#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা,পর্বঃ ০৯
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
নিঝুম চুপচাপ গিয়ে দাড়ালো সাথীর পাশে। সে নিজের চিন্তায় বিভোর আশপাশের কিছুতেই মন নেই তার।
সাথী হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো, আপু এইটা কেমন হইবো ?
সাথীর কথা কানে যেতেই চোখ রাঙিয়ে তাকালো নিঝুম। সাথী দাঁতে জিহ্বা কাটলো।
নিঝুম বললো, মা কী বলেছিলো মনে নেই ?
ভুল হয়ে গেছে।
হুম এখন তাড়াতাড়ি পছন্দ কর আবার তিথির জন্যও তো কিনতে হবে।
প্রয়োজনীয় শপিং করে বের হলো নিঝুম আর সাথী। রাস্তা পার হওয়ার সময় সাথী একটু এগিয়ে গেলো আর নিঝুম পেছনে অন্যমনস্ক হয়ে আসছিলো। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে হাত ধরে টান দিয়ে একটু পেছনে নিয়ে যায় আর একটা প্রাইভেট কার নিঝুমকে ছুঁই ছুঁই হয়ে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যায়। চমকে উঠে নিঝুম, মাত্র এক মিনিটের ব্যবধানে সে লাশ হয়ে রাস্তায় পরে থাকতো। কে বাঁচালো সেটা দেখতে পেছনে ফিরে চমকে উঠলো নিঝুম। অয়ন শক্ত করে তার হাত ধরে আছে আর তার মুখ রাগে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
নিঝুম অবাক হয়ে বললো, আপনি ?
মুহুর্তেই নয়না দৌড়ে অয়নের কাছে এলো, নিঝুমকে সে তখনো খেয়াল করেনি। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, কী হয়েছে অয়ন, এভাবে দৌড়ে এলে কেনো ?
অয়ন নয়নার কথার উত্তর না দিয়ে নিঝুমের দুবাহু ধরে বললো, এভাবে কেউ রাস্তা পার হয় ? রাস্তা পার হওয়ার আগে দু’পাশে দেখে নিতে হয় সেটুকু জ্ঞান নেই তোমার ? এক সেকেন্ড লেট করলে কী হতো ভাবতে পারছো তুমি ?
নয়না এবার দেখতে পেলো নিঝুমকে। সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে অয়নের দিকে। অয়নের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে নিঝুম নিজের বাহু থেকে অয়নের হাত ছাড়িয়ে ঘুরে দাড়ালো।
অয়ন রেগে বললো, কথা বলছো না কেনো তুমি ?
নিঝুম না দাড়িয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। অয়ন রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো।
নয়না ভেংচি কেটে বললো, দেখলে কী বেয়াদব ? তোমার কোনো কথার উত্তরই দিলো না।
অয়ন আর না দাঁড়িয়ে পার্কিংয়ের দিকে চলে গেলো গাড়ি আনতে। নিঝুম আর সাথী পাশাপাশি বসে আছে রিকশায়। নিঝুমের বিস্ময় এখনো কাটছে না। সে যেটা দেখেছে সেটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না। যেখানে সব শেষ হয়ে গেছে সেখানে নতুন করে স্বপ্ন দেখা তার মানায় না।
হঠাৎ সাথী বললো, আপু রানার বিষয়ে তো কিছুই করলা না।
নিঝুম নিজের হুশে ফিরলো এবার। সাথী কী বলেছে আবার জানতে চেয়ে উত্তরে রোবটের মতো বললো, আমরা এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। রানা চাইলেও আর তোকে বা তিথিকে খোঁজে পাবে না। আর থানায় তোর সব তথ্য দিয়ে রানার নামে একটা জিডি করে রেখেছে বাবা আর অফিসারকে ভালো করে বুঝিয়ে বলে গেছে। ও চাইলেও আর কিছু করতে পারবে না। বাবার থেকে বেশি পাওয়ার ঐ রানার নেই।
