মন_পিঞ্জর,১৩,১৪

0
808

#মন_পিঞ্জর,১৩,১৪
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_১৩

আয়ান বসে আছে এক বিস্তর মাঠের ছোট্টো একটা বেঞ্চের এক কোনে,মনে কাজ করছে ওর বিশাল শুন্যতা,যার কোনো মানে জানা নেই আয়ানের,বিশাল আকাশের বুকে নিজের ঠায় পেয়ে ওই চাঁদটা যে মনের খুশিতে আজ জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে ধরনিতে,ওই আকাশের বুকে চাদটাকে যে বড্ড মানায়,আকাশটা যে আজ তারার মেলায়ও ভরপুর,তাকিয়ে থাকতে সত্যিই অনেক ভালোলাগা কাজ করছে আয়ানের মনে,এভাবে আকাশ দেখা কখনোই ভালো লাগতো না আয়ানের তবে আঁখির যে এসব বড্ড পছন্দ ছিলো,ওর সাথে থাকতে গিয়ে ওরই কিছু অভ্যেস আয়ত্তে চলে এসেছে আয়ানের,আজকে কেনো যেনো বড্ড মনে পড়ছে ওর আঁখির কথা,মনে মনে অনেক কথা উঠছে ওর।আজকে তো মাহি ঠিকই বলেছে,আয়ান কখনোই আঁখির কোনো অনুভুতির দাম দিতে চাইতো না,আঁখি রোজ রাতে ততোক্ষণ খেতো না যতোক্ষণ আয়ান না ফিরেছে না ঘুমিয়ে বসে থাকতো,এদিকে আয়ান ইচ্ছে করেই বলতো আসছি বলে আর আসতো না বরং বড় বড় রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসে মাহির সাথে রঙিন রাত কাটিয়ে সুন্দর নিদ্রা যাপন করতো, এদিকে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটাতো আঁখি,আয়ান ইচ্ছে করেই ওকে নিজে আসার আশা দিয়ে রাখতো কারন ওর সেই অনুভুতিগুলোতে আঘাত করে আয়ানের ভালোই লাগতো,আঁখির আয়ানের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আয়ানের কাছে মজার জিনিস মনে হতো কারন আয়ান আঁখিকে যাই বলতো আঁখি তা মেনে নিতো,আয়ানের এই ইশারায় সব কিছুই করে ফেলতে চাইতো কোনো দিক বিবেচনা করতো না, আয়ানের যেকোনো কথায়ই বিশ্বাস করতো আর তাতে যে আয়ানের ভালোই লাগতো।আঁখি যেনো ওর হাতের পুতুল হয়ে গেছিলো যাকে মন মতো নাচাতে বড্ড ভালো লাগতো ওর,তবে আয়ান তো ওকে মন মতো অনেক নাচিয়েছে ওর মনও তো ভরে উঠেছিলো আঁখির উপর তাই ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে তবে আজ কেনো আঁখি ওর মাথায় চেপে বসেছে ওর জানা নেই,ওর তো আঁখিকে পছন্দ ছিলো না, ওর তো মাহির মতো মেয়েই ভালো লাগতো তবে আজ কেনো মাহির মধ্যে ও আঁখিকে পেতে চায়,এসব চিন্তা আকঁড়ে ধরেছে আয়ানকে।চারিদিকেই নিরবতা কাজ করছে কিন্তু আয়ানের মনটা যে আজ বড়ো উতলা,বার বার যেনো আঁখি নাম নিচ্ছে,আজ এই চাঁদনি রাতে আঁখির পাশে থাকাটা কি খুব বেশি দূরুহ ছিলো?প্রশ্নটা বড়ই জ্বালাতন করছে আয়ানকে।
গতকাল রাতে যখন আয়ান শুনতে পেলো আঁখির বাড়িওয়ালা আঁখির সাথে বেয়াদবি করেছে তখন আর নিজেকে আটকাতে পারে নি আয়ান,ছুঁটে গেছিলো সেই হাসপাতালে যেখানে ওই লোকটাকে নেওয়া হয়েছিলো তারপর ওখানে গিয়ে লোকটাকে অনেক মারলো আয়ান,সেখানের কেউই ওকে আটকাতে সক্ষম হলো না,তারপর পুলিশ ডেকে লোকটাকে ধরিয়ে দিলো,আসলে আয়ান আঁখির পিছন লোক লাগিয়েছিলো ওর খবর আয়ানকে দেওয়ার জন্য,তখনি লোকটা জানালা দিয়ে ওসব কান্ড দেখে আয়ানকে ফোন করে,আয়ান তারপর ওই লোকটাকেও অনেক মারে,কারন লোকটা তখন আয়ানকে ফোন করার আগে আঁখিকে বাঁচাতে পারতো তাই।তারপর পাগলের মতো খুঁজতে থাকে আঁখিকে তবে পায় না,অবশেষে আজ বিকেলে আঁকির দ্বিধার করতে সক্ষম হয় আয়ান,তবে আজও আঁখি ওকে এভাবে ফিরিয়ে দিবে আশা করে নি আয়ান,আঁখি কখনো আয়ানের মুখের উপর কোনো কথা বলে নি,তাই আঁখির আয়ানের সাথে এমন কঠোর ব্যবহার মেনে নিতে ব্যার্থ হচ্ছে আয়ান,এমন তিক্ত কথা যে আগে কখনো আঁখির মুখ থেকে শুনে নি আয়ান,আঁখির ওকে এড়িয়ে চলা আয়ানের বুকে যেনো ছুঁড়ি চালাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আদৃত দাঁড়িয়ে আছে বেলকোনির একপাশে,আকাশের ওই চাঁদটাকে দেখতে যে বড্ড মায়াবী লাগছে ওর,আদৃতের একাকিত্বের সাথি যেনো ওই রাতের বিস্তৃত আকাশ আর তার বুকে ঠাই নিয়ে খুশিতে ঝলঝল করা ওই চাঁদটা,আরোহী চলে যাবার পর যে প্রায় রাতেই ঘুম ধরা দেয় না আদৃতের চোখে,চোখ বন্ধ করলেই কতগুলো তিক্ত স্মৃতি এসে বড্ড বিরক্ত করে ওকে,কি দোষ ছিলো ওর শুধু বার বার ওর বোকা মন আল্লাহর কাছে এই একই প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছুক হয়,হয়তো এটাই ওর ভাগ্যের লিখন ছিলো,যা চাইলেও পাল্টে ফেলতে পারবে না আদৃত, এসব ভাবনায় অনেকক্ষণ কাটিয়ে উঠলে হঠাৎ চোখ গেলো আদৃতের সোফায় শুয়ে থাকা সেই মায়াবী রমণীর দিকে,আদৃত ওকে বেডেই শুতে বললো,কিন্তু এ যে জেদি বাঘিনী,নিজের কথার এক অক্ষর খেলাপ যেতে প্রস্তুত না।এদিকে বেলকনি দিয়ে আগত বাতাসের শিহরণে বার বার কেঁপে উঠছে তাও ঘুমে ঠায় ব্যাস্ত ওই বাঘিনীটা, হয়তো আদৃতের মতোই অনেক রাতের ঘুমহীন চোখে আজকে একটু শান্তির ঘুম নেমেছে,ওর দিকে তাকিয়ে এমনটাই মনে হলো আদৃতের,ভালো করে বেলকোনির সামনের পর্দাটা টাঙিয়ে নিলো তারপর বারান্দার গ্লাসটা লাগিয়ে একটা চাদর নিয়ে এলো আঁখির পানে,ওটা ভালো করে আঁখির গায়ে দিয়ে দিলো,লক্ষ্য করলো আঁখি ঘুমের মধ্যে কিছু বরবর করছে।

