মাধবীলতা ৫ম পর্ব

0
1737

মাধবীলতা
৫ম পর্ব
-ঈপ্সিতা শিকদার

মাধবী বাচ্চাদের খাবার খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আনমনেই জানালার পাশে বসে সে। ভেবে উঠে অতীতের কথা, সায়েমের কথা, প্রাক্তন সংসারের কথা।

সায়েমের সাথে ঠিক প্রণয় নয়, বন্ধুত্ব কিংবা পরিচিতি ছিল মাধবীর। একই ভার্সিটিতে পড়তো তারা সেই সুবাদেই, মাঝে এক ইয়ারের গ্যাপ শুধু। সায়েম ভার্সিটি থেকে বের হলেই চাচার জোরে বেশ ভালো একটা চাকরি পেয়ে যায়। তার পরপরই বিয়ের প্রস্তাব রাখে সে।

দিনটি ছিল শুক্রবার। চাকরি পাওয়ার আনন্দে ট্রিট দিবে জানায় সায়েম। মাধবীও খুশি হয়ে রাজি হয়ে যায়। মাধবী আবার সাজসজ্জা প্রিয় যুবতী, তাই বেশ ভালোভাবে তৈরি হয়েই রওনা হয়।

রেস্টুরেন্টে ঢুকেই সায়েমের হাতে নিজের কিনা আনা উপহারটা তুলে দিয়ে বলে,
“অভিনন্দন আপনাকে। আল্লাহ আরও সফল করুক আপনাকে জীবনে।”

সায়েম মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। মাধবী নিজের হাত গিফট্ বক্স থেকে সরিয়ে নিতে লাগলেই সায়েম হাত ধরে ফেলে তার। মাধবী জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকায়।

সায়েম আলতো হেসে শুধায়,
“ভার্সিটিতে প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। তোমার কাজল রাঙা চোখ আমায় এমন মায়ায় আটক করেছে চেয়েও ছুটতে পারিনি। তবে সাহস হয়নি কখনো ভালোবাসি বলার। মধ্যবিত্ত বেকার ছেলে ছিলাম বলেই কি না… এখন চাকরি হয়েছে জোরটাও একটু বেড়েছে। তাই তোমায় নিজের করে নিতে চাই। বিয়ে করবে আমায়?”

মাধবী আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। কোনো শব্দ উচ্চারণ ছাড়াই বড় ভড় পা ফেলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। সেও সায়েমকে পছন্দ করে, কিন্তু হুটহাট সব বন্ধুদের সামনে প্রপোজ করায় হতবিহ্বল সে।

পরদিন ভার্সিটিতে গেলে সায়েম পুনরায় জানতে চায় তার উত্তর। সেবার কোনো ভণিতা ছাড়াই হ্যাঁ বলে দেয় সে। মাধবী নিজের ভাই রায়িমের সাথে বেশ ফ্রী, তাকে সব জানায় সে। বোনের মত আছে দেখে রায়িমও আর দ্বিমত করে না।

কিন্তু ঝামেলা হয় সায়েমের পরিবার থেকে। রত্না রায়হান কিছুতেই বাপ-মা মরা এতিম মেয়েকে পুত্রবধূ করতে রাজি নন। সায়েম বহু চেষ্টার পরও ব্যর্থ।

মাধবী বিষয়টা বুঝে সায়েমকে আবেদন করে,
“তুমি, তোমার মায়ের পছন্দ মতো বিয়ে করে নাও। আমাকে ভুলে যাও। আমরা এক হওয়ার নয়।”

সায়েমকে আর কিছু বলার সু্যোগ দেয় না মাধবী। কল ডিসকানেক্ট করে দেয়। পরদিন সকালে সায়েম হুট করেই কল করে শুধায়,
“আমি তোমার জন্য কাজি অফিসে অপেক্ষা করছি। তুমি যদি না আসো কসম মায়ের গলায় ফাঁস দিব আমি।”

মাধবীর প্রেমে কাতর যৌবনা হৃদয়, প্রেমিকের ডাক কী করে উপেক্ষা করতে পারে? পরনের কাপড়েই চলে যায় সে। কী তাড়ার সহিতই না সেদিন রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করেছিল এবং করিয়েছিল সায়েম! ভাবখানা এমন যে একটু দেরি হলেই যেন মাধবী ছুটে পালাবে। অথচ, পালিয়েছে আজ সে নিজেই।

সায়েম থাকতো একা ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট নিয়ে, সেখানে তাকে উঠিয়েই নিজ পরিবারকে ও মাধবীর পরিবারকে জানায়। রায়িম খুব সহজেই মেনে নিয়েছিল তার সম্পর্ক। মানেনি সায়েমের মা রত্না রায়হান ও তার পরিবার। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই যেন সহ্য করে নিয়েছিলেন তিনি মাধবীকে।

তবে গ্রাম থেকে যখন আসতেন তখন সায়েমের আড়ালে আজেবাজে কথা বলতে কোনো বাদ রাখেননি। মাধবী চুপচাপ সহ্য করে নিত, কয়েকদিনের মেহমান ভেবে। এর মাঝে সায়েমকে অনেক বুঝিয়ে শিক্ষিকার চাকরিটা করে মাধবী, সময় কাটাতেই। বলতে গেলে সবমিলিয়ে ভালোই চলছিল মাধবীর সংসার।

ঝড় আসে যখন বিয়ের তিন বছরের মাথায় সায়েমের বাবা মারা যান। কারণ তখন রত্না রায়হানের স্থায়ী ঠিকানা হয় মাধবীর সংসারে। সেই থেকেই কত্ত রকম ঝগড়া সায়েম ও তার মাঝে! হবে নাই বা কেন? রত্না রায়হানের আগমনের পর থেকে একদণ্ড একাকি কথা বলতে পারেনি সায়েমের সাথে। তার উপর প্রতিনিয়ত সায়েমের কানে তার নামে বিষ ঢালা তো আছেই।

সবকিছু মানিয়ে নিয়েই স্বামী-সন্তান নিয়ে চলছিল মাধবীর সংসার। এর মাঝেই রত্না রায়হান অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হন। সেই অবস্থায় এমন এক অন্যায় আবদার করা হয় যে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না মাধবী।

রত্না রায়হানের বোনের মেয়ে নাতাশা। দেখতে অমায়িক সুন্দরী হলেও বিয়ে হচ্ছে না তার বহু আগে থেকেই। অসুস্থ অবস্থায় ছেলের হাত ধরে মিনতি করে বলেন,
“আমার ভাগ্নি আর বোনটা রে বাঁচা তুই বাজান! ওরে বিয়ে কর। নাহলে এমনেই বাপছাড়া মেয়ে, মা মইরা গেলে কূলছাড়া হয়ে কই যাইবো?”

মাধবী এমন কথা শুনেই তেঁতে উঠে প্রতিবাদ করে। সায়েম কোনো কথাই বলেনি সেদিন। এরপর রত্না রায়হান নিজের কথা মানানোর জন্য অনশনব্রত করেন। সায়েমও খাণিক খোশামোদি করে রাজি হয়ে যায়।

মাধবীও বলে দিয়েছিল সে এই বিয়ে কিছুতেই মেনে নিবে না। সায়েম মাধবীকে না বলেই তালাকের ব্যবস্থা করে ফেলে। জানতেই যেন মাধবীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তবুও নিজেকে সামলে নেয় সে। কারণ মায়েদের ভেঙে পড়তে নেই নাহলে নাড়িছেঁড়া সন্তান ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে।

নিজের অতীত ঘাঁটতে ঘাঁটতেই শব্দ করে এক শ্বাস ফেলে মাধবী। বিড়বিড়ায়,
“সকল অন্যায় হয়েছেও আমার সাথে, অন্যায়কারীও আমি। বাহ্! কী বিচার তোমার সমাজব্যবস্থা!”

___

মাগরিবের নামাজ পড়ে আয়াশকে নিয়ে হাঁটতে বেড়িয়েছেন লতা বেগম। গতকাল কল্যাণীর মা তথা তাঁর বেয়াইন এসেছিলেন। তার পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করেই খোঁচা দিয়ে বসেন,
“বাব্বাহ্! আরামে বসে পরের রুজি কত খেতে পারেন আপনি বেয়াইন, ওজন তো আগের চেয়েও বিশ কেজি বাড়ছে লাগছে!”

পুত্রবধূর বাড়ির লোক থেকে ওজন নিয়ে খোঁটা শুনে লজ্জায় লতা বেগমের যেন মরিমরি অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তাই ঠিক করেছেন যতোই ডাক্তার বলুক এক ঘণ্টার বেশি হাঁটতে না, যতই প্রেশার লো থাকুক বা হাঁটুর ব্যথা বাড়ুক, কিন্তু তিনি রোজ কম করে হলেও তিন ঘণ্টা তো হাঁটবেনই।

মাধবীও বাচ্চাদের নিয়ে হাঁটতে এসেছে। আজ আয়াশকে পড়াতে হবে না, খালি সময় আছে। ঘরবন্দী থাকতেও ভালো লাগছিল না, তাই-ই বের হয়েছে।

এমন সময় চোখাচোখি হয় লতা বেগমের সাথে। নারীটি সাথে সাথেই দৃষ্টি নত করে ফেলেন। না জেনে বিচার ও মন্তব্য করায় বেশ ভালোই লজ্জিত তিনি। ক্ষমা চাইতেই মন চাচ্ছে। কিন্তু কোনো এক বাঁধায় চাইতেও পারছেন না।

মাহির ও মিহিরিমা আয়াশের কাছে ছুটে চলে যায়। সাথে সাথে বাচ্চাদের দিকে এগিয়ে আসে মাধবী। লতা বেগমের আড়ষ্টতা দেখে সে-ই বলল,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”

লতা বেগম আমতা আমতা করে জবাব দেন,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আছি তো যেমন তেমন। আসলে কীভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো আমি না জেনে…”

“ইট’স ওকে আন্টি। আমি বুঝেছি আপনি বুঝতে পারেননি। আপনি এমন ল্যাংড়িয়ে হাঁটছেন কেন?”

“আর বোলো না, বয়স হয়েছে হাঁটুর ব্যথাও বেড়েছে। আরও কত রকম রোগ যে হবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে! আর বড়োজোর কয়দিনই বা বাঁচবো তারপর তো ঐ কবরেই ঠিকানা।”

“এভাবে বলবেন না। কে কতদিন বাঁচবে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। হতেও তো পারে আরও বহু বছরের হায়াত বাকি আপনার।”

“মা, তোমার কিছু লাগলে, কোনো প্রয়োজনে বা বিপদে আমাকে বলতে কোনো বাধা বোধ করবে না। তুমিও আমার মেয়ের মতোই। জানো তোমার আঙ্কেলের খুব মেয়ের সখ ছিল। তিনি বলতেন বাপ-মায়ের সবচেয়ে আপন না কি মেয়েরাই হয়। জয় হওয়ার পর বারবার চাইতেন আরেকটা বাচ্চা নিতে।

আমার কথা ছিল এক সন্তান থাকলে তার সব সখ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারবো। আর মেয়ে-ছেলে কোনো কথা না, নৈতিকতা শিখাতে পারলে এমনেই… কিন্তু আজ বুঝি তোমার আঙ্কেলের কথার মূল্য। এখন মনে হয় যদি একটা মেয়ে থাকতো, তবে আর কিছু না হোক, কথা বলার সঙ্গী তো মিলতো।”

মাধবীর কেন যেন মনে হলো এই গোমড়ামুখো মানুষটির গম্ভীর আচারণের আড়ালে লুকিয়ে আছে বহু চাপা কষ্ট। সে নিজেও তো কষ্ট আড়াল করতে আর বাঁচার তাগিদেই শক্ত হয়েছে। এই সমাজে নিজের কষ্ট দেখালে দুটো দৃষ্টি দেখতে পাওয়া যায় মানুষের। একদলের দৃষ্টিতে তা হয় দুর্বলতা, আরেক দলের দৃষ্টিতে তা হয় লোকদেখানো অশ্রু।

সে লতা বেগমের হাতে হাত রেখে আত্মস্থ করে শুধায়,
“মাত্রই তো বললেন আমি আপনার মেয়ের মতোন। কোনো দরকার হলে আপনাকে বলতে। সুতরাং, আপনিও আপনার সব কথা এই মেয়েকে বলতে পারেন বিশ্বাস করে।”

দুজনের মাঝে আরও বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়। এশার আজান পড়তেই মাধবী বাচ্চাদের নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। লতা বেগম আপন মনেই বিড়বিড়ান,
“এমন মেয়ে পেয়েও যারা ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের মতো দুর্ভাগী আর একটাও নেই।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here