মরিচাধরা_মনের_খাঁচা,পর্বঃ ১১,১২

0
811

#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা,পর্বঃ ১১,১২
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১১

এলোমেলো পায়ে রুমে গেলো অয়ন। রুমটা দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো৷ এখনো কত সুন্দর করে সাজানো রুমটা। অয়ন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বেডের দিকে৷ নিজের নামের পাশে নয়নার নামটা দেখে চোখ ভড়ে উঠলো নোনাজলে। এই একটা ভুলের জন্য আজ তার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। অয়ন খুব সাবধানে নয়নার জায়গায় নিঝুমের নাম লিখে দিলো। তারপর বেড থেকে নেমে দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে বসলো।

২১.
অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট নিঝুম। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভার্সিটি চেঞ্জ করার জন্য বেশ অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। সারাবছরও তেমন একটা পড়াশোনা হয়নি। মানসিক যন্ত্রণার সাথে লড়ে, পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। আজই প্রথম ভার্সিটি গিয়েছিলো। মনে হচ্ছে টিউশন ছাড়া খুব বাজে অবস্থা হবে রেজাল্টের।

নিঝুম ডিনারের সময় বললো, বাবা আমার একটা টিউটর প্রয়োজন। রেজাল্টের অবস্থা নাহলে খুবই খারাপ হয়ে যাবে।

নিয়াজ মুচকি হেসে বললো, ঠিক আছে আমি দেখছি।

সাথীর জন্যেও প্রয়োজন। দু’জনকেই যাতে সময় দিতে পারে এমন কাউকেই দেখো।

নিয়াজ সাথীর দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলে ?

সাথী মাথা নিচু করে বললো, নাইনে উঠার পরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো মা।

আচ্ছা তোমাকেও ভর্তি করে দিবো। ক্লাস করার প্রয়োজন নেই, বাড়িতে পড়েই এসএসসি পরীক্ষা দাও। কলেজে ভর্তি হয়ে গেলে ক্লাস করো।

সাথী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো নিয়াজ চৌধুরীর দিকে। সাথী বাবা মারা গেছে সাথী তখন অনেক ছোট। মা মানুষের বাড়ি কাজ করে তাও এতটুকু পড়াতে পেরেছিলো। বাবার ভালোবাসা পাওয়া হয়নি সাথীর।

নিয়াজ সাথীর মাথায় হাত রেখে বললো, আমার নিঝুম মাকে আমি খুব ভালোবাসি। সে যখন তোমাকে নিজের বোনের জায়গা দিয়েছে, আমরা তাহলে কীভাবে মুখ ফিরিয়ে নিবো।

সাথীর কোল থেকে হঠাৎ কেঁদে উঠলো তিথি। নিয়াজ তিথির মাথায় হাত রেখে বললো, নানুভাই তুমি কবে স্কুলে যাবে ?

তিথি কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো নিয়াজের দিকে। তা দেখে সবাই হেসে উঠলো। তিথির দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নিঝুম। সেটা সবার চোখে না পরলেও সাথীর চোখে ঠিক পড়লো। সাথী এখন নিঝুমের সম্পর্কে সবই জানে৷ নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে সাথী দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। সাথীর কাছে এখন মনে হয়, তার থেকে বেশি অসহায় নিঝুম। খাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেলো। নিঝুম একটা চাদর জড়িয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলো। কুয়াশা দখল করে নিয়েছে চারপাশটা। বেলকনির বাইরে সাদা কুয়াশা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা বরাবরই ভালো লাগে নিঝুমের। তাই উপভোগ করতে লাগলো সময়টা। স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আবছা কুয়াশায় অয়নের সাথে কাটানো মধুর স্মৃতি। অয়নদের বাড়ির পেছনে একটা জলপাই গাছে আছে। ফজরের নামাজ পড়ে কুয়াশা ঘেরা সকালে জলপাই কুড়াতে খুব ভালো লাগতো নিঝুমের। একদিন মনে হলো অয়নকে নিয়ে যাওয়া যাক। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, কনকনে শীত তখন। ফরজের নামাজ পড়ে ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছিলো অয়ন। নিঝুম নিঃশব্দে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।

মিনমিনে গলায় বললো, শুনুন না।

হঠাৎ করে কথা বলায় অয়ন একটু চমকে উঠলো। পা পিছলে যেতে নিলে নিজেকে সামলে নেয়।

রাগী গলায় বললো, এখনই তো পড়ছিলাম তোমার জন্য।

যাহ্ বাবা আমি আবার কী করলাম ?

এভাবে ভূতের মতো পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছো কেন ?

কোথায় ভূতের মতো দাঁড়ালাম ? আচ্ছা বাদ দিন, একটা কথা বলার ছিলো।

কান খোলা আছে, না চাইলেও শুনতে পাবো।

নিঝুম মুখ ভেংচি কাটলো অয়নের কথা শুনে। কারণ অয়ন সবসময় এভাবে ত্যাড়াভাবে কথা বলে তার সাথে।

ভেংচি কাটা বন্ধ করে যেটা বলতে এসেছিলে সেটা বলো।

নিঝুম চমকে উঠলো অয়নের কথা শুনে। সে বুঝলো কীভাবে, নিঝুম ভেংচি কেটেছে। জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই মনে পড়ে গেলো সামনে কাঁচের দেয়াল।

তাই ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে বললো, বাড়ির পেছনের জলপাই গাছে না ? সেটায় অনেক জলপাই হয়েছে।

অয়ন ট্রেডমিল থেকে নেমে ভ্রু কুঁচকে বললো, তো ?

নিঝুম উৎফুল্ল হয়ে বললো, সকালে অনেক জলপাই গাছের তলায় পড়ে থাকে।

অয়ন আগের ভঙ্গিতে বললো, তো ?

নিঝুম চোখ বন্ধ করে একটা ঢোক গিলে বললো, লবণ মরিচ দিয়ে জলপাই কামড়ে খেতে যা লাগে না। চলুন না কুড়িয়ে নিয়ে আসি।

অয়ন নাক ছিটকে বললো, তুমি জলপাই কুড়িয়ে খাবে ? দারোয়ানকে বললে এমনই পেরে দিবে আর তাছাড়া বাজারে কত কিনতে পাওয়া যায়।

নিঝুম মুখ ফুলিয়ে বললো, কুড়িয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা।

অয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। নিঝুম তা দেখে ভয়ে ঢোক গিললো।

এই নিয়ে কতদিন কুড়িয়ে এনে খেয়েছো ?

নিঝুম আমতা আমতা করে বললো, যেদিন থেকে গাছে জলপাই দেখেছি।

অয়ন বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। নিঝুম ভয় সাইডে রেখে অয়নের হাত ধরে টেনে নিয়ে বললো, চলুন তো।

অয়ন কিছু বলার সুযোগ পেলো না। বাড়ির বাইরে পা রাখতেই বাইরের ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগলো। অয়ন শুধু কালো রঙের একটা সেন্টু গেঞ্জি পরে আছে।

নিঝুম হঠাৎ বলে উঠলো, আপনি দাড়ান আপনার জন্য একটা চাদর নিয়ে আসি। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা পরেছে।

অয়ন গম্ভীর গলায় বললো, লাগবে না।

নিঝুম মনে মনে বললো, লাগবে না তো ? আজ ঠান্ডায় মজা বুঝবে বাছাধন।

মুখে বললো, চলুন চলুন।

কুয়াশায় তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অয়ন টাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিঝুমের সাথে যেতে লাগলো। মুলত অয়ন দেখতে চায় নিঝুম কী কী করে বেড়ায়। তাই নিঝুম জোর করায় সে বাঁধা দেয়নি। গাছের নিচে এসে নিঝুম জলপাই খুঁজতে লাগলো। বাড়ির বাউন্ডারি ঘেঁষে জলপাই গাছটা। গাছের নিচে সবুজ ঘাঁস। অয়ন গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলো গাছ ভর্তি বড় বড় জলপাই। এই গাছ নিয়ে তার কোনো ধারণাই ছিলো না। অথচ নিঝুম ঠিক খোঁজে বের করেছে।

নিঝুম চেঁচিয়ে বলে উঠলো, পেয়েছি।

নিঝুমের হাতে একটা জলপাই দেখতে পেলো অয়ন। নিঝুমের কান্ড দেখে আড়ালে হাসলো। নিঝুমের অনেক আচরণই বাচ্চাদের মতো। কথায় আছে এক বাবার এক মেয়ে একটু বেশি আহ্লাদী হয়। নিঝুম তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

অয়ন নিজের হাতে হাত ঘঁষে বললো, ঠান্ডা লাগছে, পেয়েছো তো এবার চলো।

নিঝুম বললো, কেবল তো একটা পেয়েছি। আপনাকে আগেই বলেছিলাম একটা চাদর নিয়ে আসি, শুনলেন না। আপনি চাইলে আমার সাথে চাদর শেয়ার করতে পারেন।

নিঝুমের কথা শুনে অয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তা দেখে নিঝুম ঘাসের মাঝে আবার জলপাই খুজতে লাগলো। অয়ন দেখতে লাগলো নিঝুমকে।

বিড়বিড় করে বললো, পাগলী একটা।

ধীরে ধীরে অয়নের শীত বাড়তে লাগলো। একটু পর নিঝুম পাশে এসে বললো, হয়ে গেছে চলুন।

কয়টা পেয়েছো দেখি।

নিঝুম নিজের হাতের মুঠো খোলে দেখালো অয়নকে। আট দশ-টা বড় বড় জলপাই দু’হাতের মুঠোয়। জলপাইয়ের সাথে ঘাসের ময়লা লেগে আছে।

তা দেখে অয়ন নাক কুঁচকে বললো, নোংরা মেয়ে একটা।

নিঝুম নাক ফুলিয়ে বললো, আমি কী না ধুয়ে খেয়ে নিবো নাকি ?

অয়ন এগিয়ে গেলে নিঝুম বললো, একটা জিনিস দেখবেন ?

পেছন ফিরে তাকিয়ে অয়ন বললো, কী দেখবো ?

জুতো খোলেন।

অয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো, জুতো খুলতে যাবো কেনো ?

আগে খুলুন তারপর বলছি।

অয়ন জুতো খোলে ঘাঁসে পা রাখতেই গা শিরশির করে উঠলো।

নিঝুম মুচকি হেসে বললো, কেমন লাগলো ?

এর আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয়নি অয়নের। তাই অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করলো মনে।

এবার হাঁটুন, দেখবেন কেমন ভালো লাগে।

অয়ন ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। প্রত্যেকটা কদমে গা শিরশির করে উঠছে। নিঝুম জলপাইগুলো একহাতে নিয়ে অয়নের কাছে গিয়ে নিজের গায়ের চাদর অর্ধেক চাদর অয়নের গায়ে দিলো। অয়ন ফিরে তাকালো তবে কিছু বললো না। মাঝে কিছুটা দুরত্ব রেখে পাশাপাশি হাটতে লাগলো। অয়নেরও অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করছে মনে। অনেকটা সময় এভাবে হাটলো দু’জনে। হঠাৎ অয়নের হাত টেনে জলপাইগুলো তার হাতে দিকে নিঝুম।

অয়ন কিছু বলার আগেই বললো, আপনি এগুলো নিন আমি জুতো দু’জোড়া নিয়ে আসছি।

অয়নের উত্তরের অপেক্ষা না করেই দৌড়ে জুতো আনতে চলে গেলো নিঝুম। অয়ন মাঝে মাঝে অনেক বেশি অবাক হয় নিঝুমের কাজে। দু’জনে ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। অন্যদিনের থেকে আজকের সকালটা সুন্দর লাগছে অয়নের কাছে৷ কারণটা জানা নেই। শুক্রবার তাই অফিস নেই, ব্রেকফাস্ট করে রুমে বসে কাজ করছিলো ল্যাপটপে।

নিঝুম রুমে এসে বললো, খা করুন তো ?

অয়ন ভ্রু কুঁচকে কেনো বলার জন্য মুখ খুলতেই নিঝুম একটা জলপাই ঢুকিয়ে দিলো অয়নের মুখে। নিঝুম জানে অয়ন একদমই টক খেতে পারে না। জলপাইয়ে কামড় লাগতেই মুখ কুঁচকে চোখ বন্ধ করে ফেলে অয়ন। তা দেখে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায় নিঝুম।

পুরনো স্মৃতি মনে করে আনমনে হেসে উঠলো নিঝুম আর মুহুর্তেই বাস্তবে ফিরে এলো। হাসি মিলিয়ে চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো নিঝুমের। চোখ বন্ধ করলে আজও সব জীবন্ত মনে হয়। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় ঐ তো অয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিন্তু চোখ খুলতেই চারদিকে কেবলই শূন্যতা। দু-হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো নিঝুম।

ভেজা গলায় বললো, কেনো এমন হলো অয়ন ? আপনি কেনো একটু ভালোবাসতে পারলেন না আমাকে, কেনো,,?

২২.
অন্ধকার রুমে দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে অয়ন ৷ কানে বারবার অহনার বলা কথা বাজছে। নিঝুম কখনো মা হতে পারবে না। কোথায় তবু তো একটু পরিবর্তন হয়নি মনের। মন বলছে কত মানুষই তো আছে যাদের সন্তান নেই। একে অপরের হাত ধরে সারাজীবন পাশাপাশি থাকতে পারলেই খুশি অয়ন। না এভাবে বসে থাকলে হবে না৷ নিঝুমকে খুজতে হবে। উঠে দাঁড়ালো অয়ন, গতকাল থেকে কিছুই পেটে পড়েনি, উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে গেলো। শারীরিক দূর্বলতা আর মানসিক যন্ত্রণার কাছে হার মেনে সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো সে। মাথায় আঘাত পেলো বেডের কর্ণারে লেগে। একটু একটু করে সাদা ফ্লোর লাল হতে লাগলো তার রক্তে। কেউ না দেখলে বিপদ হতে সময় লাগবে না খুব একটা।

চলবে,,,,

#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১২

পিটপিটিয়ে চোখ খোলে তাকালো অয়ন। সব ঝাপসা লাগছে তাই চোখ বন্ধ করে আবার খুললো। ধীরে ধীরে এবার সব পরিষ্কার হয়ে এলো। আশপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সে হসপিটালে আছে। মাথা ব্যাথা করে উঠলে হাত দিয়ে বুঝলো ব্যান্ডেজ করা। গতরাতের সব মনে পরে গেলো ধীরে ধীরে। হাত ভারী মনে হলে তাকিয়ে দেখে কেউ হাত ধরে ঘুমিয়ে আছে।

অয়ন অবাক কণ্ঠে বললো, তয়ন ?

হালকা আওয়াজেই ঘুম ভেঙে গেলো তয়নের। অয়নকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ব্যস্ত গলায় বললো, এখন কেমন লাগছে ভাইয়া ?

অয়ন আগের মতোই অবাক কণ্ঠে বললো, তুই এখানে ?

গতরাতেই এসেছি, ভেবেছিলাম তোকে, মাকে আর ভাবিকে সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু এসে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম। মায়ের কাছে সব শোনে তোর রুমে গিয়ে দেখি সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছিস। আশপাশটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি হসপিটালে আনা হয়েছে বলে বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেছিস।

অয়ন ছোট করে বললো, ওহ্।

তয়ন বললো, তুই এমন একটা ভুল কীভাবে করলি ভাইয়া ?

আবেগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

তোকে আমি আগেই বলেছিলাম নয়নাকে তুই কখনো ভালোবাসিসনি। হ্যাঁ নয়নার পার্সোনালিটি তোর ভালো লাগতো ব্যস এটুকুই। মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে কখনো অন্যের পাশে সহ্য করতে পারে না। আর সেখানে নয়না সারাদিন ছেলে ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরে বেড়াতো। তোর কোনো হেলদোল ছিল না তা নিয়ে।

অয়ন কিছু না বলে চুপ করে রইলো। তয়ন বুঝতে পারলো অয়নের মনের অবস্থা।

তাই কথা ঘুরিয়ে বললো, বাদ দে সেসব। এখন কেমন লাগছে সেটা বল ?

অয়ন বললো, ভালো।

তয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো অয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে। মাত্র তিন দিনে কী হাল হয়েছে অয়নের।

মা কোথায় তনয় ?

মাকে অসুস্থ লাগছিলো দেখতে, তাই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আর ডক্টর বলেছে সকালেই তোকে ডিসচার্জ করে দিবে, আঘাত খুব একটা গভীর না।

সকাল হবে কখন ? এখানে ভালো লাগছে না।

একটু আগেই ফজরের আযান হয়েছে। সকাল হতে দেরি নেই খুব একটা।

অয়ন ক্লান্ত ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে নিলো আবার। তয়ন উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। সকালে ডক্টর ডিসচার্জ করে দিলো অয়নকে। বাড়ি গিয়ে অয়ন শাওয়ার নিয়ে নিলো। দু’দিন হয়ে গেছে শাওয়ার নেওয়া হয় না, খাবার খাওয়া হয় না। মাত্র কয়েক ঘন্টায় অয়নের জীবন পুরো পাল্টে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে অয়ন আদৌও বাঁচবে কিনা কে জানে।

শাওয়ার নিয়ে বের হতেই দেখে তয়ন বসে আছে তার বেডে।

অয়নকে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে বললো, তুই শাওয়ার নিয়েছিস কেন ভাইয়া ?

দু’দিন ধরে শাওয়ার নেওয়া হয় না। নিজের গায়ের গন্ধে নিজেরই বমি পাচ্ছে।

অয়নের কথা শুনে মুখ টিপে হাসলো তয়ন। অয়ন বরাবরই একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ।

অয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো, হাসছিস কেনো তুই ?

তয়ন শব্দ করে হেসে উঠে বললো, তোর মতো খুঁতখুঁতে মানুষ দু’দিন পর গোসল করলো। সত্যি ভাবা যায় এটা, তুই বল ?

তোর সাথে মজা করার মতো ইচ্ছে আমার একটুও নেই। এখানে কেনো এসেছিস সেটা বল ?

মা ব্রেকফাস্ট করতে ডাকছে।

আমি খাবো না তুই যা। আমাকে এখন বের হতে হবে।

আজ না খেলে তিনদিন হবে তোর পেটে কিছু পড়েনি। সারারাত স্যালাইন চলেছে তাই এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিস। তবে আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়তে খুব একটা সময় লাগবে না।

অয়ন কিছু না বলে মাথার ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করতে গেলে তয়ন এগিয়ে গেলো।

দে আমি করে দিচ্ছি।

ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করে ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেলো দু’জনে। অয়ন কোনোমতে একটু খেয়ে উঠে গেলে অহনা বললো, কোথায় যাচ্ছো ?

নিঝুমকে খুঁজতে।

তোমার শরীর ঠিক নেই এখন। রুমে গিয়ে রেস্ট নাও কোথাও যেতে হবে না।

আমি ঠিক আছি।

অহনা এবার রেগে বললো, তোমার কী মনে হয়, এমন উদভ্রান্তের মতো খুজলে ওকে তুমি পেয়ে যাবে ?

অয়ন রেগে বললো, তাহলে কী করবো আমি ? তুমি জানা সত্বেও বলছো না ও কোথায় আছে। এখন কী করতে পারি আমি, তুমি বলো ?

তয়ন খাবার নাড়তে নাড়তে বেশ শান্ত গলায় বললো, অতিরিক্ত চাপে তোর বুদ্ধি লোপ পেয়েছে ভাইয়া।

অয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো, মানে ?

ভাবি নিশ্চয়ই বাতাসে মিলিয়ে যায়নি। আর এই শহরে নেই সেটাও তুই নিশ্চিত হয়েছিস। এই শহর থেকে বের হতে সে নিশ্চয়ই বাস, ট্রেন, প্লেন কোনো একটা অবশ্যই ব্যবহার করেছে। সেদিনের সব জায়গার যাত্রী লিস্ট চেক করতে পারিস। অথবা আঙ্কেলের অফিসে খোঁজ নিতে পারিস তার টান্সফার কোথায় হয়েছে। সেটা জানতে পারলে সব আরো সহজ হয়ে যাবে। তুই এসব না করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভাবিকে খুঁজছিস।

অয়ন আজ বুঝতে পারলো তারাহুরো করে মানুষ সহজ পথটাও কঠিন করে ফেলে।

তয়নের দিকে তাকিয়ে বললো, ধন্যবাদ।

অয়ন আবার বাইরের দিকে যেতে থাকলে তয়ন বলল, দাঁড়া আমিও আসছি, তোর সাথে।

তয়নও খাবার ফেলে ছুটলো অয়নের পেছনে। অহনা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো কেবল। অয়ন আগে নিঝুমের বাবার অফিসে চলে গেলো। কোথায় বদলি হয়েছে জানতে চাইলে প্রথমে মানা করতে দেয় বলতে। অয়নের পরিচয় জানার পর আর একটু পকেট গরম হতেই গরগর করে সব বলে দিলো।

মিস্টার চৌধুরী হঠাৎ করে বদলি কেনো নিলেন বুঝতে পারছি না। আর এটাও বলে গেছে উনি কোথায় আছে এটা যেনো কাউকে বলা না হয়।

অয়ন কাঁপা গলায় বললো, কোথায় আছেন উনি ?

লোকটা টাকার দিকে তাকিয়ে হলদেটে দাঁত বের করে হেসে বললো, সিলেট জেলায় আছে। সিলেটে আমাদের অফিসে খোঁজ নিলেই সব জানতে পারবেন।

অয়ন যেনো অমাবস্যার রাতে এক চিলতে আলো খোঁজে পেলো। তয়নের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিলো। অয়ন লোকটাকে ছোট করে ধন্যবাদ বলে অফিস থেকে বের হয়ে এলো।

বাইরে এসে তয়ন বললো, এবার কী করবি ?

অয়ন হাসি মুখে বললো, সিলেট যাবো আর সেটা আজই। তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।

তয়ন বাঁকা হেসে বললো, ঠান্ডা মাথায় ভাবলে এটা অনেক আগেই তোর মাথায় আসতো। কিন্তু তুই তো বউ হারানোর শোকে দেবদাস হয়ে গিয়েছিলি।

অয়ন ভ্রু কুঁচকে তাকালো তয়নের দিকে। তা দেখে তয়নের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। তয়নকে ভয় পেতে দেখে অয়ন নিজেই হেসে ফেললো।

তয়ন বললো, চল আগে বাড়ি চল।

তার আগে এক জায়গায় যেতে হবে।

তয়ন অবাক হয়ে বললো, কোথায় ?

ডিভোর্স ক্যান্সেল করতে।

আর একবার ভেবে নে ভাইয়া। নিঝুম ভাবি কিন্তু কখনোই মা হতে পারবে না। পরে আবার যদি আফসোস করিস তাহলে ভাবি অনেক কষ্ট পাবে।

অয়ন মুচকি হেসে বললো, আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই। আমার পাশে শুধু নিঝুম থাকলেই হবে।

তয়ন মুগ্ধ হয়ে তাকালো অয়নের দিকে। সব জানার পর অয়নের উপর যতটা রাগ হয়েছিলো এখন ততটাই গর্ব হচ্ছে নিজের ভাই বলে। অয়ন আগে এডভোকেটের কাছে গিয়ে ডিভোর্স ক্যান্সেল করার সব ব্যবস্থা করে ফেললো৷ পেপার যেনো নিঝুমের কাছে পাঠানোর না হয় সেটা নিশ্চিত করে বাসায় ফিরে গেলো। বাসায় গিয়েই নিজের ব্যাগ গুছানো শুরু করে দিলো।

অহনা তয়নকে বললো, অয়নকে এতো খুশিখুশি মনে হচ্ছে কেনো ?

ভাবির খোঁজ পেয়ে গেছে তাই।

কোথায় আছে নিঝুম ?

তয়ন অবাক হয়ে বললো, তার মানে তুমি সত্যি জানো না ভাবি কোথায় আছে ?

অহনা মলিন হেসে বললো, জানি না। জানতে চাওয়ার সাহস বা অধিকার কোনোটাই ছিলো না।

সিলেট আছে ভাবি।

সত্যি বলছো তুমি তয়ন।

হ্যাঁ মা একদম সত্যি। উনার বাবা সিলেট আছে মানে উনিও সিলেট আছে এটা সিউর।

অহনাকে কথাটা বলে তয়ন অয়নের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।

অয়নকে জামাকাপড় গোছাতে দেখে বললো, আমি এতবড় উপকার করলাম এখন আমাকেই ফেলে চলে যাচ্ছিস ?

অয়ন অবাক হয়ে বললো, তুই যাবি ?

না নিলে কীভাবে যাবো বল ?

নিবো না কেনো ? তুইও তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নে।

কীভাবে যাবি গাড়িতে নাকি ফ্লাইটে ?

আমার এতো সময় সহ্য হবে না তাই ফ্লাইটে যাবো।

তয়ন মুখ ফুলিয়ে বললো, গাড়ি নিয়ে চল না। লং-ড্রাইভে
যাওয়াও হয়ে যাবে। আর তাছাড়াও সবুরের ফল নাকি মিষ্টি হয়।

তয়নের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়ে গেলো অয়ন।

তয়ন বললো, তাহলে এখন না। রাতে রওনা হয়ে যাবো আর সকালের মধ্যে পৌঁছে যাবো ইনশাআল্লাহ। এখন চল কিছু শপিং করে আসি। ভাবির রাগ ভাঙানোর জন্য কিছু তো লাগবে তাই না।

এটা কিন্তু ঠিক বলেছিস।

তয়ন বেশ স্টাইল নিয়ে বললো, ইমদাদুল আহমেদ তয়ন কখনো ভুল কিছু বলে না।

অয়ন একটা থাপ্পড় মারলো তয়নের মাথার পিছনে আর তারপর দুইভাই চললো শপিং করতে।

২৩.
কী হলো আপু, এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে ?

সাথীর কথায় চমকে উঠলো নিঝুম। ভার্সিটি গিয়েছিলো কিন্তু একটা ক্লাস করেই ফিরে এলো। গতরাতে অয়নকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে সকাল থেকে। বারবার ইচ্ছে করছে একটা কল দিয়ে অয়নের খোঁজ নিতে। কিন্তু কিছুতেই করে উঠতে পারছে না। যদি তার ফোন করা নিয়ে নয়না আর অয়নের মাঝে কোনো ঝামেলা হয় সেটা ভেবে। ভার্সিটিতে এমনিতেই সে নতুন, কাউকে চিনে না। তাই আরো বেশী বিরক্ত লাগছিলো সবকিছু।

কী হলো আপু কিছু বলছো না যে ?

নিঝুম ক্লান্ত গলায় বললো, ভালো লাগছিলো না তাই চলে এলাম। মা কোথায়, মাকে দেখছি না যে ?

মায়ের মাথা ব্যাথা করতাছে তাই মেডিসিন খাইয়া ঘুমাইছে একটু আগে।

নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বললো, তোর এই জগাখিচুরির কথা ঠিক হবে কবে ?

সাথী বোকা হেসে বললো, চেষ্টা করছি তো।

তিথি কোথায় ?

বেডে খেলনা দিয়ে বসিয়ে রেখেছি। রান্না করতে হবে তো তাই।

নিঝুম বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললো, তুই ওকে রুমে একা রেখে, কিচেনে কাজ করছিলি ?

সাথী মুখ কাচুমাচু করে বললো, হ্যাঁ।

নিঝুম রেগে বললো, তোর একটু জ্ঞান বুদ্ধি কবে হবে বলতো সাথী ? যদি বেড থেকে নিচে পরে যায়।

নিঝুম তাড়াতাড়ি সাথীর রুমে গিয়ে দেখে তিথি ভদ্র মেয়ের মতো পুতুল দিয়ে খেলছে। নিঝুম তাকে কোলে তুলে কপালে চুমু খেলো। বুকে জড়িয়ে নিলো শক্ত করে।

দরজায় দাঁড়িয়ে সাথী সবটা দেখে বিড়বিড় করে বললো, আমার থেকে তুমি হয়তো ভালো মা হতে পারবে। আমার যদি বেঁচে থাকার একটা সম্বল থাকতো তাহলে ওকে তুলে দিলাম তোমার হাতে ।

নিঝুম তিথিকে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো আর সাথী দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আবার কিচেনের দিকে গেলো। তিথিকে কোলে নিয়ে নিঝুমের অস্থিরতা যেনো অনেকটাই কমে গেলো। আজকাল তিথিকে বুকে নিলে খালি বুকটা ভরা ভরা মনে হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সাথীর কাছে তিথিকে চেয়ে নিতে। কিন্তু সাহস হয়ে উঠে না কখনো।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here