মন_মহুয়ার_নেশা #সূচনা_পর্ব

0
1410

#মন_মহুয়ার_নেশা
#সূচনা_পর্ব
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– এই গ্রামটা মেয়ে মানুষের জন্য ভালো নয় ডাক্তারদিদি,তাই এইখানে না থাকাটাই আপনার জন্য ভালো হবে।

কেয়ারটেকার কথা শুনে চমকে উঠলো মহুয়া। কেয়ারটেকারের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো..
– মানে?
– এত মানে টানে বলতে পারবো না ডাক্তারদিদি,সা*ব*ধান করার কথা সা*ব*ধান করলাম বাকিটা আপনার বিষয়।

কেয়ারটেকার নিজের স্থান ত্যাগ করলো কিন্তু মহুয়াকে একরাশ কৌতুহলের মধ্যে ফেলে দিয়ে
মহুয়া আজকেই গ্রামের হাসপাতালে বদলি হয়ে এসেছে শহুরে জীবন ছেড়ে,, নতুন পরিবেশ নতুন জায়গা আগে কখনোই গ্রামে আসা বা থাকা হয়নি কখনোই শুধুমাত্র বাবার জেদের কারনে এই অজ পাড়া গাঁয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে মহুয়া। একরাশ বিরক্তি,জার্নি করে ক্লান্ত শরীর তার মাঝে এই রহস্যময় কথা সবমিলিয়ে মহুয়ার ভীষন রাগ হচ্ছে ওর বাবার উপরে। মহুয়া ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে তার শহুরে জীবনের অতীতে ডুব দিলো…

অতীত..

সদ্য ডাক্তারি পাশ করা মহুয়া, শহরের নামকরা হাসপাতালে চাকরির অফার আসতে লাগলো। মহুয়া তো খুব খুশি এবার মানুষের সেবা করতে পারবে কিন্তু তখনি বিপত্তি বাঁধলো ওর ড্যাডের কথাতে।

– মামনি এবার কি করবে ভাবছো।
– এই তো অনেকগুলো হাসপাতাল থেকে অফার এসেছে যেকোন একটাতে জয়েন করবো।
– আমি চাই তুমি এই হাসপাতালে ডাক্তার হিসাবে জয়েন করো।

মহুয়া কৌতুহলী হয়ে ওর ড্যাডের হাত থেকে জয়েনিং লেটারটি নিলো। কাগজপত্র দেখে মহুয়ার চোখ চড়কগাছ।

– ড্যাড এই হাসপাতালটা কোথায়?
– নারায়নপুর গ্রামে।( গ্রামটার নাম সম্পূর্ণ কাল্পনিক,,বাস্তবে এই নামে কোনো গ্রাম আছে নাকি সেটা আমার অজানা)
– গ্রাম?( চমকে উঠে)
– হ্যা গ্রাম,এই গ্রামের হাসপাতালেই তুমি চাকরি করবে এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশান।
– ড্যাড আমি জীবনে কখনোই গ্রামে যায়নি সেখানে তুমি আমাকে এইরকম একটা অজ পাড়া গাঁয়ে ডাক্তারি করতে বলছো, এইখানে তো অনেক ভালো ভালো হাসপাতাল আছে এইখানে করি না।
– না মামনি, একজন ডাক্তারের কাছে মূল লক্ষ্য হলো মানবসেবা। আর এই শহরে অনেক অনেক ডাক্তার আছে কিন্তু ওই গ্রামে মানুষরা ঠিকমতো চিকিৎসা পাই না ওদের তোমার মতো ডাক্তার দরকার।

মহুয়া তার বাবার কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কিছুই বলে উঠতে পারলো না।

(মহুয়া হাসান। বয়স ২৪+ দেখতে মাশাআল্লাহ সুন্দরী। বাবা- মাকে নিয়েই পরিবার। )

মহুয়ার বাবার সিদ্ধান্তের সাথে মহুয়ার মায়ের সিদ্ধান্তের মত নেয়। তিনি কিছুতেই তার একমাত্র মেয়েকে গ্রামে পাঠাবেন না। বাবার জেদের কারনেই মহুয়াকে শহর ছাড়তে হয়েছে।

ভাবনার মাঝে কখন যে মহুয়া ঘুমিয়ে পড়েছিলো সেইদিকে খেয়াল নেয়। ফোনে রিং হবার আওয়াজে মহুয়ার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো। ফোনটা কানে তুলে নিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো…
– কে?

অন্যদিকে মহুয়ার ঘুম ঘুম কন্ঠ শুনে ক্রিশের বুকের ভেতরে অন্যরকমের একটা অনুভুতি খেলে গেলো। নিজের অনুভূতি গুলোকে পাত্তা না দিয়ে ক্রিশ বললো…
– মহু।

চেনা কারোর কন্ঠস্বর বুঝতে পেরে মহুয়ার চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে যায়। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো ক্রিশ ফোন করেছে।

– ক্রিশ বল।
– পৌঁছে গেছিস গ্রামে।
– হ্যা রে।
– যাক ভালো। তা কেমন লাগলো গ্রামটা।
– এখনো রুম থেকে বের হয়নি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তোর ফোন আসাতে উঠলাম।
– বিরক্ত করলাম নাকি।
– আরে না বরং উপকার করলি। তোর জন্য তো আমার ঘুমটা যাই হোক গায়েব হয়ে গেলো আর আমি গ্রামটা ঘুরতে পারবো।
– তা ঠিক।
– হুম। আচ্ছা রাখছি পরে কথা বলবো,ফ্রেশ হবো।
– আচ্ছা বাই।
– বাই।

মহুয়া ফোনটা কেটে দিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো। আর ক্রিশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো,মহুয়াকে মেডিকেল কলেজ থেকেই পছন্দ করে, কিন্তু বলে উঠতে পারেনি বাধা একটাই ক্রিশ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আর মহুয়া মুসলিম।মহুয়া কখনোই ওকে মেনে নেবে না এটা খুব ভালো মতোই জানা আছে ক্রিশের।তাই বলে বেকার সম্পর্ক টা নষ্ট করতে চাই নি।

মহুয়া ফ্রেশ হয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। পরনে একটা স্কাই ব্লু রঙের শাড়ি,চুলটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো,যদিও চুলটা বড়ো নয়, কাঁধের একটু নীচে। গলায় বাবার দেওয়া গোল্ড চেন আর কানে দুটো টপ। হাতে একটা ঘড়ি ব্যাস কমপ্লিট। ডাক্তার মানুষদের আর সাজলে চলে না। সাদামাটাই মানায়। মহুয়া নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো গ্রাম ভ্রমনে।

গ্রামটা ভালোই জনবহুল। যে যার মতো কাজে ব্যস্ত,তবে একটা বিষয় একটু অদ্ভুত লাগলো আশেপাশে কোনো মেয়েকেই চোখে পড়লো না। মহুয়া সেদিকে খেয়াল না দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলো। তখনি দেখতে পেলো একদল মানুষ দৌড়ে দৌড়ে কোথাও একটা যাচ্ছে।

মহুয়া একজনকে থামিয়ে দিয়ে বললো..
– কি হয়েছে এত মানুষ ওইদিকে যাচ্ছে কেন?
– নদীর ধারে একটা মেয়ের লা**শ পাওয়া যাচ্ছে, আল্লাহ জানে কার মেয়ের সর্ব**নাশ হলো।

কথাটা বলেই লোকটা দৌড়ে চলে গেলো। মহুয়া নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে ওহ গ্রামের লোকদের পেছন পেছন দৌড়ে গেলো। নদীর ধারটাই মানুষ গিজগিজ করছে। অনেক মানুষের ফিসফিস শব্দ শোনা যাচ্ছে।

মহুয়া ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলো একটা মেয়ের লা**শ পড়ে আছে‌। মুখটা বোঝা যাচ্ছে না ঠিকমতো কিন্তু জামাকাপড়ের অবস্থা ভালো নয় দেখে মনে হচ্ছে কেউ ধ*র্ষা**ধ*র্ষি করে কিছু করার চেষ্টা করেছে বা কিছু করেছে। মহুয়া এগিয়ে যেতেই যাবে তখনি একটা মধ্য বয়সি নারী ওহ পুরুষ দৌড়ে এসে লা**শটার কাছে বসে কাঁদতে শুরু করলো।

– এই মা তোর কি হলো কথা বল না। কথা বল না মা(মেয়েটি)

কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটিকে ঘুরিয়ে দিলো যার জন্য মেয়েটার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মহুয়া,,আন্দাজ মতে মেয়েটার বয়স খুব করে হবে ১৭ /১৮ বছর। এই ফুলের মতো নিস্পাপ মেয়েটাকে কে মা**র*লো?

– এই রফিক তাড়াতাড়ি তোর মেয়েকে দা*ফনের ব্যবস্থা কর।
– হ্যা রফিক ভাই চেয়ারম্যান সাহেব ঠিক বলেছেন তুমি তাড়াতাড়ি তোমার মেয়ের দা*ফনের ব্যবস্থা করো।

অনেকেই চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে মতপ্রকাশ করলো। মহুয়া নিজের কৌতুহল নিজের শিক্ষা,প্রতিবাদী স্বভাব কিছুই আর দমিয়ে রাখতে পারলো না। একটু এগিয়ে এসে বললো…

– এখুনি দা*ফন করা হবে না। এটা পুলিশ কে*স পুলিশ আসুক তারপরে সবকিছু হবে।

সকলেই মহুয়ার দিকে অবাক চোখে তাকালো। চেয়ারম্যান সাহেব পানের পিক ফেলে বললেন..
– এই মেয়ে কে তুমি। আগে তো কখনোই দেখিনি এই গাঁয়ে।
– আমি মহুয়া। গ্রামের হাসপাতালের নতুন ডাক্তার।
– বাবা মেয়ে ডাক্তার(ব্যঙ্গ করে চেয়ারম্যান সাহেব)
– জ্বি। এই কেউ পুলিশে খবর দাও।
– কোনো পুলিশ আসবে না।
– এসে গেছি আমরা।

পুলিশকে দেখে সকলেই আরো একদফা অবাক হয়ে যায়। গ্রামের মানুষরা আস্তে আস্তে ওখান থেকে সরে যায়। চেয়ারম্যান সাহেব পুলিশ আর মহুয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করে।

– আপনি কে?( পুলিশ টি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়)
– আমি মহুয়া। গ্রামের হাসপাতালের নতুন ডাক্তার।
– ওহ আপনিই তাহলে মহুয়া।
– জ্বি।
– আমি তন্ময় হাসান। এই গ্রামের থানার ওসি।
– থ্যাঙ্কস আপনাকে ঠিক সময়ে এইখানে আসার নাহলে তো ওনারা জোর করেই দা*ফন করে দিত।
– আমরা তো জানতেই পারতাম না যদি না ঠিক সময়ে নিশান আমাদের খবর দিত।
– নিশান কে?
– ওইতো।

মহুয়া ছেলেটার দিকে তাকালো, পরনে একটা লুঙ্গি, ছেঁড়া শার্ট,গলায় গামছা। কপাল ভর্তি ঘাম, ঠোঁটের কোনো একটা হাসি। হাসিটাই কিছু একটা ছিলো যেটা মহুয়াকে মুগ্ধ করলো।।

– তাহলে ম্যাম আমার আমাদের কাজ করি।
– জ্বি অবশ্যই।

লা**শটাকে নিয়ে চলে যায় পুলিশরা। মহুয়া চলে যেতে গেলেও কিছু একটা মনে করে পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো…
– ধন্যবাদ।

নিশান এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো…
– আমাকে বলছেন?
– জ্বি।

নিশান মহুয়ার কাছে এগিয়ে এসে বললো।

– আমাকে ধন্যবাদ বলছেন কেন?
– আপনি ঠিক সময়ে পুলিশকে খবর না দিলে তো।

নিশান মুচকি হেসে বললো…
– সেটা ঠিক আছে কিন্তু ম্যাডাম এই গ্রামটা নিরাপদ নয় আপনার জন্য আপনি এখান থেকে চলে যান।

কথাটা বলার সময়ে নিশানের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো। নিশান আর কিছু না বলে স্থান ত্যাগ করলো। মহুয়া বুঝে উঠতে পারছে না এই গ্রামের আসল রহস্য টা কী?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here