মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড় #পর্ব_২৯

0
223

#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_২৯
Tahrim Muntahana

গোধূলি বিকেল! সাড়ে পাঁচটার মতো বাজে হয়তো। নীল আকাশে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি! কিছুক্ষণ পর পর এক ফালি কালো মেঘ ভেসে যাচ্ছে অবলিলায়। হৃদানের চৌধুরী মেনশনে মানুষে গিজগিজ করছে। নিজের ঘরের বেলকনিতে বসে মেঘেদের খেলা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো হৃদান। আজ তার মনে যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে তা সারা দেশ জানবে! আজ সারা দেশকে দেখিয়ে দিবে হৃদান চৌধুরী ভালোবাসা! এতদিন সবাই তার নিষ্ঠরতা দেখেছে আজ ভালোবাসা দেখবে। ভালোবাসা যদিও প্রকাশের না! অনুভব করতে হয় কিন্তু সে আজ প্রকাশ করবে! হৃদান চৌধুরীর নিষ্ঠুরতার চেয়েও ভালোবাসার প্রখরতা বেশী সবাই দেখবে আজ! কথাগুলো ভেবেই হাতে রাখা ডায়েরিটার দিকে তাকালো হৃদান। নাহ তার ডায়েরি লেখার অভ‍্যাস কোনো কালেই নেই। তার হাতে আদরের ডায়েরী। যেখানে তার প্রতি ভালোবাসা, অনুভূতি গুলো স্থান পেয়েছে। মেয়েটা তাকে আগে থেকেই এতটা ভালোবাসে বুঝতেই পারেনি সে। ঠোঁট এলিয়ে হাসলো সে। এত খুশি কেন লাগছে তার! এই খুশি বেশীক্ষণ থাকবে তো? ভয়াবহ কোনো ঝড় না এলেই হয়!

বস সব কমপ্লিট! সময় হয়ে এসেছে যেতে হবে এখন।

পান্চুর কথায় হৃদান বেলকনি থেকে ঘরে এলো। দরজায় দাড়িয়ে হাক ছেড়ে কথা গুলো বলছিলো পান্চু। হৃদান সোফায় বসে চিন্তিত স্বরে বলে উঠে,

আচ্ছা পান্চু বাসর ঘরে আমি লজ্জা পাবো নাকি আমার বউ পাবে!

পান্চু কিছুক্ষণ টাশকি খেয়ে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

আপনাদের জামাই-বউ কারোর ই লজ্জা নেই। ড‍্যাং ড‍্যাং করে বাসর ঘরে ঢুকে পড়বেন। লজ্জা তো যা আছে সব আমার!

পান্চু দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো হৃদান। পান্চু কিছু বলছে না বলে বাঁকা হেসে বলে উঠলো,

বউয়ের কথা মনে পড়ছে আধা টাকু পান্চু কাকু!

পান্চু চমকে হৃদানের দিকে তাকালো। খেয়াল করলো তার পা কাঁপছে। পরক্ষণেই পান্চুর মুখটা একদম চুপছে গেলো। বস কি এখন তাকে শাট শাট করে গুলি করে দিবে? এখনো বাসর করতে পারলো না! পান্চুর মুখ দেখে হো হো করে হেসে দিলো হৃদান। হাসতে হাসতে বলে উঠলো,

যাও নিচে যাও ; তোমার বউ অপেক্ষা করছে!

পান্চু এবার ভয় পেয়ে গড়গড় করে বলে উঠলো,

সরি বস, আসলে কি হয়েছে। মেয়েটার তিনদিনের দেখার দিন যে বিয়ের জন‍্য জোর করবে কে জানতো। ব্ল‍্যাকমেইল করছিলো ইজ্জতহানী করে দিতো আমার। আপনি তো জানেন পান্চুর চরিত্র তার বসের মতোই পবিত্র! দাগ কি করে লাগতে দিই বলুন। তাই কোনো কিছু না ভেবেই কাজি অফসি গিয়ে বিয়ে করি। কাউকে জানায় নি। আপনার দেওয়া ফ্ল‍্যাটে আছে। সরি বস! এবারের মতো ক্ষমা করে দিন দ্বিতীয় বার আর ভুল হবে না। একমাস আগে জানিয়ে রাখবো!

