মায়াডোর-০৬,০৭

0
310

মায়াডোর-০৬,০৭

(৬ষ্ট পর্ব)
.
ভোরে সবার আগে ঘুম ভাঙলো ইতির৷ আস্তে-আস্তে বিছানা থেকে নেমে গেল সে। রাতে অশান্ত মন নিয়ে কখন ঘুমিয়েছিল বুঝতেই পারেনি৷ বাথরুমে এসে আয়নায় তাকিয়ে দেখে কপালের ফোলা কমলেও লালচে দাগ পড়ে গেছে। ডান গালের ঠিক মাঝামাঝি একটা ব্রণ উঠেছে৷ আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই ব্যথায় সরিয়ে নিল। দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে-মুছে বারান্দায় এলো। এখনও পুরোপুরি আলো ফোটেনি। আলো-আঁধারির মিশ্র স্নিগ্ধ পরিবেশ। দাদাভাইয়ের রুম থেকে কোরআন তেলাওয়াতের সুর ভেসে আসছে৷ অনেকদিন হলো শুনেনি৷ রোজই ঘুম ভাঙে বেলা করে। আমগাছের ডালে একটা শালিক পাখি দেখা যাচ্ছে। ইতি গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে ডিল ছুড়ে মারার ভঙ্গি করলো। শালিক পাখিটির বোধহয় মাথা থেকে চোখ বেশি পরিষ্কার। দেখে ভয় পেয়ে গাছের পাতা নাড়িয়ে উড়ে চলে গেল বাউন্ডারির দেয়ালে। একটা কাক আকাশে উড়ে গেল কা-কা করে। কোথাও থেকে বুনো ঘ্রাণ আসছে। ভোর বুঝি এতই সুন্দর? বাইরে ছুটে যেতে ইচ্ছা করছে। সূর্য উঠার আগপর্যন্ত গন্তব্যহীন ছুটে চলতে পারলে ভালো লাগতো। হঠাৎ ইচ্ছে হলো কল্পের রুমের দিকে যাবে। চুপিচুপি সেদিকে গেল। আশ্চর্য! দরজা একেবারে খোলা। খুব সাবধানে উঁকি দিল বিছানায়৷ পরনে ট্রাউজার আর কালো হাফহাতা গেঞ্জি। ঘন কালো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পড়েছে। বন্ধ চোখের পাতা খানিকটা লালচে। বুকের সঙ্গে একটা বালিশ জড়িয়ে ধরে আছে৷ ঘুমানোর ভঙ্গিতে একটা ‘শিশু-শিশু’ ভাব আছে। অথচ তাকেই বলে কি-না পিচ্চি মেয়ে। ঠোঁট বাঁকিয়ে দরজা থেকে চলে গেল ইতি৷ কিন্তু ভেতরে কেমন অস্থিরতা অনুভব করছে। কিছু একটা করতে ইচ্ছা করছে। ভাবের দোকানদার ফেইসবুক প্রফাইল তালা মেরে রাখলেও দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়েছে কেন? নিশ্চয় ভয়ে। ভীষণ মজা পাচ্ছে ইতি। নিজেকে তো অনেক বড়ো মানুষ মনে করে। আর ভেতরে ভেতরে বুঝি একটা ভীতুর ডিম। ইতি সিঁড়ি দিয়ে ছাদে এলো। খোলা আকাশের নিচে দু’হাত মেলে দিয়ে চোখবুজে ভোরের মিহি বাতাস গায়ে মেখে নিচ্ছে সে। সঙ্গে সেই অচেনা বুনো ঘ্রাণ। বুক ভরে শ্বাস নিল বারকয়েক। বুকের ভেতর এত অস্থিরতা কেন? এত অশান্ত লাগছে কেন? নিজের ভেতরে এতো অস্থিরতা এতদিন বুঝি ঘাপটি মেরে ছিল। কখনও জানান দেয়নি। চিলেকোঠার চালে চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শুনে চোখ মেলে তাকালো ইতি। দুইটা চড়ুই পাখি ঝগড়া করছে। এরা স্বামী-স্ত্রী না-কি প্রেমিক-প্রেমিকা? ছাদে পরে থাকা দড়িলাফের দড়িটা হাতে নিল সে। কল্পের রুমের সোজা ওপরে খেললে কেমন হয়? শব্দ শুনে নিশ্চয় ভয়ে লাফ দিয়ে উঠে বিছানায় বসবে। তারপর ভয়ার্ত চোখে চারদিকে তাকাবে। চেহারা কল্পনা করে বুকটা মমতায় হু-হু করে উঠলো ইতির। ঘুমাক মানুষটা। ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এতটাও ছাড় দিবে না সে। লতিফার ভাইকে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং আজই৷ কিন্তু কি দরকার দেখিয়ে বাড়িতে আনা যায় ছেলেটি? একটা বুদ্ধি দরকার। টাকাও দরকার। ওকে আনতে হলে ভাড়ার টাকা তো দিতে হবে। সঙ্গে কিছু বকশিশ। বুদ্ধি দরকার। ক্লাসে গিয়ে কাকে বললে চট করে একটা বুদ্ধি বের করে দিবে? রুমকিকে বললে নিশ্চয় পারবে। আচ্ছা এটুকু বুদ্ধি কি তার নিজের নেই? গতকাল মাকে কেমন বোকা বানিয়ে দিল সে। ভাবতে হবে। ইতি ছাদের পিলারে বসলো। এবং প্রতিবারের মতো সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল। পিলারে বসলেই মনে হয় খুব বিশ্রী দেখাচ্ছে। অথচ ছেলেদেরকে তো ভালোই লাগে। বসে বসে সিগারেট খায়, মোবাইল টিপে, বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেয়। ইতি সিঁড়ি দিয়ে আবার নিচে চলে গেল। আস্তে আস্তে গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো নীলার পাশে। লতিফাকে বলতে হবে তার ভাইকে কল দিয়ে আনতে। এসে বলবে শহরে এসেছিল বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় বোনের কাছে এসেছে৷ কেউ এতটাও বেশি ঘাটাবে না। একটা বিষয় কল্পনা করে ইতির ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। ভাবের দোকানদার এভাবেই যদি দরজা খুলে ঘুমায়। আর ভয় পেয়ে চিৎকার দেয় কিংবা দৌড়ে আসে। তখন সেইই সবার আগে ছুটে গিয়ে সান্ত্বনা দিবে। যেন কল্প একটা বাচ্চা ছেলে সেরকম সাহস দেবে ইতি। বারান্দা থেকে দাদাভাইয়ের গুন-গুন শব্দ ভেসে এলো। তারপর গেইট খোলার শব্দ। রুম থেকে করিডরে বের হলো ইতি। সাদা পাঞ্জাবি পায়জামার সঙ্গে কালো সু-জুতা পরে বাইরে যাচ্ছেন দাদাভাই। প্রায়ই তিনি হাঁটতে বের হন। ইতির মাথায় তখন অন্যকিছু খেলে গেল। তাড়াতাড়ি গিয়ে ঢুকলো দাদাভাইয়ের রুমে। পুরো ঘর আতরের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে। সে তাড়াতাড়ি বিছানা, বালিশ তুলে কিছুই পেল না। পুরো ঘর তন্নতন্ন করে একটা পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই পেয়ে গেল তিন হাজার টাকা। পুরো টাকাটা নিয়েই তাড়াতাড়ি রুম ত্যাগ করলো।

সাড়ে নয়টায় নিয়ন আর মিলনকে স্কুলে দিতে বের হয়েছেন ফরিদ সাহেব। একটু পরেই কল্প এলো। পিছু পিছু এলো ইতি। অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই সবার এক সঙ্গে বের হওয়া। তবুও ইতির ভীষণ ভালো লাগলো। নিয়নদের স্কুল কাছেই। ফরিদ সাহেব হাত ধরে ওদের নিয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে গেলেন। ইতি কল্পের দিকে তাকালো। সাদা কেডস। জিন্স প্যান্ট। গায়ে নেভি ব্লু টি-শার্ট। হাতে কালো ঘড়ি। চোখ ফেরাতেই যেন পারছে না ইতি। কল্প তার দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘রিকশা কোথা থেকে পাব?’

– ‘এদিকেই আসে। একটু কম কম আরকি। অপেক্ষা করতে হয়।’

– ‘ও আচ্ছা।’

দু’জন খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতেই একটা রিকশা পেল। কল্প হাত তুলে দাঁড় করায়। কিন্তু তার আগেই গিয়ে উঠে বসলো ইতি।
সে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘একটাই রিকশা কে যাব তাহলে?’

ইতি পুনরায় রিকশা থেকে নেমে বললো,

– ‘কে যাব মানে? একটা মেয়েকে রেখে আপনি রিকশা নিয়ে চলে যাবেন? আচ্ছা যান, যাচ্ছি না আমি। আপনি রিকশা থামিয়েছেন। আপনিই যান।’

কল্প ইতস্তত করে বললো,

– ‘আমার একটু জরুরি দরকার।’

– ‘তো আমি কি ঘুরতে বের হইছি না-কি। আপনার মতো ছেলে তো জীবনে দেখিনি।’

কল্প ইতি-উতি করে বললো,

– ‘আচ্ছা আপনিই যান।’

ইতি গিয়ে রিকশায় উঠে বসলো। তারপর পিছু ফিরে তাকিয়ে বললো

– ‘রিকশা এদিকে খুব কম আসে। এতই যখন জরুরি তাহলে এটাতেই উঠেন। একটা পিচ্চি মেয়ের সঙ্গে গেলে কেউ কিছু মনে করবে না।’

কল্প অস্বস্তি নিয়ে চারদিকে তাকায়। ইতি একপাশে সরে বসে তাড়া দিয়ে বললো,

– ‘আসুন।’

কল্প গিয়ে পাশে বসলো। রিকশা চলছে। কিছুদূর যেতেই ইতি অন্যদিকে তাকিয়ে স্মিত হেঁসে বললো,

– ‘রাতে দোষী ঘরে থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

– ‘না, কি অসুবিধা হবে?’

– ‘ভয়-টয় পাননি?’

– ‘না না কি যে বলেন, ভয় পাব কেন? আমি ভূ*ত-প্রে*ত তেমন ভয় পাই না।’

– ‘ও আচ্ছা ভালো। কিন্তু আমাকে ‘আপনি’ করে না বললেই পারেন। পিচ্চি একটা মেয়েকে আপনি বলার কি আছে।’

কল্প রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছে বললো,

– ‘না আপনিই ভালো।’

ইতি মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো

– ‘ধন্যবাদ আমাকে ভালো বলার জন্য।’

– ‘আপনি রসিকতা করছেন না-কি?’

ইতি হাসি বন্ধ করে বললো,

– ‘আচ্ছা রসিকতা বাদ। সিরিয়াস কথা হল আপনার কাছে আজ রাত থেকেই পড়তে যাব। সুতরাং তুমি বলতেই পারেন। আপনি স্যার মানুষ।’

– ‘ও হ্যাঁ, আচ্ছা।’

– ‘আপনি কি নার্ভাস? এত ঘামছেন কেন?’

– ‘না না ঠিক আছি আমি।’

ইতি হাসছে। কল্পকে খুবই বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে। কিছু মানুষের বাহ্যিক আচরণ দেখে ভেতরের অবস্থা বুঝা যায় না। ভাবের দোকানদার বোধহয় সেরকম না।
কিন্তু তার সাথে রিকশায় যেতে বিব্রতবোধ করছে কেন? একটা রূপবতী মেয়ের পাশে বসে যেতেই কেবল এরকম বিব্রতবোধ করে ছেলেরা। ইতি এটুকু ভালো করেই বুঝে। খুবই আত্মবিশ্বাস এসেছে মনে। সে অভয় দেয়ার চেষ্টা কতে মিষ্টি হেঁসে বললো,

– ‘প্লিজ আমাকে লজ্জা পাবেন না৷ আমার দিকে আরেকটু এসে বসুন সমস্যা নেই। শান্ত-শিষ্ট হয়ে বসুন।’

কল্প বিরক্ত হয়ে বললো,

– ‘তুমি একটু বেশিই কথা বলো। আমি তোমাকে লজ্জা পাব কেন?’

ইতি আহত চোখে তাকিয়ে বললো,

– ‘একটা ছেলে একটা মেয়েকে লজ্জা পেতে পারে না?’

– ‘তুমি কি সেরকম কোনো মেয়ে?’

ইতির মুখের আলো ‘ধুপ’ করে নিভে গেল। ভীষণ অপমানবোধ করছে সে। অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছে। কথাটা গায়ে লেগেছে কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না। রিকশা খানিকদূরে যেতেই ইতি বললো,

– ‘স্কুলের সামনে রাখেন।’

রিকশা থামতেই ইতি নেমে গেল। ভাড়া দিতে গেলে কল্প বাঁধা দিল। ইতি নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর জন্য মিষ্টি হেঁসে বললো ‘আচ্ছা যাচ্ছি।’
কল্পও মাথা নেড়ে বিদায় দিল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। মেয়েটা বেশি কথা বলে। এমনিতেই সে ভয়ে অস্থির। মেয়েটিকে মিথ্যে বলেছে। সত্য বললে হাসতো। তার চাচা এসে এয়ারপোর্টে নামার কথা নয়টায়। ইতিমধ্যে নয়টা পেরিয়ে গেছে। ছোটচাচা গতকাল রাত একটায় কল দিয়ে হুট করে জানালেন বড়ো চাচা আসছেন। ভোরে তার ঘুম ভাঙেনি। ঘুম থেকে উঠেও মনে ছিল না। এরকম ভুলে যাওয়ার সমস্যা তার কখনও ছিল না। আজ এটা কি হলো! এখন একটাই ভরসা। বেশিরভাগই বিদেশি যাত্রীরা নির্ধারিত সময় থেকে অনেক দেরিতেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে। ছোটচাচা তাকে আর কল দেননি। সেও দিচ্ছে না। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আগে এয়ারপোর্টে গিয়ে খবর নিবে ইংল্যান্ডের যাত্রীবাহী বিমান এসে গেছে কি-না। খুবই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়া গেল। কাছে থেকেও যথা সময়ে যেতে পারলো না। স্কুলের টাইমে রাস্তায় জ্যামজট বোধহয় একটু বেশিই থাকে। আম্বরখানা পৌঁছাতেই দশটা বেজে গেল তার। ঠিক তখনই মোবাইল বেজে উঠলো। ছোট চাচার নাম্বার। শুকনো ঢোক গিলে কল্প সালাম দিল,

– ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কিরে তুই এলি না এয়ারপোর্টে?’

– ‘চাচা এইতো চলে আসছি। আমি রাস্তায়।’

– ‘তুই এখন কোথায় আসবি? গাধা না-কি! আমরা সিলেট পেরিয়ে চলে এসেছি।’

– ‘ও আচ্ছা। রিকশা পাচ্ছিলাম না চাচা তাই দেরি হয়ে গেছে।’

– ‘আমরা ভোরে রওনা দিয়ে গ্রাম থেকে চলে এসেছি আর তুই শহরে থেকে দেরি হয়ে গেছে। গাধা কোথাকার। এই নে, ভাইসাব কথা বলবেন তাই কল দিয়েছি।’

– ‘আচ্ছা দাও।’

কথা হলো তার বড়চাচার সঙ্গে। দেখতে যেতে বলেছেন। পড়ালেখার খোঁজ-খবর নিলেন। ফোন রেখে সে ফিরে এলো বাসায়।

রুমকি স্কুলের মূল ফটক থেকে ইতিকে রিকশা থেকে নামতে দেখেছে। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো সে। ইতি কাছে আসতেই বললো,

– ‘রিকশায় ওই ছেলেটা কে ছিল?’

– ‘গতকাল ফোনে এই ভাবের দোকানদারের কথাই বলেছিলাম।

– ‘দেখতে তো পুরাই হিরো, জিতছিস তুই।’

– ‘জিতছি মানে? ও কি আমার জামাই লাগে?’

– ‘হবু জামাই।’

– ‘হবু জামাই? আজাইরা কথা বলবি না। ওর ভাব সম্পর্কে তুই কিছুই জানিস না।’

– ‘ভাবে ধরে একটু টানাটানি করলেই হয়ে যাবে।’

– ‘কেন মনে হচ্ছে তোর? টানাটানি করলে ভাব আরও লম্বা হয়। বাড়ে ছাড়া কমে না।’

– ‘তোর সঙ্গে ভাব দেখাবে কোনো ছেলে? ঠিকই পা পিছলে মুখ থুবড়ে তোর প্রেমে পড়বে। ওই দেখ সিফাত কিভাবে তাকিয়ে আছে তোর দিকে। আহারে বেচারার যা ও একটু আশা ছিল এখন তো আর বাড়িতে হ্যান্ডসাম একটা ছেলে রেখে ওকে তুই পাত্তাই দিবি না।’

ইতি মাথা তুলে তাকায়। সিফাত দু’তলার বারান্দা থেকে তাকে দেখছে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,

– ‘আমি তো তাকে আগেও পাত্তা দেইনি রুমকি।’

– ‘দিয়েছিস তো বলছি না, তবুও তো হঠাৎ তোর ভালো লাগতে পারতো। মন গলতে পারতো।’

– ‘তোর অলরেডি গলে গেছে মনে হচ্ছে। তুই তাহলে প্রেম কর।’

– ‘আমাকে তো সে পছন্দ করেনি। করলে আসলেই ভেবে দেখতাম। সিফাত ছেলে ভালো। কেমন লাজুক। দূর থেকে এত আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে৷ কিন্তু সামনে আসে না। এরকম ছেলে ভালো লাগে।’

– ‘আমি শিওর তুই ওর প্রেমে পড়েছিস রুমকি।’

– ‘মোটেও না।’

দু’জন কথা বলতে বলতে ক্লাসে এলো। খানিক পর বাংলা স্যার এসে ঢুকলেন খাতা নিয়ে৷ ক্লাস শুরু হয়েছে৷ কিন্তু ইতির মাথায় রাতের প্লান ঘুরপাক খাচ্ছে। লতিফাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে এসেছে। টাকার লোভও দেখানো শেষ। আজই কল দিয়ে ওর ভাইকে আনবে লতিফা। ভাবের দোকানদারকে সে এভাবেই শায়েস্তা করবে। একের পর এক অপমান করছে। আজকের কথাগুলোও মাথায় একদম গেঁথে গেছে ‘তুমি বড়ো বেশি কথা বলো। আমি তোমাকে লজ্জা পাব কেন? তুমি কি সেরকম কোনো মেয়ে না?’

– ‘ইতি দাঁড়াও।’

ভাবনা থেকে কেঁপে বের হলো ইতি। বাংলা স্যার তাকে দাঁড়াতে বলছেন। ইতি মাথা নীচু করে দাঁড়ালো।

– ‘কি হয়েছে ইতি? অমনোযোগী হয়ে বসে কি ভাবছো?’

– ‘কিছু না স্যার।’

– ‘কিছু না মানে? মুখ-চোখ শক্ত করে দাঁত কটমট করে রাগে ফুসছো মনে হচ্ছে। ঘটনা কি? কাউকে মারবে না-কি?’

সিফাত ছাড়া ক্লাসের সবাই পিছু ফিরে ইতির দিকে তাকিয়ে হা-হা করে হেঁসে উঠলো। সে লজ্জায় থুতনি বুকের সাথে লাগিয়ে নুইয়ে বললো,

– ‘কিছু না স্যার।’

স্যার এগিয়ে এসে অবাক হয়ে বললেন,

– ‘সে কি তোমার সামনে তো বইও খোলা নেই। কি হয়েছে বলো তো।’

– ‘কিছু হয় নাই স্যার।’

– ‘আচ্ছা বসো। রুমকি একটু সাবধানে থেকো ইতি হঠাৎ মা’রতে শুরু করতে পারে।’

সবাই আবার হাসতে শুরু করলো। সিফাত করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। ইতি বসে পড়লো। রুমকি ফিসফিস করে বললো, ‘মাত্র এক রাতেই ছেলেটা তোকে পাগল করে দিছে।’

ইতি বিস্মিত হয়ে বললো,

– ‘কি আজেবাজে কথা বলছিস! এক রাতে মানে কি!’

– ‘এত রাগছিস কেন? তুই নিজেই গতকাল কল দিয়ে বললি ছেলেটা বিকালে এসেছে। তো মাঝখানে একটা রাতই তো গেছে শুধু।’

– ‘ক্লাসে বাজে কথা বলবি না। এমনিতেই মাথা খারাপ।’

– ‘মাত্র এক রাতেই ছেলেটা তোর পুরো মাথাই দখল করে নিছে। অথচ সিফাত দুই বছর থেকে পারলো না। দেখ এখন ক্লাসের সবাই হেসেছে। কিন্তু সে হাসেনি। আহা কি প্রেম।’

– ‘সিফাত হাসেনি কিন্তু তুই ঠিকই হেসেছিস। এটা মনে রাখিস। আর তুই এত সিফাত সিফাত করছিস কেন? এত প্রেম থাকলে যা, পেছনের সিটে গিয়ে ওরে নিয়ে শুয়ে থাক।’

রুমকি খিলখিল করে হঠাৎ হেঁসে উঠলো। হাসি আঁটকে রাখতেই পারলো না। বাংলা স্যার ডাস্টার দিয়ে টেবিলে বাড়ি দিয়ে বললেন,

– ‘হাসিটা মিষ্টি। কিন্তু ক্লাসে মিষ্টি হাসি দেওয়ার জায়গা না। কে হাসছে দাঁড়াও।’

স্যারের কথা শুনে সবাই আবারও একসঙ্গে হেঁসে উঠলো। বাংলা স্যারের ক্লাসে সবাই রোজই এভাবে হাসাহাসি করে কাটিয়ে দেয়।

তিনি ডাস্টার দিয়ে টেবিলে আঘাত করে বললেন,

– ‘সবাই হাসি বন্ধ করো। কে হেসেছো দাঁড়াও।’

একটা মেয়ে দাঁড়ালো। স্যার এগিয়ে এসে বললেন,

– ‘তুমি হাসছো কেন?’

– ‘আমি হাসিনি স্যার।’

– ‘তাহলে দাঁড়ালে কেন?’

– ‘রুমকি হাসছে এটা বলতে দাড়াইছি স্যার।’

– ‘রুমকি দাঁড়াও।’

রুমকি ভয়ে ভয়ে দাঁড়ালো। স্যার কাছে গিয়ে বললেন,

– ‘পাঠদানের সময় হঠাৎ হাসার কারণ কি? এখানে কি কমেডি নাটক চলছে? কেন হাসছো বলো।’

রুমকি ইতির দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘ওর জন্য স্যার।’

ইতি চোখ দিয়ে শাসাচ্ছে কিছু না বলতে। স্যার সেটাও দেখে ফেললেন।

– ‘ইতিও দাঁড়াও। এবার রুমকি বলো সে কি এমন হাসির কথা বলেছে যে তুমি খিলখিল করে ক্লাসেই হেঁসে উঠলে। এখানে অনেক ছেলে আছে। ওরা শুনুক সেই মহামূল্যবান হাসির কথা। যে কথাতে এতটাই কাতুকুতু যে, শোনার পর ক্লাসেই একটা তরুণী খিলখিল করে হেঁসে উঠেছে। ছেলেগুলো শুনুক। ভবিষ্যতে গোমড়ামুখো বউ পেলে কাজে লাগবে।’

সবাই পুনরায় হাসতে শুরু করলো। ইতির বুক ‘ধুপধাপ’ করছে। রুমকি কথাটা বলে ফেললে লজ্জায় মরে যাবে সে।

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

মায়াডোর (৭ম পর্ব)
.
কিন্তু রুমকি আসল কথাটি বললো না। সে চারদিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বললো,

– ‘স্যার ইতিকে যখন আপনি বসতে বললেন। সে বসার পর খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ ফিসফিস করে বললো..।’

রুমকি থেমে আবার ইতির দিকে তাকালো। ইতি বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে।

স্যার তাড়া দিয়ে বললেন,

– ‘কি বললো, বলো।’

– ‘ও বসে আমাকে একটা চিমটি দিয়ে বললো ‘মনে রাখিস তুই আমার বান্ধবী হয়ে আমাকে নিয়ে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেসেছিস’ এই কথা শুনে স্যার আমার আবার হাসি পাইছে।’

স্যার ম্লানমুখে তাকিয়ে থেকে বললেন,

– ‘আমরা হতাশ হয়েছি। এখানে এতো হাসির মতো কি আছে? দুইজনই কান ধরে পুরো ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকো।’

ইতি মাথা নুইয়ে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘স্যার আর কখনও এমন হবে না।’

তিনি ডাস্টার দিয়ে বেঞ্চে প্রচণ্ড জোরে আঘার করে বললেন,

– ‘আর কখনও এমন না হলে আর কখনও কান ধরাও লাগবে না। আজ ধরো।’

দু’জন কান না ধরে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইল। স্যার রেগে গিয়ে বললেন,

– ‘আমি তিন পর্যন্ত গুনবো। এর ভেতরে কান না ধরলে শাস্তি বাড়বে। ক্লাসে কান ধরে ওঠ-বস করা লাগবে৷ এক, দুই,…।’

তিন বলার আগেই দু’জন কান ধরলো। ক্লাসের পুরো সময়টা এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। ছেলেরা খানিকক্ষণ পর পর হাসিমুখে পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখছে।
প্রচণ্ড রাগে, অপমানে, অভিমানে ইতির কান্না পাচ্ছে। সব দোষ কল্পের। ওর জন্যই একের পর এক ঝামেলা হচ্ছে।

আজ বেশ গরম পড়েছে।
কল্প বাসায় ফেরার সময় ভার্সিটির প্রস্তুতির জন্য লাইব্রেরি থেকে কিছু বইপত্র এনেছে। সঙ্গে একটা পত্রিকা। এখন থেকে সাম্প্রতিক বিষয়গুলোও জেনে রাখতে হবে৷ পরীক্ষায় এগুলো থেকেও প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু গোসল করে এসে পড়ার টেবিলে বসতেই বিদ্যুৎ নিয়ে গেল। অল্প সময়েই ঘেমে-নেয়ে একাকার সে। বারান্দায় বের হয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ফরিদ সাহেব গামছা হাতে খালি গায়ে আমগাছের নিচে চেয়ার নিয়ে বসেছেন। বিদ্যুৎ দু’দিন কিছুটা কম নিয়েছিল। আজ সকাল থেকে আবার শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ নিলেই ফরিদ সাহেব প্রচণ্ড রেগে যান। তারপর অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুরু করেন। কল্পকে দেখে গামছা দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে বললেন,

– ‘দেখেছো অবস্থাটা? কারেন্ট নাই দেখে গোসলে গেলাম। আইসা দেখি চলে আসছে। ভাবলাম নামাজটা পড়ে নিয়ে এরপর খেতে বসবো। জায়নামাজ বিছাইতেই আবার নিয়ে গেল৷ কতবড়ো শ*য়তানের বাচ্চা এরা দেখেছো তো। নাটক করে বুঝলে? শ*য়তানের বাচ্চারা নাটক করে। দেশটাকে লুটেপুটে খেয়ে এখন নাটক শুরু করছে। তোমাদের এদিকে কেমন বিদ্যুৎ নেয় বলো দেখি ছোকরা।’

কল্প পত্রিকা দিয়ে বাতাস করতে করতে বললো,

– ‘সারাক্ষণই নিয়ে রাখে নানাভাই, মাঝে মাঝে দেয়।’

– ‘এগুলো নাটক করে বুঝলে, নাটক। ঘাড়ের উপর বসে শ*য়তানের বাচ্চারা নাটক শুরু করছে। আমরাই ঘাড়ে তুলেছি এদের। একটা ঝাড়া দিয়ে ঘাড় থেকে ফেলে দেওয়া দরকার। কিন্তু সেই যুগ কি আর এখন আছে। এখনকার পোলাপান হইছে ঝিমুইন্না পার্টি। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে রুমের ভেতরে ঝিমাচ্ছে।’

মুজিব উদ্দিন গেইট খুলে এসে নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘কি হয়েছে বাবা। এতো চিল্লাচিল্লি কিসের?’

– ‘শোন এখন থেকে বিদ্যুৎ বিল আর দিবি না৷ লাইন কেটে নিলে নিক। ৪-৫ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ ছাড়া যেহেতু থাকতে পারি৷ সারাজীবন পারবো।’

– ‘কেন বাবা। কার সঙ্গে এই বিদ্রোহ? তোমার দলই তো ক্ষমতায়..।’

– ‘চুপ কর বেয়াদব। তুই কি আমার লগে রসিকতা করছিস? দল মারাচ্ছিস। ফরিদ মাস্টার দলের মুখে ঝাঁটা মারে। সব শা*লার ব্যাটারা বা*টপা*র। দেশের অর্থ পা*চার করতে করতে একেবারে শেষ করে দিছে। তোকে যা বলেছি তাই করবি। বিল দেওয়া বন্ধ। কথার যেন কোনো হেরফের না হয়।’

মুজিব উদ্দিন নাক টেনে বললো,

– ‘কিন্তু বাবা মোবাইল, ফ্যান, বাতি এগুলো ছাড়া কি চলা সম্ভব?’

– ‘মোবাইল, টিভি, ফ্যান সব চুলায় যাক। মোবাইল ছাড়া কি চলিনি আমরা? বাতি ছাড়া কি সারাজীবন আমরা অন্ধকারে ছিলাম?’

লতিফা বারান্দায় এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

– ‘তাইলে আমার এতগুলো সিরিয়ালের বাকি অর্ধেক কিভাবে দেখমু দাদাভাই? আমি তাইলে এই বাড়িতে আর কাজেই থাকমু না। যে বাড়িতে সিরিয়াল নাই সেই বাড়িতে লতিফারও কাজ নাই।’

ফরিদ সাহেব পায়ের জুতা হাতে নিয়ে তেড়ে যেতে যেতে বললেন,

– ‘সিরিয়াল মারানির মাইয়া দাঁড়া তুই এখানে।’

‘ওমাগো’ বলে লতিফা দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। মুজিব উদ্দিন বাবাকে ধরে আঁটকে বললেন,

– ‘বাবা তুমি আজকাল বিদ্যুৎ গেলেই পাগল হয়ে যাচ্ছ। তোমার জন্য চার্জার ফ্যান আনবো আমি। শান্ত হও।’

– ‘কি বললি! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি? তুই আমাকে পাগল বললি। ছাড় আমাকে। ছাড় বলছি। আমার এ বাড়িতে আর থাকা হবে না। এটা পাগলাগারদ না। আমি এখনই পাগলাগারদের খুঁজে বের হব।’

নিজেকে ছাড়িয়ে তিনি চলে গেলেন রুমে। গিয়ে লুঙ্গি খুলে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরলেন। হাতে লাঠিটা নিতেই চলে এলো বিদ্যুৎ। হুস্না আর নীলা এসে ফ্যানের সুইস দিয়ে বললো,

– ‘বাবা বাড়ি থেকে যখন চলেই যাবে শেষ খাবারটা আমাদের নিয়ে খেলে কেমন হয়?’

– ‘না এই বাড়ির খাবারও আমি খাব না। এটা পাগলাগারদ না।’

নীলা হাত ধরে বললো,

– ‘আসো তো বাবা। তুমি এখন বাড়ি থেকে বের হলে আমরা দুই বউও তোমার সঙ্গে বের হয়ে যাব। তুমি পাগল হলে আমরাও পাগল।’

ফরিদ সাহেব হেঁসে উঠলেন,

– ‘শুধু তোমার জন্য খেতে যাচ্ছি মা। তুমি হচ্ছ শিল্পী মানুষ৷ আহ কি মধুর সংগীত। একজন শিল্পীর কথা আমি ফেলতে পারি না। ফরিদ মাস্টার শিল্পীর কদর দিতে জানে।’

মুজিব উদ্দিন এসে নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘মা ও ভালো গান গাইতেন তাই না বাবা।’

– ‘হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস। বেচারি শুধু ভালো গান গাইত তা না৷ ভালো গল্পও করতো।’

– ‘হ্যাঁ বাবা। আর হুস্না তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে টেবিলে খাবার দাও আবার বিদ্যুৎ গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

ফরিদ সাহেব পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করতে চাইলেন রসিকতা করছে কি-না। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না। ইতস্তত করে রুম থেকে বের হলেন। নীলা ফ্যান বন্ধ করে পিছু পিছু এলো। সবাই বসলেন খাবার টেবিলে। কল্প এলো খানিক পর। ফরিদ সাহেব প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললেন,

– ‘বুঝলে ছোকরা। শরীর হইল মহাশয়, যা দিবা তা সয়। একটা সময় তপ্ত রোদে কাজ করছি৷ পড়ালেখা করছি। বিদ্যুৎ ছিলই না গ্রামে। তবুও তো রাতে ঘুমাইছি। কিন্তু এখন শেখ হাসিনার বাংলাদেশ৷ উন্নত হয়ে গ্রামগঞ্জে, চরে-দ্বীপে, ঘরে- ঘরে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। শরীর পাইয়া গেছে আরাম। এখন আর শরীর কষ্ট সইতে পারে না। অথচ সকল সরকারের আমলেই লোডশেডিং ব্যাপারটা ছিল। তখন ঠিকই গায়ে লাগেনি। এখন শেখ হাসিনার সুখী বাংলাদেশ। একটু এদিক-ওদিক হলে আরামের শরীর বিদ্রোহ করে।’

মুজিব উদ্দিন হাসি আটকানোর ভঙ্গিতে খিকখিক করে হেঁসে বললো,

– ‘আমাদের কেন হাসাচ্ছ বাবা৷ খেতে বসেছি হঠাৎ হাসির তোড়ে বিষম খেয়ে মারা যাব। একটু আগে গালাগাল করে এখন মাথার উপরে ফ্যান চলায় প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছ।’

– ‘আরে নির্বোধের বাচ্চা সেটাই তো বলেছি। আরামে আছি তো একটু বিদ্যুৎ নিলেই এখন সইতে পারি না।’

তখনই চটের থলে হাতে একটি ছেলে লতিফার সঙ্গে খাবার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। পায়ে লাল কেডস। পরনে হলুদ প্যান্ট আর ফুলতোলা শার্ট। গলায় ঝুলছে সবুজ ইয়ারফোন। ছেলেটি হুস্নার দিকে ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘আপনেরা খেতে বসেছেন তাই সালাম দিলাম না। বেয়াদবি ক্ষমা করবেন।’

ফরিদ সাহেব তাকিয়ে বললেন,

– ‘তুমি কে ছোকরা?’

– ‘আমি লতিফার ভাই লতিফ। হাওরে বাঁধ দিছিলাম। প্রচুর মাছ পড়েছে৷ তাই মায় আপনেরার লাগি মাছ দিয়া পাঠাইল।’

মুজিব উদ্দিন নাক টান দিয়ে বললো,

– ‘হাওরে বাঁধ ব্যাপারটা কি?’

– ‘বছরে মনে করেন দুইবার বাঁধ দেয়া যায়৷ একবার নতুন পানি আসনের সময়। আরেকবার জমি-টমি থেকে পানির টান পড়লে।’

– ‘বুঝি নাই৷ ব্যাপারটা জটিল মনে হচ্ছে।’

ফরিদ সাহেব ধমক দিয়ে বললেন,

– ‘তুই নির্বোধের বাচ্চা বুঝবি না। বাবা তুমি খেতে বসো আমাদের সঙ্গে।’

লতিফ শার্টের হাতা গুটিয়ে চেয়ার টেনে বসে গেল। সবার আগে খাওয়া শেষ হলো কল্পের। সোজা গিয়ে বসলো সে পড়ার টেবিলে। বিদ্যুৎ যতক্ষণ আছে পড়া যাক। কিন্তু তার আর সুযোগ পেল না৷ দরজার সামনে এসে লতিফ বললো,

– ‘আসসালামু আলাইকুম ভাই সাহেব। আপনি অনুমতি দিলে একটু আসতাম।’

– ‘হ্যাঁ আসুন।’

– ‘ভাই সাহেবকে দেখলেই মনে হয় বিরাট শিক্ষিত। নাম কি ভাই আপনের।’

– ‘কল্প ইসলাম।’

– ‘বাহ অন্যরকম নাম।’

কল্প আর কিছু না বলে বইয়ে চোখ রাখলো৷ লতিফ নিজেই পুনরায় বললো,

– ‘বুঝলেন ভাই সাহেব। হাওরে বাঁধ দিছিলাম বড়ো কষ্ট কইরা। পরথম পরথম মাছ ভালাই পড়তো। এরপর ঘটতে শুরু করলো এক আচানক ঘটনা।’

কল্প আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে বললো,

– ‘আচানক ঘটনা মানে।’

– ‘বুঝেনই তো হাওরে বাঁধ দিয়ে সারারাত জেগে থাকতে হয়৷ দিনে ঘুম। এই এক জীবনে রাইতে যে কত আচানক কাণ্ড দেখলাম ভাইসাহেব। আল্লাহর দুনিয়াটাই হইল গিয়া আচানকের।’

– ‘কি আচানক কাণ্ড একটু বলেন তো।’

– ‘গতরাতের কথাই আপনেরে বলি। আমরা জাল দিছি পুরা জমি পেঁচাইয়া। রাইতে ভূ*ত-পে*ত্নী জালটারে পানির উপরে টাঙাইয়া রাইখা চলে গেছে।’

– ‘কি বলেন এগুলো। মানুষও করতে পারে।’

– ‘আচানক কথাবার্তা কন ভাই আপনে। পরথম আমরা তাবু থাইকা পানিতে হাঁটার শব্দ পাইছি। রাত তখন তিনটা। চারদিক আন্ধার। এত রাইতে পানিতে কে হাঁটব কন। আচানক হইয়া আমরা তাবু থাইকা বাইর হইলাম। শোনা গেল খিলখিল কইরা হাসির শব্দ। আমরা লাইট নিয়া গিয়ে দেখি কেউ নাই কিন্তু চুক্ষের সামনে জাল পানি থাইকা সমানে উপরে উঠতেছে। আমরা সবাই তো তাজ্জব বইনা গেলাম। দোয়া দরূদ পড়া ছাড়া কিচ্ছু করনের নাই। সব মাছও বাইর হইয়া গেল।’

কল্প ভয়ে শুকনো ঢোল গিলে বললো,

– ‘ভাই জ্বি*ন-ভূ*তের গল্প শুনতে চাচ্ছি না এখন। বাদ দিন। আমি পড়বো।’

– ‘ভাই গল্প কইতাছেন কেন। বাস্তব ঘটনা গল্পের কি এইখানে। একদিন কি হইছে শুনেন। মুয়াজ্জিনের আগে আমাদের মসজিদে জ্বি*ন রাত তিনটায় আজান দিয়া ফেলাইছিল। বুঝেন কেমন আচানক কারবার। রাইত হইল ভাই জ্বী*ন-ভূ*তের। দিন হইল মানুষের।’

– ‘হ্যাঁ ভাই আপনি যান। আমি পড়বো।’

– ‘আচ্ছা ভাই আপনি পড়েন। আমি বইসা থাকি৷ লতিফ বেশি কথা কওনের লোক না।’

কল্প মাথা থেকে ভূ*ত-প্রে*ত সরাতে শব্দ করে পড়তে শুরু করলো। লতিফ প্রথম থেকেই কল্পের কথা বলার ভঙ্গি মনযোগ দিয়ে শুনছে। এখনও সে বসে আছে সবকিছু ভালোভাবে পরখ করার জন্য।

ইতি স্কুল থেকে ফিরে কাপড় পালটে খেতে বসলো। লতিফা এসে ফিসফিস করে বললো,

‘লতিফ আইছে। আইয়া কি বলছে জানো।’ কথাটি বলে লতিফা ফিক করে হাসলো। ইতি নির্লিপ্ত চেহারায় বললো,

– ‘কি বলছে?’

– ‘বলছে মা মাছ দিয়া পাঠাইছে।’

– ‘ভালো করছে।’

– ‘সে আসার পর থাইকা মাস্টারের ঘরে বইসা আছে। ওর কথা খেয়াল করতেছে। গলা নকল করাও একটা বিরাট কাম ইতি।’

– ‘হ্যাঁ ঠিক বলেছো। এখন আমার কানের কাছ থেকে সরে যাও।’

– ‘তোমার কি মন খারাপ?’

– ‘বলছি না যেতে।’

লতিফা চলে গেল। খানিক পরেই ফরিদ সাহেবের চিল্লাচিল্লি শোনা গেল। তিনি রান্নাঘরে এসে লতিফাকে ডাকলেন। লতিফা ভয়ে ভয়ে সামনে এলো,

– ‘কি হয়েছে দাদাভাই।’

– ‘তুই আমার পাঞ্জাবির পকেট থেকে টাকা চু*রি করেছিস কেন?’

– ‘হায় আল্লাহ কি কন। আল্লাহ-রসুলের কসম লাগে। এই লতিফা টাকা চু*রি করার মতো মেয়ে না।’

– ‘তাহলে টাকা কে নিল। টাকা কি গায়েব হয়ে গেছে।’

লতিফা ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে বললো,

– ‘আমি কি জানি আপনের টাকা গায়েব হইছে না-কি চু*রি হইছে।’

– ‘টাকা তুইই নিয়েছিস বের করে দে লতিফা।’

বাড়ির সবাই এলেন হইচই শুনে। মুজিব উদ্দিন এসে বললেন,

– ‘বাবা টাকা নাই হয়েছি এত চেঁচামেচির কি আছে?’

– ‘কি বললি তুই? আমি চেঁচামেচি করি? ওই টাকা আমার মসজিদে দেওয়ার জন্য মানত করা ছিল।’

– ‘ঠিক আছে, কত ছিল। আমি দিয়ে দিচ্ছি।’

– ‘তুই আমারে টাকা দেখাচ্ছিস? আমারে টাকা দেখাচ্ছিস তুই? আমার ওই টাকাই লাগবে। ওইটা মানতের টাকা।’

– ‘কিন্তু বাবা ওই টাকা পাবে কোথায় এখন?’

– ‘লতিফা বের করে দিবে। সেইই নিছে টাকা।’

লতিফ আর কল্পও ততক্ষণে চলে এসেছে। লতিফ গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

– ‘বেয়াদবি না নিলে একটা কথা বলি। টাকা বের করার একটা পদ্ধতি আছে। বাটি চালান। পরিচিত কবিরাজ আছে কল দিমু নাকি?’

ফরিদ সাহেব বললেন,

– ‘হ্যাঁ তাই করো। আমি চু*রকে দেখতে চাই।’

ইতি ভয় না পেয়ে উল্টো সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। মন খারাপ ভাবটা নিমিষেই কেটে গেছে। এতদিন অনেকের মুখে শুধু বাটিচালানের গল্প শুনেছিল। এবার নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে। টাকা নিয়ে লুকিয়ে রাখবে দাদা ভাইয়ের রুমে। সুতরাং বাটি উনার রুমের দিকেই যাবে। তাকে ধরার কোনো সুযোগ নেই। সবাই ভাববে দাদাভাই টাকা নিজেই রেখে ভুলে গিয়েছিলেন। ইতি খুশিতে আত্মহারা হয়ে লাফ দিয়ে উঠে বললো,

– ‘হ্যাঁ দাদাভাই বাটি চালান হোক। মানতের টাকা চু*রি হওয়া মুখের কথা না।’

লতিফা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,

– ‘আমারে চো*র বলা হইছে আমিও আসল চো*র দেখতে চাই। লতিফ তুই এখনই কল দে। আমরা চো*রের বংশ না নগদে প্রমাণ হইয়া যাইব।’

‘ঠিক আছে আমি এখনই কবিরাজকে কল দিতাছি।’ কথাটি বলে লতিফ চলে গেল ছাদে।
মুজিব উদ্দিন নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘এবার খুশি তো বাবা? শান্ত হও। আমি বাজারে চলে যাচ্ছি।’

ইতি চোরা চাহনিতে কল্পের দিকে তাকালো। তারপর মাথায় এলো ‘আচ্ছা যদি টাকা নিয়ে ভাবের দোকানদারের বিছানার নিচে রাখি, তাহলে কেমন হবে?’

__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here