#মন_পিঞ্জর,পর্ব_৩৯
#লেখিকা_আরোহী_নুর
দেখতে দেখতে কেটে গেছে দুমাস,চৌধুরী ম্যানশনে ছেয়ে আছে নিস্তব্ধতা,কেউ খুশি হতে পারে না এখন,আগের মতো বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় নেই,চারিদিকেই শুধু নিরাশা আর নিরাশা,আয়ানদের বাড়ি আর সম্পত্তি ফিরে পেয়েছে আয়ান,তারপর আয়েশা আর মিরা রাহমানকে অনেকবার আয়ান নিতে এসেছে তবে ওরা যায় নি,আয়েশা তো চৌধুরী ম্যনশনেও থাকতে চায় নি তবে সবাই অনেক জোড়াজুড়ি করাতে থাকতে হলো,ইশা মা আর দিদুর কথা ফেলতে পারে নি ও,ওকে এ অবস্থায় অন্যত্র যেতে দিতে একদম নারাজ ওরা,তবে ও মনে এটে নিয়েছে সুস্থ হয়ে গেলে আর এখানে থাকবে না,যতোই হোক অন্যের ঘরে আর কদিন পরে থাকবে,বিষয়টা আয়েশার আত্মসম্মানে আঘাত করছে,তাছাড়া পুষ্পকে নোমানের আশেপাশে সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আর জুটিয়ে পারছে না আয়েশা,এই দু’মাস নোমান অনেক খেয়াল রেখেছে আয়েশার,ওকে এক মুহুর্তের জন্যও একা ছাড়তে চায় নি,যা পুষ্প মেনে নিতো না,নোমানের সামনে কিছু বলতে গেলে নোমান তার প্রতিবাদ করে তাই নোমানের অগোচরে আয়েশাকে খুঁচা মেরে কথা বলে,সবাই নোমানের আয়েশার প্রতি খেয়াল করা দেখে অবাক,প্রথমে সবাই ভাবছিলেন হয়তো ডাক্তার হিসেবে আয়শার এমন খেয়াল রাখছে তবে আস্তে আস্তে সবারই মনে কথাটা অন্য সুত্রে ধরা দিচ্ছে,নোমানও যেনো আয়েশাকে নিয়ে অনুভব করতে পারছে অনেক কিছুই,নোমান আর পুষ্পর বিয়েটা এখনও স্থগিত রয়ে গেছে,আঁখি আর আদৃত ফিরা না পর্যন্ত ঘরে কোনো আনন্দ উৎসব করতে সবাই নারাজ,তবে কবে চৌধুরী বাড়ির সেই সুখের দিন ফিরে আসবে কে জানে,আয়েশা এখন নিজে থেকে অনেকটা হাঁটতে পারে,আয়েশাও আঁখিরই অপেক্ষায় আছে,ও আসলে ওকে আর মায়ে নিয়ে নিজেদের এক আলাদা গন্তব্য বেঁছে নিবে,মাঝে মধ্যেই আঁখির কথা ভেবে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে আয়েশা,অপেক্ষার প্রহর যেনো কাটছেই না ওর,আঁখিকে ছাড়া যেনো জীবন নিঃস্ব।
সায়েদাও বেশ ভালো নেই,সেদিনের পর থেকে তাজবীরের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারে নি সায়েদা,তাজবীর সায়েদার ওর সাথে যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে,দিন দিন তাজবীরের স্মৃতিতে কাতর হয়ে পরছে সায়েদা, পারছে না ওকে ভুলতে,নাওয়া খাওয়া একপ্রকার ভুলেই গেছে,ঘুমও আসে না রাতে তেমন,পড়ালেখাতেও মন নেই,নিজের ভুল বুঝতে সক্ষম হয়েছে তবে তার ক্ষমা চাওয়ারও সুযোগটা তাজবীর ওকে দিচ্ছে না।
কোথাও যেনো কেউ ভালো নেই,কারো মনে সুখ নেই,চৌধুরী পরিবারে সবারই মোনাজাতে হাত তুলে এখন শুধু একটাই চাওয়া আঁখি আর আদৃতকে,তবে উনাদের সে চাওয়া কবে পূর্ণ হবে কে জানে।
কেবিনের ছোট্ট কাচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে আয়ান,চোখে শুকনো জল লেগে আছে,কাঁদতে কাঁদতে যেনো এখন চোখ দিয়ে জলটাও বের হয় না,সবাইকে হারিয়ে এখন নিঃস্ব সে,মা বোন তাকে মাফ করবে কি না সে জানে না তবে ওদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও ছাড়বে না আয়ান,যে করেই হোক ওদের নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনবেই,আর বাকি রইলো আঁখি,ও তো এখন কথায় বলে না,নিজেই পড়ে আছে জীবন্ত লাশ হয়ে,ওর পাশে যাবার ক্ষমতাটুকুও আয়ানের নেই,তাই কাচ দিয়ে দেখে যায় ওকে শুধু অপলকে,আঁখি শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে, আজ সত্যিই ওর কোনো দুঃশ্চিন্তা নেই,দুই মাস ধরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে,তবে ওর ঘুম ভাঙাতে এক ব্যাকুল হৃদয় পুড়ছে দিন রাত,চোখ থেকে তার কান্না সরে না,আসে না রাতে ঘুম,কখনো ইচ্ছে হলে খায় কখনো না খেয়ে সারাদিন পার করে,চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে অনেক,উষ্কখুষ্ক হয়ে থাকে সারাদিন,যেনো খাপছাড়া কেউ,তার যে একটাই লক্ষ্য শুধু আঁখির ঘুম ভাঙানো,ওকে একটু কথা বলানো,ওকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া আনন্দ করা,কষ্টের ক্ষন আঁখির হাত ধরে পার করে দেওয়া,সারাদিন এটা ওটা রিসার্চ করে,কতো কিছু করে কোনো কিছুর বদলেও যদি আঁখির জ্ঞান ফিরাতে সক্ষম হয়,নামাজে বসে মোনাজাতে চায় শুধু আঁখিকে,জায়নামাজ ভিজে যায় ওর চোখের জলে,এখনও মোনাজাতে বসে আছে সে।
আল্লাহ আর কত পোড়াবে আমায়,আমি ওকে আপনার কাছে চেয়ে আনি নি,ভালোই তো ছিলাম নিজের একা জীবনে,আরোহী চলে যাবার পর তো আপনার কাছে আর কিছু চাইতামও না,শুধু আপনার ইবাদাত করে যেতাম কারন তখন আর নিজের জন্য চাওয়ার কিছু ছিলো না,তবে না চাইতেও যে আপনি আমার জীবনে পাঠিয়ে দিলেন আঁখিকে,যে আমাকে আবারও নতুন করে বাঁচতে শিখালো,হাসতে শিখালো,ভালোবাসতে শিখালো,আর যখন ওকে নিয়ে বাঁচতে চাইলাম তখন ওকে দূর করে দিচ্ছেন,কেনো রাব্বুল আলামীন,আমি যে আর পারছি না আর ওকে ওই অবস্থায় দেখতে,ফিরিয়ে দিন ওকে আমার কাছে, আমার প্রাণের বদলে হলেও ওকে ভালো করে দিন,ও ভালো আছে যেনে যে এখন মৃত্যুতেও শান্তি হবে আমার।
নামাজ শেষ করে আবার আদৃত নিজ গন্তব্য চলে আসে,আদৃতকে আসতে দেখে আয়ান কেবিনের সামনে থেকে সরে যায়,আয়ানের তো এখন নিজের থেকেও বেশি আদৃতের জন্য খারাপ লাগে,আদৃতের দিকে যে তাকানোই যায় না,সারাদিন আঁখিকে নিয়েই পরে থাকে,তবে আয়ানকে দেখলেই অস্বাভাবিক বিহেইব করে তাই ওর সামনে পড়ে না আয়ান,আজ দু’মাস বাড়ি যায় নি এখনও আদৃত,কাজ কর্ম কোনো দিকে খেয়াল নেই,ওর তো এখন একটাই লক্ষ্য আঁখির জ্ঞান ফিরানো।
এবার আবার বসলো আঁখির পাশে,হাত বুলালো ওর মাথায়,চোখ টপকে বেড়িয়ে এলো নোনাজল,মুছে নিলো উল্টো হাতে,মৃদ্যু কন্ঠে আঁখির উদ্দেশ্যে বললো।
মিস আঁখি আর কতো শুয়ে থাকবেন,বলবেন না আমায় আর কৃপণতা ছেঁড়ে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে নিতে,দেখেন না আমি যে হাসতে ভুলে গেছি,আজ যে আমার আর হাসি পায় না,উঠে আবারও হাসতে বাধ্য করেন না আমায়,আপনি না ডাক্তার হবেন,এভাবে পরে থেকে ডাক্তার হবেন কিভাবে,সামনে তো এক্সাম, উঠেন না।
রোজকারের মতোই পাগলের প্রলাপ বকছে আদৃত আঁখির পাশে বসে,ওর হাল যেই দেখছে তারই কান্না পাচ্ছে,ফায়সাল খান আর তাজবীর তো হাসপাতাল ছাড়েনই না,আঁখির অপেক্ষায় বাবা আর ভাইয়ের অবস্থা নাজেহাল,চোখের জল যে ওদেরও শুকোয় না,খান বাড়ির প্রতি মোনাজাতে যে শুধু আঁখিকে ফিরে পাওয়ার হাহাকার।
