মায়াডোর-২১,২২
(২১ পর্ব)
.
রিকশাওয়ালা বিভ্রান্ত হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। কল্পের চোখ জলে ঝাপসা। তবুও আকাশ দেখার চেষ্টা করছে সে। নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ। শিমুল তুলোর মতো টুকরো টুকরো শুভ্র মেঘ চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। রিকশাচালক ইতি-উতি করে সিটে উঠে বসে। নিতম্ব দুলিয়ে প্যাডেল দিতে থাকে। কিছুদূর যেয়ে বলে, ‘ভাইসাহেব এইদিকে যাই?’
কল্প মাথা নাড়ে। রিকশাচালক পুনরায় প্যাডল চাপে। ইতির জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মেয়েটা ভালো নেই। আর সে? সে কি ভালো আছে? তার ওইসব যুক্তি, ধৈর্য, নিজেকে সামলে চলার বুকভরা গর্ব সবই যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কোনোকিছুই আর মাথায় আসছে না৷ সবকিছু এখন তার বিরুদ্ধাচারণ শুরু করেছে। ইতিকে স্বাগত জানাচ্ছে। তারও ভালো লাগে ওকে। মেয়েটার এই বেপরোয়া ভালোবাসায় কোনো ক্লেদ নেই সে জানে৷ তবুও ওর ভালোবাসা উপেক্ষা করে সে আরেকজনকে গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এটা কি ঠিক হচ্ছে? সে নিজেও তো ভালোবাসে ইতিকে। নিজের সঙ্গেই কি সে জোর-জবরদস্তি করছে? আসলে তার এখন কি করা উচিত?
রিকশাচালক আরও খানিকটা দূরে এসে বললো, ‘ভাই সাহেব এইদিকে যাই?’
সে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। পুনরায় প্যাডেল চাপে রিকশাচালক। কল্প ডুবে থাকে ইতির ভাবনায়। আরও মিনিট তিরিশেক পর একটা মানসিক ডাক্তারের চেম্বারের সামনে এসে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে রিকশাওয়ালা বলে, ‘ভাই সাহেব দুইদিন আগে এক যাত্রী আমারে নিয়া এই ডাক্তারের কাছে আইছিল। আপনি কি যাইবেন?’
কল্প আনমনে ‘হ্যাঁ’ বলতে যেয়েই আবার থেমে গেল। রিকশাচালকের রসিকতা টের পেয়ে রাগ না করে হেঁসে ফেললো সে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আপনি কি বিরক্ত?’
– ‘না হয়ে উপায় আছে ভাই আপনিই কন। ভোরে রিকশা নিয়া আইসাই আপনার পাল্লায় পড়লাম। কোথায় যাইবেন না যাইবেন কিছুই কইতেছেন না। হুদাই ঘুরাইতেছেন। এগুলো কি ভালো লাগে?’
কল্প হেলান দিয়ে বসে বললো, ‘হ্যাঁ বুঝতে পারছি কাজটা ঠিক হয়নি। চলুন একটা রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাক। দুজনে নাশতা করি।’
রিকশাচালক পুনরায় উঠে। দু’জন একটা রেস্তোরাঁয় যায়। টেবিলে নাশতা আসে। রিকশাচালক রুটি ছিঁড়ে ডালভাজি মিশিয়ে আয়েশ করে মুখে দিয়ে বললো, ‘ভাইসাহেব দেশের হাল-অবস্থা বুঝতাছেন কিছু? সবকিছুর দাম বাইড়া যাইতেছে। খরচাপাতির বাজারে আগুন।’
কল্প মাথা নাড়ে কেবল। লোকটি আরেক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে বলে, ‘তয় ভাইজান এইবার মনেহয় নব্বই এর গ*ণঅ*ভ্যুত্থান হইয়া যাইব। বিরোধীদল দেখতেছেন কিরকম চ্যাতছে।’
কল্প বিস্মিত হয়ে লোকটির মুখের দিকে তাকায়।
– ‘আপনি রিকশা চালিয়েও এত খবর রাখেন?’
– ‘আগ্রহ ভাইসাহেব, রাজনৈতিক আলাপ-সালাপ বড়োই ভালো লাগে। যেখানে আলাপ পাই, বইসা বইসা শুনি।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘আপনের অসুবিধা কি ভাইসাহেব। মনে তো হয় কোনো কিছু নিয়া বিরাট চিন্তায় আছেন।’
কল্প লোকটির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে।
– ‘আপনি জেনেই বা কি করবেন?’
