মায়াডোর-১৩,১৪
(১৩ পর্ব)
.
ইতি অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘আমি জানি না। নীলা আন্টি চাইলে বসুন।’
– ‘কিন্তু তুমিই তো আমাকে বললে ছাদে আসতে।’
নীলা দাঁত কটমট করে ইতির দিকে তাকায়। মুচকি হাসে কল্প। তারপর বসতে বসতে বলে,
– ‘ওর দিকে এভাবে তাকাতে হবে না আন্টি৷ আমি জানি আপনি কারও সামনে গান গাইতে লজ্জা পান। সুতরাং গান গাওয়ার জন্য বলবো না।’
নীলা মুখ টিপে হেঁসে বললো,
– ‘তাহলে বাঁচালে তুমি। ভেবেছিলাম বিপদে পড়ে গেছি।’
ইতি গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থেকো বললো,
– ‘কিন্তু সে তো আর তোমার শ্বশুর না। শোনালে কি হয়?’
নীলা ফিক করে হেঁসে ধমক দেয়, ‘চুপ ইতি, তারচেয়ে বরং আমি গিয়ে লুডু নিয়ে আসি। খেলবো বসে বসে।’
নীলা নিচে চলে গেল৷ ইতি বাঁ পা ভাজ করে ডান পায়ের হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। মাথার চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো। কল্প চারদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– ‘জানো আমার কেন চাঁদনি রাত দেখার কোনো আগ্রহ নেই?’
ইতি জবাব দিল না৷ কল্প নিজেই বললো,
– ‘কারণ তোমাকে যেখানে রোজই দেখি। চাঁদ দেখার আগ্রহ আসবে কিভাবে বলো? তোমার সৌন্দর্যের কাছে তো এইসব চাঁদ-টাদ তেতুল গাছের পে*ত্নী।’
ইতি তাতেও জবাব না দিয়ে মুখ টিপে কেবল হাসে। কল্প আবারও ফিসফিস করে বললো,
– ‘চুলগুলো এত সুন্দর করে চারদিকে ছড়িয়ে বসেছো। আমি শিওর এতক্ষণে উল্টো চাঁদই তোমাকে দেখা শুরু করেছে।’
ইতির এত ভালো লাগছে। কি সুন্দর করে প্রশংসা করছে মানুষটা। ইচ্ছা করছে ওর কোলে মাথাটা রাখতে। এই ছাদে, খোলা আকাশের নিচে। মাঝে মাঝে দু’হাত বাড়িয়ে কল্পের মুখটা ছুঁয়ে দেবে সে। ইতি ভেজা গলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘আপনি এত মিষ্টি করে কথা বলতে পারেন জানতাম না তো।’
কল্প মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আরও মিষ্টি করে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু তুমি তো মিষ্টি মুখটা চাঁদকে দেখাচ্ছ, আমাকে না।’
ইতি ফিক করে হাসলো। তারপর ওর দিকে ফিরে বললো,
– ‘জ্বি বলুন আপনার মিষ্টি কথাগুলো শুনি।’
কল্প মোবাইল হাতে নিয়ে বললো,
– ‘ফেইসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে একটা লেখা পেলাম। একজন লেখকের। হয়তো বেচারা চাঁদ দেখে দেখে প্রণয়িনীকে নিয়ে লিখেছে, সেটা পড়ি?’
ইতি ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে থেকে মাথা কাঁত করে সম্মতি দিল।
কল্প মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকে বললো,
“ভেসে যাওয়া প্রতিটি চাঁদনি রাতে
তোমায় বাহুডোরে বেঁধে ভালোবাসি বলবো;
মাদুরিটা বিছিয়ে নিয়ে অমন জোছনা রাতে, বাড়ির ছাদে
তোমার কোলেই মাথা পেতে রাখবো।”
ইতির বুকটা শিরশির করে উঠে। পুরো শরীরজুড়ে উষ্ণ এক অনুভূতি বয়ে যায়। খুব একটা উঁচুমানের কোনো কথা নয় এগুলো, একেবারে সহজ, সরল, স্বাভাবিক কথা৷ তবুও ইতির কাছে অসাধারণ হয়ে উঠলো তার মনের অপ্রকাশিত বাসনার সঙ্গে মিলে যাওয়ায়।
মুগ্ধ হয়ে বললো,
– ‘যে লিখছে তার নাম কি?’
– ‘জবরুল ইসলাম।’
‘এটা আবার কেমন নাম! কিন্তু লেখাটা ভালোই লেগেছে’ তারপর খানিক থেমে বললো ‘আপনার ইচ্ছা হয় না এরকম?’
কল্প মোবাইল মাদুরিতে রেখে বললো,
– ‘কিরকম?’
– ‘ভেসে যাওয়া কোনো এক চাঁদনি রাতে, বাড়ির ছাদে, কোনো রূপবতীকে বাহুডোরে বেঁধে ভালোবাসি বলতে?’
– ‘তা তো হয়ই।’
– ‘তো রূপবতী কাউকে পাচ্ছেন না বলে ধরা হচ্ছে না না-কি?’
– ‘আজব কথা বলো না। রূপবতী তো তুমিও। তাই বলে কি এখন জড়িয়ে ধরতে হবে? সবার প্রতি সেই অনুভূতি আসে না। যেমন তুমি রূপবতী, কিন্তু তোমাকে আমি অন্য চোখে দেখি। এমন নারীও হয়তো একদিন আসবে, যাকে বাহুডোরে বেঁধে ভালোবাসি বলার জন্য আমার মন থেকেও তাগাদা পাব।’
ইতি ক্রোধে অন্যদিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললো, ‘আপনার অন্য চোখ আমি উপড়ে ফেলে দেবো।’
কল্প বিভ্রান্ত হয়ে তাকায়।
– ‘কি হলো, ভুল কিছু বললাম না-কি?’
ইতি মাদুর থেকে উঠে হন-হন করে চলে যায়। কল্প দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ভেবেছিল রাগ ভাঙাবে। অথচ মেয়েটা উল্টো রেগে গেল।
নীলা ইতিকে সিঁড়িতে পেয়ে হাত ধরে বলে ‘কোথায যাচ্ছ, লুডু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নিলয় নিয়ে রেখেছিল তোমাদের বিছানার নিচে। তাই দেরি হলো। আসো।’
– ‘আন্টি হাত ছাড়ো। আমি খেলবো না। তোমরা খেলো।’
ইতি নিচে চলে এলো৷ নীলা ছাদে গিয়ে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘ইতি চলে গেল কেন কল্প?’
– ‘বুঝতে পারিনি।’
– ‘মনে হলো রাগ করে গেছে, আচ্ছা বাদ দাও। আজ আর খেলবো না।’
নীলাও চলে এলো ছাদ থেকে। ইতি বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।
রাগে শরীর কাঁপছে। নিজের চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। একটা ছেলে এতটা অনুভূতিহীন হয় কিভাবে? বয়স কম হলেও তো সে এতটুকু জানে পুরুষ মানুষদের নারীদের প্রতি সীমাহীন দূর্বলতা থাকে। রাস্তায় ষাট বছরের বৃদ্ধও রূপবতী নারী দেখলে লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকে। সে কি রূপবতী নয়? তার রূপ দেখে কি একজন পুরুষের বিশেষ কোনো অনুভূতি জাগার জন্য যথেষ্ট নয়? তাহলে ‘অন্য চোখ’টা আবার কি? সে তো কল্পের চাচি-খালা লাগে না যে অন্য চোখে দেখতে হবে। না-কি এত পাগলামির পরও তাদের সম্পর্ক এখনও গম্ভীর রয়ে গেছে। ইতির আরও জেদ হলো। এভাবে বারবার চলে আসলে হবে না৷ আরও চড়াও হবে সে। আরও বেপরোয়া। নিজের মুখেই তো ছাদে প্রশংসা করেছে। তবুও কেন সে অন্য চোখে দেখবে? অন্য চোখ উপড়ে ফেলে অবশ্যই প্রেমে ফেলে ছাড়বে সে কল্পকে।
হুস্না বেগম এসে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে বললেন,
– ‘কিরে মা, ঘুমিয়ে যাচ্ছিস না-কি। ঘুম পেলে ওদের সঙ্গে খেয়ে নে৷ তোর বাবা আজ এখনও আসেনি। ঘুম পেলে আব্বা আর কল্পের সঙ্গে খেয়ে নে।’
ইতির মাথায় একটা দুষ্টবুদ্ধি উদয় হলো। সে উঠে মায়ের পিছু পিছু রান্নাঘরে আসে। দাদার পাশে গিয়ে চেয়ার টেনে সোজা কল্পের মুখোমুখি বসলো। টেবিলে খাবার দিয়ে হুস্না বেগম বললেন, ‘কিছু লাগলে ডাক দিছ তো মা’ বলে তিনি সিরিয়াল দেখতে চলে গেলেন।
কল্প প্লেটে খাবার নিচ্ছে। ইতি মুখ টিপে হেঁসে ওর দিকে তাকিয়ে টেবিলের নিচ দিয়ে পা দু’টো ওর কোলে রেখে দিল। বাসায় একটা বিড়াল আছে। প্রায়ই লাফালাফি করে। কল্প প্রথমে ভাবে বিড়াল হয়তো কোলে উঠে বসে আছে। প্লেটে ভাত নিতে নিতেই বাঁ হাতে ‘ঠাস’ করে বিড়ালকে থা*প্পড় দিয়ে ঠোঁটে ‘যাহ’ বললো।
ব্যথায় ‘উফ’ করে উঠলো ইতি। ফরিদ সাহেব ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ফাজলামি না করে ভাত খা, মেরেছে বিড়ালকে আর তুই এখান থেকে “উফ” করছিস কেন।’ কথাটি বলে তিনি মাথা নীচু করে খাবারে মনযোগ দিলেন। কল্প ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চারিদিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলছে৷ পা সরানোর জন্য বারবার হাত দিয়ে ঠেলছে। কিন্তু ইতির পা সরানোর কোনো নামগন্ধ নেই। একবার নিরুপায় হয়ে ভাবে চিমটি দিলে কাজ হতে পারে। জোরে দেবে না-কি আস্তে দেবে? এত সুন্দর কোমল পায়ের পাতায় জোরে চিমটি দিলে নিশ্চয় দাগ পড়ে যাবে। তাছাড়া বেশি ব্যথা পেয়ে যদি চিৎকার দিয়ে উঠে তাহলে তো আবার ফরিদ সাহেব বুঝে যাবেন। সে আস্তে-আস্তে চিমটি দিল। সঙ্গে সঙ্গে ইতি ‘উফ’ করে উঠলো। ফরিদ সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
– ‘তোর কি পেটে কৃমি হইছে? শান্তি নাই তোর জানে?’
– ‘মশা কামড়ালে কি উফ বলবো না?’
ফরিদ সাহেব পুনরায় খেতে শুরু করলেন। কল্প বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে ভেবে খাবার খেতে শুরু করে। পা থাকুক,
কোনোভাবেই সরানো যাবে না। তাকে শান্ত দেখে ইতি পা নাড়াতে নাড়াতে বললো, ‘উফ কি মজা।’
ফরিদ সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘নির্বোধের বাচ্চা না-কি? একা একা কি বলিস?’
– ‘তরকারি ভালো হলে কি আরেকজনকে ডেকে এনে বলতে হবে মজা হইছে? নিজেই বলতে হয়। সব মজার কথা সবাইকে বলা যায় না।’
– ‘খেতে বসে রসিকতা করবি না। খেতে বসেছিস চুপচাপ খা।’
– ‘রসিক বন্ধুর সঙ্গেই তো রসিকতা করছি।’
ইতির সাহস দেখে কল্প ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে। ওর মনে হয় মাথা ঠিক নেই আজ। তাড়াতাড়ি খেয়ে চলে যেতে পারলেই বাঁচে কল্প। খানিক পরেই হুস্না বেগমকে দরজার সামনে দেখেই তার বিষম খেয়ে হেঁচকি উঠতে শুরু করলো।
– ‘আরে গাধি বসে কি দেখছিস ওকে পানি দে।’
ইতি আলগোছে পা নামিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিল। তবুও হেঁচকি আর থামলো না তার। প্লেটের খাবার রেখেই উঠে চলে গেল। হুস্না বেগম আফসোস করে বললেন, ‘দেখো তো হেঁচকির যন্ত্রণায় ছেলেটা খেতেই পারলো না।’
ইতি সুর মিলিয়ে বললো,
– ‘মা একটা প্লেটে করে উনার রুমে ভাত ঢেকে রেখে আসবো। রাতে উঠে ক্ষিধে লাগলে খেতে পারবে।’
– ‘হ্যাঁ ভালো কথা বলেছিস। তুই খেয়ে রেখে আয় তো।’
ইতি খাওয়া শেষে সত্যি সত্যি প্লেটে করে কল্পের জন্য খাবার নিয়ে চলে গেল। কল্প বিছানায় শুয়ে-শুয়ে হেঁচকি তুলছে। টেবিলে প্লেট রেখে ইতি মেঝেতে হাঁটু ভাজ করে বসে কল্পের চুলে আঙুল ডোবায়। চোখ বুঝে আসে ভালো লাগায়। কিন্তু কল্পের গলার সুর রুক্ষ, বেরসিক। সে হেঁচকি তুলে বললো,
– ‘এগুলো কিরকম ফাজলামো হচ্ছে ইতি?’
ইতির গলায় তবুও মমতা মাখা। গাঢ় মমতা নিয়ে ঠোঁট কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে,
– ‘আপনাকে এত ভালো লাগে কেন বলুন তো জনাব?’
কল্প বিস্মিত হয়ে আধশোয়া হয়ে বসে তাকিয়ে রইল। ইতি বিছানায় কনুই ঠেকিয়ে হাতের তালুতে থুতনি রেখে বললো,
– ‘টেবিলে খাবার ঢাকা আছে ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিয়েন।’
কল্প উঠে আসন পেতে বসে রূঢ় গলায় বললো,
– ‘তুমি কি করছো এসব? এগুলোর মানে কি? কেউ দেখলে কি হতো জানো?’
ইতি উঠে বারান্দায় সতর্কভাবে দেখে এসে পাশে বসে বললো,
– ‘মাথা খারাপ হয়ে আছে, এতকিছু ভেবে কি কাজ করছি না-কি?’
– ‘মাথা খারাপ মানে?’
– ‘এত কথা বলবেন না তো। হেঁচকি মনে হয় কমে গেছে। বসুন আরাম করে, আমি খাবার খাইয়ে দেই হাত দিয়ে?’
কথাটা শুনেই কল্পের আবার হেঁচকি উঠে গেল, ‘কি বলছো তুমি এসব!’
ইতি ওর গালে পরম মমতায় হাত ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
– ‘ইশ খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে কি ভীষণ মায়াবী লাগছে আপনাকে। আর মুখ শেভ করবেন না তো।’
কল্পের হেঁচকি আরও বেড়ে গেল। ইতি হাসতে হাসতে গ্লাসে পানি ঢেলে এনে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘পানি খান।’
কল্প পানি খেয়ে বললো, ‘তোমার কি আজ মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুমি এগুলো কি বলছো?’
ইতি আবার উঠে গিয়ে সতর্কভাবে বারান্দা দেখে এসে বললো ‘আজ আমার আসলেই মাথা খারাপ। আপনি বাঁচতে হলে একবার আমাকে বাহুডোরে বেঁধে জড়িয়ে ধরুন।’
কল্প বিস্মিত হয়ে বিছানা থেকে নেমে ওর হাত ধরে টেনে বললো,
– ‘তুমি এখনই আমার রুম থেকে বের হয়ে যাও। হঠাৎ কেউ এসে এসব শুনলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
ইতি আলগোছে কল্পের বুকের সঙ্গে মিশে গেল৷ দম আঁটকে গেল কল্পের। ইতি শক্ত করে ধরলো তাকে। দুজনের শরীরই যেন কাঁপতে শুরু করেছে। ইতি ঘোর লাগা গলায় বলে,
– ‘সর্বনাশ আর নতুন করে কি হবে বলুন, আপনি তো আমার সর্বনাশ অনেক আগেই করে ফেলেছেন।’
কল্প বিস্মিত হয়ে তাকে ঠেলে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
– ‘করছো কি তুমি! কেউ দেখে ফেললে কি হতে পারে তোমার কোনো ধারণা নাই।’
ইতি চম্বুকের মতো মিশে আছে। বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে উষ্ণ শ্বাস ফেলে ঘোরলাগা গলায় বললো, ‘ইশ ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। আপনার বুকে দুনিয়ার সকল শান্তি নিয়ে বসে আছেন।’
কল্প কাতর গলায় বলে,
– ‘প্লিজ ইতি, ছাড়ো আমাকে। তোমার মাথা ঠিক নাই। দু’জনই বিপদে পড়বো আজ।’
ইতি ছেড়ে দিয়ে দুইহাতে কল্পের মুখ ধরে বললো,
– ‘ইশ এত কাতর হয়ে বলেন কেন? এভাবে বললে কি না ছেড়ে পারি? আচ্ছা আপনি কি জানেন? আপনাকে যে আমি অন্য চোখে দেখি?’
কল্প ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে বললো,
– ‘তুমি আজ যা করেছো তোমাদের বাড়িতে আর থাকতে পারি না আমি। কয়েকদিনের ভেতরেই আমার চলে যেতে হবে।’
ইতি ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভয় পেল। কল্প যদি সত্যিই চলে যায়? তারপর সঙ্গে সঙ্গে সুলতানার একটা খেলার কথা মনে পড়ে গেল। চেহারা বদলে নিয়ে মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেঁসে উঠে বললো,
– ‘আপনি ভয় পাইছেন তাই না? এইযে আমি কান ধরেছি। প্লিজ রাগ করবেন না। এটা একটা খেলা ছিল।’
কল্প ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রূঢ় গলায় বললো,
– ‘খেলা মানে?’
– ‘ ডেয়ার ট্রুথ খেলা। সুলতানা দিয়েছিল এই ডেয়ার। একটা সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আবোল-তাবোল কিছু কথা বলতে হবে। অবশ্য পূরণ না করে মিথ্যে বলতে পারতাম। কিন্তু সে কসম করিয়ে দিয়েছে যাতে সত্য বলি।’
– ‘থা’প্পড় দিয়ে তোমাদের দাঁত ফেলে দেওয়া উচিত। এটা কেমন খেলা? আর একজন ডেয়ার দিলেই পূরণ করার জন্য ফরজ হয়ে যায় না। ফালতু কোথাকার। আর এটা ডেয়ার হলে রান্নাঘরের ওইগুলো কি ছিল?’
– ‘স্যরি বললাম তো।’
– ‘শোনো ইতি, ছেলেরা মেয়েদের মতো নিজেকে সামলাতে পারে না। তোমাদের পিছু পিছু ঘুরলেও কিচ্ছু হয় না। কিন্তু একটা ছেলের সঙ্গে এরকম করলে নিজেকে সামলে রাখা তারজন্য একটা যুদ্ধের মতো হয়ে দাঁড়ায়। তুমি যথেষ্ট সুন্দরী একটা মেয়ে। এইযে কাজগুলো করেছো। আমি যদি হঠাৎ আবেগের বশে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে দরজা বন্ধ করে দিতাম? তখন কি হতো?’
ইতি মাথা নুইয়ে থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বললো,
– ‘তা করবেন না জানি। কারণ আপনি তো আমাকে অন্য চোখে দেখেন।’
কল্প কোমরে হাত দিয়ে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বলে,
– ‘প্লিজ তুমি যাও, চলে যাও বলছি।’
– ‘কেন? না গেলে কি দরজা বন্ধ করে ফেলবেন? কি করবেন বন্ধ করে?’
কল্প হেঁসে ফেললো। তারপর হাত ধরে টেনে বারান্দায় বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ইতির পুরো শরীরে ‘ওম ওম’ একটা ভাব৷ ভাবতেই পারছে না খানিক আগে কল্পকে জড়িয়ে ধরেছে সে৷ এখনও নাকে পুরুষালি মিষ্টি একটা ঘ্রাণ লেগে আছে। এখনও ওর গালের স্পর্শ দুইহাতে লেগে আছে। একটা মানুষ কতদিন গোসল না করে থাকতে পারে? এই স্পর্শগুলো সে কিভাবে গোসল করে জলের সঙ্গে ভাসিয়ে দেবে? চোখ এখনও বারবার ভালো লাগার আবেশে বন্ধ হয়ে আসছে ইতির। কবে যে পুরোপুরি নিজের করে পাবে মানুষটাকে। ইতি ধীরপায়ে রুমে এসে একটা বালিশ ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখবুজে শুয়ে রইল।
___চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম
মায়াডোর (১৪ পর্ব)
.
ইতি চলে যাওয়ার পর কল্প দরজা বন্ধ করে আরও এক গ্লাস পানি খায়। তার শ্বাস-প্রশ্বাস উষ্ণ, ঘন। চেয়ার টেনে কনুই টেবিলে ঠেকিয়ে বসে বসে দুই আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে থাকে। ভেবে পাচ্ছে না কি করবে সে। নিজেকে সামলে চলা যেন একটা সংগ্রামের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতে তার অনেক ধৈর্য, বয়সের তুলনায় যথেষ্ট পরিমিতিবোধও আছে৷ নিজের এই গুণগুলো সম্পর্কে সে এতদিন অবগত ছিল। তাই একটা সময় তার প্রতি ইতির ব্যাকুলতা টের পেলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইতিকে পড়িয়ে গেছে। ভেবেছিল ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্কের ভারসাম্য সে অবশ্যই রক্ষা করতে পারবে৷ কিন্তু দিন যত যাচ্ছে যেন ক্রমশই নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে৷ এমনটা হবার কথা নয়। জন্মের পর থেকে সে অসম্ভব দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে। সামান্য হাওয়ায় নড়ে যাওয়ার মতো মানুষ সে নয়। কিন্তু মেয়েটা তার মনের এইসব শক্তির অহম ভেঙে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। শুরু থেকেই মোটামুটি প্রস্তুত ছিল কোনোভাবেই এই মেয়ের সঙ্গে প্রেমে জড়াবে না৷ একটা পরিবার কতটুকু বিশ্বাস করে যুবক ছেলেকে বাড়িতে থাকতে দেয় সে জানে৷ এই বিশ্বাস সে ভাঙতে চায় না। সম্পর্কে জড়ালে তো একদিন সবাই জানবে, তখন মামার কাছেই বা কি জবাব দেবে সে? এই বাড়ির লোকগুলো কি মনে করবে? বিশ্বাস করে থাকতে দিয়েছে, পরিবারের একজন সদস্যের মতো দেখেছে। এই অবস্থায় তাদের মেয়ের সঙ্গেই প্রেম? এ হতেই পারে না। এরকম একটা প্রস্তুতি তার ছিল। কিন্তু ইতি মেয়েটা এমন যে তাকে উপেক্ষা করা যায় না৷ আজকাল তাকে দেখলেই ভেতর তোলপাড় করে। ইচ্ছে করে নিজের গড়া সকল প্রস্তুতি নিজেই ভেঙে-ছুড়ে খানখান করে ফেলতে। যখন জড়িয়ে ধরলো ইতি। পৃথিবী যেন থমকে গিয়েছিল। পৃথিবীর নিয়ম-নীতি, দ্বিধা, শঙ্কা সকল কিছু তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। এই বিশ্বচরাচরে যেন ইতির এই জড়িয়ে ধরা থেকে সুন্দর আর কোনকিছুই নেই৷ ওকে বুকে টেনে নেওয়া থেকে তার জীবনেরও যেন দ্বিতীয় কোনো লক্ষ্য নেই। আদুরে বিড়াল ছানার মতো বুকটায় যখন মিশে গেল ইতি। পুরো শরীর যেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। রক্ত টগবগ করতে শুরু করলো। অনূভুতিগুলো ইতির পক্ষে আন্দোলন শুরু করলো। বারবার চোখবুজে এসেছিল অন্যরকম এক ভালো লাগায়। ইতির শরীরের থেকে এক অদ্ভুত বুনো ঘ্রাণ নাক দিয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে পৃথিবীর, সমাজের, শিক্ষা-দীক্ষার যে সকল প্রভাব ছিল। সবকিছু খসে পড়ে যায় নিমিষেই৷ সে যেন কেবলই একজন মানুষ। বুনো আদিম মানুষ। যাদের ওপর এই উন্নত পৃথিবীর কোনো প্রভাব পড়েনি। তার হাতটা অবশ হয়ে এসেছিল। কিভাবে এই মেয়েটিকে জোর করে ছাড়াতে পারে সে? এই সাধ্য তার ছিল না। ইতি তখন বুকে নাক ঘষছে। তার ঘাড়ের পেছনের চুলগুলোতে আঙুল চালাচ্ছে। কল্প অসহায় হয়ে পড়ে। নিজের কাছে নিজে পরাজিত হয়ে যায়৷ কাতর হয়ে ইতিকে ছাড়তে বলা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই৷ ইতি যেন দয়া করে ছেড়ে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে৷ না হলে ইতির ভালোবাসার উত্তাপে সে আজ মোমের মতো গলে যেত। কিন্তু কতদিন এভাবে নিজেকে সামলে রাখবে? ইতির প্রণয়ের আহবান কতদিন সে উপেক্ষা করতে পারবে? ওর খিলখিল করে হাসিই যেন একটা মৌলিক সংগীত। হাঁটা-চলা সবকিছুতেই কবিতার ছন্দ। এইসব ছন্দে সে যখন-তখন মুগ্ধ হয়ে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। আত্মবিশ্বাস এখন শূন্যের ঘরে চলে এসেছে। এই অসম্ভব রূপবতী, মায়াবতী মেয়েটিকে তার উপেক্ষা করার সাধ্য আর সত্যিই নেই। আজ ছাদে যখন গেল সে। গিয়েই মনে হয়েছিল এই ছাদটা পৃথিবীর অদ্ভুত এক মায়ার জগত। একটা গানের সুর আসছে। আকাশে ফুটফুটে একটা চাঁদ। তার কোমল আলোয় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। অপূর্ব এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছে ইতি নামক অলিক কিশোরী। যাকে দেখে মানুষ বলে ভ্রম হলেও, সে আসলে এই অপূর্ব সুন্দর রাতেরই যেন একটা অংশ। এক পা ভাজ করে আরেক পায়ের হাঁটুতে দুইহাত রেখে বসে আছে যেন এক অপ্সরা। চুলগুলো পিঠে ছড়ানো। ছিপছিপে হাতটি দেখতে মোমের মতো ফরসা, মসৃণ, কোমল। কল্পের ভেতরের প্রেমিক সত্তা বিদ্রোহ করে উঠে। মন্ত্র-মুগ্ধের মতো পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। পদশব্দে গান বন্ধ হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই এক সময় কবিতার মতো খুবই গহিন থেকে ইতির প্রতি প্রশংসা ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে পড়ে তার। শেষদিকে অবশ্য কোনোভাবে সামলে নিয়ে চলে আসে সে। কিন্তু এভাবে কতদিন? এই সংগ্রামে, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় সে হারবে। নিশ্চিত হারবে। ইতি একটুও বুঝতে চায় না কেন? এই প্রেম হবে না। সে প্রেমে পড়তে চায় না। প্রেম কেন তার ওপর এসে এমন বাজেভাবে পড়ে যাচ্ছে? যদি সে এই সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, এরপর কি হবে? বিষয়গুলো ভেবে তার গা শিউরে উঠে। মামা-মামী কি বলবেন? এই পরিবার কি বলবে? বিছানায় গিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে কল্প। চোখ থেকে সরানোই যাচ্ছে না ইতির মিষ্টি মুখটা। গালের ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটা তিল। পাতলা গোলাপি দুটো ঠোঁট। ভাসা ভাসা চোখগুলো থেকে চঞ্চলতা উপচে পড়ছে৷ ভাবতে ভাবতে এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় কল্প।
ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে সে। একটা খুবই বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছে ইতিকে নিয়ে। নিজের কাছেই নিজের ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। এমন বাজে স্বপ্ন কিভাবে দেখতে পারলো! ইতিকে নিয়ে এমন বিশ্রী ভাবনা তো সে কখনও ভাবেনি। মিষ্টি একটা ছোট্ট মেয়ে। তার কাছে পড়েও। হয়তো তারও ভালো লাগে, ইচ্ছা করে খুব করে ভালোবাসতে, আদর করতে। তাই বলে এমন স্বপ্ন? কল্প খানিকক্ষণ দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছে৷ গোসল করতে হবে। এরকম অঘটনের পর সে সঙ্গে সঙ্গে গোসল না করে থাকতে পারে না৷ সারাক্ষণ নিজেকে কেমন অপবিত্র, নোংরা মনে হয়। কেউ হয়তো এখনও জাগেনি। আলগোছে বাথরুমে গিয়ে গোসল করে নিতে হবে৷ তারপর চুপিচুপি ছাদে গিয়ে থ্রি-কোয়ার্টার শুকোতে দিয়ে আসবে। এতকিছু কেউ খেয়ালই করবে না।
ইতি রাতে কল্পের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায়। ফজরের আজানের সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুমই এলো না৷ এপাশ-ওপাশ করে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে। বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে সে। আলগোছে নীলার মোবাইল নিয়ে ছাদে চলে যায়। মাদুরিতে বসে কল দেয় তানিয়ার ফোনে। সে নানাবাড়ি থাকতে দেখেছে রাতে মামীর ফোন ওর কাছেই থাকে। কয়েকবার রিং হতেই ঘুম ঘুম গলায় তানিয়া বললো,
– ‘হ্যালো।’
– ‘কিরে কি করছিস?’
– ‘মেজাজটা খারাপ করবি না ইতি।’
– ‘ওমা আমি আবার কি করলাম।’
– ‘কল রিসিভ করেছি জরুরি কিছু ভেবে। মনে হইছিল কেউ মারা-টারা গেছে। আর তুই এই ভোরবেলা কল দিয়েছিস ‘কি করছি’ জানতে।’
– ‘জরুরি কিছু কথা আছে৷ তাইতো কল দিয়েছি।’
– ‘তাড়াতাড়ি বল কি জরুরি কথা।’
– ‘কল্পের সঙ্গে কাল কি হয়েছে জানিস?’
– ‘হ্যাঁ জানি, আমি তোদের বাড়ির সিসি ক্যামেরা। বইন এগুলো জরুরি কোনো ঘটনা না যে তুই পাঁচটায় কল দিয়ে বলতেই হবে। ফোন রাখ।’
তখনই ছাদে কল্পকে দেখে চমকে গেল ইতি। কল্পের পরনে লুঙ্গি, গায়ে কালো সেন্টু গেঞ্জি। ছাদের দরজা খোলা দেখে কল্প ভেবেছিল রাতে ভুলে লাগানো হয়নি। ইতি কল কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
– ‘ভোরবেলা গোসল করলেন না-কি?’
কল্প ‘হ্যাঁ’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। ইতি নাছোরবান্দা হয়ে পিছু পিছু গিয়ে বললো, ‘কেন?’
কল্প প্যান্ট ঝেড়ে মেলে দিয়ে বললো,
– ‘তুমি এই সময়ে ছাদে কি করো?’
– ‘প্রেমিকের সঙ্গে গোপনে ফোনে কথা বলছিলাম।’
– ‘ডিস্টার্ব দিলাম এসে যাও কথা বলো। আমি চলে যাচ্ছি।’
– ‘কিন্তু আপনি সকালে গোসল করলেন কেন? আমি না পিচ্চি আর আপনি অনেক বড়ো। তাহলে পিচ্চিদের মতো বিছানায়…।’
কল্প ওর মুখটা চেপে ধরলো৷ ইতির চোখ পিটপিট করছে৷ ছাদের কার্নিশে দুইহাতে চেপে ধরে আছে৷ কল্প চারদিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘এত কথা বলো কেন? তুমি পিচ্চি বলেই তো জানো না হিসু ছাড়াও ছেলেদের সকালে গোসল করার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। এসব নিয়ে কোনো আলাপই হবে না। কাউকে বলবেও না। আমি প্যান্ট চিলেকোঠার একপাশের কার্নিশে মেলে দিচ্ছি কেউ দেখবে না।’
কথাগুলো বলেই কল্প ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ইতি ফিক করে হেঁসে বলে,
– ‘এহ খুব ভয় পাইছি৷ ছাড়লেন কেন ভালোই তো লেগেছিল।’
কল্প এগিয়ে এসে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে মাথায় গাট্টা মে’রে চলে গেল।
ইতি গিয়ে আবার মাদুরে বসে। গোসলের ব্যাপারটা কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না। ক্লাসও নেই যে গিয়ে বান্ধবী কাউকে জিজ্ঞেস করবে। মালিহা আপুকে কল দিতে হবে। কিন্তু এখন ভালো লাগছে না। নিচে নেমে এলো সে। দাদাভাই সুর দিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। নীলা এখনও ঘুমোচ্ছে। ইতি মোবাইল রেখে বিছানায় শুয়ে খানিকক্ষণ যেতেই কল্পের দরজার সামনে শুনলো দাদাভাইয়ের ডাক। ইতি কৌতূহলী হয়ে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় যায়। ফরিদ সাহেব সু-জুতা পরে কল্পের দরজার সামনে। কল্প ও খানিক পর বের হলো। ওর পায়ে কেডস, পরনে কালো ট্রাউজার আর হাফহাতা গেঞ্জি। ইতি এগিয়ে গিয়ে বললো,
– ‘দাদাভাই তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’
– ‘তুই তো বাড়িতে ছিলি না। আমরা নানা-নাতি তিন-চার দিন থেকে ভোরে হাঁটতে বের হই। বুঝলি ভোরে হাঁটলে শরীর ভালো থাকে। তুই যাবি না-কি?’
ইতির আগেই কল্প ব্যস্ত হয়ে বললো,
– ‘না না, ইতি দরকার নেই যাওয়ার।’
– ‘আশ্চর্য আমি গেলে আপনার অসুবিধা কি? আমি অবশ্যই যাব।’
ফরিদ সাহেব কল্পের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘নিবে না-কি?’
– ‘ও তো উঠানেই হাঁটাহাঁটি করতে পারবে। ছাদও আছে। মাইয়া মানুষ এতদূর গিয়ে কি করবে।’
ইতি প্রতিবাদ করে বললো,
– ‘তাহলে আপনারা উঠান আর ছাদ রেখে বাইরে যাচ্ছেন কেন?’
– ‘আমরা মাইয়া না-কি!’
– ‘মাইয়া মানুষের কি শরীর শুধু তুলতুলে থাকতে হবে? আমাদের কি রোগ-বালাই হতে পারে না? হাঁটা-চলা ব্যায়াম সবারই দরকার।’
কল্প বিরক্ত হয়ে বললো,
– ‘নানা হাঁটেন তো। ও এখনও পিচ্চি ওর আবার জগিং কি? রাস্তায় গিয়েই দুষ্টামি শুরু করবে।’
ফরিদ সাহেব মাথা নেড়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ইতির রাগে শরীর জ্বলছে। পিছু থেকে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে আছে কল্পের দিকে। তারা উঠান পেরিয়ে চলে গেছেন। ইতি হঠাৎ মনে পড়েছে এরকম ভাব করে ডাক দিল, ‘কল্প ভাইয়া এদিকে শুনে যান, আমার জন্য একটা জিনিস আনতে হবে।’
ফরিদ সাহেব গেইট খুলে বাইরে গেলেন। কল্প বিরক্ত মনে ফিরে এলো। কাছাকাছি আসতেই ইতি ফিসফিস করে বললো, ‘কাল সন্ধ্যায় কি টের পান নাই আমি পিচ্চি না এতদিনে নারী হয়ে উঠেছি? আমি এখন শরীরে-মননে, অনুভূতিতে টইটম্বুর এক যুবতী মেয়ে, এটা মাথায় ঢুকিয়ে নেন।”
কল্প কোমরে হাত দিয়ে তাকিয়ে থেকে বললো,
‘এই কথা বলার জন্য ডেকেছো?’ তারপর বিরক্তিতে ‘ধুর’ বলে আবার চলে গেল সে। ইতি পিছু থেকে তাকিয়ে হাসছে। মানুষটাকে পানির সঙ্গে গুলে খেয়ে ফেলতে পারলে ভালো হতো৷ অসহ্য রকমের ভালো লাগে। খানিক পর ধীরে ধীরে কল্পের রুমের দিকে গেল সে। আলনার এলোমেলো একেকটা কাপড় ভাজ করে রাখার আগে চোখবুজে বুক জড়িয়ে ধররে, চুমু খায়, গালে চেপে ধরে থাকে। সবকিছুতে কি এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় ইতির। এই রুমটাই অন্য রকম এক ভালো লাগার। এই চার দেয়ালের ভেতরের সবকিছু আপন, ভীষণ প্রিয়। বিছানার দিকে তাকায় গিয়ে। এলোমেলো বিছানা টেনে ঠিক না করে শুয়ে যায়। বালিশে নাক টেনে এনে ঠোঁট নাক ডুবিয়ে দেয়। গায়ের লোম নড়েচড়ে উঠে। হৃৎস্পন্দন ক্রমশই বাড়ছে। এই বালিশে কল্প মাথা পেতে ঘুমায়? কি বিস্ময়কর ব্যাপার। বালিশটা তার হাতের কাছে। ইতি বালিশ বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিনিট খানেক চোখবুজে থাকে৷ ইশ কল্প যদি কোনোভাবে তার হয়ে যেত। একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ। কবে হবে? আদৌও কি হবে? মানুষটা কেন এখনও ভালোবেসে বুকে টেনে নিচ্ছে না? হঠাৎ করে ইতির ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল৷ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কেন যেন মনে হয় কল্প তাকে পছন্দ করে না, করবেও না৷ মানুষটা মেয়েদের প্রতি উদাসীন কি-না কে জানে। পড়ালেখা ছাড়া হয়তো আর কিছুই বুঝে না সে। না-কি গোপন কোনো প্রণয়িনী আছে? ইতির আরও মন খারাপ হয়ে গেল। কাউকে সে ওর পাশে সহ্য করতে পারবে না৷ ভেজা চোখে বালিশে চুমু খেয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল। তারপর চাদর টেনে-টুনে ঠিক করে চলে যায় রান্নাঘরে। আজ সে নিজেই নাশতা বানাবে। কল্প এ বাড়িতে থাকে, অথচ তার রান্না খাবে না? তা কি করে হয়। ছুটির দিনগুলোতে সে ধীরে ধীরে সবকিছু রান্না শিখে ফেলবে।
__চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম