মন_হারানোর_বিজ্ঞাপন,পর্ব ৩
নুজহাত_আদিবা
রাগে অভিমানে শাড়িগুলো ওখানেই আবার আগের মতো করে রেখে দিলাম। যাকে ইচ্ছা তাঁকে দিক অন্বয় শাড়িগুলো। আমার কী তাতে? যেদিন আমাকেও ভালোবাসে শাড়ি কিনে দেবে আমিও সেদিন নেবো। এর আগে নেব না।
অন্বয়কে রাতে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের বাসার আশেপাশে কোনো শিউলিফুল গাছ আছে কি না। আমার শিউলি ফুল খুব ভালো লাগে। তাই জিজ্ঞেস করেছি অন্বয়কে। শিউলিফুল গাছ থাকলে সকালে গিয়ে শিউলিফুল কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। অন্বয় শুধু বললেন না। এরপর আর টু শব্দ ও করলেন না।
পরদিন শুক্রবার অন্বয়ের অফিস নেই। তাই সকালে ঘুম থেকে ওঠার ঝামেলাও নেই। রাতে মোবাইলে একটা মুভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙলো সকাল নয়টায় উঠে দেখি শিউলি ফুলের তীব্র ঘ্রাণ। এত সুন্দর শিউলি ফুলের তীব্র ঘ্রাণের উৎস খুঁজে বের করতে শুরু করলাম আমি। অনেকক্ষন খোঁজাখোজির পরে বালিশের সাইডে অনেক গুলো শিউলি ফুল দেখতে পেলাম। হাতের মুঠোয় শিউলি ফুলগুলোকে নিয়ে ঘ্রাণ নেওয়া শুরু করলাম আমি। বাসায় অন্বয় ছাড়া কেউ নেই। তাই নিশ্চিত ভাবে বলাই যায় অন্বয়-ই ফুল গুলো এনেছে। কিন্তু, কোথায় পেলেন উনি?
~~~~~~~~~~
অন্বয় গিয়েছেন আম্মুকে নিয়ে আসতে। আম্মুর শরীরটাও বেশি ভালো না। আর আম্মু অন্বয়কে ছাড়া একটানা বেশিদিন থাকতে পারেন না। তাই এভাবে চলে আসা।
আম্মু আর অন্বয় ফিরে আসতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। আম্মু বললেন গোসল করে খাওয়া দাওয়া করবেন। অন্বয়ও ফ্রেস হতে চলে গেছেন। আমি টেবিলে আস্তে আস্তে সব কিছু এনে রাখলাম। খাবার বেড়েই আম্মুকে আগে ডাক দিলাম। এতদূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন। খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার আম্মুর।
আম্মু যখন টেবিলে খেতে এলেননতখন আমি অবাক। কারণ, আম্মুর গায়ে সেই শাড়িটা। মানে অন্বয়ের আলমারিতে যে-ই শাড়িগুলো ছিল। ওই শাড়িগুলোর ভেতরে এই শাড়িটাও ছিল। তাহলে এই কাহিনী। অন্বয় আম্মুর জন্য এনেছে শাড়িগুলো। যাক, তাহলে তো ভালোই। অন্তত ওই মেয়ের জন্য আনেনি।
অন্বয় খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে এসে বেডে শুয়ে পড়লেন। আমিও রুমে ঢুকে টাওয়াল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে অন্বয়কে বললাম, আপনার আজকে বিকালে কোনো কাজ আছে অন্বয়? অন্বয় বললেন না। আমি তারপর অন্বয়কে বললাম, তাহলে আমার সাথে বিকালে একটু বাইরে যেতে পারবেন? আসলে আমাদের বারান্দা-টা কত্ত বড়। একটু গাছ-গাছালি থাকলে আরও সুন্দর লাগতো৷ তাই বিকালে যদি সময় করে একটু আমার সাথে বের হতেন তাহলে ভালো হতো। অন্বয় হালকা শব্দ করে বললেন আচ্ছা।
আমি মনে মনে একটু খুশি৷ হুম আর না থেকে আচ্ছা। একটু একটু করে আমার সাথে শব্দ করে কথা বলছে আরকি। চলতে থাকুক এভাবে। আমার সাথে থাকতে থাকতে একসময় আমার মতো কথা বলা শিখে যাবে অন্বয়।
অন্বয় ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। বিকালে আমি ওনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। ভেবেছিলাম আকস্মিক ভাবে নিদ্রাভঙ্গ হওয়াতে উনি রেগে যাবেন। কিন্তু, অন্বয় রাগলেন না। স্বাভাবিক ভাবেই ঘুম থেকে উঠে হামি দিতে শুরু করলেন। আমি অন্বয়কে ডেকে বললাম, আপনি বলেছিলেন বিকাল বেলা আমার সাথে বাইরে যাবেন। তাই ডেকে তুললাম৷ বিকাল হয়ে গেছে; যাবেন না আপনি? অন্বয় বিছানা থেকে নেমে বললেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন হুম। এরপর আমিও রেডি হতে শুরু করলাম। অন্বয় আলমারি থেকে একটা শার্ট বের করে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করলেন। অন্বয়ের হাতের শার্টের কালারটা আমার পছন্দ হলো না। আমি সবকিছু ভুলে গিয়ে অন্বয়কে বলে ফেললাম, এই শার্টটা থেকে আপনাকে ওই গাঢ় বেগুনি রঙের শার্টটায় বেশি সুন্দর লাগবে। এই কথাটা বলার কিছুক্ষন পরে আমার মনে হলো আমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। অন্বয়ের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল আমার। সেটা না করে, আমি আরও উল্টো আমার পছন্দ বলে ফেললাম।
আমি তবুও ভেবেছিলাম অন্বয় হয়তো অন্বয়ের পছন্দের শার্টটাই পরবেন। কিন্তু, পরে দেখি অন্বয় ওই গাঢ় বেগুনি রঙের শার্টটাই পড়েছেন।
~~~~~~~~~
নার্সারী থেকে আমার পছন্দ অনুসারে বেশ কিছু গাছ কিনলাম আমি। শেষে দুটো গোলাপ গাছ খুব পছন্দ হলো। কিন্তু, এই গোলাপ গাছ একটাই রাখা যাবে বারান্দায়। দুটোর একসাথে জায়গা হবে না। অনেকটা সময় ভাবাভাবি করেও কোনটা নেবো বুঝতে পারলাম না। পরে চিন্তা করে দেখলাম একবার অন্বয়কে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? আমি দু’হাতে দুটো গাছ তুলে নিলাম। একটা ডানহাতে আরেকটা বামহাতে। অন্বয়কে গিয়ে বললাম দেখুন তো কোনটা বেশি ভালো। অন্বয় আমার ডান হাতের দিকে ইশারা করে বললেন এটা। আমি অন্বয়ের দিকে বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, এই গাছটা তো বেশি সুন্দর। অন্বয় আমার বাম হাতের দিকে ইশারা করে বললেন, এই গাছটা বেশিদিন বাঁচবে না।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বোবার মুখে বুলি ফুটেছে দেখি। বোবা দেখি আবার গাছও চেনে। এরপর অন্বয়ের বলে দেওয়া গাছটাই নিলাম।
বাড়ি ফিরে আসার সময় অন্বয় আর আমি এক রিকশায় এলাম। আর তাঁর পেছনের রিকশা-তে আমাদের গাছগুলো। আমি অন্বয়ের পাশে বসে সযত্নে অন্বয়ের কাঁধে মাথা গুঁজে দিলাম। ভেবেছিলাম অন্বয় হয়তো সরে যাবেন। কিন্তু না, অন্বয় সরে গেলেন না। বরং ওখানেই স্থির হয়ে বসে রইলেন।
আমি অন্বয়ের কাঁধে মাথা দিয়ে গভীর ভাবনার জগতে ডুবে গেলাম। আচ্ছা, অন্বয়ের প্রেমিকা আমাদের এভাবে দেখে ফেললে কিছু ভাববে না তো? ভাবলে ভাবুক তাতে আমার কী? যা যাবে সব অন্বয়ের যাবে। আমার এত চিন্তা করে কাজ নেই।
~~~~~~~~~~
পরদিন আম্মু সকালে ফোন দিয়ে বললো, আমি যেন অন্বয়কে নিয়ে আজকে আমাদের বাসায় চলে আসি। অন্বয়ের আজকে অফিস আছে। তাই, অন্বয় যেতে পারবেন না। অন্বয় অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। অফিস থেকে যখন বাড়ি ফিরবেন আমাকে আবার সাথে নিয়ে ফিরবেন।
বাসায় যাওয়ার পর আব্বু জিজ্ঞেস করলো অন্বয় কেন আসেনি? আমি বললাম অন্বয়ের আজকে অফিস আছে৷ তাই, উনি আসতে পারেননি।
সারাদিন আমাদের বাসায় থেকে সবার সাথে আড্ডা দিয়ে গল্প করে সময় কেটে গেল। রাতে যখন অন্বয় আমাকে নিয়ে আসতে আমাদের বাসায় গেলেন। তখন, আমার চাচাতো বোন লামিয়া আর সামিয়া অন্বয়ের সাথে কথা বলতে চলে গেল। কিছুক্ষন পরেই আবার দু’জনে চলে এলো।
এসেই আমাকে বলতে শুরু করলো, ভাইয়া এত চুপচাপ কেন আপু? কত গম্ভীর হয়ে থাকে সবসময়। বেশি কথাও বলে না। সবসময় সিরিয়াস হয়ে থাকে। তুমি কী ভাইয়াকে বাসায় নিয়ে মারো আপু? ভাইয়া তাই তোমার ভয়ে কথা বলে না?
আমি ওদের দুজনের কথা শুনে কী আর বলবো? অন্বয় আমার সামনেও এমন চুপচাপ গম্ভীর হয়ে থাকেন। মনে হয় ওনাকে কেউ মেরেছে। শুধু মারেনি মেরে সারাজীবনের জন্য বোবা বানিয়ে দিয়েছে।
বাসায় আসার পর অন্বয় আম্মুর রুমে গেলেন। আমি অবশ্য যাইনি। কারণ, মা ছেলের মধ্যে অনেক কথা থাকতে পারে। সেখানে আমার ঢুকে লাভ কী?
অন্বয়ের আর আমার পরদিন রাতে একটা দাওয়াতের অনুষ্ঠান ছিল। অন্বয়ের কলিগের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি ছিল। অন্বয় অফিস শেষ করে বাসায় এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। অন্বয় অফিস থেকে আসার আগেই আমি রেডি হতে শুরু করলাম। অন্বয়ের পাঞ্জাবি, পাজামা সব আয়রন করে গুছিয়ে রাখলাম। অন্বয়ের পাঞ্জাবির সাথে ম্যাচ করে আমি শাড়ি পড়লাম। আমার জীবনটা আজকাল অন্বয় অন্বয় হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন অন্বয় ব্যাতীত কারো কথা মাথায় আসে না। ঘুমাতে গেলেও অন্বয়। খেতে বসলেও শুধু অন্বয়। কী এক অবস্থা হুহ্! আমি সারাদিন ওই ভদ্রলোকের কথা চিন্তা করে রাতের ঘুম হারাম করি। আর উনি সারাদিনে একবারও আমার কথা ভাবেন কি না কে জানে।
চলবে…