আয়ান যেয়ো না তুমি,ছেড়ে দিও না আমায়,আমি তোমার জন্য সব করবো শুধু ছেঁড়ে যেও না আমায়,পাশে থাকো আমার,আমার তোমাকে বড্ড প্রয়োজন আয়ান যেয়ো না।

আঁখির এসব কথায় অনেক খারাপ লাগা কাজ করলো আদৃতের ভিতর,কেনো কিছু লোক সত্য ভালোবাসার কদর করতে জানে না?কেনো সত্য অনুভুতিগুলোর সাথে ওরা খেলা করতে ভালোবাসে?তবে কি কাউকে সত্য ভালোবাসাটা আজ কালকার পৃথিবীতে শুধুই একটা ভুল?সারাজীবনের কষ্টের কারন?কেনো ওই স্বার্থপর লোকগুলো সুখে থাকে আর যারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসে তাদেরই কপালে কেনো কষ্টটা লিখা থাকে,হয়তো তাদের অনুভব শক্তি বেশি থাকার কারনে ওদের ভাগের কষ্টটাও বেশি হয়,এসব অনুভূতি থেকে আদৃতের মনে খনিক মায়া কাজ করে আঁখির জন্য,হাত বাড়ায় ওর মাথায় একটু হাত বুলানোর উদ্দেশ্যে কিন্তু তখনি নিজের আদর্শের টানটা অনুভব হয় ওর,একটা মেয়েকে তার অনুমতি ছাঁড়া ঘুমের ঘরে কি করে স্পর্শ করতে পারে ও,এটা যে ওর আদর্শের বিরুদ্ধে, তাই হাতটা ঘুটিয়ে নেয়,তারপর আবারও আঁখির গায়ের চাদর ভালো করে টেনে দিয়ে নিজের বেডে চলে যায়,সত্যিই আঁখিকে আদৃত যতো দেখে ততোই অবাক হয়,মেয়েটা যে প্রতিবার ওর চিন্তা থেকেও বেশি কিছু করে যায়,আজ যদি আঁখির মতো প্রতিটা মেয়ে নিজেদের লড়াই লড়তে সক্ষম হতো তবে এই সমাজটা যে পতনের মুখ থেকেও ফিরে আসতে সক্ষম হতো,কিন্তু তা যে শুধু কল্পনা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না আদৃতের,কারন আঁখির মতো আর কটা মেয়ে আছে যারা নিজেদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিজেরা চালিয়ে যাচ্ছে।

________________

সারারাতে বাড়ি ফিরেছে আয়ান, এদিকে ও কোথায় ছিলো না ছিলো তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই মাহির,আয়ান রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো মাহি আধো আধো ড্রেস পড়ে মডার্ন বেশে একদম রেডি,আয়ান এবার গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো।

কোথায় যাচ্ছো?

বন্ধুদের সাথে দেখা করতে,কিছু শপিংও করবো,আর হ্যাঁ তোমাকে তো আমি বলতেই ভুলে গেছিলাম,আমার একাউন্টের টাকাগুলো না শেষ তাই আমি তোমার কার্ড নিয়ে যাচ্ছি কেমন।

গতকাল চারদিন আগেই না তোমার একাউন্টে আমি ১০০,০০০ টাকা ভরিয়েছিলাম ওগুলা কি করেছো?

বা রে ওগুলা কোনো টাকা হলো না কি,শেষ হয়ে গেছে,আমার কি আর টাকাপয়সা লাগে না,ওকে এবার আবার তুমি তোমার সো কোল্ড ডায়লগ নিয়ে আমার মাথায় চেপে বসো না,তোমার মেন্টালিটি দিন দিন কেমন জানি বুড়ো দাদুদের মতো হয়ে যাচ্ছে,হা,হা,দেখি সরো আমার বেরুতে দেড়ি হচ্ছে,বাই বেবি,লাভ ইউ।

চলে গেলো মাহি,এদিকে আয়ান বাকরুদ্ধ কি বলবে বলার কোনো ভাষা নেই ওর।
এদিকে ওর মন মেজাজ একদমও ভালো নেই,তাই কোনোরকম ফ্রেস হয়ে আয়ান নিচে নামলো নাস্তা করতে।টেবিলে বসতেই আয়েশা ওকে নাস্তা দিলো।

কি আয়েশা তুই আজও নাস্তা দিচ্ছিস যে নতুন কাজের লোক কোথায়?