– ‘কিছুই না ভাইসাহেব৷ ইচ্ছা হইলে বলবেন। না হইলে নাই। স্বাধীন বাংলাদেশ।’
কল্পের লোকটিকে ভালো লাগছে। মনখোলা নিশ্চিন্ত মানুষ৷ সে এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে বললো, ‘ভয়ের কারণে খুবই পছন্দের কিছু ত্যাগ করতে চলেছি৷ এটা নিয়েই চিন্তিত।’
রিকশাচালক কিছুই বুঝতে পারে না। তবুও চিন্তিত হয়ে যায়। গ্লাসে পানি ঢেলে দুই চুমুক দিয়ে বলে, ‘ভাইসাহেব ভয়ে পছন্দের কিছু ত্যাগ করতাছেন মানে কি? দুনিয়াটা কাঁপা-কাঁপির জায়গা না ভাইসাহেব৷ দুনিয়া হইল গিয়া দাপা-দাপির জায়গা। কোনোকিছুতে ভয় পাইয়েন না।’
কল্প কিছু বলার আগেই পকেটে মোবাইলটা চিৎকার শুরু করে। বের করে দেখে মামা কল দিয়েছেন। সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ক্রোধান্বিত গলায় বললেন, ‘এই বেকুবের বাচ্চা? তুই শুরু করেছিসটা কি, হ্যাঁ? তুই এখন কোথায়? তোর চাচা আমার কাছে কল দিয়েছে। হোটেলের নাশতার কার্ড তোর কাছে। টাইমের ভেতরে তারা না-কি নাশতা দেয়। এরপর বন্ধ। তুই সেই কার্ড নিয়ে ভোরে উধাও হয়ে গেলি তাদের কিছু না বলে, তুই শুরু করেছিসটা কি?’
– ‘ও হ্যাঁ, আমার মনে ছিল না মামা। আমি এখনই যাচ্ছি।’
– ‘তোর মন কোথায় থাকে? আরও অনেক অভিযোগ তোর নামে আছে। তুই না-কি সারাক্ষণ ধ্যান ধরে থাকিস৷ কারও সঙ্গে কোনো কথা বলিস না। একা একা বসে সারাক্ষণ কিসব ভাবিস। কি শুনি এগুলো?’
কল্প এই প্রথম জীবনে একটা উল্লেখযোগ্য কাজ করলো। ভালো লাগেনি তাই মামার কল কেটে দিল। এরকম কাজ সে কখনও করে না। কোনোদিন রে’গে গিয়ে কোনোকিছু ছুড়ে মা’রেনি৷ ভে’ঙে ফেলেনি। রে’গে গিয়ে কোথাও ঘু’সি মা’রেনি। না খেয়ে থাকেনি। ক্লাসে দেরিতে যায়নি। বাড়ির কাজ না করে গিয়ে স্যারের মা’র খায়নি। তার জীবনে অনিয়ম, অঘটন বলতে তেমন কিছুই যেন নেই। কল্প চেয়ার থেকে উঠে বললো, ‘একটু তাড়াতাড়ি শেষ করেন নাশতা, যেতে হবে আমার।’
কল্প উঠে গিয়ে নাশতার বিল দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। মাথায় একটা কথা কেমন বারবার খেলে যাচ্ছে। ‘দুনিয়াটা কাঁপা-কাঁপির জায়গা না, দাপা-দাপির জায়গা’ কথাটা কতটুকু যৌক্তিক? কল্প বুঝতে পারছে না। তবুও যেন তার উপর কেমন প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। রিকশাচালক খানিক পর এলো। সে উঠে বসে সিটে৷ হোটেলের নাম বলে লোকটিকে৷ রিকশা পুনরায় চলছে। তখনই আবার মোবাইল বেজে উঠে। পকেট থেকে বের করে দেখে মায়ের কল। এই নাম্বার থেকে কল এলে তার ভেতরে যেন একফালি শীতল হাওয়া বয়ে যায়। রিসিভ করে সালাম করে সে। তিনি ওপাশ থেকে বলেন,
– ‘কল্প তুমি এখন কোথায়?’
– ‘বাইরে আছি।’
– ‘তোমার মামা কল দিয়েছিলেন। তুমি না-কি কল কেটে দিয়েছো?’
