মন_নিয়ে_কাছাকাছি #পর্ব_২,০৩

0
289

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_২,০৩
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
০২

গ্রামের সম্মুখপথে তিনতলা সাদা রঙের যে বাড়িটা দেখা যায় সেটা আমজাদ চেয়ারম্যান বাড়ি। পাশেই বয়ে গেছে বড় রাস্তাটি। আকাশী রঙের প্রাচীরের মধ্যিখানে লোহার গেইট বাঁধানো জায়গাটা ঠেলে বাড়ির দিকে এগোনোর সময় চোখে পড়ে বাড়িটির কন্যাহস্তের গড়ে তোলা বাগান। নানা রকমের ফুলে বাড়ির আঙিনাটা ভরে আছে। সকাল বিকেলে সদ্য ফোঁটা ফুলের সুবাসে ম ম করে। ঘুরঘুর করে কয়েকটা পোষা মোরগ মুরগী। সোহ সোহ আওয়াজ করে বাড়ির বয়ঃজ্যোষ্ঠ জাহানারা খাতুন সারাক্ষণ তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। বিষ্ঠায় যে ভরিয়ে ফেলে উনার নাতনিদের পরিষ্কার ঝকঝকে করে রাখা উঠোনটা।

উঠোনের এককোনায় মাথার উপর ছাদ দেওয়া একটি মজলিশ খানা। চেয়্যারম্যান সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গ নিয়ে এই মজলিশখানায় বসে আলোচনা সাড়ে। ছোট কন্যার অপছন্দ বাড়ির ভেতরে বসে কূটনৈতিক আলোচনা করা। মোটকথা বাবা ভাইয়ের পেশাকেই সে আপাতদৃষ্টিতে বিরক্তির চোখে দেখে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। মাথার উপর খাঁ খাঁ করা রণচণ্ডী ধারণ করা সূর্যটির তেজ কমেছে। এবার গা এলিয়ে দিয়ে আহ্বান জানিয়েছে গোধূলিকে। তারপর নিস্তেজ গোধূলি ধীরে ধীরে গ্রাস হলো আঁধারিয়া কবলে। বিহঙ্গদের নীড়ে ফেরার দৃশ্য রোজ দেখে বাড়ির ছোট কন্যাটি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। তার ভালো লাগে এই ঘরে ফেরার দৃশ্যটা। মানুষকে তার কর্মশেষে নিজ নীড়ে ফিরতেই হয়। নিজ ঘর। নিজ বাড়ি। আপনরা থাকে যেথায় ।

ডাক ভেসে এল।

রাহা কোথায় রে তুই? তাড়াতাড়ি আয় ননদিনী। একা পারছিনা তো আমি ।

ভাইকন্যার মায়ের ডাক শুনে সারাহ ছুটে গেল ভাইয়ের ঘরে। ভাইয়ের বউ তারই মতো মেয়েটিকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। যার সাথে তার দুটো বছরের ব্যবধান। কিছুদিন পরেই যার বিয়ে।

এসেই দরজার দুই দিকে দুইহাত রেখে উঁকি দিল সে। ঘনকালো লম্বা সর্পিলাকার বেগুনি ফিতা দিয়ে বাঁধানো বেণুনীটা ঝুলে পড়লো সামনে।

সবাই ঘাড় ঘুরাতেই চমৎকার করে মিষ্টি হাসিটা হেসে সে বলল,

টিংটিং রে কোথায় তুই?
যাবি শ্বশুরবাড়ি?
পড়ে নতুন শাড়ি আর
চড়ে গরুর গাড়ি?

নোরার পাশেই বসা বাচ্চা মেয়েটির হাতে খাঁচার ভেতর ডানা ঝাপটালো বন্দী ছোট্ট কাকাতুয়া পাখিটা । সুর টেনে গাইলো

টিংটিং টিংটিং।

ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি খিলখিল সুরে হেসে উঠলো। বলল

চা..রা…আ ফিপপি

নোরাহ আর অন্তরা হেসে উঠলো।

__________________

মা বাবার মৃত্যুর পর বাবার বন্ধুর ঘরেই বেড়ে উঠা তানজীব আর তাহমিনা। যদি ও পিতৃনিবাসের নতুন চারতলা বিশিষ্ট ঘরটার কাজ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তোলা বাড়িটা।

সাজ্জাদ সাহেব আর তওহীদ তাহমিদ ছিলেন সম্পর্কে খালাতো ভাই আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মৃত্যুর সময় বন্ধুর হাতেই ছেলেমেয়ে দুটোকে তুলে দিয়ে যান তিনি।
সাজ্জাদ সাহেবের স্ত্রী তাহমিনা আর তানজীবকে সন্তান স্নেহে আদর যত্নে রেখেছেন এতগুলো বছর।
তানজীব ও নিরাপত্তার স্বার্থে বোনকে রেখে যায় এই বাড়িতে। সাজ্জাদ সাহেব আর খানসা বেগমের চোখে যে স্নেহস্পর্শ সে পেয়েছে তাতে সে নিশ্চিত বোনকে সে সঠিক জায়গায় রেখেছে। তারা তার বোনের অযত্ন করবে না।
শেখওয়াত নিবাসে তাদের কেটে গিয়েছে পনেরটি বছর। এতগুলো বছরে আত্মিক বন্ধনের সুঁতো অনেক মজবুত হয়েছে। শেকড় অনেকদূর চলে গিয়েছে । বাড়িটা এখন তাদের নিজের বাড়ি। নিজের পিতৃভিটায় তো যাওয়া হয় না তেমন। এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে তাহমিনা। এখানে তার একজন মা আছে। বাবার মতো ছায়াটি আছে। বড় বোন, ছোট বোন আছে। শাসন করার জন্য একজন আছেন।

আরও একজন আছে। যার চোখের মণি সে।

এমডি, এফসিপিএস, এমসিপিএস পাস হার্টসার্জন আজরাহান শেখওয়াত। সম্প্রতি ঢাকায় নামকরা একটি হাসপাতালে হার্টসার্জন হিসেবে চাকরিরত। আর কয়েকটা জেলায় চেম্বার আছে উনার। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া তাহমিনা বলতেই যে ভীষণ বেপরোয়া, ছন্নছাড়া এক পাগল প্রেমিক। সবার সামনে এরকম, আর তাহমিনার সামনে অন্যরকম এই পুরুষের ডাক আর আবদার অনুনয় তাহমিনা কভু ও ফেরাতে পারেনি। আজ ও পারেনা। এই যে কিছুদিন আগেই বাড়ির সকলের সামনে অমোঘ এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো সে। মায়ের অপছন্দ হবে জেনে ও।
বিয়ে করলে সে তাহমিনাকেই করবে। কেউ কি এর বিপক্ষে কথা বলতে পেরেছে। মা মনোয়ারা ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গেলেও ছেলের মুখের উপর কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারলেন না আজ অব্দি। এত এত মেয়ে থাকতে কেন ওই এতিমের উপর তার চোখ যাবে? এই শহরে কি মেয়ে পোড়া গিয়েছে? সুশিক্ষিত স্বশিক্ষিত ছেলেটাকে কি করে বুঝাবেন তিনি এই মেয়ে তার যোগ্য নয়।

কিন্তু শেষমেশ কি হলো? বিয়েটা কি আটকানো গেল?

খবরের কাগজটা হাতে রেখে অনেক্ক্ষণ ঘুরঘুর করেছিল আজরাহান। তাহমিনাকে ডেকে পাঠিয়েছে সেই কখন। তার আসার নামগন্ধ নেই। এ কেমন মেয়ে!

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল প্রায় আধঘন্টা পেরোতেই।

সানজু বলে ডাক দিতেই, খানসা বেগম ও সাজ্জাদ সাহেবের একমাত্র কন্যাটি ছুটে এল। বলল

আমি তো বলেছি। ও আসছে না। জেম্মা নাকি বকবে। আমি কি করব ভাইয়া?

ওকে এত পাকনামি করতে কে বলেছে? তাড়াতাড়ি আসতে বল।

বলেছি। মিনা আপা আমার কথা শুনছেনা।

রাহান এবার ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলো। আক্রোশে ফেটে পড়ে হনহনিয়ে গেল রান্নাঘরের উদ্দেশ্য। কষে যদি একটা চড় না বসায় ওই মেয়ের উপর।

খানসা বেগমের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল তাহমিনা। মনোয়ারা বেগম চাল ধুচ্ছিলেন বেসিনের পানিতে। রাহানকে সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। বউয়ের জন্য রান্নাঘর অব্দি চলে এল?

কিছু বলতে যাবে তখনই সে বলে উঠলো

মিনি বাইরে আয়।

তাহমিনা শান্ত গম্ভীর গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে ফিরে তাকালো।

কাজ শেষ হলে যাচ্ছি।

এক্ষুণি আসবি। দ্বিতীয় বার যদি বলতে হয় খবর আছে তোর।

খানসা বেগম বললেন

আরেহ যা তো। রাগাস না ওকে।

কিন্তু মণি! জেম্মা।

যাহ। কিছু বলবে না। আমি আছি।

তাহমিনা হাত মুছতে মুছতে বের হলো রান্নাঘর থেকে। রাহান হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ঘরের দিকে। মিনা বলল

এমন করছেন কেন? জেম্মা এসব পছন্দ করে না।

ঘরের ভেতর একপ্রকার হাতটা সহ মিনাকে ছুঁড়ে রাহান গর্জে বলল

তোকে ডেকেছি কখন?

মিনা কেঁপে উঠলো কচি কলাপাতাটির মতো। চোখের কোণা ভিজে উঠেছে প্রায়।

মিনি! মিনি কাঁদবি না খবরদার।

মিনা কথা শোনার অবস্থায় নেই। মাথা নামিয়েই ফেললো।

নিজের রাগ সংবরণ করে চুপচাপ স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো রাহান।

খবরের কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

খবরটা পড়। এটার জন্যই ডাকছিলাম।

আর্মি সেনার ছবি চোখে পড়ায় কাগজের পাতাটি একপ্রকার কেড়ে নিল মিনা। আর্মি পোশাক পরিহিত বাম দিকে মুখ ফেরানো গা ছমছমে নির্মম থমথমে চেহারার সেনা অফিসার কপালের কাছে হাতের পাঞ্জা খুলে তাকিয়ে রয়েছে কোনো একদিকে। টলটলে জলে ভরে উঠলো মিনার দু চোখ। কয়েকফোঁটা টপটপ ঝড়ে পড়লো শুকনো কাগজের পাতায়। গুনতে দেরী করলো না রাহান। ঝাপসা ঝাপসা চোখে মিনা পড়লো,

ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের হাতে র‍্যাংক ব্যাচ পরিধান করলেন প্যারা স্পেশাল কমান্ডো ফোর্স মেজর তানজীব তাহমিদ এনডিইউ, এনডিসি,পিএসসি।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো তথ্য।

কাগজটা বুকে জড়িয়ে ডুকরে উঠলো সে। ভাইয়ের বুকে যে এখন ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে তার। ভীষণ ছেলেমানুষী করতে ইচ্ছে করছে। ওইপাড়ে কেমন আছে তার ভাইটা? শুনেছে কোর্সটা করার সময় মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়।

কেন কাঁদছিস?

প্রশ্নটাই শোক আর ও বেড়ে গেল মিনার। রাহান এগিয়ে গিয়ে কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো।

আমি বকেছি বলে কাঁদছিস?

মিনা মাথা নাড়ালো। বুকে টেনে প্রিয়তমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাহান। বলল

আমি যে তোর ভাইকে কথা দিয়েছি তোকে কখনো কাঁদাবো না। সে এসে যদি দেখে তার বোন কাঁদছে।

মিনা শক্ত পুরুষ বাহুডোরে শুয়ে থেকে নাক টানতে টানতে বলল

দরজা খোলা। সানজু চলে আসবে।

আসুক। আমার প্রশ্নের উত্তর দে মিনি।

**********

সবে ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। কাকপক্ষীরা উঠছে ঘুম থেকে। সবুজ শ্যামলে মোড়ানো পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে বুক ফুলিয়ে। তারা কুয়াশায় মুড়িয়ে আছে। নিজেদেরকে স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলতে তাদের সময়ের প্রয়োজন।
কাঠপোড়ার গন্ধ, গমগমে গলার আওয়াজ, হাসি আর ফিসফিস শব্দ, মশমশ কশকশ শুকনো ঘাসের উপর বুট পড়া পায়ের আওয়াজ। পৎপৎ করে বাতাসের দমক হাওয়ায় উড়তে থাকা টেন্টের তেরপালের আওয়াজে ভারী উৎফুল্ল পরিবেশ।

অল্পবয়সী সিপাহিগুলো দলবেঁধে সমান্তরাল ভাবে দৌড়াচ্ছিল খোলা উন্মুক্ত মাঠে।

বলিষ্ঠ এক তাগড়া যুবককে খুবই নিগূঢ় ভঙ্গিতে
তীব্র বেগে ছুটে আসতে দেখে সবাই থমকে গেল।

মেজর স্যার আজ সবার আগে? তাদের কি দেরী হয়ে গেল তাহলে?

সবাই দাঁড়িয়ে সমান তালে পা ঠেকিয়ে হাত কপালের কাছে ঠেকাতেই মেজর স্যার মাথা নেড়ে দৌড়ে যেতে যেতে বলল

ক্যারি অন।

সবাই কথাটা কানে নিল ঠিক কয়েকটা সেকেন্ড পর। তাকিয়ে দেখছিল কেমন ভঙ্গিতে দৌড়ে যাচ্ছিল বলিষ্ঠ সেই কঠোর মানব। যেন রক্তে মাংসেই গড়া এক দানব সে। নেকড়ে সাথে ক্লান্ত দেহে লড়াইয়ের ঘটনা, কমান্ডো কোর্সের সব খুটিনাটি তারা জানতে পেরেছে অবশ্য। আর ভেতরে অদ্ভুত এক জেদ আর তেজ ফুসলিয়ে ফুসলিয়ে উঠছিল। রক্তে মাংসে গড়া মেজর স্যার যদি পারে তাহলে তারা পারবে না কেন?

চলবে,,,,

#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_৩
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

শ্যামকালো ঘর্মাক্ত চেহারাটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সাদা পাঞ্জাবির নিচে দেহ আচ্ছাদিত সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিটাসহ সাদা পাতলা পাঞ্জাবি পিঠে লেপ্টে রয়েছে। কপালের কাছটায় পড়ে রয়েছে কয়েকটা ভেজা অবহেলিত চুল। মাংসল কব্জিতে সিলভার রঙের ঘড়িটি রোদের আলো পড়ায় ঝকঝকে দেখাচ্ছে।

বিশিষ্ট তরুণ সমাজসেবক আজমীর রায়হানের দ্বিতীয় পুত্র অধীর রায়হান পিতৃকুলের রেস্টুরেন্ট ব্যবসার দেখাশোনা করেন সমাজসেবা আর রাজনৈতিক কাজকর্মের পাশাপাশি । শহরের অলি গলিতে ছোটবড় রেস্টুরেন্টগুলো ওনাদের। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা আর ও কয়েকটি জেলায় কাপড়ের দোকান রয়েছে। সেগুলো ও তারই তত্ত্বাবধানে চলছে বর্তমানে । নিজ কাজ করার পর সময় বের করে সেগুলো দেখাশোনা করেন অধীর রায়হান। মা জননী তার সমাজসেবা তথা রাজনৈতিক কাজকর্ম বেশ অপছন্দ করেন বিধায় ইদানীং তিনি খেয়াল করেছেন ব্যবসার দেখাশোনা শুরু করে মাকে আপাততপক্ষে চুপ করা্ দরকার। এতে যেমন পিতৃব্যবসার মঙ্গল বয়ে আনবে অন্যদিকে মায়ের দুশ্চিন্তা তথা ঘরে যেতে না যেতেই মায়ের খ্যাটখ্যাটানি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

অধীর ভাই ম্যানাজার সাহেব হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছে। কোনো সমস্যা না। সব ঠিকঠাক।

দূর থেকে হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলে ডেকে বলল অধীরকে।

ঠিক আছে। চলে আয়। বাড়িতে কয়েকটা পায়েসের বাটি পাঠিয়ে দে। আম্মা খেতে চাইলো। তোর যা লাগে নিয়ে বাড়ি চলে যাহ। সন্ধ্যে সন্ধ্যে চলে আসিস। আমার মার্কেটের দিকে যেতে হবে।

মার্কেটে কেন ভাই?

অধীর ধৈর্য হারা গলায় বলল

এত প্রশ্ন করিস কেন? যেটা বলছি সেটা কর। আমি তোর কথার জবাব দেওয়ার জন্য বসে আছি শালা ?

বজ্রগম্ভীর স্বরে কথাটা বলে চোখগরম করে চাইলো সে। যেন এটুকু বলতেই মহাবিরক্ত হয়ে উঠেছে সে।

সুড়সুড় করে হাঁটা ধরলো রবিন নামের অল্পবয়সী ছেলেটি। অধীর ভাই হুটহাট রেগে যায় কেন কিছুই বুঝে পায় না সে।

ফোনের দোকানে ভীড়। কোলাহল। কয়েকজন দোকানি তাকে দেখে ডাকা শুরু করলো

আরেহ, অধীর ভাই যে! কি খবর ভাই? এদিকে আসেন। ও অধীর ভাই!

অধীর হাত দেখিয়ে শান্ত হতে বলে ফোন কানে দিয়ে অন্যপথে বারংবার হাঁটতে লাগলো।

পরপর কয়েকবার রিং হতে হতে হতে ফোন কেটে গেল। তারপর কয়েক মিনিট অনবরত ফোনকল যাওয়া ফোনটির অপরপ্রান্ত থেকে রিনরিনে গলার স্বরটি ভেসে এল।

আসসালামু আলাইকুম। সরি লেট হওয়ায়। রাহা ফোন ধরছিল না। ওর নাকি লজ্জা করে আপনার সাথে কথা বলতে। আমি কাপড় শুকোতে গিয়েছিলাম ছাদে।

ওয়ালাইকুমুস সালাম। কিন্তু এত লজ্জা পেলে কি করে চলবে রাহার? পাশে আছে?

নোরাহ সারাহ’র দিকে ফিরে তাকালো। ইশারায় বলল

তোর সাথে মেবি কথা বলতে চাই।

সারাহ দূরে পিছিয়ে গেল।

এই না না। আমি কথা বলব না। তোর বরের সাথে আমার কিসের কথা?

কি ফিসফিস করছেন দুজন?

নোহা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল

সরি। ওকে বলছিলাম কথা বলতে।

হ্যা ফোনটা দিন। এত লজ্জা পেলে চলবে না।

নোরাহ হেসে বলল

থাক বাদ দিন। ও কথা বলবে না। দূরে চলে গেছে।

আচ্ছা আমি ফোনের শোরুমে আছি। কোন ফোনটা পাঠাবো? নইলে রাহাকে বলতে বলুন। কুইকলি বলুন।

নোরাহ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো এত তাড়া হলে কে বলল আসতে? কালকে যে ছবি পাঠিয়েছিল শাড়ি পড়ে তারপর তো কিছুই বলল না। কেমন মানুষ!

নোরাহ চুপ করে থাকলো আলতো অভিমানে।

লাগবে না বলেছিলাম আপনাকে। আমার এখন ফোন চাই না। যেটা আছে সেটাই যথেষ্ট।

আপনি কি বলবেন কোন ফোনটা নিতে চান?

ঠান্ডা গলায় কাঠ কাঠ আদেশী সুর।

নোরা চুপ থাকবেন না। নোরাহ!

বললাম তো ফোন চাই না আমার। আচ্ছা আমি আপনার সাথে গিয়ে কিনব। প্রমিজ।

পাক্কা?

একদম।

তারপর দু’পক্ষের আর কেউ কথা বলল না। অনেক্ক্ষণ পর নোরা মিনমিন করে বলল,

নেতা সাহেব যে পরিমাণ ব্যস্ত থাকেন !

ওপাশ থেকে দরাজ গলায় হাসি বের হয়ে এল। ততক্ষণে অধীর রিকশায় চেপে বসেছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে।

আম্মা আজকে সকালে ও একথা বলছিলেন। তোর বউ দুদিন ও থাকবে না।

নোরা হেসে উঠলো।

ঠিকই বলেছে।

আমি ভয় পাচ্ছিনা ম্যাডাম। দুদিন থাকবেন কি থাকবেন না সেটা পরের কথা। আমি আপনাকে দুদন্ড ও চোখের আড়াল হতে দিচ্ছি না। আমার সাধনার বউ।

ফোনটা সাথে সাথেই কেন যেন কেটে গেল। নোরাহ কি লজ্জা পেল?

সারাহ পেট চেপে হাসতে হাসতে বলল

বউ পাগল জামাই। হি হি।

নোরাহ তাকে হাতের ভেজা গামছা দিয়ে মারতে গেলে সারাহ দৌড়ে পালালো। দু বোনের ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে রইলো মেঝেতে বসে টিংটিংয়ের সাথে খেলা করা বাড়ির ছোট সদস্যটি।

নোরাহর ফোন কেটে দেওয়ার বিষয়টা অধীরের বুদ্ধিভর্তি মাথায় কিছুই ঢুকলো না।
বাড়িতে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই বাড়ির সবাই হামলে পড়লো যেন তার উপর।
মা এসে বললেন

কিরে অধীর? তুই নাকি তোর আব্বাকে বিয়ের দিনতারিখ নিয়ে কিছু বলিসনি? কেন? বিয়েটা কি তুই করবি না? ওই মেয়েকে বিয়ে করবি বলে তো অনেক লাফিয়েছিস এখন চুপ কেন?

অধীর সোফায় গিয়ে বসলো গা এলিয়ে। বলল,

আমার কোনো দোষ নেই আম্মা। সব দোষ আর্মি ম্যানের। রাহান আর ওকে ছাড়া আমি কোনো অকেশন নামাতে পারব না। সেটা তুমি ও জানো, আব্বা ও জানে। ও আসুক

বন্ধু সহোদরা অতঃপর বড় ভাইয়ের স্ত্রী রোহিনী এগিয়ে এল। বলল

অধীর ভাই, ভাইয়া তো আমাকে ফোন করেছিল সকালবেলা।
তানজীব ভাই নাকি কোন একটা অপারেশন শেষ হলেই চলে আসবে। আর কয়েকটা দিন বাকি। মিনা ও একই কথা বললো।

শালা বহুত জ্বালা জ্বালাচ্ছে। বিয়ে বিলম্ব করার অপরাধে আর্মি ম্যানকে কি শাস্তি দেওয়া যেতে পারে বলোতো ভাবি? চাচ্চু তুমি বলো।

রোহিনীর কোল থেকে চাচার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো চার বছরের বাচ্চাটি।

বলল

মারি মারি।

সবাই হেসে উঠলো তার কথায়। মা আনতারা হৈচৈ করে উঠে বললেন

আরেহ আরেহ গোসলে যাহ। আজান পড়ছে শুনছিস না?

_________________

গোসলটা সেড়ে ভেঁজা তোয়ালেটা বারান্দার রেলিঙে মেলে দিতেই খটখট পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিনা। সাদা এপ্রোণ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা চিকন ফ্রেমের চশমা পরিহিত সৌম্যদর্শন ডাক্তারকে দেখে চমকালে ও চেহারা তা না ফুটিয়ে মৃদুহেসে হাত বাড়িয়ে এপ্রোনটা আর ব্যাগটা নিয়ে বলল

এত তাড়াতাড়ি আজকে? কোনো সমস্যা?

কোনো সমস্যা না মিনি। বিয়ের পর তোকে তো বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা। আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর যাওয়া হয়নি। আজকে তোকে নিয়ে ঘুরতে যাব। যাবি?

নাহ।

বলেই ঘরের দিকে পা বাড়ালো মিনা।

কেন কেন?

মিনার পেছন পেছন ছুটলো রাহান।

যাবিনা কেন?

এপ্রোণটা সাদা দেয়ালের এপাশ থেকে ওপাশ দিয়ে টানা রশির উপর ঝুলিয়ে দিয়ে বলল

জেম্মা বকাবকি করবে। শুধু শুধু অশান্তি।

আরেহ আম্মার বয়স হচ্ছে তাই এরকম বকাবকি করে। তুই ওসব ধরে বসে থাকিস কেন? আমি যাব। তুই ও যাবি। কেমন?

বাচ্চাদের মতো আবদার! মিনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ঠোঁটের কোণায় হাসি টেনে বলল

নাহ।

কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে রইলো রাহান। মিনা হেসে উঠলো।

চোখের চশমাটা খুলে নিতে নিতে বলল

অন্য একদিন। ভাইয়া আসুক। তারপর সবাই মিলে বেড়াতে যাব।

সে তো সবাই মিলে। আজ তোকে একা নিয়ে যাব। যাবই যাব।

চশমাটা নিয়ে চলেই যাচ্ছিল মিনা। রাহান আষ্টেপৃষ্টে বাহুডোরে বেঁধে নিল তার কোমর । মিনার পা হালকা মেঝে থেকে একটু উপরে উঠে গেল বটে।

টাল সামলতে না পেরে রাহানের গলা ঝাপটে ধরে মিনমিন করে আতঙ্কিত গলায় বলল

কি করছেন? দরজাটা খোলা।

দু বাহুর চাপ দিল রাহান। গালে নাক ঘষে বলল

যাবি বল। বল বল।

উহু। ছাড়েন। উফফ। আল্লাহ কেউ আসলে কি হবে?

রাহান ছাড়লো না।

আর ও একটু তুলে নিয়ে দু পা হেঁটে গলার পাশে ঘন ভেজা চুলগুলোতে মুখ ডুবিয়ে বলল

যাব কেমন?

যাব বললে ছাড়বেন?

নাহ। যাব না বললে ও ছাড়ব না।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here