ওকেও কাল বিকেলে কাজ থেকে বের করে দিয়েছে মাহি।

হোয়াট?কেনো?

ও রান্নায় ছিলো তখন মাহি ওকে ডাক দিয়েছিলো এক গ্লাস পানির জন্য,ও একটু দেড়ি করে যাওয়ার মাহি ওকে অনেক বকাঝকা করে,তখন মেয়েটি শুধু এটা বলেছিলো যে ও রান্নাটা পুড়ে যাবার ভয়ে আসতে একটু দেড়ি হয়েছে।
এটা বলায় ও মেয়েটার দিকে গ্লাস ছুঁড়ে মারে যাতে মেয়েটার কপালের এক কোনে লেগে অনেকটা কেটে যায়,মাহির ওকে মারার কারন মেয়েটা নাকি ইচ্ছে করে দেড়ি করে গিয়েছিলো তারপর নাকি ওর মুখের উপর তর্কও করছে,তাই।
তারপর মেয়েটিকে ও চুল ধরে অনেক মারে,আমরাও ওকে আটকাতে ব্যার্থ হই এরপর ও মেয়েটাকে তাড়িয়ে দেয়।
যাকগে তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না ভাইয়া,তুমি নাস্তা করো,সবাই তো আর আঁখি হয় না,আর সেটা ভালোই হয়,আঁখির মতো হলে যে সবার অবহেলার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে হয়,যাকে শেষ সময়ে শুধু কষ্টই উপহারে মিলে।

আয়ান এবার ভ্রুযোগল কুঁচকে বলে উঠলো।
তুই কি মিন করতে চাইছিস আয়েশা?

বেশি কিছু না ভাইয়া,শুধু সত্যটা বলতে চাইছিলাম,যা আপনি দেখেও না দেখার আর বুঝেও না বুঝার ভান করছেন।

কথাটা বলে স্থান ত্যাগ করলো আয়েশা,আয়ান হতবাক হয়ে বসে রইলো খাবার টেবিলে,আজকে যে আয়ানের সব আছে তবুও অশান্তি আর নিরাশা পিছু ছাড়ছে না ওর,তবে কি আয়ান নিজের অজান্তেই অনেক বড় ভুল করে ফেললো।উক্ত ভাবনা বড্ড জ্বালাতন করছে আয়ানকে এবার।

__________________

আদৃত ড্রাইব করছে আর আঁখি পিছনে বসে জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতিতে চোখ বুলাচ্ছে,হঠাৎই ট্রাফিক জ্যাম লাগলো,ব্যাস্ত শহরের এই জ্যামগুলো যে সহজে ছুটার নাম নেয় না,আজকের হাল যেনো আরও নাজেহাল,আদৃত আঁখি নিজেদের মধ্যে নিরবতা বজায় রেখে একাকিত্বে মগ্ন তখন,হঠাৎই আঁখি লক্ষ্য করলো একটা বাচ্চা অনেক কান্না করছে,বাচ্চাটির মা ওকে সামালতে ব্যার্থ হচ্ছেন বার বার,তাই ওকে শান্ত করানোর সুবিধার্থে গাড়ি থেকে নিচে নেমে মুক্ত বাতাসে হাঁটতে লাগলেন তাও বাচ্চাটা শান্ত হচ্ছে না,এদিকে বাচ্চাটার কান্না সহ্য হচ্ছে না আঁখির,তাই গাড়ির দরজা খুলে বাইরে যেতে নিলো।

আরে আরে কি করছেন?বাইরে যাচ্ছেন কোনো?

আমার কাজ আছে।

কি কাজ?

তা এখন বলার সময় নেই পরে বলবো।

কথাটা বলে আঁখি ছুটে গেলো।

কেমন মেয়েরে বাবা কখন কি করে কিছুই বুঝে উঠতে পারি না,একে নিয়ে যে আর পারা যায় না,দেখি কি করে।

কথাটা বিড়বিড় করে বলে আদৃতও ওর সাথে যায়।এদিকে আঁখি ছুটে যায় বাচ্চাটির কাছে,কিন্তু ওকে যেনো ধরার সাহস পায় না,হয়তো বাচ্চাটির মায়ের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে,হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিতে চায়,তখন বাচ্চাটির মা ওকে জিজ্ঞেস করেন?

কি আপু?
আঁখি আমতা কন্ঠে বলে উঠে,

আসলে আপনি কিছু মনে না করলে ওকে আমি একটু কোলে নেই।
মহিলাটি এবার মুখে খনিক হাসি ফুঁটিয়ে বললেন।

কেনো না,নিন।

মহিলাটি বাচ্চাটিকে আঁখির কোলে দিলেন,আঁখি তো মহাখুশি, বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আদর দিতে লাগলো,ওকে দোলাতে লাগলো,খনিকে বাচ্চাটি শান্ত হলো,এমনকি আঁখির সাথে খেলাও করতে লাগলো,আঁখির অস্থির মনটাও যে এবার শান্তির ছোঁয়ায় চলে গেলো,সেখানে ট্রাফিকে আটকে থাকা অনেক লোকই আঁখির কর্মকান্ড হতবাক হয়ে দেখছে,কারন স্বাভাবিক লোক যেমন বাচ্চাকে আদর করে আঁখির ক্ষেত্রে যে তা মিলছে না,আঁখি বাচ্চাটাকে কেমন অস্বাভাবিক ভাব নিয়ে আদর করছে ,আঁখি বাচ্চাটিকে এভাবে আদর করছে যেনো ও আঁখির নিজেরই নাড়ি ছেঁড়া ধন,একটা নারীর মধ্যে একটা বাচ্চার জন্য এতো মমতাময়ী ভাব তখনি আসতে পারে যখন সেই মেয়েটি মা হবার অনুভুতি আগে থেকেই অনুভবে নিয়ে নেয়,তবে আঁখিও কি সেই অনুভুতিটা কখনো অনুভব করেছে,আদৃতের মনে তখন উক্ত প্রশ্ন চলাচল করলেও অন্য একটা মন তার উত্তর জেনে যায় তখনি আর সে মনের মালিক আর কেউ নয় সয়ং আয়ান,ট্রাফিকে তখন আয়ানও আটকে ছিলো হঠাৎই আঁখির ওসব কর্মকাণ্ডে চোখ যায় ওর,মনে পড়ে আয়ানের কিছু স্মৃতি, আঁখির এমন অস্বাভাবিক আচরণের মানে যে আয়ান কিছুটা হলেও বুঝতে সক্ষম হচ্ছে।আঁখির এমন অস্বাভাবিক আচরনের কারনও যে আয়ান নিজেই।

