মাধবীলতা ৬ষ্ঠ পর্ব (শেষ পর্ব)

0
3142

মাধবীলতা
৬ষ্ঠ পর্ব (শেষ পর্ব)
-ঈপ্সিতা শিকদার

মাধবীর সাথে লতা বেগমের সম্পর্ক বেশ ভালো হয়েছে। লতা বেগম এখন প্রায়শয়ই মাধবীর বাড়িতে আসে। মাঝে মাঝে মাহিন এবং মিহিরিমাকেও মাধবীর অনুপস্থিতিতে সামলান তিনি।

তবে মাধবীর মন একটু সন্দিহান লতা বেগমকে নিয়ে। কারণ লতা বেগমের আড়ালে কল্যাণী বদনাম করা থেকে বাদ যায় না।

বাচ্চাদের নিয়ে সবেমাত্র স্কুল থেকে ফিরেছে মাধবী। নিজের এপার্টমেন্টে না ঢুকে লতা বেগমের এপার্টমেন্টের দিকে অগ্রসর হয়। আয়াশের ক্লাস টেস্ট হয়েছে আজ, কিন্তু আয়াশ স্কুলে যায়নি। এই ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞেসাবাদ করতেই যাচ্ছে সে।

তিনতলায় যাওয়ার সিঁড়িতে উঠতেই কল্যাণীর চেঁচামেচির শব্দ শ্রবণগত হয়। কিছুটা অপ্রস্তুত হয় সে। যাবে না কি যাবে না ভাবতেই ভাবতেই ফ্ল্যাটের প্রবেশদ্বারে সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। দরজা লক করা না, তবে ভেড়ানো। অবচেতন মনেই ভিতরে চোখ রাখে সে দরজার ফাঁক দিয়ে।

দেখতে পায় লতা বেগম মাথা নত করে বসে আছেন সোফাতে। কল্যাণী আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে যাচ্ছে।

“আমার ছেলেটার আজকে ক্লাসটেস্ট! আর আপনি কি না ওকে স্কুলে না নিয়ে যেয়ে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছিলেন! এত এত খান ছেলের টাকায়, নাতির সামান্য এটুকু কাজ করতে পারেন না? লজ্জা নাই আপনার? আপনার পিছনে যেই টাকা যায় আমাদের, সেই টাকা অন্য বুয়াদের পিছনে খরচ করলে জান-প্রাণ দিয়ে বাসার সব কাজ করতো।”

লতা বেগমের চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার। তবুও তিনি একটা টুঁ শব্দও করছেন না। কাল রাত থেকেই গায়ে জ্বর তাঁর, বেড়েছে হাটু আর কোমরের ব্যথা। তিনি আগেই বলেছিলেন কল্যাণীকে আজ যেতে পারবে না। তবুও কল্যাণী নিজের মতো শুনিয়েই যাচ্ছে।

শেষে আর চুপ থাকতে না পেরে বললেন,
“আমি তো রাত্রেই তোমাকে বলেছিলাম বউমা আমি যেতে পারবো না। তোমাকে নিয়ে যেতে।”

“যা তা জ্বর আপনার। নাটক করেন আমার সাথে? আমি কেন নিয়ে যাব? আপনাকে বিনা পয়সায় খাওয়াই কি আমি গাঁধাখাটনি দিতে?”

পাশ থেকে জয়ও সায় জানিয়ে শুধায়,
“আহ্ মা! কথা বাড়াচ্ছো কেন? দোষ তোমার, মেনে নেও না!”

“হুম, অনেক দোষ আমার। মা হয়েছি, শ্বাশুড়ি হয়েছি, দোষ তো সব আমারই। এখন কি পায়ে ধরবো?”

আর কিছু শুনলো না মাধবী। মিহিরিমা ও মাহিনকে নিয়ে এপার্টমেন্ট থেকে বেড়িয়ে পড়লো। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খাবার তৈরি করতে লেগে পড়ে সে।

হুট করেই মনে পড়ে গেল জয়ের কথা। যাকে কাল অবধি আদর্শ স্বামী মানতো সে। হতাশ বোধ করলো।

মনে মনে বলল,
“আমি তো উনাকে কতো ভালো ভাবতাম। উনি তো দেখি সায়েমের চেয়েও আরও বড় সাপ। নিজের রক্ত, জন্মদাত্রীকেই যে ছোবল দিচ্ছে! কল্যাণী মনে মনে খুশি হচ্ছে স্বামীর এমন ব্যবহারে। কিন্তু একবারও ভাবছে না যে তার জন্য নিজের জন্মদাত্রীকে ছোবল দিতে পারে, সে অন্যকারো জন্য তাকে কত কী করতে পারে!”

___

লতা বেগম নিজের ঘরে উদাস মনে বসে আছেন। আয়াশ মলিন মুখে দাদীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।

“দাদী, আই এম সরি। আমার জন্য তোমাকে আজ বকা খেতে হলো।”

“না, দাদু। তোমার কোনো দোষ নেই। দোষ আমার ভাগ্যের। তোর দাদীর জন্য খারাপ লাগে তাই না রে?”

দাদীর চোখে চোখ রেখে মাথা ঝাঁকায় ছোট্ট আয়াশ। তা দেখে আরও আদুরে ভঙ্গিতে মাথায় বিলি কেটে দেন তিনি।

“তুই যখন বড় হবি, ওদের আচ্ছা মতো শাস্তি দিতি। ওদের বুঝাতে ভুলবি না তোর দাদী কোন কষ্ট সহে ছিল।”

আয়াশ লতা বেগমের ভারী কথার মানে অত বুঝলো না। শুধু বুঝলো বড় হলে দাদীর সাথে মা-বাবা যেমন করে, মা-বাবার সাথে তারও তেমনই করতে হবে।

“বাহ্! বাহ্! এখনও বিছানায় পড়ে থাকা হচ্ছে? তা নাস্তা কি আপনার মৃত জামাই এসে বানাবে?”

“বউমা, মুখ সামলে কথা বলো? নিজের কবরবাসী শ্বশুরের সম্পর্কে এমন ভাবে কথা বলতে তোমার গায়ে বাঁধলো না?”

“বা*র শ্বশুর! হারামি একটা নাহলে নিজের সম্পত্তির ভাগ কেউ ভাই-বোনদের দেয়?”

কথাটা উচ্চারণ করতেই তেড়ে এসে তার গালে ঝড়ের গতিতে চড় লাগান লতা বেগম। তাঁর চোখজোড়া থেকে যেন অগ্নিকুণ্ডলি বের হচ্ছে।

“মেয়ে আমাকে অনেক বলেছো, সহ্য করেছি! আমার ফেরেশতার মতো স্বামীকে নিয়ে আর একটা কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো বেয়াদব মেয়ে!”

কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কল্যাণী। অতঃপর একপলক অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে লতা বেগমকে দেখে গটগট করে নিজের ঘরে চলে যায়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন লতা বেগম। তিনি জানেন তাঁর কাজের পরিণাম খুব খারাপ কিছুই, তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি তিনি।

___

যথারীতি মাধবী বাচ্চাদের নিয়ে সন্ধ্যার পর পড়াতে যায়। যেতেই দেখে দরজা খোলা। দুটি ট্রলিব্যাগ পড়ে আছে দরজার সামনে।

দরজায় দাঁড়িয়েই কল্যাণী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে স্বামীকে শুধাচ্ছে,
“তোমার মা আজ আবার আমার গায়ে হাত তুলেছে। বলেছে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। আমি থাকবো না তোমার মায়ের সাথে এক বাড়িতে।”

“মা, এসব কী শুনছি? তুমি কল্যাণীর গায়ে হাত লাগিয়েছো কোন সাহসে?”

“যেই সাহসে তোমার স্ত্রী আমার স্বামীকে গালি দিয়েছে, সেই সাহসেই।” দৃঢ়তা লতা বেগমের কথাবার্তায়।

“মানে?”

লতা বেগম ধীর কণ্ঠে বলেন গোট ঘটনা। জয় জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকায়। তা দেখে আরও জোরে জোরে কেঁদে দেয় কল্যাণী। স্ত্রীর ক্রন্দনরত চেহারা আর কান্নার শব্দ দুটোই পুরুষের উপর দাসত্ব করার মূল হাতিয়ার। এবারও এই হাতিয়ারের আঘাত থেকে রক্ষা হয় না জয়ের।

“মা, ও নাহলে একটা কথা বলেছেই। তাতে তুমি এমন করবে? এটা তোমার অন্যায় হয়েছে।”

“তোর মানে কি ও যা ইচ্ছা করবে, বলবেই? কান খুলে শুনে রাখ ও যতবার এমন বেয়াদবি করবে, ততবার এমন ফলাফলই পাবে।”

তেঁতে উঠে কল্যাণী।
“আমি থাকবো না এই বাড়িতে তোমার মায়ের সাথে। আমার কাবিনের টাকা দাও, ছেলে নিয়ে আমি আমার বাপের বাড়ি চলে যাব। তোমাকে তালাক দিব আমি।”

শুকনো ঢোক গিলে জয়।
“দেখো মা, আমি তোমার জন্য নিজের সংসারে আগুন লাগাতে পারবো না। আমার বাসায় থাকতে হলে আমার স্ত্রীর মন মোতাবেক তার কথা শুনেই থাকতে হবে।”

লতা বেগমের চোখজোড়া ভার হয়ে উঠে মেঘের আগমনে। ব্যথিত হন তিনি অত্যন্ত। ছেলের থেকে এত বড় কথা কোনো মায়েরই কাম্য নয়।

“নাহলে কি আমাকে বের করে দিবি? কারণ আমি এমনই করবো।”

“আমি থাকবো না আর এ বাড়িতে জয়। হয় তোমার মাকে বলো এখনই বাড়ি থেকে বের হতে নাহয় আমি চলে যাচ্ছি।”

পা বাড়াতে অগ্রসর হয় কল্যাণী। জয় তার হাত ধরে আটকায়।

“তুমি এক্ষন আমার বাসা থেকে বের হও মা!”

লতা বেগম বিস্ফারিত নয়নে তাকান। জয়ের চোখে-মুখে মায়ের জন্য বিতৃষ্ণা। এর মাঝেই লতা বেগমকে দরজার বাহিরে ধাক্কা দেয় কল্যাণী। তিনি পড় যেতে নিলেই মাধবী ছুটে এসে তাঁকে ধরে।

“আপনাদের মধ্যে সামান্যতম মানবিকতা নেই? একজন বয়োজ্যেষ্ঠ অসুস্থ মানুষের সাথে এমন ব্যবহার করছেন?”

“তোমার এত মায়া লাগলে তুমি নিয়ে যাও না? এই মহিলাকে আমি কল্যাণী আর আমার সংসারে রাখছি না।”

“আপনি ভুলে যাবেন না সংসারটা আগে উনার, তারপর আপনার। উনার বাড়িতে আপনি উনার ছেলের বউ হয়ে এসেছেন, উনি আপনার বাড়িতে যাননি। আপনার নিজেরও একখানা ছেলে আছে জয় সাহেব আর কল্যাণী আপা। আজ যেই বীজ বইছেন, কাল তার ফল পেতেও তৈরি থাকুন। আর আপনি কি বের করে দিবেন? আমিই আন্টিকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। চলুন আন্টি।”

মাধবী এবং মাহির ও মিহিরিমা লতা বেগমকে ধরে চলে যেতে শুরু করে। মাধবীর কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে কল্যাণী।

“যা! যা! দেখবো নে কয়দিন খাওয়াতে পারোস এই বুড়ি রে! নিজেই জামাইয়ের ভাত খাইতে পারিসনি, শ্বাশুড়ি ঐদিন আইসাও গালাগালি করে গেসে, আবার বড় বড় কথা! আর টিউশনি বন্ধ, এই মাসের বেতনও পাবি না শালি!”

মাধবী কানে তুলে না কোনো কথাই, চুপচাপ নিজের এপার্টমেন্টে চলে যায়। চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ঢুকে লতা বেগমকে বিছানায় বসায়। পানি এগিয়ে দেয়।

“আমি তো কল্যাণী আপাকে তার নামের মতোই ভালা মনে করেছিলাম। এই মহিলা দেখি নামেই কল্যাণী কাজে একদম অকল্যাণী। আপনার ছেলেটাও কেমন! একদম মাই*!”

গালি দিয়েই দাঁত দিয়ে জিভ কাটে মাধবী।
“আমি আসলে এভাবে বলতে চাইনি।”

লতা বেগম ম্লান হাসেন। বিড়বিড়ান,
“সব আমার কপালের দোষ! কপালের! কিন্তু তোমরা কী করে রাখবে আমাকে? তোমাদেরই তো কত আর্থিক সমস্যা?”

“আপনি হাতি-ঘোড়া খাবেন না আন্টি। আমাদের সাথে ডাল-ভাতই নাহয় খাবেন।”

লতা বেগম কৃতজ্ঞচিত্তে মাধবীকে দেখেন। তাঁর মনে পড়ে যায় একুশ বছর আগের সেই ঝড়ের রাতের কথা। একা মা-ছেলে ছোট্ট দুই কামরার টিনশেড বাসায়। গা কাঁপিয়ে জ্বর উঠেছিল সেবার জয়ের। সারারাত্রি জেগে মাথায় জল ঢেলেছেন আর তসবিহ হাতে কেঁদেছেন।

সুস্থ হওয়ার পর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাজারটা চুমু খেয়ে আবেদন করেছিলেন,
“খোঁকা আমাকে ছেড়ে যাস নে কখনো। আমি থাকতে পারবো না তোকে ছাড়া।”

জয়ও মাকে জড়িয়ে ধরে ওয়াদা করেছিল,
“আমি কখনো ছেড়ে যাব না মা তোমাকে। কখনো না।”

সেদিনের একুশ বছর পর আজ সেই ওয়াদাকে ঘাসফুলের ন্যায় পিষে দিল জয়। মায়ের প্রয়োজন আর মূল্য কি তবে শুধু বড়ো হওয়া অবধিই! আজ তো জয় মেতে উঠেছে নিজের নব আপনজনদের নিয়ে। অতীত মনে করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন লতা বেগম।

মাধবী বুঝলো না কোন ভাষায় নারীটিকে সান্ত্বনা দিবে। সে চুপচাপ জড়িয়ে ধরলো লতা বেগমকে। লতা বেগমও সন্তানের দেওয়া শোকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলেন মাধবীকে। যে কেউ দেখলে বলবে তারা মা-মেয়ে।

সন্ধ্যার পর লতা বেগম মাধবীকে নিয়ে লতা বেগমের বাসায় যায়। তাঁর সব কাপড়-চোপড়, প্রয়োজনীয় জিনিস, কাগজপত্র নিয়ে আসেন। কল্যাণী মাধবীকে দেখে ভেঙচি কাটে।

বিড়বিড়ায়,
“তোদের পিরিত আমি ছুটাবোই। আর মাধবী তোর আমি এমন অবস্থা করবো না! খালি দেখিস!”

___

শান্তিতে কেটে যায় মাধবী ও লতা বেগমের পরের দু’দিন। মাধবী আরও তিন-চারটি বাচ্চার টিউশনি নিয়েছে। লতা বেগম এখন বাচ্চাদের সামলান বলে মাধবী নিশ্চিন্তে যেতে পারে কাজে। এছাড়া ঘরের বাদবাকি কাজ লতা বেগম করতে চাইলেও মাধবী নিজেই তা সবার উঠার আগে শেষ করে স্কুলে যায়।

বিপদ আসে দুদিন বাদে। বাড়িওয়ালা ফোন দিয়ে জানায়,
“তোমাকে এখানে রাখা যাবে না। তুমি সামনের মাসেই বেড়িয়ে যাবে।”

“কেন চাচা? কী ভুল করেছি আমি?”

“তুমি জানো না কী ভুল করেছো? তুমি কল্যাণীর সংসার ভাঙতে চেষ্টা করেছো ওর শ্বাশুড়ির সাথে মিলে। তুমি ওর জামাইকে তোমার দিকে… ছিঃ! আমার তো বলতেই লজ্জা লাগছে।”

“না, চাচা। এসব মিথ্যে। বিশ্বাস না হলে লতা আন্টিকে…”

“আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। সামনের মাসের এক তারিখের আগে বাড়ি খালি চাই! আর হ্যাঁ, এডভান্সের টাকা দিব না আমি। ভুলেও চাবে না।”

কল ডিসকানেক্ট করে দেয় বাড়িওয়ালা। মাধবীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করা লাগবে, মাসিক খরচ আছে। সে কী করে এখন কোনো বাসা খুঁজবে আবার নতুন বাসার এডভান্সের টাকাই বা দিবে কোথা থেকে? তার উপর জিনিসপত্র নেওয়ার ভ্যান ভাড়া তো আছেই।

মাধবীর রক্তশূণ্য মুখ খানা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন লতা বেগম। তিনি কাঁধে হাত রাখতেই তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেয় মাধবী।

“কী হয়েছে মা? কাঁদছো কেন? আমাকে বলো।”

মাধবী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সব খুলে বলে। চমকিত হন লতা বেগম। কল্যাণী মিথ্যেবাদী, প্রতারক, খারাপ তিনি জানতেন। তাই বলে এতটা অমানবিক! সাথে সাথে জয়কে মাধবীর ফোন থেকে কল করেন তিনি। খাণিকটা সময় রিং হওয়ার পর জয় কল রিসিভ করে।

“হ্যালো।”

“আমি তোর মা লতা বলছি। তোর বউ এসব কী বলেছে মাধবীর বাড়িওয়ালাকে? তাড়াতাড়ি ওকে বল সত্য স্বীকার করতে বাড়িওয়ালার কাছে।”

“কী বলেছে ও চাচাকে?”

লতা বেগম একে একে লতার সকল মিথ্যে বচন তুলে ধরে।

“মা, এটা তোমাদের ঝামেলা। আমার কিছু করার নেই। তুমি আর ঐ মহিলা কল্যাণীর কাছে যেয়ে ক্ষমা চাইলেই তো হয়। কল্যাণী মেয়ে কিন্তু খারাপ না। ঠিকই ক্ষমা করে দিবে। আচ্ছা, বাই। বারবার ফোন দিয়ো না।”

লতা বেগম খাণিক সময়ের জন্য অসাড় হয়ে যান। পরক্ষণেই কঠিন এক সিদ্ধান্ত নেন। মাধবীর হাত ধরে বলেন,
“আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে তোমার মাধু মা। চলো।”

মাধবী ক্রন্দনরত চেহারায় জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকান। তিনি ইশারায় আশ্বস্ত করেন তাকে।

___

বিকেল গড়াতেই পুলিশের গাড়ি সাইরেন তুলে এসে হাজির এপার্টমেন্টের সামনে। সাইরেন শুনে জানালা, দরজা দিয়ে বাহিরে উঁকি দেয় আশেপাশের সকলে।

বাসার বেল বাজাতেই দরজা খুলে কল্যাণী। চোখের সামনে পুলিশ দেখে হচকচিয়ে যায় সে। ডাকতে শুরু করে জয়কে। জয়ও বাহিরে এসে পুলিশ দেখে বেশ ঘাবড়ে যায়।

“আপনিই কি মিস্টার জয় সামিয়ান?”

“জী, আমি। কোনো সমস্যা স্যার? আপনার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছেন আপনার মা লতা বেগম। আপনি না কি তার ফ্ল্যাট আত্মসাৎ করে থাকছেন?”

“কী! উনার এত বড় সাহস!” ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে কল্যাণী।

“হ্যাঁ, আমার সাহসটা বড়োই বড় বউমা। দেখছেন তো অফিসার সাহেব কেমন আচারণ পুত্রবধূর আমার সাথে?”

জয় ধমক দিয়ে উঠে কল্যাণীকে,
“তুমি চুপ করো না কল্যাণী! আমি কথা বলছি না?”

“আপনার এই মুহূর্ত বাড়ি ছাড়তে হবে মিস্টার জয়।”

“আরে মশাই এটা পারিবারিক সমস্যা। আমার মা বৃদ্ধ মানুষ কী বুঝতে না কী করে ফেলেছে তাতে এত সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই। মা, তুমি ভিতরে আসো। আমরা কথা বলি।”

“আমি কোনো কথা বলতে চাই না অফিসার। আপনার সামনে আমি জনাব জয়কে দিন দুই দিনের সময় দিলাম। এর মধ্যে যেন আমার বাসা খালি করে দেয়।”

“শুনেছেন তো আপনি জয়? এর বিপরীতে কিছু হলে আমরা স্টেপ নিতে বাধ্য হবো।”

পুলিশ অফিসার আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যান। তিনি যাওয়ার পর জয় বহুবার চেষ্টা করলেও লতা বেগম তাকে কথা বলার সুযোগ দেন না। গটগট করে চলে যান।

ঘরে ঢুকতেই মাধবী তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
“আন্টি, আপনি আমার জন্য নিজের সন্তানদের সাথে… আপনার ঋণ আমি কী করে শোধ করবো?”

“এই পাগলি মেয়ে তুই কি পর না কি তুই আমার শেষবয়সের মেয়ে, অতি প্রিয়।”

“আমি নিজের মাকে দেখিনি সামনা-সামনি। আমার মা হয়তো বেঁচে থাকলে তোমার মতোই হতো আন্টি। সরি তোমাকে তুমি করে বলে ফেললাম।”

“কীসের সরি আর আন্টি, হ্যাঁ? আমাকে তুমি করে মামনি বলেই ডাকবি তুই। একবার মামনি বল না মাধু মা?”

“মামনি! মামনি!” আরও শব্দ করে কেঁদে দেয় মাধবী।

“কাঁদিস না মা। আমাদের এখন অনেক পথ যাওয়া বাকি। মাধবীলতা গাছ যেমন বড় হয়, তেমনই আমাদের নিজেদের করতে হবে। সবাই যাতে অনুপ্রেরণা পায় মাধবীলতার গল্প থেকে।”

সায় জানায় মাধবী। পরম মমতায় মাধবীকে জড়িয়ে ধরে লতা বেগম।

___

কেটে গেছে সাতটা বছর। লতা বেগম ও মাধবীকে আজ পুরস্কৃত করেছেন দেশের সুনামধন্য এক এনজিও। লতা বেগম ও মাধবী একে অপরের ঢাল ও প্রেরণা হয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে জীবনে। তাদের একটা সংস্থা ও ব্যবসা আছে, যার দ্বারাদুঃস্থ গৃহবধূ বা অল্পবয়স্ক নারীদের নয়, আশ্রয়, কাজ এবং অনুপ্রেরণা দেওয়া হয় নিপীড়িত শাশুড়ি ও বয়স্ক মা সমাজকেও।

পুরস্কার হাতে মাধবী ও লতা বেগম বাড়ি ফিরছে নিজেদের প্রাইভেট কারে চড়ে। ভাবছে নিজের অতীতের কথা, অতীত জুড়ে থাকা মানুষগুলোর কথা।

সায়েম ও মাধবীর তালাক হয়ে গিয়েছে আরও ছয় বছর আগে। সেখান থেকে প্রাপ্ত টাকাতেই আজকের এই ব্যাবসা তাদের। ঐ ঘটনার পর বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল জয় এবং কল্যাণীও। এরপর আর কারো সাথেই যোগাযোগ হয়নি। কখনো পিছন ঘুরে তাকাননিই তারা। আজ সমাজের সকল মাধবী আর লতা বেগমদের জন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ মাধবীলতার যাত্রা।

খোঁজ-খবর না নিলেও চেনা পরিচিত লোকদের থেকে ভাসা ভাসা খবর ঠিকই পেয়েছেন তারা। অন্যায়কারীরা ভালো নেই। জয় এক নারী বিয়ে করে ঘরে তুলেছে কল্যাণীকে রেখে, তালাক দেয়নি যদিও। সায়েমের মা বিয়ের আগ মুহূর্তে জানতে পারেন নাতাশার শারীরিক মিলামেশা ছিল বিভিন্ন ছেলের সাথে, এজন্যই বিয়ে হচ্ছিলো না তার। ফলাফল স্বরূপ নাতাশা ও সায়েমের বিয়ে হয়নি, সায়েম আজও একাকিত্বে ভোগে। কোনো বাবা-মাই আর সাহস করেনি নিজের মেয়ে তার হাতে তুলে দেওয়ার। অরোনি ও রায়িমের তালাক হয়েছে, কারণটা জানা নেই মাধবীর। জানার ইচ্ছেও নেই, সে নিজের জীবনকে সফল করা নিয়ে ব্যস্ত। কে কী করছে জানার আগ্রহ নেই।

পড়ন্ত বিকেলের মুগ্ধকর মুহূর্তে মাধবী লতা বেগমের হাতে হাত রেখে বিড়বিড়ায়,
“আমরা মাধবীলতা, আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে কোনো পুরুষের প্রয়োজন পড়েনি। আমরা প্রমাণ নারী নারীর শত্রু নয়, হতে পারে একে অপরের শক্তির উৎস। আমরা একে অপরের ঢাল হয়েই সফল।”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here