মায়াডোর-০২,০৩

0
417

মায়াডোর-০২,০৩

(২য় পর্ব)
.
নিলয় কল্পের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর হাত ধরে বললো,

– ‘ভাইয়া আমিও তোমার মতো মুখ শেভ করে স্কুলে যাব।’

সুপ্তি খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। কল্প নির্লিপ্ত চেহারায় বললো,

– ‘এটা অবশ্য ভালো বলেছিস। ক্রিম লাগা গিয়ে, আমি নিজেই শেভ করে দিব।’

কল্পের হাবভাব দেখে সুপ্তির মনে হয় সত্যিই শেভ করে দিতে পারে। ওকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। চাকা ঠেলে এগিয়ে গিয়ে নিলয়ের হাত ধরে বললো,

– ‘তুমি এখনও অনেক ছোট আছো ভাই। বড়ো হলে শেভ করবে। এখন তাড়াতাড়ি স্কুলে যাও।’

সে সুবোধ বালকের মতো চলে যাচ্ছিল। কল্প ওর হাত ধরে বললো,

– ‘বল্টু তোর মুখে দাড়ি নাই তো কি হয়েছে। মাথায় তো দাড়ি আছে। আজ তোর মাথা কামিয়ে স্কুলে পাঠাবো। সবাই তোকে দেখে বলবে ‘ন্যাড়া মাথায় ঢেউ টিন, টাকা থাকলে বউ কিন।’

নিলয় সঙ্গে সঙ্গে হাত মোচড়ামুচড়ি শুরু করে কেঁদে ফেললো। কল্প তার হাত ধরে টেনে রেজার নিতেই হাতে কামড় দিয়েই দৌড়ে চলে গেল নিলয়।
সুপ্তি হাসতে হাসতে বললো,

– ‘আচ্ছা কল্প আমাকে নূরজাহান উপন্যাসের বাকি দুই খণ্ড কি আর এনে দিবি না তুই?’

– ‘আমাদের বাজারের দোকানে নাই তো আপু। এক খণ্ডই ছিল।’

– ‘দোকানদারকে না বলেছিলি এনে রাখতে।’

– ‘হ্যাঁ বলেছি।’

– ‘তো কবে আনবে। আমি এই উপন্যাস তিনবার পড়ে ফেলেছি।’

কল্প হেঁসে বললো,

– ‘তুমি কিভাবে পারো একেকটা উপন্যাস পাঁচবার-দশবার পড়তে?’

– ‘আমার তো ভালোই লাগে পড়তে। থ্রিলার উপন্যাস ছাড়া সব গল্প-উপন্যাসই একাধিকবার পড়া যায়।’

– ‘কেন? থ্রিলার কেন একাধিকবার পড়া যাবে না।’

– ‘সেগুলো একবার পড়লেই রহস্য শেষ হয়ে যায় তাই। আমি তো সকল বই বহুবার করে পড়ি। তাই এগুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। সবচেয়ে বেশি পড়া যায় হাসির গল্প। এরপরের স্থানে প্রেমের। এরপরের পরের স্থানে সামাজিক।’

– ‘বাবা ভালোই গবেষণা করেছো। যাইহোক আমি তাহলে সিলেট থেকে কুরিয়ারে নূরজাহান পাঠিয়ে দেবো৷ মামা তোমাকে কুরিয়ার থেকে এনে দিবেন।’

– ‘তাহলে আরও কিছু বই পাঠিয়ে দিস।’

– ‘টাকা বুঝি লাগবে না ম্যাডাম। তুমি লিস্ট করে রাখো। মামাকে বলে বিকাশে টাকা দিলে আমি কিনে পাঠিয়ে দিব।’

– ‘আচ্ছা, কিন্তু আপাতত গিয়েই নূরজাহান পাঠাবি।’

কল্প মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। সুপ্তি চাকা ঠেলে দরজার সামনে গিয়ে আবার পিছু ফিরে বললো,

– ‘ছোট চাচা সৌদি থেকে টাকা কিভাবে পাঠাবেন তোর কাছে?’

– ‘আমার কাছে না৷ বড়ো মামার কাছে দিবেন। উনি বিকাশে পাঠাবেন আমাকে।’

– ‘কোচিং ফির টাকার ব্যবস্থা হয়েছে?’

– ‘আমি যাওয়ার পর মামা বিকাশে দিবেন। এখনও ছোট মামা পাঠায়নি।’

– ‘ও আচ্ছে।’

সুপ্তি বের হয়ে গেল রুম থেকে। কল্প গোসল করে এলো গিয়ে পুকুর থেকে। টেবিলে খাবার দিলেন সালেহা বেগম। কল্প চেয়ার টেনে খেতে বসেছে, সালেহা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন,

– ‘দেখলে তো তোমার ছোট মামীর কারবার? বিদেশি জামাইর লগে ইমুতে ঝগড়া করে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। তাদেরই কপাল বাবা। আমরা কাজের মহিলা। বারোমাসে একবার বাপের বাড়ি যাওয়ার কোনোদিন ফুরসত পাই নাই, এখনও পাই না। তোমার নানা-নানি থাকতে এ বাড়িতে সারাক্ষণ ভয়ে অস্থির থাকতাম।’

কল্প কোনো জবাব দিল না। জবাব দিলেই উৎসাহ পেয়ে মামী অনর্গল কথা বলে যাবেন। এসব বিষয়ে কথা বলতে তার অস্বস্তি লাগে। কোন পক্ষ নিবে ভেবে পায় না সে। খাবার শেষে রেডি হয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কল্প মামার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলো। তিনি দোকানে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছেন। সে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। মুস্তাক সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। কেউ সালাম করলে তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন দেখেননি। কল্প উঠে বললো,

– ‘আমি যাচ্ছি মামা।’

– ‘হ্যাঁ যাও, মিজান টাকা পাঠালে আমি বিকাশে দিয়ে দেবো।’

– ‘আচ্ছা মামা।’

রান্নাঘরে গিয়ে মামীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলো। সুপ্তি পিছু পিছু এলো বারান্দা অবধি। কল্প বারান্দায় এসে গ্রিলের দরজা খুলে পিছু ফিরে বললো,

– ‘যাই আপু?’

সুপ্তির চোখ ভরে এলো জলে।

– ‘কবে আসবিরে আর?’

কল্প এসে জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা রেখে বললো,

– ‘টাকার পড়া আপু, চাপও থাকবে। গিয়ে দেখি।’

– ‘আচ্ছা যা।’

– ‘নীলিমা আর নিলয়কে সন্ধ্যায় পড়তে বসাইও খেয়াল করে।’

– ‘হ্যাঁ যা, তুইও ভালোভাবে পড়ালেখা করিস।’

কল্প বের হয়ে গেল। সালেহা বেগম তখন ব্যস্ত হয়ে এসে বললেন,

– ‘কল্প বাবা দাঁড়াও।’

কল্প দাঁড়াল। তিনি এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে টেনে শিম গাছের নিচে নিয়ে বললেন,

– ‘তোমারে ফুঁ দিয়ে দিতে মনে নাই বাবা। এতদূর যাবে কখন কি বিপদ আসবে বলা যায় না।’

– ‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি দাও।’

তিনি চোখবন্ধ করে বিড়বিড় করে পুরো শরীরে ফুঁ দিলেন। কল্প লম্বা হওয়ায় তিনি মাথা নাগালে পাচ্ছেন না। ইশারা করলেন মাথা নামাতে। কিন্তু সে বুঝতে না পেরে বললো,

– ‘কি?’

“ফুঁ” দেয়ার সময় সালেহা বেগম অতিরিক্ত কথা বলেন না। তাই হাত বাড়িয়ে তার মাথা টেনে নামিয়ে ফুঁ দিলেন।

কল্প বিরক্ত হয়ে বললো,

– ‘দিলে তো আমার চুল এলোমেলো করে। এজন্য মামী আমি তোমার পা ছুঁয়ে সালাম করি না। তুমি মাথায় হাত দিয়ে দাও।’

সুপ্তি খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,

– ‘এদিকে আয় আমি ঠিক করে দিচ্ছি।’

কল্প এগিয়ে এলো। সুপ্তি চুল ঠিক করে দিচ্ছে। মতিয়া ঝাড়ু হাতে প্যাসেজের দরজার কাছ থেকে বললো,

– ‘ভাইজান চুলের বেশি যত্ন করলে হেই চুল আর মাথায় থাকতে চায় না, পড়ে যায়। আমার চুল আছিল নায়িকা মৌসুমির মতো। বেশি যত্ন করায় পড়তে পড়তে এখন শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

সুপ্তি দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ, নায়িকা মৌসুমি অত্যন্ত দরিদ্র মহিলা তো, তাই তোর মতো চুলের যত্ন করতে পারেনি বলে ওর চুল পড়েনি, তোর পড়ে গেছে। এখন চোখের সামনে থেকে সরে যা বইন।’

মতিয়া ঝাড়ু নিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ভেতরে চলে গেল।

কল্প বললো,

– ‘আচ্ছা যাই আপু। মামী যাচ্ছি দোয়া কইরো।’

‘আচ্ছা বাবা যাও’ বলে সালেহা বেগম ভেতরে চলে গেলেন। সুপ্তি বসে রইল বারান্দায়। কল্প হেঁটে হেঁটে মিলিয়ে যাচ্ছে।
যতদূর দেখা যায় সুপ্তি চেয়ারে বসে তাকিয়ে রইল। কেউ বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় ভীষণ কষ্ট লাগে সুপ্তির। মাঝে মাঝে মনে হয় সে ছাড়া প্রতিটি মানুষের জীবনে গতি আছে, তারা অবিরাম গাড়ির মতো, পাখির মতো ছুটে যাচ্ছে একটা গন্তব্যের দিকে, লক্ষ্যের দিকে। তার কোনো গন্তব্য নেই, নেই কোনো লক্ষ্য। হঠাৎ যেন এই ব্যস্ত মানুষগুলো তাকে একা রেখে নানান কাজে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে কোথাও। সে এভাবেই চেয়ারে একা বসে থাকবে নির্জন, নিস্তব্ধ বাড়িতে। তার কোনো ব্যস্ততা নেই, গতি নেই, জীবনজুড়ে আছে কেবল সীমাহীন অসহ্যকর অ*ভিশপ্ত অবসর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাল বেয়ে আসা তপ্ত অশ্রুধারা মুছে নিল সুপ্তি।

*
কল্প রিকশা থামাতে বললো। সামনের বাড়িটাই মনে হচ্ছে ফরিদ সাহেবের। সে কাগজ বের করে গেইটের পাশে সাদা ফলকের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিল। বিজনতা হাউস 14/2 B পীর মহল্লা, ১২২। সব ঠিক আছে। রিকশা ভাড়া চুকিয়ে মোবাইলের সেল্ফি ক্যামেরায় ভালো করে চেহারা দেখে নিল কল্প। তারপর গেইটে ধাক্কা দিয়ে ডান পা ভেতরে দিতেই সামনের আম গাছে লেগে একটা বল বিদ্যুৎ গতিতে এসে পড়লো তার বিশেষ অঙ্গে৷ সঙ্গে সঙ্গে সে হাত দিয়ে চেপে ধরে পুনরায় বাইরে চলে এলো৷ লোকে শুনে ফেলার ভয়ে ভেতর থেকে উঠে আসা আর্তনাদটুকুও গিলে ফেললো সে।

ইতি অবাক হয়ে বললো,

– ‘নিয়ন কে যেন ভেতরে এসে আবার গেইটের বাইরে চলে গেল।’

– ‘চো*র না-কি আপু।’

– ‘চল তো দেখি।’

ইতি ব্যাট হাতে গেইট অল্প ফাঁক করে তাকিয়ে দেখলো একটা ছেলে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে৷ সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

– ‘কে আপনি। এভাবে ভেতরে এসেই আবার বাইরে চলে গেলেন কেন। মতলবটা কি?’

ব্যথায় তার চেহারা বিকৃত হয়ে আছে৷ কল্প পিছু না ফিরেই জবাব দিল,

– ‘আমার নাম কল্প, বাড়ি মোহনগঞ্জ। ভার্সিটি কোচিং করবো তো, তাই এসেছি।’

ইতি বুঝতে পারলো ঘটনাটা৷ আজ সকালেই দাদাভাই তাকে বললেন, ‘ইতি তোমার রুম ছেড়ে দাও, একজন ছাত্র আসবে। তুমি তোমার চাচির সঙ্গে থাকবে।’

মেজাজটা এত খারাপ হয়েছিল ইতির। নিজের আলাদা রুম পেয়েছে মাত্র কয়েক মাস হলো। এত শান্তির রুম কোথাকার হরিদাস পালের জন্য ছাড়তে হয়েছে। ইতি কর্কশ গলায় বললো,

– ‘কোচিং করতে এখানে কেন এসেছেন? এটা কি কোচিং সেন্টার?’

– ‘না আমি আসলে থাকার জন্য এসেছি।’

– ‘কেন এই বাড়ি কি আপনার কাছে হোটেল মনে হচ্ছে?’

– ‘কিন্তু আমাকে তো আসতে বলা হয়েছে।’

– ‘এখন চলে যেতে বলা হচ্ছে আপনি দয়া করে চলে যান।’

– ‘দেখুন আমি গেইট খুলে ভেতরে পা দিয়েই ব্যাট হাতে আপনাকে দেখেছি। আপনি আমার বয়সে ছোট হবেন৷ সুন্দর করে কথা বলুন।’

– ‘এই বাড়িতে এটাই নিয়ম। ছোটদের সম্মান করা হয়। বড়রা অন্যায় করলে ছোটরা শাসন করে। মারধর করে। তুই-তোকারি করে। এটা সিলেট নগরীর একটা অদ্ভুত বাড়ি৷ পছন্দ না হলে আপনি যেখান থেকে এসেছেন, সেখানে চলে যান।’

– ‘আচ্ছা চলে যাচ্ছি। আপনিও গেইট বন্ধ করে চলে যান।’

ইতি গেইট ভেজিয়ে চলে গেল। কল্প কোনোভাবে এই দস্যি মেয়েটিকে সরাতে চেয়েছিল। ব্যথা খানিক স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে গেইটের সামনে কয়েক কদম হেঁটে নিয়ে জোরে কয়েকবার শ্বাস ছাড়লো সে। তারপর পরনের শার্ট ঠিকঠাক করে পুনরায় গেইট খুলে ভেতরে পা রাখলো। ব্যাট হাতে ইতি মাথা তুলে ছেলেটিকে দেখে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল৷ আগে পিছু থেকে দেখেছে কেবল। ছেলেটা ভীষণ সুন্দর। কফি কালারের শার্ট কনুই অবধি গোটানো। ঘন কালো কেশ। মাথায় এতবেশি চুল যে মনে হচ্ছে বাতাস দিলে উড়বে। লালচে ফরসা মুখে বিব্রতবোধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সে ব্যাট হাতে এগিয়ে গিয়ে বললো,

– ‘একটু আগে তো আপনিই ছিলেন তাই না?’

– ‘হ্যাঁ আমিই ছিলাম।’

– ‘আপনি না বললেন চলে যাবেন।’

– ‘রসিকতা করেছি৷ বাচ্চাদের সঙ্গে রসিকতা করা অপরাধ না৷ তাছাড়া বাচ্চা একটা মেয়ের কথায় আমি চলেও যেতে পারি না।’

– ‘আমি বাচ্চা মানে? আপনি জানেন আমি ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রী।’

– ‘না তো, আপনি তো আমাকে বলে ইন্টারে উঠেননি। দেখেও মনে হচ্ছে না। আপনার বয়সী আমার একটা ছাত্রীও আছে, নাম নীলিমা। সুতরাং আপনি আমার কাছে পিচ্চিই।’

– ‘আমার সঙ্গে একদম বাজে কথা বলবেন না। আমি পিচ্চি আর আপনি কি বুড়ো? সুপারি গাছের মতো লম্বা হলেই হয় না। আপনার চেহারায় খোকা খোকা ভাব আছে।’

বারান্দা থেকে তখনই হাঁক এলো,

– ‘কার সঙ্গে কথা বলিস ইতি।’

– ‘দাদা ওই গ্রাইম্যা ছেলেটা এসেছে মনে হয়।’

– ‘চুপ কর বে*য়াদব মেয়ে। গ্রাইম্যা ছেলে আবার কি? হে গ্রাইম্যা ছেলে আবার কি?বাড়িতে মেহমান এলে ভেতরে নিয়ে আসতে হয় এই কাণ্ডজ্ঞান নাই তোর। বে*য়াদব কোথাকার।’

– ‘ ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম দাদাভাই, চো*র না-কি মেহমান আগে তো বুঝতে হবে।’

– ‘এক চ*ড় দিয়ে সামনের দুইটা দাঁত মাটিতে ফেলে দেবো নির্বোধের ঘরের নির্বোধ। তুমি আসো তো ছোকরা। ভেতরে এসে বসো।’

কল্পকে নিয়ে তিনি সিটিং রুমে বসালেন। তারপর ডাকলেন কাজের মেয়ে লতিফাকে,

– ‘লতিফা, এই লতিফা, এদিকে আয় তো।’

লতিফা দরজার সামনে এসে বললো,

– ‘দাদুজান উনাকে কি সালাম করা লাগবো?’

– ‘এটা কেমন কথা? তোর সালাম করতে ইচ্ছা হলে করবি। অনুমতি নেয়া লাগে না-কি।’

– ‘বড়ো চাচা ওইদিন কইলেন বাড়িতে মেহমান দেখলে সালাম করে আদবের সহিত ঢুকতে।’

– ‘তাইলে ঢুকবি। এখন না করছে কে?’

– ‘না এই মেহমান তো আমার ছোট হইবেন। তাই আরকি জিজ্ঞেস করছি।’

– ‘তুই এখনই আমার সামনে থেকে যা, যা বলছি। নির্বোধের ঘরের নির্বোধ। সকল নির্বোধ নিয়ে আমি এই বাড়িতে বসবাস করছি।’

লতিফা সরে গেল দরজার কাছ থেকে। তিনি পুনরায় ডাকলেন,

– ‘লতিফা।’

– ‘জি দাদুজান।’

– ‘মেহমানকে নাশতা পাঠা। আর নাশতা শেষে রুম দেখিয়ে দে।’

– ‘জি আচ্ছা।’

তিনি উঠে বারান্দায় গিয়ে আবার ফিরে এসে বললেন,

– ‘ও হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে ভালোমন্দ কথাই বলিনি। তা বাড়ির সবাই ভালো আছে?’

– ‘হ্যাঁ নানা।’

তখনই বল এসে ছিটকে পড়লো বসারঘরে। ফরিদ সাহেব বলের দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ গম্ভীরমুখে রইলেন। তারপর চোখ থেকে চশমা খুলে টি-টেবিলে রেখে বললেন,

– ‘আমি ভাবছি কি জানো?’

– ‘জি না।’

– ‘বাড়ির নাম পালটে ফেলবো ভাবছি। বাড়িটা নিরিবিলি হবে। শান্তশিষ্ট হবে তাই দিয়েছিলাম বিজনতা। বিজনতা মানে জানো তো? শব্দটা রবীন্দ্রনাথের একটা গান থেকে ধার করা৷ ভদ্রলোকের গানে প্রথম শব্দটা শুনেছিলাম। শুনে মনে হল ইংলিশ শব্দ না-কি? পরে ডিকশনারি ঘেটে দেখি বাংলা। ভদ্রলোকের রুচিবোধ ছিল অতি উচুমানের। কোত্থেকে একেকটা সুন্দর শব্দ, এমন জায়গায় ব্যবহার করতেন। শুনে চমকে উঠা ছাড়া উপায় নাই। যাইহোক বিজনতা মানে কি জানো তো?’

– ‘জি জানি, বিজনতা মানে নীরবতা।’

– ‘বাহ, ছাত্র হিসাবে ভালো মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বাড়ির সব কয়টা নির্বোধের বাচ্চা। তোমার নামটা কি যেন?’

– ‘কল্প।’

– ‘গল্প আবার কেমন নাম।’

– ‘গল্প নয়, কল্প।’

– ‘কল্প আবার কেমন নাম। আমি তো বাংলার শিক্ষক ছিলাম। দীর্ঘ সময় মাস্টারি করেছি। ক্লাসে কখনও স্টুডেন্টের নাম ডাকতে গিয়ে কল্প পাইনি তো।’

কল্প কোনো জবাব দিল না। ভদ্রলোক অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। তিনি নিজেই আবার বললেন,

– ‘তো বাড়ির নাম দিয়েছি বিজনতা। এখন কি তোমার মনে হচ্ছে না বাড়ির সঙ্গে নাম যাচ্ছে না?’

– ‘জি তাই মনে হচ্ছে।’

– ‘কেন বলো তো।’

কল্প অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তিনি নিজেই পুনরায় বললেন,

– ‘বাড়ির নাম কি হওয়া উচিত বলো তো দেখি৷ হইচই না-কি হট্টগোল?’

তখনই নিয়ন এলো বল নিয়ে যেতে। ফরিদ সাহেব ধমক দিয়ে উঠলেন,

– ‘নির্বোধের ঘরের নির্বোধ। বাড়িতে একজন মেহমান এসেছে সেদিকে খেয়াল নাই তোদের। বল নিয়ে ছোড়াছুড়ি শুরু করেছিস। এটা বাড়ি না-কি খেলার মাঠ!’

নিয়ন বল নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। কল্প বাইরে তাকিয়ে দেখে ক্রিকেট খেলায় এখন আগের সেই দস্যি মেয়েটি নেই। দু’টা ছেলে খেলছে৷ এ বাড়িরই মনে হয়। তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নতুন যুক্ত হওয়া ছেলেটি বিকৃত মুখ-ভঙ্গি করছে৷ কল্প চোখ ফিরিয়ে নিল। সব কয়টা অতি দুষ্ট। কখনও এই ছেলেকে তার কাছে পড়তে পাঠালে কঠিন কিছু প্রশ্ন করার পর উত্তর না দিতে পারলে ‘ঠাস’ করে গালে চ*ড় মেরে দিতে হবে৷ বেয়াদব ছেলে ত্যাঁদড়ামি কার সঙ্গে করেছিল মজা টের পেয়ে যেত।
_চলবে…
_______মায়াডোর (২য় পর্ব)
লেখা: জবরুল ইসলাম

মায়াডোর (৩য় পর্ব)
.
ইতি তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ছোট চাচির মোবাইলটা হাতে নিল। খুবই শান্ত-শিষ্ট চেহারা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অস্থির সে। ধীরপায়ে হেঁটে ছাদে চলে গেল। আজকের এই অশ্চর্য ঘটনাটা প্রথমে কাকে বলা যায়? মামাতো বোন তানিয়া আছে। ফুপাতো বোন মালিহা আছে। মালিহাকে কল দিলেই অশ্লীল অশ্লীল কথা বলবে। এই মুহূর্তে অশ্লীল কথা শুনতে ভালো লাগবে না। প্রথমে কল দিল সে রুমকিকে। তারা একই ক্লাসে পড়ে। ওপাশ থেকে রিসিভ করে কর্কশ গলায় রুমকির মা বললেন,

– ‘হ্যালো।’

– ‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি৷ আমি ইতি। রুমকিকে একটু মোবাইলটা দেন।’

– ‘রুমকির লগে এত কিসের দরকার তোমার মাইয়া? দু’দিন পর পর কল দিয়ে কি এতো আলাপ।’

– ‘আমরা পড়া নিয়েই কথা বলি আন্টি।’

– ‘তোমরা কেমন পড়া নিয়ে কথা বলা ছাত্রী আমারে শিখাতে হবে না। এই রুমকি, রুমকি। এই নে তোর ইতি না ফিতি কল দিছে।’

রুমকি মোবাইল হাতে নিয়ে বললো,

– ‘হ্যালো।’

– ‘এই তোর মায়ের সামনে থেকে দূরে যা। দরকারি কথা আছে।’

– ‘সরে এসেছি বল কি বলবি।’

‘শোন না, আজ আমাদের বাড়িতে একটা ছেলে এসেছে..আমি তো প্রথমে তাড়িয়ে দিচ্ছিলাম…।

ইতি বাড়ির অতিথি সংক্রান্ত ঘটনাটা খুবই আগ্রহ নিয়ে বলছে রুমকিকে।

নিয়ন ব্যাট হাতে নিয়ে চুপিচুপি এলো কল্পের দরজার সামনে। পর্দা ফাঁক করে তাকিয়েই আবার সরে গেল সে। কল্প ভেতর থেকে বললো,

– ‘আসো দেখে ফেলেছি।’

নিয়ন ভেতরে এসে বললো,

– ‘আমি।’

– ‘নাম কি তোমার?’

– ‘নিয়ন, আমার লগে যে খেলছিল ওর নাম মিলন।’

– ‘আর আমার সঙ্গে যে ঝগড়া করছিল ওর নাম কি লিটন?’

রসিকতা টের পেয়ে মাথা নীচু করে হাসলো নিয়ন। তারপর বললো,

– ‘ইতি আপুর কথা বলছেন। উনি শুধু ঝগড়া করে না মিথ্যে কথাও বলে। আমি কখনও মিথ্যে কথা বলি না। মা বলেছে মিথ্যে বলা মহাপাপ।’

কল্প তাকে হাতে ধরে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে বললো,

– ‘তাই? বাহ তুমি তো অনেক সুন্দর করে কথা বলো। তা তোমার আপু কি কি মিথ্যে বলে?’

– ‘উনি বলছে না ইন্টারে পড়ে। মিথ্যে বলছে। উনি পড়ে ক্লাস টেনে। টেন মানে দশ ক্লাস।’

কল্প অবাক হয়ে গেল। মিথ্যে বলতে গেল কেন দস্যি মেয়েটা। তারপর নিয়নের মাথায় আঙুল চালিয়ে আদর করে বললো,

– ‘তুমি কোন ক্লাসে পড়ো।’

সে দু’টা আঙুল দেখালো। কল্প মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘দ্বিতীয় শ্রেণিতে?’

মাথা নেড়ে সম্মতি দিল নিয়ন।

ইতি ছোট চাচির রুমে এসে একটা সিল্কের শাড়ি বের করলো৷ তাকে পিচ্চি লাগে? এখন থেকে শাড়ি পরে বাড়িতে হাঁটাহাঁটি করবে। শুধু স্কুলে যাবে ড্রেস পরে। ইংলিশ স্যার ড্রেসের ব্যাপারে খুবই কড়া। বাংলা স্যার শাড়ি দেখলে খুশিও হতে পারেন। তবে বাড়িতেই শাড়ি পরলে হবে৷ ছেলেটাকে বুঝিয়ে দেবে সে আসলে ছোট না। ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে সিফাত নামে একটা ছেলে। সারাক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ইতির দিকে। স্কুল ছুটি হলে পিছু পিছু তাদের বাড়ির রাস্তা আবধি আসে। একটা পিচ্চি মেয়ের পিছু পিছু ছেলেটা কেন আসতে যাবে? নীল শাড়ি হাতে নিয়ে আয়নার সামনে গেল ইতি। চুলের খোঁপা ছেড়ে দিল। ঢেউ খেলে ঘন কালো চুলগুলো নামলো এসে কোমরের ভাঁজে। আয়নায় ফরসা একটা মুখ দেখা যাচ্ছে৷ পাতলা ঠোঁট। ঘন কালো ভ্রু। জীবনানন্দের পাখির নীড়ের মতো দু’টি চোখ। বাঁ গালের ঠিক মধ্যখানে তীব্র কালো ছোট্ট একটি তিল।

নীলা এসে বললো,

– ‘আমাদের কন্যা আয়নায় এত কি দেখছে৷’

ইতি লজ্জা পেল প্রথমে। তারপর এগিয়ে এসে বললো,

– ‘ছোট চাচি আমাকে শাড়িটা পরিয়ে দাও।’

– ‘ও বাবা এই অবেলায় কেন শাড়ি পরার ভূ*ত চাপলো মাথায়?’

– ‘তো শাড়ি পরা শিখতে হবে না? এইযে তোমরা শাড়ি পরে বাসায় এত কাজ করো। আমারও তো শিখতে হবে এগুলো। মা যে কিচ্ছু চিনি না জানি না বলে রোজ বকা দেন।’

– ‘আচ্ছা আচ্ছা হইছে। পরে একবার পরিয়ে দেবো। এখন কাজ আছে।’

– ‘না এখনই দিবে চাচি। এটাও কাজ। আমি শাড়ি পরতে না জানলে বিয়ের পর আমার শাশুড়ি তোমাদের গালি দেবে৷ বলবে মা-চাচি কিছুই শেখায়নি।’

নীলা ফিঁক করে হেঁসে এগিয়ে এলো। তারপর শাড়ি হাতে নিয়ে বললো,

– ‘তুমি কথা বলো তোমার চাচ্চুর মতো৷ এতো মিষ্টি করে কথা বলে লোকটা…।’

– ‘চাচি প্লিজ স্টপ, চাচ্চু বিষয়ক গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে না এখন৷’

নীলার স্বামী ইতালি থাকে৷ এক বছর আগে বিয়ে হয়েছিল ফোনে। তাদের এখনও সশরীরে সাক্ষাৎ হয়নি। নীলা বিয়ের দিনই শ্বশুরবাড়ি এসে উঠেছিল৷
বর দেশে আসবে আসবে করে নানান কারণে দেরি হচ্ছে। তবে তাদের মোবাইলে রোজই কথা হয়। অল্প বয়সী যুবতী নীলা ইতির সম্পর্কে চাচি হলেও দু’জন বান্ধবীর মতো মিলে-মিশে থাকে৷
নীলা শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতে দিতে বললো,

– ‘কাল রাতে কি হয়েছে জানো?’

– ‘কি?’

নীলা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘মোবাইলে কথা বলতে বলতে তোমার চাচ্চুকে লাইনে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…।’

– ‘আবার চাচ্চু!’

– ‘আরে শোনো তারপর কি হলো।’

– ‘না শুনতে চাই না। নীল চুড়ি আছে না আমার দুইহাতে পরিয়ে দাও।’

নীলা চুড়ি হাতে পরিয়ে দিল। কপালে টিপ দিল। তারপর ভালো করে অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,

– ‘ইশ কি মিষ্টি লাগছে ইতি। তুমি কিছুটা চেহারাও তোমার চাচ্চুর মতো পেয়েছো।’

ইতি দাঁত কটমট করে তাকিয়ে রইল। নীলা ফিক করে হেঁসে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। করিডর দিয়ে ইতি প্রথমে একা একা হাঁটলো খানিকক্ষণ। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। তারপর গেল ফরিদ সাহেবের রুমের দিকে। তিনি আছরের নামাজ পড়ে তসবিহ পড়ছেন। সে দরজায় নক দিয়ে বললো,

– ‘দাদাভাই আসবো?’

– ‘আয় আয়।’

ইতি রুমে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে সামনে দাঁড়ালো৷

– ‘আরে সালাম কেন?’

– ‘শাড়ি পরেছি।’

– ‘তা তো দেখতে পাচ্ছি। মাশাল্লাহ সুন্দর লাগছে। অবিকল তোর দাদির মতো হয়েছিস। সে যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল। শাড়ি পরতে পারতো না। মা পরিয়ে দিতেন মাঝে মাঝে। তোর মতো সুন্দর লাগতো।’

ইতি দরজার কাছে এসে বললো,

– ‘দাদাভাই দাদি ছিল পে*ত্নীর মতো। আমি উনার মতো হতে যাব কেন।’

‘আরে কি বললি, কি বললি তুই! কোলেপিঠে করে বড়ো করেছিল বেচারি। এখন দুনিয়ায় নাই। তুই হা*রামজা*দি তাকে পে*ত্নী বললি!’

ইতি খিলখিল করে হেঁসে চলে গেল রান্নাঘরে। তার ইচ্ছা করছে অতিথিকে কোনোভাবে দেখা দিতে। কিন্তু যাওয়ার মতো ইস্যু খুঁজে পাচ্ছে না। হুস্না বেগম মেয়েকে দেখে বললেন,

– ‘কিরে তুই শাড়ি পরে দেখি বউ সেজে বসে আছিস। ঘটনা কি?’

ইতি লজ্জা পেয়ে বললো,

– ‘ঘটনা কিছু না৷ চাচি পরিয়ে দিল। তাছাড়া শাড়ি পরে চলাফেরা করা তো শিখতে হবে। তুমিই তো বলো বড়ো হয়েছি৷ কিছুই চিনি না।’

– ‘বাহ এত বুঝ হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো শুনি।’

– ‘আমি তো ভাবছি এখন থেকে তোমাদের কাজকর্মেও সহযোগীতা করবো মা।’

হুস্না বেগম নুডলস আর চা’র প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

– ‘হয়েছে হয়েছে। যা ছেলেটিকে নাশতা দিয়ে আয়। আর একদম দুষ্টামি করবি না৷ বড়ো হয়েছিস এখনও বাচ্চামো যায়নি। তুই না-কি গ্রাইম্যা বলেছিস। এসব কি ঠিক? কবে বুঝবি তুই।’

– ‘আচ্ছা মা আমি নাশতা দিয়ে স্যরি বলবো, ওকে?’

– ‘তোর দাদা চিল্লাচ্ছেন কেন? কি করেছিস।’

– ‘কিছুই না মা। বয়স হইলে মানুষের অকারণ চিল্লাচিল্লির রোগ হয়।’

ইতি ট্রে হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল। অতিথির দরজা খোলা। লাল পর্দা ঝুলছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ‘আসবো’ বলার আগেই কেঁপে উঠলো ইতি। নিয়ন বসে আছে বিছানায়। অতিথি আলনার কাছে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম অর্ধেক খুলেছে। ছেলেটির ফরসা নগ্ন বুক দেখা যাচ্ছে৷ শার্টের ফাঁক গলে কোমল কিছু ছোট ছোট লোমও উঁকি দিচ্ছে। কাপড় পালটাতে চেয়েছিল সে, ইতিকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে শার্ট টেনে আবার বুক ঢেকে নিল। ইতি পুনরায় বাইরে এলো। শুকনো ঢোক গিলে নিল প্রথমে। বুক ‘ধুকপুক’ করছে। ছেলেটা কেমন অন্যরকম। উঠানে প্রথম দেখাতেই যেন ইতির মনের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিল। সে চাইলে এখন নিয়নকে ট্রে নিতে ডাকতে পারে। কেমন লজ্জা করছে ভেতরে যেতে। আবার যেতেও ইচ্ছা করছে। খানিক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দে কেটে গেল। তারপর স্বাভাবিক হয়ে বললো,

– ‘ভেতরে আসবো?’

কল্প শার্টের বোতামগুলো লাগিয়ে নিয়ে বিছানায় বসে বললো,

– ‘হ্যাঁ আসুন।’

ইতি ভেতরে ঢুকে সরাসরি যেন তাকাতে পারছে না। হঠাৎ আজ বানের জলের মতো শরীরে লজ্জার ঢল নেমেছে। কল্প হাত বাড়িয়ে ট্রে হাতে নিয়ে চেয়ার দেখিয়ে বললো,

– ‘বসুন।’

ইতি টেবিলের কাছে চেয়ারটাতে বসলো। কল্প চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,

– ‘একা একা চা খাচ্ছি। নিয়ন তুমি বিস্কুট নাও।’

‘না না’ বলে নিয়ন উঠে আবার খেলতে চলে গেল। ইতি অস্বস্তি কাটিয়ে নেয়ার জন্য বললো,

– ‘স্যরি, আগে ‘গ্রাইম্যা ছেলে’ বলা ঠিক হয়নি। আমি ভেবে বলিনি কথাটা।’

কল্প মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘বুঝেছি সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটিতে থাকেন তো। ঝগড়ার সুরে বলে ফেলেছেন।’

ইতি বসে বসে শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো,

– ‘আসলেই তাই।’

– ‘আর মিথ্যে বলেছিলেন কেন?’

ইতি অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকায়। ছেলেটি মুচকি হাসছে। সে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আমি কি মিথ্যে বললাম?’

– ‘পড়েন দশম শ্রেণিতে। আর বলেছেন ইন্টারে।’

ইতি মাথা নুইয়ে ফিক করে হেঁসে ফেললো। তারপর মাথা তুলে তাকিয়ে বললো,

– ‘সেটা তো বলেছি আমার বয়স বুঝাতে।’

– ‘বয়স বুঝাতে মানে?’

ইতি লজ্জায় লাল হয়ে বললো,

– ‘আমি ক্লাস এইটে গণিত বিষয়ে ফেইল করে দু’বছর ছিলাম।’

কল্প হেঁসে উঠলো। তারপর অবাক হয়ে বললো,

– ‘কি আশ্চর্য! ডায়রেক্ট ফেইল? এদিকে আবার সামনে এসএসসি পরীক্ষা রেখে ব্যাট নিয়ে দিব্যি খেলছেন, এখন আবার হুট করে শাড়ি পরে সাজগোজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’

ইতি এতক্ষণ ভালোই ছিল। কিন্তু এখন কল্পের হাসি দেখে গা জ্বলে উঠলো। খানিকক্ষণ দাঁত কটমট করে তাকিয়ে থেকে চেয়ার থেকে উঠে ‘হন হন’ করে বাইরে চলে এলো। করিডর পেরিয়ে অস্ফুটে গজগজ করে যাচ্ছে, ‘ব্যাটা তুমি কি আমার মাস্টার লাগো? পড়া রেখে খেলছি না-কি দুলছি সেটা নিয়ে কথা বলার তুমি কে? ডায়রেক্ট ফেইল বলে এমন ভাব করছে যেন পৃথিবীতে আমি একাই ফেইল করে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছি।’

__চলবে..
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here