– ‘না তো, আমি তো ভেবেছিলাম উনি কেটে দিছে।’
– ‘ও তাই না-কি, কিন্তু সে অনেক রেগে আছে। তোমার চাচা না-কি তাকে কল দিয়েছিল। তুমি কেমন অস্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছো। সে তো নিজেই স্ত্রী-সন্তানদের কাছে তোমার অনেক প্রশংসা করেছিল বাবা। তাইতো সবাই রাজি হয়েছে। এখন তোমার চাচার মুখ ছোটো করো না।’
– ‘আচ্ছা মা।’
– ‘ওদের সঙ্গে হাসি-খুশি হয়ে কথা বলবে, মিশবে। ওরা তো সব সময় আনন্দ-ফূর্তিই পছন্দ করে।’
– ‘হ্যাঁ মা বুঝেছি।’
– ‘নিপার সঙ্গে কথা হয় তোমার?’
– ‘না মা।’
– ‘সে কি বাবা? সিলেট তো তুমি নিজেই থাকো। তোমার ভার্সিটিও আছে। তাকে নিয়ে বের হও। আড্ডা দাও। একজন আরেকজনকে এভাবে বুঝতে হবে তো।’
– ‘আচ্ছা মা।’
– ‘শুধু ‘আচ্ছা আচ্ছা’ করো না। তোমার চাচা রেগে আছেন। তাই তোমাকে কল দেননি।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘এখন তাড়াতাড়ি যাও, ওরা অপেক্ষা করছে।’
– ‘হ্যাঁ যাচ্ছি।’
কল রেখে দিলেন তিনি। কল্প হোটেলে ফিরে এলো প্রায় এগারোটার দিকে। তার চাচা প্রচণ্ড রেগে আছেন৷ কিন্তু কিছুই বলছেন না তাকে। সে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল। খানিক পর চাচি এসে দরজায় নক করলেন। সে খুলে দিল। তিনি স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘কোথাও গিয়েছিলে না-কি?’
– ‘হ্যাঁ চাচি, আমার লজিং বাড়িতে গিয়েছিলাম।’
– ‘ও আচ্ছা। নাশতা করেছো?’
– ‘জ্বি করেছি। আপনারা করেছেন তো?’
– ‘হ্যাঁ বাইরে গিয়ে করে এলাম।’
– ‘ও আচ্ছা।’
উনি চলে গেলেন। কল্প এসি ছেড়ে শুয়ে রইল দীর্ঘ সময়। তারপর মনে হলো ইতিকে কিছু বলা দরকার। কিন্তু কি বলবে সে? তবুও মোবাইল হাতে নিয়ে ইনবক্সে গেল। খানিক ভেবে মেসেজ দিল, ‘ইতি প্লিজ কোনো রকম পাগলামি করো না। তুমি কি সকালের নাশতা করেছো? নাশতা করো। সহজ-স্বাভাবিক হও। আর জ্বর ছাড়ছে না কেন? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি ওষুধও খাচ্ছ না।’
মেসেজ সিন হলো না। কল্প মোবাইল পাশে রেখে দুইহাত নিচে দিয়ে আবার শুয়ে রইল।
খানিক পর দরজায় পুনরায় কারও নক পায়। উঠে দরজা খুলে দেখে নিপা। সাদা গেঞ্জি পরে আছে। মাথা ডান পাশে সামান্য কাত। মিষ্টি হেঁসে বললো,
– ‘আসতে পারি?’
– ‘হ্যাঁ আসো।’
নিপা সোফায় বসলো। তারপর চারদিকে তাকিয়ে কপালের চুল সরিয়ে নিয়ে বললো, ‘চলো আজ আমরা দু’জন কোথাও ঘুরতে যাই।’
কল্প আমতা-আমতা করে বললো, ‘কোথায়?’
– ‘যেখানে নিয়ে যাবে তুমি। আমি তো চিনি না তেমন।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ কখন বের হবে?’
– ‘গোসল করে রেডি হয়ে যাও, এখনই বের হয়ে যাব।’
– ‘ও আচ্ছা।’
নিপা ডান পাশে মাথা সামান্য কাত রেখে মিষ্টি হেঁসে উঠে চলে গেল। কিছু কিছু মেয়েরা একপাশে মাথা খানিক কাত রাখে কেন কে জানে৷ কল্প উঠে বাথরুমে চলে গেল৷ নিপা আর সে প্রায় সম-বয়সী। ওইদিন তার মা বললেন তিন মাসের ছোট নিপা। তবুও মেয়েটিকে তার কাছে বড়োই মনে হয়।
ইতি বিছানায় উঠে বসে আছে। নীল কম্বল দিয়ে কোমর অবধি ডাকা। এখনও সে কিছুই খায়নি৷ হুস্না বেগম রাগারাগি করে চলে গেছেন। নীলা রান্নাঘরের সব কাজ শেষ করে এসে ইতির পাশে বসে। তারপর ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘ইতি সারাক্ষণ শুয়ে না থেকে উঠে বসো তো।’
ইতি উঠে বসে নীলার হাত মুঠোয় নেয়। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে, ‘ওই গানটা একটু গাও তো আন্টি ‘বরষার প্রথম দিনে’।’
– ‘ঢং করো না তো ইতি, এই ভর-দুপুরে কিসের গান? আমি খাবার এনে দিচ্ছি খাও আগে।’
– ‘খাব তুমি গানটা গাও।’
– ‘খাবে তো?’
