মায়াডোর,১৫,১৬
(১৫ পর্ব)
.
কল্প আজ শুধুমাত্র ফরিদ সাহেবের জন্য হাঁটতে বেরিয়েছে। অন্যদিন সে খানিকটা হলেও দৌড়ায়। আজ পাশাপাশি ধীরগতিতে হাঁটছে। সামনে মসজিদ। ফরিদ সাহেব বললেন,
– ‘চলো মসজিদের ঘাটে গিয়ে জিরান লই।’
কল্প সম্মতি জানিয়ে উনার সঙ্গে যায়। ফরিদ সাহেন বসতে বসতে বললেন,
– ‘তা বলো, ওইদিন যে জিজ্ঞেস করলাম বৃদ্ধদের শেষ জীবন নিয়ে তোমার ভাবনা কি? কিছু কি ভেবেছো?’
কল্প মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘অন্য বৃদ্ধদের নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। আপনাকে নিয়ে অবশ্য ভেবেছি।’
– ‘তাই না-কি? তা কি ভাবলে?’
– ‘আপনি প্রচণ্ড একাকীত্বে ভুগছেন৷ নানিকে বোধহয় অনেক বেশি ভালোবাসতেন।’
তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তা ঠিক বলেছো, এই কারণে তোমাকে আমার এত পছন্দ। আচ্ছা এই অসুখের চিকিৎসাটা কি বলো তো।’
– ‘এখন থেকে আপনি দিনের নামাজগুলো মসজিদে এসে পড়বেন। ফজর এশা বাড়িতে পড়তে পারেন সমস্যা নেই।’
– ‘তাতে ফায়দাটা কি এক্সারসাইজ?’
গল্প প্রশ্নের ধরন দেখে হেঁসে ফেললো।
– ‘তা না, মসজিদে এলে আপনার সমবয়সীদের সঙ্গে একটা বন্ধন হবে।তাদের সঙ্গে খাতির জমাবেন। মাঝে মাঝে দাওয়াত দিয়ে বাসায় নিবেন। এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বিরক্তিকর৷ কিন্তু মিশলে দেখবেন ভালো লাগছে।’
– ‘মানে কি এসবের? বেকার ছেলেদের সঙ্গে বেকার বৃদ্ধদের মিলাতে চাচ্ছ না-কি?’
– ‘অনেকটা সেরকমই।’
– ‘আচ্ছা, তারপর।’
– ‘আপনি অবসরে আছেন এই ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।’
– ‘তাহলে কি ভাববো আমি একটা বেকার যুবক?’
– ‘তাও না, আপনি আরও বেশি নিজেকে ঝামেলায় জড়িয়ে রাখুন। সাংসারিক ঝামেলায়। যেমন ছেলের ব্যাবসা কেমন চলছে। কোনো ঝামেলা আছে কি-না। পরিবারে কেউ অসুখ হলে এটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন, কেউ ঠিকমতো পড়ছে কি-না দেখবেন। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির খবর নিবেন। ওদের সমস্যার কথা শুনবেন। এভাবে নিজেকে সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে রাখুন।’
– ‘তা কেন? মানুষ তো সমস্যা থেকে দূরে থাকতে চায়।’
– ‘কিন্তু আপনি থাকবেন না। নিজেকে দরকারি করে তুলুন। আরও বেশি সাংসারিক করে তুলুন। একেবারে বিছানায় পড়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত এভাবে থাকবেন।’
– ‘তোমার কি মনে হয়, তাহলে আমার সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে?’
– ‘আপনার তো কোনো সমস্যা নেই৷ আপনি একটা তুমুল ব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন। শিক্ষকতা করেছেন। অবসরের ঠিক আগে স্ত্রী মারা গেলেন। প্রচণ্ড ভালোবাসতেন তাকে। তাই যখন অবসর পেলেন। একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন আপনি। একাকীত্বে ভুগতে শুরু করেছেন। হঠাৎ রাগারাগি করছেন। মনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আগেকার সুন্দর দিনগুলোর কথা ভেবে গাইছেন ‘আগের বাহাদুরি এখন গেল কই’। শিক্ষিত হওয়ায় পাড়ার আট-দশজন বয়স্কদের সঙ্গেও মিশতে পারেন না। এটুকুই। আর আরেকটা সমস্যা হচ্ছে দুই ছেলে আছে, দু’জন ভালো বউ আছে। যার কারণে আপনার কোনো কিছু নিয়েই ভাবতে হচ্ছে না৷ সবকিছু মিলিয়ে আপনি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছেন। বসে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই আপনার। অবশ্য এখন নানি থাকলে খুবই হতো না। একজন সঙ্গী থাকতো।’
– ‘ঠিকই বলেছো তুমি।’
– ‘চলুন বাড়ি যাই এবার।’
– ‘হ্যাঁ চলো।’
বাড়িতে ফিরতে তাদের আটটা বেজে গেল। কল্প হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় বসতেই মুজিব উদ্দিন এসে ঢুকলেন। তারপর চেয়ার টেনে বসে খানিক ইতস্তত করে নাক টান দিয়ে বললেন,
– ‘ভাগনা কল্প, তুমি আমাকে একটা বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে?’
কল্পের বুকটা কেঁপে উঠলো। উনি আবার কিছু টের পাননি তো? সে ভয়ার্ত গলায় বললো,
– ‘কি করতে হবে মামা?’