নিঝুম সাথীকে পৌঁছে দিয়ে তিথিকে আদর করে অয়নদের বাসায় চলে গেলো। এই বাড়িতে আজই তার শেষ রাত। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ঝলমলে আলোয় চমকাতে থাকা বাড়িটাকে দু-চোখ ভরে দেখলো। এভাবেই তো সেজেছিলো বাড়িটা নিঝুমের আগমনের দিন। অদ্ভুতভাবে তার বিদায় বেলায়ও বাড়িটা সেই রুপেই সেজেছে, শুরু সাজেনি নিঝুম। তার মনটার ভিতরে অন্ধকার বাসা বেধেছে। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখের পানি মুছে বাড়ির ভেতরে পা রাখলো। প্রথমবার পা রেখেছিলো এই বাড়িটায় সারাজীবন কাটানোর স্বপ্ন নিয়ে আর আজ রাখছে রাত পোহালে চিরদিনের জন্য বিদায় নেওয়ার জন্য। খুশি দরজা খোলে দিলে তার দিয়ে তাকিয়ে মুচকি হাসলো নিঝুম। খুশি মেয়েটা আজ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। সে যেনো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য কোনো জিনিস দেখে ফেলেছে। নিঝুম তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে অহনাকে দেখতে পেলো ড্রয়িংরুমের সোফায়।
তার দিকে তাকিয়েও মুচকি হেসে বললো, মা আমি খুব ক্লান্ত। আমার রুমে যাচ্ছি আমাকে আজ আর ডাকবেন না। মা খাইয়ে দিয়েছে আজ আর খাবো না।
অহনা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ভালোবাসার মানুষের বিয়ের খাবার কী আর গলা দিয়ে নামবে ?
নিঝুম অসহায় গলায় বললো, মা আমি ক্লান্ত।
সেটা কী শারীরিকভাবে নাকি মানসিকভাবে ?
উভয় দিক থেকেই প্রচন্ড ক্লান্ত আমি।
বুকে পাথর চেপে হাসির নাটক করলে ক্লান্ত তো হবেই।
নিঝুম আর কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো অহনার দিকে, অহনাও তাকিয়ে রইলো নিঝুমের নিষ্পাপ মুখটার দিকে। অহনার খুব শখ ছিলো একটা মেয়ের। যে খুব দুষ্টু হবে, যার দুষ্টুমিতে অহনা নিজের শূন্যতা ভুলে থাকবে। কিন্তু তার স্বপ্ন ভেঙে তয়নের জন্ম হলো। নিঝুমকে সেদিন প্রথম থেকে অহনার মনে হয়েছিলো এমন একটা দুষ্টু মেয়েই তার চাই। নিজের মেয়ের শূন্যতা পূরণ করার জন্যই অয়নের বউ করে আনা নিঝুমকে। আজ অহনার বড্ড আফসোস হচ্ছে, কেনো সে নিঝুমের জীবনটা জড়িয়েছে অয়নের সাথে। নিঝুমের নিজস্ব সত্ত্বাকে অহনা খুন করেছে নিজের হাতে। নিঝুমের দুষ্টুমিগুলো হারিয়ে গেছে অয়নের অবহেলার স্রোতে। নিঝুম নিজের রুমে চলে গেলো আর অহনা সোফায় বসে আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করতে লাগলো। আর কখনো প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর সামনে দাঁড়াতে পারবে না অহনা। তার একমাত্র কলিজার টুকরো মেয়েকে হাতজোড় করে এনে সামলে রাখতে পারেনি। আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফিরিয়ে দিতে চলেছে। অহনা ডুকরে কেঁদে উঠে নিজের কপাল চাপড়াচ্ছে। নিঝুম গিয়ে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলো বেডে। ফ্রেশ হওয়ার শক্তিটুকুও যেনো নেই শরীরে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো অয়নের মুখ। রাগী চোখে হারানোর ভয় স্পষ্ট ফোটে উঠেছে। নিঝুম চোখ খোলে ফেললো। অয়ন তো তাকে ভালোই বাসে না তাহলে তাকে হারানোর ভয় কেনো পাবে সে ? কিন্তু তখন নিঝুম তার চোখে হারানোর ভয় স্পষ্ট দেখেছে।
নিঝুম নিজের মাথা চেপে ধরে বললো, এটা আমার ভুল। এটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না। অয়ন শুধু নয়নাকে ভালোবাসে আর রাত পোহালেই তাদের বিয়ে আর আমার বিদায়। এটাই সবচেয়ে বড় তিক্ত সত্য।
নিঝুম চোখ বন্ধ করে নিলো আর নোনাজল গড়িয়ে বালিশে গিয়ে পড়লো।
রেগে আগুন হয়ে বাড়ি ফিরলো অয়ন। তখনকার রাগ এখনো কমেনি তার। হলুদের অনুষ্ঠানে সে ছিলো কেবল নামমাত্র। পুরোটা সময় নিঝুমর উদাসীন মুখটা তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। নয়নাকে খারাপ লাগছে বলে চলে এসেছে। খুশি দরজা খোলে দিলে সোজা চলে গেলো নিঝুমের দরজার সামনে।
নিঝুম দরজা খোলো এখনই।
ভেতর থেকে কোনো উত্তর এলো না।
অয়ন দিগুণ রেগে বললো, নিঝুম তুমি দরজা খুলবে নাকি আমি দরজা ভেঙে ভেতরে আসবো ? আর এটা আমাকে করতে হলে তা তোমার জন্য ভালো হবে না।
পেছন থেকে খুশি বললো, ভাবি বললো তার ক্লান্ত লাগছে তাই এসেই শুয়ে পড়েছে। এতোক্ষণে হয়তো ঘুমিয়েও গেছে।
অয়ন রেগে দরজায় একটা লাথি দিয়ে চলে গেলো সামনে থেকে। বাইরে থেকে অয়নের শব্দ আসা বন্ধ হতেই নিঝুম উঠে বসলো। দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখ মুখে পানি দিয়ে কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টা তো ব্যর্থই হয়। ডুকরে কেঁদে উঠলো নিঝুম। পৃথিবীর সামনে সে নিজেকে পাথর সাজিয়ে রাখলেও নিজের কাছে হেরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভালোবাসার মানুষটা অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার থেকে মৃত্যু যন্ত্রণা হয়তো অনেক সহজ। অয়নের সামনে গেলে হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবে না তাই যেতে চায় না সে। নিঝুম নিজের চুল আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।
কাঁদতে কাঁদতে বললো, হে খোদা আর একটু ধৈর্য্য দান করুন আমাকে আর কয়েকটা ঘণ্টা দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দিন।
অনেকটা সময় সেভাবে কাটিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এলো নিঝুম। টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। ফর্সা মুখের চোখ আর নাকটা টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে তার। নিঝুম নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। নয়না কী তার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী ? ফর্সা গোলগাল মুখটায় জোড় ভ্রুর নিচে টানাটানা চোখ, একটু বোচা নাক আর সরু দু’টো গোলাপি ঠোঁট। মাঝে মাঝেই বাবা নাক টেনে বলতো আমার বুচুমণিটা। তার জন্য যেনো বোচা নাকটাই বেশী মানানসই। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল, যে কেউ নিসন্দেহে বলবে নিঝুম অসম্ভব সুন্দরী। তবে হ্যাঁ নয়নার থেকে সে লম্বায় একটু কম।
নিঝুম আবার নিজেই বললো, ভালোবাসা কী বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে হয় ?
টাওয়েল রেখে ড্রায়ার থেকে ঘুমের মেডিসিন বের করে দুটো খেয়ে নিলো। আজ একটায় কাজ হবে না নিঝুমের। তাই দুটো খেয়ে বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
১৭.
একটার পর একটা সিগারেট টেনে যাচ্ছে অয়ন। বিদেশে বড় হওয়ায় সিগারেট আর ড্রিংকস খুব কমন বিষয় ছিলো অয়নের কাছে। তবে বিয়ের পর ধীরে ধীরে এগুলো থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলো অয়ন। বাসায় সিগারেট রাখলে নিঝুম সিগারেটের ভেতরের সব ফেলে, মরিচের গুঁড়ো ভরে রাখতো। দু’টান দিতেই কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ হয়ে যেতো। এলকোহলের সাথে করলার জুস, মরিচের গুঁড়ো আবার কখনো মুলা’র জুস মিশিয়ে রাখতো। এসবের জন্য বাসায় খাওয়া বাদ দিলেও বাইরে ঠিক খেতো। ধীরে ধীরে বাইরেও খাওয়া কমিয়ে দিলো আর একসময় পুরোপুরি বাদ। কিন্তু যেদিন থেকে নয়না ফিরেছে, অয়ন আবার সব খাওয়া শুরু করেছে আর বাধা দেওয়ার জন্য এখন নিঝুমও নেই। বাসায় ড্রিংকস না থাকায় সারারাত সিগারেট টেনে কাটিয়ে দিলো। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে একটা প্রাইভেট কার প্রচন্ড গতিতে এগিয়ে আসছে নিঝুমের দিকে আর নিঝুম উদাসীন হয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। নয়না ফোন দিয়ে বিরক্ত করছিলো বলে ফোন অফ করে রেখেছে। সকালের আলো ফোটাতেই অয়ন গিয়ে হাজির হলো নিঝুমের দরজার সামনে। নামাজ শেষে নিঝুম বাইরে বের হবে এটা তার রোজকার রুটিন। কিন্তু অয়নকে অবাক করে আধঘন্টা পেরিয়ে গেলেও নিঝুম দরজা খুললো না। বাইরে সূর্য তার আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে দিয়েছে।
অয়ন দরজায় আঘাত করে বললো, নিঝুম দরজা খুলো।
এবারও নিঝুমের কোনো সাড়াশব্দ নেই। অয়ন এবার জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলো দরজায়। প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো নিঝুমের। মাথাটা খুব ভাড় মনে হচ্ছে নিজের কাছেই। অহনা নিচে এসে অয়নকে নিঝুমের দরজা ধাক্কাতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো। অয়নের হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো অয়নের গালে৷ অয়ন গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকালো। নিঝুমের যা ঘুম ঘুম ভাব ছিলো বাইরের থাপ্পড়ের আওয়াজে কেটে গেলো। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেলো। এদিকে অহনা রাগে থরথর করে কাঁপছে।
অয়ন অবিশ্বাসের গলায় বললো, মা তুমি আমাকে মারলে ?
অহনা নিজের হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে বললো, হ্যাঁ মারলাম। এই থাপ্পড়টা তোমাকে আরো অনেক আগে দিলে আমাকে আজ এই দিন দেখতে হতো না।
কিন্তু মা আমি কী করেছি ?
সকালবেলা অভদ্রের মতো একটা মেয়েটা রুমের দরজা ধাক্কা দিয়ে বলছো কী করেছি ?
মা নিঝুম আমার স্ত্রী।
অহনা মুখ কুঁচকে বললো, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর তোমার বিয়ে আর এখন ওকে নিজের স্ত্রী বলতে লজ্জা করছে না তোমার ? মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিয়েও শান্তি হয়নি তোমার ? এখানে কেনো এসেছো, কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে ?
মা তুমি আমাকে ভুল বুঝছো ?
একদম চুপ, তোমার আর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না। বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয় বরং একটা পবিত্র সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক তুমি প্রতিনিয়ত অবহেলা করছো। হলাল রেখে হারামের পেছনে ছুটেছো। আমি তোমার মা হয়ে বলছি, যতটা অবহেলা নিঝুমকে করেছো তার থেকে হাজার গুন ভালোবাসা নিয়ে নিঝুমকে পাগলের মতো খোঁজবে তুমি। চিৎকার করে কাঁদবে ওকে ফিরে পাওয়ার জন্য কিন্তু পাবে না। আজ আমিও দেখবো পৃথিবীতে পবিত্র ভালোবাসার, হালাল ভালোবাসার জোর বেশি নাকি অপবিত্র আর হারাম ভালোবাসা জোর বেশি। হালাল চাওয়ার জোর বেশি নাকি হারাম চাওয়ার জোর বেশি। হালাল সম্পর্কের জোর বেশি নাকি হারাম সম্পর্কের জোর বেশি।
অয়ন অবাক হয়ে বললো, মা।
অহনা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, নিঝুমের রুমের আশপাশেও যেনো তোমাকে আমি আর না দেখি। দেখলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না কথাটা মনে রেখো।
অয়ন মাথা নিচু করে চলে গেলো সেখান থেকে। অয়নের ত্রিশ বছরের জীবনে এই প্রথম অহনা তার গায়ে হাত তুললো। প্রথম সন্তান মায়ের কাছে একটু বেশি প্রিয় হয়। যদিও মায়ের কাছে সব সন্তানই সমান হয়, তবে প্রথম সন্তানের মাধ্যমেই সে প্রথম মা হওয়ার স্বাদ গ্রহণ করে তাই প্রথম সন্তান হয় স্পেশাল। অয়নও তার ব্যতিক্রম নয়।
নিঝুম দরজা খোলে অহনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, এটা কী করলেন মা ? আমি উনার সুখের কথা চিন্তা করে এতোকিছু করলাম। আর আপনি মা হয়ে তাকে এমন কথা কেনো বললেন ?
অহনা নিঝুমের মাথায় হাত রেখে বললো, মরীচিকার পেছনে ছুটে কেউ সুখী হয় না রে মা। ও মোহে অন্ধ হয়ে আছে তাই বুঝতে পারছে না কোনটা সত্যি আর কোনটা মরীচিকা। নয়নার চোখে ওর জন্য সেই ভালোবাসা আমি কখনো দেখিনি যা তোর চোখে দেখেছি। আর অয়নের চোখেও নয়নার জন্য সেই অস্থিরতা আমি দেখিনি যেটা তোর জন্য দেখেছি। মানুষের মুখ মিথ্যা বললেও চোখ কখনো মিথ্যা বলে না রে নিঝুম। ছেলেটা একদিন সব বুঝতে পারবে কিন্তু সেদিন হয়তো আর কিছুই করার থাকবে না। তুই রুমে যা আমি খাবার নিয়ে আসছি তোর জন্য।
নিঝুম বললো, আপনিই না গতকাল বললো ভালোবাসার মানুষের বিয়ের খাবার কী আর গলা দিয়ে নামবে ?
অহনা নিঝুমকে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো, তুই তাড়াতাড়ি চলে যা এখান থেকে।
অহনা চলে গেলে নিঝুম বিড়বিড় করে বললো, তুমিও তাড়িয়ে দিচ্ছো। হ্যাঁ চলেই যাবো কিন্তু উনাকে আর একবার বর সাজে দেখে। তখন নিজের বরের সাজে দেখেছিলাম আর আজ নয়না আপুর বরের সাজে দেখবো।
ঘড়ির কাঁটা নিজ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অয়নের কিছু ফেন্ড তাকে বর সাজতে হেল্প করেছে। তবে কেউ মজা করছে না কারণ সবারই নয়নার থেকে নিঝুমকেই পার্ফেক্ট মনে হয় অয়নের জন্য। অয়ন যাওয়ার সময় নিঝুম আড়াল থেকে দু-চোখ ভরে দেখে নিলো শেষবারের মতো। অয়ন নিঝুমের দিকে তাকালে সে আড়ালে চলে গেলো দ্রুত। অয়ন দেখতে পেলো না নিঝুমকে। অয়নরা চলে যেতেই নিঝুম অয়নের রুমে গেলো। দরজায় হেলান দিয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো রুমটা দিকে। রুমের প্রতিটা কোণায় কত কত স্মৃতি জমে আছে। এই রুমটায় একসময় নিঝুমের অধিকার ছিলো, আজ থেকে এটাও অন্যকারো হয়ে যাবে। রুমটা গোছানোর সময় প্রত্যেকটা জিনিস ছুঁয়ে দেখলো নিঝুম। আজ আর চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে না, নিজ হাতে সুন্দর করে সাজাতে লাগলো অয়ন আর নয়নার বাসরঘর। এই দ্বায়িত্বটা সে নিজেই চেয়ে নিয়েছে। বেডে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে অয়নের পাশে নয়নার নামটা লিখতে গিয়ে হাত প্রচন্ড কাঁপছিলো নিঝুমের। সাজানো শেষে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আবার দেখে নিলো রুমটা। নিঝুমের বাসরের থেকেও অনেক সুন্দর হয়েছে আজকের বাসরঘরটা। নয়না বেডে বসলে হয়তো সাজটা পূর্ণতা পাবে। নিঝুম আর দাঁড়াতে পারলো না, অহনার কাছে গেলো। ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে আছে অহনা।
নিঝুম সালাম দিয়ে বললো, আসছি বলতে পারলাম না তাই বললাম যাওয়ার সময় হয়ে গেছে মা। নিজের খেয়াল রাখবেন আর উনারও, ভালো থাকবেন চলি।
অহনা চোখ খুললো না। নিঝুম অহনাকে একবার জড়িয়ে ধরে দৌড়ে বের হয়ে গেলো। নিঝুম যেতেই অহনা ডুকরে কেঁদে উঠলো। বাড়িটা আরো একবার ভালো করে দেখে নিলো আর কখনো যে দেখা হবে না। এই শহরে আর কখনো পা রাখতে চায় না নিঝুম। শেষবার বাড়িটা দেখে ট্যাক্সি করে সোজা এয়ারপোর্টে চলে গেলো। মা, সাথী আর তিথি তার জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে।
১৮.
বলুন বাবা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
নয়না অনেক আগেই কবুল বলে দিয়েছে কিন্তু অয়ন উচ্চারণ করতে পারছে না শব্দটা। মনে হচ্ছে কেউ গলা চেপে ধরে রেখেছে। এতোটা কষ্ট তো নিঝুমের সাথে বিয়ের সময় কবুল বলতে হয়নি তার। তখন তো সে নিজের ভালোবাসা নয়নাকে রেখে নিঝুমকে বিয়ে করেছিলো। তবে আজ এতোটা কষ্ট কেনো হচ্ছে ? চোখের সামনে নিঝুমের দুষ্টুমিগুলো ভাসছে, তার নোনাজলে ভেজা চোখ অয়নকে যেনো বলছে আপনি আমার সাথে এতোবড় অন্যায় করতে পারেন না। নিঝুমের নির্লজ্জের মতো বারবার বলা ভালোবাসি শব্দটা কানে বাজছে অয়নের। এদিকে কাজি সাহেব বারবার তাড়া দিচ্ছে কবুল বলার জন্য, আশপাশের সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। হঠাৎ পাশ থেকে নয়না অয়নের হাতটা ধরলো শক্ত করে। অয়ন পাশ ফিরে নয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে অয়নের দিকে। মুহূর্তেই নয়নার মাঝেও নিঝুমের মুখটা ভেসে উঠলো অয়নের চোখে।
চলবে,,,,