– ‘হ্যাঁ।’
ইতি বিছানা থেকে রুমের জানালা দিয়ে জল ডুবুডুবু চোখে আমগাছের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলা ওর এক হাত কোলে নিয়ে গুনগুন করছে,
“বরষার প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে
আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়
সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়
কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয়..।
জীবনের সব ভুল যদি ফুল হয়ে যায়
জীবনের সব ভুল যদি ফুল হয়ে যায়
যদি কোনো দিন আসে জোছোনার আঁচলে ঢাকা মধুর সময়
তখন কাছে এসো, তাহাকে ভালোবেসো
সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়
কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয়
বরষার প্রথম দিনে…..।”
___চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম
মায়াডোর (২২ পর্ব)
.
কল্প সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে হোটেলে ফিরে আসে। শেষপর্যন্ত শুধু নিপা আর সে একা বাইরে যেতে পারেনি। নিহা ড্রিমল্যান্ড পার্কে যাওয়ার জন্য সবাইকে অস্থির করে ফেলেছে। সেটাই হলো। সবাই মিলে ড্রিমল্যান্ড গিয়ে ঘুরে এসেছেন। কল্প পুরোটা দিনই অন্যমনস্ক ছিল। সুযোগ পেলেই ইনবক্সে গিয়ে দেখেছে ইতি মেসেজ সিন করলো কি-না। একবার মনে হয় ওর ফোনে হয়তো মেগাবাইট নেই। আবার মনে পড়ে যায় মেসেঞ্জার তো ফ্রি। তাহলে কেন মেসেজ সিন করবে না? হোটেলে ফিরে এসে এখন ভাবছে কল দেবে। সবাই যার যার রুমে চলে গেছেন। সে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসেছে। মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিতে গিয়ে অবাক হয়ে যায়। ইতির নাম্বার তার কাছে নেই৷ কি আশ্চর্য! ওর নাম্বারটা অবধি তার কাছে থাকবে না? এই বিষয়টা কেন যেন তার বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধে গেল৷ মেয়েটাকে সে এত উপেক্ষা করে কেন? কত কষ্টই না পেয়েছে ইতি এতটা দিন। কিন্তু তখন সে এগুলো বুঝতে পারেনি কেন? না-কি সে এতদিন প্রেমে পড়েনি ইতির? ছেড়ে চলে যাবে মনে হতেই এই পরিবর্তন? কল্প কিছুই যেন বুঝতে পারে না৷ পুরো চিন্তার জগত এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন ভেবে পাচ্ছে না এত উপেক্ষা সে এতদিন কিভাবে করেছিল? নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগছে। এই মুহূর্তে ইতির সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু যোগাযোগ করবে কিভাবে? ইতি ঠিকঠাক মতো খাওয়া-দাওয়া করছে কি-না কে জানে। হঠাৎ মনে হলো নানাভাইয়ের নাম্বার তার কাছে আছে। কিন্তু উনার সঙ্গে কথা বলে বড়জোর ইতির কথা জিজ্ঞেস করা যাবে। ওর কাছে ফোন নিয়ে দিতে কিভাবে বলবে? কল্প জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রুমের বাতি বন্ধ করে দেয় সে। গ্লাস ভেদ করে চাঁদের নরম আলোয় আলোকিত হয়ে যায় কামরা। কল্পের কি যে হলো। সঙ্গে সঙ্গে আবার পর্দা টেনে দিল সে। কেন হোটেলে বসে আছে? এই শহরেই তো তার ইতি আছে৷ তারজন্যই তো অভিমান করে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে বসে আছে মেয়েটা৷ গেঞ্জিটা গায়ে দেয়৷ চুলে আঙুল চালায়। মানিব্যাগ পকেটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে হোটেল থেকে। বাইরে এসে রিকশায় উঠে মনে পড়ে কাউকে বলে আসা দরকার ছিল। চাচাকে কল দিয়ে জানায় বাইরে এসেছে। ফিরতে একটু দেরি হবে৷ উনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। ইতিদের বারান্দার গ্রিল ভেতর থেকে লাগানো। কলিংবেল চাপলো সে। খুলে দিলো এসে নীলা।
– ‘আরে কল্প এসেছো।’
– ‘হ্যাঁ, শহরেই তো আছি তাই ভাবলাম দেখে যাই।’
– ‘ভালো করেছো।’
ফরিদ সাহেব হাঁক ছেড়ে রুম থেকে বললেন, ‘কে এসেছে বউমা?’