এদিকে বাচ্চাটি শান্ত হয়ে গেলে ওর মা বলে উঠলেন।

বাহ তোমার কোলে গিয়ে আমার রাজ দেখি একদম শান্ত হয়ে গেলো?তুমি বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসো হয়তো,তা তুমি হয়তো নিজেও বাচ্চার মা তোমার ওকে আদর করা দেখেই বুঝা যাচ্ছে,তা তোমার কয়টা বেবি আছে?

আঁখির হাসিমুখটা খনিকে মলিনতায় পুর্ন হলো মহিলাটির কথায়,কন্ঠে একটা ব্যাথার্থ ভাব এনে মৃদু স্বরেই বললো এবার।

আমার কোনো বাচ্চা নেই।

ওহ সরি……..ইশ ট্রাফিক ছাড়ার টাইম হয়ে গেছে,আপনাকে ধন্যবাদ আপু, এবার রাজকে আমার কাছে দিয়ে দিন ট্রাফিক ছেড়ে দিবে।

কথাটা বলে মহিলাটি বাচ্চাটাকে নিয়ে নিলো আঁখি যেনো বাচ্চাটাকে দিতে না চাইলেও দিতে হলো,খনিকের জন্য আঁখির মনে হলো ওর কোলটা আজ আবারও কেউ খালি করে দিলো,গড়িয়ে পড়তে এলো চোখের জল,তবে তা পড়তে দিতে নারাজ আঁখি,তাই আর সেখানে দাঁড়ালো না কোনোরকম নিজেকে শক্ত করে সেখান থেকে চলে এসে গাড়িতে বসলো।

আয়ানের আজ কেনো যেনো নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো,যার কারন ওর নিজেরও জানা নেই কিন্তু মনের কোনো কোনেই শান্তির ছোঁয়া পাচ্ছে না আয়ান,এদিকে আঁখির এমন আচরন আদৃতের মনের প্রশ্নগুলোকে আরও প্রখড় করে তুললো,মনে মনে কোনো একটা কিছু যেনো আন্দাজ করে নিলো আদৃত।

ট্রাফিক ছেড়ে দিলে আদৃত আবার ড্রাইব করতে ব্যাস্ত হয়,এদিকে পরিবেশের ছুটন্ত ভাব আঁখির মনে যেনো তুলে দিয়ে যাচ্ছে হাজারো তিক্ত স্মৃতি, চোখের জলগুলো যে তার মালিকের বিরুদ্ধে গিয়ে আজকে বয়ে যেতে অবাধ্যতায় মেতে উঠেছে,পারছে না আঁখি কোনোভাবেই এই তিক্ত স্মৃতি থেকে নিজেকে দূর করে নিতে,বার বার এসে ধরা দিচ্ছে মনে,এদিকে অবাধ্য জলগুলো বাঁধন মানলোই না,বেয়ে নেমে এলো নিজেদের আপন গতিতে আঁখি ঝটফট ওগুলা মুছে নিলো আদৃতের অগোচরেই, তারপর নিজের পেটে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা খালিলাগা অনুভব করতে লাগলো।এদিকে উক্ত ঘটনা চোখ ফাঁকি দিতে পারলো না আদৃতের,গাড়ির সামনে টাঙিয়ে রাখা ছোট্ট মিররে আঁখির কর্মকাণ্ড সব চোখে আবদ্ধ করলো আদৃত, মনের সন্দেহের মাত্রা টার পরিমাণ যে এখন চরম সীমায় পৌঁছে গেছে ওর,নিশ্চয়ই আরও অনেক রহস্যই আছে আঁখির জীবনে যার সাথে আঁখি কারোই পরিচয় করাতে নারায।

চলবে……….

#মন_পিঞ্জর
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_১৪

আয়ান বাড়ি ফিরেছে অনেক আগে মাহির এখনও কোনো আতাপাতা নেই,আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলো এবার আয়ান।

আয়েশা মাহি কোথায়?

জানি না ভাইয়া,সকালে বেরুনোর পর এখন অব্দি ফিরে নি।

হোয়াট,এখনও আসে নি মানে?ফোনও তো ধরছে না।দেখি একটু খোঁজ নিয়ে।

কথাটা বলে দরজা খুলে বাইরে যেতে নিলে আয়ান লক্ষ্য করলো একটা কালো কার থেকে নেমে আসছে মাহি,একটা ছেলে ওকে ধরে নামিয়ে দিচ্ছে, দুজনই মাতাল অবস্থায়, অন্য একটা ছেলে নেশাগ্রস্ত অবস্থায়ই ড্রাইবিং সিটে বসা,মাহিকে নামিয়ে দিয়ে ছেলেগুলো চলে গেলো,মাহি মাতাল অবস্থায় হেলে দুলে বলছে।

বাই গাইজ,অনেক ফুর্তি করেছি আজ,তোদের ডান্স টা কিন্তু সেই ছিলো,হা হা।

হেলদুল খেয়ে মাহি পড়ে যেতে নিলে এগিয়ে গিয়ে ওকে ধরে নিলো আয়ান,মাহি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো আয়ান রক্তবর্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।এবার মাহি হেলদুল খেতে খেতেই বললো।

আরে বেবি,তুমি কখন এলে?জানো আজকে ক্লাবে কতো মজা করেছি,আরে তুমি তো আর এখন ক্লাবেই যাও না,দিন দিন কেমন বোরিং হয়ে যাচ্ছো,দেখি সরো আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে আমি বরং রুমে যাই।

মাহি চলে যেতে নিলে আয়ান শক্ত করে মাহির হাত ধরে দাঁতে দাঁত চেঁপে রাগি স্বরে বলতে লাগলো এবার।

তুমি ক্লাবে গিয়েছিলে মাহি?ড্রিংক করে এসেছো?ছেলেগুলো কে ছিলো?

