#মম_চিত্তে
#পর্ব_১২,১৩
#সাহেদা_আক্তার
১২
মম সেখানেই খাওয়া থামালো। রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, প্রশ্নটি করার কারণ জানতে পারি, স্যার? রিয়ান নিজের জন্য খাবার বাড়তে বাড়তে বলল, যেহেতু আপনাকে আমার বউ হিসেবে সিলেক্ট করা হয়েছে সেইক্ষেত্রে জানতে চাওয়াটা বোধহয় অযৌক্তিক নয়। মম রিয়ানের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে আবার খাওয়ায় মনযোগ দিল। কি বলবে ভাবতে লাগল। রিয়ান ওকে চুপ থাকতে দেখে বলল, বললেন না যে। বললে আমার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো।
– কি ব্যাপারে? বিয়ে?
মমকে শান্ত দেখে রিয়ান ভেতরে ভেতরে অস্বস্থিবোধ করতে লাগল। বাইরে তা প্রকাশ না করে বলল, হ্যাঁ। মম দ্রুত খাওয়া শেষ করে বলল, আপনার আগে আমি আমার সিদ্ধান্ত আপনাকে জানিয়ে দেই। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না।
রিয়ানেরও খাওয়া শেষ করে চামুচ প্লেটে নামিয়ে রাখল। ও এভাবে রিজেক্ট হবে আশা করেনি৷ সে চায়ের অর্ডার দিয়ে আরাম করে বসে বলল, আলিফ ভাইয়ের জন্য? মম হেসে বলল, অন্ধকারে ঢিল মারছেন? রিয়ান কিছু বলল না। ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মম খাওয়ার প্লেটটি ঠেলে রেখে বলল, তা এক প্রকার ঠিকই বলেছেন।
– যেমন।
– আলিফ আমার ভার্সিটি ফ্রেন্ড ছিল একসময়। বলা চলে সিনিয়র ছিল। পরবর্তীতে ব্যক্তিগত কারণে এখন সে অপছন্দের তালিকায়। বাকিটা তাহলে আপনার বোঝা উচিত।
– কি ব্যক্তিগত কারণ?
– আমার ব্যক্তিগত কথা জানার অধিকার আপনি এখনো পাননি। যেহেতু বিয়েটা হচ্ছে না তবে এই প্রসঙ্গে আমি কথা বলতে চাইছি না। আপনি হঠাৎ আলিফকে নিয়ে প্রশ্ন করছেন কেন? সে কি কিছু বলেছে?
– না। আপনাদের দুইজনকে অফিসের সামনে দেখেছিলাম।
– ও, তাতেই এত প্রশ্ন করছেন!
ওদের একজন স্টাফ চা দিয়ে গেল। রিয়ান কিছু না বলে ওকে দিয়ে যাওয়া চা টায় চুমুক দিল। মম কিছু আড়াল করতে চাইছে যা তার অজানা। আলিফের আচরণে কখনো খারাপ কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি। তাকে ভালো বলেই জানে সবাই। তাহলে কি এমন ব্যক্তিগত কারণ যা তাকে মমর অপছন্দের তালিকায় ফেলল!? ব্যাপারটা ওর মনে খচখচ করতে লাগল৷ কিন্তু মম নিজে থেকে বলবে না সেটা বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। তাই অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইল। ভাবল কানের দুলটা ফেরত দিয়ে কোটের কথা জানতে চাইবে। কোটটা ওর ভীষণ পছন্দের। বিয়ে না হোক অন্তত কোটটা উদ্ধার করা প্রয়োজন।
রিয়ান মুখ খোলার আগেই মমর ফোন বেজে উঠল। ও চা শেষ করে ফোনটা হাতে নিল। মাধুরী খালার ফোন। রিসিভ করতেই তাঁর ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে মম বলল, কি হয়েছে খালা? এমন গলায় কথা বলছো কেন? কারো কিছু হয়েছে? মাধুরী খালা বললেন, মা, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। খালু কেমন যেন করতেসে। তোমার খালুরে এম্বুলেন্সে কল করতে পাঠাইসি। তুমি কই? মম দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, কি হয়েছে আব্বুর?
– জানি না মা। তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আমার ভয় লাগতেসে।
– আমি এখুনি আসছি। হাসপাতালের এম্বুলেন্স এলে আমাকে এড্রেসটা পাঠিয়ে দাও।
মম বলতে বলতে বেরিয়ে গেল রিয়ানকে কিছু না বলে। এদিকে রিয়ান আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না।
.
.
.
.
রায়হান সাহেবকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হুট করে বুকে ব্যাথা উঠেছিল সকালে। তাই শুয়ে ছিলেন। খাবার খাওয়ার পর বুকে ব্যাথা আরো বাড়তে থাকে। শ্বাস নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ তারপর শরীর আরো খারাপ হতে থাকে। হাসপাতালে আসতে আসতেও ঘেমে একাকার হয়ে গেছেন৷ তাই তার পোশাক চেঞ্জ করে দিয়েছে হাসপাতালের বয়। মাধুরী খালা ভয়ে চুপসে বসে আছেন এক পাশে। জাবেদ খালু দৌঁড়াদৌঁড়ি করছেন। মম পৌঁছাতেই মাধুরী খালা কাছে এসে বললেন, মা, দেখো না খালুর কি হইয়া গেল। সকালে উঠল না। তারপর এক ঘন্টা পর উঠে খাইয়া আবার শুইয়া পড়ল। দুপুরে ডাক দিলাম। উইঠা ওয়াশরুম যাইতে গিয়া পইড়া গেল। দেখি শ্বাস নিতে পারে না। জোরে জোরে শ্বাস টানে বুকে হাত দিয়া। ঘামতেসিলো অনেক। তোমার খালুরে কইতেই সে ……। মাধুরী খালা কাঁদতে লাগলেন। মম আশ্বস্ত করে বলল, ভয় পেয়ো না। আমি এসে গেছি না? ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখছি। জাবেদ খালু কোথায়?
– ঐ যে।
তিনি পেছনে ইশারা করলেন। মম তাকিয়ে দেখল তিনি একজন ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে মনযোগ দিয়ে শুনছেন কি বলছে৷ ও গিয়ে বলল, ডক্টর কি বুঝলেন? ডাক্তার ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এখুনি বুকের এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষা, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম আর করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম করিয়ে নাও। শুনে যা মনে হচ্ছে হার্ট ব্লক হয়ে গেছে কোথাও। রিপোর্ট দেখে আমরা পরবর্তী ধাপে আগাবো।
– আচ্ছা।
মম চলে গেল রায়হান সাহেবের বুকের পরীক্ষা গুলো করাতে। জাবেদ খালুও ওর পেছন পেছন গেলেন। ডাক্তার ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ফোন বের করল এপ্রোন থেকে। কল করে বলল, রিয়ান, মমর বাবা অসুস্থ। রিয়ান ফাইল দেখছিল। ফাইল বন্ধ করে রেখে বলল, তুমি জানলে কি করে, নিক্বণাপু?
– কিছুক্ষণ আগে আমাদের হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। অবস্থা ভালো লাগছে না। পরীক্ষা দিয়েছি। রিপোর্ট আসলে বুঝতে পারব।
– এজন্যই আমার সামনে থেকে চলে গেল কিছু না বলে।
– কথা বলছিলি নাকি?
– হুম।
– ও একলা সামলাতে পারবে কি না বুঝতে পারছি না। তুই আসবি একবার?
– দেখি। তুমি আর বড়চাচা তো আছো।
– তা আছি।
– আমাকে রিপোর্ট দেখে বোলো কি অবস্থা। আর…
– কি?
– কিছু না। পরে বলব।
– আচ্ছা। আমি যাই। রাউন্ডে যেতে হবে।
নিক্বণ ফোন রেখে দিল৷ রিয়ান একবার ভেবেছিল মমর বিয়েতে আপত্তি থাকার কথা বলে দেবে। কিন্তু পরমুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল। আগে বিপদটা কাটুক তারপর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলা যাবে।
রিপোর্ট ভালো আসেনি রায়হান সাহেবের। হার্টের কয়েক জায়গায় ব্লক হয়ে গেছে বাজে ভাবে। রক্ত চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ছে। নিক্বণ সব রিপোর্ট দেখে বলল, যতদ্রুত সম্ভব বাইপাস সার্জারি করা লাগবে।
– এতে কত খরচ পড়বে?
নিক্বণ মমর মাথায় হাত রেখে বলল, কদিন পর যাদের সাথে আত্মীয়তা হতে যাচ্ছে তাদের সাথে টাকার হিসাব নাই বা করলাম। আমি সব কিছু ঠিক করছি তুমি শুধু দোয়া করো যাতে তোমার আব্বু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। এইটুকু বলে ও চলে গেল। নিক্বণ কি বলল কিছু বুঝতে পারল না কিন্তু এটা ঠিকই বুঝতে পারল নিজে যতই শক্ত দেখাক বাইরে ভেতরটা ভয়ে কিছুক্ষণ পর পর শিউরে উঠছে। মম সার্জারি জিনিসটা ভীষণ ভয় পায়। ছোটবেলায় এক সার্জারির মাঝেই ওর আম্মু ওদের দুইজনকে ছেড়ে যায়। তখন থেকে সার্জারি জিনিসটা ওর কাছে মৃত্যু সমতুল্য। যেন সার্জারি করলেই মরে যাবে যে কেউ। ও মাধুরী খালার দিকে তাকিয়ে বলল, আব্বু বাঁচবে তো?
– এসব কি বলো মা। নিশ্চয়ই বাঁচবো।
মম মাধুরী খালাকে জড়িয়ে ধরল। সত্যিই কি ফিরে আসবে রায়হান সাহেব অপারেশন থিয়েটার থেকে!?
অপারেশনের আগে রায়হান সাহেবকে দেখে কান্না পেল মমর। নাকে অক্সিজেন নল লাগানো। হাতে ক্যানেলা। রক্ত স্যালাইন চলছে। একদিনে মুখ শুকিয়ে চেনা যাচ্ছে না তাঁকে। ওর সামনে দিয়ে নিয়ে গেল অপারেশন থিয়েটারে। মম জামা খামচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। অপারেশন শুরু হওয়ার একটু পর রিয়ানের পুরো পরিবারকে হাসপাতালে দেখে অবাক হলো ও। দিদুনকে তুলি ভাবির কাছে রেখে এসেছে। তিনি আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু কেউ দেয়নি। রিতু, অনিমা, নীলিমা প্রাইভেটে। ফেরদৌসী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করো না। মায়ের স্পর্শ পেয়ে মম তাঁকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ পর পর ওর কাঁপুনি বুঝিয়ে দিল ও নিঃশব্দে কাঁদছে।
টানা কয়েক ঘন্টার অপারেশনের পর রাশেদ হাসান বের হলেন। মম দৌঁড়ে গিয়ে বলল, আব্বু কেমন আছে? তিনি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ভালো আছে। তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখতে হবে। হৃদযন্ত্র, রক্তচাপ, নিঃশ্বাস ও অন্যান্য ভাইটাল সাইনের উপর অনবরত নজর রাখা হবে। সেখানে দুই তিন দিন রাখা হবে। তারপর অবস্থা অনুযায়ী জেনারেল ওয়ার্ডে শিফট করে দেবো। মম ভালো মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। একটুপর রায়হান সাহেবকে দুইজন বয় মিলে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে নিয়ে যেতে লাগল। মম তাঁর বুকের দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ে হচ্ছে এই ভেবে যদি দেখে তাঁর বুক ওঠা নামা বন্ধ হয়ে গেছে! তাঁকে দেখে মম মুখ চেপে ধরল। তার এই অবস্থা দেখে ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। তাঁকে এমন দেখবে ভাবতেই পারছে না ও। শুক্রবার ডাক্তার দেখাবে ভেবেছিল আর তার আগেই কি হয়ে গেল! আদ্রিতা প্রিয়ান্তুকে কোলে নিয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওর কাছে এসে বলল, মম, তুই বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নে। নাহার চাচি ওর সাথে একমত হয়ে বললেন, আদ্রি ঠিকই বলছে। তুমি বাড়ি যাও মা। রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক। নিক্বণ আর ওর বাবা আছে। তারা দেখে রাখবে।
– না, আমি আব্বুর কাছে থাকবো।
– তোমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে না।
– না পারলে না পারি। বাইরে থেকে দেখবো। জ্ঞান ফিরলে আব্বু আমাকে খুঁজবে। আমি জানি।
মমকে দেখে কেউ কিছু বলল না। ও কেবিনের সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে। তাঁকে ছেড়ে ও কোথাও যাবে না। কখনো না। আর বিয়ে তো কোনোদিনও না।
রাত সাড়ে এগারটা বাজে। রিয়ানের পরিবারের সবাই বাড়িতে চলে গেছে। মমকে বার বার বলেও বাড়িতে পাঠানো যায়নি৷ এখন সে কেবিনের সামনে দেয়ালে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। কেউ সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেই জেগে উঠে। মাধুরী খালা আর জাবেদ খালুকেও জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে ও। রিয়ান যখন হসপিটালে পৌঁছালো তখন দেখল মম চোখ বন্ধ করে হাতের উপর মুখ রেখে ঘুমাচ্ছে। ক্লান্তির ছাপ ওর চোখে মুখে। ঘুমে পড়ে যাচ্ছিল; রিয়ান গিয়ে ওর মাথাটা ধরল। সাবধানে ওকে সোজা করে পাশে বসল। মাথাটা নিজের কাঁধে রাখল। ওর দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মুখে চোখের পানি শুকিয়ে আছে। আপনা থেকে হাত দিয়ে পানিটা মুছে দিতে গিয়েও হাত সরিয়ে ফেলল। মম জেগে উঠছে। চোখ খুলে পাশে রিয়ানকে দেখে বলল, আপনি এখানে?
– আপনার আব্বুকে দেখতে এসেছি। আমার পরিবার এখনো জানে না আপনি আমাকে রিজেক্ট করেছেন। তাই দায়িত্ব তো পালন করাই লাগবে।
– ও। আচ্ছা শুনুন। ডক্টর নিক্বণ আপনার বোন, তাই না?
– হ্যাঁ কেন?
– তার থেকে আমায় বিলটা নিয়ে দেবেন। যেখানে বিয়েটাই হচ্ছে না সেখানে সুবিধা ভোগ করার কোনো মানেই হয় না।
চলবে…
#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৩
#সাহেদা_আক্তার
– এসব ব্যাপারে পরে ডিসকাস করা যাবে। খাবেন তো? আদ্রিতার কাছে শুনলাম আপনি কিছুই খান নি। রাত তো অনেক হলো।
– ক’টা বাজে?
– প্রায় সাড়ে বারোটা।
– এতক্ষণে তো জ্ঞান ফেরার কথা। আব্বু…
মম কেবিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এক নজর বুকের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রায়হান সাহেবের শ্বাস প্রশ্বাস চলছে। রিয়ান উঠে এসে ওর কাছে দাঁড়িয়ে বলল, খুব ভালো বাসেন বাবাকে?
– হুম।
– আপনার বাবা যদি দেখে আপনি না খেয়ে আছেন তাহলে খুশি হবেন?
মম ইতস্তত করতে লাগল। রায়হান সাহেবকে ফেলে ওর এক পা কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। রিয়ান আস্বস্ত করে বলল, নিক্বণাপু আছে, চিন্তা করো না। সে স্পেশালভাবে বলে রেখেছে। জ্ঞান আসতে সময় নেবে। অ্যানেস্থেশিয়ার প্রভাব কাটতে সময় নেবে। জ্ঞান ফিরলেই আপনি জানতে পারবেন। এখন চলুন খাবেন। মম অনিচ্ছার সত্ত্বেও ওর সাথে হাসপাতালের ক্যান্টিনে গেল। চেয়ারে বসতে বসতে রিয়ান জিজ্ঞেস করল, কি খাবেন?
– আপনার যা খুশি অর্ডার দিতে পারেন।
রিয়ান নরমাল একটা খাবার সেট অর্ডার দিল। মম এক নজরে গ্লাসে রাখা টিস্যুর দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেছে। খাবারটা সামনে আসতেও ওর খেয়াল হলো না। রিয়ান ডাকতে চামুচ হাতে নিয়ে ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগল। দেখে বোঝাই যাচ্ছে খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। রিয়ান কয়েক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি নিজে খাবেন না আমি খাইয়ে দেবো? ওর কথায় মম একটু লজ্জাবোধ করল। খাচ্ছে না দেখে এমন কথা বলা লাগে? ও কি বাচ্চা নাকি? ভাবতে ভাবতে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। অর্ধেক খাওয়া শেষ হতেই মমর ফোনে কল আসল। রায়হান সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে। শুনে অর্ধেক খাবার ফেলে রেখে দৌঁড়ে চলে এল কেবিনের সামনে। ভেতরে তাঁকে হাত নাড়াতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শরীরে যেন জোর নেই। কথা বলতে পারছেন না। ঠোঁট নাড়াছেন। এখনো ঘোর কাটে নি। মমর ইচ্ছে হলো ভেতরে যেতে। কিন্তু ঢুকতে দেবে না। নিক্বণ ভেতরে তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। বাইরে এসে ওকে দেখে বলল, সব ঠিক আছে। তবে শরীর খারাপ লাগতে পারে অ্যানেস্থেশিয়ার জন্য। একজন নার্স থাকবে। তুমি চিন্তা করো না। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও। রিয়ানকে আসতে দেখে বলল, তুই ওকে বাড়িতে দিয়ে আয়। আর…
– আমি যাবো না। আমি আব্বুর কাছে থাকবো নার্সের বদলে।
– মম, অবুঝের মতো এমন বোলো না। ব্যাথার ইনজেকশন দিতে হবে, ওষুধ দিতে হবে, ক্লিন করতে হবে। অনেক কাজ যা তুমি পারবে না। নার্সকেই করতে হবে। খাওয়া হয়েছে?
– অর্ধেক খেয়ে চলে এসেছে।
– এটা তো ঠিক করোনি। খাওয়া দাওয়া করো ঠিকমতো। তুমিও যদি অসুস্থ হয়ে যাও তাহলে কে দেখে রাখবে?
মম চুপচাপ রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। এগিয়ে গিয়ে কেবিনের কাচে হাত রেখে বলল, সব আমার দোষ আব্বু। আমি কাছে থাকার সত্ত্বেও তোমাকে দেখে রাখতে পারিনি।
সকালে মানুষের আনাগোনায় ঘুম ভাঙল মমর। চোখ খুলে প্রথমে যা আবিষ্কার করল তাতে ভয়ে দশ হাত দূরে সরে গেল। ও রিয়ানের কোলে সারারাত ঘুমিয়েছে! কিভাবে হলো! যতদূর মনে পড়ে ও এমনিই শুয়েছিল চেয়ারগুলোয়। কখন ক্লান্তিতে চোখ লেগে গিয়েছিল মনে নেই৷ মম সাবধানে সরে গিয়ে কেবিনের সামনে দাঁড়াল। রায়হান সাহেবও ঘুমাচ্ছেন। পা হুট করে হালকা হয়ে যাওয়ায় রিয়ানের ঘুম ভেঙে গেল। মমর পেছন থেকে বলল, ঘুম কেমন হলো মিস মম? মম মনে মনে বলল, আর ঘুম! পিঠটা ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। কিভাবে যে বেহুঁশের মতো চেয়ারে পড়ে পড়ে ঘুমালাম কে জানে। বাইরে বলল, ভালো।
– হুম তা তো হবে। সারারাত আমার পায়ের উপর কয়েক কেজি ওজনের ভারি মাথাটা রাখলে ভালো তো হবেই। ফাঁকে দিয়ে আমার পা দুটো অবশ হয়ে গেছে। নড়তে পারছি না। বাই দ্যা ওয়ে নিনিটা কে?
– কেন বলুন তো।
– রাতে আমার হাতটাকে জড়িয়ে ধরে যেভাবে নিনি নিনি করছিলেন আর নাক মুখ ঘষছিলেন!
– আ…আ… আমি!? মজা করছেন?
– আপনার মনে হচ্ছে আমি মজা করছি? আমার পা দুটো তো নেই মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় আমি মজা করব?
– ঠিক হয়ে যাবে। আমি ওয়াশরুম থেকে আসি।
মম কোনমতে পালালো ওখান থেকে। এ ক’দিন নিনিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ঘুমাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নিনিটা এত ফ্লাফি আর তুলতুলে যে ঘুম চোখে না থাকলেও ঘুম চলে আসে। নিনির কথা হঠাৎ মনে হল, কালকে বাসায় অনেকক্ষণ একা ছিল বেচারি। কি করেছে কে জানে। ফ্রেশ হয়ে হাত মুখ ধুতে ধুতে নিজেকে আরেক দফা জ্ঞান দিল। রিয়ানকে এমন আচরণের জন্য সরি বলতে হবে। গিয়ে দেখল কেউ নেই। একজন নার্স এসে বলল, আপনি মিস মম?
– জ্বি।
– এই কাগজটি একজন ভদ্রলোক দিয়ে গেছেন।
মম কাগজটা খুলে দেখল রিয়ান দিয়ে গেছে। সে বাড়ি চলে গেছে ফ্রেশ হয়ে অফিস যাবে৷ আজকের জন্য ওকে ছুটি দিয়েছে। তবে নিচে একটা ওয়ার্নিং দিয়ে বলেছে, পা দুটো তো ভর্তা করে দিয়েছেন৷ পরের বার এর পরিবর্তে কি পুরষ্কার দিবেন তা ঠিক করে নিন।
মম কাগজটা ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিল। এমন বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে হেসে ফেলল। কেবিনের দিকে তাকিয়ে রায়হান সাহেবকে দেখে নিল একবার। তিনি ঘুমাচ্ছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিচে নাস্তা করতে চলে গেল। কালকে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া হয়নি। তাই প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। ক্যান্টিনে দুটো পরোটা, ডিমভাজি আর ডাল অর্ডার দিল৷ খেতে খেতে রিয়ানের কথা আবার মনে পড়ল। খাওয়ার মাঝেই হাসি চলে এল।
– কি দেখে এমন হাসছো?
নিক্বণ এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে ওর সামনে এসে বসল। মম খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে বলল, তেমন কিছু না। আব্বুর সারতে কতদিন সময় লাগবে? নিক্বণ আলতো করে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আপাতত তিনদিন পর জেনারেল ওয়ার্ডে নেওয়ার পর এক সপ্তাহের মধ্যে আশা করি বাসায় নিয়ে যেতে পারবে। মম মাথা নাড়ল। তারপর দুজনে চুপ করে রইল। নিক্বণ কফি খেতে খেতে বলল, অফিস কেমন চলছে?
– ভালোই।
– কোনো সমস্যা হলে ভাইকে বোলো। ও সমাধান করে দেবে।
মম আবার মাথা নাড়ল। কি করে যেন রিয়ানের পরিবারের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে। এতটা কাকতালীয় ঘটনা কি করে হচ্ছে তা মাথায় আসছে না ওর। বিলের প্রসঙ্গ ওঠানোর আগে নিক্বণের ফোন চলে এল। ও ধরে বলল, হ্যাঁ, আমি এখুনি আসছি। ফোন কেটে রেখে বলল, আচ্ছা তাহলে পরে কথা হচ্ছে। তুমি খেয়ে নাও। আমি আসি। নিক্বণ উঠে চলে গেল। মম কিছু বলার সুযোগ পেল না। ও ধীরে সুস্থে খেয়ে বিল দিতে গেলে জানতে পারল ওর বিল পে করা হয়ে গেছে। এটা যে নিক্বণের কাজ খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। এভাবে ঋণী করতে থাকলে শোধ করবে কিভাবে ভাবতে ভাবতে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এল৷
.
.
.
.
তিনদিন পর জেনারেল ওয়ার্ডে রায়হান সাহেবকে স্থানান্তর করল। এই দুই তিন দিন মমকে হাফ আওয়ার কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছে অফিস থেকে। যদিও ও এত সুযোগ সুবিধা নিতে চাইছিল না। কিন্তু কেউ ওর কোনো কথা শুনল না। রিয়ানের সাথে দেখা হয়নি এই ক’দিন। নিক্বণও ব্যস্ত থাকে বলে কথা হয় না। তাও নিয়মিত দেখে যায় রায়হান সাহেবকে। মমর অনুপস্থিতিতে মাধুরী খালা দেখাশোনা করতে লাগল।
আজকে কাজ শেষ করে মম সোজা হসপিটাল চলে গেল। সব মিলিয়ে তিন চার দিন পর কথা হবে রায়হান সাহেবের সাথে। মম কেবিনে ঢুকে দেখল তিনি অপর পাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন খোলা জানালার দিকে। মৃদু বাতাস আসছে। বেশ ভালো লাগছে বাতাসটা। মম আস্তে আস্তে তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল বিছানার পাশের ছোট টুলটায়। কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থেকে ডান হাতটা নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিল। ছোঁয়া পেতেই তিনি ফিরে তাকালেন মমর দিকে। তাঁর শুকনো চেহারা দেখে ওর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। রায়হান সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, কেমন আছিস মা?
– ভালো। আমাকে কেন বললে না তোমার শরীর খারাপ করছিল। এমন কেউ করে?
তিনি চুপ করে রইলেন। মম আবার বলল, তোমার কিছু হলে আমার কি হতো বলো তো!? এবার তিনি মুখ খুললেন। বললেন, এজন্যই তো তোর বিয়েটা দিতে চেয়েছিলাম৷ তোর মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তোর বিয়েতে মত নেই। তোকে বিয়ে দিয়ে কোনো ভালো পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারলে আমি মরেও শান্তি পেতাম। মম আস্তে করে বলল, তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না আব্বু। এখন তো আরো চাই না। আর তুমিও আমাকে ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি যাবে না। আম্মুটাও তাড়াতাড়ি চলে গেল। রায়হান সাহেব কাঁপা হাতে ওর হাত দুটো ধরে বলল, তোর কাছে আর কিছু চাইবো না৷ এই শেষবার তুই এই বিয়েতে রাজি হয়ে যা৷ যতটুকু জেনেছি ছেলে পরিবার দুটোই ভালো।
– জানি আব্বু।
– তাহলে রাজি হতে চাইছিস না কেন?
– আমার যে মন ওঠে গেছে ছেলে শব্দটার উপর। ভালো লাগে না। তাছাড়া তোমার শরীরও ভালো নেই।
– তুই বিয়ে করলে দেখবি আমি ভালো হয়ে গেছি।
– থামো না আব্বু। তোমার শরীর অনেক দুর্বল। মাত্র সব কিছু খুলে এখানে শিফট করেছে। একটু রেস্ট নাও। তুমি ভালো হলে পরেও বিয়ের আলোচনা করা যাবে।
– না। আগে তুই কথা দে তুই বিয়েটা করবি।
মেশিন হঠাৎ জোরে জোরে শব্দ করতে লাগল। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। প্রেশারও বাড়ছে। মম ভয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। কথা দিলাম। এখন একটু শান্ত হয়ে ঘুমাও। রায়হান সাহেব আস্তে করে শান্ত হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করতে মম মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, আব্বু, কেন দূরে পাঠিয়ে দিতে চাইছো তোমার থেকে!?
পরদিন সকালে বাসা থেকে তৈরি হয়ে এসে দেখল কেবিনের ভেতরে কারা যেন কথা বলছে। হাসির শব্দও ভেসে আসছে। মম দরজা খুলে দেখল রাকিব হাসান আর ফেরদৌসী এসেছেন। সাথে রাশেদ হাসানও আছেন। রায়হান সাহেবকে দেখতে এসেছেন। তিনি আজকে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। ওকে ডেকে বললেন, মা, দেখতো এই শাড়ি গয়নাগুলো পছন্দ হয় কি না। ওনারা নিয়ে এসেছেন।
– এগুলো কার? আমাকে দিচ্ছো কেন?
– তোর জন্য। তোর বিয়ের। কালকে আমি তাদের তোর রাজি হওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছি। তাই তারা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন।
মম একবার তাদের দিকে তাকালো। ও কি বলবে তার অপেক্ষায় সবাই উৎসুক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সবার মুখে হাসি। মম ফেরদৌসীকে ডেকে বললেন, আমি আপনার সাথে আলাদা করে কিছু কথা বলতে চাই। তিনি সবার দিকে একবার একবার করে তাকালেন৷ রায়হান সাহেবের মুখ আবার শুকনো হয়ে গেল এই ভেবে যে মম আবার না করে না দেয়। ফেরদৌসী রাজি হয়ে ওকে নিয়ে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলেন। মম কোনো প্রকার ভণিতা না করেই বলল, বিয়েতে আমার কিছু শর্ত আছে।
চলবে…