– ‘কল্প এসেছে বাবা।’
তিনি রুম থেকে বের হয়ে বললেন, ‘আরে কল্প এসেছো, আসো আমার রুমে গল্প-টল্প করি।’
কল্প আমতা-আমতা করে বললো, ‘আসছি নানা, ইতিকে দেখে আসি।’
– ‘ওকে, ওকে যাওয়ার আগে আইসো।’
নীলার সঙ্গে কল্প ওর রুমে গেল। অন্ধকার ঘর। বাতি জ্বলতেই দেখা গেল ইতি গুটি-শুটি মে’রে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। বিছানায় বসে গিয়ে সে। হুস্না বেগম খানিক পর এসে বললেন, ‘কল্প দেখো তো বাবা ওর সঙ্গে কথা বলে। কেন এমন করছে। কিছুই তো বলে না। সবাই বলতেছে ভূ*তে ধরছে। আমার তো তাও মনে হয় না।’
কল্প মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা মামী আমি দেখছি।’
তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন। কল্প নীলাকে আমতা-আমতা করে বললো, ‘ওকে ডেকে তুলে নিয়ে আমি ছাদে যাই? আজ তো চাঁদনি রাত। আপনিও হাতের কাজ সেরে আসুন। ওর মন ভালো হবে।’
– ‘ইতি গেলে তো ঠিক আছে। আমিও ডেকেছি একটু আগে যায়নি।’
– ‘আচ্ছা আমি ট্রাই করি।’
কল্প ওর কপালে হাত রাখে। এখনও প্রচণ্ড গরম। সে আস্তে-আস্তে কয়েকবার ডাকে। চোখ মেলে অবাক হয়ে উঠে বসে বললো, ‘আপনি?’
কল্প মুচকি হেঁসে বললো, ‘হ্যাঁ আমি, তবে যেভাবে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে পড়ে আছো। আমার জায়গায় আজরাইলও আসতে পারেন।’
ইতি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। নীলা মাদুর এনে কল্পের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘যাও নিয়ে আমি আসছি একটু পর, ওকে বুঝাও, ভাত না খেলে, ওষুধ না খেলে জ্বর ছাড়বে কি করে? ভাইয়াও রাতে দোকান থেকে ফিরে গালাগাল করে খাওয়াতে পারেন না। একবেলা খেলে আরও দুইবেলা নাই। এভাবে কতদিন? কলেজ পড়ালেখা সব গোল্লায় যাচ্ছে।’
কল্প মাদুর হাতে নিয়ে বললো, ‘ইতি কম্বল এভাবে গায়ে জড়ানো থাকুক। চলো ছাদে।’
– ‘না আমি কোথাও যাব না।’
– ‘স্যারের কথা শুনে না। বেয়াদব ভূ*ত ধরছে তাহলে।’
ইতি তবুও অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। কল্প নীলাকে বললো, ‘আন্টি আপনি এক কাজ করুন। প্রথমে চা দিবেন। এরপর ওকে কোনো খাবার দিন ছাদে। আমি একেবারে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে যাব।’
– ‘আরে আগে ছাদে তো নিয়ে যাও। ওর যা ঘ্যা*ড়ত্যা*ড়া জানো না তো।’
– ‘আমারও ঘা*ড়ত্যা*ড়া আন্টি আপনি গিয়ে চা বানান। আমি দেখছি।’
নীলা চলে যায়। কল্প দরজার কাছ থেকে দেখে এসে ইতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বললো, ‘বাবা, আমার অভিমানী পাখিটার এত অভিমান?’
