#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা,পর্বঃ ০৬
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
অয়ন উঠে বসে মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো। তারপর উঠে গিয়ে সাইড টেবিলে রাখা পানির মগ থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে দুই গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। হ্যাঁ রাগটা এবার অনেকখানি কমে গেছে। ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। নিঝুম বেসিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। ওয়াশরুমে ঢুকেই গা ঘিনঘিন করে উঠলো অয়নের। ফ্লোরে বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে একদম। নাম কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে নিঝুমের কাঁধে হাত রাখলো।
হয়েছে নাকি আরো বমি করবে ?
নিঝুম কিছু না বলে চুপচাপ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।
অয়ন নিঝুমের দুবাহু ধরে বললো, চলো রুমে চলো।
নিঝুম ঘুরে দাঁড়িয়ে এক পা আগাতেই চোখে অন্ধকার দেখলো। অয়ন ধরে রাখায় তার বুকেই ঢলে পড়লো। নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে গালে থাপ্পড় দিয়ে কয়েকবার ডাকলো অয়ন কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে কোলে তুলে নিলো। বেডে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখটা যেনো শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে মেয়েটার। অয়ন বেডে বসে পড়লো ক্লান্ত ভঙ্গিতে, মাথা ধরে গেছে তার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুটো বাজতে কিছু সময় বাকি আছে। সকালে আবার অফিসে যেতে হবে তার।
১৩.
খাবার দিয়েছি এসে খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।
মায়ের ডাকে অতীত থেকে ফিরে এলো অয়ন। বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে এলো দীর্ঘ শ্বাস। নিঝুমের জ্বালাতনে এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো অয়ন। সবসময় আল্লাহর কাছে চাইতো এই জ্বালাতন থেকে মুক্তি পেতে। অথচ আজ সেই দিনগুলো বড্ড বেশি মিস করছে। মিস করছে নিঝুমের দুষ্টুমিগুলো, মেয়েটা হঠাৎ করেই কেমন বদলে গেলো। অয়নে উঠে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। নিচে গিয়ে দেখে অহনা ডাইনিং টেবিলে বসে আছে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে।
অয়ন একটা চেয়ার টেনে বসে বললো, তুমি খেয়েছো ?
সেটা তোমার জেনে কাজ নেই। নিজের খাওয়া নিজে খাও, অন্যের খোঁজ নিয়ে কাজ নেই।
অয়ন নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি এমন করে কথা বলছো কেনো মা ?
অহনা এবার অয়নের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি এখনো তোমার সাথে কথা বলছি সেটাই তোমার সৌভাগ্য।
অয়ন অবাক চোখে তাকালো মায়ের দিকে। অহনা উঠে দাঁড়িয়ে খুশিকে ডেকে বললো, খুশি যা লাগে এগিয়ে দিস।
অহনা চলে গেলে অয়ন সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। অহনা অয়নকে একটু বেশি ভালোবাসে কারণ অয়ন সবসময় তার সাথেই ছিলো। তয়ন তার থেকে আলাদা থাকতো পড়াশোনার জন্য কিন্তু অয়ন মাকে একা রেখে কোথাও যায়নি। তাই ভালোবাসাটা একটু বেশি, কখনো অয়নের সাথে এভাবে কথা বলেনি অহনা। খাবার না খেয়েই উঠে রুমের দিকে চলে গেলো সে।
খুশি বিড়বিড় করে বললো, প্রতিদিন নতুন নতুন নাটক হয় এই বাড়িতে।
এভাবেই কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। নিঝুম নিজেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে নিয়েছে অয়নের থেকে। যেখানে মায়া বাড়িয়ে লাভ না হয় সেখানে মায়া কাটাতে শিখতে হয়। নিঝুম জানে সে কখনো অয়নের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারবে না তবু চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অহনাও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না অয়নের সাথে। এদিকে নয়নার বাসা থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে। নিঝুম ডিভোর্সের জন্য পরিচিত লয়ারের সাথে যোগাযোগ করেছে। তিন মাস সময় লাগবে ডিভোর্স লেটার হাতে পেতে। নিঝুম চাইলেই নিজের বাড়ি চলে যেতে পারে কিন্তু এখনই সবাইকে জানিয়ে ঝামেলা তৈরি করতে চাইছে না। তবে নিঝুমের বাবা-মা সবই জানে, তারা বারবার চলে যেতে বলছে কিন্তু নিঝুম যাচ্ছে না। অহনা আর অয়ন ব্রেকফাস্ট করছে৷ টেবিলে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। তখনই নিঝুম নিজের রুম থেকে বের হলো একদম রেডি হয়ে। পায়ের ক্ষত অনেকটাই শুকিয়ে গেছে তবু একটু খুড়িয়ে হাঁটতে হয়। জ্বর সেরেছে দুদিন হলো, তবে শরীর এখনো অনেক দূর্বল।
অহনা নিঝুমকে দেখে বললো, তুই কোথায় যাচ্ছিস ?
নিঝুম স্বাভাবিক গলায় বললো, বাইরে কিছু জরুরি কাজ আছে।
এই দূর্বল শরীর নিয়ে কোথায় যেতে হবে না তোমার, একদম সুস্থ হয়ে যাও তারপর যা কাজ আছে সব করো।
নিঝুম মলিন হেঁসে বললো, হাতে যে সময় খুব একটা নেই মা।
অয়ন আর অহনা দু’জনেই অবাক চোখে তাকালো নিঝুমের দিকে। তার কথার মানে বুঝতে পারেনি কেউ।
অহনা অবাক হয়ে বললো, মানে ?
রানা পুলিশ নিয়ে সাথীর বাসায় গিয়েছিলো। মেয়েটা ফোন করে অনেক কাঁদছে, ওর মায়ের অবস্থাও নাকি খুব খারাপ।
এইসব ঝামেলায় না জড়ালেই হয়তো ভালো হতো।
একটা অসহায় মেয়ে আমার কাছে সাহায্য চেয়েছে। ওকে সাহায্য না করলে সারাজীবন নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো মা। যদি সাহায্য করার মতো উপায় আমার না থাকতো তাহলে অন্য কথা ছিলো। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাহায্য না করে থাকতে পারবো না। আমার মতো নিঃস্ব হতে দিতে পারি না আরো একটা মেয়েকে।
অয়ন খাবার মুখে দিচ্ছিলো কিন্তু নিঝুমের শেষের কথাটা শুনে হাত থমকে গেলো। সত্যি কী সে নিঝুমের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে ? অহনার মুখটা মলিন হয়ে গেলো মুহুর্তে।
ঠিক আছে কিছু খেয়ে যা।
অনেকদিন পর বাইরে যাচ্ছি, আজ একটু বাইরে খেতে ইচ্ছে করছে।
তোকে কতবার বলেছি বাইরের খাবার খাওয়া এবার একটু কমা, কিন্তু আমার কথার কোনো দামই নেই।
জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাই ছেড়ে দিলাম, এগুলোও একদিন ছেড়ে দিবো। আমি আসছি মা আজ ফিরতে একটু লেট হবে।
নিঝুম এগিয়ে গেলে অয়ন পেছন থেকে বললো, কোথায় যাবে, আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।
নিঝুম অয়নের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, তার প্রয়োজন নেই মিস্টার অ্যাটিটিউড। আপনার দামি গাড়ি আমার গন্তব্যে যাবে না। সাথী আপনাদের মতো প্রাসাদে না বস্তিতে থাকে আর তাছাড়া নয়না আপু দেখলে মাইন্ড করতে পারে।
কথাটা বলে নিঝুম চলে গেলো আর অহনাও। অয়ন একা বসে রইলো টেবিলে। নিঝুমের এমন কথাবার্তা একটুও মেনে নিতে পারছে না সে। নিঝুমের সেই নিষ্পাপ হাসিটা দেখা হয় না অনেক দিন হলো।
সরু গলি দিয়ে রিকশা ঢুকে গেলো বস্তির ভেতর, আশপাশের নোংরা গন্ধে পেট ফুলে যাচ্ছে নিঝুমের। মাস্কের উপর ওড়না চেপে ধরলো। সামনে মানুষের ভীড় দেখে কপাল কুঁচকে গেলো নিঝুমের। ঠিকানা অনুযায়ী এটাই সাথীর বাড়ি, কিন্তু এখানে এতো মানুষ কেনো ? মানুষ ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলো নিঝুম। টিনের ঘরের সামনের সরু উঠানে একটা লাশের খাটিয়া রাখা। নিঝুম বুঝতে পারলো না কার লাশ এটা। কান্নার শব্দ কানে আসতেই সাথীর দিকে চোখ পড়লো তার, চিৎকার করে কাঁদছে মেয়েটা।
কান্নার স্বরে বলছে, আমারে এই দুঃখের সাগরে ভাসাইয়া দিয়া তুই স্বার্থপরের মতো চইলা গেলি মা। আমারে এতিম কইরা তুইও নিজের সুখ খুইজা নিলি।
নিঝুমের চোখ টলমল করছে পানিতে। এটুকুই তো মাথার উপর ছায়া ছিলো মেয়েটার। আল্লাহ তাও কেড়ে নিলো, এবার একা একটা মেয়ে, কীভাবে এই সমাজে টিকে থাকবে ? মুখোশধারী শেয়াল শকুনের অভাব নেই আমাদের সামাজে। সাথীর মতো যুবতী মেয়ে একা থাকলে, এরা সুযোগ পেলে ছিঁড়ে খাবে। সাথীর পাশেই ছোট একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে একটা মেয়ে। বাচ্চাটাই হয়তো তিথি, দেখতে সাথীর মতোই সুন্দর আর কী নিষ্পাপ মুখ। মায়ের কান্না দেখে মেয়েটাও কেঁদে মুখ লাল করে ফেলেছে। নিঝুম এগিয়ে গিয়ে সাথীর কাঁধে হাত রাখলো। সাথী মাথা তুলে নিঝুমকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
আপা আমার মা চইলা গেছে আমার একা ফালাইয়া।
সাথীকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জানা নেই নিঝুমের। তাই সাথীকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো, সাথী কাঁদতে লাগলো চিৎকার করে। দাফন হয়ে গেলে ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় কমে গেলো। রয়ে গেলো শুধু নিঝুম আর রিনি। সাথী তখন চুপচাপ নিঝুমকে জড়িয়ে বসে আছে আর রিনির কোলে তিথি। রিনি কিছুতেই তিথিকে সামলাতে পারছে না আর সাথী এখন মেয়েকে সামলানোর মতো অবস্থায় নেই। নিঝুম রিনিকে বললো সাথীকে ধরতে আর সে তিথিকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েটাকে কোলে নিতেই শরীর জুড়ে এক শীতল হাওয়া বয়ে গেলো নিঝুমের আর বুকটা হাহাকার করে উঠলো। এমন একটা দিন তার জীবনে আর কখনো আসবে না। খুব করে স্বপ্ন দেখেছিলো ছোট্ট এক পরীর হাত ধরে পাশাপাশি হাটবে অয়নের সাথে। কিন্তু সে স্বপ্ন কখনো পূরণ হওয়ার নয়। নিঝুম তিথিকে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। মেয়েটাও যেনো মায়ের ছায়া খোঁজে পেলো নিঝুমের কোলে। চুপটি করে নিঝুমের বুকে শুয়ে রইলো। এ যেনো অদৃশ্য কোনো আত্মার সম্পর্ক তাদের।
হঠাৎ রিনি বলে উঠলো, তোমার হাতে তো জাদু আছে।
নিঝুম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, আমি হাত দিয়ে যা ছুঁই তাই দুঃখ হয়ে যায়। প্রথম কোনো সুখের আভাস পেলাম কিছু ছুঁয়ে।
কিছুটা সময় নিঝুমের দিকে তাকিয়ে রইলো রিনি। নিঝুম রিনির সমবয়সী কিংবা বছর খানেকের বড় হবে। রিনি খুব চালাক মেয়ে, নিঝুমের হাসি খুশি মুখের আড়ালের কষ্টটা যেনো দেখতে পেলো তার চোখে।
সাথীর দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি একা এই বাড়িতে থাকবে কী করে ভাবি ? বস্তির বখাটেগুলো আগে থেকেই তোমার পিছু পরে আছে।
নিঝুমের কপালেও চিন্তার ভাজ পড়লো এবার। ছোট বাচ্চাটা নিয়ে সাথী একা কীভাবে থাকবে এখানে ? নিঝুম গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো।
১৪.
বাবা-মা এখনো নিঝুমের কথা জানে না অয়ন। তবু তারা তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যদি নিঝুমের কথা একবার জানে তাহলে কী করবে বুঝতে পারছো তুমি ?
তারজন্য আমি এখন কী করতে পারি ?
তোমাকে কিছু করতে হবে না, শুধু এটুকু বলো নিঝুম আর কতদিন তোমাদের বাসায় থাকছে ?
নয়না তুমি আদৌও আমাকে বিশ্বাস করো, ভালোবাসো ?
নয়না ব্যস্ত গলায় বললো, এটা কেনো বলছো ?
নিঝুম নিচের একটা রুমে থাকছে আর আমি দোতলায়। প্রয়োজন ছাড়া নিজের রুমের বাইরেও বের হয় না কখনো। নিঝুম সব সত্যি না বললে তুমি কখনো আমাকে বিশ্বাস করতে না। এতো কিছুর পরও তুমি নিঝুমকে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে পরে আছো ?
নয়না মনে মনে বললো, তোমাকে কী করে বুঝাই আমার ভয় নিঝুমকে নিয়ে নয় বরং তোমাকে নিয়ে।
মুখে বললো, আমি সেভাবে বলিনি।
ডিভোর্স লেটার হাতে পেয়ে গেলেই নিঝুম চলে যাবে, চিন্তার কিছু নেই।
চলবে,,,,,