাবার মৃত্যুর পর বাবার বন্ধুর ঘরেই বেড়ে উঠা তানজীব আর তাহমিনা। যদি ও পিতৃনিবাসের নতুন চারতলা বিশিষ্ট ঘরটার কাজ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তোলা বাড়িটা।
সাজ্জাদ সাহেব আর তওহীদ তাহমিদ ছিলেন সম্পর্কে খালাতো ভাই আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মৃত্যুর সময় বন্ধুর হাতেই ছেলেমেয়ে দুটোকে তুলে দিয়ে যান তিনি।
সাজ্জাদ সাহেবের স্ত্রী তাহমিনা আর তানজীবকে সন্তান স্নেহে আদর যত্নে রেখেছেন এতগুলো বছর।
তানজীব ও নিরাপত্তার স্বার্থে বোনকে রেখে যায় এই বাড়িতে। সাজ্জাদ সাহেব আর খানসা বেগমের চোখে যে স্নেহস্পর্শ সে পেয়েছে তাতে সে নিশ্চিত বোনকে সে সঠিক জায়গায় রেখেছে। তারা তার বোনের অযত্ন করবে না।
শেখওয়াত নিবাসে তাদের কেটে গিয়েছে পনেরটি বছর। এতগুলো বছরে আত্মিক বন্ধনের সুঁতো অনেক মজবুত হয়েছে। শেকড় অনেকদূর চলে গিয়েছে । বাড়িটা এখন তাদের নিজের বাড়ি। নিজের পিতৃভিটায় তো যাওয়া হয় না তেমন। এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে তাহমিনা। এখানে তার একজন মা আছে। বাবার মতো ছায়াটি আছে। বড় বোন, ছোট বোন আছে। শাসন করার জন্য একজন আছেন।
আরও একজন আছে। যার চোখের মণি সে।
এমডি, এফসিপিএস, এমসিপিএস পাস হার্টসার্জন আজরাহান শেখওয়াত। সম্প্রতি ঢাকায় নামকরা একটি হাসপাতালে হার্টসার্জন হিসেবে চাকরিরত। আর কয়েকটা জেলায় চেম্বার আছে উনার। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া তাহমিনা বলতেই যে ভীষণ বেপরোয়া, ছন্নছাড়া এক পাগল প্রেমিক। সবার সামনে এরকম, আর তাহমিনার সামনে অন্যরকম এই পুরুষের ডাক আর আবদার অনুনয় তাহমিনা কভু ও ফেরাতে পারেনি। আজ ও পারেনা। এই যে কিছুদিন আগেই বাড়ির সকলের সামনে অমোঘ এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো সে। মায়ের অপছন্দ হবে জেনে ও।
বিয়ে করলে সে তাহমিনাকেই করবে। কেউ কি এর বিপক্ষে কথা বলতে পেরেছে। মা মনোয়ারা ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গেলেও ছেলের মুখের উপর কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারলেন না আজ অব্দি। এত এত মেয়ে থাকতে কেন ওই এতিমের উপর তার চোখ যাবে? এই শহরে কি মেয়ে পোড়া গিয়েছে? সুশিক্ষিত স্বশিক্ষিত ছেলেটাকে কি করে বুঝাবেন তিনি এই মেয়ে তার যোগ্য নয়।
কিন্তু শেষমেশ কি হলো? বিয়েটা কি আটকানো গেল?
খবরের কাগজটা হাতে রেখে অনেক্ক্ষণ ঘুরঘুর করেছিল আজরাহান। তাহমিনাকে ডেকে পাঠিয়েছে সেই কখন। তার আসার নামগন্ধ নেই। এ কেমন মেয়ে!
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল প্রায় আধঘন্টা পেরোতেই।
সানজু বলে ডাক দিতেই, খানসা বেগম ও সাজ্জাদ সাহেবের একমাত্র কন্যাটি ছুটে এল। বলল
আমি তো বলেছি। ও আসছে না। জেম্মা নাকি বকবে। আমি কি করব ভাইয়া?
ওকে এত পাকনামি করতে কে বলেছে? তাড়াতাড়ি আসতে বল।
বলেছি। মিনা আপা আমার কথা শুনছেনা।
রাহান এবার ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলো। আক্রোশে ফেটে পড়ে হনহনিয়ে গেল রান্নাঘরের উদ্দেশ্য। কষে যদি একটা চড় না বসায় ওই মেয়ের উপর।
খানসা বেগমের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল তাহমিনা। মনোয়ারা বেগম চাল ধুচ্ছিলেন বেসিনের পানিতে। রাহানকে সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। বউয়ের জন্য রান্নাঘর অব্দি চলে এল?
কিছু বলতে যাবে তখনই সে বলে উঠলো
মিনি বাইরে আয়।
তাহমিনা শান্ত গম্ভীর গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে ফিরে তাকালো।
কাজ শেষ হলে যাচ্ছি।
এক্ষুণি আসবি। দ্বিতীয় বার যদি বলতে হয় খবর আছে তোর।
খানসা বেগম বললেন
আরেহ যা তো। রাগাস না ওকে।
কিন্তু মণি! জেম্মা।
যাহ। কিছু বলবে না। আমি আছি।
তাহমিনা হাত মুছতে মুছতে বের হলো রান্নাঘর থেকে। রাহান হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ঘরের দিকে। মিনা বলল
এমন করছেন কেন? জেম্মা এসব পছন্দ করে না।
ঘরের ভেতর একপ্রকার হাতটা সহ মিনাকে ছুঁড়ে রাহান গর্জে বলল
তোকে ডেকেছি কখন?