– ‘আর বলো না বাবা। আমার ছোটবোন পাগল হয়ে গেছে ইতিকে তাদের বাড়িতে নেয়ার জন্য। ডেইলিই কল দিয়ে এক ঘ্যানঘ্যানানি চলে। ওরা ঢাকায় থাকে। তাই যাওয়া-আসা কম হয়। ইতি ছুটি তো, তাই বেশি জোরাজুরি করছে। আমি দোকান ফেলে এসবের টাইম আছে বলো? একা মানুষ। হুস্নাও বুঝতে চাচ্ছে না।’
কল্প শুকনো ঢোক গিলে বললো,
– ‘তুমি একটু ওকে নিয়ে যাও না ভাগনা৷’
– ‘কি বলেন মামা আমার ক্লাস আছে।’
– ‘আরে এগুলো অল্প কিছুদিনে সমস্যা হবে না৷ এই বয়সে কোথাও বেড়াতেও তো যাও না। শুধু পড়ালেখা করলে কি চলবো? ঢাকা তো মনে হয় যাওনি। একটু বেড়ানোও হয়ে গেল।’
– ‘না মামা…।’
– ‘না না করো না তো বাবা। মানুষ হয়ে জন্মাইছো শুধু চেয়ার টেবিলে বসে পড়ালেখা করে ২০-৩০ বছর কাটানোর জন্য না।’
কল্প ‘হা’ করে তাকিয়ে রইল। খানিক পর ইতি নাশতার ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকে। কল্পকে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে ট্রে টেবিলে রেখে বললো,
– ‘কি হলো কোনো সমস্যা?’
কল্প স্বাভাবিক হয়ে বিছানা থেকে উঠে চেয়ার টেনে বসে বললো,
– ‘না ঠিক আছি।’
– ‘আমার হাতে আপনার জন্য নাশতা বানিয়েছি জনাব। কিন্তু আমি সব পারি না। শুধু নুডলস সহজ লাগে তাই বানিয়েছি।’
কল্পের মন-মেজাজ এমনিতেই খারাপ। সে রূঢ় গলায় বলে উঠে,
– ‘তুমি প্লিজ বকবক না করে এখন যাও তো।’
ইতির মুখ মলিন হয়ে যায়। ভেবেছিল কল্প খুশি হবে। অথচ সে উল্টো রেগে গেল। সে রুম থেকে বের হয়ে এলো রান্নাঘরে৷ মুজিব উদ্দিন এসে বললেন,
– ‘হুস্না ইতিকে নিয়ে কল্প ঢাকায় যাবে।’
ইতি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘আমাকে নিয়ে ঢাকায় মানে?’
– ‘তোর ছোট ফুপুর বাসায়। উনি ডেইলি বলে। যা বেড়িয়ে আয়।’
– ‘আমাকে আগে তো বলোনি কেউ। কখন যাব? আর কল্প ভাইয়া কি রাজি হইছে?’
– ‘হ্যাঁ খুশিই হইছে উল্টো৷ ঢাকা যায়নি তো। বেড়ানো হবে তার।’
ইতি খুশিতে আত্মহারা হতে গিয়ে আবার দমে গেল। কল্প যদি খুশিই হবে তাহলে একটু আগে এমন করলো কেন? লোকে অকারণ বলে মেয়ে মানুষের মন বুঝা মুশকিল, অথচ পুরুষ মানুষের মন বুঝার জন্য স্কুল থাকা উচিত। ইতি নাশতা করতে বসে বললো,
– ‘কখন বের হব বাবা?’
– ‘তোদের ইচ্ছামতো বের হ। আমি কল্পের কাছে তোর ফুপুর নাম্বার দিয়ে যাচ্ছি। আর টাকা তোর মায়ের কাছে আছে।’
– ‘আচ্ছা।’
ইতির খুশিতে দম-বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কল্পকে বলবে ট্রেনে যাওয়ার জন্য। দু’জন কি সুন্দর মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে যাবে। নাশতা শেষেই সে গোসল করে নিল। যাওয়ার কাপড় পড়বে একেবারে খেয়ে-দেয়ে। এখন আপাতত পাতলা ফিনফিনে একটা ড্রেস পরে চুল মুছতে মুছতে সে কল্পের রুমে গেল। কল্প দুইহাত মাথার নিচে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। ইতি বিছানায় এসে বসলো। কল্প তাকায়। সদ্য স্নান করা ইতির মুখটা ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে শুরু করেছে। ওর চুল মোছার কি আর জায়গা নেই? সুডৌল কোমরে বারংবার চোখ চলে যাচ্ছে। ইতি খানিক পর কনুই বিছানায় ঠেকিয়ে নিজের থুতনি হাতের তালুতে রেখে তাকিয়ে থেকে বললো,
– ‘নাশতা কেমন হয়েছে?’
সে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ‘জঘন্য, আমি বিড়ালকে খাইয়ে দিয়েছি।’
– ‘মিথ্যে কথা বলবেন না তো। সবারই ভালো লেগেছে।’
কল্প কোনো জবাব দিল না। ইতি পুনরায় ব্যগ্র গলায় বললো,
– ‘কেন আমার সঙ্গে এমন করেন?’
কল্পের বুকটা শিরশির করে উঠে। ইতি চলে যাচ্ছে না কেন? সে রূঢ় গলায় বললো,
– ‘গোসল করে এসে এখানে এভাবে এসে বসে আছো কেন? যাও, কেউ দেখলে কি বলবে?’
– ‘কিভাবে বসেছি? বউদের মতো না-কি? তাহলে টেনে বুকে নেন।’
কল্প কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
– ‘তুমি কি যাবে? না আমিই বের হয়ে চলে যাব?’
