মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড় #পর্ব_১৬,১৭

0
419

#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_১৬,১৭
Tahrim Muntahana
১৬

আদরের মামা-মামি এসেছে গ্রাম থেকে। সাথে পরশ রোহানি। অসুস্থতার খবর পেয়েই ছুটে চলে এসেছে তারা। গ্রাম থেকে আদরের পছন্দের বিভিন্ন রকম আচার, পিঠা, ফল সবকিছু নিয়ে সন্ধ‍্যা নাগাদ এসে পৌঁছেছে। বেশ ক’দিন থাকবে তারা। আদর তো আনন্দে আত্মহারা। মামির মাঝে সে মা মা গন্ধ পায়। মামিও তো একজন মাটির মানুষ। দুনিয়ার সব ভালোবাসা যেন তার মধ‍্যেই উপর ওয়ালা ঢেলে দিয়েছে।
তারা তো আদরের আসল মামা-মামি না!আতইয়াবের মামা-মামি তবুও এতটা দিন আদর কে ভালোবেসে আসছে! বুঝতেও দেয়নি আদর ওদের কেউ নয় বরং সবসময় এটা বুঝাতে চেয়েছে আদর ছাড়া ওরা অচল।
বিশ্রাম করছে সবাই। মাগরিবের নামাজ আদায় করে আদর ছাদে দাড়িয়ে আছে। ভালো লাগছে না হঠাৎ করে। মন টা কেমন করছে। মনে হচ্ছে আবার খারাপ কিছু হবে। হঠাৎ রাস্তায় চোখ যেতেই আদর ভয় পেয়ে গেলো। কয়েকটা লোক আবছা আলোয় রিভলবার নিয়ে পায়চারি করছে। বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আদর এক দৌড়ে নিচে চলে গেলো। এই ভয়টাই সে পাচ্ছিলো! নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে থাকে আদর। ভয়ে হাত পা কাঁপছে তার। ভয়টা তাকে নিয়ে না গ্রাম থেকে মামা-মামি কাজিন রা এসেছে ওদের কিছু হয়ে গেলে। কি করবে মাথায় ঢুকছে না। হৃদানের কথা মনে হতেই ফোন লাগালো। রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে!

ল‍্যাপটপে কাজ করছিলো হৃদান। কাল ইমপরটেন্ট একটা মিটিং আছে। ফোনটা বিছানায় পড়ে আছে। সেদিকে খেয়াল নেই তার। হঠাৎ কাজের মাঝেই আদর কে দেখতে যাওয়ার ভুত মাথায় চাপলো। মামা-মামি আসছে নিশ্চয়ই মেয়েটা খুব খুশি। এখন কি যাওয়া ঠিক হবে? ভেবেই সিসি ফুটেজ অন করলো আদরদের বাড়ির। হঠাৎ ই আদর কে এতটা বিচলিত হয়ে কাউকে ফোন করতে দেখে চমকে উঠে হৃদান। ল‍্যাপটপ টা পাশে রেখেই ফোন খুঁজতে থাকে। কোথায় রেখেছে ফোন! কিছুক্ষণ খুঁজার পর বালিশের নিচে ফোনটা পেয়ে যায়। তখনো ফোনের উপরে আন্ডাবাচ্চা নামটা জ্বল জ্বল করছে। ধরার আগেই কেটে গেলো। ১৩ টা মিসড কল উঠে আছে। হৃদানের ভয় হলো। ফোন দেওয়ার আগেই আবার ফোন আসলো। ঝটপট ফোনটা ধরেই বলতে লাগলো,

হোয়াট হেপেন্ড আন্ডাবাচ্চা? এমন করছো কেন? এতটা বিচলিত কেন তুমি? কি হয়েছে? প্লিজ সে!

আদর জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলে উঠলো,

হৃদ, হৃদ আমাদের বাড়ির সামনে কারা যেন রিভলবার নিয়ে ঘুরছে। ভয় লাগছে আমার। প্লিজ সেইভ আস হৃদ। ওরা ক্ষতি করতেই এসেছে। প্লিজ কাম হৃদ। আমি বাঁচতে চাই আপনার সাথে। অনেকটা বছর একসাথে বাঁচতে চাই। আপনাকে ভালোবাসতে চাই। প্লিজ কামমমমম হৃদ!

মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লো হৃদান। এর জন‍্য এমন করছে আদর! পরক্ষণেই গার্ডদের উপর রাগ হলো তার। বলেছে লুকিয়ে পাহারা দিতে; রাস্তা দিয়ে ঘুরছে তারা? যার জন‍্য তার প্রেয়সী এমন করছে! এতটা ভয় পাচ্ছে! হৃদান ফুস করে দম নিলো। শান্ত স্বরে বলে উঠলো,

কুলডাউন আদুপরী! ওরা আমার লোক! গার্ড দিচ্ছে তোমাকে। রিস্ক আছে জানোতো। এতটা হাইপার হচ্ছো কেন? ভালো করে খেয়াল করবে না? আ’ম সরি আন্ডাবাচ্চা তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিলো। সুযোগ ই পাইনি।

আদর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। কতটা ভয় পাচ্ছিলো। পরক্ষণেই ফুঁসে বলে উঠলো,

আপনাকে ক‍্যাবলাব্রিটিশ এমনিই বলি?বোকার হদ্দ, প‍্যাঁচার পোনা, ইউ বেটা খ! বি! শ! কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনার ধারণা আছে। কত কি ভেবে ফেলিছিলাম যে আমার চল্লিশায় কে কে আসবে, কে কে দোয়া করবে, কে কে বিনা দাওয়াত অন্ন ধ্বংস করতে আসবে, কে কে মজা করতে আসবে; আমার চল্লিশা আমি খেতে পারবো কিনা! আমার অনুপস্থিতে আপনি অন‍্য মেয়ের সাথে লুতুপুতু করবেন কিনা, যাতে লুতুপুতু না করতে পারেন তার ব‍্যবস্থাও করতে যাচ্ছিলাম। আমার মাথায় সব বুদ্ধি আপনি নিয়ে নিলেন। আপনার সাথে ১১ ঘন্টার ব্রেকআপ!

টুস করে ফোনটা কেটে দিলো আদর। আর হৃদান সে হা করে আদরের সব ভাবনা শুনছিলো। এই টুকু সময়ে এই মেয়ে কতকি ভেবে ফেলেছে। তার উপর বলছে তার বুদ্ধি নাকি আমি নিয়েছি! ভাবা যায় এসব? আবার ১১ ঘন্টার ব্রেকআপ! সকালের আগে আর কথা হবে না এজন‍্যই যে বলেছে হৃদান বুঝতে পেরেছে। হাইরে হৃদান চৌধুরী তোর এই দিন আসলো! হালকা হসলো হৃদান। আবার ল‍্যাপটপ টা হাতে নিয়ে যেইনা সোফায় বসবে ওমনি দরজা থেকে ডাক পড়লো,

খাবার দেওয়া হয়েছে; বিশিষ্ট‍ ব‍্যবসায়ী হৃদান চৌধুরী যেন খেতে আসে! বিনা পয়সায় কামলা তো একটা পেয়েছে, যে যার মতো খাটিয়ে যাচ্ছে। আমার কি কোনো দাম আছে? কামের বেটি সকিনার মতো খেটেই যাচ্ছি। এই দিন দেখার আগে তুলে নিলে না কেন আল্লাহ!

হৃদান ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকালো। পেছন ঘুরে তারিম চেঁচিয়ে কথা গুলো বলে চলে যাচ্ছে। বুঝলো না হৃদান, কি হয়েছে হঠাৎ করে। রেগে আছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তাই আর দেরী করলো না। হাটা ধরলো। ডাইনিংয়ে বসে আছে পান্চু, পিয়াস।। পান্চু কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। সে আসতেই চায়নি। তারিম ধমকে নিয়ে এসেছে। বড় হয়ে ছোটদের কে ভয় পেয়ে পান্চুর নিজের উপরেই বিশ্বাস উঠে গেছে। ভবিষ্যতে বউয়ের ঝারি খেয়েই তাকে বাঁচতে হবে নাকি! হৃদান কে আসতে দেখেই পান্চু উঠতে যাবে তারিম ধমকে উঠলো,

চুপ করে বসো। আমার পারমিশন নিয়েছিলে উঠার আগে? সাহস কত বড়। একদম চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিবো। এখন থেকে বাড়িতে শুধু হৃদযা চৌধুরীর হুকুম চলবে। কোনো হৃদান পৃদানের খাওয়া নেই। সবাই কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও। বাড়ির বস আমি, তাকে দেখে উঠার কিছুই নাই। চুপচাপ খেতে বসো!

তারিমের ধমকে পান্চু আর উঠার সাহস করলো না। কে জানে ধাম করে কয়েকটা দিয়ে বসলে। মেয়ের রাগ সাংঘাতিক। অন‍্যদিকে হৃদানের মাথায় কিছুই ঢুকছে না তার শান্তশিষ্ট বোনটার হঠাৎ কি হয়েছে? এতটা রেগে আছে কেন? তার দিকে তাকাচ্ছেই না! হৃদান বসতে যাবে তার আগেই তারিম নিচের দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,

আপনাকে আমি বসতে বলেছি? এই বাড়িতে যা করতে হবে সব আমার পারমিশন নিয়ে করতে হবে। প্রথমবার তাই ক্ষমা করলাম এরপর ভুল হলে বাড়িতেই ঢুকতে দিবো না!

হৃদান এবার নত স্বীকার করে বলে উঠলো,

আপনার মেহেরবানিতে আমি কি বসতে পারি রানীসাহেবা!

হৃদানের এমন অবস্থা দেখে পিয়াস মিটমিটিয়ে হাসছে। পান্চু তো হা করে সব দেখছে। কি দিন আসলো তার বসের। কিন্তু তার খুব একটা খারাপ লাগছে না হৃদানের এমন অবস্থা দেখে। এতদিন আমাদের হুকুম দিয়ে আসছে এখন নিজে কিছুটা হুকুম পালন করুক। হা হা হা বেশ হয়েছে! হৃদানের এমন কথায় তারিমের হাসি পেলেও মুখটা গম্ভীর করে হাত দিয়ে ইশারা করলো বসার জন‍্য। তিনজনকে খাবার দিয়ে সে রান্না ঘরের দিকে যেতে নিবে হৃদান হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো। কিছু বলার আগেই এক লোকমা ভাত মুখে ঢুকিয়ে দেয়। তারিম চোখ রাঙিয়ে খেতে থাকে। এহ এখন ডং দেখানো হচ্ছে। তখন এতবার বলল কাল একটু ঘুরতে যাবে তখন তো হু হু ছাড়া মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না এখন দরদ দেখাতে আসছে! তারিম কে খাইয়ে নিজে খেয়ে নিলো হৃদান। তারিম গম্ভীর মুখে সবকিছু গুছিয়ে রাখছে। হৃদান যাওয়ার আগে মুচকি হেসে বলে,

কাল বিকেলে রেডি থেকো। মিটিং শেষে ঘুরতে নিয়ে যাবো!

বলেই চলে যায় হৃদান। এদিকে তারিম সে তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে পান্চুর টাক মাথায় ঢোল বাজাচ্ছে। আর ব‍্যাচারা পান্চু চোখ মুখ কুচকে সবটা সহ‍্য করছে।
_____________________

আদর এখন মোটামুটি সুস্থ। পরশ রোহানির সাথে সময়টা তার খুব ভালো কাটছে। আতইয়াব ও কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়ে হসপিটালে ডিউটি করছে। হঠাৎ করেই রোহানি বায়না ধরেছে ঘুরতে যাবে। সাথে সাথে পরশ ও সায় জানালো। পরশ জানে আজ আতইয়াবের হসপিটালে অপারেশন আছে তাই অনেক জোর করেছে আতইয়াবকে যাওয়ার জন‍্য! মিথ‍্যা জোর আরকি। আতইয়াব বোনের খুশির জন‍্য সায় দিলেও গার্ড নিয়ে যেতে বলেছে। আদর ও না করেনি। তার জীবন এখন হুমকির মুখে সে জেনেও তো ইগনোর করতে পারে না!

বিকেল হতেই তিনজনে বেরিয়ে পড়ে। পরশ অনেক খুশি। কারণ আজ রাইসাও আসবে। অনেক দিন দেখা হয়না তাদের। ম‍্যাসেজে টুংটুং কথা বলেই যাচ্ছে। আদরের মনটা হালকা খারাপ। রোহানির তাড়ার জন‍্য হৃদান কে বলেও যেতে পারছে না। পরে জানলে কেমন রিয়েক্ট করবে কে জানে।

গাড়ি থামলো গ্রামের একটি ব্রিজের উপর। হৃদান কে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আদর খেয়াল ই করেনি। গ্রাম দেখে আদর বিস্মিত হয়ে গেলো। কত সুন্দর গ্রামটা। মাঝারি সাইজের নদী, নদীর পাড় টা উঁচু করে বাঁধা; সম্ভবত বন‍্যা থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা, নদীর পাড়গুলোতে অনেক গাছগাছালি!ক্লান্ত পথিকরা এখানে অনায়েসেই বিশ্রাম নিতে পারবে, কি স্নিগ্ধ বাতাস। ব্রিজটি নতুন দেওয়া হয়েছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিছুটা দূরে কয়েকটা দোকান দেখতে পেলো আদর। আরো অবাক হলো সে। এখানে দোকান। খদ্দের ও আছে দেখছি। আদরের মনটাই ভালো হয়ে গেলো এরকম পরিবেশে এসে। আদর নামতে নিবে রোহানি বাঁধা দিয়ে বলল,

চুপচাপ বস, একটু পর নামতে হবে।

আদর ভ্রু কুচকালো। গাড়িতে বসে থাকবে কেন? একটু অপেক্ষা করতেই আরো দুটো গাড়ি এসে ব্রিজের উপর থামলো। রোহানি ধপ করে নেমে গেলো। পরশ আগেই নেমে ছবি তুলছে। হাতে ক‍্যামেরা। আদর গাড়ি থেকে নেমে সামনে তাকাতেই বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো। কি দেখছে সে? হৃদান এখানে? হৃদান ও তেমন! আদর কে এখানে এক্সপেক্ট ই করেনি সে। তার বুঝতে সময় লাগলো না সব তার বোনের কারসাজি। যাই বলুক বোন একটা ঠিক কাজ করেছে। খুশিতে তারিম কে জড়িয়ে ধরলো হৃদান। তারিম তো হিহি করে হেসে দেয়।
হৃদানের পড়নে সাদা পাঞ্জাবি; কালো সুতার কাজ করা। ঠিক আদর ও সাদা
লং গ্রাউন পড়ছে। তারিম আগে থেকেই প্ল‍্যান করে রেখেছিলো। এগিয়ে গেলো হৃদান। আদরের তো চোখ চিকচিক করছে খুশিতে। কি অসাধারণ লাগছে হৃদান কে। এই প্রথম সে পাঞ্জাবিতে দেখছে; এর আগে দেখবে কেমন করে হৃদান শুধু পাঞ্জাবি তার বাবা-মায়ের মৃত‍্যবার্ষিকীতেই পড়ে তাও চুপিচুপি। একসাথে হয়েই তারিম রোহানি চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

সারপ্রাইজজজজজ!

ওদের চিৎকারে পিয়াস পান্চু কান হাত দিয়ে চোখ ছোট ছোট কে চেয়ে থাকে। আর আদর হৃদান তো একে অপরের দিকে তাকিয়েই আছে। পরশ ছবি তোলা অফ করে এগিয়ে এসে হৃদানের সাথে কথা বলে। পিয়াস দোকানের দিকে যাওয়ার তাড়া দিতেই পরশ বলে উঠে,

তোমরা হাটতে থাকো আমি একটু পর আসছি। রাইসা এখনো আসেনি।

পরশের কথায় সায় দিয়ে ওরা হাটতে থাকে। হৃদান আদরের ডান হাতটা নিজের বাম হাতের মুঠোয় নিয়ে হাটছে। বাম হাত ধরেনি যদি ব‍্যাথা পায়। খুব সতর্ক সে! পিয়াস বার বার রোহানির দিকে তাকাচ্ছে। সে তারিমের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। পিয়াসের কেন জানি মেয়েটাকে বেশীই ভালো লেগেছে। হঠাৎ করেই রোহানির ফোন আসায় সবাই চুপ হয়ে যায়। ফোন ধরে কানে তুলতেই অপর পাশের কথা শুনে রোহানি রেগে বলে উঠে,

রেগিং করেছে মানে? প্রপোজ রিজেক্ট করেছে বলে রেগিং দিবে? দাড়া কালকে আসছি ভার্সিটি। কয়েকদিন ছিলাম না ক্ষমতা হাতে পেয়ে গেছে? ওই মাইনকারে যদি কাল ভার্সিটির সবার সামনে মেয়েদের মতো না কান্না করিয়েছে আমার নাম রোহানি ইসলাম না!

রোহানির কথায় আদর হাসলো। সে ভাবছে কাল ছেলেটার কি হবে। কেন যে সেধে সেধে মানইজ্জত খোয়াতে আসে কে জানে। পিয়াস তো চরম লেভেলের শকড। এই মেয়েকে তো সে শান্তশিষ্ট ভেবেছিলো এতো পুরাই আগুন। নাহ পিয়াস নাহ! আর এগোস না! সাবধান! এই মেয়ে জীবনে আসলে জীবন তেজপাতা হয়ে যাবে। রোহানির কথা শুনে হৃদান বুঝলো কোন ঝামেলা হয়েছে। তাই বলল,

একা একা ঝামেলা করতে যেয়ো না। কাল পান্চু গিয়ে ছেলেটাকে দেখে নিবে। হাজার হোক আমার সার্ভিস পাওয়া তোমার শালীগত অধিকার!

হৃদানের কথায় রোহানি জোরে হেসে দিলো। ভাব নিয়ে বলে উঠলো,

আরে নাহ জিজু। এইসব আমার পাঁচ মিনিটের কাজ। বেশ নামডাক আছে ভার্সিটিতে! এক নামে চিনে সবাই। ভয়ে থরথর করে কাঁপে। আমিই সামলে নিতে পারবো!

রোহানির কনফিডেন্সে হৃদান হাসলো কথা বললো না। আর পিয়াস তো ক্রাশ নামক বাঁশটা আবার খেলো। নাহ তার মায়ের জন‍্য এমন একটা বউমাই লাগবে। যেমন মা তেমন বউ হবে। বউ-শাশুড়ি খাপেখাপ।

দোকানের দিকে এসে পৌঁছেছে ওরা। বেশ ভালো পরিবেশটা। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে সময় কাটাচ্ছে নিজেদের মতো। একটা ছোট পার্ক সাইট ও বলা চলে। চায়ের দোকান, ফুচকা, ঝালমুড়ির দোকান, আইসক্রিমের দোকান, কসমেটিকসের দোকান ও আছে! আদর তো লাফিয়ে উঠলো এসব দেখে। রোহানি দৌড়ে গিয়ে ফুচকা অর্ডার দিলো। আদরের ঝালমুড়ি খুব পছন্দ। ফুচকা ওতটাও পছন্দ না; তবুও খুব একটা খারাপ লাগে না। রোহানি দোকান থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

আজ তোমার পকেট ফাঁকা করে ছাড়বো জিজু!

হৃদান হাসলো। কতই খাবে আর। হৃদান আর আদর ঘাসের উপর বসেছে। কথা বলছে আর হাসছে দুজনে। এর মধ‍্যে পান্চু দু প্ল‍্যাট ঝালমুড়ি এনে দিতেই আদর লুফে নিয়ে খেতে শুরু করে। প্রথমে টের না পেলেও কয়েক চামচ খাওয়ার পর যখন ঝালে চোখ মুখ লাল হয়ে যায় তখন খাওয়া থামিয়ে দেয় আদর। একদম ঝাল খেতে পারেনা সে। এতটা ঝাল হবে ভাবেনি। হৃদান একটু একটু করে খাচ্ছে। সে ভালোয় ঝাল খেতে পারে। প্রথমে নাক ছিটকালেও আদরের খাওয়া দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। মুখে দিতেই নিজেরো ভালো লাগে। হঠাৎ আদর কে খাওয়া থামিয়ে হাঁপাতে দেখে ফট উপর আদরের দিকে তাকায় হৃদান। আদরের চোখ মুখ লাল দেখে ভয় পেয়ে যায়। চেঁচিয়ে পানি আনতে বলে।
পান্চু সবাই কে দিয়ে কেবল একটা ফুচকা মুখে দিচ্ছিলো বসের চেঁচানো তে তেতুলের পানি শার্টে পরে শার্ট ভিজে যায়। সেদিকে না তাকিয়ে পানি নিয়ে দৌড়ে এগিয়ে যায়। ঢকঢক করে পানি গিলে আদর। ঝাল একটু কমলেও হৃদানের রাগ কমলো না। সব রাগ গিয়ে জমা হলো ঝালমুড়িওয়ালার উপর। রেগে গিয়ে বলে উঠলো,

ঝাল দিতে বারণ করা হয়েছিলো না। এত ঝাল দিয়েছেন কোন সাহসে। ঠিক ভাবে বানাতে পারেন না। স্টুপিড!

ঝালমুড়িওয়ালার মুখটা মলিন হয়ে যায়। আদরেরও খারাপ লাগে। এগিয়ে গিয়ে হৃদানের হাত ধরে অনত্র নিয়ে আসে। পিয়াস গিয়ে লোকটাকে সরি বলে। সাথে এও বলে হৃদান পাগল। পান্চু তো পিয়াসের কথায় হেসে খুন। লোকটার মন ভালো করতে পিয়াস হৃদানের নামে উল্টাপাল্টা বলেই যাচ্ছে। একবার যদি হৃদান জানতে পারে পিয়াসের কি হবে আল্লাহ মালুম! লোকটাও হেসে দেয় একসময়। রোহানি সবটা দেখে ফুচকা খেতে খেতে। ব‍্যাপারটা বেশ ভালোলাগে তার!

আদর গম্ভীর মুখে হৃদানের দিকে তাকিয়ে আছে। হৃদান মাথা নিচু করে আছে। মনে হচ্ছে বেশ ভয়ে আছে। আদর শান্ত সুরে বলে উঠলো,

আপনি জানেন উনার কত কষ্ট লেগেছে। ভুল হতেই পারে তাই বলে এমন করবেন। আপনারা এমন করেন বলেই উনারা ভাবে গরিব বলে উনাদের সাথে এমন করা হয়। সব ধনীদের এক ভাবে উনারা। এরপর এমন করলে আপনার খবর করে দিবো। যাওয়ার সময় সরি বলবেন। এমন পাগলামি করার মানে আছে!

আদরের কথায় মুগ্ধ হয় হৃদান। সে এমন কখনোই ভাবেনি। আদরের ভাবনা সত‍্যিই আলাদা। আদরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

আমি প্রেমে পাগল, তাই পাগলামি করি!
উন্মাদনা ছাড়া পাগলামি বুঝাতে পারিনা!
কারণ আমি,
ব‍্যকুলতায় উদ্ভাসিত কবিতা
রচনা করতে পারিনা!
আমি কবি নয়, প্রেমিক আমি!
এক ভয়ংকর পাগল প্রেমিক!
যার সূচনা হয়েছিলো তুমিতে!
তেমনি,
তোমার ভুমিকাতেও আমি,
উপসংহারেও আমি!
উপসংহারের শেষটাও হবে আমাকে ঘিরে,
শুধুই আমি!

চলবে…?

#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_১৭
Tahrim Muntahana

গোধূলি বিকেল শুরু। সূর্যটা এখনো হালকা তেজ দিচ্ছে। এই গরমে সূর্যটা আকাশ ছেড়ে যাওয়ার চিন্তাও করে না। মনে হয় আকাশ কে তার তেজ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ভালোবাসায়। কিন্তু এই ভালোবাসা তো ক্ষণস্থায়ী। সূর্যকে আকাশের বুক থেকে চলে যেতেই হবে। চাঁদের আগমন ঘটবে আবার এই আকাশের বুকেই। সেই অভিযোগ; সূর্য যেন নিজের রাগ দিয়ে প্রকাশ করছে। যার ফল ভোগ করছে মানবজাতি। কিছু ভালোবাসার জন‍্য হয়তো অন‍্যকে ফল ভোগ করতে হয়। ভালোবেসে কষ্ট পেয়ে নিজেকে ধাবিয়ে রাখার চেষ্টায় কিভাবে অন‍্যের ক্ষতি হয় বুঝ ই আসে না। যার দৃষ্টান্তে স্থান পেয়েছে হিমেল খান!

পুরো বাড়িতে হইচই লাগিয়ে দিয়েছে হিমেল। নিজের ভেতরকার ক্রোধ দ্বারা বাড়িটা মুহূর্তেই নিরব নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। তার মুখে এখনো বিড়বিড় শব্দে শোনা যাচ্ছে,

আমি আদর কে চাই; আমার আদরকে এনে দাও; আমার আদরকেই লাগবে; আর কোনো মেয়ের জায়গা নেই আমার জীবনে; যে করেই হোক আমার আদরকে চাই ই চাই; খুন হয়ে হোক নাহয় খুন করে! আদরকে লাগবে!

হাইরে ভালোবাসা! এ যে কূলকিনারা মানে না, বাঁধা মানে না; কিন্তু অপাত্রে দান করলে দান টা তো ব‍্যর্থ হবেই। হিমেলের ভালোবাসাটাও ব‍্যর্থ। সে দুজন ভালোবাসার মানুষের মধ‍্যে এসে তাদের দুজনকে আলাদা করার চেষ্টায় আছে!

ফ্লাসবেক,

দুপুরের মাঝ সময়টাতে আদর বসেছিলো একটি পার্কে। পাশেই তারিম সুবাহ বসে গল্প করছে। ভার্সিটি শেষে একটু ঘুরতে এসেছে তারা। আদর এখন পুরোপুরি সুস্থ। আনমনে ভেবে চলছিলো হৃদানের কথা। দিন গুলো কিভাবে চলে যাচ্ছে। ঘুরতে যাওয়ার এক সপ্তাহ কেটে গেছে অথচ আদরের কাছে মুহূর্তগুলো এখনো জীবন্ত লাগে। অনুভূতিটা তো জীবন্তই! এই এক সপ্তাহে তেমন দেখা না হলেও হৃদান আদরের খেয়াল নিতে ভুলেনি। প্রচন্ড কাজের প্রেসার হৃদানের। নিউ ডিলটা নিয়েই কাজ করছে। কাজের মধ‍্যেও হঠাৎ হঠাৎ ফোন করে আদর কি করছে, ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা সব খোঁজ খবর নিয়ে আবার কাজে মনোযোগি হয়। হালকা রোমান্টিক কথা বলতেও ভুলে না। সত‍্যিই হৃদান চৌধুরী আজ ভয়ংকর পাগল প্রেমিক হয়ে গেছে। শুধুই আদরের! ভাবছিলো আর মুচকি হাসছিলো আদর। তারিম সুবাহ কয়েকটা বাচ্চাদের সাথে কথা বলছে কিছুটা দূরে। হঠাৎ নিজের সামনে পুরুষালি ছায়া দেখে বিচলিত হয় আদর। ছায়ার মানুষটা তার না! ফট করে মাথা তুলে অচেনা এক ছেলে কে ভ্রু কুচকায় আদর! কিছু বলে না। এটা যেহেতু পার্ক আসতেই পারে। অন‍্য মুখো হয়ে বসতেই আবার সেই লোকটা আদরের সামনে গিয়ে দাড়ায়। আদর এবার বুঝে যায় লোকটা তার কাছেই এসেছে। দাড়িয়ে যায় সে। কপাল কুচকে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,

নিশ্চয় আপনার আমাকে পছন্দ হয়েছে। পার্কে একা সুন্দরী একটা মেয়ে বসে আছে লাইন মারায় যায়! তাই আপনিও ঠিক লাইন মারতে এসেছেন তাইতো? আগেই বলে দিচ্ছি কাজ হবে না ভাই। এই পৃথিবীতে একজন বাদে সব যুবকই আমার ভাই হয়। তাই ভাই বলছি কি প্লিজ লিভ। একবার য‍দি জানতে পারে আপনি তার সম্পদের উপর নজর দিয়েছে আল্লাহ মালুম কি হবে!

আদরের কথায় লোকটির মুখ থেকে মুচকি হাসি সরে গম্ভীর হয়ে যায়। হটাৎ করেই নিচে বসে পড়ে। আবেগি কন্ঠে বলে উঠলো,

প্রথম দেখাই ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। আমি জানিনা কি আছে তোমার মধ‍্যে। তোমার ওই তেজী চাহনী ঘায়েল করে দিয়েছে আমায়। কম মেয়েকে দেখেনি কিন্তু কারো চোখ, চোখের চাহনী এতটা জীবন্ত লাগেনি। প্লিজ এক্সেপ্ট মি। আ’ম হিমেল খান। সান অফ হিয়ান খান। কোনো কিছুর কমতি নেই। টাকা, বাড়ি গাড়ি, যথেষ্ট সুদর্শন দেখতে আমি। রানি হয়ে থাকবে তুমি! আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ। প্লিজ!

আদর গাঢ় চাহনীতে তাকিয়ে আছে। ভেতরে কি চলছে বোঝা মুশকিল। হিমেল তখনো আদরের দিকে হাত বাড়িয়ে বসে আছে। চোখ বলে দিচ্ছে সে চায়ছে আদর তার হাত টা বাড়িয়ে দিক। কিন্তু আদর দু পা পিছিয়ে গেলো। হিমেল চমকে দাড়িয়ে গেলো। এই হিমেল খান কে রিজেক্ট করা পসিবল? আদর আবার তিন পা এগিয়ে এসে বলল,

আপনি হিয়ান খানের ছেলেই হোন বা প্রেসিডেন্টের ছেলেই হোন আই ডন্ট কেয়ার। আদর আহমেদ কে সস্তা ওই সব মেয়েদের খাতায় ফেলবেন না যারা আপনার টাকা রুপ থেকে আপনার জালে ফেঁসে যায়। আমাকে ভালোবাসেন অথচ খুঁজ নেন নি। আপনার কাছে আমি রানি হয়ে থাকবো আর দুজনের কাছে আমি রাজরানী হয়ে আছি! এক আমার ভাইয়া আর দুই আমার ভালোবাসার মানুষটা। আপনি যদি সাধারণ প্রেম নিবেদন করতেন আমি আপনাকে না বলে দিতাম এমনকি আপনাকে বন্ধু করে নিতাম। কারণ ভালোবাসায় কারো হাত থাকে না, হঠাৎ করেই হয়ে যায়। কিন্তু নাহ আপনি তো আমাকে টাকার লোভ দেখাচ্ছেন! তাই আপনাকে ফাস্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং আমার সামনে আসবেন না ; নাহলে আপনার সাথে কিছু হলে আমি দায়ি না! গেট আউট!

হিমেলের চোখ মুখে রাগ ফুটে উঠলো। সামান‍্য একটা মেয়ে তাকে এত কথা শুনাচ্ছে। এত বড় সাহস তাকে রিজেক্ট করে। নিজেকে সংযত করে বাঁকা হেসে বলে উঠে,

আমার চোখ একবার যার উপর পড়েছে তাকে তো আমার হতেই হবে। আই লাইক ইউর এনগ্রি ফেচ। ইয়েস তোমাকে আমার হতেই হবে। এট এনি কস্ট। আগে তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে মারবো তারপর তোমাকে বউ করবো। তাও ১৫ দিনের মধ‍্যে। তোমাকে তো মিসেস হিমেল খান হতেই হবে।

হিমেল কথাটা বলেই হাটা ধরে। আর এক মুহূর্ত থাকলেই হয়তো কিছু ভুল করে ফেলতে পারে। যা সে চায়ছে না। আদর কে নিজের করে পাওয়ার জেদ চেপেছে মনে। আর আদর হিমেলের কথা শুনে ব‍্যাঙচি দিয়ে বলে উঠে,

দিবা স্বপ্ন কখনো পূরণ হয়না। আর আমার মানুষটার নাম শুনলে এখনি হিসু করে দিবি। থাক বললাম না তোর লজ্জা না থাকলেও আমার আছে। এরপর আমার সামনে পড়লে তোকে হিসু করিয়েই ছাড়বো।

হিমেল ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে তাই কথাটি তার শ্রবণ হয়নি। আদর নিজেও মাথা না ঘামিয়ে তারিমদের কাছে চলে যায়।

ফ্লাসবেক এন্ড। এরপরেই বাসায় এসে হিয়ান খান কে আদরের কথা বলায় রেগে যায় হিয়ান খান। আরো ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করাবে এসব বলতেই হিমেল নিজের রাগ ধমাতে না পেরে ভাঙচুর করে বাড়ি মাথায় তুলে। তার যেভাবেই হোক আদর কে চাই। উপর থেকে ভাইয়ের পাগলামি নিরবে দেখছিলো হিয়া। আদর কে তার চিনতে দেরী হয়নি। কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। তার ভাই যে তাকে এতসুন্দর উপহার দিবে ভাবতে পারেনি। এবার সে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবে। ভাইকে দিয়ে হৃদানের জীবন থেকে আদর কে সরাবে আর সময় মতো হৃদানের জীবনে এন্ট্রি নিবে সে। খুশিতে নাচতে নাচতে নিজের ঘরে চলে গেলো। সে যেন হৃদান কে নিজের করে পেয়ে গেছে এমন!
_____________________

আতইয়াব তারিম বসে আছে মুখোমুখি। দুজনের মুখ এবং মনের ভাব সম্পূর্ণ আলাদা। আতইয়াব বসে অপলক দেখছে তারিম কে আর তারিম সে তো বিরক্ত নিয়ে বসে আছে। যথটা বিরক্ত হয়েছে বুঝাচ্ছে ততটাও বিরক্ত নয় সে।

পার্ক থেকে বের হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে উপস্থিত হয় আতইয়াব। তাকে দেখে তারিম লুকাতে চাইলেও লুকাতে পারেনা। আতইয়াব আজ প্রি-প্ল‍্যান ভালোভাবে করেই এসেছে। আজ সে তারিম কে ছাড়বে না। আদর নিজেও অবাক হয়েছে এই সময় ভাই কে দেখে। আতইয়াব কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আদর সুবাহ কে নিজের গাড়িতে তুলে দিয়ে ড্রাইভার কে পৌঁছে দিতে বলেছে। আর তারিমের এক হাত শক্ত করে ধরে ছিলো যেন দৌড় না দিতে পারে। তারিম কে সে ভালোভাবেই চিনে। তারিম যেন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। মানুষটা তার ভালোবাসা। কি করে দূরে থাকে একমাত্র সেই জানে। এখন মানুষটা এত কাছ‍ে থাকলে যে সে সামলে উঠতে পারবে না। আর কত নাটক চালিয়ে যাবে সে। সে তো এতটাও কঠিন নয়। ভেতরটা খুব নরম।

আতইয়াব ঠুস করে ঘাসের উপর বসিয়ে দেয় তারিম কে। নিজেও পাশে বসে পড়ে। সেই থেকে দুজনের কারো মুখেই রা পযর্ন্ত নেই। তারিমের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। তাই কপট রেগে বলে উঠলো,

এসবের মানে কি মি. ইততেয়াজ। আমাকে আটকে রাখার রাইট কে দিয়েছে আপনাকে। হাত ছাড়ুন বলছি। ভালোবাসা দেখাতে আসছেন এখানে? আপনার ভালোবাসার নিকুচি করি। যেতে দেন আমাকে নাহলে চিৎকার করবো আমি।

আতইয়াবের শান্তশিষ্ট মুখটা হঠাৎ থমথমে হয়ে গেলো। রাগে আরো শক্ত করে ধরলো তারিমের হাত। ব‍্যাথায় চোখ বন্ধ করে নিলো তারিম। টু শব্দ পযর্ন্ত করলো না। সে দেখতে চায় মানুষটা কি করে। আতইয়াবের তারিমের আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে বলল,

ভুলে যেওনা ইউ আর মাই ওয়াইফ। তোমার উপর সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে। তাই রাইট নিয়ে কথা বলোনা। আর আমাকে ইগনোর করছো কেন? আমার ভালোবাসাকে ইগনোর করার রাইট কে দিয়েছে তোমায়?

ওয়াইফ! নামেই ওয়াইফ। কখনো সেই সম্মান টা দিয়েছেন? আর আমি আপনার ওয়াইফ দু একজন ছাড়া কেউ জানে না।তাই এত ওয়াইফ বলার কিছুই হয়নি। বাইরের একজন মানুষ আপনাকে আমার সাথে দেখলে অন‍্যকিছু ভাববে। ছাড়ুন আমার হাত। মনটা যেহেতু আমার সেহেতু আপনার ভালোবাসাকে ইগনোর করার রাইট আমার আছে। আর কাকে ভালোবাসা বলছেন? আপনার মন আছে? হৃদয় আছে? অনুভূতি আছে? যে অন‍্যের ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে, দুজন ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করে দেয় তার মনে আদও ভালোবাসা আছে?

তারিমের এমন কথায় আতইয়াব তারিমের হাত ছেড়ে দিলো। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে বলল,

ওও এই জন‍্য ইগনোর করছো। তোমার ভাইয়ের জন‍্য তুমি আমাকে ইগনোর করছো! আচ্ছা তুমি তোমার ভাইয়ের টা ভাবলে একবার আমার জায়গায় বসিয়ে দেখতো তো। আদরের জায়গায় বসাও। আমি একজন ভাই হয়ে কিভাবে ঝুঁকির মুখে বোনকে দিই বলো? আন্সার দাও?

তারিম নিজেকে শান্ত রাখলো। রেগে গেলে সমস‍্যাটা বাড়বে। তাই শান্তভাবে বুঝানোটাই ভালো। আতইয়াবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

তাহলে বলবো আপনি আমাকে ভুলে যান। কারণ হৃদান চৌধুরী ঝুঁকি নিয়ে থাকলে; হৃদযা চৌধুরীও ঝুঁকি নিয়ে থাকবে। হ‍্যাঁ একবার আমি হৃদযা চৌধুরী এক্সপোস হলে গার্ড ছাড়া বের হতেই পারবো না। শত্রুরা হামলে পড়ে কলিজাটা আলাদা করে নিবে। সেখানে যদি জানতে পারে হৃদযা চৌধুরী হাজবেন্ট আপনি। অবশ‍্যই আপনার জীবন ও ঝুঁকিতে থাকবে। আপনাকেও ওরা টার্গেট করবে। সাথে আদু কেও। আপনাদের দুজনের জীবন ঝুঁকিতে থাকবে আমাদের ভাই-বোনের সাথে জড়ালে তাই প্লিজ আপনারা দুজন আপনাদের মতো থাকুন আমি আমার ভাইকে নিয়ে ভালো থাকবো। সুন্দর দেখে বউ নিয়ে এসে সংসার করুন। ওকে এখন যাচ্ছি।

তারিমের কথাটা আতইয়াবের মনে ধাক্কা লাগলেও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রাগকেই প্রাধান‍্য দিলো সে। তেজী কন্ঠে বলে উঠলো,

তোমার কি আমাকে মেরুদন্ড হীন মনে হয়? নিজের বউ কে প্রটেক্ট করতে পারবো না? একবার তোমার দিকে তাকিয়ে দেখুক শরীর থেকে মাথা আলাদা করে দিবো।

আতইয়াবের কথায় তারিম শব্দ করে হেসে দিলো। হটাৎ ই গর্জে উঠে বলল,

আমার ভাইকে আপনার মেরুদন্ডহীন মনে হয়? আমার ভাই তার বউকে প্রটেক্ট করতে পারবে না? যে খুনখারাপি থেকে দূরে থেকেছে সে নিজের ভালোবাসার জন‍্য খুন করতে পারবে অথচ যে এসবের সাথে জড়িত, এসব করতে হাত পা কাঁপেনা ; সে পারবে না? কোনটা মনে হয় আপনার? পাগলের মতো ভালোবাসে আমার ভাইটা। তার মতো নিষ্ঠুর একটা মানুষের হৃদয়ে আদর ভালোবাসার ফুল ফুটিয়েছে। আপনার কি মনে হয় ওদের ভালোবাসা এতটাই ঠুমকো? আপনি জানেন? আদরের হাত যে জায়গায় ছুরির আঘাত লেগেছে ; ঠিক সে জায়গাতেই আমার ভাই নিজের হাতে একেরপর এক ছুরি দিয়ে আঘাত করে গেছে। আদরের শরীর থেকে যতটা না রক্ত বের হয়েছে ঠিক তার চারগুন রক্ত আমার ভাইয়ের শরীর থেকে বের হয়েছে। এটা করেই ক্ষান্ত হয়নি। সে কেন প্রটেক্ট করতে পারলো না? কেন বাঁচাতে পারলো না তার ভালোবাসাকে সেজন‍্য নিজের দুই হাতে একের পর এক আঘাত করে গেছে। যেভাবে নিজেকে কষ্ট দেওয়া যায় সেভাবেই দিয়েছে শুধু মাত্র আদরের জন‍্য! আপনার কাছে এসব কি মনে হয়? এমনি এমনি? এসব পাগলামি আমার ভাই করেছে যন্ত্রণা থেকে। যে পাথর হৃদয়ে আদর ভালোবাসা নামক ঝড় তুলেছে সে হৃদয়টাই বারবার কাঁপে প্রেয়সীকে হারানোর ভয়ে। পাগল হয়ে যায় ভাইটা আমার। ছটফট করতে থাকে আদরকে হারানোর ভয়ে। এসবের সাক্ষী আমি নিজে। হ‍্যাঁ নিজেকে আঘাত করার পরে আধো আধো জ্ঞানে আদরের নামটাই জপতো আমার ভাই। ১০৪ ডিগ্রি জ্বরেও আদরের নাম মুখ থেকে সরাতে পারিনি। নিজেকেও এতটা ভালোবাসে না যতটা আদর কে ভালোবাসে। আর আপনি? আদর ও ঠিক ততটাই ভালোবাসে। ভাইয়া তো কিছু দিন হলো ভালোবাসে আর আদর! সে তো সেই ভার্সিটির প্রথম থেকে হৃদান চৌধুরীকে ভালোবেসে আসছে। একবার ভাবুন তো আদর যাকে এতটা ভরসা করে সেই ভরসা করা মানুষটাই তার ভালোবাসা বুঝে না ; আদর ঠিক আছে? কষ্ট হয়না ওর? আর সেদিন দোষটা ভাইয়ার ছিলো না। আহনাফ চৌধুরীর মেয়ের উপর এট‍্যাক হয়েছিলো আদরের উপর না; আপনি না বুঝেই এতসব করলেন। কিচ্ছু বলার নেই আপনাকে। আপনার বিবেক কে প্রশ্ন করে দেখুন কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। পেছন ডাকবেন না। আপনি যেদিন আসল আপনিকে ধরতে পারবেন সেদিন তারিম ঠিক ফিরে আসবে!

চোখের পানি মুছতে মুছতে হাটা ধরলো তারিম। আজ যদি আতইয়াব বুঝতে না পারে আর কখনো বুঝতে পারবে না। সেও আর ফিরবে না আতইয়াবের জীবনে। যে অন‍্যের ভালোবাসাকে সম্মান দিতে জানেনা সে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ‍্য নয়। আতইয়াব মাথা নিচু করে থম মেরে বসে আছে। মাথায় কিলবিল করছে তারিমের কথা গুলো। বুকের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে। তারিম কে ফেরানোর ইচ্ছে হলেও ফেরাতে পারছে না সে। কেউ যেন গলাটা চিপে ধরে আছে। কথা বের হচ্ছে না। তারিম কে পার্কের গেটের দিকে আসতে দেখেই একজন তাড়াতাড়ি সরে দাড়ালো সেখান থেকে। ওরা পার্কের গেটের সামনেই বসেছিলো। আর কি কথা বলছিলো সবটাই শোনা যাচ্ছিলো গেট থেকে। তারিম পার্ক থেকে বের হয়ে কোনদিক না তাকিয়ে রিকশা ডেকে; তাতে চেপে বসে। হাত দিয়ে ইশারা করে চলার জন‍্য। তার ও যে কষ্ট কম হচ্ছে না। সে তো ভালোবাসে!

এলোমেলো পায়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে চলছে আদর। হাটা দেখে মনে হচ্ছে খুব দুর্বল। শরীরের দুর্বলতা নাকি মনের দুর্বলতা! চোখদুটোতে নেমে এসেছে বারিধারা। থামার নাম নেই। চোখের পানি নির্লজ্জের মতো গালটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। পানি মোছার যেন ইচ্ছেটাও আদরের মধ‍্যে নেই। তার কানেও তারিমের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কৌতুহল বশত সে ড্রাইভার কে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে নেমে আসে গাড়ি থেকে। গেটে কাছে লুকিয়ে থেকে সবটা শুনতে পায়সে। সে জানে মানুষটা তাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু এতটা ভালোবাসে জানা ছিলো না। অথচ সে সেদিন ঘরে হৃদানকে কেমন করে বলল,

আমাকে যদি ভাইয়া আর আপনার মধ‍্যে যেকোনো একজন কে বেছে নিতে হয় আমি কিন্তু ভাইয়াকেই নিবো। যার জন‍্য বেঁচে আছি; যার ভালোবাসায় বড় হয়েছি তাকে ছাড়তে পারবো না। আমি আপনাকে আর ভাইয়াকে দুজনকেই চাই!

আদরের এই কথায় কোনো ভুল ছিলো কিনা আদর জানে না। ভুল কি ছিলো! এতবছরের ভালোবাসা তো মিথ‍্যে হতে পারেনা কয়েকমাসের ভালোবাসার কাছে। কিন্তু ভালোবাসা তো ভালোবাসায়! আচ্ছা তার এই কথাটাই কি হৃদানের মনে ভীতি সৃষ্টি করেছে? সে ভাইয়াকেই বেছে নিতো ভেবেই নিজেকে আঘাত করেছে হৃদান! সে তো অন‍্যভাবে বুঝাতে পারতো! তাহলে এমন করলো কেন? এসব ভাবতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো আদর। বসে পড়লো রাস্তায়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ নিজের ঠিক দুহাত সামনে একটা গাড়ি ব্রেক কষতেই ভয় পেয়ে যায় আদর। ঠাস করে পড়ে যায় রাস্তায়! এত স্ট্রেস না নিতে পেরে ততক্ষণাৎ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে!

কে হতে পারে লোকটি? আতইয়াব কি বুঝবে? নাকি আগের মতোই তার ভাবনা নিয়ে থাকবে?

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here