মাধবীলতা,৩য় পর্ব

0
1228

মাধবীলতা,৩য় পর্ব
-ঈপ্সিতা শিকদার

লতা বেগম নাতিকে নিয়ে বাসায় ঢুকতেই শুনতে পায় পুত্রবধূর চাপা কান্নার আওয়াজ ও চেঁচামেচির। বুক মুচড়ে উঠে। ছেলেটা নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরেছে, আর সব শুনে তো তাঁকেই বকবে। একজন প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন তিনি, যেখানে সেখানে কান্না তাঁর আত্মসম্মানেই আঘাত করে। নিতান্তই এ কারণে কাঁদলেন না, নাহলে ভয়ে আঁখিজোড়ায় জমিত নোনাজলের মেঘের বৃষ্টি হয়ে নামতে দেরি হত না।

নিজেকে শক্ত রাখার অদম্য প্রয়াস তাঁর। কিছুই শুনেননি এমন একটা ভঙ্গিমায় নাতি আয়াশকে নিয়ে নিজের ছোট্ট ঘরটায় ঢুকেন তিনি।

এদিকে কল্যাণী লতা বেগমের ঢুকার আভাস পেয়ে আরও তেঁতে উঠল। স্বামীর দিকে পাশে থাকা চাবিরতোড়াটা ছুড়ে মেরে বলল,

“দেখলে এসেছো তোমার মা? আমি যে কাঁদছি তা শুনে একবারও আসলো আমার ঘরে? তার তো মনে রঙ লেগেছে আমাকে কষ্ট দিতে পেরে ডাইনি বুড়ি একটা!”

“আরে বাবা থামো। আমি বুঝাচ্ছি মাকে। তুমিও বা মাকে বলতে গেলে কেন শুধুমাত্র একটা মলম কেনায়!” বিরক্তির রেশ জয়ের কণ্ঠে।

“ওহ্! তাহলে মায়ের জন্য একবারে জ্বলে যাচ্ছে এখন! আমার স্বামীর টাকা সে না বলে নিলে এখন আমি কিছু বলতেও পারব না। তবে দাও আমার কাবিনের পাঁচ লক্ষ টাকা, চলে যাই আমি ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি।”

মুখবন্ধ হয়ে যায় জয়ের। এই জায়গাতে বেশ দুর্বলতা তার, একেবারে জবানবন্দী দশা। শুকনো ঢোক গিলে বলে,
“আরে রাগ করছো কেন কল্যাণী? আমি কী বলেছি তোমার দোষ? আমি বলতে চাচ্ছি মা বয়স্ক মানুষ, তার সাথে এসব নিয়ে বাজানোর দরকার নেই তো।”

রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল কল্যাণী। চোখ দিয়েই যেন ধ্বংস করে দিবে। তা দেখে তাড়াতাড়ি কল্যাণীর উপর থেকে চোখ সরিয়ে নেয় জয়। “মা! মা!” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে বসার ঘরে এসে দাঁড়ায়। পিছন পিছন কল্যাণীও আসে।

ছেলের গর্জনে যেন কেঁপে উঠেন লতা বেগম। হিমশীতল হয়ে উঠেছে তাঁর গোটা দেহ। ধীর পায়ে বসার ঘরে আসে সে।

বহু কষ্ট মুখে খুলে বলেন,
“ডাকছিস আমাকে?”

“তুমি কল্যাণীকে থাপ্পড় মেরেছো কেন? কিছু হলে আমাকে বলতে গায়ে হাত তুলা কেমন বিষয় আবার!”

“চড় মেরেছি সেটা বলেছে তোর স্ত্রী। কেন চড় মেরেছি সেটা বলেনি? তোর বউয়ের কত বড় স্পর্ধা আমাকে চোর বলে!”

“না বলে কিছু নিলে সেটা চুরিই হয়। চুরি করসেন, চোর বলব না তো কী মহীয়সী নারী বলব? নিজে দোষ করে আপনি কি না আমাকে চড় মারলেন!”

“দেখ তোর বউ তোর সামনেই আমাকে…”

তাকে বলতে না দিয়েই তার ছেলে বিরক্তির সুরে বলল,

“আহ্-হা! এত প্যাঁচাচ্ছো কেন? ও নাহয় রাগের মাথায় একটা কথা বলেই ফেলেছে। তুমি একটু সয়ে নিতে পারলে না? আর ও তো এমনি এমনি বলেনি, তুমি না বলে নিয়েছো বলেছে। তোমার লাগলে তুমি বলেই নিতে।”

আজ ভীষণ বাজে হতাশ হলেন লতা বেগম। তাঁর আজ অতিরিক্তই আশা ছিল যে ছেলেটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। মনে মনেই বললেন,
“ছেলেটাকে আমি আসলেই পেটে ধরেছিলাম তো? নাহলে মায়ের সম্মানে আঘাত, তার অপমান এতটাই বা কারো সয় কী করে?”

কিছু না বলেই সম্মোহিত স্থান ত্যাগ করলেন তিনি। জয়ও কল্যাণীকে অনেক রস মাখানো কথা বলে ঘরে নিয়ে যায়। লতা বেগমকে স্বামীর অপদস্থ করতে পেরে কল্যাণীর মুখশ্রীতেও বিজয়ীর হাসি।

___

মাধবী ঘরে এপার্টমেন্টে পা রাখতেই দেখল তার দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে সায়েম। হয়তো তার জন্য অপেক্ষারত। অপেক্ষা করবে নাই বা কেন? মাত্রাতিরিক্ত প্রিয় মাটাই যে থানায় বন্দী।

সে ব্যাগ থেকে দরজার চাবি বের করে কাউকে দেখেনি এমন একটা ভান করে এগিয়ে যায়। সায়েমের সামনে দাঁড়িয়েই দরজার তালা খুলতে শুরু করে।

সায়েম মাধবীকে খেয়াল করে উত্তেজিত গলায় বলল,
“এখন এসেছো তুমি!”

“না, এখনো আসি নাই। রাস্তায় হাঁটছি।”

“এতটা স্বাভাবিক কী করে তুমি! আমার মা জেলে বন্দী তোমার জন্য। তোমার একটুও অনুতাপ আছে তা নিয়ে!”

“না, সে তার কর্মের জন্য জেলে বন্দী। আর হ্যাঁ, তোমার মাকেও ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম ভদ্র মানুষের বাড়িতে এসে ভদ্র হয়ে কথা বলতে, তোমাকেও বলছি।”

বলতে বলতেই দরজাটা খুলে বাচ্চাদের নিয়ে ফ্ল্যাটের ভিতরে প্রবেশ করে মাধবী। তার সাথে সাথে সায়েমও ঢুকে। তবে এবার তার আচারণ বেশ শান্ত। সে বেশ বিনীত কণ্ঠে শুধায়,

“তুমি প্লিজ নিজের কেসটা উঠিয়ে নেও। দুপুর গড়ালেই আজ আর বাড়ি আসতে পারবে না। বৃদ্ধ মানুষ এত দখন কী করে নিবে একবার ভাবো।”

“বেশ কেস উঠিয়ে নিতে রাজি আমি। তবে তুমি শুধু একটা পেপারে সাইন করে দাও।”

ব্যাগ থেকে ফাইল আর কলম বের করে এগিয়ে দেয় যুবতী। সায়েম ভ্রুঁ কুঁচকে ফাইল হাতে নিয়ে, তাতে চোখ বুলায়। বাচ্চাদের কাস্টাডির কাগজ। এতে লেখা আছে সায়েম স্বইচ্ছায় বাচ্চাদের সম্পূর্ণ কাস্টাডি মাধবীকে দিয়ে দিচ্ছে।

আশাহত হয় সায়েম। তার ইচ্ছে ছিল বাচ্চাদের কাস্টাডি নিয়েই মাধবীকে ব্ল্যাকমেইল করে তালাকনামায় সিগনেচার করাবে। কিন্তু এখন আর সেই উপায় কোথায়? বিনা কোনো কথাতেই যথাযথ স্থানে সাক্ষর করে সে।

মাধবীর মুখশ্রীতে জয়ের হাসি। সায়েম প্রশ্ন করে,

“এবার তো কেস উঠাবে?”

“নিশ্চয়ই।”

সায়েমের সাথে বাচ্চাদের নিয়ে আবারও বের হয় মাধবী। থানায় যেয়ে কেস উঠিয়ে হাস্যোজ্জ্বল চেহারাতেই বিদায় নেয় সায়েম ও রত্না রায়হানের থেকে। যাওয়া আগে এও বলে,
“সাত লাখ টাকাটা দ্রুতো পরিশোধ করতে ভুলো না কিন্তু। আম্মা আপনি মনে করিয়ে দিয়েন ছেলেকে।”

থানায় থেকে সাহসে কুলাচ্ছে না রত্মা রায়হানের মাধবীকে। তাই চুপচাপ গলাধঃকরণ করল মেয়েটির সকল কথা।

বাসায় পৌঁছে নিজে কাপড় বদলে মাহিন-মিহিরিমারও গা মুছিয়ে দিল। বাজার করেনি আজও, ফ্রিজ তো দূরে থাকা চুলাও নেই বাসায়। কত কিছুর প্রয়োজন যে এই মা-সন্তানের সংসারে ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কিনে আনা খাবারগুলো ওয়ানটাইম প্লেটে বাড়তে বাড়তে মনে মনে বলল,

“ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলোর উপরও কম দখল যায়নি। কিন্তু এভাবে কতদিন স্কুলে নিয়ে যাবে? একসময় তো কর্তৃপক্ষও বিরক্ত হবে। ওরাও তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। একটা প্রি-স্কুল বা ডেকেয়ারে ভর্তি করলে ভালো হয়। কিন্তু চাকরির সাত হাজার টাকা বেতনে তো ভাড়া দিয়ে নুন আনতেই পানতে ফুড়াবে, মাহিন-মিহিরিমার বেতন বা ভর্তি খরচ যোগাবে কোথা থেকে? উপায়হীন আমি, তবুও একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। আরেকটা পার্টটাইম চাকরি বা নতুন চাকরিতে জয়েন।”

“মাম্মা! মাম্মা! পেটে ইঁদুর ডাকে। ক্ষুধা লেগেছে তো।”

বড্ড আদুরে গলায় মাকে জড়িয়ে ধরে খাবারের জন্য আবেদন করল মাহিন। মিহিরিমাও ভাইয়ের দেখাদেখি মাকে জড়িয়ে ধরল।

“এই তো বাচ্চারা, মাম্মা খাবার সার্ভ করে ফেলেছি। এখন আমরা ইয়াম ইয়াম করে খাব।”

খাবার নিয়ে মাধবী বাচ্চাদের নিয়ে খাটে বসে। একটু একটু করে মুখে তুলে দেয় খাবার। হুট করেই মিহিরিমা প্রশ্ন করে,

“মাম্মা, আমরা আর বাবা কি আর কখনোই একসাথে থাকব না? আর মাম্মা স্কুলের আঙ্কেল-আন্টিরা আমাদের ব্রোকেন চাইল্ড বলো কেন?”

ধ্বক করে উঠে মাধবীর বুক। তার ইচ্ছে করছে যারা এসব বলেছে তাদের যেয়ে বলতে একটা তালাকে দোষী হয় স্ত্রী নাহয় স্বামী অথবা দুজনেই। তবে বাচ্চাটাকে কেন নতুন এক নাম দেয় সমাজ? কেন তাদের নিচু চোখে দেখে? একটা বিষাক্ত পরিবেশে, ঝগড়াঝাঁটির মাঝে বেড়ে উঠার চেয়ে কি শান্তশিষ্ট ও স্বাভাবিক পরিবেশে শুধু মা কিংবা বাবার সাথে বেড়ে ওঠা ভালো নয়?

কিন্তু নিজের ইচ্ছেতে মাটি দেয় সে। কারণ কয়জনের মুখ বন্ধ করবে সে? এই সমাজের মানুষ পরের শোকে হয় দর্শক, আর নিজের শোকে পাগল।

তাই নিজেকে শক্ত রেখে মেয়েকে উত্তর দেয়,
“না মা, তোমার বাবা আর আমাদের সাথে কখনোই থাকবে না। কারণ সে আমাকে বা তোমাদের চায় না। আর ব্রোকেন চাইল্ড হলো তারা যাদের বাবা-মা একসাথে থাকে না। এই সমাজে ব্রোকেন চাইল্ডদের এভারেজ ভাবা হয়, নত দৃষ্টিতে দেখা হয়।

তোমাদের প্রুফ করতে হবে তোমরা এভারেজ নয়, ইউ টু আর মাই সুপারহিরোস্। এজন্য বেশি বেশি খেতে হবে। নিজেকে গড়ে তুলতে হবে একজন সম্মানির ব্যক্তিত্ব হিসেবে। অন্যান্য ব্রোকেন চাইল্ডদের জন্য উদাহরণ তৈরি করতে হবে, তাদের অনুপ্রেরণা জাগাতে হবে।”

এত ভারী ভারী কথা মাহিন-মিহিরিমা বুঝল কি না কে জানে? তবে মায়ের ক্লান্ত মুখ খানার দিকে গোলগোল চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাতে ভুল করল না তারা। মাধবী এটুকুতেই যেন স্বস্তি পেল।

___

স্কুল থেকে দুইদিনের ছুটি নিয়েছে মাধবী নিজের নতুন সংসার গোছাতে। প্রথমেই বাচ্চাদের নিয়ে হোটেলে নাস্তা সেড়ে রিকশা করে বাজারে যায় মাধবী। একটা স্বল্পমূল্যের চুলা ও সেকেন্ডহ্যান্ড ফ্রিজ কিনে। ভ্যানে তা পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরাও রিকশা দিয়ে পিছন পিছন আসে। সেগুলো ঠিক জায়গায় রাখিয়েএ বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে পার্স নিয়ে নিচে আসে।

আজ যেহেতু চুলা, ফ্রিজ কিনেছে, তাই বাহিরের নাস্তা খাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। এপার্টমেন্টের সামনের ভ্যান থেকে শাক-সবজি কিনতে সেদিকে এগুচ্ছিল ছিল। আকস্মাৎ এক চোর পার্স ছিনিয়ে নিয়ে বামের জনমানবহীন রাস্তা দিয়ে দৌড় দেয়। তার পিছনে ছুটে মাধবী।

সেই রাস্তা হয়েই এগিয়ে আসছিলেন লতা বেগম। তিনি দেখতে পান মাধবী “চোর! চোর!” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ছেলেটার দিকে ছুটছে। কী ভেবে কে জানে পাশ ছেলেটা তাঁকে ছাড়িয়ে যাবে সেই মুহূর্তেই ছেলেটাকে ঝাপটে ধরেন তিনি। ব্যাগটা নিয়ে টানাটানি শুরু হয় তাঁর ও কিশোর ছেলেটির মাঝে।

“এই ছেলে ছাড় বলছি ব্যাগটাকে! কামাই করে খেতে পারিস না?”

ছেলেটা পিছনে তাকিয়ে অন্যান্যদের এগিয়ে আসতে দেখে ব্যাগ রেখেই লতা বেগমকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দৌড় দেয়। সূচালো পাথরে হাতে আঘাত পান তিনি।

মাধবী উপস্থিত হয়, তাড়াতাড়ি লতা বেগমকে উঠায়। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি ঠিক আছেন তো?”

লতা বেগম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান। কাপড় হাত দিয়ে ঝেড়ে ময়লা মুক্ত করেন। তারপর মাধবীর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকান।

“হুম, আমি ঠিক আছি। কিন্তু তুমি একটু সাবধানে চলবে না? জানি, স্বামীর থেকে মোটা অংকের টাকা পেতে চলেছো। তবুও যেই পর্যন্ত না পাও সেই পর্যন্ত এক এক পয়সা তোমার জন্য জরুরি। তুমি একা নও, তোমার বাচ্চাও তোমার সাথে।”

মাধবী উত্তর দেয় না। চুপচাপ ইশারায় সায় জানায়। আজ প্রথমবারের মতোন কোনো নারীর মাঝে মায়ের ছায়াতল পেল সে। মুখে এক শান্ত হাসি ফুটে উঠে তার।

লতা বেগম ধীর পাদচারণায় এগিয়ে যায় নিজ এপার্টমেন্টের দিকে। মাধবী মন্ত্রমুগ্ধা হয়ে সেদিকে খাণিক ক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এর পর নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কোথায় যেন গান চলছে,
Tere dil ka mere dil se
Rishtă purănă hăi

Teri bechǎini ka
Teri tanhãyi ka
Ehsaas hai mujhko Sun

Mäin jo sååth tere hoon
Phir tujhe hǎi käisā ghăm
Dård båänt lenge hum Sun…
(Tere dilka rishra – Sonu Nigam)

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here