দুই মাস আগে আদৃত আঁখির অপারেশনে সাকসেসফুল হয়,ওকে বাঁচিয়ে নিতে পারলেও আঁখি কোমায় চলে যায়,তারপর থেকে সবার এ হাল,তবে ফায়সাল খান চুপ থাকেন নি,মেয়ের এমন অবস্থা মেনে নিতে পারেন নি উনি,আয়ানকে অনেক মারেন,অবশ্য সবাই ওনাকে আটকায়,তারপর মাহির উপর বিভিন্ন ধরনের চার্জ লাগিয়ে দেন নিজের পাওয়ার বলে,অবশ্য মাহির বিরুদ্ধে এমনিতেই যে কেসগুলো ছিলো ওগুলোতেই ওর অনেক সাজা হতো উপর থেকে ফায়সাল খানের চার্জগুলোর বদৌলতে মাহির যাবত জীবন কারাদন্ড হলো,ওর পরিবারও ওকে বাঁচাতে পারলো না,যা মাহি মেনে নিতে পারে নি,সাজা ঘোষনার পরো কোর্ট থেকে ওকে নিয়ে জেলে যাওয়া হচ্ছিলো তখনি মাহি শরীর খারাপের নাটক করে,যাতে ওকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ও সুযোগ বুঝে পালাতে শুরু করে,পুলিশ ওর পিছন ছুঁটতে থাকে,একসময় ওকে গুলি করলে একটা গুলি ওর হাতে লাগে তাও পালাতে থাকে কোনোরকম,অবশেষে পালাতে গিয়ে বেখালি হয়ে একটা গাড়ির নিচে চাঁপা পড়ে মাহি,যাতে ওর দুটো পাই কাটা পড়ে,এক্সিডেন্টে মুখের একপাশ পুরো নষ্ট হয়ে গেছে,নিজেকে এখনও দেখতে পায় নি,তবে নিজের করুন দশা আন্দাজ করতে পারছে,এখনও শুয়ে আছে একটা হাসপাতালের বেডে,তবে ভালো হয়ে গেলে ওকে আবার হাজতে নিয়ে যাওয়া হবে।
আদৃত বসে ছিলো একনজরে আঁখির পানে তাকিয়ে, তখনই খেয়াল করলো আঁখি প্রতিক্রিয়া করছে,আদৃত অস্থির হয়ে উঠে ওর চেক আপ করতে শুরু করলো,প্রায় ১ ঘন্টা পর আঁখির জ্ঞান ফিরাতে সক্ষম হলো আদৃত,আঁখি চোখ খুলে কোনোরকম তাকিয়েছে মাত্র,চোখ খুলেই আদৃতের দ্বিধার করতে পেরে মনের কোনে যেনো খনিক প্রশান্তির ছোঁয়া দোলিয়ে গেলো ওর।আদৃতের তো নিজের চোখে বিশ্বাসই হচ্ছে না,চোখ টপকে পরছে প্রাপ্তির জল,খুব ভালো করে কথা না বলতে পারলে,আঁখি মৃদ্যু কন্ঠে এবার বললো আদৃতকে।
এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো,যেনো আমি মানুষ না কোনো ভুত।
আদৃত ওর কথার কোনো জবাব দিলো না,ঝাপটে ধরলো আঁখিকে শোয়া অবস্থায়,আর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
মিস আঁখি আপনি ফিরে এসেছেন,আমি জানতাম আপনি ফিরবেন,আল্লাহ আপনাকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিবেন না,আপনি ফিরবেন আমি জানতাম।দাঁড়ান আমি দেখি আপনি ঠিক আছেন কি না।
আদৃত আঁখিকে ছেঁড়ে দিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে আবার ওর চেকআপ করতে শুরু করলো,আঁখি শুধু চেয়ে দেখছে ওর অস্থিরতা,মনে অনেকটা ভালোলাগা এঁকে দিচ্ছে আদৃতের ওকে নিয়ে এই অস্থিরতা, যাতে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো আঁখি, আদৃতকে শান্ত হয়ে বসতে বললো নিজের পাশে ,তারপর ওকে নিজের দিকে একটু ঝুকেও আসতে বললো।আদৃত ওর দিকে কিছুটা ঝুকে এলে কোনোরকম নিজের নরম হাতে ওর চোখজোড়া মুছে দিলো আঁখি ।অতঃপর আবার ধিমি স্বরে বললো।
আপনি কখনোই কৃপণতা ছাড়বেন না,তাই না?
আপনি চলে আসছেন না এখন আমার এই কৃপণতাও চলে যাবে।
হুম,তবে জানতে পারি, আমি কি এমন স্পেশাল যে আমার জন্য সব ছাড়তে রাজি।
দুষ্টু স্বরে কথাটা বললো আঁখি খনিক মুচকি হাসি মুখে টাঙানোর চেষ্টা করে,জবাবে আদৃত বললো।
এ জবাবটা খুব শিগ্রই আপনি পেয়ে যাবেন।আপনি চলে এসেছেন না এখন সব ঠিক হবে।
চলবে…….