মরিচাধরা_মনের_খাঁচা,পর্বঃ ১৪,১৫

0
835

#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা,পর্বঃ ১৪,১৫
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৪

নিঝুম অয়নের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলো।

শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বললো, আপনি এখানে ?

অয়নের ঘোর কাটলো নিঝুমের কথায় তবে মুখ দিয়ে কেনো শব্দ বের করার শক্তি পাচ্ছে না।

ভেতর থেকে তয়ন পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো, আগে ভেতরে এসো ভাবি, তারপর সব কথা জানা যাবে।

তয়নকে দেখে নিঝুম অবাক হয়ে বললো, তয়ন ভাইয়া আপনি দেশে আসলেন কবে ?

তয়ন একটু ভেবে অয়নের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা ভাইয়া আমি কবে এলাম বল তো ?

অয়ন বিরক্ত হয়ে তাকালো তয়নের দিকে। নিঝুম দু’জনকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।

সাথীকে উদ্দেশ্য করে বললো, সাথী এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দে তো বোন।

সাথী তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস নিঝুমের দিকে এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে গ্লাস ফাঁকা করে দিলো।

সাথী আরেক গ্লাস দে।

গ্লাসটা কে দিলো না দেখেই খেয়ে নিলো নিঝুম। খালি গ্লাসটা ফেরত দিতে গিয়ে খেয়াল করলো এটা সাথী নয়। উপরে তাকালে অয়ন মুচকি হাসলো নিঝুমের দিকে তাকিয়ে।

আরো খাবে ?

নিঝুম উঠে দাঁড়ালো আর শক্ত গলায় বললো, মা তোমার বান্ধবীর ছেলেটা এসেছে। ভালো করে আদর আপ্যায়ন করে করে বিদায় করো।

নিঝুম নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালে অয়ন বলে উঠলো, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে নিঝুম।

নিঝুম বললো, আপনার সাথে আমি সব কথা শেষ করে তবেই এসেছি। এখন আপনার সাথে আমার না কোনো কথা আছে আর না আছে কোনো সম্পর্ক। সম্পর্কের একটা সুতো ছেঁড়া বাকি আছে সেটাও খুব তাড়াতাড়ি ছিন্ন হতে চলেছে।

অয়ন অসহায় গলায় বললো, তুমি আগে আমার কথাটা একবার শুনে নাও।

নিঝুম আর কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেলো। দরজা আঁটকে দিবে তার আগেই একটা বলিষ্ঠ হাত তাকে বাঁধা দিলো। তাকিয়ে দেখলো অয়ন শক্ত করে ধরে রেখে দরজাটা।

নিঝুম কঠিন গলায় বললো, দরজা ছাড়ুন মিস্টার ইমরান আহমেদ অয়ন। এটা আপনার বাড়ি নয়, যে এখানে আপনি অভদ্রতা করবেন।

অয়ন নিঝুমকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো, বাড়িটা আমার না হলেও বউটা আমার।

নিঝুম নাকমুখ কুঁচকে বললো, লজ্জা করছে না বাড়িতে নতুন বউ রেখে এসে, এখানে এমন বেহায়াপনা করতে। কেনো এসেছেন এখানে ? আমি তো বলেই এসেছি ডিভো,,,,

নিঝুম কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই অয়ন নিঝুমের মুখ চেপে ধরে বললো, হুঁশ কোনো ডিভোর্স হবে না। আমার বউ নিঝুম ছিলো আর নিঝুমই থাকবে।

নিঝুম একটা ঝটকায় অয়নকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বললো, একদম স্পর্শ করবেন না আমাকে। আমাকে স্পর্শ করার অধিকার আপনার নেই।

অয়ন নিঝুমকে একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমাকে স্পর্শ করার একমাত্র অধিকার আছে আমার। এতদিন নিজের অধিকার খাটাইনি এবার থেকে খাটাবো।

নিঝুম নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, কেনো নয়না ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে ?

নাহ, আমিই নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাকে ছেড়ে এসেছি।

নিঝুম অবাক হয়ে বললো, মানে ?

অয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিঝুমকে ছেড়ে সামনে দাঁড়িয়ে বিয়ের দিন থেকে পুরো ঘটনা খুলে বললো নিঝুমকে।
সরি নিঝুম।

সব শুনে নিঝুম নিঃশব্দে হাসলো।

অয়নকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে বললো, আজ নয়নাকে মনে হচ্ছে আবেগ আর আমাকে ভালোবাসা। দু’দিন পর অন্যকাউকে ভালোবাসা আর আমাকে আবেগ মনে হবে না, তার কী নিশ্চয়তা ? আর আমার সম্পর্কে সত্যিটা জানলে আবেগ ভালোবাসা যাই আছে সব ধোঁয়ার মতো বাতাসে মিলিয়ে যাবে।

অয়ন মলিন হেসে বললো, আমার চাই না কোনো সন্তান। সারাজীবন তুমি পাশে থাকলেই হবে।

নিঝুম চমকে তাকালো অয়নের দিকে আর অবাক গলায় বললো, আপনি কী করে জানলেন ?

মা আমার পাগলামি দেখে সব বলে দিয়েছে। ভেবেছিলো সব জানলে হয়তো তোমাকে ভুলে যাবো।

নিঝুম পেছনে ঘুরে কঠিন গলায় বললো, পেছনে ফেলে আসা জীবনে আমি আর ফিরে যেতে চাই না। আপনি চলে যান এখান থেকে। যখন মনেপ্রাণে আপনাকে চেয়েছিলাম বারবার আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছেন। আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে চলে এসেছি এখন আবার ফিরে যেতে বলছেন। আজ নয়নাকে আবেগ মনে হয়েছে আগামীকাল আমাকেও হয়তো,,,

অয়নও কঠিন গলায় বললো, তোমাকে না নিয়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না। আর রইলো আমার ভালোবাসার কথা। আমি প্রমাণ করে দিবো আমি ভালোবাসি তোমাকে, তুমি আমার আবেগ বা মোহ না।

আমি কোনোদিন যাবো না আপনার সাথে।

সেটা তো সময়ই বলে দিবে।

অয়ন দরজা খোলে বের হয়ে গেলো নিঝুমের রুম থেকে। তয়ন তিথিকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো সোফায়। মেয়েটা খুব মিষ্টি আর শান্ত। তয়নের কোলে একদম চুপ করে বসে আছে। তয়ন তাকে নানা কথা বলছে আর গাল টানছে।

অয়ন তয়নের কাছে গিয়ে তিথির মাথা হাত বুলিয়ে বললো, গাল টানছিল কেনো ? ব্যাথা পায় না নাকি ?

সেলিনা অয়নকে দেখে ব্যস্ত গলায় বললো, নিঝুম কী বললো ?

অয়ন সেলিনার দিকে তাকিয়ে বললো, রাগ করে আছে। আমি ঠিক রাগ ভাঙিয়ে ছাড়বো, আপনি চিন্তা করবেন না মা।

সেলিনা চমকে উঠলো অয়নের মুখে মা ডাক শুনে। নিঝুম তাদের একমাত্র মেয়ে। মেয়ে জামাইয়ের মুখে মা ডাক শোনার স্বপ্ন সেলিনারও ছিলো কিন্তু অয়ন সবসময় আন্টি আর আঙ্কেল বলেই ডাকতো তাদের।

অয়ন মাথা নিচু করে বললো, মা আমরা বরং আজ আসি।

সেলিনা অবাক হয়ে বললো, এখনই ঢাকা ফিরে যাবে ?

অয়ন মুচকি হেসে বললো, নিঝুমকে না নিয়ে এই সিলেট থেকে এক পা নড়ছি না আমি।

তাহলে কোথায় যাবে ?

মনে হচ্ছে না এতো তাড়াতাড়ি আপনার মেয়ের মন গলবে। তাই থাকার জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে আর কী।

আমাদের এতোবড় বাড়ি থাকতে তোমরা বাইরে থাকবে কেনো ? তোমরা এখানেই থাকবে।

অয়ন চিন্তিত গলায় বললো, কিন্তু নিঝুম আর আঙ্কেলও নিশ্চয়ই রেগে আছে আমার উপর।

সেলিনা আশ্বাস দিয়ে বললো, আমি আছি তো ? পৃথিবীর কোনো মা চায় না তার মেয়েকে সমাজের মানুষ বাজে কথা বলুক, বাজে নজরে দেখুক। তেমন আমিও চাই না। তবে নিঝুম মেনে নিলেই আমরা তোমাকে মেনে নিবো৷ এখন সম্পূর্ণটা নির্ভর করছে নিঝুমের সিদ্ধান্তের উপর।

অয়ন মুচকি হেসে বললো, নিঝুম আমাকে মাফ করে দিবে এটা আমার বিশ্বাস।

গাড়ি ভেতরে নিয়ে এসো আর তোমাদের জিনিসপত্র ও, সাথী রুম দেখিয়ে দিবে।

২৫.
পানি পরার ঝমঝম শব্দ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে নিঝুম। অয়ন বেড়িয়ে যাওয়ার পরই শাওয়ারে এসেছে আর এখনো ঝর্নার নিচে বসে আছে। ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেছে, চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার। চোখের নোনাপানি মিশে যাচ্ছে শীতের এই ঠান্ডা পানির সাথে।

ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে সাথী বললো, আপু মা খেতে ডাকছে তোমাকে।

নিঝুম নাক টেনে কোনোমতে বললো, আমি খাবো না।

আমি তার কিছু জানি না। মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে তোমাকে।

নিঝুমের উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলো সাথী। নিঝুম বসে না থেকে উঠে দাঁড়ালো। এখন খেতে না গেলে আবার মা আসবে ডাকতে আর তাও না গেলে বাবার কানে চলে যাবে এই খবর। সে অফিস থেকে চলে আসবে কোনোকিছু না ভেবে। নিঝুম মাঝে মাঝে ভাবে সে তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান না হয়ে আরো ভাইবোন থাকলে ভালো হতো। একমাত্র সন্তান হওয়ায় নিঝুমের বাবা-মা মেয়েকে জীবন মনে করে। নিঝুম চেঞ্জ করে বের হতেই সেলিনা রুমে এলো। মেয়ের চেহারা দেখে বুকে ধক করে উঠলো তার।

করুন গলায় বললো, এতোই যখন কষ্ট পাচ্ছিস তাহলে ফিরিয়ে দিয়েছিস কেনো ?

নিঝুম মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, সব জানার পরও এসব বলছো তুমি ?

আচ্ছা তুই আমাকে বল। কেনো ফিরে যাচ্ছিস না তুই ? অয়নের করা অন্যায়ের জন্য, নাকি নিজের অক্ষমতার জন্য ?

নিঝুম ধুপ করে বসে পরলো ড্রেসিংটেবিলের সামনের টুলে আর ক্লান্ত গলায় বললো, আমি জানি না মা।

সেলিনা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, ঠিক আছে সময় নে। নিজেকে বুঝার চেষ্টা কর, কী চাস তুই। সাথী বললো তুই নাকি খাবি না ?

খাবো, আসছি তুমি যাও।

সেলিনা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। নিঝুম চুল মুছতে লাগলো ধীর গতিতে আর চিন্তা করতে লাগলো কী করা উচিত তার। এতকিছু করার পর শুধু একবার সরি বললেই কী সব ঠিক হয়ে যায় ? মনে যে আঘাতের দাগ রয়ে গেছে সেগুলো কী একবার চাইলে সব ভুলে যাওয়া সম্ভব ? অয়নকে দেখলে চোখে ভাসে তার করা প্রত্যেকটা অপমান, অবহেলা। নিঝুম বিরক্ত হয়ে হাতে থাকা চুল মোছার টাওয়েল ছুঁড়ে ফেললো সোফায় আর মাথায় ওড়না দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। মাথার লম্বা ঘন চুল চুইয়ে পানি পরে ভিজে যাচ্ছে গায়ের জামা।

চেয়ার টেনে বসে বললো, মা খাবার দাও।

নিঝুম এসে বসতেই তার পাশে একটা চেয়ার টেনে কেউ বসে পড়লো৷ নিঝুম মনে করেছিলো সাথী কিন্তু পুরুষালি হাত দেখে মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। নিঝুম ভেবেছিলো অয়ন চলে গেছে।

নিঝুম প্রায় চিৎকার করে বললো, আপনি এখনো এখানে ?

সেলিনা টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বললো, তুই না বললি, মেহমান এসেছে ভালো করে আদর আপ্যায়ন করতে।

নিঝুম শক্ত গলায় বললো, শেষে বিদায় করতেও বলেছিলাম। সেটা কী শুনতে পাওনি ?

সময় হলে সেটাও করবো। আপাতত যেটার সময় সেটাই করি না হয়।

সেলিনা কথাটা বলে আবার কিচেনে চলে গেলো। নিঝুম রেগে টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে নিলে অয়ন হাত টেনে ধরলো আর নিচু গলায় বললো, চুল থেকে পানি পড়ছে। ভালো করে মুছোনি কেনো ? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।

নিঝুম হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ভালোবাসা একটু বেশি বেড়ে গেছে মনে হয়।

এটা কিন্তু আমি তোমাকে নতুন করে বলছি না নিঝুম। আগেও এমন দেখলে একই কথা বলতাম। তবে আগে যেটা করতাম এখন সেটা করবো।

নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বললো, মানে ?

কথার উত্তর না দিয়ে অয়ন নিঝুমের হাত ধরে নিঝুমের রুমের দিকে যেতে লাগলো।

নিঝুম হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, আপনি কিন্তু এবার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছেন। এসব করে আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন ?

কিছুই প্রমাণ করতে চাইছি না। নিজের অধিকার আগে ছেড়ে দিয়েছিলাম, এবার থেকে সব বুঝে নিবো। অনেক ভুল করেছিলাম এবার থেকে শুধরে নিবো।

অয়ন আর একটা শব্দও করলো না। নিঝুমের রুমে গিয়ে ছুঁড়ে মারা টাওয়েল তুলে নিঝুমের চুল মুছে দিতে লাগলো। নিঝুম সরে আসতে চাইলে অয়ন একহাতে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে চুল মুছতে লাগলো। অনেকটা সময় সাপের মতো মোড়ামুড়ি করে হঠাৎ থেমে গেলো নিঝুম। অয়নের এতোটা কাছে এসেছে আগে খেয়াল হয়নি। নিঝুম একদম শান্ত হয়ে অয়নের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। শুনতে লাগলো বুকের ধকধক শব্দ।

অয়ন মুচকি হেসে বললো, এভাবেই শান্ত মেয়ে উপস সরি শান্ত বউ হয়ে থাকবে।

নিঝুমের ঘোর কেটে গেলো। নিঝুম শান্ত হয়ে যাওয়ায় অয়নের হাত একটু ঢিলে হয়ে গিয়েছিলো। ঘোর কাটতেই অয়নকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো নিজের থেকে।

কাঁপা গলায় বললো, দূরে থাকুন আমার থেকে।

নিঝুম বড় কদমে বের হয়ে গেলো রুম থেকে।

অয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, ভালোবাসা নিয়ে তুমি বারংবার আমার কাছে এসেছো আর আমি তোমাকে আঘাত করে ফিরিয়ে দিয়েছি। এবার নাহয় আমার পালা। তুমি যতবার আমাকে ফিরিয়ে দেবে আমি ততবার ভালোবাসার দাবি নিয়ে তোমার সামনে দাঁড়াবো।

চলবে,,,

#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৫

রাতে নিয়াজ বাড়ি ফিরে প্রথমে একটু ঝামেলা করলেও সেলিনা তাকে সামলে নিয়েছে। বুঝিয়েছে ভুল মানুষেরই হয়। অয়ন ঠিক সময়ে তার ভুল বুঝতে পেরেছে, তাই তাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। নিয়াজ মেনে নিয়েছে, তবে সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছে নিঝুমের উপর। এদিকে তনয়কে চলে যেতে বলেছিলো অয়ন কিন্তু সে যাবে না বলে দিয়েছে।

গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। নিঝুম এখন ভার্সিটি যাবে তাই। গতকাল দুপুরের পর অয়নের সাথে আর কথা বলেনি। অয়ন রাগ ভাঙানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। নিঝুমকে আসতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো অয়ন। নিঝুম পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে হাত টেনে ধরলো।

নিঝুম হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, হাত ছাড়ুন।

অয়ন হাতটা আরো একটু শক্ত করে ধরে বললো, গাড়িতে উঠো।

নিঝুম হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, আপনার কী কানে সমস্যা নাকি মাথায় ? কতবার বলেছি আমার থেকে দূরে থাকুন।

তুমি বললেই আমাকে শুনতে হবে ?

আচ্ছা আপনার লজ্জা করছে না এসব করতে ? অন্যের বাড়িতে শুয়ে বসে খাচ্ছেন লজ্জা করছে না ?

অয়ন জানে নিঝুম তাকে রাগানোর জন্য এসব বলছে তাই না রেগে মুচকি হেসে বললো, লজ্জা নারীর ভূষণ। আর আমি জানি, তোমাকে নিজের করে পেতে আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে আমার রাগ, ইগো, লজ্জা। তাই এসব আমি ঢাকায় রেখে এসেছি। এবার চলো তোমার লেট হচ্ছে।

আমি যাবো না আপনার সাথে।

যাবে না তো ?

না যাবো না।

ওকে এবার দেখো, আমি কী করি।

নিঝুম প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালে অয়ন তাকে কোলে তুলে নিলো ঝটপট।

নিঝুম চেঁচিয়ে বললো, আরে আরে কী করছেন আপনি ? নামান বলছি এখনই।

নামাবো তো অবশ্যই তবে জায়গা মতো।

অয়ন নিঝুমকে কোলে নিয়ে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে পড়লো।

নিঝুম রেগে বললো, এসব কী করছেন আপনি ?

অয়ন সীটবেল লাগাতে লাগাতে বললো, আজ তুমি আমার কোলে উঠে ভার্সিটি পর্যন্ত যাবে, এটা তোমার শাস্তি।

আপনার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে পুরোপুরি ? এটা ঢাকার রাস্তা নয়, এক্সিডেন্ট করে মারার প্ল্যান আছে নাকি হ্যাঁ ?

সমস্যা নেই, মরে গিয়ে দু’জনে একসাথে জান্নাতে গিয়ে ঘুরবো, প্রেম করবো। আমার জান্নাতি হুর লাগবে না তুমি থাকলেই হবে।

নিঝুম তাকায় অয়নের দিকে। অয়নের ঠোঁটে তখনও মুচকি হাসি বিদ্যমান।

আমাকে নামান, আমি পাশের সীটে বসে যাচ্ছি।

সেই সুযোগ হারিয়ে ফেলেছো, এখন এভাবেই যেতে হবে।

আমার এত তাড়াতাড়ি মরার শখ নেই।

আমি থাকতে তোমার কিছু হতে দিবো না ইনশাআল্লাহ।

দেখুন বেশি কথা না বলে নামান আমাকে। নাহলে পুলিশ দেখলে চিৎকার করে বলবো, আপনি আমাকে কিডন্যাপ করছেন।

নিঝুমের কথা শুনে অয়ন ছোট ছোট চোখে তাকালো তার দিকে। নিঝুম সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অয়ন দরজা খোলে দিলে নিঝুম নেমে গিয়ে ঘুরে এসে পাশের সীটে বসলো। নিঝুমের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো অয়ন।

অনেকটা সময় নিরবতায় কেটে গেলে হঠাৎ অয়ন বললো, আমাকে কী মাফ করা যায় না নিঝুম ?

নিঝুম তাকালো অয়নের দিকে কিন্তু কিছু বললো না।

অয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সামনে তাকিয়ে বললো, আমি জানি অনেক অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। তার জন্য যা ইচ্ছে শাস্তি দাও আমাকে, তবু ফিরে এসো।

নিঝুম আনমনে বললো, শাস্তি তো দিচ্ছি।

অয়ন চমকে উঠলো নিঝুমের কথা শুনে, তবে কিছু বললো না। বাকি রাস্তা চুপচাপ থেকেই পৌঁছে গেলো ভার্সিটির সামনে।

নিঝুম নামতে গেলে অয়ন বললো, এটা যদি আমার শাস্তি হয়, ঠিক আছে তোমার যতদিন ইচ্ছে আমি এই শান্তি ভোগ করবো।

নিঝুম কিছু না বলে নেমে গেলো গাড়ি থেকে। অয়নও গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিঝুমের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

দোস্ত ছেলেটা জোস না ?

ঠিক বলেছিস, তবে এর আগে তো দেখিনি।

নিঝুম যেতে যেতে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের কথা শুনে তাদের দিকে তাকালো। তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো। অয়ন গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিঝুম অয়নের দিকে একটা রাগী লুক দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। অয়ন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো নিঝুমের লুক দেখে। হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না। নিঝুম চলে যেতেই অয়ন গাড়িতে উঠে চলে গেলো।

২৬.
তয়ন বেডে আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিলো তখনই সাথী চা নিয়ে তার রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো।

আসবো ভাইয়া ?

তয়ন দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ আসো ?

সাথী ভেতরে এসে চায়ের কাপ সাইড টেবিলে রেখে বললো, আপনার জন্য চা এনেছি।

তয়ন মুচকি হেসে বললো, ধন্যবাদ কিন্তু আমি চা খাই না।

সাথী মলিন মুখে বললো, চা খান না কোনো ?

আমি চা খাই না কফি খাই।

ঠিক আছে আমি কফি কইরা দিতাছি।

তয়ন এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাথীর দিকে। সাথী দাঁতে জিহ্বা কেটে বললো, সরি।

সাথী চলে যেতে গেলে তয়ন বললো, কফি লাগবে না। তোমার সাথে একটু কথা ছিলো।

সাথী ঘুরে তাকিয়ে বললো, জি বলুন।

যদি কিছু মনে না করো তাহলে বলতাম আর কী।

কিছু মনে করবো না বলুন, সমস্যা নেই।

তোমার হাসবেন্ড কোথায় ?

সাথী ঘুরে তাকালো তয়নের দিকে। এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়তো তাকে বারবার হতে হবে। কিন্তু প্রশ্নটা যে তাকে পীড়া দেয় ভয়ংকর পীড়া, সেটা কী কেউ বুঝে ?

তয়ন বললো, প্রবলেম থাকলে বলতে হবে না, ইটস ওকে।

সাথী সামনে তাকিয়ে বললো, না না সমস্যা নেই। তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।

তয়নকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে সাথী বের হয়ে গেলো। তয়ন যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না সাথীর কথা। এতো সুন্দর আর নিষ্পাপ একটা মেয়েকে কীভাবে কেউ ছেড়ে যেতে পারে ? তাছাড়া তিথির মতো ফুটফুটে মেয়েটাও কী তার মন গলাতে পারেনি ? সাথী আর তিথির জন্য খুব খারাপ লাগছে তয়নের।

কী করছিস তুই ?

আরে ভাইয়া যে, ভাবীকে ভার্সিটি দিয়ে এসেছিস ?

হ্যাঁ দিয়ে এসেছি আর তোর জন্য ফ্লাইটের টিকিট নিয়ে এলাম।

তয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো, কীসের টিকিট ?

অয়ন টিকিট তয়নের হাতে দিয়ে বললো, বিকেলের ফ্লাইটে তুই ঢাকা যাচ্ছিস।

তয়ন টিকিটের দিকে একবার তাকিয়ে অয়নের দিকে তাকালো, আমি তো তোর সাথে এসেছি আর তোর সাথেই যাবো।

অয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, নিঝুম এতো সহজে ফিরে যাবে না আমার সাথে। অফিস রেখে দুজনেই এখানে পরে থাকলে বিজনেস গোল্লায় যাবে। বাবার অনেক কষ্টে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য শেষ হয়ে যাবে। তাই তুই ঢাকায় গিয়ে অফিস সামলা কিছুদিনের জন্য। আর মাও একা আছে সেখানে।

তয়ন গাল ফুলিয়ে বললো, আমি যদি না আসতাম।

তুই না আসলে সেদিন হয়তো বাঁচতামই না আমি।

তয়ন রেগে বললো, একদম বাজে কথা বলবি না, কয়টার ফ্লাইট ?

দুপুর দুইটার।

ঠিক আছে, আমি চলে যাবো।

তাহলে এখন রেস্ট নে, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

অয়ন চলে গেলে তয়ন হাতে রাখা টিকিটের দিকে তাকিয়ে রইলো। অজানা কারণে এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না তয়নের কিন্তু কিছু করারও নেই। তবে যাওয়ার আগে সাথীকে একবার সরি বলতে হবে। তয়ন বেড থেকে নেমে সাথীকে খুজতে বের হয়ে গেলো। কিচেনে দাঁড়িয়ে দুপুরের রান্নার জন্য সবজি কাটছিলো সাথী। সেদিকে তার খেয়াল নেই, অন্য এক দুনিয়ায় ডুবে আছে সে। তয়ন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় দেখলো সাথীকে। মেয়েটা সত্যি অনেক মায়াবী, মুখটা যেনো নিষ্পাপ। সাথী হঠাৎ উহ্ করে উঠলে তয়নের ভাবনার ব্যাঘাত ঘটে। সাথী হাতের আঙুল চেপে ধরে তাকিয়ে আছে, টপটপ করে রক্ত পড়ছে হাত থেকে।

তয়ন এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে দেখে বললো, একটু সাবধানে কাজ করতে পারো না। কতটা কেটে গেছে দেখো তো, চলো আমার সাথে।

তয়ন আঙ্গুল শক্ত করে চেপে ধরে সাথীকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। সাথী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তয়নের দিকে৷ এর থেকে অনেক বড় বড় আঘাতে কেউ একটু তাকিয়েও দেখেনি। সাথীর চোখে পানি চলে এলো তয়নের এটুকু কেয়ারে। তয়ন সাথীকে বসিয়ে রেখে নিজের ব্যাগ থেকে ফাস্টএইড বক্স এনে তুলোয় মেডিসিন লাগিয়ে কাটা জায়গায় লাগাতেই সাথী ব্যাথা কুঁকড়ে গেলো।

তয়ন ব্যস্ত গলায় বললো, সরি সরি আমি আস্তে আস্তে করছি।

তয়ন ফু দিয়ে ধীরে ধীরে কাটা জায়গা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। সাথী তখনো মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তয়নের দিকে।

সাথীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তয়ন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, আমি আসলে তোমাকে সরি বলতে গিয়েছিলাম। নিজের অজান্তে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি।

সাথী দৃষ্টি সরিয়ে বললো, আমি কিছু মনে করেনি। আপনি তো খুব কমন একটা প্রশ্ন করেছেন, কষ্ট পাবো কেনো।

আমি সত্যি দুঃখীত সাথী।

এভাবে বলবেন না দয়া করে। আমি এখন আসি, কাজ আছে।

সাথী উঠে আবার কিচেনের দিকে চলে গেলো। কিচেনে গিয়ে ব্যান্ডেজের উপর আলতো হাত ছুঁইয়ে দিলো। মুগ্ধতায় ডুবে গেলো সে। আড়াল থেকে তয়ন ক্যামেরা বন্দী করে নিলো সাথী হাসিমাখা মুখটা। কাজটা কেনো করলো তয়নের নিজেরও জানা নেই।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here