#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৬,১৭
#সাহেদা_আক্তার
১৬
একঘন্টা সাজানো শেষে ওকে সুন্দর করে বিছানায় বসালো। দরজায় খুলতে রিতু, অনিমা আর নীলিমা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আদ্রিতা বলল, কিরে, এভাবে ঢুকছিস কেন? রিতু গোমড়া মুখে বলল, ঢুকবো না? আমার ভাইয়ের বউয়ের সাজ আমাকেই দেখতে দিচ্ছে না। অনিমা নীলিমা দুইজনে ওর সাথে একমত হয়ে মমর সামনে এসে বসল। একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথে বলল, ফাটাফাটি৷ ওদের কথা শুনে মম মুখ নিচু করে বসে রইল লজ্জায়।
মমর শ্বাশুড়ি আর চাচি শ্বাশুড়িরা রুমে এসে বসলেন একটু পর। ওকে দেখে অনেক প্রসংসা করলেন। বিকাল হয়ে আসছে। বিয়ে শেষে খাওয়া দাওয়া করে রওনা দিতে হবে। তাই সবার অনুমতি নিয়ে কিছুক্ষণ পর বিয়ে পড়াতে কাজি রুমে প্রবেশ করল। কাজি ওর সামনে বসতেই অজান্তে কেঁপে উঠল মম। কাজি বিয়ে পড়াছেন আর মম হাত দিয়ে শাড়ি খাঁমচে ধরে আছে। বুক ফেটে কান্না আসছে। চোখের সামনে কেবল রায়হান সাহেবের ছবি ভাসছে। একমাস যেতে না যেতে আবার অন্যের কাছে চলে যেতে হচ্ছে। কিছুতেই ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। কাজি কয়েকবার কবুল বলতে বলল কিন্তু ওর কোনো কিছু যেন কানে যাচ্ছে না। বৃষ্টি পাশে থেকে হালকা একটা ধাক্কা দিল। তাতে ভাবনা থেকে ফিরে এসে দেখলো সবাই ওর কবুল বলার অপেক্ষায়। না বলা পর্যন্ত সবাই কেবল ওকে জোর করতে থাকবে। বহুকষ্টে তিনবার শব্দটা উচ্চারণ করতেই চারপাশের সবাই স্বজোরে আলহামদুলিল্লাহ পড়ল। সাথে সাথে চোখ পানিতে ভরে উঠল ওর। ভেতরটা চিৎকার করে বলছে আমি যেতে চাই না। কিন্তু যাওয়াটা যে অনিবার্য। আবার নতুন করে কারো মায়ায় বাঁধা পড়তে যাচ্ছে।
কাজি ওকে সই করার জন্য কাবিন এগিয়ে দিল। ও চোখের পানিতে কিছু দেখছে না। চোখ বন্ধ করতেই টুপ টুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি কাবিনে পড়ে ভিজে গেল খানিকটা। চোখ পরিষ্কার হতেই স্বাক্ষর করে দিল। রিয়ানের বোনেরা ওর কাছে বসে গল্প করতে লাগল কিন্তু পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট ওর মনকে ভারি করে তুলল।
কাজি সবাইকে নিয়ে চলে গেল বসার রুমে। সেখানে রিয়ান বসে আছে ওর ভাই আর চাচাদের নিয়ে। কবুল বলা শেষে সই করতে গিয়ে রিয়ান দেখল কাবিনটা ভেজা। কয়েক মুহুর্ত ভেজা অংশের দিকে তাকিয়ে সই করে নিল। বাইরের রুম থেকে আলহামদুলিল্লাহ শব্দটা কানে আসতেই মম কান্নায় ভেঙে পড়ল। পাশে বসে থাকা বর্ষাকে জড়িয়ে ধরল। দুই চোখের পানি নদীর স্রোতের মতো বেয়ে বেয়ে বর্ষার শাড়ি ভিজিয়ে দিল৷ বিয়ে যতবারই হোক না কেন কাছের মানুষ ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট এতটুকু কমে না। বৃষ্টি এসে ধমকের সুরে বলল, দিচ্ছিস তো কেঁদে কেঁটে সাজটা নষ্ট করে? কত কষ্ট করে সাজালাম। আয় তো আমার কাছে। বৃষ্টি জড়িয়ে ধরতেই আরেক দফা কান্না। এবার আর কেউ কিছু বলল না বরং বৃষ্টিও কাঁদতে শুরু করল। আদ্রিতা এসে বলল, ওকে বসার রুমে নিয়ে যেতে বলেছে। একটু পরই বেরিয়ে যাবো। বৃষ্টি শুনে সরে এসে মুখটা সুন্দর করে মুছে দিল। সাজটা ঠিক করে ওকে বসার রুমে নিয়ে গেল।
রিয়ানের পাশে বসিয়ে দিল ওকে। রিয়ান এক দুবার ওর দিকে তাকালেও মম তাকালো না। মুর্তির মতো সামনের টি-টেবিলটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বিয়ের কাজ শেষ। সবাই নিজেদের মধ্যে গল্প করছে আর খাওয়া দাওয়া করছে। মম রিয়ানের পাশে বসে পোলাও নাড়ছে হাত দিয়ে। খাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। রিয়ান কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মুরগী দিয়ে এক লোকমা পোলাও ওর মুখের সামনে তুলে ধরল। মম একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কি করছেন?
– দেখছো না খাইয়ে দিচ্ছি।
– সবাই দেখছে।
– দেখুক। খাইয়ে না দিলে মনে হয় মুখে একটা দানাও ঢুকবে না। তখন থেকে দেখছি তো তোমাকে।
আপনি থেকে কত সহজে রিয়ান তুমিতে চলে এল! মম ভাবতে ভাবতে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিয়ান ব্যাপারটা খেয়াল করে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আমাকে কি আজকে অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে যে এভাবে তাকিয়ে আছো? শুনে মম সাথে সাথে দুচোখ নামিয়ে ফেলল। রিয়ান আবার বলল, আরে আমি কি এভাবে খাবারটা ধরে রাখবো? হাত ব্যাথা করবে না? মম প্রতিউত্তরে বলল, আমি নিজে খাচ্ছি।
– তাহলে আমি যে এত কষ্ট করে তোমার জন্য খাবারটা তুলে মুখের সামনে ধরলাম তার কি হবে?
মম দেখল রিয়ান নাছোড়বান্দা। এদিকে সবাই তাকিয়ে আছে। ওর ভাই বোনেরা ফিসফিস করছে আর মিটিমিটি হাসছে। ও লজ্জায় দ্রুত রিয়ানের হাত থেকে খাবারটা খেয়ে নিল। সাথে সাথে ভাই বোনগুলো খুশিতে চিৎকার করে উঠল। মিনহাজ ক্যামেরা এগিয়ে দিয়ে বলল, দেখতো ভাই ছবিটা কেমন হয়েছে। ফ্রেম বন্দি করা তোদের একসাথে প্রথম স্মৃতি। মম তাকালো ছবিটার দেখে। স্মৃতি শব্দটা ওর মনে নাড়া দিল। কেমন অদ্ভুত লাগছে ওর। ভেতরে শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়ে যেন পদ্মের কলি ফুটছে। মরে কাঠ হয়ে যাওয়া গাছগুলো এতদিন পর কোনো এক অদ্ভুত কারণে সতেজ হয়ে উঠছে। শক্ত পাথর হয়ে যাওয়া ওর বাগানটায় নতুন প্রাণ ফিরছে। সত্যিই কি হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার নতুন সংজ্ঞা ওকে খুঁজে দিতে পারবে রিয়ান? মম রিয়ানের দিকে তাকাল। ওর টোল পড়া হাসি দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে খেতে লাগল।
খাওয়া দাওয়া শেষে এখন রওনা দেওয়ার পালা। সবাই উঠে দাঁড়ালেও মম ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো। উঠার শক্তি যেন পাচ্ছে না। মাধুরী খালা এগিয়ে এসে ওকে ওঠাতেই ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। যেতে চায় না আবার আগের মতো। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। রাকিব হাসান তাড়া দিয়ে বললেন, আকাশের অবস্থা ভালো নয় বেয়াই সাহেব। বৃষ্টি আসতে পারে মনে হচ্ছে। আগে আগে রওনা দিলে ভালো হতো। রায়হান সাহেবও একমত হয়ে মমর দিকে এগিয়ে এলেন। তিনি কাছে আসতেই মম তাঁকে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে বলল, নিজের মেয়েকে নিজের কাছে রাখলে না আব্বু। এত ভারী হয়ে গিয়েছিলাম!? এর প্রতিউত্তরে তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। কেবল কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল৷
গাড়িতে বহুবার রিয়ান মমর দিকে তাকিয়েছে কিন্তু মম উদাস মনে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঠান্ডা হাওয়াতে ওর কানের পাশে থাকা অল্প ক’গাছি চুল উড়ছে। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা ওর ভেতরে ঝড়ের সংকেত জানাচ্ছে যেন। একটা দীর্ঘশ্বাস আপনিই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। রিয়ান কিছু না বলে ওর ডান হাতটা ধরল৷ স্পর্শ পেয়ে মম হাতের দিকে তাকাল। রিয়ানের হাতটা পর্যবেক্ষণ করল কতক্ষণ। এই স্পর্শে ওকে অভ্যস্ত হতে হবে। স্পর্শটা কোনো খারাপ উদ্দেশ্যের নয় বরং যেন ওকে বলছে আমি আছি তোমার পাশে সারাজীবন। ভরসা পেয়ে আপনি থেকে মমর হাত রিয়ানের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হলো। তখন অনুভব হলো ওর হাত রিয়ানের হাতের তুলনায় নিতান্ত বাচ্চার হাত। ভেবে আপনমনে মুচকি হেসে ফেলল। হাসিটা রিয়ানের চোখ এড়ালো না। বলল, হাসছো যে? মম অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কিছু না। ও হাত সরিয়ে নিতে গিয়ে দেখল রিয়ান শক্ত করে হাত ধরে আছে; না ছাড়লে ছাড়ানোর উপায় নেই। দুজন দুই জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। নিঃশব্দে বাতাস আর মেঘের আনাগোনা দেখছে। হাতের স্পর্শে একে অপরকে অনুভব করছে। এভাবেই বাকি পথ পাড়ি দিল দুজনে কোনো এক অজানা ভালো লাগায়।
বাড়িতে আসতেই সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জার্নি করার পর শরীর এত ক্লান্ত লাগে! কিন্তু আজকে ক্লান্তির ক কেও আসতে দেওয়া যাবেন না। বাড়িতে নতুন সদস্য উপস্থিত। তার সাথে গল্প করতে হবে না? সন্ধ্যা হয়ে গেছে আসতে আসতে। ফুলি নাস্তা তৈরী করে ফেলেছে এর মাঝে। মমকে রিয়ানের পাশে সোফায় বসানো হলো। ভাই বোন সবগুলো ঘিরে ধরেছে ওদের মৌমাছির মতো। তার মাঝে কোনো এক ফাঁক গলে রওশন আরা ঢুকে বললেন, কই আমার নাতবৌ? সর তো। তোদের জন্য কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। রিতু বলল, আরে দিদুন এখন আমরা ভাবির সাথে গল্প করব। তুমি বুড়ি মানুষ কি করবে। তিনি রিতুর কান মলে দিয়ে বলল, আমার জন্য একটা নাত জামাই কি করে তাড়াতাড়ি আনা যায় সেই ব্যবস্থা করব।
– দেখেছো ভাবি, তুমি আসতে না আসতেই আমাকে বের করে দেওয়ার চিন্তা। ননদ হিসেবে তোমাকে একটু জ্বালানো লাগবে না? বলো? ভাইয়া শোননা, আমি ভাবছি আজকে ভাবি আমার সাথে থাকবে। সারারাত অনেক গল্প হবে। কালকে তোর কাছে দিয়ে আসবো।
ওর কথায় রিয়ান হুট করে বলে ফেলল, কেন! ওর বলার ধরণ দেখে হাসির রোল পড়ে গেল ভাই বোনদের মাঝে। নীলি বলল, ওমা! সারাজীবন তো তোমার কাছে থাকবে আজ না হয় আমাদের কাছে থাকবে। রওশন আরাও ওদের সাথে যোগ দিয়ে বললেন, দাদু ভাই, আমিও তাই ভাবছি। আজকে আমার নাতবৌ আমাকে পান বানিয়ে দিবে আর সারারাত গল্প করবে এই বুড়ির সাথে। রিয়ান খানিকটা বিরক্তি সুরে বলল, তুমিও এই ফাজিল গুলোর সাথে হাত মেলালে? অনি বলল, ভাইয়া, আজকে নতুন ভাবির কাছে গল্প শুনবো। আদ্রিতাও একমত হয়ে বলল, আমিও। ওর সাথে কোনোবারই ঠিকমতো গল্প করতে পারলাম না। আজকে মন ভরে গল্প করব। থাকুক না আমাদের সাথে। রিয়ান কিছু না বলে মমর দিকে তাকাল। মম মুখ নিচু করে নতুন বউয়ের মতো বসে আছে। ওর চোখের পাতায় ভোরের শিশিরের মতো চোখের পানি জ্বলজ্বল করছে। রিয়ানের ভালোভাবেই তা চোখে পড়ল। তবে তার থেকে বেশি চোখে পড়ছে ওর মুখটা। রিয়ান পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইল মমর দিকে। ভাইবোনরা ওকে দেখে মিটি মিটি হাসতে লাগল। মিনহাজ চটপট ক’টা ছবি তুলে নিল ওদের মুহুর্তের। মমর খোঁচায় রিয়ানের হুশ ফিরল। ও আস্তে করে বলল, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? রিয়ান প্রতিউত্তরে বলল, তোমাকে সুন্দর লাগছে তাই। মম শুনে মুখ আরো নিচু করে ফেলল। মনে মনে বলল, আমাকে লজ্জা দেওয়া ছাড়া লোকটার মনে হয় আর কাজ খুঁজে পাচ্ছে না আজ।
নাস্তা আসতেই খাওয়া দাওয়া শুরু। সবাই খোশগল্প করছে। খুব অল্প সময়ে মম ওদের সাথে স্বাভাবিক হয়ে গেল। খুব তাড়াতাড়ি তারা যে কাউকে আপন করে নিতে পারে। এভাবে গল্প প্রায় এগারটা পর্যন্ত চলল। তারপর খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে যাওয়ার পালা। ওকে রিয়ানের রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ভাই বোন গুলো ফাজলামি শুরু করল। নিক্বণ মমর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, যদি ভাই কোনো দুষ্টুমি করে আমাকে ডাকবে। এসে কান মলে দেবো। কথাটার গভীরতা বুঝতে পেরে মম লাল হয়ে গেল। আদ্রিতা বলল, হয়েছে হয়েছে এবার একটু ক্ষান্ত দে। ওকে দেখ। ভারি শাড়ি গয়নায় নুইয়ে পড়ছে লতার মতো। ওদের ফ্রেশ হতে দে। সবাই ওর কথায় একমত হলো। গল্প করতে করতে ব্যাপারটা খেয়ালই হয়নি। ওদের থেকে বিদায় নিয়ে সবাই আবার নিচে গিয়ে আবার গল্প জুড়ে দিল।
মম ঢুকতে রিয়ান দরজা মেরে দিল। দরজা মারার শব্দে কেমন এক অদ্ভুত ভয় ওকে জেঁকে ধরল। ও যেখানে ছিল সেখানে পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। রিয়ান ওর দিকে এগিয়ে আসছে। তার পায়ের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। রিয়ান ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। মম মুখ নিচু করে ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রিয়ান ওর আঁচলের কোণা নিয়ে একগোছা চাবি বেঁধে দিয়ে বলল, আজকে থেকে এটা তোমারও রুম। তোমার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে থাকবে। মম ফ্যালফ্যাল করে রিয়ানের দিকে তাকালো। রিয়ান হেসে বলল, কি দেখছো? তোমার বরকে সুন্দর লাগছে কি না? তোমার বর শব্দটা শুনে ভেতরটা অদ্ভুতভাবে মোচড় দিল। রিয়ান একটা চাবি দেখিয়ে দিয়ে বলল, এটা হচ্ছে আলমারির চাবি। ওখানে তোমার জন্য শাড়ি কিনে রেখেছি আমি। ফ্রেশ হয়ে এসো। তুমি বের হলেই আমি যাবো। মম মাথা নেড়ে আলমারির দরজা খুলে দেখল শাড়িতে ভর্তি আলমারি। এত শাড়ি দিয়ে ও কি করবে? একটা কলাপাতা রঙের সুতির শাড়ি বেছে নিয়ে আলমারি বন্ধ করতে রিয়ান বলল, জানো এই সুতির শাড়িটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। ভাবছিলাম তোমাকে কেমন দেখাবে। আজকেই সেই সৌভাগ্য হয়ে যাবে আমার ভাবিনি। মম এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুম পালালো। রিয়ানের হাসিটা ওর ভেতরটাকে ওলোট পালোট করে দেয় সব সময়।
চলবে…
#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৭
#সাহেদা_আক্তার
মম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল রিয়ান সোফায় বসে আরাম করে ল্যাপটপে কাজ করছে। ও এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা মুছতে লাগল। ভারি গয়না শাড়ি শরীর থেকে নামতে যেন সারা শরীর পালকের মতো হালকা হয়ে গেল। মম মাথার উপর টাওয়াল রেখে মাথা মুছতে গিয়ে দেখল রিয়ান ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ও পেছন ফিরতেই রিয়ান বলল, তোমাকে মানিয়েছে শাড়িটায়। মাথা এভাবে ঘষতে হবে না। বাইরে বারান্দায় চলো। সুন্দর একটা ঠান্ডা বাতাস। এমনিই চুল শুকিয়ে যাবে। রিয়ান ওর হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে এল। আসলেই বাইরে অনেক বাতাস। আকাশ যে ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে তা বেশ ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে আকাশের শেষ সীমানায়। মম ঐ দিকে তাকিয়ে রইল। রিয়ান ওকে খেয়াল করে বলল, আচ্ছা তুমি কি বিদ্যুত চমকানোতে ভয় পাও?
– কেন বলুন তো।
– প্রথম দিন যেদিন তোমার সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন তুমি ভয়ে কুঁকড়ে ছিলে।
– প্রথমদিন? কই নাতো। আপনিই তো আমাকে খেতে ডাকলেন। ভয়ে ছিলাম কখন?
– তোমার মনে নেই?
– না তো। আপনি কবেকার কথা বলছেন?
রিয়ান দুলটা পকেট থেকে বের করল। মম অবাক হয়ে বলল, এই দুলটা আমি খুঁজেছিলাম। পাই নি। আপনার কাছে কি করে গেল? ও মজা করে বলল, তোমাকে বিয়ে করব বলে হয়তো দুলটা আমার কাছে চলে এসেছে। রিয়ান মজা করছে দেখে মম বলল, আমি ভেতরে যাচ্ছি। আমার এস্ট্রোফোবিয়া আছে। তাই এই বিদ্যুত চমকানোর মধ্যে দাঁড়িয়ে ভয়ে মরার ইচ্ছে নেই। মম চলে যেতে লাগলে পেছন থেকে রিয়ান ওর হাত ধরে এক টান মারল৷ সাথে সাথে মম ওর বুকের উপর এসে পড়ল। রিয়ান বলল, ভয় পেলে এই বুকটা আছে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। সাথে সাথে মেঘ গর্জে উঠতে মম ওর পাঞ্জাবি খাঁমচে ধরল। পরমুহুর্তে ভেতরে একটা শান্তি লাগল৷ আসলে এতদিন পর একটা আশ্রয় পাওয়া গেল যা সকল ঝড় ঝাপটা থেকে ওকে দূরে রাখবে।
ওর শান্তিটা বেশিক্ষণ থাকল না। রিয়ান বলল, তোমার চুলগুলো উড়ে এসে চোখে মুখে ঢুকছে যে মম। মম মাথা তুলে বোকার মতো ওর দিকে তাকাল। তারপর বলল, তাহলে এক কাজ করি। মাথা ন্যাড়া করে ফেলি। রিয়ান সাথে সাথে বলল, এই না না। সব বাতাসের দোষ। আমার লম্বা চুল ভাল্লাগে। তুমি আমার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকো। আর কিছু বলব না। রিয়ান ওর মাথাটা হাত দিয়ে বুকের উপর রাখল। মম মুচকি হেসে মিথ্যা অভিমান করে বলল, আমি ঘুমাবো। রাত হচ্ছে। কালকে অফিস যেতে হবে।
– আমি ছুটি দিয়ে দিলাম। যাওয়া লাগবে না। চুপচাপ এভাবে থাকো। এখানে আরাম লাগছে। প্রাকৃতিক বাতাসের থেকে আরাম আর কিছুতে পাবে?
– ধুর বাবা আমি গেলাম।
মম রিয়ানের বাঁধন ছেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রিয়ান পেছন থেকে বলল, বাবা না জামাই। তবে বাবুর বাবা বলতে পারো। মাইন্ড করবো না। মম ওর কথা শুনে দ্রুত বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল৷ মনে মনে ভাবল, কি একটা অবস্থা। বিয়ে হতে না হতে যেন ওর অন্যরূপ দেখছে। হঠাৎ মনে হলো, এতক্ষণ এত বজ্রপাত হলো অথচ ও ভয় পেল না। এমনকি খেয়ালই করল না। এত মোহে যে বাঁধছে ছেড়ে যাবে না তো!
ঘুমে চোখটা লেগে গিয়েছিল। রিয়ানের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। পেছন ফিরে বলল, কি? রিয়ান ওকে উঠিয়ে ওর কোলে শুয়ে বলল, মাথা টিপে দাও। একটু কাজ করেছি ল্যাপটপে আর মাথা ধরেছে। দিদুন তোমাকে আমার মাথা টেপানোর জন্য আনিয়েছে। আর তুমি ঘুমাচ্ছো।
– মানে কি?
– মানে এখন তুমি আমার মাথা টিপে দেবে। আমি না তোমাকে বুকে মাথা রাখতে দিয়েছিলাম?
– আমি বলেছিলাম নাকি!?
– না বললে নাই। এখন তুমি মাথা টিপ দিবা না হলে…
– না হলে কি?
রিয়ান এমন ভাব করল যেন ওর মতিগতি ভালো না। মম জানে রিয়ান ফাজলামি করছে ওর সাথে কিন্তু ও চাইলেও এখন মাথাটা সরাতে পারবে না কোল থেকে। বাধ্য হয়ে মাথা টিপা শুরু করল। রিয়ান চোখ বন্ধ করে বলল, আসলে দিদুন ঠিকই বলেছে মাথা টেপানোর জন্য হলেও বিয়েটা করা দরকার। কথাটা শুনে মম জোরে একটা টিপ মারল সাথে সাথে রিয়ান ব্যাথা পেয়ে বলল, আউ, এভাবে কেউ মাথা টিপে? টিপে তো মাথার হাড় ভেঙে দেবে।
– ভাঙুক। ভাঙলে শিক্ষা হবে।
– উহু মরে যাবো। তখন…
মম ওর মুখ চেপে ধরে বলল, হয়েছে আর বাকিটা না বললেও চলবে। মম চুপচাপ ওর মাথা টিপতে লাগল। রিয়ানের কথা শুনে অন্য একজনের কথা মনে পড়ে গেল। সেও এভাবে বলেছিল মরে যাওয়ার কথা তাই আজ সে মম থেকে বহুদূরে।
আদ্রিতা গল্প শেষে রুমে আসলো। আলিফ তখনো জেগে প্রিয়ান্তুকে ঘুম পাড়াচ্ছে। মেয়েটা দেশে এসে যা দুষ্ট হয়েছে! সহজে ঘুমাতে চায় না এখন। এখনো হাত পা নেড়ে জানান দিচ্ছে যে সে জেগে আছে। আদ্রিতা হেসে পোশাক বদলে এল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তোমার কি হয়েছে বলতো? আজকে সারাদিনে তোমার কোনো দেখাই পেলাম না। এমন না যে খুব মানুষের ভীড় ছিল। আমরা আমরাই ছিলাম। তাও তোমাকে চোখে দেখতে পাইনি। আলিফ প্রিয়ান্তুর বুকে হাত দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, বিয়ে মানে তো কাজ। আমিই তো বাড়িতে ছেলে মানুষ ছিলাম৷ আদ্রিতা মিথ্যা অভিমান করে ওর দিকে ফিরে বসে বলল, কাজ না কচু? কি এমন কাজ? কত করে বললাম চলো চলো। গেলে না যে গেলেই না। আলিফ চুপ করে রইল। আদ্রিতা মাথা বেঁধে ওর কাছে এসে বলল, কি হয়েছে বলো না। তোমাকে কেমন যেন অন্য রকম লাগছে আমার। কেমন যেন বদলে গেছো। আজকে নিচে খেতেও নামলে না। রুমে খেলে। আমরা কত গল্প করলাম। তুমি গেলেও না।
– কাজ করেছি তো তাই শরীরটা ভালো লাগছিল না। আদ্রি…
– হুম?
– চলো আমরা ফিরে যাই।
– হঠাৎ? এই তো সবেমাত্র ভাইয়ের বিয়েটা হলো। এর মধ্যে কি করে যাওয়া যায়?
– আব্বুকে দেখতে যাবো কাল। সেখান থেকে সোজা চলে যাবো। আমারও তো ছুটি শেষ হয়ে এসেছে।
– আর ক’টা দিন থাকি না।
– তাহলে তুমি থাকো। আমি না হয় চলে যাই।
আদ্রিতা মুখ গোমড়া করে বলল, তুমি গেলে আমিও চলে যাবো। আচ্ছা, কালকে সকাল সকাল ব্যাগ গুছিয়ে রাখব। যখন বলবে রওনা দিবো। আলিফ ওর দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিল। আসলেই ও প্রিয়ান্তু আর আদ্রিতাকে নিয়ে সুখে আছে। ওদের হারাতে চায় না। মমর নতুন জীবনেও বাঁধা হতে চায় না। অনেক তো কষ্ট দিয়েছে মেয়েটাকে। এখন একটু সুখের মুখ দেখুক।
.
.
.
.
অভ্যাস করে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকেই ঘুম ভেঙে গেল মমর। সারারাত বসে ঘুমিয়েছে ও। কোলের কাছে ভারি লাগতেই তাকাল। এখনো রিয়ানের মাথা ওর কোলে। রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোখ খোলা। সাথে সাথে একটা ছোট চিৎকার দিয়ে ওকে ঠেলে সরাতে গিয়ে ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠল। রিয়ান আকস্মিক এমন হওয়ায় বলে উঠল, এভাবে কেউ কোল থেকে মাথা নামায়?
– নামাবো না? আপনি কোথায় তাকিয়ে ছিলেন?
– কোথায় তাকাবো। চোখ খুললে যা দেখা যাবে সেদিকেই তো তাকিয়ে থাকবো।
মম দুই হাত দিয়ে ওর পেট ঢেকে মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। রিয়ান উঠে আড়মোড়া ভেঙে বলল, বাবারে, মনে হয় যেন অন্য কোনো মেয়ের পেট দেখে ফেলেছি। বউই তো।
– হ্যাঁ, বউ বলেই আরাম করে সারারাত আমার পায়ে ঘুমিয়ে বারোটা বাজিয়েছেন।
– কাটাকাটি হয়ে গেছে। হাসপাতালে আমার পায়ের উপর তুমি ঘুমিয়েছিলে আর এখন আমি। হিসাব কমপ্লিট।
মমর কান্না চলে আসছে। পা এমন অবশ হয়েছে যেন সেন্স পাচ্ছে না। মনে মনে বলল, আমার মাথা আর আপনার মাথা সমান নাকি! কি ভারি বাবা! কয় কেজি কে জানে। কিভাবে এই ভারি মাথা নিয়ে ঘোরে!? মমর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বলল, আমি আগে যাবো না তুমি আগে? মম কিছু বলছে না দেখে বলল, ওকে, আমিই যাচ্ছি। রিয়ান ওয়াশরুমে চলে গেল। মম সাবধানে পা নামাতে গিয়ে দেখল আসলেই কোনো সেন্স পাচ্ছে না। দু মিনিট পর পুরো দুই পায়ে এমন ঝি ঝি ধরল যে ও নিচের ঠোঁট কামড়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে রইল। ফ্লোরে পা রাখতেই মনে হল অসংখ্য কাঁটা ফুটছে পায়ে। মনে মনে বলল, আসুক আর কোলে মাথা রাখতে। মাথা দিয়ে আমি ফুটবল খেলবো।
দশ মিনিট পর রিয়ান ফ্রেশ হয়ে দেখল মম আলমারি খুলে তাকিয়ে আছে। ও পেছন থেকে এসে উপরের তাক থেকে একটা শাড়ি নামিয়ে দিল। ও এত কাছে ছিল যে সদ্য গোসল করে আসা শরীরের ঘ্রাণ ওর নাকে লাগছিল। রিয়ান শাড়িটা ওর হাতে দিয়ে বলল, এটা পরো৷ আজকে তো বাড়ি যাবে। আসবে কবে? মম শাড়িটা নিয়ে আলামরি মারতে মারতে বলল, যদি না আসি? পেছন ফিরতে রিয়ান আলমারিতে বাম হাত রেখে ওর দিকে ঝুঁকে গেল। এই প্রথম মম রিয়ানকে খুব কাছ থেকে দেখছে। ও বলল, না আসলে তুলে নিয়ে আসবো। মম রিয়ানের কপালে সজোরে একটা টোকা দিয়ে বলল, তোমার স্বপ্নে। টোকা পেয়ে রিয়ান সরে গেল খানিকটা৷ সেই সুবাদে মম ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। রিয়ান পেছন থেকে বলল, তুমিতে এসেছো তাহলে। মম কিছু না বলে সোজা ওয়াশরুম ঢুকে গেল। ঢোকার সময় ফিসফিস করে বলল, বাচ্চা একটা বিয়ে করেছ।
মম ফ্রেশ হয়ে বের হলো। রুমে রিয়ানকে দেখা গেল না। ও মাথাটা মুছে সুন্দর পরিপাটি হয়ে নিচে চলে এল। বিয়ের পরদিন শ্বশুরবাড়ির সবাই চায় নতুন বউয়ের হাতের রান্না খেতে। কিন্তু সকালের নাস্তা করেই তো ও বেরিয়ে যাবে। তারপর রায়হান সাহেব সুস্থ হলে তারপর আসবে। এমনই তো কথা ছিল। ও রান্নাঘরে ঢুকে দেখতে লাগল কোথায় কি আছে। ফুলি হামি তুলতে তুলতে এসে বলল, কি খুঁজো গো নতুন ভাবি?
– নাস্তা বানাবো ভাবছিলাম। কি বানানো যায় বলো তো।
– দাদীআম্মা তো সকালে রুটি খায় আলুভাজি দিয়া।
– আচ্ছা, আর বাকিরা?
– খালাম্মা যা বানায় তাই খায়। এক একদিন এক এক জিনিস বানায়।
– আচ্ছা।
মম ভাবতে বসল কি বানাবে। আগে রুটিটাই বানাবে চিন্তা করল। বাকিটা পরে দেখা যাবে। আলুর খোসা ছাড়িয়ে কুঁচি কুঁচি করে কেটে ভাজতে দিয়ে রুটি বানাতে বসল। ফুলি আলুটা দেখছে আর ও রুটি বানাচ্ছে। এমন সময় ফেরদৌসী রান্নাঘরে ঢুকলেন। ওকে দেখে বললেন, ওমা! উঠে গেছো! মম ভদ্রভাবে উত্তর দিল, জ্বি।
– ভালো করেছো। আম্মার খাবার তো তৈরী করেও ফেলেছো দেখছি। এক কাজ করো তুমি রুটি আর ভাজি নিয়ে আম্মাকে দিয়ে দিও।
– বাকি নাস্তা?
– আমরা আছি তো।
কথা বলতে বলতে নাহার আর কনক চাচিও চলে এলেন। তুলি ভাবিও একটু পরে নেমে এল। সবাই মিলে হাতে হাতে নাস্তা তৈরী হয়ে গেল। আটটা বাজতেই সবাই নাস্তার টেবিলে হাজির। মম সবাইকে খাবার বেড়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসলে ফেরদৌসী বাঁধা দিয়ে বললেন, তুমি বসে খেয়ে নাও। রিয়ানের সাথে বের হবে তো?
– তা হবো। কিন্তু …
– বেড়ে দেওয়ার অনেক সময় পাবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও আজ।
মম চুপচাপ বসে পড়ল। চাইলেও কেউ কাজ করতে দিচ্ছে না। এই প্রথম আলিফের সাথে নাস্তার টেবিলে দেখা। একবার চোখাচোখি হতেই কেউ কারো দিকে আর তাকালো না। কালকে আসার পর থেকে একবারও মুখ দেখায়নি আলিফ৷ আজকেও খাবার খেতে না আসলে বাজে দেখাবে বিধায় নিচে নাস্তা করতে আসা। সে চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। সবাই নিজের মতো গল্প করে খাওয়া শেষ করল।
মম রুমে এসে চটপট তৈরি হয়ে নিল। কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে বলল, চলুন। রিয়ান একটু অবাকের সুরে বলল, শাড়ি নেবে না? মম আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বলল, শাড়ি নিয়ে কি করব? আর ওখানে তো আমার জামা আছে। রিয়ান খানিকটা রাগের সুরে বলল, কি করবে মানে? যাচ্ছো তো আমাকে ফেলে কত দিনের জন্য। আমি মাঝে মধ্যে গেলে শাড়ি পরবে না?
– আপনি গেলে শাড়ি পরতে হবে কেন?
– কারণ তোমাকে শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগে।
চলবে…