ইতি দুই হাটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে দিল। কল্প কপাল ধরে টেনে তুলে মাথা। দু’গাল বেয়ে পানি পড়ছে ইতির। কল্প তাড়াতাড়ি মুছে দিল হাত দিয়ে। তারপর আবার দরজার কাছে যায় কেউ আসছে কি-না দেখতে। ফিরে বিছানায় বসে ইতির মাথা বুকে টেনে এনে মাথায় চুমু খেয়ে বললো, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে ম্যাডাম, প্লিজ ছাদে আসো। অনেক কথা আছে।’
ইতি ভেজা গলায় বললো, ‘আর কি কথা বলার আছে আপনার।’
কল্প মুচকি হেঁসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো, ‘এখানে এত প্রশ্ন করো না৷ কে কখন দেখবে তার ঠিক আছে? ছাদে চলো।’
ইতি আস্তে-আস্তে বিছানা থেকে নামে। ছাদে চলে আসে তারা। মাদুর বিছিয়ে মুখোমুখি বসে দু’জন। চাঁদের আলোয় চারপাশে আবছা আলো-ছায়া। নীলা এলো খানিক পর। চা দিয়ে বললো, ‘ইতি মুগ ডাল আছে। জাউ বানিয়ে দেই?’
কল্প ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘শুধু মুগ ডাল দিয়েও আরেকটা জাউ খিচুড়ি আছে না-কি?’
নীলা হেঁসে বললো, ‘আরে না, চালও থাকবে।’
– ‘ও আচ্ছা৷ তাহলে ভালো। খাবে না ইতি?’
ইতি মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। চলে গেল নীলা। ইতি অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি বলবেন বলুন।’
কল্প দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে কপাল আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বললো, ‘আসলে এখনই বলার মতো কিছু নাই। তবে বুঝতে পারছি তোমাকে ছাড়া আমারও থাকা সম্ভব না।’
ইতি অবাক হয়ে সরাসরি কল্পের দিকে তাকায়। কল্প চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, ‘চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে খাও।’
ইতিও চা নিল। ক্ষীণ সময় দু’জন চুপচাপ থাকে৷ ইতি তারপর বলে, ‘তো এখন কি করতে চাচ্ছেন?’
– ‘এটাই তো বুঝতে পারছি না।’
– ‘তো আসছেন কেন? এটা এসে বলার মতো কি হলো?’
– ‘অস্থির হবে না তো ইতি। এখন আমি বুঝতে পারছি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে সিরিয়াস হতে হবে। আমিও থাকতে পারবো না৷ আর তোমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছি।’
– ‘তো এগুলো তো হওয়ারই ছিল। এটা নতুন করে বুঝার মতো তো কিছু নাই। আপনি কি এখন কষ্টকে উপভোগ করতে ছাদে নিয়ে এসেছেন? মানে ইতি আমরা দু’জন কষ্ট পাচ্ছি। চলো ছাদে একটু আড্ডা মা’রি। এরকম কিছু?’
– ‘তা না, এখন আপাতত কি করতে হবে এটা বলতে এসেছি। এখন তোমার খাওয়া-দাওয়া সবকিছু ঠিকঠাক মতো করতে হবে। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে কলেজে যাও। স্বাভাবিক হও।’
– ‘মানে কেন স্বাভাবিক হব?’
– ‘পাগল না-কি, স্বাভাবিক নেই কেন তুমি? আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি এই জন্য তো? এখন তো এসে বললামই আমারও কষ্ট হচ্ছে। কি করা যায় দেখি৷’
– ‘তাহলে কি তুমি ওই বিয়ে না করার কথা ভাবছো?’
– ‘হ্যাঁ, কিন্তু কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।’
– ‘বুঝতে পারবেন না কেন৷ ওই মেয়ে তো আপনার চাচাতো বোন। তাকে বুঝিয়ে বলুন। সেইই বিয়ে ভেঙে দিবে।’
– ‘যাইই করি করবো। আপাতত তুমি পাগলামি বন্ধ করো। সুস্থ-স্বাভাবিক হও।’
ইতি কল্পের থেকে চোখ সরিয়ে চাঁদের দিকে তাকায়। আনন্দ অশ্রুতে আঁখি ছলছল। ইতি ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভেজা গলায় বলে, ‘গায়ে এখন জ্বর কেমন একটু দেখুন তো আমার হাতটা ধরে।’
কল্প ওর হাতটা আলগোছে ধরে। শিমুল তুলোর মতো নরম হাত। সে গালের সঙ্গে চেপে ধরে চুমু খেয়ে বললো, ‘ইতি মেসেঞ্জারে তোমার নাম্বার দিয়ো৷ আর এখন থেকে রোজ কথা বলবে, ওকে?’
ইতির চোখ বেয়ে জল পড়ছে। নিচের ঠোঁট কাপছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছে না। সে মাথা নেড়ে কেবল সম্মতি দেয়। কল্প পুনরায় বলে, ‘খাওয়া-ঘুম কোনো কিছুর যেন অনিয়ম না হয়। চোখের নিচের কালো দাগ আমি এসে পরেরবার দেখতে চাই না। তুমি আগের মতো সবার সেই চঞ্চল ইতি হয়ে যাবে, ওকে?’
ইতি মাথা নাড়ে। কল্প আবার বলে, ‘নিজেকে এত পালটাতে হবে না ইতি। তুমি যেমন ছিলে তেমনই ভালো। এখন চোখের জল মুছে ফেল। কেউ এলে দেখে ফেলবে।’
ইতি চোখের জল মুছতে গিয়েও আবার কেঁপে-কেঁপে উঠে। কল্প চিলেকোঠা থেকে দেখে আসে কেউ আসছে কি-না। ফিরে এসে ইতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ মুছিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘প্লিজ শান্ত হও, আমি আছি তো। বেশি ইমোশনাল হলে বিপদ আছে। এইযে দেখা করতে পারছি। কেউ সন্দেহ করছে না। এই সুযোগগুলোও পাব না শেষে।’
ইতি চোখ মুছে শান্তি হয়ে বসে। কল্প আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি কি গান পারো?’
ইতি মাথা নেড়ে না করে। কল্প দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আমিও পারি না। তবে কবিতা পড়ে শুনাতে পারি।’
ইতি খুশি হয়ে বললো, ‘আচ্ছা আপনি আগে বলুন তারপর আমিও কবিতা পড়ে শুনাবো।’
কল্প মুচকি হাঁসে। তারপর রবীন্দ্রনাথের ‘অনন্ত প্রেম’ কবিতাটি পড়তে শুরু করে।
“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে৷ গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।”
নীলা দু’জনের জন্য খিচুড়ি নিয়ে এলো। কল্প অবাক হয়ে বললো, ‘আমি খাব না। হোটেলে ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করবে।’
নীলা বসতে বসতে বললো ‘এনেছি যেহেতু খেয়ে নাও।’
– ‘এগুলো ইতির মতো অসুস্থ আর বুড়া-বুড়িদের খাবার।’
ইতি দাঁত কটমট করে তাকায়। কল্প প্লেট নীলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নানাকে দিয়ে আসেন এই প্লেট।’
– ‘না উনি তো ভাত খাবেন রাতে।’
– ‘দেন, দেরিতে না হয় খাবেন ভাত।’
নীলা উঠে চলে যায়। কল্প আরেকটু নিবিড় হয়ে মুখোমুখি বসে প্লেট হাতে নিয়ে বললো ‘হা করো আমি আগে ম্যাডামের অনশন ভাঙিয়ে দেই।’
ইতি ফিক করে হাসলো। তারপর বললো ‘আপনার মুখে ‘অভিমানী পাখি’ শুনে কিযে ভালো লেগেছিল। আরেকবার ডাকবেন?’
কল্প স্মিত হেঁসে বললো, ‘আমার অভিমানী পাখিটি ‘হা’ করো।’
ইতি ‘হা’ করে। কল্প এক চামচ ওর মুখে দেয়। ইতি খেয়ে বললো, ‘আমার না হয় চেহারা ছবির অবস্থা খারাপ হইছে আপনার বিরহে৷ কিন্তু আপনি ইংলিশ ম্যাম পেয়েও এই অবস্থা কেন? আদর যত্ন করে না?’
কল্প ডান হাতে ইতির মাথায় গাঁট্টা মে’রে বললো,
– ‘বাজে কথা বলো না। সারাক্ষণ তোমার কথাই ভেবেছি।’
– ‘কেন? হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ কি?’
– ‘বাঁধ ভেঙে গেছে ম্যাডাম। জল দেখেছো তাকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দিলে ধীরে ধীরে নামে। কিন্তু বাঁধ দিয়ে রাখলে যখন ঠেলে ছুটে তখন স্রোত প্রবল থাকে। আমার হইছে মনে হয় এই অবস্থা।’
– ‘কিন্তু বাঁধ ভাঙলো কিভাবে বলুন।’
– ‘তোমাকে মেসেজ দিয়ে বিয়ের কথা জানিয়েছিলাম না? এরপর থেকে অদ্ভুত এক অসুখ হয়েছে। বুঝতে পারলাম আমার এই অসুখ ইতি ম্যাডাম ছাড়া সারবে না।’
ইতি মুখে হাত দিয়ে হেঁসে ফেলে। কল্প তাড়া দিয়ে বললো, ‘তাড়াতাড়ি খাও, সবটুকু খাবে।’
– ‘কিন্তু আপনি অন্যদিকে তাকান। কেউ হা করে তাকিয়ে থাকলে আমার খেতে অস্বস্তি লাগে।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ জনাব, তাছাড়া একটু আগে চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে ঢং করলেন না? এভাবে হা করতেও মেয়েদের লজ্জা লাগে। কারণ হা করলে নিজের কাছে মনে হয় বিশ্রী লাগছে চেহারা। আমরা বিশ্রী লাগে এমন কিছুই করতে চাই না।’
– ‘আমরা চাই?’
– ‘হ্যাঁ ছেলেরা চায় বলে আমার ধারণা। আপনারা নিজের আরাম, শান্তির জন্য খালি গায়ে হাঁটবেন, বিশ্রী লাগছে জেনেও হাঁটবেন। কে কি বললো এসব দেখার টাইম নাই আপনাদের। নিজের আরাম আর মনের শান্তিই প্রাধান্য পায়।’
– ‘ওরে বাবা তাই না-কি? সত্যিই তো অসুস্থ অবস্থায় মানুষ দার্শনিক হয়ে যায়।’
ইতি হাসলো৷ কল্প অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে খাও।’
ইতি দ্রুত খেয়ে নিল। খানিক পর নীলা উপরে এলো ওষুধ আর পানি নিয়ে। কল্প তাকে ওষুধ খুলে দিয়ে বললো, ‘এই নাও খাও।’
ইতি বাধ্য মেয়ের মতো ওষুধ খেয়ে নিল৷ নীলার কল এলো তখনই। সে রিসিভ করে ছাদের কার্নিশের কাছে চলে যায়। কল্প আমতা-আমতা করে বললো, ‘এখন আমার যেতে হবে ইতি। ওরা অপেক্ষা করবে। দেশি কেউ ছাড়া ওরা বাইরে খেতে যেতেও ভয় পায়।’
ইতি জল ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো, ‘এখনই চলে যাবেন?’
– ‘হ্যাঁ, নানার সঙ্গেও দেখা করে যেতে হবে। এমনিতেই দেরি হবে।’
– ‘কবিতা শুনবেন না?’
– ‘ফোনে শুনে নিব। এখন যাই।’
কল্প উঠে চিলেকোঠায় চলে এলো। নীলাকে কলে ব্যস্ত দেখে ইতিও কম্বল গা থেকে ফেলে পিছু পিছু আসে। সিঁড়ি থেকে দেখে থামে কল্প। তারপর ফিরে আসে ইতির কাছে। ফিসফিস করে বলে ‘নীলা আন্টি কই?’
– ‘কলে ব্যস্ত।’
কল্প ইতির গালে হাত রেখে বলে, ‘একবার ভীষণ শক্ত করে কি জড়িয়ে ধরতে পারি আমার অভিমানী পাখিকে?’
ইতি থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কল্প উঁকি দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে ইতিকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কপালে আলতো করে চুমু খায়। ইতির পুরো শরীর কাঁপছে৷ অবশ হয়ে আসছে অন্যরকম এক সুখের ব্যথায়৷ কল্পকে ছাড়িয়ে ইতি দেয়ালে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। চোখবুজে বড়ো বড়ো শ্বাস ছেড়ে শুকনো ঢোক গিলছে সে। কল্প এগিয়ে গিয়ে গালে গাল চেপে ধরে বললো, ‘যেতে ইচ্ছা করছে না ইতি। তবুও হঠাৎ কেউ টের পেলে সমস্যা। তোমার শরীরেও এখনও জ্বর। আমি যাই?’
ইতি আবার কল্পকে জড়িয়ে ধরে পুরো মুখে চুমু খেয়ে বলে ‘আপনি পালটে যাবেন না তো? আজকের এই সন্ধ্যা মিথ্যে না তো?’
– ‘না মিথ্যে না, সবই সত্য। এবার আমাকে বিদায় দাও।’
ইতি ছেড়ে দেয়। কল্প পেছনে আর তাকায় না। তাড়াতাড়ি নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম