মায়াডোর-২৩,২৪

0
257

মায়াডোর-২৩,২৪

(২৩ পর্ব)
.
নিপা ভার্সিটির রাস্তায় ঢুকেই মুগ্ধ হয়ে যায়। কল্পের সঙ্গে হেঁটে-হেঁটে সবকিছু দেখে এখন এসেছে শহিদ মিনারের কাছে। টিলা বেয়ে আঁকাবাকা লাল দীর্ঘ সিঁড়ি উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে নিপা অবাক হয়ে বললো, ‘এত উঁচুতে?’

কল্প মুচকি হেঁসে বলে, ‘হ্যাঁ টিলার ওপর এই শহিদ মিনার। এখান থেকে সকল সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে না। ১০১টি সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতে হবে। মোট তিনটি ধাপে ভাগ করা।’

– ‘মাইগড! আমি কি উঠতে পারবো?’

– ‘বাদ দাও, উঠতে হবে না, ফুচকা খাবে?’

নিপা মাথা কাত করে সম্মতি দিল। টিলার পাশেই ফুচকাওয়ালা। কল্প গিয়ে ফুচকার অর্ডার দেয়। নিপা আনমনে কিছু একটা ভেবে বললো, ‘পার্সেল নাও, উপরে গিয়ে খাব।’

– ‘উপরে যাবে?’

– ‘হ্যাঁ।’

কল্প ফুচকা নিয়ে আসে। নিপা তার বাঁ হাত ধরে বলে, ‘চলো দেখে আসি।’

কল্প হাঁটতে থাকে। নিপা তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চারপাশে প্রচুর সবুজ গাছ। আচ্ছা এত মিষ্টি করে পাখি কোথায় ডাকছে? পাখিটার নাম কি?’

কল্প ঠোঁট উলটে বললো, ‘বুঝতে পারছি না। জঙ্গলের মতো তো এই জায়গা। কত পাখি আছে। না দেখে নাম বলতে পারবো না।’

– ‘ও আচ্ছা, এই ভার্সিটির নাম কি যেন?’

– ‘হজরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।’

– ‘দারুণ, তোমার ভার্সিটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’

– ‘ধন্যবাদ।’

সিঁড়ি পেরিয়ে খানিকটা উপরে উঠতেই চোখে পড়ে বৃত্তাকার লাল দেয়াল। এর পরেই মূল বেদিতে ওঠার জন্য আরও সাত ধাপের ছোট সিঁড়ি পার হয় তারা। নিপা ইতোমধ্যে হাঁপিয়ে গেছে। কিন্তু উপরে আসতেই ওর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে মুখ থেকে ‘ওয়াও’ শব্দটি বের করে নিয়েছে। পেছনে তাকিয়ে পুরো ক্যাম্পাস দেখে নিপা। চারপাশে বৃত্তাকার লাল দেয়াল। ছেলে-মেয়েরা বসে আছে। অথচ নিচ থেকে বুঝাই যায়নি উপরে মানুষ আছে। একেবারে নিরিবিলি পরিবেশ। যেদিকে চোখ যায় ঘন সবুজ গাছগাছালি৷ পাখির কলরব।

আরেকটু সামনে যেতে যেতে দৃশ্যমান হয় পুরো শহীদ মিনার। সবুজের সমারোহে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে আছে। সবুজের মাঝখানে এক টুকরো লাল এই প্রাঙ্গণটি যেন বাংলার লাল সবুজের পতাকা। নিপা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকাচ্ছে। এসব দেখে কল্পের আচমকাই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইতি বছর দেড়েক আগে তার ভার্সিটিতে আসতে চেয়েছিল। সে নিয়ে আসেনি। ইতিও বোধহয় এরকম উচ্ছ্বসিত হয়ে যেত দেখে। কল্প দেয়ালে বসে পড়ে। নিপাও এলো পাশে।

– ‘ফুচকা বের করো।’

কল্প তাকে বের করে দেয়। নিপা একটা ফুচকা মুখে দিয়ে আচমকা প্রশ্ন করলো, ‘এবার বলো তোমার সমস্যাটা কি?’

কল্প অবাক নয়নে নিপার দিকে তাকায়। ওর মুখ পুরোপুরি স্বাভাবিক৷ কল্প ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘কিসের সমস্যার কথা বলবো?’

– ‘তোমার যে সমস্যা আছে সেটা।’

– ‘আমার আবার কিসের সমস্যা?’

– ‘শোনো কল্প, আমাদের নতুন একটা সম্পর্ক হতে যাচ্ছে। এটা ছাড়াও কিন্তু আমি তোমার চাচাতো বোন। আমরা সম-বয়সীও। আমাকে তুমি নির্দ্বিধায় যেকোনো কিছু বলতে পারো।’

– ‘কিন্তু বলবো কি?’

– ‘বাবা এবার ইংল্যান্ড গিয়ে তোমার অনেক বেশি প্রশংসা করেছিলেন। দেশে এসে কিন্তু তোমার চলাফেরা দেখে তিনি নিজেও খুশি না৷ তুমি কেমন আনমনা হয়ে থাকো। আমার সঙ্গে যে তোমার বিয়ে হতে যাচ্ছে সেটা যেন জানোই না।’

কল্প মুচকি হেঁসে বললো, ‘সেরকম কিছু না। আমরা বাঙালি ছেলে-মেয়েরা এরকমই। বিয়ের আগে হবু বর-কনের আলাদা করে কথাবার্তা হয় না।’

নিপা হেঁসে উঠে বললো, ‘তোমরা দেশি মানুষরা ভাবো আমরা বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানি না৷ তুমি জানো আমরা ইংল্যান্ড যে টাউনে থাকি বের হলেই বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়। আমাদের আশেপাশে সকল বাসায় বাঙালি থাকে। না হলে আমরা বাংলায় কথা বলি কিভাবে? ইংলিশ শেখার আগে আমরা বাংলা শিখে ফেলি। তোমাদের সম্পর্কে আমার জানা আছে। এইযে ছেলে-মেয়েরা দেয়ালে একে অন্যের হাত ধরে বসে আছে এগুলো কি? বাঙালি ছেলে-মেয়েরা বলে এড়িয়ে যেও না। তোমার চোখে আমাকে নিয়ে আলাদা কোনো আগ্রহ নেই। যেমন উঁচুতে শহিদ মিনার তাই তুমি সঙ্গে সঙ্গে বললে থাক বাদ দাও, উঠতে হবে না। বাঙালি ছেলেরা কিন্তু এরকম করবে না৷ কোলে করে নিয়ে উঠে যাবে। আসল কথা হলো তোমার আমার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তাই বলছি সোজাসুজি বলো সমস্যাটা কি।’

– ‘কিছুই না বললাম তো।’

– ‘তাহলে কি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছ? আচ্ছা ধরলাম বিয়ে করবে। তাহলে কেন বিয়ে করতে চাচ্ছ বলো তো?’

কল্প কোনো জবাব দিল না। নিপা পুনরায় বললো, ‘ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য না-কি? দেশে তো আবার ইংল্যান্ড এর বৃদ্ধ পুরুষের সঙ্গেও যুবতী মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়।’

কল্প আহত চোখে নিপার দিকে তাকায়। নিপা হেঁসে বললো, ‘নিজের সঙ্গে জোরাজুরি করে আমাকে বিয়ে করতে যেও না। আমাকে বিয়ে না করলেও সব সময় পাশে পাবে। তুমি আমার চাচাতো ভাই। এটা মনে রেখো। টাকা-পয়সা যখনই দরকার হয় বলবে। আমি পাঠাবো।’

– ‘কোনো কারণে কি তুমি নিজেই আমাকে বিয়ে করতে চাও না?’

নিপা ফিক করে হাসে। তারপর আমতা-আমতা করে বলে, ‘সত্যিই ধরেছো। আমার দেশে বিয়ে করার ইচ্ছা নেই৷ কিন্তু বাবা তোমাকে নিয়ে অনেক ভাবেন। তোমার জন্য কিছু করতে চান। চাচা অনেক কিছু করেছেন এই পরিবারের জন্য।’

– ‘তুমি বিয়ে করতে না চাইলে না করছো না কেন?’

– ‘চাই না মানে, চাইতাম না আগে। বাবার মুখে তোমার কথা শুনে। দেশে এসেও প্রথমে দেখে মনে হলো ভালোই। তাই রাজি হয়েছি। কিন্তু তোমার চালচলন দেখে দিন দিন কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। তাই বাবাকে বিয়ের পাকা কথায় যেতে আমিই না করেছি। আরও কিছুদিন বুঝতে চেয়েছি।’

– ‘কি বুঝলে?’

– ‘কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমাকে যে বিয়ে করবে তুমি। সেটা জানোই না। বিশেষ কোনো খেয়ালই করছো না আমাকে। যাইহোক ক্লিয়ার করে বলো। কারণ আমার তোমাকে বিয়ে করতেও সমস্যা নেই, না করতেও সমস্যা নেই। বুঝতে পারছো?’

কল্প খানিক ভেবে বললো, ‘বিয়ের পাকা কথা যেহেতু আঁটকে রেখেছো। না করে দাও চাচাকে।’

– ‘তা কেন করবো?’

– ‘ধরো আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি না।’

– ‘তাহলে তুমি না করবে। আমি কেন?’

কল্প হেঁসে বললো, ‘তুমি না আমার চাচাতো বোন, একটু হেল্প করবে না?’

– ‘কিসের হেল্প?’

– ‘আমি না করলে সবাই বকা দিবে। আমার মামা, মা, চাচাও। আমার জন্য অনেক অসুবিধা হয়ে যাবে।’

– ‘মাই গড! তুমি কি সত্যিই বিয়ে করতে চাচ্ছ না? আর যদি না চাও, তাহলে বলে দিচ্ছ না কেন?’

– ‘আমি না করতে চাচ্ছিলাম না।’

– ‘না করলে কি হবে?’

– ‘আছে অনেক কিছু।’

– ‘আর আমি না করলে কি হবে জানো? বাবা আরও বেশি কষ্ট পাবেন। ভাববেন ভাতিজার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। এর থেকে তুমিই না করো। আমি পাশে আছি।’

কল্প দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘একটা কিছু তো করতেই হবে।’

– ‘কেন বিয়ে করতে চাচ্ছ না আমি কি জানতে পারি?’

– ‘আমি একজনকে ভালোবাসি নিপা। মেয়েটাও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের খবর শুনে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে অসুস্থ হয়ে গেছে।’

– ‘ওয়াও, কি কিউট। সত্যি বলছো এসব? কে মেয়েটা? আমি দেখতে চাই।’

– ‘আচ্ছা দেখা যাবে৷ কিন্তু আমি অনেক ভয়ে আছি। অনেক রকমের ভয়।’

– ‘কিসের ভয়।’

– ‘তোমাকে বিয়ে করবো না শুনলেই সবাই রেগে যাবে। এরপর যদি ইতির বাড়িতে জানাজানি হয় আমার থাকারও অসুবিধা হবে। আগে একটা চাকরি ম্যানেজ করা লাগবে না হলে পড়ালেখা করাও প্রব্লেম হবে।’

– ‘এসব নিয়ে চিন্তা করো না। আমি ইংল্যান্ড গিয়ে তোমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবো। টাকার দরকার হলেও জানাবে। তুমি কি ওকে বিয়ে করতে চাচ্ছ?’

– ‘হ্যাঁ, তবে বছর খানেক লাগবে। আগে চাকরি দেখতে হবে।’

– ‘এখন আমাদের ব্যাপারে কি করবে?’

কল্প ওর হাত ধরে বললো, ‘তুমি প্লিজ না করে দাও।’

– ‘না, এই কাজ আমি করলে বাবার ভেতরে কষ্ট থেকে যাবে৷ ভাববে তোমাকে আশা দিয়ে কথা রাখতে পারেনি। আর তুমি নিজ থেকে না করলে তার এই কষ্ট থাকবে না। তুমি বলবে পড়ালেখা করে দেশে কিছু করতে চাও।’

কল্প চিন্তিত মুখে মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা দেখি। এখন চলো হোটেলে ফিরে যাই।’

দু’জন বাসায় ফিরে আসে। রাতে ইতিকে মেসেজ দিয়ে সবকিছু জানায় কল্প। ইতি খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছাদে গিয়ে কল দেয়। রিসিভ করে সে।

– ‘হ্যালো।’

– ‘কি করেন জনাব?’

– ‘এখন কোথা থেকে কল দিয়েছো?’

– ‘ছাদে এসেছি।’

– ‘এখন ছাদে গিয়েছ কেন? জ্বর কি কমেছে?’

– ‘হ্যাঁ অনেকটাই কমেছে, সকালে একটু ছিল। পরে পুরোদিনই ভালো লাগছে।’

– ‘ওষুধ খেও ঠিকঠাক।’

– ‘তা তো খেতেই হবে।’

– ‘খুব ফুরফুরে মেজাজে আছো মনে হচ্ছে। এদিকে আমি টেনশনে শেষ। কি যে হবে ভেবে পাচ্ছি না।’

– ‘ধ্যাৎ এত ভয় পাবেন না তো। যা হওয়ার হবে। আপনি এক কাজ করুন। ওদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর বলে দিবেন বিয়ে করতে চান না।’

– ‘না প্রথমে মামাকে বলে দেবো। এরপর উনিই চাচাকে বলবে।’

– ‘হ্যাঁ এরকম সোজা বলে দেন। এরপর দেখবেন কিছুই হবে না।’

কল্প পাশ ফিরে কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আচ্ছা ওইদিন না কবিতা শুনাতে চাইছিলে। আজ শোনাও।’

– ‘এহ চু’রি করে ছাদে এসেছি আর উনাকে এখন কবিতাও শুনাতে হবে।’

– ‘তাহলে থাক, আমার এখন কবিতা রেখে, তোমাকে দেখতেই ইচ্ছা করছে।’

– ‘তাহলে চলে আসুন প্লিজ। ভীষণ মিস করেছি সারাদিন। আপনি তো ইংলিশ ম্যাম নিয়ে ঘুরেছেন।’

– ‘ঘুরতে গিয়েও মিস করেছি ইতি। শহিদ মিনারে গিয়ে আচমকা মনে পড়ে গেল তুমি একদিনে যেতে চেয়েছিলে।’

– ‘তখন তো ভাবের দোকানদার ছিলেন আপনি। কত ইচ্ছা করতো এক সঙ্গে ঘুরতে।’

– ‘জানো, কাল রাতে ফিরে একটুও ঘুমাতে পারিনি৷ জীবনে প্রথম কাউকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। শিমুল তুলোর মতো নরম তুমি। হোটেলে ফিরে এগুলো ভাবতেই অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল।’

ইতি ফিক করে হেঁসে বললো, ‘প্রথম কই, একদিন আপনার রুমে গিয়ে জোর করে জড়িয়ে ধরেছিলাম৷ বাসেও ঢাকা যাওয়ার পথে আমার কাঁধে ঘুমিয়ে গেলেন।’

– ‘ও হ্যাঁ তাইতো। তবুও গতকালের জড়িয়ে ধরা প্রথম মনে হচ্ছে।’

– ‘আচ্ছা এখন চলে আসুন না।’

– ‘আমারও ইচ্ছা করছে যেতে।’

– ‘আচ্ছা আরেকটা কথা। আপনি ফেইসবুকে ছবি দেন না কেন? কয়েকটা দিয়ে রেখেছেন এগুলো প্রতিদিন দেখি।’

কল্প হাসতে হাসতে বললো, ‘তুমি ফেইসবুকে গিয়ে ছবি দেখো প্রতিদিন?’

– ‘হ্যাঁ জনাব, এখন আসুন প্লিজ।’

– ‘আমারও তো আরেকবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে ম্যাডাম। কিন্তু এরকম বারবার গেলে কি ভাববে ওরা?’

– ‘কিছুই ভাববে না। আপনি এমন ভাব করবেন যেন আপনার রুম থেকে কিছু নিতে এসেছেন।’

– ‘না থাক ইতি। আমি তো শিগগিরই ফিরবো৷ এখন বাড়াবাড়ির দরকার নেই।’

ইতি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কল্পের বুকের ভেতর শিরশির করে উঠে।

– ‘আচ্ছা আমি আপনার ঘ্রাণ পাই কেন সারাক্ষণ? এইযে এখন পাচ্ছি৷ আর আজ সারাদিন গেইটে একটু শব্দ হলেই মনে হয়েছে আপনি আসছেন। আপনার কি এমন লাগে?’

– ‘হ্যাঁ, তোমাকে বিয়ের কথা জানানোর পর এমন হয়েছিল। আর এতক্ষণ ঘ্রাণ পাইনি। এখন তুমি বলার পর পাচ্ছি।’

ইতি খিলখিল করে হেঁসে উঠে। তারপর আবার অকারণ মন খারাপ হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘আপনাকে কি আমি সত্যিই পেয়ে পাব কল্প ভাইয়া? যদি কোনোভাবে পেয়ে যেতাম। পাব তো?’

কল্পের বুকে ‘চিনচিনে’ এক ব্যথা হয়। চোখটা ভিজে আসে। ভেজা গলায় বলে, ‘পেতে তো হবেই ইতি। আমার অভিমানী পাখিটাকে আমার লাগবেই। এতদিন একা একা অনেক কষ্ট পেয়েছো। আমি নিজেই কষ্ট দিয়েছি। এখন আমি সবকিছু করবো। তুমি নিশ্চিন্তে থাকবে, ওকে?’

– ‘ইশ, আপনি আমাকে এত ভালোবাসবেন ভাবিনি কখনও। আপনি একটু আদর করে কথা বললেই চোখে পানি চলে আসে।’

– ‘আচ্ছা এখন ছাদ থেকে যাও। পরশু কলেজে যাবে। আরও একদিন রেস্ট নাও। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক মতো করো। এখন রাখি।’

– ‘এই দাঁড়ান।’

– ‘কি?’

– ‘একটা আদর দিয়ে ফোন রাখেন।’

– ‘মোবাইলে এসব ভালো লাগে না ইতি। মোবাইল আমার বউ না। আর তোমার সতিন না।’

‘আপনি শুধু ভাবের দোকানদার না, খা’টাশও’ কথাটা বলেই ইতি কল কেটে দিয়ে একা একা হাসতে শুরু করে।

শহর থেকে দু’দিন পর তারা গ্রামে ফিরে। কল্পের পুরো সময়টা অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এখানে এসে পরেরদিনই সে চাচার থেকে বিদায় নিয়ে নানাবাড়ি আসে। মামা বাজারে। রাতে আর দেখা হয় না তার। সুপ্তি আপু বা মামীকে কিছুই বলে না। একা একা আনমনে দিন সময় কাটে। পরেরদিন ভোরে উঠে মোস্তাক সাহেবের রুমে যায়।

– ‘মামা আমি কি আসবো?’

– ‘আয়।’

– ‘কিছু কথা ছিল।’

তিনি বিছানায় উঠে বসে বললেন, ‘কি বলবি বল।’

– ‘মামা আমি নিপাকে বিয়ে করতে পারবো না।’

মোস্তাক সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘বেকুবের বাচ্চা তুই কি বললি?’

– ‘আমি এই বিয়েটা করতে চাচ্ছি না।’

– ‘কেন?’

– ‘আমি পড়ালেখা করে দেশেই কিছু করবো।’

– ‘মানে কি এসবের? তুই দেশে কি করবি?’

– ‘দেশে কি করবো মানে। সব মানুষ কি ইউরোপ চলে গেছে না-কি মামা? আমি একটা ভালো ভার্সিটিতে পড়ি…।’

কথাটা আর শেষ করতে পারে না সে। মোস্তাক সাহেব ধমক দিয়ে উঠেন, ‘বেকুবের বাচ্চা আমার সামনে তোর ভার্সিটির আলাপ করবি না৷ কোনো খবর রাখিস দুনিয়ার? মানুষ বর্ডার পাস হয়ে, সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাচ্ছে৷ কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে ইংল্যান্ড যাচ্ছে৷ কত অনার্স মাস্টার্স পাস করা ছেলে ইউরোপ গিয়ে ল্যাট্রিন পরিষ্কার করতেও একপায়ে রাজি৷ মানুষ এসব সুযোগ পায় না। তুই পণ্ডিত হইছিস। পড়ালেখা দেখাচ্ছিস। পড়ালেখা করে কি করবি? চাকরি পাবি কি-না তার নাই ঠিক। ইংল্যান্ড গেলে সপ্তাহে কামাবি লক্ষ টাকা৷ দেশে আছে কি?’

– ‘মামা বাংলাদেশ কোনো যু*দ্ধ-বি*ধ্বস্ত দেশ না যে একটা পাব্লিক ভার্সিটির স্টুডেন্ট পড়া ছেড়ে রেস্টুরেন্টে কাজ করার জন্য ইংল্যান্ড চলে যাবে।’

– ‘হায়রে বেকুবের বাচ্চা, সোনাই গাজির ছেলে মনির তো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। সেটাও পাব্লিক ভার্সিটি। সে কেন পড়া শেষ না করেই দুবাই, মাল্টা হয়ে ফ্রান্স চলে গেল? আর তুই তো বিয়ে করে ডায়রেক্ট ইংল্যান্ড যাচ্ছিস৷ একেবারে লিগ্যাল। কোনো ঝামেলা নাই।’

– যাইহোক মামা। আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না, তুমি না করে দিয়ো চাচাকে৷ আমি নিপাকেও না করে দিয়েছি।’

মোস্তাক সাহেব রাগে কাঁপছেন। তিনি উঠে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ক্রোধান্বিত গলায় বললেন,

– ‘তুই আমার বাড়ি থেকে বের হ। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলে এরপর পন্ডিতি বাইর হয়ে যাবে। তুই এই মূহুূর্তে বের হয়ে যাবি এই বাড়ি থেকে।’

সুপ্তি চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে রুমে ঢুকে বললো, ‘কি হয়েছে বাবা, তুমি ওর সঙ্গে এত চেঁচামেচি শুরু করেছো কেন?’

যে মোস্তাক সাহেব সুপ্তির কথার উপরে কথাই বলেন না। সচেতনভাবে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে যিনি সুপ্তিকে নিজেই কাঁধে তুলে রেখেছেন৷ তাকে আচমকা গালে ঠাস করে চ*ড় দিয়ে বললেন, ‘তোকে মাতব্বরি করার জন্য ডাকিনি। চোখের সামনে থেকে যা। তুই ওকে প্রশ্রয় দিয়ে এরকম করেছিস৷ এই বেকুবের বাচ্চাকে আমার বাড়িতে দেখতে চাই না। যে ওর হয়ে ওকালতি করবে তাকেও ঘাড় ধরে বের করে দেবো।’

কল্প মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মোস্তাক সাহেব জুতো হাতে নিয়ে বললেন, ‘তুই যাবি না-কি জুতা দিয়ে মারতে মারতে বের করে দিব?’

কল্প বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে একটা ব্রিজে বসে৷ খানিক পর খবর পেয়ে তার মা কল দিলেন। কল্পকে বোঝালেন এমন পাগলামি না করতে৷ এত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিজের হাতেই যেন নষ্ট না করে দেয়। মানুষ এমন সুযোগ পায় না। ঘণ্টা খানেক দু’জনের যুক্তিতর্ক হয়। এক সময় কোনোভাবে তাকে বুঝাতে না পেরে তিনিও রাগা-রাগি থেকে গালাগালি করে কল কেটে দিলেন। কল্প কোনো উপায় না দেখে ব্যাগ-প্যাক নিয়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। মেইন রাস্তায় আসতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আসমান ডেকে ঝুম বৃষ্টি। আশেপাশে কোনো রিকশা নেই। কল্প বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে শুরু করে।
___চলবে……
লেখা: জবরুল ইসলাম

মায়াডোর (২৪ পর্ব)
.
কল্প বৃষ্টিতে ভিজে বাজারে এসে বাসে উঠেছে। সিট ভিজে যাবে বলে হেল্পার বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ভাই আপনে তো ভিজাইয়া দিবেন সবকিছু। দাঁড়াইয়া যাওন লাগবো আপনের।’

কল্প মাথা নাড়ে। ডান হাতে মাথার উপরের স্টিলের পাইপ শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাস চলতে শুরু করেছে। প্রায় এক ঘণ্টা এভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে কল্প সিলেট আসে। ভেজা কাপড় কিছুটা শুকিয়েছে। তবুও শরীরে, পোশাকে তার ছাপ স্পষ্ট। রিকশা নিয়ে সোজা চলে এলো ইতিদের বাড়িতে। তখন বেলা প্রায় এগারোটা। ইতি কলেজে চলে গেছে। লতিফা তাকে দেখে বললো, ‘একি অবস্থা ভাইজান? কোথা থাইকা আইছেন?’

কল্প বারান্দায় গিয়ে হাসি হাসি চেহারায় বললো, ‘চলে এলাম। ভার্সিটি আছে তো আমার। তাছাড়া নিয়ন আর মিলনের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে।’

কথাগুলো বলে কল্প নিজের রুমের দিকে চলে যায়। ভেজা ব্যাগটা রাখে টেবিলে। কিছুটা শুকিয়ে গেলেও ভেতরের কাপড় ভেজা সে জানে। তবুও শুকোতে দিতে তার ভালো লাগছে না। শরীরজুড়ে কেমন অবসাদ আর ক্লান্তি। বিছানা যেন তাকে টেনে নিয়ে যায়। জুতোটা খুলেই গুটি-শুটি মে’রে শুয়ে পড়ে৷ শরীরে কেমন ‘ওম-ওম’ ভাব। কিছুটা ঠাণ্ডাও লাগছে। কম্বল নেই। একপাশের বিছানার চাদর টেনে নিজেকে ঢেকে নিল। এত আরাম। শুয়ে থাকতে এত আরাম লাগছে৷ নিজের উষ্ণ শ্বাস-প্রশ্বাস নিজের কাছেই ভালো লাগছে। ক্রমশই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

ইতি বিকেলে কলেজ থেকে ফিরেছে। টেবিলে বই রাখতেই নীলা এসে বললো, ‘ইতি কল্প আজ দুপুরে এসেছে, এসেই ঘুমোচ্ছে শুধু। লতিফা একবার ডেকে এসেছে, উঠেনি। তুই যা তো৷ কিছু কি খাবে না এত বেলা হয়েছে।’

ইতি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘কি? কল্প ভাইয়া এসেছে?’

– ‘হ্যাঁ, বুঝলাম না ওর না বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। চলে এলো যে?’

– ‘কি জানি, তোমরা কিছু জিজ্ঞেস করোনি?’

– ‘না লতিফাকে বলেছে তার না-কি ভার্সিটি আছে। নিয়ন মিলনেরও পড়ালেখায় ক্ষতি হচ্ছে৷ তাই চলে এসেছে।’

ইতি আর কথা না বাড়িয়ে ছুটে গেল কল্পের রুমে। বিছানা চাদর গায়ে দিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে কল্প। ইতি চাদর উপর দিয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখে শরীর প্রচণ্ড গরম। জ্বর এলো না-কি? টেবিলে ব্যাগ দেখে গিয়ে হাত দেয়। ভেজা ভেজা লাগে। চেইন টেনে খুলে ভেতরে হাত দিয়ে দেখে কাপড়-চোপড় ভেজা। ইতি তাড়াতাড়ি ব্যাগ নিয়ে বাইরে যায়৷ রান্নাঘরে এসে বলে ‘মা, কল্প ভাইয়ার তো জ্বর মনে হচ্ছে। আর এই দেখো ব্যাগ ভেজা।’

হুস্না বেগম টেবিলে প্লেট রেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘বলিস কিরে, ভিজে-টিজে এসেছে মনে হয়। এখন তো এমনিতেই চারদিকে জ্বর হচ্ছে মানুষের।’

– ‘কিন্তু একটা মানুষ দুপুর থেকে বিছানায় পড়ে আছে তোমরা খেয়াল করবে না? আমি গিয়ে দেখি বিছানার চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে।’

– ‘বলিস কিরে? লতিফাকে পাঠিয়েছিলাম। বললো শুধু ঘুমাচ্ছে। আমি তো আর যাইনি ওদিকে।’

ইতি রূঢ় গলায় বললো, ‘একটা কম্বল বার করো। আমি এগুলো শুকোতে দিয়ে আসি।’

ইতি ছাদে কাপড় শুকোতে দিয়ে এলো৷ হুস্না বেগম একটা পাতলা কমলা রঙের কম্বল দিয়ে বললেন, ‘ওকে তুলে বল কিছু খেয়ে ঘুমাতে। আর তোর বাবাকে কল দিয়ে বলবো রাতে ওষুধ নিয়ে ফিরতে।’

ইতি মাথা নেড়ে মায়ের হাত থেকে কম্বল নিয়ে কল্পের রুমে যায়। ইতি বিছানায় বসে আস্তে আস্তে বিছানা চাদর সরিয়ে দিতেই কল্প খানিক কেঁপে উঠে লাল টকটকে চোখে তাকায়। ইতি কপালে হাত দিয়ে বললো, ‘আপনার তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজলেন কেন? এখন চারদিকে মানুষের জ্বর হচ্ছে জানেন না?’

কল্প সে কথার জবাব দিল না৷ উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আমার গায়ে কম্বল দাও।’

ইতি তাড়াতাড়ি পুরো শরীরে কম্বল দিয়ে বললো, ‘উঠে আগে কিছু খেয়ে নিন।’

কল্প ঢোক গিলে বললো, ‘ইতি আগে দেখো কেউ আসছে কি-না।’

ইতি চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘কেউ নেই। কি বলবেন বলুন। এত ভয় পাই না আমি।’

কল্প দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘বেশি বাড়াবাড়ি ভালো না৷ এখন আরও বেশি ভয় পাওয়া লাগবে। আজ থেকে তুমি এই রুমে আসবে না৷ আর আমার জ্বর থাকলেও প্রব্লেম নেই। তোমার দুই ভাইকে ডেইলি পড়তে পাঠাবে।’

ইতি ওর কপালে হাত রেখে ব্যগ্র গলায় বলে, ‘কি হয়েছে হঠাৎ বলুন তো?’

কল্প কপাল থেকে হাত সরিয়ে বললো, ‘যা বলেছি তাই করবে৷ আমি একটা চাকরি আর আলাদা থাকার ব্যবস্থা করার আগপর্যন্ত কোনো ঝামেলা চাইছি না।’

– ‘মানে কি এসবের?’

– ‘এত মানে মানে করো না। যা বলছি ভালোর জন্য বলেছি। এখন বের হয়ে যাও। আমার এখানে পাঠাবে লতিফা বা অন্য কাউকে৷ তুমি আসবে না।’

– ‘বুঝলাম না কি হয়েছে। মেসেঞ্জারেও তো বলেননি।’

মেসেঞ্জার শুনে কল্প পকেটে হাত দেয়। মোবাইল পকেট থেকে বের করে পাওয়ার বাটনে ক্লিক করে দেখে ডিসপ্লেতে সমস্যা এসে গেছে। ইতি অবাক হয়ে বললো, ‘এ কি অবস্থা? মোবাইল নষ্ট হলো কিভাবে?’

কল্প মোবাইল বালিশের পাশে রেখে বললো,

– ‘বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় হয়তো। যাইহোক তুমি এখন যাও।’

ইতির চোখ ভিজে এলো৷ কল্পের গালে হাতটা রেখে বলে, ‘কি হয়েছে বলুন তো। আমার অনেক ভয় লাগছে।’

কল্প হাত ছাড়িয়ে নেয়। রূঢ় গলায় বলে, ‘ইতি কেউ এসে দেখলে কি হবে বুঝতে পারছো? আমাকে বিপদে ফেলবে না-কি? তুমি এখনই বের হয়ে যাও।’

ইতি ইতি-উতি করে উঠে চলে যায়। রান্নাঘরে যেতেই নীলা তাকে দেখে বললো, ‘কিরে উঠেছে কল্প?’

– ‘হ্যাঁ আন্টি। বলেছে খাবে।’

হুস্না বেগম এসে নাশতার ট্রে ইতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা দিয়ে আয়।’

– ‘অন্য কাউকে পাঠাও আমি খাব এখন। কলেজ থেকে এসে কিছুই খাইনি।’

হুস্না বেগম নিজেই নিয়ে গেলেন। টেবিলে ট্রে রেখে বললেন, ‘কল্প উঠো বাবা। খেয়ে নাও। তোমার মামাকে বলেছি ওষুধ নিয়ে আসবে রাতে।’

কল্প কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করে হুস্না বেগমকে দেখে উঠে বসে। তারপর ম্লানমুখে মুচকি হেঁসে বলে, ‘একটু এখানে দিয়ে দেন মামী।’

হুস্না বেগম ট্রে নিয়ে রাখলেন তার বিছানায়। কল্প চায়ের কাপ নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বললো, ‘কাল থেকে নিয়ন আর মিলনকে পড়তে পাঠাবেন। বাচ্চারা গ্যাপ পেলেই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।’

– ‘তুমি আগে সুস্থ হও বাবা।’

– ‘ও কিছু না মামী, ওদের পাঠাবেন ডেইলি সকালে। বিকেলে আর সন্ধ্যায় অন্য টিউশনি আছে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘মামী বাসায় কি জ্বরের ওষুধ নেই আগের? নাপা-টাপা কিছু।’

– ‘দেখতে হবে বাবা।’

– ‘একটু দেখুন তো কষ্ট করে।’

হুস্না বেগম চলে গেলেন। কল্পের হঠাৎ মনে পড়লো সে বাইরে যেহেতু যাচ্ছে কোনো ফার্মেসি থেকেও খেতে পারবে। অকারণ বলেছে। এখনই তার আগের দুইটা টিউশনির খবর নিতে হবে। মোবাইল নষ্ট, না হয় কল দিতে পারতো৷ ওরা কোনো নতুন স্যার রেখে দিল কি-না কে জানে৷ সে নাশতা করে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য পায়ে কেডস আর গায়ে ফুলহাতা শার্টের নিচে গাঢ় গেঞ্জি পরে নেয়৷ হুস্না বেগম এলেন নাপা নিয়ে। তাকে কাপড় পরতে দেখে বললেন, ‘এই জ্বর নিয়ে কোথায় যাচ্ছ বাবা?’

সে হাত বাড়িয়ে ওষুধ নিয়ে বললো, ‘টিউশনি আছে মামী। সমস্যা নেই। ঠাণ্ডা লাগবে না। যাচ্ছি আমি।’

কল্প ওষুধ খেয়ে বের হয়ে গেল। হুস্না বেগম ট্রে নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে নীলাকে দেখে বললেন, ‘এত জ্বর নিয়ে ছেলেটা টিউশনি পড়াতে চলে গেছে।’

ইতি আশেপাশেই ছিল। শুনে ‘চিনচিনে’ ব্যথা হয় বুকে। হঠাৎ কি হয়েছে মানুষটার কে জানে। মোবাইলটাও নষ্ট। মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করার কোনো সুযোগ নেই। ইতি ছাদে গিয়ে পিলারে মন খারাপ করে বসে থাকে।

রাত ন’টায় কল্প ফিরে আসে বাসায়৷ এসেই কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে সে। ইতি নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে ইতস্তত করে তার রুমে চলে যায়। গিয়ে বসে বিছানায়। কপালে হাত দিয়ে দেখে প্রচণ্ড গরম। ব্যগ্র গলায় বলে, ‘এত জ্বর নিয়ে আপনি বাইরে গেলেন কেন?’

কল্প নাক টেনে বললো, ‘বিকেলে কমই মনে হয়েছিল। সন্ধ্যার পর থেকে বেড়ে গেছে।’

– ‘এই সিজনাল জ্বর আমার হয়ে গেছে৷ আমি জানি৷ রাতে বেড়ে যায়। আপনি দিনে জ্বর কম দেখেই বাইরে চলে যাবেন না প্লিজ। রেস্ট নিন কিছুদিন।’

– ‘ইতি তোমাকে কিন্তু নিষেধ করেছিলাম আমার রুমে আসতে।’

কল্পের হাতটা ধরে পরম মমতায় গালে চেপে ধরে ইতি। আরেক হাতে কল্পের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা যাচ্ছি।’

ইতি উঠে যাচ্ছিল। কল্প নাক টেনে বললো, ‘শোনো ইতি, আপাতত তুমি এসো না। বাট মনে রেখো৷ আমি তোমারই আছি, ওকে?’

ইতির চোখ ভিজে আসে৷ ভেজা গলায় বলে, ‘কিন্তু আসবো না কেন?’

– ‘এত কথা বলো না তো, যাও রুম থেকে। এখানে এইযে এসেছো। এসে যা করছো কেউ দেখলে কি হবে?’

ইতি চোখের পানি মুছে বলে, ‘আমি এসব ভয় পাই না। দেখলে আরও ভালো। আপনার সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দেবে।’

– ‘দুনিয়া তোমার মতো এত সরল না ইতি। বিয়ে পরিয়ে দেবে না-কি আমাকে বের করে দেবে কে জানে! যা বলছি তাই করবে। এখানে আসবে না। আর এসে ভুলেও টাচ করবে না আমাকে।’

– ‘আমাকে আপনি দুনিয়া শেখাবেন না। আমার দুনিয়া শেখার ইচ্ছা নাই। আপনি সুস্থ হয়ে একটা চাকরি জোগাড় করে বিয়ে করে নিন। আমার আর কিছু চাই না।’

– ‘ইতি রুম থেকে বের হও প্লিজ।’

– ‘এত পাগল হচ্ছেন কেন? কেউ আসছে না তো এদিকে।’

– ‘তোমার এত সাহস কেন আমি বুঝি না। কেউ এখন আসছে না, হঠাৎ ঠিকই আসবে।’

ইতি রাগে ‘হন-হন’ করে বের হয়ে যায়। পরেরদিন একবারও ইতি তার রুমে এলো না। কলেজ থেকে ফিরে একা একা ভেতরে অস্থিরতা নিয়ে দিন কাটিয়ে দিল৷ কল্পও সারাদিন বাইরে ছিল৷ সন্ধ্যায় রুমে এসে শুয়ে থাকে। ইতি মাঝরাতে চুপিচুপি কল্পের রুমের দিকে যায়৷ প্রচণ্ড ভয় লাগে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। দিনে সে যতবার যায় এর পেছনে যুক্তি থাকে, কারণ থাকে। তাই এত ভয় হয় না৷ রাতে ভয় লাগছে। কেউ দেখলেই সর্বনাশ। গলা শুকিয়ে আসে ইতির। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভেতরে গিয়ে বিছানায় বসে৷ তারপর ইতস্তত করে আলগোছে কাঁপা কাঁপা হাতটা কল্পের কপালে রাখে। গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। ইতির ভীষণ কষ্ট হয়। তবুও তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে নিঃশব্দে নিজের বিছানায় ফিরে আসে। এরকম বেশ কয়েকদিন চলে যায়। ইতি পুরোদিন আশেপাশে না গেলেও মাঝরাতে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে চলে আসে৷ রাতে কোনোভাবে নিজেকে সামলাতে পারে না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে। একটা মানুষ, যাকে সে মনে-প্রাণে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে বসে আছে। যাকে পরিবারের পর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। সে পাশের রুমে জ্বরে কাতরালে ইতি না গিয়ে কিভাবে থাকবে? তাই রোজ রাতেই ইতি যায়। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল। ইতি বুঝতে পারে কল্প অকূল সাগরে পড়ে গেছে৷ জ্বর নিয়ে সারাদিন ছুটাছুটি করে। রাতে জ্বর বেড়ে যায়। ইতি কল্পের কথামতোই আশেপাশে যায় না৷ রাতে সকলের অগোচরে গিয়ে ছুঁয়ে আসে প্রিয় মানুষটিকে৷ বিপত্তি সৃষ্টি হয়ে কয়েকদিন পর। অন্যদিনের তুলনায় কল্পের জ্বর বেড়েছে। সে গিয়েই কপালে হাত দিতেই কল্প ধরে ফেলে হাতটা। ইতির ভয়ে বুক কাঁপলেও মানুষটাকে ফেলে চলে আসতে পারে না। কল্প এক সময় কোলে মাথা রাখে। ইতির পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে যায়। মনে হয় কল্প যেন কোনোদিন তাকে স্পর্শ করেনি। কোনোদিন এভাবে হাত ধরেনি৷ অথচ আজ মানুষটা কোলে মাথা রেখেছে। ইতির চোখ ভিজে যায়। পরম মমতায় চুলে আঙুল ডুবিয়ে দেয়। তখনই আচমকা রুমের বাতি জ্বলে যায়। মুজিব উদ্দিন বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছেন। ইতি পলকেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here