– ‘আপনি আমার এই এক দূর্বলতা পাইছেন তাই না? শুধু চলে যাব, চলে যাব।’
– ‘যেতেই হবে তুমি যা শুরু করছো।’
ইতি বিছানা থেকে উঠে বললো,
– ‘আপনি না আমাকে নিয়ে ঢাকা যাবেন। তো শুয়ে আছেন কেন। গোসলে যান।’
– ‘তুমি আগে বের হও। আমি যখন ইচ্ছা গোসল করবো।’
– ‘যাবেন কখন?’
– ‘যখন ইচ্ছা।’
ইতি দাঁত কটমট করে তাকিয়ে থেকে বের হয়ে চলে গেল। কল্প শুয়ে রইল এভাবে। ইতি রেডি হয়ে কাপড় পরে হাঁটছে। কল্পের গোসলেরই নাম নেই। জোহরের পর হুস্না বেগম নিজেই এসে বললেন,
– ‘কল্প কখন যাবে বাবা? গোসল করে নাও।’
– ‘মাথা ব্যথা করছিল তো তাই শুয়ে রইছিলাম মামী। এখনই গোসল করছি।’
গোসল করে খেয়ে-দেয়ে বের হলো তারা বিকেল তিনটার দিকে। কল্পের পায়ে কেডস, পরনে জিন্স প্যান্ট আর ব্লেজারের নিচে ভি গলার কালো গেঞ্জি। ইতি সুন্দর করে সেজেছে। সবকিছুই ঠিক আছে। কেবল মনটা ভীষণ খারাপ। কল্পের প্রতি প্রচণ্ড রাগও আছে। রেডি হয়েছিল সকালে। এখন বের হয়েছে তারা৷ কল্প একবারও বলেনি কখন বের হবে। বললে সেজে-গুজে বাড়িতে এভাবে সারাদিন বসে থাকতে হতো না। কল্প রিকশা ডেকে উঠে বসেছে। ইতি একা একাই উঠে পাশে বসে। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে জল ছলছল চোখে বললো,
– ‘আপনি এরকম না করলেও পারতেন।’
– ‘এসব আজাইরা কথা রাখো তোমার। এখন কিভাবে যাবে বলো। রিকশা কোথায় যেতে বলবো। বাস স্টেশনে না-কি রেলস্টেশনে?’
ইতি চোখের জল আড়াল করে বললো,
– ‘রেলস্টেশনে।’
শখ দেখে কল্পের মেজাজ যেন আরও খারাপ হলো। জেদ মেটানোর জন্য বললো, ‘রিকশা বাস স্টেশনে যান।’
ইতি আহত নয়নে ওর দিকে তাকায়। কল্প অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ইতি আর কিছু বললো না। চুপচাপ বসে রইল। রিকশা চলে গেল বাস স্টেশনে। টিকিট কেটে দু’জন সিট পেয়েছে মাঝখানে। ইতি জানালার কাছে বসেছে। কল্প তার পাশে। বাস চলতে শুরু করেছে। ম্লানমুখে দুইহাত বুকে বেঁধে ইতি বাইরে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘ সময় এভাবে চুপচাপ বসে রইল সে। কল্পের ধীরে ধীরে মনটা কেমন হতে শুরু করেছে। অকারণ রাগারাগি করছে সে। যেতেই যখন হচ্ছে, মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? কল্প আস্তে-আস্তে বললো, ‘ইতি।’
ইতি তাকালো না। যেন সে ঘুমিয়ে আছে।
সে হাঁটু দিয়ে হাঁটুতে মৃদু ধাক্কা দিল। তবুও ইতির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কল্প অসতর্কভাবে ওর উরুতে হাত রেখে বললো, ‘কি হয়েছে এদিকে তাকাও।’
সঙ্গে সঙ্গে ইতি তার দিকে তাকালো। দুই গাল বেয়ে জল পড়ছে৷ কল্প সতর্ক হয়ে বাসের চারদিকে তাকায়৷ তারপর হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, ‘আরে কাঁদছো কেন? কেউ দেখলে কি বলবে?’
– ‘আপনি জানেন না কেন কাঁদছি?’
কল্প ওর এক হাত মুঠোয় নিয়ে বললো,
– ‘প্লিজ আস্তে কথা বলো। মানুষ শুনবে। কেন কাঁদছো বলো তো।’
– ‘আপনি আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন? আর কত অপমান, অবহেলা করবেন?’
কল্প এক হাত পিঠের দিকে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে গালে হাত রেখে বললো,
– ‘কানে কানে সব অভিযোগ বলো। আস্তে কথা বলবে। লোকে শুনলে কি থেকে কি ভাববে।’
ইতি ফিক করে হেঁসে উঠলো।
– ‘লোকে কিছু বললে বলবেন আপনার বউ আমি।’
– ‘ধ্যাৎ, সব সময় ফাজলামো। এখন বলো তো এত কষ্ট পাওয়ার কারণ কি?’
– ‘আমাকে বললেই হতো দেরিতে বের হবেন। আমি সকাল থেকে রেডি হয়ে বসে রইলাম আর আপনি এটা কি করলেন?’
কল্প কোনো সদুত্তর দিতে পারলো না। ইতি পুনরায় বললো, ‘আর আপনি নিজেই বললেন ট্রেনে না বাসে যাব। আমি ট্রেন বলতেই আপনি রিকশাওয়ালাকে বললেন বাস স্টেশনে যেতে। কেন সব সময় আমার সঙ্গে এমন করেন বলুন তো?’
কথাটা বলে ইতি ফ্যাসফ্যাস করে আবার কেঁদে দিল। একটুও কাঁদতে চায়নি সে। তবুও কান্না এসে গেল। একটু আগেই মন ভীষণ খারাপ ছিল। এখন আশ্চর্য এক ভালো লাগায় ছেয়ে গেছে মন। কল্প মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
– ‘প্লিজ ইতি। বাসে মানুষ ফলো করবে। তুমি একটু শান্ত হও। আর সবকিছুর জন্য আমি স্যরি। ওকে?’
কল্পের কানে নাক ঠোঁট ঘষে ইতি উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আচ্ছা জান।’
কল্পের দম-বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ইতিকে কখনও প্রেমের প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ দিতে চায় না সে। সে হেঁসে ওর কোমল গাল টিপে দিয়ে বললো, ‘সারাক্ষণ শুধু দুষ্টামির চিন্তা কেন? আমি জড়িয়ে ধরেছি না? এবার ঘুমিয়ে যাও। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’
ইতি আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ওর গলায় মুখ গুঁজে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে ‘ওম-ওম’ গলায় বললো, ‘ঠিকই বলেছেন। আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর শখটাও মিটে যাবে…।’ এটুকু বলে থামে সে। তারপর বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পুনরায় বলে, ‘আচ্ছা আপনার শরীরে কি যেন একটা ঘ্রাণ আছে৷ আমাকে ঘোর লাগিয়ে দেয় বারবার। মাতাল হয়ে যাব মনে হচ্ছে।’
কল্পের শরীর বারবার কাঁটা দিয়ে উঠছে। উষ্ণ একটা স্রোত পুরো শরীরে বয়ে যাচ্ছে৷ এ কেমন বিপদে পড়েছে সে? একটা পরিবার তাকে কোন মর্যাদার আসনে বসালে এভাবে মেয়েকে তার সঙ্গে দেয়? সে এই বিশ্বাসের মূল্য কিভাবে দেবে? ইতি পুনরায় উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে ফিসফিস করে বললো, ‘ইশ এত শান্তি লাগছে কেন বলুন তো। আপনাকে আমার এত্ত ভালো লাগে কেন কল্প ভাইয়া?’
কল্প দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে আছে। পুরো শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছে তার। ইতি এক হাতে তার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘ভুলেও ভাববেন না আমি নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে। আমার পেছনে একশো ছেলে ঘুরলেও আমি ফিরে তাকানোর মতো ছিলাম না। কিন্তু আপনার মাঝে যে কি আছে আল্লাহই জানেন। প্রথমদিন দেখেই নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে হয়ে গেছি।’
কল্পের ভয় বেড়ে যাচ্ছে। ইতি মনে হয় সব কথা বলে ফেলবে। এখন কি করবে সে? হঠাৎ মাথায় এলো কিছুই শুনেনি এরকম একটা ভাব ধরে থাকতে হবে। সে আলগোছে চোখবুজে ইতির মাথায় নিজের মাথা ফেলে দিল।
তাইই হলো। ইতি সত্যিই ভেবেছে কল্প ঘুমিয়ে গেছে। সে নিজের মাথাটা আলগোছে সরিয়ে কল্পকে কাঁধে জায়গা করে দিয়ে ওর ঘন কালো চুলে আঙুল ডুবিয়ে দিল।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম
মায়াডোর (১৬ পর্ব)
.
বিরতির জন্য বাস থামিয়েছে। এখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। ইতির কথাগুলো না শোনার ভান করতে যেয়ে কল্প সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল। পুরো রাস্তা পরম মমতায় ইতি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। একা জেগে থাকলেও খারাপ লাগেনি, সবকিছু অসম্ভব ভালো লাগছিল। বাইরে তাকালেই রাস্তার পাশে সবুজ মাঠ, ধানক্ষেত, বাড়ি-ঘর, ব্যস্ত মানুষদের ছুটে চলা। সবই মুগ্ধ হয়ে দেখেছে ইতি। একসময় গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। কল্প তখনও ঘুমে। ইতির হাতে, কাঁধে ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। তবুও সে নড়েনি। মানুষটা ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। কিন্তু বিরতির জন্য বাস থামিয়েছে। কিছু একটা খাওয়া দরকার। তাই না ডেকে এখন আর উপায় নেই। ইতি মাথায় হাত রেখে ডাকলো,
– ‘আর কত ঘুমাবেন উঠুন।’
দু’বার ডাকতেই কল্প উঠে গেল। লাল টকটকে চোখে চারদিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘বাসের মানুষ কই?’
– ‘বিরতি এখন। নাশতা করতে হবে না বুঝি, উঠুন।’
– ‘বাবা সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’
– ‘হ্যাঁ, এত ঘুমাতে পারেন আপনি। আমার হাত অবশ হয়ে যেত আরও কিছুক্ষণ পর।’
– ‘তুমি ডাকতে পারতে। স্যরি। কখন ঘুমিয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি।’
– ‘স্যরি বলার কিছু নাই। নামুন।’
দু’জন বাস থেকে নামে। বাইরে সন্ধ্যার ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ইতি হাত ফোটাতে গিয়ে বলল ‘উফ নাড়ানো যাচ্ছে না।’
কল্প হাই তুলে বললো, ‘এতক্ষণ তোমার কাঁধেই ছিলাম?’
– ‘জি জনাব।’
– ‘ইশ তাহলে তো তোমার কষ্ট হইছে অনেক। এতক্ষণ কিভাবে পারলে ধৈর্য ধরে বসতে?’
– ‘আপনার ঘুম ভাঙবে বলে ধৈর্য ধরে থেকেছি।’
কল্পের বুকটা আবার শিরশির করে উঠে। এই মেয়েটা তাকে এত ভালোবাসে কেন? কিভাবে উপেক্ষা করবে সে। কল্প ওর গালে হাত দিয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘ইতি মাঝে মাঝে তোমাকে অনেক কষ্ট দেই তাই না?’
ইতি তন্ময় হয়ে কল্পের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কল্প নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে ওর হাত ধরে বললো,
– ‘চলো নাশতা করি। হাতে বেশি ব্যথা করছে তোমার? তুমি অন্যভাবে না নিলে নাশতা করে এসে আমি ম্যাসেজ করে দেবো।’
ইতি হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘অন্যভাবে মানে কি?’
– ‘তুমি যদি আবার আমাদের প্রেম হয়ে গেছে ভাবো তাহলে তো সমস্যা।’
ইতি আর কিছু বললো না। চুপ হয়ে গেল। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি না করে দেয়? তাহলে ভীষণ কষ্ট পাবে ইতি। আরও দিন যাক। ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে কল্প ভাইয়াও দূর্বল হয়ে পড়ছে। রেস্টুরেন্টে ঝলমলে আলো। চোখে লাগছে ভীষণ। ইতিকে বসিয়ে রেখে কল্প হাত-মুখ ধুয়ে এসে চেয়ার টেনে বসে ফিসফিস করে বললো, ‘আরও অনেক সময় বাসে থাকতে হবে তো। বাথরুমে যেতে পারো।’
ইতি লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে বললো ‘ধ্যাৎ।’
ওর হাতের নীল চুড়িগুলো চিকচিক করছে। হাতে কি সুন্দর মানিয়েছে চুড়ি। ইতি তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, ‘কি দেখছেন?’
– ‘কিছু দেখছি না, বাথরুমের কথায় এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে। তোমরা মেয়েদের অকারণ সবকিছু নিয়ে লজ্জা। এগুলো নিয়ে লজ্জার কি আছে বুঝি না।’
– ‘এসব কথা বন্ধ করুন তো। কি খাবেন, অর্ডার দিন।’
দু’জন নাশতা করে বাসে ফিরে এসেছে। কল্প বসতে বসতে বললো, ‘নিজের কাছে এখন খারাপ লাগছে।’
ইতি বসে কপাল থেকে চুল সরিয়ে বললো, ‘কেন?’
– ‘নাশতা করতে যেয়ে তুমি বললে হাত তুলে মুখে নিতে ব্যথা করছে।’
– ‘এগুলো ঠিক হয়ে যাবে।’
কল্প ম্লানমুখে বাইরে তাকিয়ে বসে রইল। ইতি তার হাতে আলগোছে একটা চিমটি দিয়ে বললো, ‘অন্যভাবে নেব না ম্যাসেজ করে দিন।’
কল্প মুচকি হেঁসে বাসের দিকে তাকায়। বাতি বন্ধ। ফ্যান চলছে। মানুষ ইয়ারফোন কানে গুঁজে চোখবুজে আছে। কেউ মোবাইল টিপছে। কল্প আস্তে-আস্তে ইতির কাঁধে হাত রাখে৷ কাঁধ থেকে টিপে টিপে আসে পেশিতে৷ তারপর ফিসফিস করে বললো, ‘হাত তোলা দাও এভাবে।’
ইতি তাই করে। খানিক পর কল্পের কাঁধে মাথা রেখে ওর হাতটা কোলে এনে ধরে বসে ইতি বললো, ‘একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন?’
ইতির গালে এক হাত রেখে কাতর গলায় কল্প বললো, ‘ইতি আমি যেভাবে তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। এমনিতেই নিজেকে কন্ট্রোল করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা করো। ইমোশনাল হয়ে তোমার সঙ্গে যদি একটা সম্পর্কে যাই পরে পস্তাতে হবে।’
ইতি চোখে চোখ রেখে বললো ‘আপনিও আমাকে পছন্দ করেন তাই না? তাহলে এমন করছেন কেন?’
– ‘সরাসরি কোনো প্রশ্নই আমাকে করবে না ইতি। আমি জবাব দেয়ার কিছুই খুঁজে পাব না।’
– ‘আপনার ভয়টা কিসের বলুন তো।’
– ‘আমি প্রেমে জড়াতে চাই না।’
– ‘আপনি আমাকে পছন্দ করেন না?’
– ‘এই প্রশ্ন আসছে কেন? আমি প্রেমে জড়াতে চাই না। এটাই শুধু জেনে রাখো।’
– ‘তাহলে বিয়ে করে নিন।’
– ‘আমি মাত্র অনার্সে পড়ি।’
– ‘আপনি চাইলেই চাকরি পাবেন এখনও।’
– ‘এত কম বয়সে বিয়ে করবো? আর তোমারই বা এখন কত বয়স যে বিয়ে করবে?’
– ‘তাহলে প্রেমে সমস্যা কি? আমার পরিবার আপনাকে মেনে নিবে আমি জানি।’
– ‘আমার মনে হয় না৷ তুমি কিছুই জানো না। আমাদের দুই পরিবারে ঝামেলা কি নিয়ে জানো? তোমার বড় ফুপুকে বড়ো মামা পছন্দ করতেন। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তোমাদের পরিবার দেয়নি বিয়ে। এসব নিয়ে মনোমালিন্য এখনও আছে।’
– ‘তাই না-কি, জানতাম না তো। তাহলে ওরা নীলা আন্টিকে কিভাবে মেনে নিল। আমার ধারণা আপনাকেও নেবে।’
– ‘ইতি প্লিজ আমি আজকাল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। তুমি একটু ছাড় দাও আমাকে। এরকম করলে আমি ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি।’
ইতি ফিক করে হেঁসে বললো ‘ভাবের দোকানদারের অবস্থা তাহলে এই?’
– ‘দুষ্টামি করো না ইতি। আমি সুপ্তি আপুকেও তোমার কথা বলেছি। আপু খুবই সাবধান করে দিয়েছেন।’
– ‘ওমা আপনি কি বলেছেন? বলতে গেলেন কেন?’
– ‘আমি কি করবো বলো? তুমিই বলো আমারও তো বয়স কম। তুমি এরকম করলে আমি কিভাবে ঠিক থাকতে পারি? আপুও বললেন কোনোভাবে যেন প্রেমে না জড়াই। খুবই ঝামেলা হবে। তোমাদের পরিবারও কষ্ট পাবে। মামার মুখও ছোট হবে।’
– ‘এসব চিন্তা করার কিছু নাই। এতকিছু ভেবে কি প্রেম হয়?’
– ‘ইতি প্লিজ, পাগলামি করো না। আমি তোমাকে একটা কথা বলি। আমি অনার্স শেষ করে চাকরি নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব না হয় দেবো। আপাতত আমাদের বাড়াবাড়ির দরকার নেই।’
– ‘কিন্তু যদি না দেন?’
– ‘আমি তোমাকে কোনো কথা দিতে চাই না। আমার মামা-মামী আছেন। চাচারা আছেন। ওরা মানলে এবং তোমার পরিবার মানলে বিয়ে হবে।’
– ‘আপনার নিজের কোনো ইচ্ছার মূল্য নেই?’
– ‘আমার কাছে বিশ্রী লাগছে ব্যাপারটা। তোমার পরিবার এত বিশ্বাস করে…।’
ইতি মুখ ধরে ফেললো।
– ‘এসব শুনতে চাই না। আপনিও আমাকে ভালোবাসেন আমি জানি।’
কল্প হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
– ‘এসব শুনতে না চাইলে আমি তোমাদের বাসা থেকে চলে যাব।’
ইতি তাকে ছেড়ে দিয়ে থমথমে মুখে বসে রইল। কল্প আবার বললো, ‘ভালো হয় তোমাকে আর টিউশনি না করালে। সময় এলে বিয়ের প্রস্তাব দেবো৷ সব মিলিয়ে যদি পাই তাহলে পেলাম। আর না হয় দু’জনই পরিবারের মতো বিয়ে করবো। ওকে?’
ইতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ‘আপনি একটা কাপুরুষ। এভাবে প্রেম হয় না।’
– ‘আমি তো প্রেম করতে চাইও না ইতি। আমি প্রথম থেকেই প্রস্তুত ছিলাম কোনোভাবে প্রেমে জড়ানো যাবে না৷ তোমার পরিবার আমাকে কত বিশ্বাস করে। তোমার দাদাভাই জানো আমাকে কত পছন্দ করেন? যদি এসব শুনেন কত কষ্ট পাবেন।’
– ‘কিন্তু আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন।’
– ‘তুমি কি ভালো না বাসার মতো কেউ? না চাইলেও প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে মানুষ।’
– ‘তাহলে কাপুরুষের মতো পিছিয়ে যান কেন?’
– ‘ইতি আমি আট-দশটা ছেলের মতো তোমার রূপের মোহে পড়ে ভ্রমরের মতো ফুলে বসতে চাচ্ছি না। অন্যরা ভাবে যা হওয়ার হবে আগে মজাটা করে নিই৷ কিন্তু আমি এরকম না। সবদিক ভাবছি।’
– ‘যাইহোক আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবো না। আপনি নিজের মতো থাকুন। আমাদের বাসায়ই থেকে পড়ালেখা করুন। আপনার কাছে আর পড়বোও না।’
কল্প জানালার বাইরে তাকায়। তার চোখ জলে ভরে গেছে৷ প্রেমে কোনোভাবেই জড়ানো যাবে না। সে ভেজা গলায় বললো, ‘ইতি নিজেকে শক্ত করে নাও। এভাবেই থাকো। আমি একটু এরকমই। আমি সবকিছু নিয়ে অগ্রিম ভেবে রাখি। কোনোদিনই আমার অগ্রিম ভাবনা বিফলে যায় না। আমি জানি প্রেমে জড়ালে সমস্যা হবে। তুমি একবার ভাবো যদি প্রেম করি। তারপর একে অন্যকে না পাই? তাহলে কেমন কষ্ট হবে?’
ইতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো ‘আপনি একটা মানসিক রোগী। অতিরিক্ত ভাবনা, অগ্রিম ভাবনা এগুলো কোনো গর্বের কথা নয়। পৃথিবীতে কোনোকিছু ছক এঁকে হয় না। এখনও আমাকে ছাড়তে আপনার কষ্ট হচ্ছে, হচ্ছে না? আমারও হচ্ছে। তাহলে প্রেম করলে কি সমস্যা? শেষে পেলে পেলাম। না পেলে এখন যে কষ্ট পাচ্ছি সেটা তখন পাব।’
কল্প কোনো জবাব দিল না। ইতি পুনরায় হেঁসে বললো, ‘পৃথিবীতে আজ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। প্রেম করার আগেই ছ্যাঁকা খাওয়ার ভয়ে দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা অগ্রিম ছ্যাঁকা খেয়ে নিল। ভাবেন আপনি কত বড়ো উন্মাদ। এরকম কাপুরুষ ছেলে পৃথিবীতে থাকতে পারে জানতাম না। অবশ্য আমিও পৃথিবীতে নারী জাতির জন্য কলংক। এরকম কাউকে কেউ এত নির্লজ্জের মতো ভালোবাসেছে কি-না আমার সন্দেহ আছে।’
– ‘প্লিজ ইতি শান্ত হও।’
– ‘নীলা আন্টির মোবাইল দিয়ে ফেইসবুকে আপনার ওই জবরুল ইসলামকে বের করে ছিলাম। একটা লেখা পড়েছিলাম টাইমলাইম ঘুরে। ওই লেখাটাও জানেন আমার নিজের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। লেখাটা শুনবে কি? ইতি বিড়বিড় করে বললো,
“প্রতিটি মানুষের আত্মসম্মানবোধ থাকে, অহমিকা থাকে, কেউ তাকে ছোট করে কথা বললে তার প্রচণ্ড রাগ হয়৷ সেই মানুষই আবার কাউকে এতটাই ভালোবেসে ফেলতে পারে যে, নিজেকে একেবারে সস্তাভাবে ওর কাছে বিলিয়ে দিতে চায়, ওর সকল যত্নের দায়িত্ব নিতে চায়, আদর করে আদর করতে চায়, দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত পাশে থাকতে চায়। দুঃখের ব্যাপার হলো একেবারে সস্তাভাবে নিজেকে দিয়ে দিতে চাইলেও প্রায়ই ভালোবাসার মানুষটি আমাদের নেয় না।”
আমার হয়েছে এই অবস্থা৷ নিজেকে কত সস্তা বানিয়েছি। সব সময় বেহায়ার মতো লেগে থেকেছি। কিন্তু আপনি বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
কল্প কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ বসে রইল। ইতিও খানিক নীরব হয়ে গেল৷ রাত নয়টার দিকে তারা এলো ফুপুর বাসায়। মহাখালী বাস স্টেশন থেকে তাহিদ তাদের রিসিভ করে এনেছে। তাহিদ ডাক্তার। পড়ালেখা শেষ করে নতুন চেম্বার দিয়েছে৷ বাসায় মানুষ তাদের খুবই কম। তার বাবা ব্যবসা করেন। মরিয়ম বেগম বাসায় একা। একটা কাজের মেয়ে আছে। তাহিদকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু সে আরও বছর দুয়েক পর বিয়ে করতে চায়। মরিয়ম বেগম কল্পকে আলাদা একটা রুমে দিলেন। সে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই খাবার টেবিলে ডাকলেন। ইতিও ফ্রেশ হয়ে এসে বসেছে। সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছেন। মরিয়ম বেগম প্রথমেই বললেন,
– ‘তোমার নাম কল্প?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘ভাইয়ার মুখে তুমি আসছো শুনে আমি তো অবাক৷ তাহিদ চিনতে পেরেছিস ওকে? মুনিয়া আপুর ছেলে। ওইযে শপিংমলে দেখা হয়েছিল৷ তারপর আমাদের বাসায় আসতে দাওয়াত দিয়েছিলাম।’
ইতি বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছে কল্পের দিকে। কল্প মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে। সে জানে তার মায়ের বাসা ঢাকায়। কখনও আসেনি সে৷ মা বছর কয়েক পরে নানাবাড়ি গেলে দেখা হয়। উনার স্বামী ছাড়া তেমন কেউই জানে না আগের একটা সন্তান আছে৷ মরিয়ম বেগম বললেন,
– ‘তোমার মায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় মাঝে মাঝে।’
কল্প ‘ও আচ্ছা’ বলে আবার মাথা নুইয়ে ফেললো। তাহিদ বললো,
– ‘তুমি কখনও এসেছিলে ওই বাসায়? খালা তো অসুস্থ ছিলেন। উনার কিডনিতে প্রব্লেম ছিল।’
– ‘শুনেছিলাম, কখনও আসিনি।’
– ‘এটা কেমন কথা মা’কে দেখবে না এসে?’
মরিয়ম বেগম ধমক দিয়ে বললেন, ‘আরে বোকা, তাকে আড়াল রেখে মুনিয়া আপুর বিয়ে দেওয়া হইছিল। এরপর তো দুলাভাই জেনে ফেলেছিল। অবশ্য শেষে ঝামেলা হয়নি, শুধু বলেছিল ছেলে সে গ্রহণ করবে না। আর তার আত্মীয়-স্বজন যাতে কেউ না জানে। তাই যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলে। এখন সে কিভাবে বাসায় এসে দেখবে?’
মালিক সাহেব রূঢ় গলায় বললেন, ‘মরিয়ম তুমি এই অনর্গল কথা বলার অভ্যাসটা ছাড়ো। তুমি যাকে নিয়ে কথা বলো তার প্রতিক্রিয়া কি তা খেয়াল করো না। ছেলেটা খেতে বসেছে খেতে দাও।’
মরিয়ম বেগম রেগে গিয়ে বললেন ‘তুমি নাক গলাবে না একদম। ও আমার বোনের ছেলে। ওর সঙ্গে আমি কিসের এত হিসাব-নিকাশ করে কথা বলবো?’
মালিক সাহেব আর কোনো কথা বললেন না। মরিয়ম বেগম পুনরায় বললেন,
– ‘কল্প তোমাকে না-কি তোমার বাপ-চাচারা নিতে চায়। তুমি যাও না? তোমার মা বলেছিল এই কথা।’
– ‘জি, ওরা বলে, আমি যাই না।’
– ‘তোমার না-কি ওইখানে সম্পদের অভাব নাই। চাচা একজনও ফ্যামিলি সহ ইংল্যান্ড। তাহলে যাও না কেন?’
– ‘বাবাকে তো ছোটবেলায়ই হারিয়েছিলাম। দাদা-দাদিও নেই। নানাবাড়ি এসে নানা-নানি পেয়েছি। ওরা মারা যাওয়ার পর। সুপ্তি আপুও আছেন। ওখানেই আমি ভালো থাকি। তাদের ছেড়ে যেতে চাইনি৷’
– ‘তোমার মা’কে আমি কল দিয়ে বলেছি তোমার কথা। সে বলেছে আসবে আমার বাসায়। তোমাকে নিয়ে যেন না যাই।’
কল্প কোনো কথা বললো না। মালিক সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার সবকিছুতে বাড়াবাড়ি মরিয়ম। ছেলেটা কি বলেছে মায়ের সঙ্গে দেখা করবে? সে এসেছে ইতি মা’কে নিয়ে। তুমি ওর মা’কে কল দিতে গেলে কেন?’
– ‘তুমি চুপ থাকো। সবকিছু বলতে হয় না-কি৷ এত কাছ থেকে এসে চলে যাবে এটা হয়? মা-ছেলের দেখা করিয়ে দিলে ক্ষতি কি? মুনিয়া আপু আমার মামাতো বোন, দুরের কেউ না। বাসায় আসার জন্য বলতে পারি না?’
– ‘তোমাদের দুই ফ্যামিলির সম্পর্ক ভালো না আমি জানি।’
– ‘তাহলে কল্প আমাদের বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করছে কিভাবে? বাজে কথা না বলে চুপ থাকো।’
ইতির এসব শুনে হঠাৎ কষ্ট হচ্ছে। কখনও কল্পের এই বিষয়গুলো নিয়ে সে মাথা ঘামায়নি। ওর মায়ের ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। কল্পের কষ্ট হয় কি-না কে জানে। এই মুহূর্তেই বা তার কেমন লাগছে? খাবার শেষে কল্প নিঃশব্দে ওর রুমে চলে গেল। ইতিও খানিক পরেই ওর রুমে গেল। কল্প বিছানায় শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে।
ইতি বিছানায় গিয়ে বসে বললো, ‘আপনার আম্মুর সাথে দেখা হবে, আপনার হয়তো অনেক ভালো লাগছে, তাই না?’
কল্প ওর দিকে না তাকিয়ে বললো, ‘বাসে কিন্তু বলেছি ইতি। আমাদের বাড়াবাড়ি কমিয়ে আনতে হবে৷ অপ্রয়োজনীয় সবকিছু বাদ। টিউশনি অবধি বাদ। তুমি এখন একটা নতুন বাসায় বেড়াতে এসে আমার রুমে ঢুকে বিছানায় বসে আছো কেন?’
– ‘সবকিছু বাদই তো। এখন আমি এমনিতেই এসেছিলাম।’
– ‘আসার দরকার নেই, তুমি এখন বের হয়ে গেলে খুশি হব। আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা মাথায় রেখো।’
ইতি মন খারাপ করে উঠে চলে গেল৷ সিটিং রুমে মরিয়ম বেগম আর তাহিদ বসে আছে৷ ইতি তাদের কাছে গিয়ে সোফায় বসলো। তাহিদ ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিরে তুই না-কি এখন ফেইল টেইল মারিস না। এসএসসিতে না-কি ভালো রেজাল্ট করেছিস?’
– ‘আজাইরা কথা বলবে না ভাইয়া৷ আমি শুধু একবারই এইটে ফেইল করেছিলাম।’
– ‘তা এসএসসি পাস করেছিস। এখনও তোর মোবাইল নেই৷ কল্পের মোবাইলে যোগাযোগ করতে হইছে। এটা কেমন কথা।’
– ‘তোমার মামা আর নানা টাকা না দিলে আমি কিভাবে কিনবো। ওরা বলে এইচএসসি পর দেবে। মা তো বলেন মোবাইল দিয়ে কি হবে৷ বিয়ের পর জামাই দিলে ইউজ করবি।’
– ‘ওরা দিতে হবে কেন? তুই চু*রি করবি টাকা। নানার পকেট মারতে পারিস না?’
– ‘একদিন মেরেছিলাম। বাড়িতে বাটি চালান হয়েছে।’
তাহিদ আর মরিয়ম বেগম হেঁসে উঠলেন। তাহিদ তারপর বললো, ‘তোরা পাগলের গোষ্ঠী।’
মরিয়ম বেগম পায়ের জুতা দেখিয়ে বললেন, ‘জুতা খুলে মারতে শুরু করবো আজেবাজে কথা বললে।’
তাহিদ হাসতে হাসতে খানিক পর বললো,
– ‘ইতি তুই যেহেতু পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছিস। তাই আমিই তোকে একটা মোবাইল কিনে দেবো।’
ইতি বিস্মিত হয়ে বললো ‘সত্যিই?’
– ‘হ্যাঁ।’
তারপর ইতির আবার মুখটা মলিন হয়ে গেল।
– ‘কিন্তু তুমি দিলেও আব্বু-আম্মু রাগারাগি করবে।’
– ‘সেটাও আমি ম্যানেজ করবো। রাগারাগি করে তুই পড়িস না তাই।’
মরিয়ম বেগম ইতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুই বড়ো হয়ে গেছিসরে মা। তোদের জন্য কত টানে ফুপুর। যেতে পারি না। এইযে গরু, বলতে বলতেও নিয়ে যায় না৷ বাপের মতো খাটাশ হয়েছে।’
– ‘থাক ফুপু আমি কিছু না বলি। কিছু বললে আবার মোবাইল হাত ছাড়া হতে পারে।’
মরিয়ম বেগম হেঁসে উঠলেন। তাহিদের কল এসেছে। সে উঠে চলে গেল।
___চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম