#মম_চিত্তে
#পর্ব_১
#সাহেদা_আক্তার
ডিভোর্স লেটারে সাইন করার পর অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল নিজের স্বামীর দিকে মম। তার চেহারায় বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই বরং হাসতে হাসতে নিজের প্রেমিকার সাথে কথা বলছে। অবশ্য দুঃখ থাকার কথাও না। কারণ ওদের একমাসের বিবাহিত জীবনে সে কখনো মমর দিকে ফিরেও তাকায়নি। আলাদা রুমে যে যার মতো কাটিয়েছে। বাসর রাতেই ওকে জানানো হয়ে গেছে এই কবুল শব্দটার কোনো মূল্য নেই। তাহলে দুঃখ কিসের!
কোর্ট থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটা ধরল ও। আকাশে মেঘ জমেছে। ঠান্ডা বাতাস বৃষ্টির জানান দিচ্ছে। মম একবার তাকাল আকাশের দিকে। যে সম্পর্কটা শুরু হওয়ার আগেই পঁচে গিয়েছিল তার থেকে মুক্ত আজ। বেশ ভালো লাগছে। ভাবলো বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। আবহাওয়া যদিও ভালো লাগছে তার বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। কিন্তু রিকশা পাওয়াও মুশকিল হয়ে গেল। আকাশে যে পরিমাণ মেঘ জমেছে তাতে ঝড় তুফান উঠবে মনে হচ্ছে। রিকশা খুঁজতে খুঁজতে হাঁটা ধরল রাস্তা ধরে। কিছুদূর যেতে না যেতেই মুষল ধারে বৃষ্টিটা শুরু হয়েই গেল। মাথা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে দৌঁড়ে গিয়ে একটা ফাইভ স্টার হোটেলের দরজায় আশ্রয় নিল। সুবিধার ঠেকছে না পরিবেশটা। ছোটবেলা থেকে বিদ্যুৎ চমকানোকে ভীষণ ভয় পায় মম। এস্ট্রাফোবিয়া আছে ওর। রাতে মাকে জড়িয়ে কাঁথার নিচে কাঁপতো বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে। এখনো দূর প্রান্তে আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। যে কোনো মুহুর্তে বজ্রপাত শুরু হতে পারে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। হোটেলের ভেতরে যাওয়ার কথা মাথাতেই এল না ভয়ে। শুধু চিন্তা কি করে বাসায় যাওয়া যায়। মম ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল। বাবাকে ফোন করতে হবে যাতে কোনো একটা পরামর্শ দিতে পারে। ডায়ালে নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎই কাছে কোথাও বাজ পড়ল। সাথে সাথে হাত থেকে খসে পড়ল ফোন। মম কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল হাঁটু ভাঁজ করে। দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরল।
– রিয়ান, কথা তো শোন একবার।
– কি ককক………. হাচ্চু……… শশুনবো? জানিস না। আমার বিড়ালে এলার্জি? হা… হা… হা… হাচ্চু……
– ওরা ভুল করে…
– ভুল? আআমি… হা… হাচ্চু……
রিয়ান হাঁচতে লাগলো হোটেলের বাইরে এসে। হোটেল ম্যানেজারকে বলে রেখেছিল যাতে আশেপাশে বিড়াল কেন বিড়ালের বও না থাকে। কিন্তু ক্লাইন্টের সাথে মিটিংয়ের মাঝ পর্যায়ে হঠাৎ কোথা থেকে এক তরতাজা বিড়াল এসে উপস্থিত হলো তা দৃষ্টিগোচর হয়নি কারো। ব্যস; হাঁচতে হাঁচতে প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছে রিয়ানের। সারা মুখ লাল হয়ে গেছে। মিনহাজ রিয়ানকে বোঝাতে লাগল, দেখ ভাই মিটিংটা খুবই ইম্পর্টেন্ট। রাকিব চাচা বার বার বলে দিয়েছে যাতে কোনো ভুল না হয়……। পকেট থেকে ওষুধ বের করে মুখে দিয়ে দিল রিয়ান। তারপর মাস্কটা পরতে পরতে বলল, আমার প্রাণটা কি ইম্পর্টেন্ট না? আমি এখুনি হা…চ্চু…… বাড়ি ফিরবো। হা… হা… হাচ্চু……। রিয়ান নাক ঢলে বলল, ড্রাইভারকে বলো গাড়ি বের করতে। মিনহাজ বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল, ভাই দেখ বাইরে অনেক বৃষ্টি। চল হোটেলে বসবি। একটু শান্ত…। রিয়ান কোনোমতেই রাজি হল না ওর কথায়। যেখানে বিড়ালটা এখনো বর্তমান সেখানে গিয়ে হাঁচতে হাঁচতে প্রাণ দেওয়ার মানে হয় না। সে এখুনি বাড়ি যাবে মানে এখুনি যাবে। মিনহাজ কোনো উপায় না দেখে হোটেলের নিচে থাকা পার্কিং লটে গাড়ি আনতে চলে গেল।
হাঁচির সাথে সাথে কোথাও একটা বাজ পড়ল। চারদিক আলোয় সাদা হয়ে গেল। তখনই রিয়ানের চোখ পড়ল কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মমর দিকে। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আলোর উৎসের দিকে। হাতের ফোনটা পড়ে ভেঙে আছে পায়ের কাছে। আস্তে আস্তে দুই কান চেপে বসে পড়ল। ওর ভেজা শরীর অনবরত কাঁপছে। রিয়ান দুই কদম এগিয়ে ওকে ডাকতে গেল। তখনই আবার বাজ পড়ল কোথাও। মম ওর কান খামচে ধরল ভয়ে। রিয়ান কি ভেবে ওর কােটটা খুলে মমর মাথার উপর দিয়ে দিল। এদিকে মিনহাজ গাড়ি থেকে ডাক দিল ওকে। সে গাড়ি পার্কিংলট থেকে নিয়ে বেরিয়েছে। ওর ডাকে চলে গেল গাড়ির কাছে। এক পলক মমর দিকে তাকাল। ও এখনো ভয়ে সেভাবেই বসে আছে।
গাড়ি ছেড়ে দিতেই মিনহাজ বলল, চাচার সাথে কথা বলেছিলাম। রিয়ান কিছু বলল না। মিনহাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রিয়ানকে ছোটবেলা থেকে জানে ও। ভীষণ একগুঁয়ে। তাই আর কিছু বলার চেষ্টা করল না। মাঝপথে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তোর কোট কোথায়?
– একজনকে দিয়ে এসেছি।
মিনহাজ অবাক হয়ে বলল, তোর প্রিয় কোট একজনকে দিয়ে এসেছিস! কি বলছিস! কে সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি! মিনহাজের কথায় হুশ হলো রিয়ানের। আসলেই তো। ওর সবচেয়ে ফেবারিট স্যুট এটা। যার এক সুতা এদিক থেকে ওদিক হলে কাজের লোক পর্যন্ত চাকরিচ্যুত হয় সেই স্যুটের কোট আজকে ঐ মেয়েকে দিয়ে এল! সাথে সাথে মিনহাজকে বলল গাড়ি ঘুরাতে। আধা ঘন্টা পর পৌঁছালো হোটেলের সামনে। কোথাও কেউ নেই। রিয়ান চারদিকে খুঁজে দেখল। সেই মেয়েটি নেই। তবে মেয়েটি যে জায়গায় বসে ছিল সেখানে একটা সাদা দুল পেল। রিয়ান সেটি তুলে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল দুলটির দিকে। দুলটা থেকে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। মিনহাজ দৌঁড়ে আসতেই ভেজা দুলটিই প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। ও হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কোথাও কেউ নেই।
– তুই দেখেছিস নাকি মেয়েটাকে?
– মেয়ে ছিল নাকি!
রিয়ান চুপ করে গেল। আর কোনো বেফাঁস কথা বললেই বাড়িতে গিয়ে ক্যাঁচাল শুরু করবে। মিনহাজ মুচকি হেসে বলল, সে যাই হোক। প্লিজ ভাই, এসেছিস যখন আবার মিটিংয়ে চল। হাঁচি তো কমে গেছে। এবার আর ভুল হবে না ভাই। চল। রিয়ানের বেশ বিরক্ত লাগল। অনিচ্ছার সত্ত্বেও আবার মিটিংয়ে গেল।
.
.
.
.
বৃষ্টিটা কমেছে। বলতে গেলে মিনিটে কয়েক ফোঁটা পড়ছে গায়ে। কোনো রকমে দুলতে দুলতে বাড়ি ফিরল মম। রায়হান সাহেব বাসার নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনবরত মমর ফোনে কল করে যাচ্ছিলেন। নট রিচেবল বলছিল। চিন্তায় কপালের ভাঁজ সরছিল না। বিধ্বস্ত মমকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে দৌঁড়ে গেলেন। ভিজে চুপসে আছে মেয়েটা। দ্রুত বাসায় নিয়ে গেলেন। বাসায় ঢুকতেই নির্লিপ্ত চোখে বাবার দিকে তাকাল ও। তারপরই হঠাৎ হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। রায়হান সাহেব কিছু বললেন না। জোর করেই মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে আজ পস্তালেন। তারই দোষে মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। ভাবতেই নিজের চোখও ভিজে উঠল তাঁর। নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে হালকা হতে দিলেন।
আধা ঘণ্টা পর শান্ত হতেই মম নিজের রুমে চলে গেল। ভেজা কাপড়ে ঠান্ডা লেগে গেছে। নাক টানতে টানতে টাওয়াল আর কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই খেয়াল হল ওর গায়ে একটা কোট জড়ানো। মম খুলে কোটটার দিকে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলল, আবার কোটটাও খুলে আমার গায়ে দিয়েছো? হাসছিলে তো নিজের প্রেমিকার সাথে। আবার…… ওয়েট। এটা তো ওর কোট না। ও তো আজকে কোট পরে যায়ই নি। এটা কার কোট তাহলে! মম কিছুতেই মনে করতে পারল না। কোটটা ভিজে চুপসে গেছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব দামি কোট। মম সাবধানে কোটটা ধুয়ে নিল। হ্যাঙ্গারে ঝোলাতে ঝোলাতে হালকা একটা মিষ্টি ঘ্রান নাকে লাগল ওর। মনে মনে বলল, কোটের মালিককে পেলে জিজ্ঞেস করতে হবে তো কি পারফিউম লাগায়। নিজের কথায় নিজেই হেসে ফেলল মম। কি সব ভাবছে! কিন্তু কোটের মালিকটা কে!?
এক ঘন্টা মিটিং শেষে ফেরার পথে চুপচাপ বসে রইলো রিয়ান। মিনহাজ ড্রাইভারের সাথের সিটে বসেছে। আশেপাশে তাকিয়ে বলল, এক ঘন্টায় কি ঝড়টাই না হয়ে গেল! তবে আর যাই বলিস, তুই কোটটা মেয়েটাকে দেওয়ায় আর যাই হোক আমার উপকার হয়েছে। মিটিংটা সাকসেসফুলি শেষ হয়েছে। ডিলটা ক্যান্সেল হলে রাকিব চাচা দিতো আমাকে উত্তম মধ্যম। ওর কথায় রিয়ানের কোটটার কথা মনে পড়ছে খুব। দরদ দেখাতে গিয়ে এত বড় ভুল কি করে করল! পকেটে হাত দিতেই দুলটার স্পর্শ পেল। কোটের বদলে দুল পকেটে নিয়ে ফিরছে সে। কৃতজ্ঞতা বোঝাতেই কি দুলটা ফেলে গেল! অদ্ভুত রকমভাবে মনের অজান্তেই দেওয়া নেওয়া হয়ে গেল ওদের। মিনহাজের ডাকে রিয়ানের চিন্তায় ছেদ হলো। সে বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, একটু শান্তি দিবি না। মিনহাজ দাঁত দেখিয়ে হাসতে লাগল। ও জানালার বাইরে তাকাল। পকেটে দুলটা হাতের মুঠোয়।
রাত গভীর হতে লাগল। মম জানালার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো দিকে নজর নেই। দৃষ্টি আবদ্ধ মুষল ধারে পড়তে থাকা বৃষ্টির ফোঁটার দিকে। সন্ধ্যা থেকে আবার অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। এখনো কমেনি। একটানা পড়ে চলেছে। আজ এত কান্না করছে কেন আকাশ? আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ও। যেন চোখ মুছে দেবে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো হল না। বরং হাতটাই পানিতে ভিজে গেল। সে হাত বাড়িয়ে কিছু পানি হাতে নিল। মুখে দিয়ে দেখলো নোনতা। সে অবাক হয়ে ভাবল বৃষ্টির পানি তো কখনো নোনতা হয় না। তবে? হঠাৎ খেয়াল হল শুধু আকাশ নয় তার চোখও কাঁদছে। কারনও আছে। কিন্তু আকাশের কি কারণ? মম আপনমনে হেসে বলল, ধুর, আকাশের আবার কান্না করার কারণ লাগে নাকি!?
আকাশের কান্নার কারণ উড়িয়ে দিলেও নিজের কান্নার কারণ উড়িয়ে দিতে পারল না। অনেকদিন ডায়রী লেখা হয়নি৷ ইচ্ছে করেই লিখেনি৷ যখন লিখতে বসে তখন সব মনে পড়ে যায়৷ পুরনো পাতাগুলো নিজে থেকে উল্টে চোখের সামনে চলে আসে। ভেসে আসে সেই দৃশ্যগুলো। তখন চোখগুলোকে আর থামানো যায় না৷ বৃষ্টির মতো অঝোর ধারায় পড়তে থাকে।
ছোটবেলায় সবাই বলতো মম ওর মায়ের রঙ পেয়েছে। কি সুন্দর মানিয়েছে তাকে। সুন্দর শ্যামবর্ণের মায়াভরা মুখটা মিষ্টি লাগে দেখতে। বলতো যেই দেখবে সেই নাকি ওর রূপে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখন মম এসব শুনে লজ্জায় মুখ লুকাতো। ইন্টারে পড়াকালীন অনেক প্রপোজ পেয়েছিল। কখনো রাজি হয়নি। ভার্সিটিতে ওঠার তিন বছরের মাথায় প্রেমে পড়ে যায় আলিফের। সেই থেকে এক সাথে পথ চলার শপথ নিয়ে এগোতে থাকে দুজন। এদিকে অনার্স শেষ হতেই বিয়ের জন্য পিড়াপিড়ি শুরু করলেন রায়হান সাহেব। তার মাঝে হঠাৎই আলিফের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এক নিমিষে উধাও হয়ে যায় ওর জীবন থেকে। একটা বছর যোগাযোগবিহীন কাটে। একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় মম আলিফের ফিরে আসার আশায়। তারপরই হঠাৎ একদিন আলিফের এক বন্ধু থেকে জানতে পারল সে নাকি নতুন বউ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে এক বছর হচ্ছে। শুনে হাজার রাগে অভিমানে বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। আজ সেই সম্পর্কও ছিন্ন করে ফের আপন নীড়ে ফিরে এল। ছেলেদের প্রতি ঘৃণা জন্মে গেছে মমর। হঠাৎ কি মনে করে বারান্দায় ঝুলতে থাকা কোটটার দিকে নজর পড়ল। বাতাসে সেটি দুলছে। মম আপন মনে হেসে বলল, তোর হয়ত নিজের মালিকের কাছে ফেরা হবে না।
চলবে