মাধবীলতা ৪র্থ পর্ব

0
1719

মাধবীলতা
৪র্থ পর্ব
-ঈপ্সিতা শিকদার

মাধবী বাড়ি ফিরে দেখে তার দরজার সামনে এক অচেনা নারী দাঁড়িয়ে। নারীটির চোখে-মুখে অপেক্ষার সাথে বিরক্তিও স্পষ্ট।

মাধবী এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কারো অপেক্ষা করছেন?”

“আমি মাধবী ম্যামের অপেক্ষা করছি। কিন্তু আপনি কে?”

“আমিই মাধবী।”

“ওহ সরি, ম্যাম। আমি আগে কখনো না দেখায় চিনতে পারিনি। আমি আয়াশের মা কল্যাণী। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। একচ্যুয়ালি কথা নয়, রিকুয়েস্ট ছিল।” কিছুটা আমতা আমতা করে বলে কল্যাণী।

“ওহ, আসেন। ঘরে আসেন। ভিতরে যেয়ে কথা বলি।”

দরজা খুলে ভিতরে দুই যুবতী। মাধবী বাজারের ব্যাগটা সিঙ্কের উপর রেখে দুই বোতল পানি এনে কল্যাণীর সম্মুখে রাখে। তার মুখে হাসি লেগে আছে।

“কিছু মনে করবেন নতুন ঘর-সংসার তো, আর কিছু নেই ঘরে।”

“না, না, কী মনে করব? আমি কি বাড়িতে না খেয়ে থাকি না কি? আমার স্বামী আলহামদুলিল্লাহ ভালো কামাই করে, আমি আমার ছেলে সুদ্ধ পেট পুরে খেতে পারি।”

কল্যাণী শেষ বাক্যটি উচ্চারণ করলো আড়চোখে মাধবীর দিকে তাকিয়ে। মাধবী বুঝতে পারলো না কথাটা কটাক্ষ করে বলল এই নারী না কি এমনিতেই? তবুও কথা বাড়ালো না সেদিকে আর।

“কী যেন বলবেন বলছিলেন তখন? বলুন।”

“আমার আয়াশকে তো চিনেনই। ছেলেটা দিন দিন গণিতে দুর্বল হয়ে পড়ছে।”

“কিন্তু আমি তো কোনো বাচ্চাকে প্রাইভেট পড়াই না। মানে আগে কখনো পড়াইনি।”

“আগে পড়াননি তো কী হয়েছে? এখন পড়াবেন। প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা দিব, বিনিময়ে শুধু বাংলা, ইংরেজি আর গণিতটা।”

টাকার প্রলোভনে চকচক করে উঠলো মাধবীর চোখজোড়া। নিজের আদর্শ, নীতি সব যেন ধসে পড়তে শুরু করলো মস্তিষ্ক থেকে অর্থের মায়ায়। অর্থের যে খুব প্রয়োজন এই মা-সন্তানের সংসারে।

“আচ্ছা, পড়াবো আমি। কিন্তু এই সময়তে আমার বাচ্চাগুলো…?”

“তাদের নিয়ে আসবেন। আমিও তো মা, আপনার বাচ্চা, আমার বাচ্চার মতোই। তবে ম্যাম আপনাকে আজ বিকাল থেকেই পড়ানো শুরু করতো হবে। আমার বাসা পাশের বিল্ডিংয়ের তিন তলায়, বা’পাশে।”

“জী, ঠিক আছে। আমি মাগরিবের নামাজের পর আসবো।”

“আচ্ছা। তাহলে আমি আজ আসি মাধবী ম্যাম। বিকেলে আপনি এসে পড়বেন কিন্তু।”

আর কোনো কথা হয় না কল্যাণী ও মাধবীর মাঝে। কল্যাণী বিদায় হতেই মাধবী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়ে বলে,
“আল্লাহ, সারা দুনিয়া হাত ছেড়ে দিলেও, তুমি তোমার বান্দাকে একা ছাড়ো না। তুমি আমার আঁধার দিনে এক ফালি আলোর দেখা পায়িয়ে দিলে। আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ!”

___

মাগরিবের নামাজ পড়ে বাচ্চাদের তৈরি করে আয়াশদের বাসায় যায়। বেল বাজালে লতা বেগম দরজা খুলে দেন। ভ্রু কুঁচকে বলেন,
“তুমি এখানে?”

“আমি ডাকিয়েছি আম্মা। উনি আজ থেকে আমাদের আয়াশকে পড়াবেন।”

ম্লান মুখে “ওহ” বলে চলে গেলেন লতা বেগম।

মাধবী ভিতরে প্রবেশ করে মিহিরিমা ও মাহিরকে নিয়ে। ডাইনিং টেবিলে বসে কল্যাণীর সাথে কুশল বিনিময় শেষে আয়াশকে পড়াতে শুরু করে। মিহিরিমা ও মাহিরের সামনেও ইংরেজি কবিতার বই দিয়ে পড়তে বসিয়ে দেয়।

এর মধ্যেই বেল বেজে উঠে আবার। মাধবী খেয়াল করে কল্যাণী সোফায় বসে থাকার পরও খুলছে না। অনবরত বেলের শব্দে লতা বেগমই নিজের ঘর থেকে বের হয়ে দরজা খুলেন।

জয় প্রবেশ করে। যুবকের ক্লান্তি গোটা দেহে। সিঙ্গেল সোফাটিতে গা এলিয়ে দিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে আবেদন করে,
“এক গ্লাস পানি এনে দাও তো, কল্যাণী। আর কড়া করে চা বানাও।”

“আমি চাকর না কি এ বাড়ির এসব করবো! তুমি তো জানোই আজ আমি কত অসুস্থ বোধ করছি, তারপরও আমাকেই বলছো। কত মানুষ খালি বসে আছে, তাদের চোখে পড়ে না।”

লতা বেগম ভালোই বুঝতে পারলেন, পুত্রবধূর ইঙ্গিতটা যে তাঁর দিকেই। তিনি ছেলের ম্লান মুখের দিকে একবার তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে যান। মা তো তিনি, সন্তান মাকে ফেলে দিতে পারলেও, মা সন্তানকে ফেলতে পারেন না।

জয়কে পানি এনে দিয়ে, আবার চা বানাতে চলে গেলেন লতা বেগম। একটু বাদেই ট্রে করে চার কাপ চা নিয়ে এলেন। প্রথমেই রেখে আসলেন ডাইনিং টেবিলে মাধবীর জন্য। মেহমানকে আগে না দিলে বিষয়টা নিয়ে খুঁত খুঁত লাগতো তাঁর।

এরপর জয়কে দেন। কিন্তু কল্যাণীকে দিতে যেতেই পা পিছলে পড়ে যান। মুক্ত হয়ে চা ভর্তি কাপ সুদ্ধ ট্রেটাও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। চায়ের কয়েক ছিটে কল্যাণীর পায়েও পড়ে, একেবারে গায়ে না লাগার মতোই অবস্থা। তবুও কল্যাণী আর্তনাদ করে উঠে নাটকীয় ভাবে।

লতা বেগমও মাটিতে বসে কোঁকাচ্ছেন পায়ে অতি মাত্রায় ব্যথা পাওয়ায়। উঠতেও পারছেন না তিনি। জয় উঠে দাঁড়ায় সোফা থেকে। তিনি ভাবলেন তাঁকে ধরবে হয়তো। কিন্তু না তাঁকে আবারও আশাহত করে আঘাতপ্রাপ্ত মাকে রাখে জয় স্ত্রীকে ধরে।

“মা, একটু দেখে-শুনে কাজ করবে না? দিতে তো মেয়েটার পা পুড়িয়ে!”

“হুহ্! এত বলদ কেন তুমি? দেখতে পারছো না তোমার মা এ কাজ ইচ্ছে করে করেছে? উনি শোধ নিচ্ছেন, আমি যে চা বানালাম না এজন্য। বদ…”

হুংকার দিয়ে কথাগুলো বলতে বলতেই মাধবীর দিকে চোখ পড়ে তার। হুশ আসে, ভুলেই বসেছিল মাধবী এখানে। দুই মুহূর্ত নিয়ে কণ্ঠ ও চেহারাকে কাঁদো কাঁদো করে শুধায়,

“আমি তো তোমার মাকে নিজের জন্মদাত্রী মায়ের মতোই দেখি। আর তোমার মা… রোজ তো আমিই চা বানাই, আজ একদিন বানাতে বললাম বলে এমন কাজ করলো?”

বড় বড় পা ফেলে ঘরে চলে যায় সে। বউয়ের ক্রন্দনরত চেহারা দেখেই মন সম্পূর্ণরূপে গলে যায় জয়ের। বউয়ের কাছে যেতে যেতে মাকে ধিক্কার জানাতে আর ভুল করে না সে।

“ছিঃ! মা, তুমি এমন করলে আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না!”

লতা বেগম অতি বেদনায় যেন কাতরের সাথে স্তব্ধও হয়ে উঠলেন। চোখজোড়ায় মেঘ জমে গেছে তার। বৃষ্টি হবে যেকোনো মুহূর্তে। কারো সামনে কাঁদতে তার লজ্জা, তবুও উঠার উপায় কই? পা-ই নড়াতে পারছেন না।

মাধবীর খুব করে মন চাচ্ছে লতা বেগমকে যেয়ে উঠাতে। কিন্তু লতা বেগম বা কল্যাণী আবার কী মনে করে বসে তা ভেবেই আগাচ্ছে না। তার যে এই টিউশনিটার খুব প্রয়োজন।

এমন মুহূর্তে আয়াশ বইপত্র ফেলেই দাদীর কাছে দৌড়ে যায়। ছোট্ট গায়ে দাদীর বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া দেহ উঠাতে বেশ কষ্ট বোধ করছিল। কিন্তু সাহায্যের হাত এগিয়ে দৌড়ে যায় মিহিরিমা ও মাহির। তিন ছোট্ট শিশুরা মিলে লতা বেগমকে তাঁর বিছানায় রেখে আসে।।

মাধবীর মুখশ্রীতে প্রফুল্লতা ফুটে উঠে। আনমনেই বিড়বিড়ায়,
“এই ছোটো ছোটো অবুঝ শিশুদের মতোই যদি আমাদের মন পবিত্র হতো।”

___

আজ শুক্রবার। মাধবীর ভালো কিছু রান্না করারই ইচ্ছে। তাই সকাল বেলাই বাচ্চাদের গোসল করিয়ে, ভালো কাপড় পরিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাজার করতে। আজ মুরগির মাংস ভুনা আর পোলাও রান্না করার ইচ্ছে তার। বাজার থেকে রান্নার বাজারের পাশাপাশি কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় থালা-বাসনও কিনে সে।

বাড়িতে এসে মিহিরিমা ও মাহিরকে ফোনে কার্টুন ছেড়ে দিয়ে, রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। ক্রিংক্রিং শব্দে কলিংবেল বেজে উঠে। উড়না মাথায় দিতে দিতে এগিয়ে যায় সে।

দরজা খুলে দিতেই ভিতরে প্রবেশ করে সোফায় বসে কল্যাণী। তার হাতে একটা পুরোনো আইসক্রিমের বাটি।

“কী করছিলেন আপা?”

“এই রান্না করছিলাম আপু। আপনি রান্না করবেন না?”

একটু বিব্রতভাব দেখা দিল কল্যাণীর মাঝে। এর কারণটা মাধবী বুঝলো না। নিজেকে সামলে কল্যাণী মুখ খুলল। অনায়াসে এক ডাহা মিথ্যে উচ্চারণ করে ফেলল সে,
“আরে আমার যেই জ্বালা তা তো আপনি জানেন না। সেই সকাল ছয়টায় উঠে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার তৈরি করতে হয় নাহলে শাশুড়ি… কাল কী হলো দেখলেনই তো। এমনেই অত্যাচাত করে আমাকে।”

“বুঝেছি। তা আন্টি এখন কেমন আছে? কাল দেখে লাগছিল তার পায়ে ভীষণ লেগেছে।”

“আরে সব ঢং ম্যাডাম ছেলেকে পটানোর, আর আপনাকে দেখানোর জন্য। আপনি চলে যেতেই কেমন ড্যাংড্যাং করে সারা ঘরময় পায়চারি করলো। এই শাশুড়িদের কাজ-কারবার বোঝেন না। আপনিও তো একসময় স্বামী-সংসার করেছেন।”

ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলল মাধবী। তার শাশুড়ির দেয়া আঘাতগুলো গণতে বসলে বয়স শেষ হয়ে যাবে, তবুও গণা শেষ হবে না। আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল,

“সব শাশুড়িগুলোই একরকম বউদের কষ্ট দিয়েই যেন তৃপ্তি পায়। এরা যেমন করে এদের সাথেও তেমনই করা উচিত।”

কল্যাণী বেশ খুশি হলো মাধবী তার কথা বেশ বিশ্বাস করায়। আরও ইনিয়েবিনিয়ে নানা মিথ্যে অভিযোগ দিল ও দোষ বলল লতা বেগমের। মাধবীর কানকে লতা বেগমের বিরুদ্ধে বিষ পূর্ণ করেই মাধবীর ফ্ল্যাট ছাড়ে সে।

সে বেরিয়ে যেতেই মাধবী ভাবে,
– আমার প্রথম ভাবনাই ঠিক ছিল। এই মহিলাও রত্না রায়হানের মতোন। ভাগ্যিস কল্যাণী আপুর জামাইটা সায়েমের মতোন নয়। কত্ত ভালো! একদম আদর্শ স্বামী!

___

আসরের আজানের পর বাচ্চাদের নিয়ে মাঠে এসেছে মাধবী, যাতে তারা খেলতে পারে। আয়াশও তখন খেলছে নিজ বন্ধুদের সাথে। আয়াশকে দেখে ছুটে সেদিকে যায় মিহিরিমা ও মাহির।

লতা বেগম মাঠের সাইডে পরিত্যক্ত একটা বেঞ্চির উপর বসে চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা এঁটে সোয়েটার বুনছেন। মাধবী আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে তাঁর পাশে গিয়েই বসলো।

লতা বেগম কাজ করতে করতেই বললেন,
“তোমার ছেলেকে বেশি বেশি আনার এনে খাওয়াবে, রক্তশূন্যতা তার।”

“সরি? মানে আপনি কীভাবে…?”

“চুলগুলো এমনেই পাকেনি। যতো অভিজ্ঞতা এসেছে, ততোই পেকেছে। সেই। অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।”

মাধবী জবাব দিলো না। লতা বেগম পুনরায় মুখ খুললেন,
“তোমাদের বিল্ডিংয়ের দুই তলায় চারজল ব্যাচেলর ভাড়া এসেছে। সাবধানে থাকবে। রাত-বিরাতে দরজায় কেউ নক করলে বা বেল বাজালেও দরজা খুলবে না।

নারীর জীবনে জন্য পুরুষের থাকা আবশ্যক নয়। তবে আমাদের সমাজে বসবাসকৃত কিছু জানোয়ারের চোখে বাবা, ভাই, স্বামী এর ছায়া বঞ্চিতা নারী সরকারি সম্পত্তির মতোন লাগে।

আর বুঝি না বাপু তোমাদের জেনারেশনের কাজকর্ম। কিছুর থেকে কিছু হলেই তালাক দিয়ে দাও। এডজাস্টমেন্ট নামের তো কিছু আছে।”

“করেছি তো আমি এডজাস্ট। বাপ-মা তুলে গালির সাথে এডজাস্ট করেছি, সারাদিন গাঁধার মতো খাটার পর দিনশেষে ‘সারদিন করাটা কী?’ প্রশ্নের সাথে এডজাস্ট, দুনিয়ার সব অনিষ্ঠের দায়ভার আমার মাথায় দেওয়ার সাথে এডজাস্ট।

শুধু একটা জিনিসের সাথে এডজাস্ট করতে পারিনি। তা হলো- স্বামীর ভাগ দেওয়া। এজন্যই স্বামী হারা আমি। আপনারা শাশুড়িরা তো এটাই চান।” ম্লান হেসে কথাটা বলে সাথে সাথে সেখান থেকে উঠে হনহন করে বাচ্চাদের নিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যায়।

লতা বেগম গোলগোল চোখে যুবতীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তবে কি এত অভিজ্ঞতা, শিক্ষা নিয়ে মানুষ বিচারে ভুল করলেন লতা বেগম?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here