পান্চুর শেষের কথা শুনেই হৃদান চোখ বড় বড় হয়ে এলো। এ ছেলে বলে কি? দ্বিতীয় বার ভুল হবে না মানে?

তুমি কি বিয়ে আরো করতে চাইছো নাকি?

না মানে আপনি অভয় দিলে করতাম!

বলেই পান্চু এক দৌড়। এখানে থাকলে তার টাক মাথার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যেত তাই তো কথাটা বলেই দিয়েছে দৌড়। হৃদান হাসতে হাসতে সোফায় বসে পড়ে। আজ অকারণেই এত হাসি পাচ্ছে তার।
দরজা লকের শব্দ আসতেই হাসি থেমে গেলো তার। কে এসেছে দেখতে চোখ তুলে তাকাতেই আপনাআপনিই তার চোখ বুজে এলো। রাগে চোখ লাল হয়ে গেলো মুহূর্তেই। হিয়া এসেছে। হাটুর উপর একটা প‍্যান্ট ; উপরে টি-শার্ট পড়ে এসেছে। হিয়া এসেই হৃদানের কোলের উপর বসে পড়লো। কিছু বুঝার আগেই হিয়া নিজের ফোনে ফটাফট কয়েকটা ছবি উঠিয়ে নিলো। হৃদান যেন কিছু বুঝতে পারলো না। যতক্ষণে বুঝতে পেরেছে ততক্ষণে অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। হিয়া বাঁকা হেসে ফোন হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। হৃদান হাসলো, বদ্ধ ঘরে বিকট শোনালো হাসিটা। হিয়া ভড়কে গেলো। বুক কাঁপছে তার। কতটা সাহস নিয়ে এসেছে একমাত্র সেই জানে। হৃদান দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

কয়েকটা ছবি দিয়ে কি প্রমাণ করতে পারবেন মিস হিয়া শিকদার?

অনেক কিছু! এই ছবি গুলা যদি এখন আপনার উডবির কাছে পাঠিয়ে দিই কি হবে বলুন তো? আ আ ভুল বুঝবে না? বিয়েটা ভাঙবে না?

হৃদান চমকে উঠলো। আদর এসব দেখে তাকে ভুল বুঝবে? বিয়েটা কি ভেঙে দিবে! কথাগুলো মনে হতেই হৃদানের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। আদরকে হারানোর ভয় ক্রমে ক্রমে যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। হৃদানের ভয়মিশ্রিত চাহনী দেখে হিয়ার সাহস যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। শব্দ করে হেসে বলে উঠলো,

রিলেক্স হৃদান ভাইয়া! আমি তো তোমার সাথে মজা করছিলাম। হৃদান চৌধুরীকে ভয় পেতে দেখতে কেমন লাগে সেটাই দেখছিলাম বাট নাহ ভালো লাগলো না আমার। তাই বলে দিলাম। সরি সরি আমার এমনটা করা উচিত হয়নি! ওভারএক্টিং হয়ে গেছে!

হৃদান হিয়ার কথায় অবাক হয়ে গেলো। এতক্ষণ হিয়া মজা করছিলো? মজা করার জন‍্য এরকম ড্রেস পড়ে তার সামনে আসবে? হৃদানের চাহনী দেখে হিয়া ইতস্তত করে বলে উঠলো,

আমি আসলেই মজা করছিলাম ভাইয়া। তুমি আর আদর আমাদের জন‍্য যা করেছো অনেক। তোমরা না থাকলে তো আমি, ভাইয়া এই দেশে টিকে থাকতেই পারতাম না! এটা ঠিক আমি তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু তোমাদের ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা কিছুই না! তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও নাহলে দেরী হয়ে যাবে।

হৃদানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো প্রাণ টা বুঝি উড়াল দিবে।
হিয়া মুচকি হেসে চলে গেলো।হৃদান খুশি মনে রেডি হতে গেলো। বিয়ের খুশিতে যেন তার মস্তিষ্ক টাও ডাউন হয়ে আছে। হিয়ার কথার জালে ভুলেই গেলো ফোনে এখনো সেই ছবি গুলো রয়ে গেছে।

আধা ঘন্টা পর পিয়াস হৃদানের দরজায় নক করলো। তখন সে শেরওয়ানি পড়ে পাগড়ি মাথায় দিয়ে বার বার আয়নায় নিজেকে দেখছিলো। কি সুন্দর লাগছে তাকে! আগে কখনো এভাবে আয়নায় নিজেকে দেখা হয়নি তার। আজ দেখছে সে; বিয়ের সাজে আদরের পাশে বেমানান লাগবে না তো! হাইরে ভালোবাসা! কতটা পরিবর্তন করে দেয় একটা মানুষকে; ভেতর কিংবা বাহির! পাগডি পড়েই পারফিউম স্প্রে করে ফোনটা নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সে। পিয়াস কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইলো। আজ সে অন‍্য হৃদান কে দেখছে। কতটা নিপুণ লাগছে! পিয়াসের হা করা মুখটা হালকা হেসে বন্ধ করে দিলো হৃদান। পিয়াস নিজেও হেসে বলে উঠলো,

বাহ! কি লাগছে জানু তোকে। আমার ই নজর লেগে যাচ্ছে। পাঞ্জাবি সাথে তোর বডিটা যা ফুটে উঠেছে না! আমি মেয়ে হলে নিশ্চিত তোকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম!

পিয়াসের কথায় হৃদান ঢং করে হাত দিয়ে নিজের বডি ঢেকে নিলো। মনে হচ্ছে লজ্জায় সে মরে যাচ্ছে। ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

নজর ঠিক কর শালে, বাই এনিচান্স তোর জেন্ডার পাল্টে যায়নি তো? খবরদার সাবধান আমার দিকে নজর দিস না; এসব আমার বউয়ের হোক। বাসর ঘরে বউ কে কি জবাব দিবো!

হৃদানের কথা শুনে পিয়াসের মাথায় হাত। এ ছেলে বলে কি? জেন্ডার চেন্জ হবে মানে? পরক্ষণেই কথার মানেটা মাথায় আসতেই কিছু বলতে নিবে সামনে তাকিয়ে দেখে হৃদান হাওয়া। বোকাবনে গেলো সে। মাথা চুলকে ভাবতে ভাবতে নিজেও নিচের দিকে চলল। ড্রয়িং রুমে আসতেই হৃদানের চোখে পড়লো পান্চু ফ্লোরে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। আর সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। হৃদান কে দেখেই সবাই কিছুটা সরে দাড়ালো। হৃদান বলে উঠলো,

রিলেক্স! আনন্দ করতে এসেছেন ; আমার বিয়ে জমিয়ে উপভোগ করুন। আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

হৃদানের কথায় সবাই কিছুটা স্বস্তি পেলো। নিজেদের মতো মজা করতে লাগলো তারা। হৃদান পান্চুর পায়ের কাছে এসে দাড়ালো। বসকে দেখেই পান্চু নাকে কান্না করে বলে উঠলো,

বস, আমি আপনার কোন জন্মের শত্রু। আমাকে এইভাবে ধোঁকা দিলেন। আমাকে না বলেই আমার, অনিচ্ছায় বিয়ে করা বউকে বিয়েতে নিয়ে চলে এলেন। এখন আমার কি হবে? এই মেয়ে শুধু আমার টাক মাথায় চুমু খায়। মানুষ দেখে না; যখন তখন আমার ইজ্জত লুটে নিবে!

পান্চুর কথায় হৃদান ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। সাথে সাথেই চারপাশ থেকে হাসির শব্দ জোরালো হলো। পান্চুর বউ একদম ফুসে উঠলো। নিজের প্রাইভেট কথা কিভাবে বলছে। হৃদান আরেকটু মজা করে বলে উঠলো,

শুধু তো টাক মাথায় চুমু খায়; আমি আমার বউকে যখন তখন লিপকিস করবো। বউ আমার; সবকিছুই যখন তখন হবে। আমার একটু প্রেম পেলেই হবে! শুধু কবুল টা বলতে দাও!

পান্চু হতাশ। কার কাছে কি বলছে? এই পৃদান চৌধুরী এখন ঠোঁট কাটা হয়ে গেছে; সে বউকে দেখে ভুলেই গিয়েছিলো। চারদিকের সবার মুখেই হাসি। খানিকটা অবাক ও হয়েছে হৃদান চৌধুরীর মুখে এমন কথা শুনে। হৃদান আর দেরী করলো না। সবাই কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।হিমেল পিয়াস এখানের সব এরেঞ্জমেন্ট করেছে। পান্চু সব দেখভাল করছে। হৃদান রা বের হতেই হিয়া হেলেদুলে বের হয়ে আসলো। মুখে তার লেগে আছে বাঁকা হাসি। লেহেঙ্গা পড়েছে সে। গিয়ে হৃদানের গাড়িতে বসতে যেতেই হৃদান বলে উঠলো,

মিস হিয়া আপনি পরের গাড়িতে উঠুন। এটাতে কেউ এলাউ না!

হিয়া মনে মনে অপমানিত হলেও মুখ ফুটে কিছু বললো না। হেসে মাথা দুলিয়ে পরের গাড়িতে উঠে বসলো। হিয়া যেতেই হৃদান হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এই গাড়িতে আদরের জন‍্য উপহার রয়েছে। পিয়াস কে ডাক দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজে নেমে পড়লো। মাথায় এখনো তার পাগড়ি! একটুর জন‍্যও খুলেনি। বাইকে উঠে বসতেই পিয়াস চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

পাগড়ি আমার কাছে দে হৃদান। হেলমেট পড়!

নো ওয়ে। পাগড়ি খোলা যাবে না। হেলমেট পড়বো না আজ!

হৃদানের কথায় পিয়াস আর কিছু বললো না। বলেও লাভ নেই। শুনবে না সে জানে। হৃদান বাইক স্টার্ট দেওয়া আগে পেছনে থাকা ফটোগ্রাফার দের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

প্রত‍্যেক স্টেপের শট চাই আমার। বাট কেউ আমার বউয়ের দিকে ভুল করেও ক‍্যামেরা ধরবেন না! ওটা আমার ব‍্যক্তিগত সম্পদ! আপনাদের সবার দিকেই আমার লোক নজর রাখবে খেয়াল থাকে যেন। ওই মেয়েটার ক্ষেত্রে আমি যেমন সবচেয়ে বেশী সফট তেমনি কিন্তু সবচেয়ে বেশি হিংস্র!

জোরে বলায় বিয়েতে আসা সবার কানেই কথাটা গিয়েছে। হৃদান চৌধুরীর ভালোবাসা সম্পর্কেও তাদের ধারণা এসে গেছে। অপেক্ষা শুধু ওই মেয়েটা কে দেখার। শুধু নামই শুনেছে দেখতে পারেনি তেমন কেউ। কে সেই মেয়ে; যে হৃদান চৌধুরী কে এতটা পাল্টে দিলো। পাথর মনে প্রেমের ছোঁয়া দিয়ে ফুল ফুটিয়েছে!
হৃদান উপর ওয়ালা নাম নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। সাথে সাথে ডেকোরেশনের মিউজিশিয়ান রা তাদের কাজ করতে লাগলো। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রত‍্যেক টা মানুষ দেখেছে। প্রত‍্যেক টিভি ও খবরের পাতায় হৃদান চৌধুরী বিয়ে নিয়েই হইচই চলছে! বাইক চৌধুরী মঞ্জিলের গেটে আসার আগেই গান বাজনা থামিয়ে দিয়েছে হৃদান। আদর কে সে চমকে দিবে। গেটের কাছে তারিম সুবাহ রোহানি রিয়া ওরা এসে দাড়িয়েছে। টাকা ছাড়া ঢুকতে দিবে না। পিয়াস এসেই রোহানিকে দেখে টাশকি খেলো। চিনতেই পারছে না আজকে সে। বিয়ে আদরের নাকি এদের এটাই তার মাথায় ঢুকছে না। পান্চু তো বলেই উঠলো,

বুঝলাম না! বিয়ে ম‍্যামের নাকি আপনাদের! বিয়ের কণেও তো মনে হয় এত সাজেনি যতটা আপনারা সাজছেন।
মুখের গঠন ই তো পাল্টে গেছে। চিনতেই পারছি না আমি!

পান্চুর কথায় পিয়াস হৃদানের হাসি পেলেও হাসলো না। অনেক কষ্টে চেপে রাখলো। পরে দেখা যাবে বিয়ের আগেই বোন গপ্পেন অনশন করে বসে। কিন্তু ফুসে উঠলো তো মেয়েরা। আদরের কথা অনুসারেই তো সবাই সেজেছে। এতটাও মেকাপ করেনি তারা। তারিম পান্চুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

পান্চু ভাইয়া চোখ কোথায় রেখে আসো নাকি কান দিয়ে দেখছো। তোমার ক্ষেত্রে এমনটাই মনে হয়। তোমার টাক মাথায় তবলা বাজালেই মাথায় হার্টএ‍্যাটাক হয়ে চোখ ভালো হয়ে যাবে!

তারিমের কথায় মেয়েরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। পান্চুর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। মাথায় হার্টএ‍্যাটাক কেমনে হবে? আর মাথার সাথে চোখের কি সস্পর্ক! কিছু বলতে নিবে তার আগেই পান্চুর বউ বলে উঠলো,

আমি আঞ্জুমান। পান্চুর বউ। এই টাকমাথার মানুষটার কথায় কান দিয়েন না। মাথার উপরেও যেমন কিছু নেই; মাথার ভেতরেও তেমন কিছু নেই!

পান্চু ঘোর অপমানিত হলো। শেষমেষ নিজের বউয়ের দ্বারা অপমান! এই মুহূর্তে পান্চু বিয়ে বাড়ি বয়কট করবে। নেহাত বস কে ভয় পায়! নিজের বউ কে শিক্ষা দেওয়ার কঠিন একটা প্ল‍্যান করে নিলো পান্চু। তার বউ কেও টাক মানাবে সে। তখন দেখবে টাক মাথা বলে কিভাবে ক্ষেপায়। গেটে দাড়িয়ে থাকা হৃদানের আর সহ‍্য হলো না বউ কে কখন দেখতে পারবে। নিজের ক্রেডিট কার্ড তারিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতর। মনটা আরো খুশিতে ভরে উঠলো। কি সুন্দর করে সাজিয়েছে বাড়িটা। বাহ তার বড়বাবা দেখছি দারুণ! হৃদানের কথা অনুসারে তারিম রা আদর কে নিয়ে এসে স্ট্রেজে বসিয়ে দেয়। আদর এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন হৃদান কে দেখতে পায় না তখন মনটা হালকা খারাপ হয়। কখন আসবে মানুষটা! কখন চাঁদ মুখটা দেখে চোখের তৃষ্ণা মেটাবে! তারিম আদর কে ধাক্কা দিতেই আদর নিজের ভাবনা থেকে বের হলো। খোঁচাতে লাগলো সে। আদর সব ভুলে আনন্দে মেতে উঠলো।নিজের ফোনটা বের করে একের পর এক পোজ নিয়ে ছবি উঠতে লাগলো। নিজের বিয়েতে নিজে না মজা করলে কি করে হয়! এমন সময় গানের শব্দ আসতেই আদর অবাক হলো। বিয়ে বাড়ি হলেও নাচ গান করেনি কেউ। হৃদান না করে দিয়েছিলো। আদর এতে খুব খুশিও হয়েছিলো। এমনিতেও মাথায় প্রেশার পড়বে তার উপর গান বাজনা হলে মাথা ব‍্যাথাটা যাবেই না। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের চেয়ারে বসে উঠলো। যতসময় গড়াচ্ছে গানের শব্দও নিকটে শোনা যাচ্ছে; সাথে মানুষের হইচই। আদরের সাথে তারিম ওরা দাড়িয়ে আছে। একেবারে কাছে গানের শব্দ আসতেই আদর মুখ তুলে সামনে তাকালো। আপনাআপনিই মুখে হাত চলে গেলো তার। হৃদান শেরওয়ানির সাথে মাথায় পাগড়ি পড়ে গানের তালে নেচে নেচে মঞ্চের দিকে আসছে। এত কাছ থেকে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ হতে দেখে আদর খুশি হবে না অবাক হবে বুঝতে পারছে না। তার ইচ্ছেগুলোর কথা হৃদান জানলো কি করে? সে তো তারিম ওদের কেউ বলেনি! একমাত্র ডায়েরি! ডায়েরির কথা মনে হতেই আদরের কাছে সবটা পরিষ্কার হলো। সে কিছুদিন ধরে ডায়েরি টা পাচ্ছিলো না। এই তার কারণ! আর অবাক হলো না বরং নিজের আসন থেকে উঠে দাড়ালো। হৃদান এসেই নিজের ডান হাত টা এগিয়ে দিলো। এক সেকেন্ড ও দেরী করলো না আদর। সাথে সাথেই নিজের বাম হাত টা হৃদানের হাতের উপর রাখলো। মঞ্চ থেকে নেমেই হৃদানের সাথে নাচতে শুরু করলো। হৃদান তারিম ওদের ইশারা করতেই ওরাও চলে আসলো। এ যেন এক এলাহি কান্ড। বড়রা সবাই তৃপ্তি নিয়ে ছেলেমেয়েদের খুশি দেখছিলো। ছেলে মেয়েরা খুশি থাকলেই তো তারা খুশি। হৃদান আদরের নাচের ভিডিও করছে স্বয়ং পান্চু। তাছাড়া কারোর এলাউ নেই।

হৃদানের সাথে আসা লোকজন আদর কে একনজর দেখেই বুঝেছে হৃদান চৌধুরী কেন এত পাগল হয়েছে। মেয়েটার যেমন রূপ তেমনি মিষ্টিভাষী। ওদের সাথে কি সুন্দর করে কুশল বিনিময় করলো। নাচানাচির পর্ব শেষ হতেই আদর কে হৃদান বলে উঠলো,

এখানে বসো আমি আসছি!

হৃদান বাড়ির ভেতর চলে গেলো। আতইয়াব ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। অন্ধকার রুম। হৃদান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার কি কষ্ট হচ্ছে না? তার ও তো ছোট্ট পুতুল বোনটাকে বিদায় দিতে হবে! পাশে গিয়ে নিঃশব্দে বসলো। নিজেদের হালাল শত্রুতার সম্পর্কটা বজায় রেখে বলে উঠলো,

বউ তো নিয়ে যাইনি ; দেবদাস হয়ে বসে আছেন কেন? চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমার বাসরের সাথে সাথে আপনার বাসরের ব‍্যবস্থাও করবো!

আতইয়াব একপলক হৃদানের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। কথা বলার ইচ্ছে নেই তার। হৃদান চাপা শ্বাস ফেলে আতইয়াবের এক হাত আকড়ে ধরে বলল,

আই প্রমিজ মি. ডক্টর আপনার বোনের একটু ক্ষতি হতেও দিবো না। নিজের জীবন দিয়ে আগলে রাখবো। ইউ ক’নো না? আমি ওকে কতটা ভালোবাসি! একটু অযত্ন করবো না। আপনি যদি এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকেন আপনার বোন কি আনন্দ করতে পারবে? আপনাকে যে ওর খুব দরকার এখন। কবুল বলার সময়টাতে আপনাকে ওর হাত ধরতে হবে। আপনার ভরসার জায়গাটুকু কেউ নিতে পারবে না! আর আপনাকেও আমি আপনার বোন থেকে আলাদা করবো না! আমি আমি আমার বোন কে করবো! চলুন আমার সাথে।

হাত ধরে টেনে তুললো আতইয়াব কে। হৃদানের কথাগুলো শুনে ইতিমধ্যেই আতইয়াবের মনটা একটু হালকা হয়েছে। কিন্তু শেষের কথাগুলো বুঝলো না। কথাও বাড়ালো না। মুখে হাসি ফুটিয়ে আদরের পাশে গিয়ে বসলো। মাথায় হাত রাখতেই চোখটাও ভিজে আসতে চাইলো তার। পাত্তা দিলো না, চোখের পাপড়ি ঘনঘন ফেলে চোখের পানি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। ভাইয়ের মুখ দেখেই আদরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তার এখনি হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! হৃদান কাউকে মন খারাপ করার সুযোগ দিলো না। ওয়েটার কে ইশারা করতেই দুটো খাবার প্লেট এনে সামনের টি-টেবিলে রাখলো। হৃদান আতইয়াবের হাতে একটি ধরিয়ে দিয়ে বলল,

না খেয়ে আছে। আপনার হাতে খাবে বলে। হৃদু কাম। খাওনি কেন? আমাকে একটা ফোন করতে পারতে! আমি চলে আসতাম না?

তারিম মাথা নিচু করে নিলো। আতইয়াবের জন‍্য খারাপ লাগছিলো আর নিজেকেও তো কাল ভাইকে ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে যেতে হবে! এই ভেবেই মনটা খারাপ ছিলো। ভাইকে ভিষন মিস করছিলো সে। কিন্তু নিজের জন‍্য তো ভাইয়ের মজা টা নষ্ট করতে পারেনা। তাই বলেনি। হৃদানের পাশে নিঃশব্দে বসলো। হৃদান কথা না বাড়িয়েই খাইয়ে দিতে লাগলো। ভাই-বোনের ভালোবাসা দেখে যেন সবার চোখ জুড়িয়ে গেলো। আদর-তারিম জানে হৃদান-আতইয়াব ও খায়নি। তাই দুজন নিজেও ওদের হাতে তুলে খাইয়ে দিলো। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই হৃদান তারিম কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

সুবাহ রোহানি হৃদুকে ওর রুমে নিয়ে যাও। দুটো মেয়ে আছে যা যা করতে বলে করবে; কোনো প্রশ্ন করবে না!

তারিম কিছু বুঝলো না। তবুও ভাইয়ের কথায় সায় জানিয়ে তিনজন উপরে চলে গেলো। তারিম যেতেই হৃদান ফালাহ কে ইশারা করলো। সাথে সাথেই ফালাহ আতইয়াবের হাত ধরে ওদের ঘরে চলে গেলো। কারোর মাথাতেই কিছু ঢুকছে না। আদরের দিকে তাকালো হৃদান। ভালো করে কিছুক্ষণ দেখলো। নেশা ধরে যাচ্ছে তার। মদ খেয়েও মনে হয় এতটা নেশা হবে না তার! নিজের ফোনটা নিয়ে আদরের সামনে গিয়ে বলল,

এই ইচ্ছেটাও অপূর্ণ রাখি কি করে আদরপরী! তুমি আমার ব‍্যক্তিগত সম্পদ যার ব‍্যক্তিগত ফটোগ্রাফার টাও আমি। সো লেটস স্টার্ট!

আদর একগাল হাসলো। বিভিন্ন পোজ নিয়ে অনেকগুলা ছবি উঠলো। হৃদান বড়বাবাকে দেখে এগিয়ে গেলো তার কাছে। জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,

আজকে এত টাটকা লাগছে কেন বলোতো? বউ বেশী আদর দিয়েছে? যাই বলো ব্রাইডাল হয়েছে বাড়ির ডেকোরেশন টা। বউয়ের চুমু ছাড়া বুঝি ভালো লাগে না? ভয়ে জানপ্রাণ লাগিয়ে দিলে!

হাসতে হাসতে সরে এলো হৃদান। নাসির চৌধুরী চোখ রাঙিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে দিয়ে বলে উঠলো,

নিজের হাতে তোমার বাসর ঘর সাজিয়েছি! টাকাটা নিয়ে ঘরে এসো কেমন? আর সাবধান। এত তাড়াতাড়ি এগিয়ো না, আস্তে আস্তে করো!

এবার হৃদানের চক্ষু চড়কগাছ! নাসির চৌধুরী হৃদানের কাঁধে চাপট দিয়ে আহনাফ চৌধুরীর কাছে চলে গেলেন। হৃদান খানিকটা পরেই হেসে মাথা চুলকালো। আজকে বাপ-ছেলে খাপেখাপ পড়েছে!

তারিম ঘরে যেতেই দুজন মেয়ে ওকে কণের সাজে সাজিয়ে দিতে থাকলো। সে শুধু অবাক হয়ে সবটা দেখতে লাগলো। সাজ কমপ্লিট হতেই আয়নায় নিজেকে দেখে লাজুক হাসলো সে। সুবাহ দেরী না করে তারিম কে নিয়ে নিচে নেমে এলো। আতইয়াব ও ঠিক তেমন ই অবাক। শেরওয়ানি পড়ে ঘরে বসে আছে; বাইরে বের হবে না। ফালাহ শেষমেষ না পেরে আরেকজনের সাহায‍্যে হাই করে তুলে নিয়ে এসেছে। মঞ্চে এসেই দুজন দুজনকে দেখে অপলক তাকিয়ে রইলো। এ দেখার যেন শেষ নেই। ততক্ষণে মঞ্চে আরো দুটো চেয়ার যুক্ত হয়েছে। রাত আটটার মতো বেজে গেছে। এখন বিয়ে পড়ানো হবে। বড়রা তাগাদা দিচ্ছে। কাজি আসতেই হৃদান বলে উঠলো,

আমাদের বিয়ে আগে পড়ানো হবে কাজিমশাই!

হৃদান কে টক্কর দিয়ে আতইয়াব বলে উঠলো,

না কাজিমশাই আমাদের বিয়ে আগে হবে!

আতইয়াবের কথায় হৃদান ঠেস দিয়ে বলে উঠলো,

আপনি চুপ করেন মি.ডক্টর। বিয়েই তো করতে চাইছিলেন না। কতবড় সারপ্রাইজ দিলাম কই খুশিতে গদগদ হয়ে বলবেন ওদের টা আগে পড়ানো হবে বিয়ে! তা না করে আমার সাথে শত্রুতা করছেন? এ ঘোর অপরাধ!

হৃদান কথায় আতইয়াব কিছুক্ষণ ভাবলো। বাঁকা হেসে বলে উঠলো,

মি. মডেল সারপ্রাইজ আপনার বোনের জন‍্য ছিলো নট মি। আমি একটুও অবাক হয়নি! বিয়ে আমার টাই আগে হবে!

আপনি এমন করতে পারেন না মি. ডক্টর। যত তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়ানো হবে তত তাড়াতাড়ি বাসর করতে পারবো। কেন বাঁধা দিচ্ছেন। আমি কেঁদে দিবো!

চারদিকে হাসির রুল পড়ে গেলো। এই প্রথম কোনো বিয়েতে তারা এমন দেখছে। আদরের ধ‍্যান ওদিকে নেই। তার ধ‍্যান সম্পূর্ণ তার ফোনের দিকে। হৃদানের কোলে বসে আছে হিয়া! একটু আগেই ফোনে এমএমএস এসেছে। আদরের বুকটায় চিনচিন ব‍্যাথা করছে। মাথাটা কেমন ভনভন করছে! অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,

বিয়ে হবে নাহ!

চলবে…..?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here