মরিচাধরা মনের খাঁচা,পর্বঃ ০৩,০৪
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৩
জানলার পর্দা ভেদ করে সূর্যের আলো অয়নের চোখে লাগতেই ঘুম ভেঙে গেলো তার। চোখ বন্ধ করেই আশপাশ হাতড়ে ফোন খোঁজে হাতে দিলো। স্কিনে তাকিয়ে সময়টা দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আটটা বাজতে খুব একটা সময় বাকি নেই। সারারাত বৃষ্টি হওয়ার পর সকালে স্বচ্ছ আকাশে সূর্যের অস্তিত্ব আজ তীব্র। গতরাতে অনেক দেরি করে ঘুমানোর জন্য উঠতেও দেরি হয়ে গেলো। তবে প্রতিদিন নিঝুম এসে ফজরের সময় ডেকে দেয় আর অয়নও উঠে নামাজটা পড়ে নেয়। মনে হয় এই তো সেদিনই নিঝুম এবাড়িতে এলো।
৬.
নিঝুম বাসর রাতে দু’রাকাআত নফল নামাজ পড়তে বললে অয়ন বলে, যে বিয়েই মানি না তার জন্য আবার নফল নামাজ আদায় করবো ?
নিঝুম কিছু একটা ভেবে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যেদিন আমাকে মেনে নিবেন, সেদিন আবার বিয়ে করে নফল নামাজ আদায় করে নতুন জীবন শুরু করবো।
অয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, সেদিন কখনোই আসবে না।
নিঝুম হাসি মুখে বললো, আসবে আসবে, এমন একদিন অবশ্যই আসবে ইনশাআল্লাহ। সেদিন আমার থেকেও আপনি বেশি ভালোবাসবেন আমাকে।
সেটা তোমার স্বপ্নে।
স্বপ্ন ঠিক আছে, তবে একদিন বাস্তবেও হবে। আচ্ছা বাদ দিন সেসব কথা। এখন ছেড়ে দিচ্ছি তবে ফজরে কিন্তু উঠিয়ে ছাড়বো।
আমি সাতটার আগে ঘুম থেকে উঠি না।
সেটা সকালেই দেখা যাবে। কিন্তু এখন বলুন আমি ঘুমাবো কোথায় ? আপনার বেডে ঘুমাতে দিবেন না সেটা ভালো করেই বুঝে গেছি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে তাড়াতাড়ি বলুন কোথায় ঘুমাবো।
তুমি কোথায় ঘুমাবে তার আমি কী জানি ?
বলুন, নাহলে কিন্তু বেডে শুয়ে পড়বো।
একদম বেডে আসবে না, তুমি ঐ সোফায় ঘুমিয়ে পড়ো।
অয়নের বলতে দেরি হলেও নিঝুমের শুয়ে পড়তে দেরি হলো না। কিছু চেঞ্জ না করেই শুয়ে পড়তে দেখে অয়ন নাক কুঁচকে ফেললো। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো, কখন ঘুমিয়ে গেছে টেরই পায়নি। সকালে কেউ মুখে পানি ছুঁড়ে মারলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। কী হলো বুঝতে অনেকটা সময় লাগলো অয়নের। দু’হাতে মুখের পানি মুছে সামনে তাকিয়ে দেখলো একহাতে মগ নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, মিটিমিটি হাসছে নিঝুম। রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো অয়নের। বুঝতে বাকি রইলো না কাজটা কার। উঠে গিয়ে নিঝুমের হাত পেছনে মুচড়ে ধরলো।
দাঁতে দাঁত চেপে বললো, এটা কী ধরনের অসভ্যতামি ?
নিঝুম ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে বললো, সেই কখন থেকে ডাকছি আপনি শুনছিলেন না, তাই এভাবে জাগাতে হলো।
তোমাকে কেউ বলেছিলো আমাকে জাগাতে ?
যাহ্ বাবা, না জাগালে নামাজটা পড়তেন কীভাবে ? এখন জান নামাজটা পড়ে নিন। দেখুন আমি শাওয়ার নিয়ে নামাজও পড়ে ফেলেছি।
অয়ন এবার খেয়াল করলো রাতের সাজে নেই নিঝুম। শাওয়ার নিয়ে একটা সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছে। দেখতে অনেকটা স্নিগ্ধ লাগছে।
অয়ন শয়তানি হাসি দিয়ে বললো, তুমি শাওয়ার নিয়েছো ?
নিঝুম নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, সেই কখন নিয়েছি। আপনার মতো নাকি, পড়ে পড়ে ঘুমাবো।
অয়ন কিছু না বলে নিঝুমকে কোলে তুলে নিলো হুট করে। নিঝুম অয়নের হঠাৎ এমন কাজে ভয় পেয়ে অয়নের টিশার্ট আঁকড়ে ধরলো।
আরে আরে কোলে তুললেন কেনো ? আছাড় দিয়ে আমার কোমর ভাঙার প্ল্যান করেছেন নাকি ?
অয়ন কিছু না বলে শয়তানি হাসি দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে লাগলো।
ওয়াশরুমে কেনো যাচ্ছেন ? আরে বাবা আপনার দরকার আপনি একা যান না।
অয়ন চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে পানি ভড়া বাথটবে ছুঁড়ে ফেললো নিঝুমকে। অয়নের কাজে নিঝুম পুরো হতভম্ব হয়ে গেলো।
রেগে বললো, এটা কী করলেন আপনি ? একটু আগেই শাওয়ার নিয়েছি আমি।
অয়ন নিঝুমের দিকে একটু ঝুঁকে বললো, সকাল সকাল আমাকে ভেজানোর শাস্তি এটা।
নিঝুম খপ করে অয়নের টিশার্ট আঁকড়ে ধরলো আর বললো, বউয়ের সাথে গোসল করার শখ হয়েছে আগে বললেই হতো।
অয়ন কিছু বুঝে উঠার আগেই নিঝুম টান দিয়ে অয়নকেও ফেলে দিলো। অয়ন গিয়ে পড়লো সোজা নিঝুমের উপর আর ভিজে জবজবে হয়ে গেলো মুহূর্তে।
নিঝুম মুচকি হেসে বললো, এখন কেমন লাগছে মিস্টার অ্যাটিটিউট উপস সরি মিস্টার হাসবেন্ড ?
অয়ন বাথটাবের দুপাশে ধরে নিঝুমের উপর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তোমাকে আমি দেখে নিবো।
অয়ন রেগেমেগে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে গেলে নিঝুম উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। অয়ন বের হয়ে নিজের পোশাক নিয়ে অন্য রুমের ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বের হয়ে গেলো। নিঝুম উঠে আবার শাড়ি চেঞ্জ করে নিলো।
এরপর থেকে নিঝুম নানা টেকনিক ব্যবহার করে অয়নকে ঘুম থেকে তুলতো। প্রথমদিকে অয়ন প্রচন্ড বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে ভালো লাগতো। কিন্তু নিঝুমকে কখনো বুঝতে দিতো না, নিঝুমের আড়ালে মুচকি হাসতো তার কান্ডকারখানা দেখে। অয়নের অভ্যাস হয়ে গেছে ফজরের সময় উঠা, তবু ঘুমের ভান ধরে নিঝুমের ডাকের অপেক্ষা করতো এরপর থেকে।
৭.
আজ নিঝুমও ডাকেনি আর অয়নেরও ঘুম ভাঙেনি।নিঝুম কেনো তাকে ডাকেনি ভাবতেই গতকালের কথা মনে পড়ে গেলো। নিঝুমের পা কেটে গেছে সে হাঁটতে পারলে তো তাকে ডাকবে। অয়ন তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। নিঝুমের কী অবস্থা দেখতে হবে। অয়ন রেডি হয়ে নিচে নেমে দেখে খুশি ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। প্রতিদিন সেটা নিঝুম আর অহনা করে।
অয়ন একটা চেয়ার টেনে বসে বললো, মা কোথায় খুশি ?
খুশি গম্ভীর গলায় বললো, ভাবিরে ডাক্তার দেখতে আইছে, খালাম্মা ভাবির রুমে আছে।
অয়ন খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললো, সামান্য পা কাঁটার জন্য ডক্টর ডেকে আনতে হবে ?
ভাবির জ্বর হইছে, খালাম্মা সারারাত ভাবির কাছে ছিলো।
অয়ন অবাক হয়ে বললো, কীহ্ নিঝুমের জ্বর হয়েছে ?
খুশির উত্তরের অপেক্ষা না করেই অয়ন উঠে নিঝুমের রুমের দিকে পা বাড়ালো। নিঝুমের সহজে জ্বর হয় না কিন্তু যখন হয় দশ পনেরো দিনের আগে আর ঠিক হয় না। তখন নিঝুমের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়।
অয়ন নিঝুমের রুমে গিয়ে দেখে ডক্টর কিছু লিখছে আর বলছে, শরীরে এখনো অনেক জ্বর। শুধু মেডিসিনের দিকে না, খাবারের দিকেও কড়া নজর রাখতে হবে। খাবার ঠিক মতো খেলে খুব বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে না। আজে বাজে খাবার দিবেন না শুধু পুষ্টিকর খাবার দিবেন।
অহনা নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, আমি ওর খেয়াল রাখবো ডক্টর।
প্রেসক্রিপশন অহনার হাতে দিয়ে বললো, এখানে মেডিসিন লিখে দিয়েছি সময়মতো সব দিবেন। আর পায়ের ব্যাথাটা কমার জন্যও কিছু মেডিসিন দিয়েছি। তবে কাটা জায়গায় যেনো পানি না লাগে। আমি তাহলে এখন উঠি মিসেস রাজিব।
অহনা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, সরি ডক্টর আপনাকে এতো সকালে বিরক্ত করার জন্য।
না না সমস্যা নেই, এটা আমার ডিউটি।
অয়ন দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর তার পাশ কাটিয়ে বের হয়ে গেলো। অহনা পুনরায় নিঝুমের মাথার কাছে বসলো।
অয়ন এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বললো, মা এতো কিছু হলো আর তুমি আমাকে একবার ডাকলে না ?
অহনা শান্ত গলায় বললো, তোমাকে কেনো ডাকবো ?
অয়ন অবাক হয়ে বললো, আমাকে কেনো ডাকবে মানে ? ওর এমন একটা অবস্থায় তুমি একা একা সব করছো।
অহনা এবারও বেশ শান্ত গলায় বললো, নিঝুম তার জীবনের কোনো বিষয়ে তোমাকে জড়াতে চায় না আর।
অয়ন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকা নিঝুমের দিকে। এই কী সেই মেয়ে ? যে মেয়েটা সামান্য গা গরম হলেও অয়নকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়তো।
অহনা গম্ভীর গলায় বললো, খুশি ব্রেকফাস্ট দিয়েছে হয়তো। খেয়ে অফিসে চলে যাও, তোমার লেট হচ্ছে।
নিজের মায়ের ব্যবহারেও আজ অবাক অয়ন। অনেকটা ঘোরের মাঝেই বের হয়ে গেলো নিঝুমের রুম থেকে। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসতেই খুশি খাবার এগিয়ে দিলো। পরোটা , সবজি, ডিম ভাজা, ফলের জুস। সব খাবার যেনো তেলে ডুবে আছে। অয়ন অয়েলি খাবার পছন্দ করে না, আর ব্রেকফাস্টে তো একদমই না। খাবার দেখেই বুঝতে পারলো আজ সব খাবার খুশি বানিয়েছে। তাই আর না খেয়েই উঠে চলে গেলো কিছু না বলে। খুশি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। অয়ন গাড়িতে গিয়ে বসতেই পকেটে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো। বের করে স্কিনে নয়নার নাম্বার দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো।
৮.
যে মেয়ে জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্বামীর বাড়িতে সাথীর জায়গা হয়নি আজ সে মেয়েকেই কেড়ে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তারা। এর কারণ জানা নেই সাথীর আর সে জানতেও চায় না। ছয় মাসের ফুটফুটে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে চলেছে সাথী। মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখলো নিজের অসুস্থ মাকে।
ব্যস্ত গলায় বললো, তুই উঠে এলি কেনো রে মা ? তোর কিছু দরকার হইলে আমারে বলতি। আজ তোর শরীরটা বেশি খারাপ হইয়া গেছে।
সাথীর মা জমিলা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, মাইয়ার জীবনের এমন দুর্দশা দেইখা কোন মা ভালো থাকবো রে ?
সাথী একহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, আমি তো আমার মাইয়া নিয়া বাঁচতে শিখা গেছিলাম। ওরা এহন আবার আমার মাইয়াডারে কাইড়া নিতে চাইতাছে কেন, বল না রে মা ?
চলবে,,,,,
#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৪
কথায় আছে পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না।
দরজায় দাঁড়িয়ে কথাটা বলে উঠলো রিনি। সাথী রিনিকে দেখে এগিয়ে এলো।
রিনি তুমি এইহানে ?
তুমি কেমন আছো ভাবি আর আমার পরীটা কেমন আছে ?
সাথীর কাছ থেকে তিথিকে কোলে নিলো রিনি। সারা মুখে অসংখ্য চুমু খেলো।
কেমন আছে আমার মা টা ? ফুপিকে মনে পরে না তোমার একটুও ?
সাথী মলিন মুখে বললো, তুমি এইহানে আইছো তোমার ভাই জানলে তো, তোমারে মারতেও পিছপা হইবো না।
রিনি গম্ভীর গলায় বললো, আমি এখন আর কারো ধার ধারি না ভাবি। বাসায় তো থাকি না, থাকি ভার্সিটির হোস্টেলে।
সাথী প্রায় টলমলে চোখে তাকালো রিনির দিকে, তোমার ভাই তো মাইয়াডারে দেখতেই পারে না। এহন আবার নেওয়ার জন্যে উঠে পরে লাগছে কেন ?
রিনি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, ভাবি ঐ যে বললাম না পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না। তোমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কারণ তিথি ছিলোই না কখনো। তুমি প্রেগনেন্ট থাকতে ভাইয়া ঐ মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলো। ঐ মহিলা ডিভোর্সি, ভাইয়ার সাথেই কাজ করতো আর ভাইয়ার থেকে বয়সেও বড়। তিথির যখন জন্ম হয় তখন ঐ মহিলা দুই মাসের প্রেগনেন্ট। বিয়ের জন্য ভাইয়াকে চাপ দিতে থাকে। ভাইয়া কী করবে দিশা না পেয়ে তিথিকে কারণ বানিয়ে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে তাকে বিয়ে করে। একমাস আগে বাথরুমে পরে গিয়েছিলো আর পেটে প্রচন্ড আঘাত পায়। বাচ্চা তো মারা গেছেই আর কখনো মাও হতে পারবে না। ভাইয়া চাইলেও কখনো তাকে ডিভোর্স দিতে পারবে না তাই তিথিকে নিতে চাইছে এখন।
সাথী কঠিন গলায় বললো, আমার সংসার কাইড়া নিয়া শান্তি হয় নাই। এহন আমার মাইয়ার দিকে হাত বাড়াইছে। সংসার সহজে ছাইড়া দিছি তয় আমার মাইয়ারে আমার থেইকা কেউ কাইড়া নিতে পারবো না।
কথাটা বলে সাথি নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরলো। রিনি তাকিয়ে আছে সাথীর দিকে। সাথী রিনির থেকেও বয়সে ছোট। সাথীকে সে সবসময় শান্তশিষ্ট মেয়েই জানে। তবে আজ হয়তো একজন মায়ের মমতাই তার শক্তি হয়েছে।
জমিলা বেগম বললো, সাথী মাইয়াডারে কিছু খাইতে দে।
রিনি ব্যস্ত হয়ে বললো, না আন্টি তার প্রয়োজন নেই। আমি তিথিকেই দেখতে এসেছিলাম একটু। আর এটা বলতে এসেছিলাম ভাইয়া বোধহয় পুলিশের কাছে যাবে তিথিকে পাওয়ার জন্য। তাহলে আমি বরং আজ আসি। ভাবি নিজের খেয়াল রেখো আর তিথিকে সামলে রেখো।
রিনি তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে বের হয়ে গেলো। সাথী পাশে পাতানো বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। রানার সাথে সে টাকার জোরে পারবে না। তাহলে কীভাবে নিজের মেয়েকে ধরে রাখবে ?
৯.
নয়নার সাথে ব্রেকফাস্ট করে অফিসে এসেছে অয়ন। তার সাথে থেকে নিঝুমের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছে। কিন্তু দুপুরের লাঞ্চের সময় হতেই নিঝুমের কথা মনে পরে গেলো। বারবার মানা করা সত্বেও নিজে হাতে রান্না করে দুপুরের খাবার নিয়ে সবসময় হাজির হতো নিঝুম। কাজে ডুবে থাকা অয়নকে টেনে তুলে খাবার খেতে বসিয়ে দিতো। একদিন অয়ন খুব অপমান করেছিলো নিঝুমকে। হয়তো তখন বিয়ের তিন মাস হয়েছে। নিঝুমের কান্ডকারখানায় অয়ন পুরো অতিষ্ঠ। সেদিন বড় একটা লস হয়েছিলো কোম্পানির। কেবিনে কপালে হাত রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলো অয়ন। তখনই দুপুরের খাবার নিয়ে হাজির হয় নিঝুম।
নক ছাড়া কেবিনে ঢুকেই বলে, সরি সরি আজ একটু লেট হয়ে গেছে। আসলে আজ সব আপনার পছন্দের খাবার রান্না করেছি তাই একটু লেট হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন আর গরম গরম খেয়ে নিন।
অয়ন তখনো একই ভঙ্গিতে বসে আছে। নিঝুম টেবিলে খাবার সাজিয়ে অয়নের দিকে তাকালো।
একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে বললো, কী হলো এখনো বসে আছেন কেনো ? খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে গেলে কিন্তু ভালো লাগবে না খেতে। তখন তো বলবেন জঘন্য রান্না করি আমি।
অয়ন শান্ত গলায় বললো, আমি খাবো না। তুমি এসব নিয়ে চলে যাও।
নিঝুম এগিয়ে গিয়ে অয়নের হাত টান দিয়ে বললো, খাবো না মানে কী ? আমি কতো কষ্ট করে রান্না করলাম।
মুহূর্তে যেনো অয়নের রাগ আকাশ সমান হয়ে গেলো। এক ঝটকায় নিঝুমের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। নিঝুম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে অয়নের দিকে।
অয়ন রেগে বললো, What is your problem yaar ? কেনো পিছে পরে আছো আমার ? আমি তোমাকে বলেছি আমার জন্য রান্না করতে ? আমি তোমাকে বলেছি আমার জন্য খাবার নিয়ে এখানে আসতে ? তোমার জন্য আমি কোথাও একটু শান্তিতে থাকতে পারি না। বাসায় যতক্ষন থাকি মাথা খেয়ে ফেলো এটা ওটা বলে। অফিসে একটু শান্তিতে থাকবো তার উপায়ও রাখনি। এতবার মানা করার পরও বেহায়ার মতো চলে আসো খাবার নিয়ে। দয়া করে আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
লজ্জা আর অপমানে চোখে পানি চলে আসে নিঝুমের, এতোটা অপমানিত হয়তো এর আগে কখনো হয়নি সে।
তবু চোখের পানি মুছে বললো, আমার উপরের রাগ খাবারের উপর কেনো দেখাচ্ছেন ? খাবারটা খেয়ে নিন দয়া করে, নাহলে শরীর খারাপ করবে।
অয়ন দিগুণ রেগে খাবারের প্লেট তুলে আছাড় মারলো আর সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো মুহুর্তে। নিঝুম ভয়ে কেঁপে উঠে দু’কদম পিছিয়ে গেলো।
অয়ন নিজের মাথা চেপে ধরে বললো, সহজ কথা বুঝতে পারছো না তুমি ? এখনই চলে যাও আমার সামনে থেকে।
নিঝুম দু’হাতে মুখ ঢেকে একবার অয়নের দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। বাইরে আসতেই সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। নিঝুম কোনোদিকে না তাকিয়ে, সোজা বের হয়ে গেলো অফিস থেকে। নিঝুম চলে যেতেই আবার চেয়ারে বসে পড়লো অয়ন। চোখ গেলো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাবারের দিকে। টেবিলে সাজানো তার পছন্দের বিভিন্ন খাবার। অয়নের হঠাৎই মনে হলো নিঝুমের সাথে সে অনেক বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে। এতোটা খারাপ আচরণ সে ডিজার্ভ করে না। শান্ত ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো অয়ন। ঠিক করলো বাসায় গিয়ে সবার আগে নিঝুমকে সরি বলবে। কিন্তু রাতে বাসায় গিয়ে দেখলো নিঝুম বাসায় নেই। অহনার কাছে জিজ্ঞেস করলে সে বললো বাবার কথা মনে পড়ছে বলে বাবার বাড়ি গেছে। কিন্তু অয়ন ঠিক বুঝতে পারলো নিঝুমের যাওয়ার কারণ। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো কিন্তু কিছুতেই শান্তি লাগছে না। একসময় নিজের উপর বিরক্ত হয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে নিঝুমের বাড়ি উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কলিংবেল চাপলে একটু পর নিঝুমের মা সেলিনা দরজা খোলে দিলো।
ব্যস্ত গলায় বললো, আরে অয়ন বাবা যে।
অয়ন মুচকি হেসে বললো, আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলে কেনো ভেতরে এসো। কেমন আছো তুমি আর তোমার মা কেমন আছে ?
আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। আপনারা কেমন আছেন ?
আমরাও ভালো আছি বাবা।
আন্টি নিঝুম কোথায় ?
ও তো ওর রুমে আছে। বললো মাথাটা ধরেছে বিরক্ত না করতে।
আমি একটু যেতে পারি ?
আমার পারমিশন নেওয়ার কী আছে ? তোমার বউ তুমি যাবে।
সেলিনা মুচকি হাঁসলো আর অয়ন খানিকটা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
আচ্ছা তুমি যাও আমি তোমার খাবারের ব্যবস্থা করছি।
কিছু করার প্রয়োজন নেই আন্টি, আমি খেয়ে এসেছি।
ঠিক আছে তাহলে যাও।
অয়ন নিঝুমের রুমে এসে দেখে পুরো রুম অন্ধকার। ফোনের ফ্ল্যাশ দিয়ে দেখে সুইচবোর্ড খোঁজে লাইট অন করলো।
সাথে সাথেই নিঝুম বললো, মা বললাম না বিরক্ত করো না। ক্ষুধা নেই আমার খাবো না।
অয়ন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, মাত্র তিন মাসে হেরে গেলে ?
অয়নের গলা শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো নিঝুম, সামনে তাকিয়ে অয়নকে দেখে অবাক হয়ে গেলো।
আপনি এখানে ?
অয়ন সোজা গিয়ে সোফায় বসে বললো, কেনো অন্যকারো আসার কথা ছিলো নাকি ?
তা কেনো থাকবে ।
তো মিস উপস সরি মিসেস নিঝুম, কোনোদিন হার মানবে না বলে মাত্র তিন মাসে হার মেনে চলে এলে ?
হার মেনে চলে এসেছি কে বললো ? ক্লান্ত হয়ে গেছি তাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে এসেছি।
অয়ন মলিন গলায় বললো, আসলে দুপুরের ব্যবহারের জন্য সরি। একটা বড় লস হয়েছে কোম্পানিতে তাই মেজাজ খারাপ ছিলো। তোমার সাথে এতোটা খারাপ আচরণ করা উচিত হয়নি আমার, সত্যি দুঃখীত আমি।
১০.
পুরনো কথা ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো অয়ন। সেদিন নিঝুম হাতে মাফ করেছিলো কিনা তার জানা নেই। অয়ন ভেবেছিলো নিঝুম আর কখনো তার খাবার নিয়ে অফিসে যাবে না কিন্তু তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে নিঝুম পরদিনই তার জন্য খাবার নিয়ে যায়। অয়নও কোনোরকম কথা বলা ছাড়া ভদ্র ছেলের মতো খেয়ে নিয়েছিলো। আজ অফিসের ক্যান্টিনের খাবার খেতে হবে ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। খাওয়া শেষে ফোন হাতে বসে আছে অয়ন। ইচ্ছে করছে নিঝুমকে একটা ফোন করে তার অবস্থা জানতে। আবার কোথাও একটা বাঁধা কাজ করছে। এর আগে নিঝুম ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন দিয়ে তার খোঁজ নিতো। সে কখনো নিঝুমকে আগে কল দেয়নি। অয়ন প্রচন্ড দোটানায় ভুগছে, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এই হার জিতের খেলায় মত্ত হয়ে সে ভুল করছে। আবার মনে হচ্ছে ভুল কোথায় সে তো নয়নাকে ভালোবাসে। কিন্তু যখন নয়নার সাথে সময় কাটাচ্ছে তখন নয়নার মাঝে সে নিঝুমকে খোঁজার চেষ্টা করছে। অয়ন নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে অয়ন কল দিলো নিঝুমের নাম্বারে। প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেলো রিসিভ হলো না। অয়ন আর একবার দিবে কিনা ভেবে পাচ্ছে না। ফোনটা হাতে ঘুরিয়ে যাচ্ছে, মিনিট পাঁচেক পর আবার কল দিলো। এবার দু’বার রিং হতেই রিসিভ হলো।
ওপাশ থেকে দূর্বল আওয়াজে বললো, আসসালামু আলাইকুম।
অয়ন একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলে বললো, ওয়ালাইকুম আসসালাম।
নিঝুম তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, এতো ব্যস্ত মানুষের আবার আমাকে কী প্রয়োজন হলো ? আমি আপনার জন্য যা করতে পারতাম তা তো করে দিয়েছি।
অয়ন মলিন মুখে বললো, সব সময় এমন বাঁকা কথা না বললে হয় না তোমার ?
কী করবো বলুন ? আমি যে মানুষটাই এমন, তাই হয়তো এতো ভালোবাসা দিয়েও একটা মন জয় করতে পারলাম না। থাক সেসব পুরনো কথা, কী প্রয়োজনে আমাকে মনে পড়লো সেটা বলুন।
তোমার শরীর এখন কেমন, জ্বর কমেছে ?
এটা তো আপনার প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ে পরে না। শুধু জ্বর কেনো এখন তো আমি মারা গেলেও আপনার কিছু আসে যাওয়ার কথা নয়।
নিঝুমের এমন কথায় কেনো যেনো অয়নের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে হলো কেউ একদম হৃদয়ে আঘাত করেছে।
অয়ন রেগে ধমক দিয়ে বললো, নিঝুম একদম বাজে কথা বলবে না।
নিঝুম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, বা রে বাজে কথা কোথায় বললাম ? যা সত্যি তাই তো বললাম মিস্টার অ্যাটিটিউট।
অয়ন অবাক হলো নিঘুমের মুখে মিস্টার অ্যাটিটউট ডাক শুনে। কারণ এটা বলে বিয়ের আগে ডাকলেও বিয়ের পর মিস্টার হাসবেন্ড বলেই ডাকতো।
অয়ন অবাক কণ্ঠে বললো, মিস্টার অ্যাটিটিউট ?
নিঝুম ব্যাথিত গলায় বললো, মিস্টার হাসবেন্ড ডাকার অধিকার ঠিক সেই সময় হারিয়েছি যখন নয়নার আপুর হাতে আপনাকে তুলে দিয়েছিলাম। যখন নয়নার আপুর হাতে হাত রেখে আপনি হারিয়ে গিয়েছিলেন অন্য কোনো ভূবনে।
নিঝুমের কথাগুলো আজ বারবার অয়নের হৃদয়ে আঘাত করছে। মনে হচ্ছে নিঝুম একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে তার থেকে। তাদের মাঝে দুরত্বটা একটু একটু করে বাড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে নিঝুম তার জীবন থেকে, তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে মেয়েটা।
অয়ন নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখেই বললো, তোমার জন্য কী কী আনবো ? জ্বর হলে তো তোমার বাড়ির খাবার খেতে ইচ্ছে করে না।
মনে রাখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে আমার জন্য আপনার আর এক বিন্দু পরিমাণ কষ্টও করতে হবে না মিস্টার অ্যাটিটিউট।
অয়নের কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে নিঝুম কল কেটে দিলো। অয়ন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। এ কোনো নিঝুমের সাথে কথা বললো সে। একটা বার এটাও জানতে চাইলো না সে দুপুরে খেয়েছে কিনা। এই কী সেই নিঝুম, যে তাকে না খাইয়ে এক পাও নড়তো না, যে তাকে দিয়ে সারারাত একটার পর একটা জিনিস আনিয়েছিলো জ্বর হয়েছিলো বলে ? অয়নের বুকের বা পাশে হঠাৎ চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।
চলবে,,,