মিনা কেঁপে উঠলো কচি কলাপাতাটির মতো। চোখের কোণা ভিজে উঠেছে প্রায়।
মিনি! মিনি কাঁদবি না খবরদার।
মিনা কথা শোনার অবস্থায় নেই। মাথা নামিয়েই ফেললো।
নিজের রাগ সংবরণ করে চুপচাপ স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো রাহান।
খবরের কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
খবরটা পড়। এটার জন্যই ডাকছিলাম।
আর্মি সেনার ছবি চোখে পড়ায় কাগজের পাতাটি একপ্রকার কেড়ে নিল মিনা। আর্মি পোশাক পরিহিত বাম দিকে মুখ ফেরানো গা ছমছমে নির্মম থমথমে চেহারার সেনা অফিসার কপালের কাছে হাতের পাঞ্জা খুলে তাকিয়ে রয়েছে কোনো একদিকে। টলটলে জলে ভরে উঠলো মিনার দু চোখ। কয়েকফোঁটা টপটপ ঝড়ে পড়লো শুকনো কাগজের পাতায়। গুনতে দেরী করলো না রাহান। ঝাপসা ঝাপসা চোখে মিনা পড়লো,
ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের হাতে র্যাংক ব্যাচ পরিধান করলেন প্যারা স্পেশাল কমান্ডো ফোর্স মেজর তানজীব তাহমিদ এনডিইউ, এনডিসি,পিএসসি।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো তথ্য।
কাগজটা বুকে জড়িয়ে ডুকরে উঠলো সে। ভাইয়ের বুকে যে এখন ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে তার। ভীষণ ছেলেমানুষী করতে ইচ্ছে করছে। ওইপাড়ে কেমন আছে তার ভাইটা? শুনেছে কোর্সটা করার সময় মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়।
কেন কাঁদছিস?
প্রশ্নটাই শোক আর ও বেড়ে গেল মিনার। রাহান এগিয়ে গিয়ে কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো।
আমি বকেছি বলে কাঁদছিস?
মিনা মাথা নাড়ালো। বুকে টেনে প্রিয়তমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাহান। বলল
আমি যে তোর ভাইকে কথা দিয়েছি তোকে কখনো কাঁদাবো না। সে এসে যদি দেখে তার বোন কাঁদছে।
মিনা শক্ত পুরুষ বাহুডোরে শুয়ে থেকে নাক টানতে টানতে বলল
দরজা খোলা। সানজু চলে আসবে।
আসুক। আমার প্রশ্নের উত্তর দে মিনি।
**********
সবে ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। কাকপক্ষীরা উঠছে ঘুম থেকে। সবুজ শ্যামলে মোড়ানো পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে বুক ফুলিয়ে। তারা কুয়াশায় মুড়িয়ে আছে। নিজেদেরকে স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলতে তাদের সময়ের প্রয়োজন।
কাঠপোড়ার গন্ধ, গমগমে গলার আওয়াজ, হাসি আর ফিসফিস শব্দ, মশমশ কশকশ শুকনো ঘাসের উপর বুট পড়া পায়ের আওয়াজ। পৎপৎ করে বাতাসের দমক হাওয়ায় উড়তে থাকা টেন্টের তেরপালের আওয়াজে ভারী উৎফুল্ল পরিবেশ।
অল্পবয়সী সিপাহিগুলো দলবেঁধে সমান্তরাল ভাবে দৌড়াচ্ছিল খোলা উন্মুক্ত মাঠে।
বলিষ্ঠ এক তাগড়া যুবককে খুবই নিগূঢ় ভঙ্গিতে
তীব্র বেগে ছুটে আসতে দেখে সবাই থমকে গেল।
মেজর স্যার আজ সবার আগে? তাদের কি দেরী হয়ে গেল তাহলে?
সবাই দাঁড়িয়ে সমান তালে পা ঠেকিয়ে হাত কপালের কাছে ঠেকাতেই মেজর স্যার মাথা নেড়ে দৌড়ে যেতে যেতে বলল
ক্যারি অন।
সবাই কথাটা কানে নিল ঠিক কয়েকটা সেকেন্ড পর। তাকিয়ে দেখছিল কেমন ভঙ্গিতে দৌড়ে যাচ্ছিল বলিষ্ঠ সেই কঠোর মানব। যেন রক্তে মাংসেই গড়া এক দানব সে। নেকড়ে সাথে ক্লান্ত দেহে লড়াইয়ের ঘটনা, কমান্ডো কোর্সের সব খুটিনাটি তারা জানতে পেরেছে অবশ্য। আর ভেতরে অদ্ভুত এক জেদ আর তেজ ফুসলিয়ে ফুসলিয়ে উঠছিল। রক্তে মাংসে গড়া মেজর স্যার যদি পারে তাহলে তারা পারবে না কেন?
চলবে,,,,