মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড় #পর্ব_১৮,১৯

0
387

#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_১৮,১৯
Tahrim Muntahana
১৮

নতুন সকালের আগমন। আজ সূর্যের অভিমান হয়েছে। তাই তো আকাশটা কেমন গুমোট রূপ ধারণ করে আছে। না আছে রোদের ছিটেফোটা; না আছে বারিধারা! আজ সকাল টা আতইয়াবের কাছে অন‍্যরকম লাগছে। কাল রাত দশটাই বাড়ি ফিরেছে সে। এসেই নিজেকে ঘরবন্ধী করে রেখেছিলো। তারিমের কথাগুলো সারারাত ভেবেছে। তারিম তো ঠিক ই বলেছে। সে সত‍্যিই ভালোবাসতে জানলে অন‍্যের ভালোবাসাকে অস্বীকার করতো না। সে বোনের প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে বোনের ক্ষতির দিকটাই শুধু ভেবে গেছে; বোনের ভালো থাকা ভাবেনি। কিন্তু আজ থেকে ভাববে সে। আজ আদর কে সে অন‍্যরকম একটি দিন উপহার দিবে। এসব ভেবেই আদরের ঘরের দিকে হাটা ধরলো। কাল রাতে বোনটার খোঁজ নেওয়া হয়নি। এতটাই চিন্তিত ছিলো যে বোন খেয়েছে কিনা তাও জানে। পথিমধ‍্যে মামির সাথে দেখা হতেই আতইয়াব এক গাল হেসে বলল,

মামি আদর কাল খেয়েছিলো?

মামি চমকে উঠলো। কি বলছে আতইয়াব! আদর তো বাড়িতেই আসেনি। সে ভেবেছে আতইয়াবের সাথে আছে। বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো,

তুই আদর কে নিয়ে বাড়ি ফিরিস নি?

আতইয়াব ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

আমি আদর কে বিকেলেই পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার সাথে ফিরবে কেন?

মামি এবার পড়ে যেতে ধরলো। আতইয়াব তাড়াতাড়ি ধরে নিলো। মামি কান্না ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো,

কাল তো আদর বাড়িই ফেরেনি। আমি ভেবেছি তোর সাথে আসবে। ড্রাইভার তো তাই বললো। তুই বলছিস আদর তোর সাথে আসেনি। আমার মেয়ে কই? ও কোথায় চলে গেলো। আল্লাহ মাবুদ এখন কি হবে? কোথায় খুঁজবো?

মামির চিৎকারে মামা পরশ রোহানি ওরাও চলে এসেছে। আদরের কথা শুনতেই মামা ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। মেয়েটি কোথায় আছে কে জানে? দিন দুনিয়া তো ভালো না এখন! আতইয়াব জল‍দি সুবাহ কে ফোন দিলো। কিচেনে ছিলো সুবাহ। সকালের ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিলো। ফালাহ ঘরেই বসেছিলো। সুবাহ’র ফোন বাজতেই সুবাহ কে ডাক দিলো কিন্তু কোনো আন্সার এলো না। ফোনটা নিয়ে কিচেনে গিয়ে সুবাহ কে দিতেই সুবাহ ফোন রিসিব করে কানে ধরলো। আতইয়াবের কথা শুনেই ব‍্যালেন্স হারিয়ে হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো। মুখ দিয়ে যেন কথাও বের হচ্ছে না। চারপাশ অন্ধকার দেখছে মনে হয়। কেন যে সে আদরকে কাল প্রশ্রয় দিলো। মেয়েটার কোনো ক্ষতি হলো না তো? রাতে কোথায় যাবে মেয়েটা? শত্রুর অভাব নেই তো! ডুকরে কেঁদে উঠলো সুবাহ। ফালাহ ততক্ষণে ফোন উঠিয়ে পুরো ঘটনা শুনে নিয়েছে। নিজের ও ভয় করছে। মা কে বলে রান্না সেভাবে রেখেই সুবাহ কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। খুঁজতে হবে আদরকে।

আতইয়াব দিশেহারা হয়ে গার্ডদের খুঁজতে পাঠিয়েছে। এতবড় শহর কোথায় খুঁজবে? কোনো শত্রুর কবলে পড়লে বোনকে বাঁচাবে কিভাবে? বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। পুলিশ কমপ্লেইন করতে হবে। ইতিমধ্যে অনেকবার আদরের নম্বরে ফোন করা হয়েছে ফোন সুইচ অফ বলছে। পরশ আতইয়াবের সাথে গেলো। রোহানি বাবা-মা কে সামাল দিচ্ছে। হাসি খুশি পরিবারটাই নিমিষেই দুঃখ এসে গ্রাস করে নিলো।

আতইয়াবের গাড়ি দেখেই ফালাহ পিছু নিলো। সময় নষ্ট করা যাবে না দাড় করিয়ে। সুবাহ সেই কখন থেকে তারিম কে ফোন দিয়ে যাচ্ছে ধরার নাম ই নেই। মরার মতো ঘুমাচ্ছে তারিম। কাল রাতে অনেকক্ষণ কান্না করেছে। তাই আজ উঠতে এতটা লেট হচ্ছে। হৃদানের নম্বর তার কাছে নেই। তাই তাকে ফোন দিতে পারছে না। আল্লাহ’ই জানে নিউজটা শুনলে হৃদানের অবস্থা কি হবে। অন‍্যদিকে হৃদান জগিং থেকে ফিরে বোনের ঘরে উঁকি দিয়েছে। এভাবে এলোমেলো হয়ে ঘুমাতে দেখে হালকা হাসলো। ডাকতে যাবে তার আগেই ফোনের দিকে চোখ যেতেই দেখলো আলো জ্বলছে। কেউ ফোন দিচ্ছে। সুবু নাম দেখে ধরতে পারলো সুবাহ। এতবার ফোন দিয়েছে? তারিম কে অনেকবার ডেকে ও উঠানো গেলো না তখন নিরুপায় হয়ে নিজেই রিসিব করলো। ফোন রিসিব হতেই সুবাহ আদরের খবর জানাতেই হৃদান তেমন প্রতিক্রিয়া করলো না। কিছুক্ষণ পর বলে উঠলো,

বাড়ি ফিরে যাও। আদর সেইফ আছে। মি.ডক্টর কে বলো চুপচাপ থাকতে। লোক জানাজানি হলে সমস‍্যা হবে।

সুবাহ চুপ করে রইলো। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ফোন লাউডে থাকায় ফালাহ’ও শুনছিলো সবটা। তার বুঝতে বাকি নেই আদর কোথায় হৃদান জানে। আতইয়াবের গাড়ি তার আগেই। মাথা টা বের করে পরশ কে ডাক দিলো ফালাহ। আতইয়াব কে ডাকলেও শুনবে না সে জানে। পরশ ডাক শুনেই গাড়ি থামালো। আতইয়াব আদরের ফোনে ফোন করেই যাচ্ছে। ফালাহ’ও গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে আতইয়াবের কাছে গিয়ে দাড়ালো। আতইয়াব কে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠলো,

আতু আদর সেইফ আছে। নো টেনশন। মি.চৌধুরী বলল চুপচাপ থাকতে। লোক জানাজানি হলে সমস‍্যা হবে। বাড়ি চল! বাড়ি গিয়ে সব কথা হবে।

আতইয়াব চমকে তাকিয়ে রইলো ফালাহ’র দিকে। একসময় চোখ টা শান্ত হলো। চোখ থেকে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। ফালাহ জড়িয়ে ধরলো বন্ধুকে। বোনকে কতটা ভালোবাসে আতইয়াব ফালাহ জানে। নিজের চোখ দিয়ে না দেখা অব্দি যে সে শান্ত হতে পারবে এও জানে সে। তাই ভাবলো সব খবর জানতে হৃদান চৌধুরীর কাছে যেতে হবে। আতইয়াব ও সায় দিলো। পরশ ফোন দিয়ে বাড়িতে জানিয়ে দিলো খবর টা। রোহানি বাবা-মাকে বুঝিয়ে রেডি হয়ে নিলো। তার শান্তি হচ্ছে না। আদরকে নিয়ে আসার পর থেকেই চোখে চোখে রাখতো সে। পুতুলের মতো যত্ন করে বড় করেছে সবাই আর আদর নিজেও রোহানিকে চোখে হারাতো। হঠাৎ এরকম খবর শুনে মাথা ঠিক থাকে!

প্রায় আধা ঘন্টা পর আতইয়াব রা হৃদানের বাড়িতে এসে পৌঁছালো। হৃদান ড্রয়িং বসেছিলো। ওদের দেখে একটুও বিচলিত হলো না বরং হাসলো। আতইয়াব এসে হৃদানের পাশে বসে পড়লো। হৃদান এবার অবাক হলো। সে ভেবেছিলো আতইয়াব এসেই তার কলার ধরে কিছুক্ষণ ভাষণ দিবে। ঝারি দিয়ে যখন ক্লান্ত হবে তখন চুপ মেরে যাবে। তখন সে আরো চেতিয়ে দিবো। ভালোয় লাগে তার বড় শালা কে রাগিয়ে দিতে! আতইয়াব আরো অবাক করে বলে উঠলো,

আদর কোথায় মি. চৌধুরী? আমার বোন ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয়নি তো!

হৃদান মুচকি হাসলো। আতইয়াব মানুষটা খারাপ না। নিজের বোন না হওয়া সত্ত্বেও কথাটা ডেসপারেড। আত্মা বলে কথা! তখন ই তারিম এসে উপস্থিত হলো সেখানে। সবাই কে একসাথে দেখে হা হয়ে গেলো সে। তারউপর দুই শত্রুকে একসাথে বসে থাকতে দেখে মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। পেছন দিকে হেলে যেতে ধরতেই পান্চু পেছনে এসে পিঠ করে দাড়ালো। তারিম পান্চুর ঘাড়ে মাথা রেখে বলে উঠলো,

পান্চু ভাইয়া এটা কি দেখছি আমি। আমি যা দেখছি তুমিও তাই দেখছো কি?

হৃদান হাসলেও আর কেউ হাসতে পারলো না। চিন্তাই আছে তারা। তারিম পরিবেশ টা হালকা বুঝে এগিয়ে এসে বলল,

আচ্ছা কি হয়েছে। তোমরা এত সকালে এখানে?

কিছুই হয়নি। একটু পর সব ক্লিয়ার হবে। খিদে পেয়েছে না? কালকে রাতে কিছুই খাওনি। পান্চু সবার খাবারের ব‍্যবস্থা করো।

হৃদানের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে ফালাহ ওরা বুঝতে পারলো আদর ইস ওকে। একটু হাত কাটাতেই যেরকম পাগলামি করেছিলো সেখানে নিখোঁজের খবর শুনেও এতটা ইজি! হয়তো মাথায় কিছু চলছে। আতইয়াব শুধু ভাবছে কখন বোনকে দেখতে পাবে। হঠাৎ করেই তারিম বলে উঠলো,

তোমরা সবাই আছো কিন্তু আদু কোথায়? এইতো রোহানি আপুও চলে এসেছে। আর পিয়াস ভাইয়া কই?

রোহানি কেবল দরজা দিয়ে ঢুকেছে তখনি তারিম কথাটি বলল। হৃদান শান্ত সুরে বলল,

বলেছি না একটু পর সব বুঝতে পারবে। চুপ করে বসো।

তারিম চুপ করে বসে পড়লো। একনজর আতইয়াবের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মানুষটাকে এমন লাগছে কেন? আদর নেই! আদরের কিছু হয়নি তো। বুকটা ধক করে উঠলো তার। কিছু বলতে নিবে তার আগেই হৃদান থামিয়ে দিলো। সে তার বোনটাকেই খেয়াল করছিলো। মতিগতি দেখেই বুঝে নিয়েছে বোন কি ভাবছে।

আদর ইস ওকে হৃদু। ডন্ট পিনিক।

তারিম মায়াভরা চোখে ভাইকে দেখলো। মানুষটা তার মুখ দেখেই মনের খবর বলে দিতে পারে। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো হৃদানকে। হৃদান নিজেও বোনকে আগলে নিলো। আতইয়াব নিস্তেজ চোখে মুহূর্ত টা দেখে গেলো। তার বোনটাও তো তার বুকেই থাকতো। এখন কোথায়!

সবাই খেলেও আতইয়াব হৃদানকে খাওয়ানো গেলো না। আতইয়াব যেভাবে বসে আছে সেভাবেই ছিলো। আর হৃদান ফোনে কিসব করে যাচ্ছে। ঠিক ২০ মিনিট পরেই হৃদানের বাড়ির সামনে একটি গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে নেমে এলো একজন লোক। কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা। পাশের দরজা খুলতেই চোখে পড়লো ঘুমিয়ে জ্ঞান হারানোর মতো পড়ে আছে আদর। লোকটি কোলে তুলে নিতে যাবে ওমনি তিনজন মেয়ে এগিয়ে এসে বাঁধা দিলো। নিজেরা ধরাধরি করে নিচে নামালো। আস্তে ধীরে একজন কোলে তুলে নিলো। সদর দরজায় আসতেই ছুটে আসলো হৃদান। আগলে নিলো নিজের বুকে। যত্ন সহকারে সোফায় আতইয়াবের কোলে শুয়িয়ে দিলো। প্রাণ যেন ফিরে পেলো আতইয়াব। চুমু খেলো কপালে। হৃদান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত মুখের দিকে। তারপর মেয়েগুলোকে উদ্দেশ্যে করে বলল,

আস্তে স্পর্শ করেছেন তো? ব‍্যাথা পায়নি একটু? ওর কষ্ট হলে কিন্তু একটাকেও ছাড়বো না!

মেয়েগুলো ভয় পেয়ে মাথা নাড়ালো যে ব‍্যাথা পায়নি। সাবধানেই নিয়ে এসেছে। তারিমের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। আদর এমন হয়ে আছে কেন? কি হয়েছে ওর? প্রশ্ন গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তখনি ছেলেটি ওদের সামনে এসে দাড়ালো। মুখ থেকে কাপড় সরাতেই সুবাহ তারিম অবাক হলো। সুবাহ হালকা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

আপনিই সেই লোক না যে কাল আদর কে প্রপোজ করেছেন?

ছেলেটি হেসে হৃদানের সামনা সামনি এসে দাড়ালো। হৃদান বলে উঠলো,

মি. খান হৃদান চৌধুরীর কলিজায় নজর দিয়েছেন দেখছি!

ছেলেটি হিমেল খান! হিমেল শব্দ করে হাসলো। কিছুক্ষণ হেসে বলল,

মি.খান তো এক জনেতেই মরেছে মি.চৌধুরী! কিন্তু তাকে তো নিজের করে পাচ্ছিনা। হঠাৎ ই সব ধোঁয়াশা হয়ে গেলো।

হৃদান অবাক হলো। কার কথা বলছে হিমেল। সবার কনফিউশন বুঝে হিমেল সোফায় বসে বলল,

বুঝতে পারছেন না তো? ভালোবাসি অন‍্যজনকে অথচ প্রপোজ করলাম আদর কে! কেন? শুরু থেকে বলতে হবে! তার আগে আদরের কাছে যে ডায়েরী আছে সেটা আমার লাগবে!

চমকে উঠলো সবাই। এখানের সবাই ডায়েরী; ওদের প্ল‍্যান সম্পর্কে জানে তাই এতটা চমকে গেছে। হৃদান চমকাই নি। সে চুপচাপ আছে। হিমেল আবার বলে উঠলো,

আমি ভালোবাসি একজন কে। কাকে শুনবেন? একজন কাজের মেয়েকে। আমি অবশ‍্যই কাজের মেয়ে ভাবি না কিন্তু আমার পরিবার ভাবে। মেয়েটির নাম রিয়া। আমার জীবনের সাথে এতটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে যে আমি সব দিক না ভেবেই মেয়েটাকে ভালোবেসে যাচ্ছিলাম। মধ‍্যেখানে বাঁধা হলো আমার বাবা হিয়ান খান। একজন কাজের মেয়ে তার ছেলের বউ হবে সে ভাবতেই পারেনা। মেয়েটির উপর টর্চার করতো তাই আমি সরে এলাম রিয়ার কাছ থেকে। বাবার সামনে প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলাম ওর সাথে জাস্ট টাইম পাস করছি আমি। আরো মেয়েদের সাথে মিশতে শুরু করলাম। বাবা খুব খুশি। কিন্তু ভুল বুঝলো রিয়া। একদিন হঠাৎ করে হারিয়ে গেলো। সারাদিন খোঁজার পর সন্ধ‍্যায় পেলাম তাকে। সেদিন সবটা বুঝানোর পর মেয়েটি আবার ভরসা করতে লাগলো আমাকে। তার জীবনের সব কথা আমাকে শেয়ার করলো। প্রথমে তো বিশ্বাস ই করতে পারছিলাম না। পরে রিয়া বলল তার একটা ডায়েরী ছিলো যার মধ‍্যে সব প্রমাণ আছে। কিন্তু ডায়েরী টা একজন মেয়েকে দিয়ে দিয়েছে। কারণ বাবা তাকে সন্দেহ করছিলো কিছু ব‍্যাপার নিয়ে। কোথায় খুঁজবো ডায়েরী। যে জায়গাটার নাম বলল সেখানে গেলাম। টাকা দিয়ে সি সি ফুটেজ চেক করলাম ওইদিনের। মেয়েটি আদর ছিলো। কয়েকদিন আদরকে নিয়ে খোঁজ নিলাম। হঠাৎ করেই আদর নিজেকে আহনাফ চৌধুরীর মেয়ে বলে দাবি করলো। আরেকটু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আদর রাতাফ আহমেদের মেয়ে। সবটা ক্লিয়ার হলো। কিন্তু মাঝখানে ঘেটে গেলো আরেকটা ডায়েরী পেয়ে। আমি আমার দাদুকে খুব ভালোবাসতাম। দাদুর মৃত‍্যবার্ষিকীতে দাদুর ঘরে বসেছিলাম। ঘরটা নিজের হাতে পরিষ্কার করছিলাম। হঠাৎ করেই একটা ডায়েরী দেখতে পাই। কৌতুহলবশত ডায়েরী টা খুলে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খাই। আমার দাদু রিয়ার ব‍্যাপারে সব জানতো। জেনে বুঝেই সে রিয়াকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। আহনাফ চৌধুরীর একটা মেয়ে আছে সবাই জানলেও তাকে দেখার সৌভাগ্য কারো হয়নি। সব সময় লুকিয়ে রাখতেন মেয়ে বউকে। তাই হয়তো আমার পরিবার চিনতে পারেনি রিয়াকে। দাদুর বেঁচে থাকায় রিয়া আমাদের মতোই বড় হচ্ছিলো। দাদুর মৃত‍্যর পরেই সব পাল্টে গেলো। কিন্তু আমি মেয়েটিকে আগের মতোই কেয়ার করতাম। আসল কালপ্রিট কে শুনবেন? আর কেউ না আমার জন্মদাতা বাবা হিয়ান খান। যার সুস্পষ্ট প্রমাণ না থাকলেও দাদুর কথাগুলো মিথ‍্যে ছিলো না। আহনাফ চৌধুরীর সম্পত্তির ফাইল তার স্টাডি রুমে দেখেছিলাম আমি। রিয়াকে ওই বাড়িতে রাখার সাহস হলো না। রাতের আঁধারে লুকিয়ে বাড়ি থেকে অন‍্যত্র রেখে আসলাম। এখন আমার প্রমাণ দরকার। তাই আদরের পেছন ঘুরা শুরু করলাম। বাড়িতে ভাঙচুর করে বাবাকে বুঝালাম আদর কে চাই ই চাই। আমি জানতাম বাবা নিজেকে বাঁচাতে আদরের ক্ষতি করতে চাইবে সেই থেকেই প্রমাণ জোগাড় করে বাবাকে হাতেনাতে ধরবো। এসব শুধু আমি আমার ভালোবাসার জন‍্য করছি না আমি একজন সিক্রেট এজেন্ট সিআইডির। কেউ জানে না এটা। আহনাফ-নাবিল চৌধুরী, রাতাফ আহমেদ তিনজনের কেসটা নিয়ে অনেকদিন হলো কাজ করছি গোপনে। কিছুতেই সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রিয়া আর আদরের জন‍্য সম্ভব হয়েছে!

সবাই থম মেরে বসে আছে। আসল কালপ্রিট তাদের জানা কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না কারোর। এতটা রহস‍্য! হৃদান ভাবছে অন‍্যকিছু। হঠাৎ করে হিয়ান খানের ছেলে এসে এসব বলবে কেন? শুধুমাত্র নিজের ডিউটি আর ভালোবাসার জন‍্য? নাকি অন‍্য কারণ আছে? হৃদান গম্ভীর মুখ দেখে হিমেল বলে উঠলো,

এসবের পেছনে আমার আরেকটা কারণ আছে। দাদু যে উইল করেছিলো সে উইলে তার সাইন ছিলো না; টিকছাপ ছিলো। আর দাদুর মৃত‍্যটাও হঠাৎ করে হয়েছে। আমার সন্দেহ দাদুর মৃত‍্যটা স্বাভাবিক নয়। এই রহস‍্যের সমাধান ও আমাকে খুঁজে বের করতে হবে!

হৃদান এবার স্বাভাবিক হলো। হিমেলের চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না সে মিথ‍্যে বলছে। বরং চোখ মুখে গাঢ়তার ছাপ। আদরের ঘুম অনেক ক্ষণ আগেই ভেঙেছে। সব কথায় শুনেছে সে। সবটা শোনার পর সে ক্লিয়ার এখন সবকিছুর পেছনে হিয়ান খান। কিন্তু তার উদ্দেশ‍্যটা বা কি? আদর উঠে বসলো। মাথাটা হালকা ভার ভার লাগছে। নরম সুরে বলে উঠলো,

আহনাফ আংকেল কে কোথায় রেখেছে আপনার বাবা? তার উদ্দেশ্যে টাই বা কি?

হিমেল চমকালো। আহনাফ চৌধুরী তো মৃত তাহলে আদরের কথার মানে! হৃদান হিমেলের বিচলিত মুখ দেখেই বুঝলো। বলে উঠলো,

আমাদের মনে হচ্ছে মামা বেঁচে আছে। মি.শিকদারের কথায় এমনটাই মনে হয়।

হৃদান আগের সব কথায় বলল হিমেল কে। হিমেল এবার মনে মনে ছক কষে নিলো কি করবে। আদর বলল,

রিয়া আপু এখন কোথায়? দেখা করবো আমি! তার জানা উচিত এসব।

হিমেল ও সায় জানালো। কাকে যেন ফোন দিয়ে আসতে বলল। হৃদান হঠাৎ করেই বলে উঠলো,

মি. খান কে কিডন‍্যাপ করি?

সবাই চুপ। ভাবছে হয়তো। ছেলের সামনে বাবাকে কিডন‍্যাপ করার কথা বলছে কিভাবে! আতইয়াব তারিমের দিকে তাকিয়ে বলল,

বউ শুনছো?ননদের জন‍্য খাবার নিয়ে এসো!

সবাই একপ্রকার ভুত দেখার মতো তাকালো আতইয়াবের দিকে। সিরিয়াস একটা মুহূর্তে কি বলল! তারিম তো তাজ্জব হয়ে দেখছে আতইয়াব কে। আতইয়াবের মুখে রসিকতার ছাপ। আদর শব্দ করে হেসে দিলো। সবাই গম্ভীর ভাবটা কাটিয়ে মুচকি হাসলো। তারিম উঠছে না বলে আতইয়াব আবার বলল,

শশুড় বাড়ি এসে অপমান হতে হচ্ছে। এটা মানা যাচ্ছে না বউ। ননদ কে না খাইয়ে রাখবে? আমার বোন তার হবু শশুড় বাড়ি এসে না খাইয়ে থাকবে?

এবার হৃদান চমকালো। যেমন তেমন চমকানো না। হাই লেভেলের চমকে উঠেছে সে। আদরের শশুড় বাড়ি মানে? মানে আতইয়াব তাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে? হাউ পসিবল? সে স্বপ্ন দেখছে নাকি। উঠে উপরে চলে গেলো হৃদান।তারিম খুশিতে নাচতে নাচতে কিচেনে গেলো। সে বুঝেছে কালকের কথাগুলোর ই ফল আজকের হাসিমুখ। খাবার আনতেই আতইয়াব আদর কে যত্ন করে খাইয়ে দিলো। হিমেল কে জোর করার পরেও খাওয়ানো গেলো না।

অন‍্যদিকে বসকে উদাস হয়ে উপরে উঠতে দেখে পান্চুর কেন জানি মনে হলো পিছু নেওয়া উচিত। আস্তে আস্তে পা ফেলে পিছু নিলো। হৃদান রুমে ডুকেই বিছানায় বসে পড়লো। আতইয়াবের কথাগুলো আবার নিজের মুখে আওড়াতে লাগলো। আসলেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু সুখ আছে যার শুরুটা খুব সহজেই কেউ মেনে নিতে পারে না। হৃদানের ও ঠিক তেমন টাই হয়েছে। ১০ মিনিট ঝিম মেরে বসে রইলো। তারপর হঠাৎ খানিক টা শব্দ করে হেসে দিলো। পান্চু দরজায় পাশে দাড়িয়ে সব দেখছে। বসের মতিগতি তার ভালো ঠেকছে না। পাগল হলো নাকি। হৃদান পান্চু কে আরো অবাক করে দিয়ে লো ভলিউমে গান ছেড়ে দিয়ে নাচতে লাগলো। তাও লুঙ্গি ডান্স গানে! পান্চু দরজা ধরে বসে পড়লো। ঠুস করে ঠেলা গেলো টাক মাথায়। ব‍্যাথাটাকে পাত্তা না দিয়ে দৌড়াতে লাগলো। আজ তাকে দেখাতেই হবে। বস যে পাগল হইছে আজ সে প্রমাণ করেই ছাড়বে। পান্চুকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে সবাই ভাবলো কি না কি। পান্চু কোনো কথা না বলে শুধু হাত দিয়ে ইশারা করছে। ওরা ভাবলো খারাপ কিছু ঘটেছে নাকি। পান্চুর পেছনে ছুট লাগালো। হৃদানের ঘরের সামনে আসতেই সবার পা আপনাআপনি থেমে গেলো। বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে সবাই। তোয়ালে কে লুঙ্গির মতো ধরে রেখে লুঙ্গি ডান্স গানে উরাধুর নেচে চলছে হৃদান। আতইয়াব মুখ চেপে হাসছে। এইটুকু কথায় কেউ এতখুশি হতে পারে ভাবতেই পারেনি সে। কতটা ভালোবাসলে হৃদান চৌধুরীর মতো লোক বিয়ের খুশিতে এভাবে পাগলের মতো নাচ করতে পারে! গান শেষ হলেও হৃদানের নাচ থামলো না। একা একাই কিছুক্ষণ পাগলা ডান্স দিয়ে পেছনে ঘুরতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। লজ্জায় মাথা কা ** টা যাচ্ছে!খুশিতে দরজা লাগাতেই ভুলে গিয়েছিলো সে। আদর হৃদানের মুখের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দিলো। খুশি যে তার ও কম হচ্ছে না। সে কি পাগল কম। ছুটে ঘরে ঢুকে গেলো। এই আনন্দটা সে কখনোই মিস করতে চাইনা। মানুষটা এভাবে আজ প্রথম নাচতে সে কি করে সময়টা বদলাতে পারে। আরেকটা গান দিয়ে নিজেও নাচতে শুরু করলো। হৃদান যেন এবার ভুলেই গেলো আশেপাশে কেউ আছে। আদরের দেখাদেখি নিজেও নাচতে লাগলো। গানের সাথে নাচের মিল না থাকলে কি হবে শরীর তো নড়ছে।
ওতেই হবে! ওদের কে একা ছেড়ে দিয়ে ওরা ড্রয়িং রুমে এসে বসে। এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে জোরে হেসে দেয় সবাই। তারিমের খুশি যেন ধরে না। মিষ্টি এনে সবাইকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। নিজেও এবার জামাইয়ের সাথে থাকবে। আহ মজা! খুশিতে ভুলেই গেলো একটু আগের গোমট পরিবেশের কথা।

চলবে…?

#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_১৯
Tahrim Muntahana

সকাল গড়িয়ে দুপুর হওয়ার উপক্রম। সবাই হৃদানদের বাড়িতেই আছে। ড্রয়িং রুমে বসে আছে সবাই। কেউ কথা বলছে না। নিরাবতা পালন করছে। কিন্তু চার কুপোতকুপোতি নিজেদের মধ‍্যে চোখে চোখে কথা বলেই যাচ্ছে। চার জুটির মতিগতি লক্ষ‍্য করছে স্বয়ং পান্চু। তার মনে বহুত দুঃখ। মুখটা হুতুম পেঁচার মতো করে রেখে একবার এদিক তাকাচ্ছে তো আরেকবার ওদিক তাকাচ্ছে। বেশী চোখ যাচ্ছে তার বসের দিকে। একবার ঠোঁট চোখা করছে তো আরেকবার চোখ মারছে। আদর ও তো কম যায় না। সেও পাল্টা জবাবে কখনো চোখ মারছে অনবরত আবার কখনো তার বসের থেকে দ্বিগুন হারে ঠোঁট চোখা করছে। এসব দেখে টাক্কুর হাত তার টাক মাথায় এমনিই চলে যাচ্ছে। আফসোস ও তার তিনগুন হয়ে যাচ্ছে। আর ওই মেয়েটার দেখা পাইনি সে। এরপর একবার দেখা পাইলে সোজা কাজি অফিস চলে যাবে। আর কোনো ছাড় নেই।

পান্চুর এমন প্রেম প্রেম পরিবেশ ভালো লাগছে না। সে সিঙ্গেল থেকে দুঃখ পাবে আর তার বস মজা নিবে তা তো হয়না। দাড়া তোদের প্রেমে হাত ঢুকাচ্ছি। মনে মনে প্ল‍্যান করে সামনে এগোনোর আগেই থেমে গেলো। ভয় লাগছে। তার বস মানুষটা ভালা না। যদি ধুম করে কিল বসিয়ে দেয় টাক মাথায়!
নাহ পান্চু না। তোর যেতেই হবে। এটা তোর মতো ঝুলে থাকা সিঙ্গেলদের সংগ্রাম। মনে মনে বলে আস্তে করে এগিয়ে গেলো পান্চু। হৃদানের থেকে দুরুত্ব বজায় রেখে ভদ্রতার সহিত বলে উঠলো,

বস আর্জেন্ট দরকার ছিলো। আজকে মিটিং আছে সেই বিষয়ে।

হৃদান বিরক্ত হলো। শান্তিতে প্রেম ও করতে পারবে না নাকি। এই বিজনেস চুলোই যাক। কিন্তু ডিলটা খুব ইমপরটেন্ট ছিলো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আজকে নিতে হবে। তাই অগত‍্যা উঠে হাটা ধরলো নিজের রুমে। পান্চু নিজেকে বাহুবা দিয়ে হৃদানের পিছু নিবে পাশ ফিরে দেখতে পেলো পিয়াস-রোহানি দুজনে বেশ গল্প করছে। হাসতে হাসতে একজনের উপর আরেকজন ঢুলে পড়ছে। তোদের হাসাহাসি করাচ্ছি দাড়া। ভেবেই পিয়াসের একদম কাছে গিয়ে বলে উঠলো,

বস ডাকছে স‍্যার চলুন।

পিয়াসের রাগ হলো। হাটুর উপরে রাখা ছোট বালিশ টা খামচে ধরলো। মনে হচ্ছে হৃদান কে চিবিয়ে খেতে পারলে শান্তি লাগতো। শালা নিজে প্রেম করবে অথচ তার প্রেমে বাঁধা দিবে। পান্চু তাড়া দিতেই অগত‍্যা তাকে উঠতে হলো। রোহানির মুখটাও মলিন হয়ে গেলো। আহা সময়টা কত ভালো যাচ্চিলো। এই জিজুটা যে কি করেনা। সবসময় কাজ আর কাজ। বিয়ের দিন শোধ তুলবে সে। ভেবেই মনে মনে হেসে মাথা ঝাঁকালো। যেন এখনি সে হৃদানের উপর শোধ নিয়ে নিয়েছে। পান্চু খুশি মনে উপরে চলে গেলো। আহা এখন কর প্রেম। কিছু সিড়ি ভেঙে নিচের দিকে তাকাতেই দেখলো আতইয়াব তারিমের হাত ধরে বসে আছে। মুখে হাসি টেনে আস্তে আস্তে কিসব বলছে আর তারিম লাল নীল হলুদ সবুজ বেগুনি হয়ে যাচ্ছে। তার পাশেই সোফায় ফালাহ-সুবাহ কিছুক্ষণ কথা বলছে তো কিছুক্ষণ এটা ওটা নিয়ে খুনসুটি ময় ঝগড়া করছে। টাকলা মাথাটাই হাত বুলালো পান্চু। নাহ এদের কেও ছাড় দেওয়া যাচ্ছে না। শাস্তি এদের কেউ পেতে হবে। ঝটপট নিচে নেমে এসে তারিমের সামনে মাথা নিচু করে দাড়ালো। আতইয়াব তখনো তারিমের হাত ধরে আছে। পান্চুর মনে হচ্ছে দিলটা ফেটে যাবে। মনে মনে আতইয়াব কে নির্লজ্জ বলেও ক্ষান্ত হলো না। তারিম কে উদ্দেশ্য করে বলল,

তারুআপু বস কফি দিতে বলল।

তারিম জোর করে আতইয়াবের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। বসা থেকে উঠে বলে উঠলো,

আচ্ছা তুমি যাও পান্চুভাইয়া আমি বানিয়ে দিচ্ছি। সবার জন‍্য চা ও করতে হবে।

এই বলে হাটা ধরলো তারিম। আতইয়াব মুখটা পাংসুটে করে হিমেলের সাথে কথা বলতে লাগলো। হিমেল এতক্ষণ ফোন টিপছিলো। অন‍্যকিছু দেখার সময় নেই তার। পান্চু এবার সুবাহ’র দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

সুবু আপু তারুআপু কে সাহায‍্য করো একটু। একা একা কাজ করছে!

চমকে উঠলো ফালাহ-সুবাহ। এতক্ষণ নিজেদের প্রেমালাপে ব‍্যস্ত ছিলো। হুট করে দাড়িয়ে গেলো সুবাহ। লজ্জা পেয়েছে একটু। রান্না ঘরের দিকে ছুটলো। ফালাহ নিজের অবস্থান থেকে উঠে আতইয়াবের পাশে বসে আলাপ করতে লাগলো। পান্চু একগাল হাসলো। আহ এখন শান্তি লাগছে। আদর লক্ষ‍্য করছিলো পান্চুকে। পান্চু আদরের দিকে তাকিয়ে টাক মাথায় হাত দিয়ে ভ্রু নাচালো। আদর খিলখিল করে হেসে দিলো। সে সবটাই বুঝতে পেরেছ। তার এত হাসি পাচ্ছে যে বলার বাহিরে।

উপরে পান্চুর জন‍্য অপেক্ষা করছে হৃদান পিয়াস। সেই কাজের কথা বললো অথচ তার ই আসার নাম নেই। পান্চু আসতেই হৃদান ভাবলো একটা ঝারি দিবে পরে ভাবলো থাক আজ ঝারি দিয়ে কাজ নেই। বিশেষ একটা দিন আজ। পান্চু এসে আগের দিনের কাজ গুলোই বারবার রিপিট করছে দেখে হৃদান ভ্রু কুচকালো। পান্চু ভয় পেলো। আস্তে আস্তে সরে এসে দরজার কাছে দাড়িয়ে বলে উঠলো,

আপনাদের প্রেম দেখে আমার মতো ঝুলে থাকা সিঙ্গেলদের বুঝি কষ্ট হয়না। আজকে আর পাবেন না আমাকে!

লে দৌড়। হৃদান এবার বুঝতে পারলো পান্চুর কাজ কি। রাগ হলো না বরং প্রচন্ড হাসি পেলো তার। লাইক সিরিয়াসলি পান্চুর ও প্রেম করার শখ জেগেছে। দুজনে হাসলো। হেসে নিচে চলে গেলো। এসে দেখলো পান্চু নেই। বাড়ির বাইরে চলে গেছে ভয়ে। আরেকদফা হাসাহাসি করে নিলো সবাই।

আড্ডার মাঝেই উপস্থিত হলো রিয়া। এসেই হিমেল কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। মানুষটাকে কতদিন ধরে দেখে না। হিমেল আগলে নিলো নিজের প্রেয়সীকে। বাবা তার পেছনে লোক লাগিয়ে দিয়েছিলো তাই তো চাইলেও রিয়ার কাছে যেতে পারতো না সে। সবাই ভাবলো ওদের একটু সময় দেওয়া দরকার। কিন্তু হিমেল বাঁধা দিলো। তার হাতে সময় খুব কম। হিয়ান খান জানতে পারলে সমস‍্যা হয়ে যাবে। আদর নিজেই রিয়ার কাছে আসলো। রিয়া প্রথমে দেখেই চিনতে পারেনি। পরে খেয়াল করতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আদর মাথা নেড়ে সায় দিতেই রিয়া আদরের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। আদর মুচকি হাসলো। রিয়া বিচলিত হয়ে বলে উঠলো,
আমার ডায়েরী! ডায়েরীটা যত্নে রেখেছো তো।

আদর মাথা নাড়ালো। রিয়াকে নিয়ে সোফায় বসলো। হৃদান তারিমের দিকে ইশারা করে বলল,

তোমার ফুফাতো ভাই-বোন। হৃদান চৌধুরী ও হৃদযা চৌধুরী।

রিয়া অবাক হয়ে তাকালো ওদের দিকে। ওর যেন বিশ্বাস ই হচ্ছে না। তারিম এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে রিয়ার পাশে বসলো। আদর আবার বলল,

তোমার রিদিমা ফুফুর ছেলে মেয়ে এই দুজন। আর তোমার ডায়েরী ঠিক আছে। এমন কি তোমার বাবাও বেঁচে আছে।

রিয়া আকস্মিক দাড়িয়ে গেলো। তার মাথা ঘুরছে। কি বলছে এসব। তার বাবা বেঁচে আছে। তারিম আবার বসিয়ে দিলো রিয়াকে। সবটা জানালো। রিয়া থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। কান্নারা যেন উপচে পড়তে চাইছে। হিমেল মাথা নিচু করে বসে আছে। কেন জানি নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। রিয়া বলে উঠলো,

আমাকে আমার বাড়িতে যেতে হবে হিমু। ওখানেই আছে এসবের পেছনের কারণ। কেন এতগুলো মানুষ কে হত‍্যা, বাবা কে আটক সব রহস‍্য ওই বাড়িতেই। আমি ডায়েরীর মধ‍্যের এক পাতা ছিড়ে ফেলেছিলাম। সেখানেই বাবা স্পষ্ট করে লিখে গেছে সব প্রমাণ, কারণ তার ঘরের সিক্রেট রুমে আছে। যেতে হবে আমাকে। হিমু নিয়ে চলো আমাকে।

রিয়া হিমেলের দিকে আকুতি ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে। হিমেল উঠে দাড়ালো। হৃদান সামনে এসে বলল,

শুধু তোমরা না আমরাও যাবো। আমাদের ও সব রহস‍্য জানতে হবে। কেন আমার বাবাকে খুন করা হলো জানতে হবে!

আর কথা বাড়ালো না কেউ। দুটো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এখান থেকে অনেকটা পথ যেতে হবে। গাড়িতে কেউ কারো সাথে কথা বললো না। সবারই মনের মধ‍্যে উৎকণ্ঠা কাজ করছে। আজকেই কি রহস‍্য সব খোলাসা হবে নাকি আবার রহস‍্যের সন্ধান পাবে। যেতে যেতে প্রায় সন্ধ‍্যা লেগে গেছে। চারদিকে কেবল অন্ধকার হতে শুরু করেছে। ভালোই হলো। রাতের আঁধারে কেউ টের পাবে না। হৃদান সাথে গার্ড নিয়ে এসেছে। পুরো এরিয়াটা ঘেরাও করা। কোনো রিস্ক সে নিতে চায়না। চৌধুরী বাড়িটা এখনো মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। গেটের সামনে দুজন প্রহরী। সরকার কর্তৃক তাদের নিয়োগ করা হয়েছে। আহনাফ চৌধুরী একজন সৎ কমিশনার ছিলেন এইটুকু সার্ভিস তার পাওয়া উচিত। দুজন গার্ড এতো মানুষ দেখে এগিয়ে আসলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো একজন বৃদ্ধ লোক। হৃদান ততক্ষণে গার্ড দ্বারা প্রহরী দুজনকে সরিয়ে দিয়েছে। বৃদ্ধ লোকটাকে দেখে দৌড়ে এগিয়ে গেলো রিয়া। চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে। লোকটি বয়সের ভাড়ে খানিকটা নুইয়ে গেছে। পাওয়ারের চশমা টা হাত দিয়ে ঠিক করে রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখটা কেমন চেনাচেনা লাগছে। মনে করতে পারছে না। বয়স হয়েছে; চোখে ছাউনি পড়েছে ; ওতসব কি মনে থাকে। রিয়া আবেগে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো,

মিও দাদু!

চমকে উঠলো বৃদ্ধটি। কে ডাকছে এই নামে? অনেকদিন পর এই ডাকটা শুনলো সে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। অনেকদিন হলো মুখে হাসি নেই তার। লাঠিতে ভর করে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো,

কে ডাকলা, এই নামে কে ডাকলা এহন?

মিও দাদু আমি রিয়া। চিনতে পারছো আমাকে। আমি তোমার সেই ছোট বিড়াল ছানাটা!

লাঠির ভরটা ছেড়ে দিলেন বৃদ্ধটি। রিয়া খপ করে ধরে নিলো তাকে। সবাই অবাক হয়ে দেখছে। বৃদ্ধটি তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেলো। রিয়াও ছুটলো তার পেছনে। মানুষটা বড্ড শকড পেয়েছে এই বয়সে। হৃদান রাও গেলো। সবকিছু শুনতে হবে।
রিয়া সরাসরি নিজের ঘরে ঢুকে পড়লো। এই বাড়ির প্রত‍্যেকটা কোণা তার চেনা। এই বাড়িই তার জগত ছিলো যে। বৃদ্ধটি একটা ছবি ফ্রেম আগলে রেখে নিচে বসে আছে। ঘরটা একদম ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে না এখানে কেউ থাকেনা। এতবড় বিছানা থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধটি নিচে বিছানা করে ঘুমাই। রিয়া বৃদ্ধটির পাশে বসে পড়লো। বৃদ্ধটির চোখে পানি। হয়তো পুরোনো কথা মনে পড়েছে। রিয়া শুনতে পেলো বৃদ্ধটি আধো আধো ভাঙা গলায় বলে চলছে,

আমার ছোড বিলাই ছানা একদিন আসবো। আসবো দেইখাই তো বাঁইচা আছি এহনো। না হইলে কবেই মইরা যাইতাম।

রিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে এতটা বছর অপেক্ষা করতে পারে। বৃদ্ধটির হাত থেকে ছবিটা শক্ত তোশকটিতে পড়ে গেলো। আশ্চর্য হয়ে বুঝতে লাগলো ব‍্যাপারটা। হিমেল গিয়ে রিয়াকে সামাল দিলো। বৃদ্ধটি এত মানুষ দেখে আবার নিজেকে কঠোর করে নিলো। রিয়া বলল,

মিও দাদু আমিই তোমার ছোট বিড়াল ছানা। মনে আছে কত খেলতাম তোমার সাথে। আমার সবটা সময় তো কেটেছেই তোমার সাথে। আমাকে বাবা-মার মতো আগলে রেখেছিলে।

বৃদ্ধটি আলতো করে রিয়ার মুখটা ছুয়ে দিলো। দাঁত ছাড়া মুখটাতে হাসি ফুটে উঠলো। চোখের কোণে পানি এখনো চিকচিক করছে। এই বৃদ্ধটি আগে আহনাফ চৌধুরীর বাড়িতে কাজ করতো। মূলত গ্রাম থেকে রিয়ার দেখাশুনার জন‍্যই তাকে এনেছিলো আহনাফ চৌধুরী। এরপর থেকেই তিনি সবটা সময় ব‍্যয় করতো রিয়ার দেখাভালের পেছনে। খাওয়া থেকে ঘুমানো গোসল করানো সবটা সে খেয়াল রাখতো। রিয়ার জগতে মা-বাবা ও এই বৃদ্ধটাই ছিলো। ভালোবেসে মিও দাদু বলতো; আর বৃদ্ধটি বিলাই ছানা বলতো।

পরিবেশ এখন শান্ত। বৃদ্ধটি চোখ মুখ বিষণ্ন করে বলতে লাগলো,

হেইদিন সাহেব আমারে জোর কইরা অন‍্য জায়গাই না পাঠাইলে ওমন হইতো না। আমার বিলাই ছানাকে হারাইতে হইতো না। সাহেব রেও না। এত বছর অপেক্ষা করছি বিলাই ছানার জন‍্যে। বাড়িডায় একডা মানুষ ও ঢুকতে দেই নাই।

কাঁদতে শুরু করলেন। একটা রাত কতকিছু কেড়ে নিয়েছে। রিয়া ওরা বুঝালো। বৃদ্ধটি ওদের জন‍্য খাবারের ব‍্যবস্থা করতে গেলো। কতবছর পর বৃদ্ধটির মুখে হাসি ফুটেছে। ওরা না করলো না। বাবার রুমে ঢুকে পড়লো রিয়া। দেয়াল গুলো ভালো করে চেক করে আলমারি টা সরাতে বললো হৃদান দের। তাই করলো। আলমারি সরাতেই রিয়া হাত দিয়ে দেয়ালে তিন-চারটা টোকা দিলো সাথে সাথে নিশব্দে দরজা টা খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকে পড়লো সবাই। ঘরটিতে অস্ত্রের অভাব নেই। জং ধরে গেছে। রিয়া সোজা টেবিলের দিকে ছুটলো। ময়লার আস্তরণ পড়ে আছে। ডয়ারটা খুলতেই চোখে পড়লো কয়েকটা পেনড্রাইভ। হাতে তুলে নিলো। কয়েকটা দলিল। সম্পত্তির দলিল। স্পষ্ট লিখা আছে তার সব সম্পত্তির অর্ধেক তার মেয়ে আর অর্ধেক তার বোন রিদিমা চৌধুরী। যা পাবে তার ছেলে মেয়ে। রিয়া হৃদানের হাতে দলিলটা দিলো। হৃদান দেখলো না রেখে দিলো। তার এসবে ইন্টারেস্ট নেই। তার কি কম আছে!
সারাঘর খুঁজলো। আর কিছু পেলো না। বের হয়ে আসলো ঘর থেকে। রাত দশটাই সবাই খেতে বসলো। নিজ হাতে রিয়াকে বেড়ে দিচ্ছে বৃদ্ধটি। রিয়া মায়াভরা চোখে দেখছে সবটা। খাওয়া দাওয়া শেষে চলে আসার প্রস্তুতি নিতেই বৃদ্ধটি মন খারাপ করলো। রিয়া বলল,

আমি একা যাচ্ছি না। তুমি যাবে আমার সাথে। একসাথে থাকবো। চিন্তা নেই তোমার সাহেব ও ফিরে আসবে। আবার প্রাণ ফিরে পাবে চৌধুরী বাড়ি।

বৃদ্ধটি ফোকলা দাঁতে হাসলো। তার মহা আনন্দ হচ্ছে। বেরিয়ে পড়লো সবাই। বাড়ি ফিরে পেনড্রাইভে কি আছে দেখতে হবে। কাল থেকেই তাদের আহনাফ চৌধুরীকে খুঁজার মিশন শুরু হবে।
আদ ও কি সে বেঁচে আছে?

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here