আরে এমন ভাব করছো যেনো আর তুমি কখনো ক্লাবেই যাও নি,তোমার মনে আছে আমাদের দেখাই ক্লাবে হয়েছিলো,হা হা।আর হ্যাঁ ওই যে ছেলেগুলো ওগুলা আমার নিউ ফ্রেন্ডস,খুব নটি বয় ওরা।

হোয়াট তোমার লজ্জা করে না মাহি?মাঝরাতে ড্রিংক করে অচেনা ছেলেদের সাথে গাড়ি করে কিভাবে ঘুরতে পারো তুমি?এসব কোন ধরনের ম্যানার তোমার?কতোটুকু চেনো তুমি ওই ছেলেগুলোদের।

আরে এতো চেনাজানার কি আছে?মনে আছে প্রথম দিন তোমাকেও চিনতাম না কিন্তু সেদিন তো তোমার সাথে কতো ঘুড়েছি তাও ড্রিংক করে হা হা।

হোয়াট,তোমার কাছে আমি আর অন্য সব ছেলে সমান?

আরে বেবি আমি সেটা কখন বললাম,আমি বলতে চাইছি এসব আজকালকার জেনারেশনের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার,তুমি শুধু নিজের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করে সবাইকে লেকচার দিলে তো হবে না,হা হা হা হা।
দেখি সরো তো এবার আমার দাদু সেজো না।

কথাটা বলে মাহি আয়ানকে সরিয়ে হেলেদুলে নিজের রুমের দিকে পদার্পণ করলো,আয়ান ভ্যাবাচেকার মতো তাকিয়ে আছে ওর পানে,আয়েশার দৃষ্টিও অগোচর করলো না মুহুর্তটা,আয়েশা যেনো মনে শান্তি পেলো,নিজের ভাইয়ের জন্য কোনো খারাপ লাগা কাজ করছে না ওর মনে কারন এটা হয়তো আয়ানের পাপের কিঞ্চিৎ প্রাকৃতিক সাজা আল্লাহর তরফ থেকে,হয়তো আস্তে আস্তে এর পরিনাম আরও বড় হবে সেক্ষেত্রেও কোনো সন্দেহ নেই আয়েশার,তাই তাচ্ছিল্য হাসি ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

আয়ান হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলো এবার।আঁখি এতো বড় বাবার মেয়ে হয়েও কখনো ক্লাবে যায় নি ড্রিংকও করে নি,অনেক মিশুক থাকলেও ছেলেদের সাথে সখ্যতা ওর কমই ছিলো,কোনো ছেলের সাথে বেশি মেলামেশা পছন্দ ছিলো না আঁখির,প্রয়োজন ছাড়া কোনো ছেলের সাথে কথাও বলতো না।তবে আয়ানও যে কখনো ক্লাবে যেতো না,কিন্তু স্ট্যাটাসটা ভারার সাথে সাথে ওর রুচিও বেড়ে গেছিলো,বাকি আট-দশ জন বিত্তবানদের তালে তাল মেলাতে ওকেও যে ওসব আধুনিকতার ছোঁয়ায় যেতে হয়,আয়ানের খুব ভালো করে মনে আছে একটা ক্লাবেই মাহির সাথে আয়ানের দেখা আর সেদিন থেকেই মাহি ওর সাথে অনেক ক্লোজ হয়ে উঠেছিলো,ও ছাড়াও মাহির অনেক ছেলের সাথে ফ্রেন্ডশিপ আছে কিন্তু কখনো কখনো আয়ানের সেসব ফ্রেন্ডশিপ লিমিটের অতিরিক্তই মনে হয়।আয়ান রুমে যায় গিয়ে দেখে ওর সুন্দরী রমনী আয়েশ করে বেডে হাত পা ছাড়িয়ে ঘুমাচ্ছেন,আয়ানের যেনো মাহির ওসব অসভ্যতা আর ভালো লাগছিলো না তাই মনের শান্তির খোঁজে বাইরে কোথাও বেড়িয়ে গেলো।
__________________

পিলুপিলু পায়ে আসছিলো আঁখি কাজ থেকে,খনিক দূরে চৌধুরী ম্যানশন আশেপাশে কোনো রিক্সা নেই তাই পায়ে হাঁটছে, এদিকে একটু একটু মাথা ধরেছে এটা সময়ের সাথে আরও প্রখড় হবে আঁখির জানা আছে তাই বাড়ি গিয়ে কিছু খেয়ে তারপর ওষুধ খেতে হবে বলে বেশ তাড়াহুড়োয়ই হাঁটছে আঁখি,হঠাৎই লক্ষ্য করলো রাস্তার পাশে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে থাকা ছোট্ট বেঞ্চের এক কোনে মাথা নুইয়ে বসে আছে কেউ একজন,আঁখি যে লোকটার মুখ দেখতে না পেলেও ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছে লোকটা আসলে কে,সে লোকটা যে ওর চিরচেনা, তবে আঁখি আর সেদিকে ভ্রক্ষেপ দেখালো না বরং নিজের গন্তব্যে মন দিলো হঠাৎই পিছন থেকে কিছু কথা ভেসে এলো আঁখির কানে।

দেখেও না দেখার ভান করছো?আমি কি এখন এতোটাই পর?

আঁখি কিছু না বলেই এগুতে লাগলো,যেনো কথাগুলো ওর কানেই গেলো না।আয়ান আবারও বললো।

পালাচ্ছো আমার থেকে?

কথাটা শুনে এবার আঁখি থমকে দাঁড়ালো, তারপর পিছন মুঁড়ে বললো।

আঁখি পালানোর মেয়ে না মি.আয়ান,সত্যের মোকাবিলা করার মতো শক্তি আঁখির আছে।বরং আপনি সত্যতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন।আপনি নিজেও জানেন আপনি এখন আর আমার আপন কেউ রয়ে যান নি।আপনি এখন আমার জন্য শুধুই একজন পরপুরুষ মাত্র,যার নিজস্ব স্ত্রী আছে হয়তো কয়েকদিন পর সন্তানও আসবে,এমতাবস্থায় আপনাকে কোনো মেয়ে আপন করে নিতে চাইলে তার সাথে আপনার সম্পর্ক অবৈধ সম্পর্কের নাম পাবে মি.আয়ান,আর আমি যেরকমই হই না কেনো কারো সাথে অবৈধ সম্পর্কে যাওয়ার মেয়ে নই।

এমন কিছু তো আমিও চাই না,তবে কি একটু সময় আমার সাথে বসে সুন্দর দুটি কথা বলার সময়ও নেই তোমার?

দেখেন আমি ব্যাস্ত একজন মানুষ,আপনার মতো বিত্তবান না,অনেক কিছুরই দায় ভার আমার মাথায় আছে তাই আপনার সাথে টাইম পাস করার সময় আমার নেই আর আপনার ভালোই জানা আছে আমার ছেলেদের সাথে কথা বলার বদ অভ্যেস বরাবরই কম আর বিবাহিত ছেলেদের আশপাশও যে ঘুরার কথা আমি ভাবতেও পারি না,সরেন আমার তাড়া আছে।

আঁখি চলে যেতে নিলে আয়ান কিছু বলবে তখনি আদৃত গাড়ি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়।

আরে আপনি?

হ্যাঁ হাসপাতাল থেকে ফিরছিলাম যাক তোমাকেও পেয়ে গেছি, চলো।

থাক আপনি চলে যান আমি নিজেই যেতে পারবো।

হয়তো আপনি ভুলে গেছেন মিস আঁখি আমাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিলো।

ভুলি নি তবে এটাও কথা হয়েছিলো যে আমার যখন ইচ্ছে আমি শুধু তখনই আপনার সাথে যাবে।

আপনার ইচ্ছে তো ভালো কথা, তবে সে ইচ্ছে দিনে ৫০ বার রুপ পাল্টালে তো হয় না মিস আঁখি,দেখেন শুধু শুধু জেদ করবেন না,বাড়িটা সামনে তাই চলেন একসাথেই যাই।

আঁখি আর কিছু বললো না,এমনিতেই এখানে থাকলে আয়ানের বেহায়া কথাগুলোর সম্মুখীন হতে হবে তাই গাড়িতে উঠতে গেলো আঁখি,গাড়ির দরজাটায় টান দিবে তখনি আয়ান আঁখির হাত ধরে নিলো,তারপর বলতে লাগলো।

তুমি ওর সাথে কেনো যাবে আঁখি?তুমি কোথায় যাবে আমায় বলো আমি পৌঁছে দেবো,আমি থাকতে তোমার অন্য কারো সহায়তা নিতে হবে না।

আঁখি কিছু বলবে তখনি আদৃত নেমে আসে গাড়ি থেকে,শান্ত ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নেমে শান্ত রুপেই আঁখির হাত থেকে আয়ানের হাত ছাড়িয়ে নিলো তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো।

আপনার এমন কেনো মনে হয় মি.আয়ান আমি উনাকে সাহায্য করতে চাইছি?আঁখি এমন মেয়ে যার কখনো কারো সাহায্যের দরকার পড়বে না মি.আয়ান।বরং আপনার কোনো সাহায্য লাগলে ওকে বলবেন,আপনাকে নিরাশ করবে না ও এতোটা বিশ্বাস ওর উপর রাখাই যায়।তাই মিছে সহযোগীতায় ওর দিকে এগিয়ে আসবেন না।

আমার আর আঁখির মধ্যে আপনার বলার কোনো অধিকার আছে বলে আমার মনে হয় না মি.আদৃত।

আমি আপনার মতো কখনো কোনো মিথ্যে অধিকার নিজের আয়ত্তে আনতে চাইও না মি.আয়ান।শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদটাই করি মাত্র,কারন অন্যায় সহ্য করার মতো লোক ড.আদৃত চৌধুরী না।

হয়েছে মি.আদৃত,এমন লোকের সাথে কথা বলেও কোনো লাভ নেই।যে সাধারন ঠিক ভুলের মধ্যেও পার্থক্যটা বুঝতে ব্যার্থ হয় সে ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্যটা কি করে বুঝবে,আপনি বরং চলেন।

আদৃতের গাড়িতে উঠে গেলো আঁখি,তারপর আদৃত গাড়ি ছেড়ে দিলো,আয়ানের মাথায় আগুন ধরলো এবার আঁখির সাথে আদৃতকে দেখে, উপর থেকে আঁখিও যে আদৃতের কথায় সায় মেলালো,কিছুতেই এসব মেনে নিতে পারলো না আয়ান,আর কোনোদিক বিবেচনা না করেই আয়ান আদৃতের গাড়ির পিছু করলো।

গাড়িটা চৌধুরী ম্যানশনের ভিতর ঢুকে গেলো,পথে কোথাও তো আদৃত আঁখিকে নামালো না,তারমানে আঁখি চৌধুরী ম্যানশনে থাকে বিষয়টা বুঝতে সক্ষম হলো আয়ান,উক্ত বিষয়টা যেনো আয়ানের মনের ঝড়ের বেগ আরও প্রবল করলো।

আঁখি ওই আদৃতের সাথে চৌধুরী ম্যানশনে কি করছে?না বিষয়টা জানতে হবে আমায়,ওই আদৃতকে সুবিধার মনে হচ্ছে না আমার।খোঁজ তো আমায় নিতেই হবে আমাকে,এই আদৃতের একটা বিহিত আমিই করবো।
_________________

আদৃতের দীর্ঘ বারান্দার এক প্রান্তে বসে আছে আঁখি,আদৃত একটা এমারজেন্সি থাকায় আবারও হাসপাতালে গেছে, রাত তখন ২ টা বাজে,আজ ঘুম নেই আঁখির চোখে,কি করে থাকবে পুরোনো কিছু তীক্ত অনুভুতি যে আজ আবারও জেগে উঠেছে,সবার সামনে তা লুকিয়ে গেলেও একাকিত্বে নিজের কাছে তা যে লুকাতে চায় না আঁখি,হাতে দুইটা রিপোর্ট নিয়ে ওগুলাতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,টপটপ করে চোখের পানি ঝড়ে পড়ছে সেগুলোতে,একটি রিপোর্টে একদম স্পষ্ট লিখা প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ আর ওপর রিপোর্ট গর্ভপাত নিশ্চিত করনের প্রমান ,আঁখির একদম মনে আছে আজ থেকে ঠিক ১৪ মাস আগে আঁখি কনসিভ করেছিলো,কয়েকদিন যাবত শরীর কিছুটা খারাপ থাকলে নিজের চেকআপ করিয়েছিলো আঁখি যাতে ডাক্তার কিছু টেস্ট করালে আঁখি প্রেগন্যান্ট তা জানতে পারে।সেদিন আঁখি কতোটা খুশি হয়েছিলো তা শুধু ওই জানে,বাচ্চাদের যে আঁখি ছোটবেলা থেকেই অনেক পছন্দ করতো,বেশির ভাগ ওর টুইন বেবি পছন্দ ছিলো,সেদিন নিজের গর্ভে আয়ানের অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে যে আঁখির ভালোলাগা চরম সীমায় পৌঁছে গেছিলো,মনে মনে কতো কিছু ভেবে নিয়েছিলো আঁখি,আয়ান শুনলে হয়তো অনেক খুশি হবে,ওকে আগের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসবে, ওর হয়তো টুইন বেবি হবে,ও আর আয়ান মিলে ওদের সুন্দর সুন্দর নাম রাখবে,আরও কতো কিছু মনে মনে ভাবতে ভাবতে ভাবনার সমাপ্তির আগেই আয়ানের কাছে পৌঁছালো আঁখি,সবার আগে যে খুশির এই খবরটা ও আয়ানকেই জানাতে চাইছিলো,ভেবেছিলো আয়ান হয়তো স্যারপ্রাইজড হবে কিন্তু আয়ান বিষয়টা শুনার পর নিজের রিয়াকশন দিয়ে আঁখিকে অবাক করে দেয়।আয়ানের এক কথাই ছিলো এখনও ওর লাইফ সেটেল হয় নি, এখন ও বাচ্চা নিয়ে ভাবতেও পারে না,এখন না কি লাইফে এনজয় করার সময় এখন কি করে বাচ্চা নিতে পারে সে,তাছাড়া ও এখন বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়ার কথাও ভাবতে পারে না,এখনও ওর লাইফে না কি অনেক কিছুই এচিভ করার আছে আর না জানি কি কি।এখন এসব বাচ্চার কথা ওর জন্য নাকি ভাবাও ভুল মনে হচ্ছে।
আঁখি সেদিন অনেক মিনতি করে আয়ানকে, অনেক বুঝায় ওকে,ভুলবশত বাচ্চা চলে আসলেও এ বাচ্চাটা যে আল্লাহ প্রদত্ত,আর আঁখি ওকে নিজের গর্ভে ধারন করতে চায়,আঁখি আয়ানকে এই নিশ্চয়তাও দেয় যে বাচ্চার কোনো দায়িত্ব ও আয়ানের উপর পড়তে দিবে না ও নিজেই দেখবে সবকিছু কিন্তু আয়ান কোনো কিছুতেই রাজি হলো না ও আঁখিকে একটাই পথ দিলো আঁখিকে বাচ্চা আর আয়ানের মধ্যে থেকে কোনো একজনকে বেঁছে নিতে হবে,কয়েকদিন বুঝানোর পর আঁখি নিজেই ব্যার্থতা স্বীকার করলো, সেদিনও সবকিছুর উপর আয়ানকেই বেঁছে নিলো আঁখি,বাচ্চাটা মেরেই ফেললো শুধু আয়ানকেই পাওয়ার লোভে,সেদিনের পর আঁখি কেমন যেনো ভেঙে পড়েছিলো শারীরিকভাবে আর মানসিকভাবেও,সারাদিন কেমন পাথরের মতো বসে থাকতো,বার বার নিজের পেটে হাত রেখে নিজের বাচ্চাটাকে অনুভব করতে চাইতো কিন্তু সে অনুভুতিটাতে শুধু খালি লাগাই বিরাজ করতো,আঁখির এমন অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আয়েশা আর মিরা রাহমান ওকে অনেক সাহায্য করেছিলেন,ওর সেবা যত্ন করেছিলেন ওরা অনেক।তবে আয়ানের আঁখির দিকে কোনো খেয়ালই ছিলো না,ও সারাদিন নিজের কাজেই ব্যাস্ত থাকতো,তাছাড়া তখন ওর ফাইনাল এক্সাম চলছিলো তাই সারাদিন পড়া নিয়েই পড়ে থাকতো আঁখি বেঁচে আছে কি মরে গেছে তাতে ওর কিছুই যেনো যায় আসতো না,আঁখির মন যে তখন সারাদিন আয়ানকেই খুঁজতো, ওর বুকে মাথা রেখে কিছুসময় বসতে পারলে হয়তো আঁখির মন পিঞ্জরে খনিক শান্তনা বিরাজমান হতো,কিন্তু আঁখির এই মনোভাব কখনো আঁখি সামনে আসতে দেয় নি আয়ানের,কারন কখনো আঁখি চায় নি ওর জন্য আয়ানের কেরিয়ার ওর সপ্ন সব ধুলোয় মিশে যাক,যে আয়ান আঁখির জন্য সবকিছু ছিলো সে আয়ানের সবকিছু ওর কেরিয়ারই ছিলো,আঁখির যে শুধু একটা চাওয়াই ছিলো আয়ানের কাছ থেকে তা শুধুই ওর একফালি ভালোবাসা।তবে আঁখি যে আয়ানের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এতো কিছু করলো আজ সেই আয়ানই ছুঁড়ে ফেললো ওকে,ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে মুঠো ভরে ভরে শুধু শুন্যতা দান করলো আঁখিকে,যার জন্য পৃথিবীর সবকিছুর মায়া ত্যাগ করলো সেই আঁখির মায়া বুঝলো না।
আঁখি এবার ফুলকি দিয়ে কেঁদে উঠলো রিপোর্টগুলো নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে।

কেনো আল্লাহ?কেনো এমন হলো?আমি যখন সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে আয়ানকেই বেঁছে নিয়েছিলাম তবে আয়ান কেনো আমায় বেঁছে নিলো না?কেনো আমি ওর কাছে শুধুই কয়েকদিনের ভালোলাগার একটা দ্রব্য ছিলাম মাত্র?কেনো আল্লাহ কেনো এমন হলো?আমি জানি সেদিন আমার মা-বাবাকে ছেড়ে আসতে আমার কতো কষ্ট হয়েছিলো,আমি জানি সেদিন আমার সপ্নগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দিতে আমার কতো কষ্ট হয়েছিলো,শুধু আমিই জানি সেদিন নিজের গর্ভে বেঁড়ে উঠা প্রাণটা শেষ করে দিতে আমার কতো কষ্ট হয়েছিলো আজও যে সেই অনুভুতি থেকে নিজেকে দূর করে রাখতে পারি না,আজও মনে হয় সে আমার গর্ভের কোনো এক কোনে লুকিয়ে আছে,কখনো মা বলে ডেকে উঠবে আমায়।আর পারছি না আল্লাহ আর পারছি না এসবকিছু মেনে নিতে,রহম করো রাব্বুল আল আমিন,শক্তি দাও আমায়,আমি যে আর পেরে উঠতে সক্ষম হচ্ছি না।একদিন সবকিছুর আগেই আমি আয়ানকে বেঁছে নিতাম আর আজ সেই আমিই আয়ানকে নিজের জীবনের কোনো অংশেই রাখতে চাই না আল্লাহ, তুমি সেই তৈফিক দিয়ো আমায়।তৈফিক দিয়ো।

কথাটা বলতে বলতে কান্নায় ফেঁটে পড়লো আঁখি,এদিকে আদৃত খনিক আগে আসলেও আঁখি সেদিকে খেয়াল করতে ব্যার্থ হলো যার ফলস্বরূপ আদৃতের কানে গেলো আঁখির বলা সমস্ত কথা,সামনে চলমান দৃশ্যটিও যে আদৃতের চোখে স্পষ্ট ভেসে উঠছে,তবে আদৃত যে সন্দেহ টা করেছিলো তাই হলো,এখন আদৃত আঁখির কথায় এতেটুকু তো বুঝতেই পারলো যে আয়ানের জন্যই আঁখি নিজের বাচ্চাকেও ত্যাগ করেছে,চাঁদের আলোয় সেই অসহায় রমণীর উজ্জল চেহারা যা অতিরিক্ত কান্নার ফলে লাল বর্ন ধারন করেছে তা বড়ই আঘাত করছে আদৃতের হৃদয়খানা,আরোহীও যে ঠিক একইভাবে কান্না করতো,কান্নার ফলে সম্পূর্ণ চেহারা খনিকে লাল বর্ন ধারন করতো,আরোহীকে যে কখনো কাঁদতে দেখে নি আদৃত,হয়তো আরোহীর কখনো কান্নার প্রয়োজনই পড়ে নি,আদৃত ওকে যে মাথায় চড়িয়ে রাখতো,তবে হ্যাঁ শেষবার অনেক কান্না করেছিলো আরোহী,নিজের প্রিয়সীর কষ্ট ভরা কান্না যে আদৃত সইতে পারে নি,সে কান্না থামানোর বদৌলতে আদৃত যেকোনো পর্যায়ে যে যেতে প্রস্তুত ছিলো তবে এমন পর্যায়েও যেতে হবে তা কখনো ভাবে নি আদৃত,হয়তো সত্য ভালোবাসায় এতোটা শক্তি থাকে যে মানুষকে অসাধ্য সাধন করারও শক্তি দেয়,আজ আঁখির সেই কষ্টানুভুতি আদৃতের মনের লুকিয়ে থাকা কষ্টানুভুতিকেও যেনো নেড়ে দিলো যার ফলস্বরূপ আদৃতেরও চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কিছু জল,যা বেশি সময় বইতে না দিয়ে মুছে ফেললো আদৃত,আঁখির দিকে এগিয়ে যেতে নিলেও আর এগুলো না,কারন আদৃত জানে ওকে দেখলে আঁখি নিজের অনুভুতি আবারও লুকাবো নিজের মিথ্যে হাসির পিছনে,তাই আর এগুলো না,কখনো কখনো যে মন খুলে কান্না করাটাও মন হালকা করার অন্যতম পন্থা হয়।

বেশ কিছুক্ষণ পর আঁকি নিজেকে সামলে নিয়ে রুমে আসলো,তৎক্ষনাৎ বেডে আদৃতকে বসে থাকতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।কাঁপা কন্ঠে বললো এবার।

আপনি?আপনি কখন এলেন?

এই তো প্রায় ২ মিনিট আগে।

আমতা আমতা করে কথাটা বললো আদৃত,আদৃত প্রায় আধ ঘন্টা আগে এসেছে তবে তা আঁখিকে জানাতে চাইলো না,আঁখি যখন নিজের অনুভুতি লুকিয়েই ভালো থাকতে চায় তবে তাতে বিঘ্ন ঘটাতেও চায় না আদৃত।কিন্তু মিথ্যা বলা জানে না তাই কন্ঠে আমতা ভাব এলো ওর কথাটা বলতে গিয়ে।

এদিকে উক্ত কথা বলতে গিয়েও আদৃতের চোখের পাতা বার বার পড়ছিলো,ঠোঁটগুলো কাঁপছিলো ঠিক সেই দিনের মতো, কিন্তু সচরাচর আদৃত যখন কথা বলে তখন এমনটা হয় না,উক্ত বিষয়টাও আদৃতকে নিয়ে আঁখির রহস্যময়ী সন্দেহ টা আরও বাড়িয়ে দিলো।

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here